“কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে”। কিন্তু যেই স্বর্ণযুগ বাঙালির অহংকার, শ্লাঘা আর সম্ভ্রমের; যে যুগ বাঙালিকে সর্বভারতীয় করে তোলে লহমায়; তা আর রইল কই! মঙ্গল সন্ধ্যায় সেই যুগের শেষতম প্রতিনিধিও যাত্রা করলেন অনন্তের পথে। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ বাঙালির কাছে আদতেই বড় ক্ষতি। একটা গোটা যুগের চিহ্নই যেন মুছে গেল তাঁর সঙ্গে। কারণ উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-সন্ধ্যা মিলে বাংলার এমন এক যুগক্ষণ চিহ্নিত হয়, যার তুলনা আর কোথাও খোঁজে না বাঙালি।
গোটা জীবন সুরের সাধনাই করেছেন সন্ধ্যা। পারিবারিক সূত্রেই সংগীত এসেছিল তাঁর কাছে। অল্পবয়সে সংগীতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সসম্মানে। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের সাক্ষাৎ শিষ্যা তিনি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর দখল তুলনারহিত। সেই তিনিই যখন সুচিত্রা সেন নামক মহাকাব্যটিকে কণ্ঠের মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলছেন, তখন তিনি একেবারে অন্য মানুষ। তিনিই আবার গাইছেন আধুনিক গান থেকে নজরুলগীতি। বাঙালির অনুরোধের আসর তাঁকে ছাড়া কবে আর সম্পূর্ণ হয়েছে! এই বৈচিত্র ধারণ করা সহজ তো নয়ই, বরং দুরূহ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তা পেরেছেন অনায়াসে।
বাংলা গানের গায়নরীতির যে আধুনিকতা, তার একদিকের কাণ্ডারি যদি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে হন, তবে অন্যদিকে অমোঘ উপস্থিতি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। নায়িকা চরিত্র রূপায়ণে তখন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে ফেলেছেন সুচিত্রা সেন। পূর্বসূরিদের থেকে অনেকটাই আলাদা তিনি। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন বাঙালি পৌঁছে যায় এক স্বপ্নের জগতে। আর বাঙালির সেই সমবেত স্বপ্নকেই কণ্ঠে ধারণ করছেন সন্ধ্যা, রূপদান করেছেন এক অন্য পৃথিবীর। এবার তাঁর প্রয়াণে স্মৃতির স্বর্ণযুগ হয়তো এখন চিরতরে বন্ধই হল বাঙালির জন্য।