সময় যতই এগোচ্ছে, দেশজুড়ে বেড়ে চলেছে হিন্দি আগ্রাসন। বাংলাতেও ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে তার থাবা। কলকাতাতেই বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে সংখ্যালঘুতে দাঁড়িয়েছে। হিন্দির আগ্রাসনে এবং অন্য ভাষাভাষীদের প্রভাবে কলকাতায় বাংলা ভাষার প্রচলন হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। যা নিঃসন্দেহে চিন্তার কারণ। ট্রেনে, বাসে, রিকশায়, ট্যাক্সিতে, হাটেবাজারে, রাস্তায়-ফুটপাতে, শপিংমলে, হোটেলে যেখানেই কথা বলার প্রয়োজন হবে, কথা বলতে হয় ইংরেজি বা হিন্দিতে, বাংলায় নয়। কলকাতার বাঙালিরা পর্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন ধীরে ধীরে। পুরাতন কলকাতার বাসিন্দাদের সিংহভাগ বাঙালি হওয়ায় সেখানে বাংলা ভাষার একচেটিয়া প্রচলন ছিল একসময়। এছাড়া সেন্ট্রাল কলকাতা-সহ পুরো কলকাতায় বাংলায় কথা বলার সুযোগ ক্রমাগত কমেছে অনেকটাই।
উল্লেখ্য, কলকাতাকে এখন বাংলা ভাষা সংস্কৃতির একমাত্র শহর বলার উপায় নেই। বহু ভাষাভাষী, বর্ণ, সম্প্রদায় ও জাতির শহর কলকাতা। ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের আবাস হওয়ায় সেখানে গড়ে উঠেছে মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি ভাষাভাষীদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। সেখানে নিজ নিজ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় তারা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অথচ বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। বিশাল ভারতে স্বীকৃত ভাষা প্রায় সাতাশটি। এছাড়া রয়েছে অস্বীকৃত প্রচুর আঞ্চলিক ভাষাও। সরকারি ভাষা হিন্দি হলেও সরকারি ভাষার অবাধ প্রচলন কিন্তু সব প্রদেশে নেই। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তো নয়ই। কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ু দক্ষিণের এ চার রাজ্যে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির প্রবেশের সুযোগ-উপায় কোনোটি নেই। ওই চার রাজ্যের মালায়ালম, কানাড়া, তেলুগু এবং তামিল ভাষার একমাত্র বিকল্প ভাষাটি হচ্ছে ইংরেজি, রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দি নয়। নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি দক্ষিণের চার রাজ্যের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাবোধ-ভালোবাসা অভূতপূর্ব এবং শিক্ষণীয়।
এপ্রসঙ্গে বলা যায়, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত একদিন স্বাধীন হবে। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? শান্তিনিকেতনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোতে প্রাদেশিক ভাষার প্রচলন যেমন আছে ঠিক তেমনি থাকবে। তবে রাষ্ট্রভাষা হতে হবে ইংরেজি।” তিনি যে কত দূরদর্শী এবং অগ্রবর্তী চেতনাসমৃদ্ধ ছিলেন তার এই মন্তব্যটি বর্তমান বাস্তবতায় এক অনন্য নজির। বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা-বৈচিত্র এখন হুমকির কবলে। এর থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেক জাতিকে তার ভাষা-সংস্কৃতির রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। ভাষা বৈচিত্র্যের পৃথিবীতে বৈচিত্র থাকাটা আবশ্যক এবং জরুরিও। সব জাতিসত্তার ভাষা-সংস্কৃতি টিকে না থাকলে পৃথিবী বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। যা একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়।