আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পরই ফের কুড়ি বছর পর আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তালিবান। রাস্তা-ঘাট, বাজার-দোকান থেকে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ— এখন সর্বত্র বন্দুক হাতে সামনে তারা। কিন্তু পিছন থেকে অনেকাংশেই কলকাঠি নাড়ছে পাকিস্তান। এই দ্রুত পট পরিবর্তনের পরে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় এক ঝটকায় অনেকখানি শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে ইসলামাবাদের হাত। কূটনৈতিক শিবিরের মতে, পাক সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সরাসরি মদতপ্রাপ্ত পাক-তালিবান গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ পোক্ত হয়ে উঠবে আফগানিস্তানে।
ইসলামাবাদের এই সম্ভাব্য বাড়বাড়ন্তে স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন দিল্লী। সূত্রের বক্তব্য, তালিবানদের অস্ত্রঝঙ্কারের পিছনে যে প্রধান ইন্ধন, সেই ইসলামাবাদের গুরুত্ব বৃদ্ধিই প্রধান উদ্বেগ নয়াদিল্লীর। নিরাপত্তা বিষয়ক কর্তা ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তালিবান নেতৃত্ব যে কাঠামোতেই আফগানিস্তানে সরকার গড়ুক বা দেশের নাম বদলে দিক, পাকিস্তানের ওপরে তাদের নির্ভরতা অদূর ভবিষ্যতে বাড়বেই। আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়ার জন্য ইসলামাবাদকে কাজে লাগানো ইতিমধ্যে শুরুও করে দিয়েছে তারা।
বাণিজ্য (বিশেষত জরুরি পণ্য আমদানি), পণ্য চলাচল সমেত বিভিন্ন কাজে উন্মুক্ত পাক সীমান্ত ও ওই প্রতিবেশী দেশের বন্দর শহরগুলি তাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি। তালিবান জানে, তারা ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক শক্তি প্রয়োগে। কিন্তু তারা কূটনীতিতে অচ্ছুত। তাই তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রতি পদে দরকার হবে পাকিস্তানের মতো একটি দেশকে। ভৌগোলিক অবস্থানের প্রশ্নে যার গুরুত্ব আফগানিস্তানের কাছে সব থেকে বেশি। যারা বন্ধুভাবাপন্ন অথচ যেখানে এখনও ভোটে জিতে আসা সরকার রয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা চীনের সঙ্গে যে দেশের সম্পর্ক মধুর।
অন্যদিকে, ইসলামাবাদ তালিবানের সঙ্গে কী চুক্তি করবে, তা এখনও স্পষ্ট না হলেও, বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তারা অতি সক্রিয়। এর নিদর্শন ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ‘শৃঙ্খলমুক্তির’ তত্ত্ব সামনে এনে তালিবান কর্তৃত্বকে দ্রুত রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। কারণ তাতে তাদের বহুমুখী লাভ। প্রথমত, আফগানিস্তানে প্রবল নৈরাজ্যের মধ্যে পাক-তালিবান গোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে পোক্ত করা যাবে। নিজেদের ঘরোয়া সন্ত্রাস দমনে (ফাটা এলাকা) যা কার্যকরী। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের উপরে সন্ত্রাসের চাপ বাড়ানোর কাজও অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।
আবার চীন ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে তালিবানের কাছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের মতে, চীন-তালিবান সেতুবন্ধনের কাজটি করছে পাকিস্তান। এর পরে নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও তালিবান সহযোগিতা দাবি করবে ধরে নিয়ে রাশিয়াও ওই যুদ্ধবাজদের সঙ্গে কাজ করতে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপূঞ্জের নিরাপত্তা পরিষেদর পাঁচ স্থায়ী সদস্যের (পি-৫) মধ্যে দুই দেশ (চিন ও রাশিয়া) ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে মাঝে রেখে তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা ভারতের।
রাষ্ট্রপূঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে চলতি মাসে ভারতই সভাপতিত্ব করছে। গতকাল রাতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে কাবুল পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছেন ভারতের প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি। কিন্তু ভারত জানে যে, পি-৫ গোষ্ঠীর দু’টি দেশ যদি তালিবানের পাশে দাঁড়িয়ে যায়, তা হলে তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসা সময়ের অপেক্ষা। সেই সূত্রে পাকিস্তানের হাত আরও শক্ত হওয়াও তা-ই।
আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করার পরে যে আফগান-প্রশ্নে ফের পাকিস্তানের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে না, সে কথা হলফ করে বলতে পারছে না ভারত। কারণ ঘরোয়া রাজনৈতিক কারণে ওয়াশিংটন এখন অন্তত এটুকু নিশ্চিত করতে চাইবে যে, তালিবানি সন্ত্রাসের ঢেউ যেন কোনও ভাবে আমেরিকার বুকে আছড়ে না পড়ে। আর এই আশ্বাসের বিনিময়ে চড়া দাম নেবে ইসলামাবাদ। যা তারা আমেরিকার কাছ থেকে ধারাবাহিক ভাবে নিয়ে এসেছে গত দেড় দশক। তা সে ইসলামাবাদের উপর থেকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ওঠানোই হোক বা এফএটিএফের নজরদারি থেকে মুক্তি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, পাকিস্তানের তালিবান-তাসের মোকাবিলায় ভারত কী ভাবে এগোবে, সেই কৌশল তৈরিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।