২০০-র বেশি আসন জিতে বাংলা দখলের খোয়াব দেখেছিল তারা। কিন্তু বাস্তবে তিন সংখ্যাই ছুঁতে পারেনি গেরুয়া শিবির। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে তাদের এই ভরাডুবির কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রাথমিক পর্যালোচনায় অনেক কারণই দেখছে রাজ্য বিজেপি। তার মধ্যে একটি কারণ এমনও বলা হচ্ছে যে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দল ১৮টি আসন পেলেও এবার সেই সব এলাকাতেও খারাপ ফল হয়েছে। তাই দলের সাংসদরা নিজের নিজের এলাকায় যথাযথ কাজ করেছেন কি না, সংগঠনে গুরুত্ব দিয়েছেন কি না, তা নিয়েও চুলচেরা বিচার চলছে।
প্রসঙ্গত, ভোটের ফলই বলছে গেরুয়া শিবিরকে ডুবিয়েছে হুগলি জেলা। যে সব জেলার ওপরে বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা বেশি ভরসা করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম গঙ্গাপারের এই জেলা। তিন লোকসভা আসনের হুগলিতে ১৮ আসনের মধ্যে মাত্র ৪টিতে জয় পেয়েছে বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে যদিও বিজেপি এগিয়ে ছিল ৮টি আসনে।
রবিবারের ফল বলছে, গত লোকসভায় জেতা হুগলি লোকসভা এলাকার ৭টি আসনের একটিতেও জয় পায়নি পদ্ম-বাহিনী। স্থানীয় সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় নিজে প্রার্থী ছিলেন চুঁচুড়া বিধানসভা আসনে। ২০১৯ সালের হিসেবে চুঁচুড়ায় লকেট এগিয়েছিলেন প্রায় ২১ হাজার ভোটে। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে তিনি পরাজিত প্রায় ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। এই জেলায় বিজেপি যে ৪টি আসনে জিতেছে তার সবকটিই আরামবাগ লোকসভা এলাকার।
নিজের লোকসভা এলাকায় হেরেছেন এমন নজির আর কোনও সাংসদের নেই। আর যে ৩ লোকসভার সাংসদকে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল তাঁদের মধ্যে কোচবিহারের নিশীথ প্রামাণিক এবং রানাঘাটের জগন্নাথ সরকার জিতেছেন। যদিও নিশীথের জয়ের ব্যবধান খুবই কম। দুই অঙ্কের সংখ্যা। দিনহাটায় প্রায় ১৫ হাজারের ব্যবধান ছিল নিশীথের। রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথও জিতেছেন শান্তিপুর আসনে। কিন্তু গোটা জেলায় বিজেপি যেমনটা আশা করেছিল তার তুলনায় অনেক খারাপ ফল। ১৭-র মধ্যে ৯ আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি।
আরও এক সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কেও প্রার্থী করেছিল বিজেপি। তিনি অবশ্য নিজের লোকসভা আসন আসানসোল থেকে অনেক দূরের টালিগঞ্জে প্রার্থী হন। হেরেছেন ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে। কিন্তু তাঁর লোকসভা এলাকার ৭টি বিধানসভার ফল স্বস্তি দিচ্ছে না আসানসোলের সাংসদ বাবুলকে। পশ্চিম বর্ধমানের মোট ৯টি আসনের মধ্যে ৩টিতে জয় পেয়েছে পদ্ম শিবির। আসানসোল লোকসভা এলাকার ৭টির মধ্যে জয় শুধু কুলটি আর আসানসোল দক্ষিণে।
বাকি ১৪ সাংসদের এলাকায় কেমন ফল হয়েছে বিজেপির? মেদিনীপুর আসনের সাংসদ দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তাঁর লোকসভা এলাকার ৭টি আসনের মধ্যে খড়্গপুর সদর ছাড়া কোথাও জয়ের মুখ দেখেনি দিলীপের দল। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরেও বিজেপি জয় পেয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। আর বিধানসভা ভোটের ফল বলছে, সাংসদ কুনার হেমব্রম, জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, সুভাষ সরকার, সৌমিত্র খাঁদের লোকসভা এলাকায় আশানুরূপ ফল মেলেনি। সাংসদ সুরিন্দর সিংহ আলুওয়ালিয়ার লোকসভা বর্ধমান-দুর্গাপুরের ৭ আসনের মধ্যে একমাত্র দুর্গাপুর পশ্চিমে জয় পেয়েছে বিজেপি।
বিজেপির উত্তরবঙ্গের সাংসদদের এলাকা নিয়েও দলে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর রায়গঞ্জ লোকসভা এলাকার ৭ আসনের ৫টিতেই হেরেছে বিজেপি। সাংসদ জয়ন্তকুমার রায়ের জলপাইগুড়ি লোকসভা এলাকাতেও ৪টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। যদিও দলের আগাম সমীক্ষা বলেছিল জলপাইগুড়ি জেলার সব আসনেই জয় পাবে বিজেপি। একই চিত্র বালুরঘাট লোকসভা এলাকায়। সব আসন জেতার স্বপ্ন দেখা বিজেপি সাফল্য পেয়েছে ৩ আসনে।
আবার, বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মুর লোকসভা মালদা উত্তরেও ৩ আসনেই আটকে থেকেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপি-র অন্দরে এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে যে, দলীয় সাংসদদের প্রতি সাধারণ ভোটারদের তেমন আস্থা দেখা যায়নি। নিজের নিজের এলাকায় তাঁরা ঠিক মতো সময় দিলে ও কাজ করলে ফল অন্যরকম হতে পারত। কারণ, ওই ১৮ আসনের মোট ৯৬ আসনে ২০১৯ সালে এগিয়ে ছিল বিজেপি। যেটা নেমে হয়েছে ৬০। অন্য দিকে, তৃণমূল ২৮ থেকে ৬৫-তে পৌঁছে গিয়েছে।