বাংলা থেকে বাংলাদেশে গোরু পাচারের ইস্যু নিয়ে জিগির তুলে গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে রাজনীতির বাজার গরম করতে আসরে নেমেছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ প্রত্যেকেই বাংলাকে গোরু পাচারের খাসতালুক বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁদের নিশানায় ছিল শাসকদল তৃণমূল। তবে গেরুয়াশিবিরের এহেন আস্ফালন সত্ত্বেও গোরু পাচার সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যান কিন্তু অন্য কথা বলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে পাচার হওয়া প্রতি ১০টি গোরুর মধ্যে আটটিই সীমান্ত পার করছে গেরুয়া শিবির ও তার শরিকদের দখলে থাকা অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিজোরাম থেকে।
উল্লেখ্য, এর মধ্যে পদ্মশিবিরের সবচেয়ে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অসম। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার আগামী বিধানসভা অধিবেশনে গোরক্ষা বিল আনছে। গোয়েন্দা দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন ধুবড়ির মানেকচর, বীরসিংচর, কোকরাঝাড়, শিলচর, করিমপুর হয়ে ১০০০-১২০০ কোটি টাকার গোরু পাচার হচ্ছে বাংলাদেশে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী কয়েকদিন আগে জানিয়েছেন, গোরু পাচারে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার কারবার হয় অসমে। বিজেপির লাগাতার অপপ্রচার, কুৎসা সত্ত্বেও বিপরীত চিত্র কিন্তু বাংলায়। গত ২০১৯ সাল থেকে পাচার ক্রমেই কমতে থাকা বাংলায়, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত একটি গোরুও দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত পার করেনি। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া এ রাজ্যের উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের নিয়ন্ত্রণাধীন জেলাগুলিতেও প্রায় একই চিত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, এপার থেকে পাচার হওয়া গোরুকে ‘আইনি’ বানানোর চেষ্টায় যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে যে সমস্ত কাস্টমস করিডোর খুলেছিল বাংলাদেশ, সেগুলির কাজকর্ম এখন লাটে উঠেছে। সূত্রের খবর, এপার থেকে পাচার হওয়া গোরুগুলি কাস্টমস করিডোরে জমা করে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশকে ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা ‘রাজস্ব’ দিয়ে, তা আইনি করা হয়। দক্ষিণবঙ্গে পাচার বন্ধ হওয়ায় সেই রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ এখন তলানিতে ঠেকেছে।
প্রসঙ্গত, বিএসএফ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণবঙ্গের দুই ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদহ ছিল গোরু পাচারের স্বর্গরাজ্য। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান সেই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারে ২০১৭ সালে ৮.৬৯ লাখ, ২০১৮ সালে ৫.২২ লাখ, ২০১৯ সালে ১.২৩ লাখ এবং গত ২০২০ সালে ৩৬২৮টি গোরু পাচারের সময় ধরা পড়ে। চলতি বছরের গত জুন মাস পর্যন্ত এই সংখ্যা মাত্র ৭২৫। উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার ধরলে সংখ্যাটি হাজারের কিছু বেশি। বিএসএফের ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স) এসএস গুলারিয়া জানিয়েছেন, গত ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই দক্ষিণবঙ্গে গোরু পাচার কমতে শুরু করেছে। এর জেরে বাংলাদেশের সব কাস্টমস করিডর বন্ধ হয়েছে। তেমনই এপারে বন্ধ হয়েছে কাস্টমসের নিলাম কেন্দ্র।
পাশাপাশি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ লাগোয়া ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে অসম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মেঘালয়ে রয়েছে মোট ১৯০০ কিমি। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ওই চার রাজ্যের সীমান্তে পাকড়াও করা হয়েছে ৯ হাজারের বেশি গোরু। এই পর্বে হাজার হাজার গোরু অসম ছাড়াও ত্রিপুরার বিলোনিয়া, সিপাইজলা, খোয়াই, কমলাসাগর, মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস, ওয়েস্ট জয়ন্তীয়া , সাউথ ওয়েস্ট গারো হিলস এবং মিজোরামের পারভা এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে অসম নিয়ে বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন হেমন্ত বিশ্বশর্মা সরকার গত ১০ দিন ধরে গোরু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বড়সড় অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু তাতেও পাচারের মাত্রা না কমায়, দুশ্চিন্তায় পদ্ম-নেতৃত্ব।