আন্দোলনের চাপে সরকার আইন প্রত্যাহার করছে। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা শুধু বিরল নয়, বলা ভাল বেনজির। তাই প্রশ্ন উঠছে, যাঁকে বিরোধীরা বারবার ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দেয়, যাঁর বিরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু, দলিত, সব শ্রেণির মানুষের কন্ঠরোধ করার অভিযোগ ওঠে, সেই নরেন্দ্র মোদী আচমকাই কেন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করল? সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মোট ৫টি বিষয় উঠে আসছে।
প্রথমত, কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রথম এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ অবশ্যই আসন্ন পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা। কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে দিল্লীর উপকণ্ঠে অবস্থানকারী কৃষকদের বড় অংশই পাঞ্জাব এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে শিখ এবং জাঠ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক। আগামী বছরের গোড়াতেই ওই পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট। আইন প্রত্যাহার না করলে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে রীতিমতো ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা ছিল বিজেপির। আবার, পাঞ্জাবে এমনিতেই দুর্বল গেরুয়া শিবির। কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে তার ফলাফল যে ভাল হবে না, সেটা সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনেই টের পেয়েছে বিজেপি। সম্ভবত সেকারণেই উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবের ভোটের আগে ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার।
দ্বিতীয়ত, এর পিছনে ভাবমূর্তি বাঁচানোর উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। মোদী সরকার যখন সাড়ম্বরে স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপন করছে, তখন রাজধানীর উপকন্ঠে এভাবে দেশের অন্নদাতাদের বিক্ষোভ মোটেই সরকারের জন্য ভাল বিজ্ঞাপন নয়। লাগাতার বিক্ষোভ, একের পর এক কৃষকের মৃত্যু মোদীর ভাবমূর্তিতে ভাল রকমেই ধাক্কা দিচ্ছিল। হাজার চেষ্টা করেও কৃষকদের দিয়ে বিক্ষোভ প্রত্যাহার করানো সম্ভব হয়নি। কৃষকরা মোটামুটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, আইন প্রত্যাহার না করলে তাঁরা সরবেন না। তাই ভাবমূর্তি ফেরাতে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে একপ্রকার বাধ্যই হল সরকার।
তৃতীয়ত, মোদীর এই পদক্ষেপ তাঁর গা থেকে ফ্যাসিস্ট তকমা সরানোর চেষ্টাও হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার ফ্যাসিস্ট, বিরোধী স্বরকে গুরুত্ব দেয় না, মোদী একরোখা, একনায়ক। গত সাত বছরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এগুলিই ছিল বিরোধীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ। কিন্তু কৃষি আইন প্রত্যাহার করে মোদী এই সব অভিযোগকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। চতুর্থত, মোদী সম্ভবত এই বার্তা দিতে চাইলেন যে কর্পোরেট নয় কৃষকরাই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের একটা বড় অংশ থেকে শুরু করে প্রায় গোটা বিরোধী শিবির দাবি করে আসছিল, ৩ কৃষি আইন আনার নেপথ্যে মোদীর আসল উদ্দেশ্য ছিল নিজের কর্পোরেট বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু আইন প্রত্যাহার করে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, কৃষকরাই তাঁর কাছের।
পঞ্চম কারণ হতে পারে ছোট কৃষকদের সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা। মোদী বরাবরই বলে এসেছেন, কৃষি আইন তিনি এনেছেন দেশের ৯০ শতাংশ ছোট কৃষকদের কথা ভেবে। আজ আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে মোদী আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘কৃষকদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতিতে আমরা পূর্ণ সততার সঙ্গে কাজ করছি। ছোট কৃষকদের উন্নতির জন্য, তাঁরা আরও শক্তি পাক, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তিনটি কৃষি আইন আনা হয়েছিল। কিন্তু, এই প্রদীপের আলোর মতো সত্য আমরা কিছু কৃষককে বোঝাতে পারিনি। হয়তো আমারই চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল।’ আসলে, ছোট কৃষকদের প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, আমি আপনাদের জন্যই এটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হলাম।