বড়সড় লজ্জার মুখে পড়ল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোথায় অবস্থান, তার সূচকে অনেকগুলো ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে আর একটা সূচক তৈরি হলে সম্ভবত দেখা যেত, বিশ্বভারতী শীর্ষের কাছাকাছি। তা হল শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-পড়ুয়াদের সঙ্গে মামলার সংখ্যার সূচক। সাসপেনশন, বেতন বন্ধ, পদচ্যুতি, বরখাস্ত, বহিষ্কার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন নানান সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে, ও ন্যায় প্রার্থনা করে আদালতে গিয়েছেন ছাত্র-শিক্ষকেরা। তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সাল থেকে কলকাতা হাই কোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ পনেরোটিরও বেশি রায় বা নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি খবরে এসেছিল, ৮ই সেপ্টেম্বর এবং ১৫ই সেপ্টেম্বর বিচারপতি রাজশেখর মান্থার দু’টি নির্দেশ। তিনি বিশ্বভারতীর তিন ছাত্রছাত্রীর বহিষ্কার রদ করেন, এবং পনেরো জন শিক্ষকের সাসপেনশন পুনর্বিবেচনা করতে বলেন। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে বলা হয় শিক্ষক, কর্মী ও ছাত্রদের প্রতি সহৃদয়, সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে চলতে, এবং অকারণ সংঘাত এড়াতে। সংবাদে প্রকাশ, এর ঠিক তিন দিন পরে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে সর্বসমক্ষে সঙ্গীতভবনের শিক্ষকদের ‘চোর’ বলেন উপাচার্য। তা ঘিরে শুরু হয়েছিল বিতর্ক।
স্বাভাবিকভাবেই উঠছে প্রশ্ন। ধরা যাক, হাই কোর্টের আদেশ অনুসারে অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী ও কর্মীরা অভিযোগ ও মামলা মাথায় নিয়ে কাজে যোগ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের হারিয়ে-যাওয়া নয় মাস, অধ্যাপক-কর্মচারীদের হৃত সম্মান, বকেয়া বেতনের টাকা পুনরুদ্ধার হল না। তাতেও মিটবে কি বিশ্বভারতীর সমস্যা? হাই কোর্ট পনেরো জনের সাসপেনশন ফের বিবেচনা করার নির্দেশ দিলেও, নতুন একগুচ্ছ অধ্যাপক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী কোপের মুখে পড়বেন না তো? সাসপেনশন, পদচ্যুতি, বরখাস্তের সিদ্ধান্তের অনেকগুলিই আদালতে প্রশ্নের মুখে ভেঙে পড়েছে। বেশ কয়েকটি মামলায় বেতন পুনরায় চালু করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত, বিভিন্ন শাস্তি খারিজ কিংবা স্থগিত করেছে। প্রবীণ, ব্যয়সাধ্য আইনজীবী নিয়োগ করেও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই সব শাস্তির সিদ্ধান্ত আদালতে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তা হলে নিজের শিক্ষক-ছাত্রদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিষ্ঠান এত কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিসের ভিত্তিতে? না কি, আদালতে মামলা চালাতে গেলে যে প্রবল আর্থিক, সামাজিক, মানসিক হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয় ব্যক্তিকে, সেই চাপের মুখে শিক্ষক-ছাত্রদের ফেলাটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে? বিচারপতিদের নির্দেশ পাওয়ার পরেও ছাত্র-শিক্ষকদের আদালতে ছুটতে হচ্ছে— নির্দেশ পালিত না হওয়ার জন্য আদালত অবমাননার মামলা রুজু করতে। কেবল আবেদনকারীদের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিপুল খরচ হচ্ছে।
সম্প্রতি হাই কোর্টের নির্দেশ, ছাত্রদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতি না করার পরামর্শও দিয়েছেন বিচারপতি। এখানে দু-একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারা যে হেতু নাগরিককে সংগঠিত হওয়ার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার দিয়েছে, বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক নয় কি? তাঁদের কর্মক্ষেত্র বিশ্বভারতী। কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রতিবাদ জানানো তাঁদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে না কি? তাই আদালতের নির্দেশের প্রতি সম্মান জানিয়েও কেউ ভাবতে পারেন, আন্দোলন তুলে নেওয়ার আদেশের থেকে পরামর্শ বা অনুরোধ জানানোই বেশি সঙ্গত ছিল কি না। গণতান্ত্রিক দেশে বিক্ষোভ জানানো বা আন্দোলন করার অধিকার দস্তুর। উল্লেখ্য, বিশ্বভারতীতে দলমতনির্বিশেষে ছাত্রছাত্রীরা শক্ত হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলনে নামতেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। একে একে শিক্ষক-কর্মচারী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যুক্তমঞ্চ গঠন করে আন্দোলনে শামিল হন। কত জনের বিরুদ্ধে কত সামান্য কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সামনে আসে। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে তিন ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কার যে ‘লঘুপাপে গুরুদণ্ড’ হয়েছে, আদালতও তা মনে করছেন। কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে উপাচার্যের সংঘাতপ্রবণ, অসহিষ্ণু রূপ স্পষ্ট হয়েছে, শিক্ষক ও পড়ুয়াদের আপাতত স্বস্তি মিলেছে।
স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-আন্দোলনকে ‘অপরাধ’ হিসাবে দেখছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়-সহ নানা জায়গায় গেরুয়াবাদীরাও এই চেষ্টাই চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ চলবে না, এমনকী প্রশ্ন করলেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এক সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন উপাচার্য এই চেষ্টা শুরু করেছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের প্র…