এবার বাংলার নির্বাচনী ফলাফলের পর্যালোচনা করলেন বিশিষ্ট্য অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের এই অর্থনীতিবিদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব যেমন ঘটনাবহুল ছিল, তার সমাপ্তিও হল যথেষ্ট নাটকীয় ভাবে। আসলে এ বারের নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলের নির্ধারক হিসেবে অনেকগুলো উপাদান ছিল, যাদের নিট ফল কী হবে, আগে থেকে বোঝা দুঃসাধ্য ছিল। এক দিকে ছিল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া; আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের শ্লথ গতির সঙ্গে মিশেছিল দুর্নীতি ও গা-জোয়ারির অভিযোগ। সেই সঙ্গে কন্যাশ্রী বা স্বাস্থ্যসাথীর মতো জনমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা সমর্থকভিত্তি গড়ে উঠেছে, বিশেষত নারীদের মধ্যে, সেটাও অনস্বীকার্য। বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে ঝাঁপিয়েছিল, যার প্রমাণ প্রচারে আগাগোড়া নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতি। তার দুটো কারণ। ঐতিহ্যগত ভাবে বাম-ঘেঁষা, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত ভাবে অগ্রসর বলে পরিচিত একটি রাজ্যকে যদি গেরুয়া পতাকার তলায় এনে ফেলা সম্ভব হয়, জাতীয় স্তরে তার তাৎপর্য হবে সুদূরপ্রসারী। আর ভারতের জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম ছ’টি রাজ্যের তিনটি (উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশ) বিজেপির নিয়ন্ত্রণে, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু নয় – এ দিক থেকেও জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির রাজ্যজয় উল্লেখযোগ্য হত। বিজেপির অনেক প্রার্থীই তৃণমূল ছেড়ে এসেছেন, ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়াকে যা খানিক দুর্বল করেছে। আবার ধর্মপরিচয়-ভিত্তিক ও জাতপাতের রাজনীতিরও নির্বাচনে বড় ভূমিকা ছিল এবার।
পাশাপাশি আর একটি বড় ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ। তা হল, রাজ্য রাজনীতিতে প্রথাগত ভাবে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং তার সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত আইএসএফ জোট বাঁধায় ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়। দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটারদের সিদ্ধান্ত হল, হয় নিজের পছন্দের দলকে ভোট দেওয়া, নয় পরিবর্তন চেয়ে ভোট দেওয়া। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটারদের কাজ আরও শক্ত, কারণ তাঁদের প্রাথমিক পছন্দের দলটি আর বাকি দু’টি দলের মধ্যে কোনটি বেশি অপছন্দ, এবং তাদের মধ্যে কার জেতার সম্ভাবনা বেশি এই সব ক’টা উপাদান মিশে সিদ্ধান্তগ্রহণের কাজ জটিলতর হয়ে দাঁড়ায়, আর তাই নির্বাচনী ফল অনুমান করা আরও শক্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে অতিমারির প্রকোপ বাড়তে থাকায় অনিশ্চয়তারও সৃষ্টি হয়। তাঁর মতে, তৃণমূল প্রত্যাশার বেশি ভোট (৪৮%) ও আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠা পায়, এই নির্বাচনে ৩৯% ভোট ও ৭৭টি আসন পেয়ে সেই অবস্থান তারা বজায় রেখেছে। বামজোট পেয়েছে মোট ভোটের ৯%, আসন মাত্র একটি, সেটিও পেয়েছে আইএসএফ। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার গড় করে জানিয়েছিল, তৃণমূলের প্রত্যাশিত আসন ছিল ১৩৬, বিজেপির ১৩৮ ও বামজোটের ২০। তৃণমূল প্রত্যাশার থেকে ভাল ফল করেছে, বিজেপি খারাপ; সবচেয়ে হতাশাজনক ফল বামজোটের।
মৈত্রীশ ঘটক জানান, জনমত সমীক্ষা যদি ছেড়েও দেওয়া হয়, গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের অংশ ও আসন সংখ্যা যথাক্রমে ছিল ৪৫% ও ২১১, বিজেপির ১০% ও ৩, আর এ বারের বামজোটের প্রধান দলগুলির সার্বিক ভোটের অংশ ছিল ৩৯% ও আসন ৭৬। অর্থাৎ, এই নির্বাচনে বিজেপির যত লাভ হয়েছে, বামজোটের সেই অনুপাতে লোকসান হয়েছে। এই নির্বাচনের সার্বিক ফলের পরিসংখ্যান থেকে তাই দুটো মূল তথ্য উঠে আসছে: প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের আপেক্ষিক অবস্থার উন্নতি; এবং, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বামজোটকে সরিয়ে বিজেপির উঠে আসা। স্কুল অফ ইকনমিক্সের এই অধ্যাপক মনে করেন, এই সার্বিক চিত্র থেকে এক দল থেকে অন্য দলে আসন পরিবর্তনের প্রকৃতি পুরোপুরি বোঝা যায় না। যেমন, আসন পরিবর্তনের আঞ্চলিক চিত্রটা দেখলে দেখা যাবে যে, উত্তর-মধ্য বঙ্গ এবং কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতা অঞ্চলে বামজোটের লোকসান থেকে লাভ করেছে তৃণমূল ও বিজেপি, দুই দলই। আবার রাজ্যের অন্য অঞ্চলগুলিতে বিজেপির আসনলাভ হয়েছে বামজোট ও তৃণমূল (বিশেষত উত্তরবঙ্গে) দুই পক্ষ থেকেই। তাই বামজোটের গত বারের সব ভোট এ বারে বিজেপি পেয়েছে, এমন সরলীকৃত সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে। গত বারের বামজোটের কিছু ভোট এ বারে তৃণমূলও পেয়েছে, আর তৃণমূলের কিছু ভোট গিয়েছে বিজেপির দিকে। ক্ষমতাসীন দল-বিরোধী হাওয়া অবশ্যই আংশিক ভাবে উপস্থিত ছিল, যা থেকে বিজেপি লাভবান হয়ে…