একুশের ভোটে ভরাডুবির পর থেকেই একদিকে যেমন বঙ্গ বিজেপির অন্দরে শুরু হয়ে গিয়েছে দোষারোপের পালা। বারবার সামনে চলে আসছে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নেতাদের মধ্যে কলহ। তেমনি অন্যদিকে, দলে অব্যাহত ভাঙন। সবমিলিয়ে রাজ্যে ক্রমশই আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে গেরুয়া শিবিরের সংগঠন।
প্রসঙ্গত, এর আগে বাংলায় বিজেপির জেলাওয়াড়ি সংগঠনও ছিল না। তবে একুশে বিজেপি বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে এবং বিধানসভায় ৩ থেকে ৭৭টি আসন লাভ করেছে। এখনও বিজেপির যে সাংগঠনিক শক্তি, তা তৃণমূলের তুলনায় তো বটেই, এমনকী কংগ্রেস-সিপিএম এর তুলনাতেও বহু জায়গায় দুর্বল। শুধু তাই নয়, এতো দুর্বল সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তাদের দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও খুব প্রবল। তার অন্যতম কারণ হল, বিজেপির কর্মীরা, যাঁরা আরএসএস থেকে বা বিজেপির মতাদর্শ থেকে আসা পুরনো লোকজন, তাঁদের যেরকম একটা গোষ্ঠী, আবার শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে তৃণমূল থেকে আসা কর্মী এবং নেতাদের একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। মূলত এই দুটো গোষ্ঠীর লড়াই খুব তীব্র হয়ে উঠেছে।
একদিকে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, আর অন্যদিকে শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু অধিকারী এসেছেন তৃণমূল থেকে, বিজেপিতে যাকে বলা হয়, ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’। এখন এই ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’ হওয়ার মধ্যে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তৃণমূল থেকে আসা বিজেপির সমস্ত কর্মীরাই যে খুশি, এমন নয়। নিশীথ প্রামাণিক কিংবা সুভাষ সরকার, তাঁরা মন্ত্রী হতে পারেন। তাঁরা নিশীথ প্রামাণিক এবং শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করেই চলছেন, যদিও তিনি সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ-রও প্রিয় পাত্র। আবার অন্যদিকে শান্তনু ঠাকুর, তিনি জাহাজ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়ে শুভেন্দু অধিকারীর নেক নজরেই আছেন।
কিন্তু দিলীপ ঘোষ, যিনি এই দলে দুর্দিনে ছিলেন, যিনি আরএসএস এর বাঙালি মুখ এবং যে দিলীপ ঘোষ প্রচুর পরিশ্রম করে দলকে অনেকটা অগ্রসর করতে সাহায্য করেছেন, তাঁকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে এখনও সরানো হয়নি। এখনও শোনা যাচ্ছে যে, আগামী দিনে হয়তো তাঁকে সরিয়েও দেওয়া হবে। যদিও আরএসএস এর নেতারা কিন্তু দিলীপ ঘোষকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে নন। এবার যেভাবে মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়েছে এবং বাঙালি মন্ত্রীরা ঠাঁই পেয়েছেন, সেখানে দিলীপ ঘোষকে তো মন্ত্রিসভায় আনাই হয়নি, উপরন্তু মন্ত্রিসভায় কারা আসবেন এবং কারা আসবেন না, সে ব্যাপারেও দিলীপ ঘোষের মতামত পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি হিংসাত্মকভাবে কথাবার্তা বলেন এবং যে ধরনের বিবৃতি দিয়ে থাকেন, তাতে তাঁকে সরানোটাই উচিত কাজ হবে। দিলীপ ঘোষ আজ নয়, বহুদিন থেকেই এ ধরনের কথাবার্তা বলেন। একবার মোহন ভাগবত এ ব্যাপারে দিলীপের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, যেখানে বিজেপির জেলাওয়াড়ি সংগঠন নেই অথচ যাঁরা আছেন, তাঁরা মার খাচ্ছেন, সে অবস্থায় যদি তাঁদেরকে উৎসাহিত করতে হয়, কর্মীদেরকে বিজেপির শিবিরে নিয়ে আসতে হয়, তাহলে একটু ‘গরম গরম’ কথা বলা দরকার। এই ধরনের কথা বললে একটা ভোকাল টনিক হয়, যাতে কর্মীদের তৃণমূল থেকে বিজেপিতে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।
এই একই যুক্তি দিলীপবাবু অমিত শাহকেও বলেছিলেন। সেই ভোকাল টনিকে অনেক কর্মীরা এসেছেন— এটাও যেমন সত্য, আবার তৃণমূল থেকেও শুভেন্দু অধিকারী এসে, যেভাবেই হোক নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০০ ভোটে হলেও পরাস্ত করেছেন। এবং কিছুটা সেই কারণেই তিনি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হয়েছেন। কিন্তু শুভেন্দুকে এরপর রাজ্য সভাপতির পদ দিলে ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোস্ট’ এর ব্যাপার চলে আসবে। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চান, এমন কাউকে রাজ্য সভাপতি করা হোক, যিনি শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী হবেন। প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি তথাগত রায়ের বক্তব্যের পাল্লাও ভারী শুভেন্দুর দিকে। কারণ, তিনি শুভেন্দুর প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে, দিলীপ ঘোষকে অপসারণের রাস্তা আরও সুগম করতে ইচ্ছুক।
শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থন নিয়ে তথাগত রায় রাজ্যের সভাপতি হতেও আগ্রহী। সুতরাং, দিলীপ ঘোষের জায়গায় যদি তথাগত রায়কে রাজ্য সভাপতি করা হয়, তাহলে এ ব্যাপারে শুভেন্দু অধিকারীর কী প্রতিক্রিয়া হবে— সেটাও কিন্তু দেখার। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই মুহূর্তে বিজেপি হাইকমান্ডের প্রতিনিধি হলেন শুভেন্দু অধিকারী। মোদী এবং অমিত শাহ তাঁকে বেছে নিয়েছেন এবং তাঁকে সামনে রেখেই আগামী পাঁচ বছর তাঁরা লড়াইটা চালিয়ে যাবেন। দিলীপ ঘোষ যদিও এখনও লোকসভার সদস্য আছেন কিন্তু তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। ডিসেম্বর মাসে দিলীপ ঘোষেরও মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তখন তাঁকে সরালে, আগামী দিনে দিলীপ ঘোষের কী ভবিষ্যত হবে, সেটাও খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে দিলীপ শিবির যে ছেড়ে কথা বলবে না, তা বলাই বাহুল্য।