আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন ফেরার পর থেকেই জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গী কার্যকলাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছিল। আর তাই কড়া নজরদারির ঘেরাটোপে মুড়ে ফেলা হয়েছিল ভূস্বর্গকে। এবার সেই নজরদারির সূত্র ধরেই সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার অভিযোগে বরখাস্ত করা হল জম্মু-কাশ্মীরের ছ’জন সরকারি কর্মীকে! এঁদের মধ্যে দু’জন পুলিশ কনস্টেবল। কিন্তু প্রশাসন যেখানে কাশ্মীরি যুবকদের মূলস্রোতে ফেরানোর কথা বলছে, সেখানে বিনা বিচারে এ ভাবে চাকরি কেড়ে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? স্থানীয়দের ক্ষোভের কথা তুলে ধরে প্রশ্ন তুলেছে কুলগামের প্রাক্তন বিধায়ক মহম্মদ ইউসুফ তারিগামির।
সংবিধানের ৩১১(২)(সি) ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল যদি কোনও সরকারি কর্মীকে দেশ বা রাজ্যের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করেন, তবে কোনও তদন্ত ছাড়াই তাঁকে বরখাস্ত করা যায়। চাকরি খোয়ানো কর্মী চাইলে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। এই ধারার ভিত্তিতেই গত এপ্রিল মাসে একটি কমিটি গঠন করে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। কমিটির কাজ, কাশ্মীরের সরকারি কর্মীদের পূর্বপরিচয় এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। সেই কমিটির তদন্তের ভিত্তিতেই এই ছ’জনকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত।
এঁদের মধ্যে আবদুল হামিদ ওয়ানি ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কমিটির অভিযোগ, সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন ‘আল্লাহ টাইগার্স’-এর জেলা কম্যান্ডার ছিলেন ওয়ানি। তাঁর নিয়োগও নিয়ম মেনে হয়নি। জঙ্গী সংগঠন জামাত-ই-ইসলামির প্রভাব খাটিয়ে চাকরিটা জোগাড় করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় শিক্ষক লিয়াকত আলি কাকরু বারামুলার বাসিন্দা। ‘স্থানীয় জঙ্গী’ তালিকায় নাম থাকায় ২০০১ সালে গ্রেফতার হন তিনি। তাঁর কাছ থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার হওয়ায় দু’বছর জেল হয়েছিল।
তৃতীয় জন পুলিশ কনস্টেবল জাফর হুসেন বাট। বন্দুক চোরাচালানের অভিযোগে এনআইএ-র চার্জশিটে নাম ছিল কিশতওয়ারের এই যুবকের। তিনি হিজবুল জঙ্গীদের গাড়ি জুগিয়ে সাহায্য করতেন বলে অভিযোগ। চতুর্থ জন পুলিশ কনস্টেবল শৌকত আহমেদ খান। বদগামের এই যুবক বিধায়কের বাড়ি থেকে অস্ত্র লুঠে অভিযুক্ত। জন নিরাপত্তা আইনে ২০১৯ সালে একবার আটকও হয়েছিলেন। পঞ্চম মহম্মদ রফি বাট সড়ক ও আবাসন দফতরের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয় জোগানোর অভিযোগে একবার গ্রেফতার হওয়া বাট এখন জামিনে মুক্ত।
শেষ ব্যক্তি তারিক মেহমুদ কোহলি। পুঞ্চের এই বাসিন্দা বনদফগরের রেঞ্জ অফিসার ছিলেন। বেআইনি অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক এবং পাকিস্তান থেকে জালনোট চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সরকারি নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘এঁরা ছ’জনই জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক, সে ব্যাপারে উপরাজ্যপাল নিশ্চিত। তাই কোনও তদন্ত ছাড়াই এঁদের অবিলম্বে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে।’ তবে এই প্রথম নয়, গত জুলাইয়ে হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান সইদ সালাহউদ্দিনের দুই ছেলেকে পুলিশ কনস্টেবলের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত হন আরও ৯ সরকারি কর্মী। গত মে মাসেও বরখাস্ত হয়েছিলেন তিন জন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যেখানে জম্মু-কাশ্মীরের স্থানীয় যুবকদের জঙ্গী কার্যকলাপ থেকে মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য কর্মসংস্থান গঠনে জোর দিচ্ছে সরকার। সেখানে কর্মীদের পূর্বপরিচয়ের যুক্তিতে চাকরি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কেন? এই ‘দ্বিচারিতা’য় ক্ষুব্ধ সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ ইউসুফ তারিগামির প্রশ্ন, ‘অভিযুক্তদের বিনা বিচারে দোষী বলে ঘোষণা করা হচ্ছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না। ‘দোষী’র পরিবারের সদস্যদেরও ‘একই দোষে দোষী’ বলে চিহ্নিত করে রাতবিরেতে থানায় ডাকা হচ্ছে, সরকারি চাকরি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে তো সরকারি কর্মীদের মনোবল তলানিতে ঠেকবে! এটাই কি গণতন্ত্র?’