১২ই জানুয়ারি। আজ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা, জগৎসভায় ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ভারতের পরিচয় ঘটানো বিস্ময়পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবস। যা প্রায় সর্বজনবিদিত। উল্লেখ্য, নরেন্দ্র নামের (স্বামীজির ডাকনাম) এক প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও প্রশ্রয়ে কয়েক বছরে সেই জন্মতিথি পালনের আড়ম্বর লক্ষ্যণীয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, একই দিনে দেশবাসীর মনে বুনে শহীদ হওয়া মহাবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের হত্যার স্মৃতি অনেকটাই ফিকে। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতিপয় সচেতন নাগরিকের সূর্য সেন স্মরণ তরুণ প্রজন্মকে আশা জাগাচ্ছে। মাস্টারদার সঙ্গে একই দিনে ‘ফাঁসি’ হয় আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী তারকেশ্বর দস্তিদারের। ইতিহাস বলছে, ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘ফাঁসি’ হয়। অবশ্য দেশমাতৃকার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে পারেননি তিনি। কারণ, ফাঁসির আগেই বিপ্লবী সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালায় ব্রিটিশ পুলিশ। নৃশংসভাবে পিটিয়ে হাতুড়ি দিয়ে সূর্য সেনের দাঁতগুলি ভাঙে, নখগুলি থেঁতো করে উপড়ে ফেলে, গোটা শরীরের সমস্ত হাড়পাঁজর টুকরো টুকরো করা হয়। অত্যাচারের চোটে চৈতন্য হারান সূর্য সেন। সেই অবস্থাতেই তাঁকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়। এমনকী সরকারিভাবে মৃত্যুঘোষণার পরে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে সৎকারের ব্যবস্থাও করা হয়নি। জেলখানা থেকে ট্রাকে তুলে দ্রুত দুই বিপ্লবীর দেহ নিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে। তার পর ব্রিটিশ ক্রুজার ‘দ্য রিনাউন’য়ে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে কোনও জায়গায়। সেখানে লোহার টুকরো বেঁধে দেহ দু’টি ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
বিপ্লবী সূর্য সেনের আসল নাম সূর্যকুমার সেন। ডাকনাম কালু। জন্মেছেন ২২ মার্চ, ১৮৯৪। তদানীন্তন চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় বাস ছিল তাঁদের। মা শশীবালা সেন এবং বাবা রাজমণি সেন। দুই পুত্র ও চার কন্যা রেখে তাঁদের অকালপ্রয়াণের পর কাকা গৌরমণি সেনের কাছে বড় হন সূর্য সেন। পড়াশোনা দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, নন্দনকাননের ন্যাশনাল হাইস্কুল হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ। কিন্তু তৃতীয়বর্ষের কোনও এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলে পড়তে আসেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে সেই ন্যাশনাল হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) সময় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে দেওয়ানবাজারে অধুনালুপ্ত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় থেকেই বিপ্লবীদলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গভীরতর হয় এবং হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের ‘মাস্টারদা’। সেই থেকে ১৯৩৩-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত পদে পদে কীভাবে ইংরেজ শাসককে তিনি পর্যুদস্ত করেছেন, সে বৃত্তান্ত আছে ইতিহাসের পাতায়।
উল্লেখ্য, বিশ্বাসঘাতক বললেই মিরজাফর শব্দটি ব্যবহারের চল রয়েছে বাংলায়। বিপ্লবী সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব যার, তার নাম নেত্র সেন। সূর্য সেনকে তখন যেনতেনপ্রকারেণ ধরার জন্য হন্যে ব্রিটিশবাহিনী। প্রথমে ৫০০০ টাকা এবং পরবর্তীতে ১০,০০০ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে। কাগজে তা নিয়ে বিজ্ঞাপনও দিয়েছে। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন। সেদিন কয়েকজন বিপ্লবীর গোপন বৈঠক চলছে। বৈঠকে থাকা ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেনের গোপন খবরের সূত্রে ব্রিটিশবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। অন্ধকারে রাতভর গুলিবিনিময়ের মধ্যে কয়েকজন বিপ্লবী গা-ঢাকা দিতে সমর্থ হলেও ধরা পড়েন সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন। তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের স্বহস্তে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার ওপরে লেখা ছিল ‘বিজয়া’। বিচারকালে সেই বিজয়ায় লিখিত বক্তব্যই রাজদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে আদালতে তুলে ধরেছে ব্রিটিশ শাসকেরা। তাঁকে শেষ করেও দেশজোড়া বিদ্রোহের আগুন নেভাতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। স্বাধীনতার পর মহাসাগরের অতলে বসে সম্ভবত তৃপ্তির হাসি হেসেছেন মহাবিপ্লবী সূর্য সেন। আজ, তাঁর প্রয়াণ দিবসে স্মৃতিচারণের আলোয় তাই এই সামান্য ফিরে দেখা।