দু’বছর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা। এই ছিল তাঁদের ‘অপরাধ’। এখন তার ‘প্রতিশোধ’ নিয়ে চলেছে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার! হ্যাঁ, প্রথমে হয়েছে ধর-পাকড়। দাঙ্গা, সরকারি কাজে বাধা, সরকার ফেলার ষড়যন্ত্র, বেআইনি জমায়েত এবং সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের মতো অভিযোগে একের পর এক মামলা দিয়ে জেলে ভরে হেনস্থা করা হয়েছে গরিব মানুষগুলোকে। জেল থেকে জামিনে বেরিয়েও রেহাই নেই। সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির বিভিন্ন একতরফা হিসেব দিয়ে পুলিশ এবার সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে সেই সব পরিবারকে।
প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে বেনজির বিক্ষোভ ও প্রতিবাদকে উপেক্ষা করেজ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন’ (সিএএ) পাশ করিয়ে নিয়েছিল মোদী সরকার। যদিও তার পরেও তা কার্যকর হয়নি এখনও। কবে করবে তার কোনও দিনক্ষণও বলতে পারছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের নানা শহরে ও মহল্লায় যে সব সাধারণ মানুষ পরিবার নিয়ে দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্কে এই আইনের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছিলেন, দু’বছর ধরে তাঁদের সইতে হচ্ছে প্রশাসনের নির্যাতন। এমনিতেই অন্য সব রাজ্যের তুলনায় উত্তরপ্রদেশে বিক্ষোভকারীদের প্রতি নির্দয় আচরণ করেছে পুলিশ।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে যথেচ্ছ লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ব্যবহৃত হয়েছে, যার ফলে রাজ্যে পুলিশের হাতে মারা গিয়েছিলেন ২২ জন। আন্দোলনকারীদের ধরে গুরুতর অভিযোগে একের পর এক মামলা দিয়ে হেনস্থাও করা হয়েছে। এর পরে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামে চলছে আর এক দফা নির্যাতন। অভিযোগ, সম্পত্তি ভাঙার ঘটনায় অভিযুক্ত জড়িত ছিলেন— এমন কোনও প্রমাণ দেখাতে রাজি নয় পুলিশ। এমনকি এ জন্য কোনও আইনও হাতে নেই তাদের। হাইকোর্টে একটি মামলায় বিচারপতির নির্দেশকে সর্বজনীন হিসেবে দাবি করে তারা ভোটের মুখে ক্ষতিপূরণ আদায়ের অভিযান শুরু করেছে। সেই নির্দেশও সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
উত্তরপ্রদেশের ১০টি জেলায় সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের হাতে ক্ষয়ক্ষতির ৩.৩৫ কোটি টাকার হিসেব তৈরি করে তা আদায়ের জন্য ৫০০-রও বেশি নোটিস জারি করেছে প্রশাসন। পুলিশ গিয়ে পরিবারগুলির হাতে নোটিস ধরিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়ে এসেছে— নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে নির্ধারিত পরিমাণ টাকার অঙ্ক জমা দিয়ে আসতে হবে। লখনউয়ের হজরতগঞ্জে সব চেয়ে বড় অবস্থানটি তোলার জন্য ২০১৯-এর ১৯ ডিসেম্বর পুলিশ লাঠি ও জলকামান চালায়। পুলিশের হিসেবে, সে দিন আন্দোলনকারীরা ৬৪ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি করেছিলেন। সে দিন ধরা পড়ে জামিনে মুক্ত ৪৬ জনের কাছে নোটিস দিয়ে ওই টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে থানায় এসে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন লখনউয়ের অতিরিক্ত জেলাশাসক।
কয়েকটি পরিবারের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে ওই ভাঙচুরে জড়িত, তার প্রমাণ চেয়েছিলেন তাঁরা। ভিডিয়ো এবং সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া কিছু অতি-ঝাপসা ছবি তাঁদের দেখিয়ে পুলিশ দাবি করেছে— এটাই ওঁরা। একই ঝাপসা ছবি প্রমাণ হিসেবে একাধিক জনকেও দেখানো হয়েছে। আইনজীবীদের দাবি— কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনের অবকাশ নেই, জবাবদিহির সুযোগ নেই, পুলিশ যা বলছে তা করতে হবে, এটা বোধ হয় একমাত্র যোগী-রাজ্যেই সম্ভব। কানপুরে এমন একটি ঘটনায় ইতিমধ্যেই ২১ জনের কাছ থেকে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ তুলেছে পুলিশ। প্রত্যেককে দিতে হয়েছে ১৩ হাজার ৪৭৬ টাকা করে। এই ২১ জনের মধ্যে কেউ রিকশাচালক তো কেউ আবার দুধ বিক্রেতা। এঁদের আইনজীবীদের কথায়, তাঁদের মক্কেলরা সকলেই হদ্দগরিব। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। অনেকেই ধার করে টাকা জোগাড় করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন।