একুশের ভোটে রাজ্যে ব্যাপক ভরডুবি হয়েছে পদ্মের। আসন প্রাপ্তিতে তিন সংখ্যাও পেরতে পারেনি বিজেপি। আর তারপরেই দলের নীচুতলার নেতারা তো বটেই, মাঝারি মায়, ওপর তলার নেতারাও পা বাড়িয়েছেন শাসক শিবিরের দিকে। যাঁরা উনিশের ভোটের আগে পরে করে ঘাসফুল ছড়ে ভিড়েছিলেন পদ্মফুলে। কিন্তু দলবদলু নেতাদের আর দলে ফেরাতে চান না শাসক দলের নেতারা। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দলবদলু গদ্দারদের আর নাই দলে কোনও স্থান। তাই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে এখন শুধুই হা হুতাশ। এমনকি সেই হা হুতাশ শোনা যাচ্ছে খাস প্রাক্তন বিধায়ক সুনীল সিংয়ের গলাতেও।
প্রসঙ্গত, অর্জুন সিং লোকসভা ভোটের মুখে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জেতার পরেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে এসেছিল নির্মম অত্যাচার। অনেকেই খুন হন, তার চেয়েও বেশি নেতা কর্মী আক্রান্ত হন। অনেকেই বাধ্য হন ঘরবাড়ি ছাড়তে। ভাঙচুর হয়েছিল হাজার হাজার তৃণমূল কর্মী ও সমর্থকের বাড়ি ও দোকান। কার্যত গেরুয়া সন্ত্রাসের মোড়কে পুরো গুজরাত হয়ে গিয়েছিল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। সঙ্গে চলেছিল একের পর এক পুরসভা এলাকায় দলবদলের ঘটনা। তাতে যোগ দেন শিল্পাঞ্চলের নির্বাচিত তৃণমূল বিধায়কেরাও।
তবে সেই ছবিটা বদলাতেও শুরু করে দ্রুত। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে যে সব পুরসভা চলে গিয়েছিল বিজেপির দখলে সেখানে একে একে ফের তৃণমূলে ফিরে আসেন সেখানকার কাউন্সিলররা। পুরসভাগুলোও ফিরে আসে তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে। তার জেরেই বেশ বোঝা গিয়েছিল যে উনিশের ভোটে যে ফলই হোক না কেন এলাকায় দাপট একচেটিয়া ভাবে ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। তাই গেরুয়া শিবির বড় মুখে যাই দাবি করুক না কেন, একুশের যুদ্ধে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ৭টি আসনে যে গেরুয়া শিবিরকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বাস্তবে সেটাই হয়েছে।
তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মমতা ঝড়ে কার্যত খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে পদ্ম শিবির। ৭টি আসনের মধ্যে কেবলমাত্র ভাটপাড়ায় জয়ী হয়েছে অর্জুন পুত্র তথা বিজেপি। বাকি ৬টিতেই উড়েছে তৃণমূলের বিজয় কেতন। এই ফলাফলের পরে পরেই এবার শিল্পাঞ্চলের তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া নেতাকর্মীরা পা বাড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলে ফিরে আসতে। গেরুয়া শিবিরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে দলবদলুদের অনেকেই এখন আফশোস করছেন। অনেকে ফিরতে চেয়ে তলে তলে দলের সঙ্গে যোগাযোগও করছেন।
কিন্তু সেখানকার তৃণমূল কর্মীরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘গদ্দারদের ছাড়াই জিতেছি। ওদের মানুষ চায় না। ওদের আর ফেরানো উচিত হবে না। ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার এটাই মোক্ষম সময়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে আমাদের বিশ্বাস আছে। উনি ঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন। দলনেত্রী মানুষের ইচ্ছেকেই মর্যাদা দেবেন।’ এদিকে নোয়াপাড়ার প্রাক্তন বিধায়ক তথা অর্জুন সিংয়ের আত্মীয় সুনীল সিং বলছেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেলেও কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়নি। তবে এখনই তৃণমূলে ফেরার চিন্তা করছি না। তাছাড়া আমি ফিরতে চাইলেই তো হবে না। ওদেরও তো নেওয়ার ইচ্ছে থাকতে হবে।’
তৃণমূলের তরফে এবার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে কার্যত সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন নৈহাটির বিধায়ক তথা পুরপ্রধান পার্থ ভৌমিক। তিনি স্বীকার করেছেন যে দলবদলু নেতারা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফের ফিরতে চাইছেন। তবে এই বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে নীচুতলার কর্মীদের দাবিও মাথায় রাখা হবে। তাঁর কথায়, ‘অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন দলে ফিরতে চেয়ে। দলে এ নিয়ে এখনও কোনও কথা হয়নি। নেত্রীকে কর্মীদের আবেগের কথাও বলব। তার পরে দল যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই হবে। কিছু গদ্দার ভোটের আগে দলবদল করে দলকে বিপাকে ফেলবে ভেবেছিল। কিন্তু আমাদের কর্মীরা সকলেই জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই দিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন। সেই কর্মীদের কথাও মাথায় রাখা হবে।’