১৮৩১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর, ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে’ পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন ডিরোজিও। সে’দিনই তিনি ‘কলেরা’য় আক্রান্ত হন। সে সময় রোগটি ছিল ‘দুরারোগ্য’। খবর পেয়ে তাঁর শিষ্যরা ছুটে আসেন। তীব্র অর্থসংকটে থাকা ডিরোজিওর চিকিৎসার ভার নিয়ে তাঁর সেবা শুশ্রুষা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তাঁর অন্তিম কালে তাঁর পাশে মা ও বোন ছাড়া ছিলেন ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘রামগোপাল ঘোষ’, ‘জন গ্রান্ট’। ২৬শে ডিসেম্বর (মতান্তরে ২৪শে ডিসেম্বর) তাঁর মৃত্যু হয়। ‘সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি’তে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল।
বহু যুগের ‘কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা’র বিরুদ্ধে বদ্ধ, জীর্ণ এই সমাজে তিনি ঝড় তুলেছিলেন। জন্ম সূত্রে বাঙালি না হলেও বাঙালিদের সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। একাধারে ‘শিক্ষক’, ‘কবি’, ‘সাংবাদিক’ এই মানুষটি তাঁর ‘উপলব্ধি আর কর্মোদ্যমে’ বদলাতে চেয়েছিলেন সমাজটাকে। তার পরিণামে তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল ‘অপমান’, ‘তাচ্ছিল্য’ আর ‘দারিদ্রতা’। সেকেলে রক্ষণশীল বাঙালির কাছে তিনি ছিলেন ‘দ্রজু ফিরিঙ্গি’। তিনি মাত্র পাঁচ বছর শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এক জন ভারতীয় না হয়েও ভারত তথা বাঙালির চিন্তাচেতনার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক অবিস্মরণীয় নাম – ‘হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’।
ঔপনিবেশিক যুগে, বিশেষ করে ঊনিশ শতকে যখন কিছু সম্পন্ন বাঙালি ‘মধ্যযুগীয় টোল’, ‘মাদ্রাসা’র প্রথাগত শিক্ষা থেকে মূলত কর্ম ও অর্থ উপার্জনের জন্য ‘পাশ্চাত্য রীতির শিক্ষা’ নিতে শুরু করেছিলেন, সেই সময়ে যে গুটিকয়েক শিক্ষকের আবির্ভাব হয়েছিল তার মধ্যে ডিরোজিয়ো ছিলেন সর্বোত্তম। যিনি ছাত্রদের মধ্যে ‘রক্ষণশীলতার গণ্ডি’ অতিক্রম করিয়ে ‘মুক্তচিন্তার পথের সন্ধান’ দিতে পেরেছিলেন। বাঙালিকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ হতে সাহায্য করেছিলেন। ‘সমাজের কূপমণ্ডকতা’কে কষাঘাত করে ‘নবজীবনের’, ‘নবজাগরণের আলোর পথ’ দেখাতে পেরেছিলেন তিনি। ‘হিন্দু কলেজে’র অল্প সময়ের শিক্ষকতা কালে তিনি ছাত্রসমাজে এতই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ উক্তি করেছিলেন ‘‘চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনই তিনিও অপরাপর শ্রেণির বালকদিগকে আকৃষ্ট করিলেন।’’
হেনরির জন্ম হয়েছিল ১৮০৯ সালের ১৮ই এপ্রিল কলকাতার ‘মৌলালি অঞ্চলে’ (১৫৫, লোয়ার সার্কুলার রোডে পৈত্রিক বাড়িতে) এক ‘ইউরেশীয় পরিবারে’। তাঁর বাবার নাম ‘ফ্রান্সিস’, মা ‘সোফিয়া’। ‘ফ্রান্সিস ডিরোজিও’ বিখ্যাত ‘জে. স্কট অ্যান্ড কোং’ নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতেন। তাঁর মা ছিলেন গৃহিণী। তাঁদের ছিল তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে ‘ফ্রাঙ্ক’, মেজ ছেলে ‘হেনরি’, ছোট ছেলে ‘ক্লাডিয়স’। তাঁদের প্রথম মেয়ে ‘সোফিয়া’ (মায়ের নাম থেকে নেয়া পদবী বিশেষ) মাত্র ১৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের ছোট মেয়ের নাম ছিল ‘অ্যামিলিয়া’। ডিরোজিওর পূর্বপুরুষরা সুদূর ‘পর্তুগাল’ থেকে ভারতবর্ষে এসে আর ফিরে যাননি। মাত্র ছ’বছর বয়সে ‘মাতৃহারা’ হয়েছিলেন হেনরি। পরে তাঁর বাবা ‘অ্যানা মারিয়া রিভার্স’ নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। ‘অ্যানা’র নিজের সন্তানাদি না থাকায় সতীনের সন্তানদের নিজের ছেলে মেয়ের মতোই দেখতেন। ‘ডিরোজিওর জন্মস্থান তথা বসতবাড়ি’টির কলকাতায় কোনও অস্তিত্ব নেই বলে তাঁর ‘জীবনীকারদের’ অনেকে জানালেও, বাস্তবে কিন্তু আজও সেই বাড়ি বহাল তবিয়তে রয়েছে এই শহরের বুকে। যে বাড়িতে ডিরোজিও তাঁর জীবন কাটিয়েছিলেন, সামান্য পরিবর্তিত হলেও, ইঁটের তৈরি সেই বিশেষ ধরনের ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাড়ি’টি এখনও দ্রষ্টব্য। ‘ডিরোজিওর বাসভবন’টি প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত হয়েছিল ‘ডিরোজিওর দুই জীবনীকার’ – ‘টমাস এডোয়ার্ড’ এবং ‘ই ডবলিউ ম্যাজের’ বিবরণ থেকে। পরবর্তী কালে কলকাতার অন্যতম ইতিহাসকার ‘ই এ কটন’ লিখেছিলেন, ‘‘লোয়ার সার্কুলার রোডের পূর্ব দিকে ও এন্টালিমুখী রাস্তার দক্ষিণে ১৫৫ নম্বর বাড়িটি বিখ্যাত ইউরেশিয়ান কবি ও শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর জন্মস্থান, যেখানে তিনি ১৮৩১ সালে মাত্র ২৩ বয়সে মারা গেছেন।’’ ডিরোজিওর ‘জন্মদাত্রী মা সোফিয়া’ মারা গিয়েছিলেন ১৮১৫ সালে। হেনরির বয়স তখন মাত্র ছ’বছর ছিল। তাঁর বাবা ‘ফ্রান্সিস ডিরোজিও’ মারা গিয়েছিলেন ১৮৩১ সালে। হেনরির দাদা ‘ফ্রাঙ্ক’ এবং বোন ‘সোফিয়া’ (মা ও মেয়ের একই নাম) দু’জনেই মারা গিয়েছিলেন ১৮২৭ সালে, হেনরির মৃত্যুর বছর চারেক আগে। তাই হেনরির মৃত্যুর পর ‘দেনার দায়ে’ সে বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর বিমাতা ‘অ্যানা মারিয়া রিভার্স’, ভাই ‘গিলবার্ট অ্যাস মোর’ বা ‘ক্লড’ এবং বোন ‘অ্যামেলিয়া’। তার পর বেশ কয়েক বার হাতবদল হয়েছিল বাড়িটির। কলকাতার অন্য এক ইতিহাসবিদ ‘রাধারমণ মিত্র’ নিলাম হয়ে যাওয়া সেই বাড়ির পরবর্তী মালিকদের একটি তালিকা তৈরি করতে গিয়ে ওই ক্রেতাকুলের একজন ‘নগেন্দ্রনাথ বসুমল্লিক’ সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘‘… ১৯০৭ সালে ১৫৫ নং লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িটি কিনে নিয়ে সেটা ভেঙে ফেলে তার জায়গায় মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি বড় বাগান সমেত অট্টালিকা তৈরি করিয়ে সেখানে গিয়ে বাস করেন। অট্টালিকার নাম দেন ‘মিনার’। অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, নগেন্দ্রনাথ নাকি ওই বাড়িতে এমন একটি কাঠের সিঁড়ি তৈরি করিয়েছিলেন, যেটির প্রত্যেক ধাপে পা দিলে পিয়ানোর এক একটি সুর বেজে উঠতো। বিলাসী নগেন্দ্রনাথ অবশ্য সে বাড়ি নিজের অধিকারে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি।’’ কিন্তু ‘রাধারমণ মিত্র’ বাড়িটির ‘পুনর্নির্মাণ’ সম্পর্কে ঠিক তথ্য দিলেও, সেটি একেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে যেটা জানিয়েছিলেন, তা ঠিক নয়। অনেক পরে ‘ডিরোজিও স্মরণ সমিতি’ এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে সিদ্ধান্তে আসে যে, ‘১৫৫ নং, লোয়ার সার্কুলার রোডের’ (বর্তমান ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড’) ডিরোজিওর বাড়িটি কখনওই ভাঙা হয়নি, কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল মাত্র। সমিতির সদস্য ‘শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়’ ‘কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং-বিভাগ’ ও অন্যত্র অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছিলেন যে, ‘নগেন্দ্রনাথ বসুমল্লিক’ বাড়িটির কিছুটা পরিবর্তন ঘটালেও মূল বাড়িটি এখনও প্রায় অক্ষুণ্ণই আছে। ডিরোজিওর মৃত্যুর ১৫০ বছর স্মরণে ১৯৮১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর বাড়ির সামনের ফুটপাথে একটি ‘স্মৃতিফলক’ লাগানো হয়েছিল। প্রত্যেক বছর ওই দিন একটি অনুষ্ঠানও করা হয়। সমিতির পক্ষ থেকে ১৯৯৪ সালে ‘রাষ্ট্রপতি’, ‘প্রধানমন্ত্রী’ ও রাজ্যের ‘মুখ্যমন্ত্রী’র কাছে পাঠানো ‘বাড়িটি অধিগ্রহণের দাবি সম্বলিত আবেদনপত্রে’ যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ‘অন্নদাশঙ্কর রায়’, ‘প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র’, ‘সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’, ‘বরুণ দে’, ‘সমীর রক্ষিত’, ‘নিমাইসাধন বসু’ প্রমুখ ২৮জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ডিরোজিওর ওই বাড়িটিতে বর্তমানে রয়েছে একটি ‘ডায়গোনস্টিক সেন্টার’। পুরসভা বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ সম্পদ’ হিসাবে ঘোষণাও করেছে।
গবেষক ‘বিনয় ঘোষ’ ‘ডিরোজিও-র পরিবার’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘কলকাতা শহরে পর্তুগিজ সমাজে ডি’রোজারিয়োর পরিবারের বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মনে হয়। ডিরোজিয়োর পিতা ‘জে স্কট অ্যান্ড কোং’ নামে কলকাতায় এক বিখ্যাত সদাগরী হৌসে উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। তিনি সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, কারণ কলকাতার গৃহসম্পত্তি তিনি নিজের অর্থেই করেছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি। পর্তুগিজরা তখন এ দেশে ফিরিঙ্গি সমাজে সংখ্যালঘু হলেও বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির দিক দিয়ে অনেক গণমান্য ছিলেন। ডি’রোজারিয়োর পরিবার তাঁদের অন্যতম।’’ অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতেও হেনরি বেশ ‘স্বচ্ছল’ পরিবারেই জন্মেছিলেন। পোশাকে কিংবা সাজসজ্জায় তিনি সব সময়ে পরিপাটি থাকতেন। মাথার মাঝখানে সিঁথি, সচরাচর টুপি পরতেন না। এটাই ছিল তাঁর পরিচিত ছবি। শীতকালে ময়দানে ক্রিকেট খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে, আর ছিল ঘোড়ায় চড়ার শখ। সে সময় ‘ইউরেশীয়রা’ ছিল সমাজে একটি ‘নিপীড়ীত সম্প্রদায়’। আইন আদালতের ক্ষেত্রেও তাঁদের জন্য ছিল ছিল বিচিত্র নিয়ম কানুন। সে সময়ে ‘ওকালতি’ কিংবা অন্যন্য বেশ কিছু পেশায় তাঁদের নিষেধাজ্ঞা ছিল। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ মিলত না এই সম্প্রদায়ের মানুষের। এ সকল বিষয়ে ডিরোজিও সচেতন ছিলেন। ডিরোজিও নিজ সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। আর এটাও জানতেন তাঁর আন্দোলনের পথে কোনও রকম ‘সংকীর্ণতা বা ধর্মান্ধতা’ কিংবা বিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আর হয়ত এই কারণেই সে কালের ‘সবচেয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের’ এক জন মানুষ হয়েও ‘হিন্দু সমাজে’ আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন। তৎকালীন ‘রক্ষণশীল খ্রিস্টান এবং হিন্দুরা’ নানা ভাবে তাঁর বিরোধিতা করলেও তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি।
ব্রিটিশদের আগমনে পূর্বে এ দেশীয় মানুষের টোল-মাদ্রাসায় ‘ন্যায়’, ‘নব্যন্যায়’, ‘অর্থশাস্ত্র’, ‘ধর্ম’ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা নিতেন। এর পর যখন আঠারো শতকের শেষ প্রান্তে কলকাতায় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ স্থাপিত হল, তখন কিছু সংখ্যক এ দেশীয় মানুষ অর্থ রোজগারের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করার কথা ভাবেন। তাঁদের মনে হল – ‘ইংরেজি’ শিখতে হবে। সেই সময়ে অবশ্য ‘ইংরেজি শিক্ষা’ বলতে বোঝানো হত ‘ইংরেজি শব্দ শিক্ষা’। দেশীয় লোকেরা ইংরেজি শিখতে লাগলেন সাহেবদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করবেন বলে। এবং যে যত বেশি ‘ইংরেজি শব্দ’ শিখতে পারতেন, তখনকার সমাজে তিনি তত বড় ‘পণ্ডিত’ বলে স্বীকৃত হতেন। এর পর দেশীয় ‘ইংরেজি শব্দ-শিক্ষা’ পাওয়া মানুষেরা যখন সাহেবদের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ভাববিনিময় করে প্রচুর অর্থের মুখ দেখতে লাগলেন, তাঁদের দেখে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ‘ইংরেজি শেখার তাগিদ’ অনুভব করে। তার ফলে কিছু সংখ্যক ‘বেনিয়া’, ‘ব্রিটিশ’ ও ‘ফিরিঙ্গিরা’ ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্র হিসাবে নিজেদের উদ্যোগে ছোট ছোট ‘ইংরেজি শিক্ষার স্কুল’ খুলতে থাকেন। সেই আমলে ব্রিটিশ ও ফিরিঙ্গিদের স্থাপন করা স্কুলগুলির মধ্যে যে স্কুলগুলি উল্লেখযোগ্য ছিল, সেগুলি হল – ‘উত্তর চিৎপুর অঞ্চলে আদি ব্রাহ্মসমাজের কাছে অবস্থিত শেরবোর্ন স্কুল’, ‘বৈঠকখানার হাটম্যানের স্কুল’ আর ‘ধর্মতলার ড্রামন্ডের স্কুল’। এ ছাড়াও ‘আমড়া তলায় মার্টিন বাউলের স্কুল’, ‘আমহার্ট স্ট্রিটের পূর্ব দিকে মেকলের স্কুল’। এ ছাড়া আরও অনেক স্কুল। এই সকল স্কুলে পাঠ নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘মতিলাল শীল’ (বাউলের স্কুল) ও ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’ (শেরবোর্ন স্কুল)। ডিরোজিও ‘শৈশবের শিক্ষা’ নিয়েছিলেন ‘ড্রামন্ডের স্কুলে’। ডিরোজিওর পরিবারের ‘আর্থিক প্রতিপত্তি’ থাকার জন্য ডিরোজিওকে তাঁর পরিবার সে সময়ের কলকাতার সব চেয়ে বিখ্যাত স্কুল ‘ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে’ বিদ্যা শিক্ষার জন্য ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। হেনরির ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর শিক্ষক ‘ডেভিড ড্রামন্ডের’। জীবনের ছয় থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত তিনি ‘হেনরি ড্রামন্ডের স্কুলে’ পড়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ডিরোজিও শিক্ষা জীবন শেষ করে ‘উচ্চতর বিদ্যার্জনে’ না গিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। নিজের শিক্ষা অসমাপ্ত রাখলেও তাঁর ছোট ভাইকে ‘স্কটল্যান্ডে’ পাঠানোর ব্যাপারে তিনি উৎসাহী ছিলেন। ‘ড্রমন্ড’ ছিলেন তাঁর বলয়ের সুপরিচিত কবি। নিজ দেশীয় সাহিত্যে তাঁর সুখ্যাতির কমতি ছিলো না। কিন্তু ওসব খ্যাতি পেছনে ফেলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে এসেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন ‘নাস্তিক’, যা তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা মেনে নেননি। ভারতে এসে তিনি ‘শিক্ষার প্রসারে’ কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রথমে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বিদ্যালয় স্থাপন করলেও তাঁর স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ছিলো অত্যন্ত কম। ভারতীয়রা দূরে থাক, ‘ভারতবাসী ইংরেজরাও’ ‘ড্রমণ্ডের স্কুলে’ তাঁদের বাচ্চাদের পাঠাতেন না; বাচ্চারা যদি ‘নাস্তিক’ হয়ে যায়! এই ভয়ে। হেনরি ডিরোজিওর পিতা যখন তাঁর ছেলেকে ‘ড্রমণ্ডের স্কুলে’ ভর্তি করান, তখন তাঁকেও এসব কথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি চরয়েছিলেন তাঁর ছেলে ‘ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত শিক্ষায়’ শিক্ষিত হোক। পিতার কাছ থেকে পাওয়া চিন্তার স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ডিরোজিও হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের সেরা ‘কিশোর সমাজ সংস্কারক’। ‘ড্রমণ্ড’ কেবল ‘গৃহত্যাগী কবি ও শিক্ষক’ ছিলেন না, ছিলেন একজন ‘দার্শনিক’। ধর্ম ছাড়াও অন্য অনেক বিষয়ে তাঁর ভাবনার সাথে অন্যদের ভাবনার বৈপরীত্য ছিলো উল্লেখ করার মত। তিনি সমসাময়িক প্রগতিশীলদের চেয়েও বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। ডিরোজিও তাঁর শিক্ষক ‘ড্রমণ্ডের’ অগ্রচিন্তার সান্নিধ্যে এসে বালক বয়সেই সুচিন্তক হওয়ার উৎসাহ ও প্রেরণা লাভ করেন। এসময় ‘দর্শনজ্ঞানের’ পাশাপাশি তাঁর ‘কাব্যপ্রতিভার’ও বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। যে স্কুলের খবর সেই সময়কার ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত, সেই সংবাদ থেকে ডিরোজিওর ছাত্রবস্থার যে খবর জানা যায়, সেখানে দেখা যায় – তিনি মাত্র আট বছর বয়সে ‘আবৃত্তি’, ‘ভূগোল’ ও অন্য বিষয়ে ‘মেধা প্রদর্শনের জন্য’ ‘একটি স্বর্ণপদক’ পেয়েছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখে তার পরের বছরে তিনি সেই একই কৃতিত্বের জন্য স্কুল থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৮২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ‘ইন্ডিয়া গেজেট’এর সম্পাদক ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমির বাৎসরিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের’ যে খবর ছেপেছিলেন, তাতে লেখা ছিল – ‘‘… ডিরোজিয়ো নামে এক ছাত্র শেক্সপীয়রের শাইলক চরিত্রের এমন অপূর্ব চিত্র তার আবৃতির বাচন ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছিলো যা ওই বয়েসের স্কুলের ছাত্রের পক্ষে অভাবনীয় বলা চলে। কলম্যানের একটি হাস্যকৌতুকের কবিতাও সে আবৃতি করেছিলো চমৎকার হাস্যদ্দীপক ভঙ্গীতে।’’ ডিরোজিও যখন পড়াশোনা করছিলেন সেই সময়ে বাংলার আরেক জন যুগপুরুষ ‘রাজা রামমোহন রায়’ ‘দেশীয় কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে’ লড়াই করছিলেন। এক বার তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’য় ‘ভারতহিতৈষী ডেভিড হেয়ারের’ আগমনে ‘রামমোহন’ ‘হিন্দুদের ধর্মন্ধতা’ দূর করার জন্য ‘বেদান্ত বিদ্যালয়’ স্থাপনের সম্পর্কে আলোচনায় ‘ডেভিড হেয়ার’ তাঁকে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য’ একটি বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারণ, ‘হেয়ার সাহেব’ বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের জন্য ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা’ই এক মাত্র পথ। এই বিষয়ে তিনি ‘দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়’কে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। তার পর ‘হেয়ার সাহেব’ এবং ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যর হাইড ইস্টের’ এবং বিত্তবান কিছু মানুষের সম্মতি নিয়ে একটি যুগপোযোগী কলেজ স্থাপন করা হয়েছিল। ‘হিন্দু কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল জন কের’ ‘হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস’ জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন – ‘‘… ইংরেজি শিক্ষা লাভের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করিবার উদ্দেশ্যে দেশীয় অধিবাসীরা নিজেরাই ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দুকলেজ স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের কাজে কয়েক জন ইউরোপীয় ভদ্রলোক সক্রিয় উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে সার হাইড ইষ্ট ও ডেভিড হেয়ার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’’
শিক্ষা শেষের পর ডিরোজিও মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই সময়ে তাঁর পিতাও গত হয়েছিলেন। তবে ‘শিক্ষকতা’ দিয়ে তাঁর ‘কর্মজীবন’ শুরু হয়নি। প্রথমে তাঁর বাবা যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, তিনি সেখানে যোগ দিয়েছিলেন ‘কেরানির চাকরি’তে। কিন্তু সেই কাজ তাঁর বেশি দিন ভাল লাগেনি। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ‘ভাগলপুরে’ তাঁর মাসির বাড়িতে। এর পর তিনি ‘ভাগলপুরের নীল দফতরে’ যোগদান করেছিলেন। সেখানেই শুরু হয়েছিল তাঁর ‘কাব্য চর্চা’। তাঁর কবিতা রচনায় প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেট’ পত্রিকার সম্পাদক ‘ডক্টর জন গ্রান্ট’। ডিরোজিও ‘জুভেনিস’ ছদ্মনামে লিখতেন। ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেট’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮২৭ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দ্যা পোয়েমস’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮২৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কবিতার বই ‘দ্য ফকির অফ জঙ্ঘীরা, এ মেট্রিকাল টেল; অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। ‘ভাগলপুরের নদীতীরে’ ‘ঝঙ্গীরা’ নামক আশ্রমে এক ফকির বাস করতেন। দূর হতে ফকিরের আশ্রম ও তাঁর জীবনযাপন মনযোগের সাথে খেয়াল করতেন ডিরোজিও। এমন জীবনযাপন তাঁর কাছে কৌতুহল উদ্দীপক মনে হযত। এই কৌতুহল অথবা ভালোলাগার সাথে একটি গল্প নিদারুণ অথবা দারুণ গল্প জুড়ে তিনি লিখে ফেলেছিলেন তাঁর সেরা কবিতা। এর পাশাপাশি চলেছিল তাঁর নিজের পড়াশুনা। ক্রমেই তিনি নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর মাসির স্বামী ‘আর্থার জনসন’ ছিলেন ‘ভাগলপুরে নীলকুঠির মালিক’। সেখানে মেসোর ব্যবসায় টুকটাক দেখাশোনা করা ছাড়া সেখানে তাঁর আর কোন কাজ ছিলো না। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া, ঘুম – ‘কাব্যপ্রতিভা সম্পন্ন’ এক বালকের জন্য সেটা ছিল অতি লোভনীয় জীবনযাপন। তাঁর মাসির বাড়ির কাছেই ছিল ‘গঙ্গা নদী’। নদী তীরের সবুজাঞ্চলে মাতাল হাওয়ায় বসে তিনি কবিতা লিখতেন, কখনো ঘাসের শরীরে গা এলিয়ে বই পড়তেন। পড়তেন নানান ধরণের বই। এর মধ্যে ‘দর্শনের বই’য়ে ডিরোজিওর আগ্রহ ছিলো সবচেয়ে বেশি। ‘ফিরিঙ্গি সমাজ ও ইংরেজরা’ ডিরোজিওর কবিতা পড়ে কিঞ্চিত অবাক হয়েছিল, তাঁরা ভেবেছিল বালকের প্রতিভা আছে বটে! কিন্তু তাঁদের বিস্ময় সীমা অতিক্রম করেছিল যখন এই বালক বিখ্যাত ‘জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের’ ‘Lectures on Philosophical Theology’ গ্রন্থের জমজমাট সমালোচনা লিখে ফেলেছিলেন। প্রতিভাগুণে অল্পদিনেই ভারতবাসী ইংরেজদের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন ফিরিঙ্গি ডিরোজিও। কিন্তু ডিরোজিয়োর মনও ‘ভাগলপুরে’ বেশি দিন ভাল ছিল না। তাই তিনি কলকাতায় ফিরে আসাটাই মনস্থির করেছিলেন।
এর পরে ডিরোজিও ‘ভাগলপুর’ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মূলত ‘ডক্টর গ্রান্টের’ সহায়তায়। ১৮২৬ নাগাদ, তিনি কলকাতায় দু’টি চাকরি পেয়েছিলেন। প্রথমটি ‘দ্য ইন্ডিয়া গ্যাজেটে’ পত্রিকার ‘সহ সম্পাদক’ হিসেবে, দ্বিতীয়টি ‘হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার’। কারও কারও মতে তিনি দু’টি চাকরি এক সঙ্গে কিছুদিন করেছিলেন। ডিরোজিও যে সময় ‘হিন্দু কলেজে’ যোগদান করেছিলেন সেই সময়টা ছিল কলেজের সমৃদ্ধিও স্বচ্ছলতার সময়। তাঁর পাণ্ডিত্য ও মেধার জন্যই কলেজের খ্যাতি ও গৌরব বেড়েছিল। কোনও কোনও গবেষকের মতে ডিরোজিওর এই জনপ্রিয়তাই তাঁর ‘পতনের কারণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘সাংবাদিক রূপে’ও ডিরোজিওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাঁর একজন ‘শিক্ষকরূপে’ ‘হিন্দু কলেজে’ যোগদানটি ছিল বেশ আকস্মিক। আদতে ১৮২৬ সালে কবিতার বই ছাপানোর কাজে তিনি কলকাতা এসেছিলেন। তাঁর শহর আগমনের খবর পৌঁছে গিয়েছিল সর্বত্র, সুবিখ্যাত ‘হিন্দু কলেজে’ও (বর্তমান ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’)। তখন ‘হিন্দু কলেজে’ ‘চতুর্থ শ্রেণীর জন্য’ ‘সাহিত্য ও ইতিহাসের একজন শিক্ষক’ প্রয়োজন ছিল। ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ’ আচমকাই ডিরোজিওকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং তিনি ‘‘হ্যাঁ’’ বলেছিলেন। আর এই ‘‘হ্যাঁ’’ বলার ফল যে কত উজ্জ্বল ও গৌরবের হতে পারে, তিনি নিজেও হয়ত জানতেন না। ১৮২৬ সালের কোনও একটি সময়ে তখন ডিরোজিওর বয়স সতেরো, তিনি ‘হিন্দু কলেজে’ ‘ইতিহাস ও ইংরেজি বিষয়’ পড়ানোর জন্য ‘চতুর্থ শিক্ষকের পদে’ যোগদান করেছিলেন। শিক্ষক পদে যোগদান কালে তাঁর বয়সের সঙ্গে ছাত্রদের বয়সের মাত্র তিন-চার বছরের তফাত ছিল। ফলে, ছাত্রদের সঙ্গে ডিরোজিওর সম্পর্ক কখনই প্রাচীন ‘তপোবনের গুরু-শিষ্যের মতো’ গুরুগম্ভীর হয়নি। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে প্রায় বন্ধুদের মতো মিশতেন। নতুন শিক্ষকের ‘পাণ্ডিত্য’, ‘বাগ্মিতা’ এবং ছাত্রদের ‘যুক্তি-তর্কের মধ্যে দিয়ে সব কিছু গ্রহণ করতে শেখানো’, তাঁদের ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া’, ‘স্নেহ করা’, প্রভৃতি গুণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পড়ানোর কালে তিনি কোনও কিছুই ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতেন না, ‘বিচার বিশ্লেষণের মধ্য’ দিয়ে ভাল-মন্দ সব কিছু বুঝে নিতে বলতেন। এর ফলে ‘কুসংস্কার’, ‘রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে’ ধীরে ধীরে যু্ক্তি, সত্য দিয়ে ভাল-মন্দ বিচার করতে শেখার প্রেরণা ছাত্রদের মধ্যে আসে ডিরোজিওর শিক্ষাদানের ফলে। তার ফলে ছাত্রকুলের মধ্যে একটি ‘আধুনিক চিন্তাজগৎ’ গড়ে উঠতে থাকে। ‘রাধানাথ শিকদার’ লিখেছিলেন, ‘‘ডিরোজিয়োর সামান্য বিদ্যাভিমান থাকলেও তাঁর মতো সহানুভূতিশীল স্নেহপ্রবণ শিক্ষক তখনকার শিক্ষায়তনে দুর্লভ ছিল। কোনও বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার আগে তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী। ছাত্রেরা তাতে যে কত লাভবান হত, তা বলা যায় না। কেবল বিদ্যা-শিক্ষা করেই তারা ক্ষান্ত হত না, বাস্তব জীবনে ও সমাজে তার প্রত্যক্ষ প্রয়োগ-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় তারা চঞ্চল হয়ে উঠত। কোনও শিক্ষক ছাত্রদের মনে এ রকম প্রেরণা জাগাতে পারতেন না।’’ সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল ‘পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরোধ’। কিন্ত তৎকালীন সময়ে পরিস্থিতি জটিল হয়েছিল তার অন্য কারণ ছিল। ভারতীয় হয়েও তিনি ‘রক্ষণশীল হিন্দুর’ কাছে ‘বিধর্মী’ ছিলেন, অন্য দিকে ‘খ্রিস্টান’ হয়েও ‘ইউরেশীয়’ হওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর সাহায্য পাননি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ সভায়’ তাঁকে ‘পদচ্যুত’ করার ব্যাপারে যখন ভোট নেওয়া হয়েছিল তাতে ‘উইলসন’ ও ‘ডেভিড হেয়ার’ অংশগ্রহণ করেননি। ডিরোজিওর ‘প্রত্যক্ষ ছাত্রদের’ মধ্যে ছিলেন ‘দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়’, ‘রামগোপাল ঘোষ’, ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’, ‘রাধানাথ শিকদার’, ‘রামতনু লাহিড়ী’, ‘শিবচন্দ্র দেব’, ‘দিগম্বর মিত্র’, ‘গোবিন্দচন্দ্র বসাক’। তেমনই ‘হরচন্দ্র ঘোষ’, ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও ‘রশিককৃষ্ণ মল্লিক’ ছিলেন তাঁর ‘ভাবশিষ্য’। তবে ‘শিক্ষাদানকে’ ডিরোজিও কেবল মাত্র ক্লাসরুমের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। ক্লাসের বাইরে তাঁর বাড়িতে কিংবা অন্যত্র তাঁরা মিলিত হতেন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদের ‘friend philosopher and guide’। ডিরোজিওর এই সব ছাত্ররা ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিলেন। ডিরোজিওর মৃত্যুর তিন বছর পর কলকাতায় পড়তে আসা ‘লালবিহারী দে’ ‘শিক্ষক ডিরোজিও’ সম্পর্কে তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকে যা শুনেছিলেন সেটা শুনে তিনি লিখেছিলেন – ‘‘হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্রেরা বেকন (Bacon), লক (Locke), বার্কলে (Berkeley), হিউম (Hume), রীড (Reid), স্টুয়াট (Stewart) প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় লাভ করেন। এই পরিচয়ের ফলে তাঁদের গতানুগতিক চিন্তাধারার এক বৈপ্লবিক আলোড়নের সূত্রপাত হতে থাকে। প্রত্যেক বিষয়ে তারা প্রশ্ন করতে ও তর্ক করতে আরম্ভ করেন। তার ফলে তাঁদের অনেক প্রচলিত বদ্ধমূল ধারণার মূল নড়ে যায়। বহুকালের বাছা বাছা সব আস্তার স্তম্ভ টলমল করে ওঠে। এই নতুন শিক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী গুরু ছিলেন ডিরোজিয়ো।’’ এই ভাবে পাঠদানে ‘পাঠ্যপুস্তক বর্জিত আরও নানা প্রশ্ন’ সামনে আসতে শুরু করলে ডিরোজিও ভেবেছিলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক বর্জিত এই সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া’ এবং ‘প্রত্যেকেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া’ দরকার। কিন্তু সেটা শ্রেণিকক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি এই সকল ‘নতুন প্রশ্ন ও তার উত্তর’, ‘তর্ক-বিতর্কের জন্য’ একটি সভার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেই সভাটি প্রথমে স্থানান্তরিত করেছিলেন ‘মানিকতলার শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে’। ১৮২৮ সালে গঠিত সেই নতুন সভার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যাকাডেমিক আ্যসোসিয়েশন’। তিনি ছিলেন সেই ‘সভার সভাপতি’। এর পর ধীরে ধীরে সেই সভায় ‘আলোচনার বিষয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা’, ‘নৈতিক ভণ্ডামি ও নোংরামি’, ‘বিচার-বুদ্ধিহীন শাস্ত্র বচন’, ‘প্রাণহীন চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠান’, ‘জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যুক্তি সহকারে বিরোধিতা করা’। নতুন চিন্তার বাহকদের এই সকল আলোচনায় ‘রক্ষণশীলদের ভিত’ কেঁপে উঠেছিল। ‘প্যারীচাঁদ মিত্র’ ও ‘ডেভিড হেয়ারের’ লেখাতেও উল্লেখ মেলে যে, ক্লাসে ডিরোজিও ছকে বাঁধা পাঠক্রমের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকতেন না। তিনি ছাত্রদের ‘বিতর্কসভা ও পত্রিকা পরিচালনায়’ উৎসাহ দিতেন। ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ ১৮৩৯ সালে উঠে গেলেও তাঁর ছাত্র এবং অনুগামীরা কিছু ‘সভাস্থাপন’ এবং ‘পত্রিকা’ চালু করেছিলেন। এর মধ্যে ‘সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’ উল্লেখ্য। তেমনই ডিরোজিও ‘হিন্দু কলেজ’ ছেড়ে দেওয়ার সপ্তাহ তিনেক পরে ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকা। এর পরপরই ‘দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদনায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘জ্ঞানান্বেষণ’। এই সব পত্র পত্রিকায় আলোচিত বিষয় ‘রক্ষণশীল হিন্দুসমাজকে’ শঙ্কিত করে তুলেছিল – তাই এই ‘নব্যবঙ্গদের সঙ্গে’ তাঁদের সংঘাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। এঁদের অনেকেরই ‘ব্যক্তিগত জীবনে’ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ‘স্থায়ী বিচ্ছেদ’ ঘটে গিয়েছিল কেননা এঁদের জীবনযাপন বা খাওয়াদাওয়া পরিবারের লোকজন মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই মনে করেন ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর সদস্যদের অনেকেই ‘পরিণত মনস্ক’ ছিলেন না। এ কারণেই হিন্দুরা যেগুলিকে ‘কুখাদ্য’ বলে মনে করতেন এঁরা সেগুলি খাওয়ার মাধ্যমে মুক্তির পথ নিহিত আছে মনে করতেন। ডিরোজিওর সময়ে তাঁর তৈরি ‘আ্যকাডেমিক আ্যসোসিয়েশন’ তো ছিলই। তার সঙ্গে দোসর হয়ে উঠেছিল ‘রাজা রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রদ আইন’, ‘ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা’ এবং ‘খ্রিস্ট্রধর্ম প্রচারের জন্য সস্ত্রীক আলেকজান্ডার ডাফের আগমন’। এর ফলে হিন্দু সমাজে ভয়ঙ্কর রকমের গেল-গেল রব উঠেছিল এবং উক্ত সব কিছুর জন্য দোষ গিয়ে পড়েছিল শিক্ষক ডিরোজিওর উপরে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি ‘পাঠ্যপুস্তক বর্হিভূত পড়াশোনা’ করিয়ে ছাত্রদের মাথা নষ্ট করছেন, ‘সামাজিক অস্থিরতা’ সৃষ্টি করছেন। সুতরাং, হিন্দু কলেজের প্রতিনিধিদের উচিত ডিরোজিয়োর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা।
‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র’ হিসেবে নিয়ে ডিরোজিও নিয়ে এসেছিলেন ‘পার্থিনন’ নামে একটি ‘সায়মিকী’। কিন্তু তৎকালীন হিন্দু সমাজ সেই পত্রিকার মাত্র একটি সংখ্যা হজম করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপানো হলেও সেটি বিতরণ করতে দেননি তৎকালীন ‘হিন্দু সমাজনেতারা’। পত্রিকাটিকে তাঁরা ‘হিন্দু ধর্মের প্রতি হুমকী’ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ‘পার্থিনন’ বন্ধ হওয়ার পরে ‘হেসপেরাস’ নামে একটি ‘বার্ষিক সংকলন’ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পত্রিকাটিও মাত্র এক সংখ্যা পরেই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এরপরে ‘ডিরোজিওর সম্পাদনায়’ ‘ক্যালিডোস্কোপ’ পত্রিকাও ‘সমভাগ্য’ বরণ করেছিল। কিন্তু ‘পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ’ ঠেকিয়ে রাখলেও তাঁদের ‘আলোচনা সভা’ বন্ধ করা যায়নি। ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায়’ ‘ডিরোজিয়ানরা’ এমন সব বিষয় নিয়ে ‘আলোচনা ও বিতর্কের আয়োজন’ করতেন, যা শুনে তৎকালীন ‘হিন্দু সমাজনেতারা’ কানে হাত দিতে বাধ্য হতেন। যেন সেগুলো শুনলেই ‘ক্ষমার অযোগ্য পাপ’ হয়ে যাবে। ‘হিন্দু ধর্মের মৌলিক রীতি’, ‘আচার ও বিশ্বাসে’ আঘাত করতে শুরু করেছিলেন ‘ডিরোজিওর শিষ্যরা’। ‘ডিরোজিও দর্শনের মূলে’ ছিল ‘স্বদেশপ্রেম’, ‘বিশ্বমানের দৃষ্টিভঙ্গি’, ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে যুক্তিনির্ভরতা’ এবং ‘সমাজে অন্ধ ও পশ্চাৎমুখী চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে লড়াই’। প্রথমটি বাদে এর প্রতিটি বিষয় ছিল ‘হিন্দু ধর্মের পুরাতনবাদী ধ্যান ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক’। ফলে ডিরোজিও খুব অল্প সময়ে ‘প্রত্যাশাতীত শত্রু’ সঞ্চয় করেছিলেন। ‘শত্রুর সংখ্যা’ দেখে ডিরোজিও স্বস্তি পেতেন, শান্তি পেতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর শিষ্যরা সঠিক জায়গায় সঠিক মাত্রায় আঘাত করছে। একসময় ‘অনেক শত্রু থাকার সুবিধা’ পেতে শুরু করেছিল ‘ডিরোজিও ও তাঁর দল’। সেই শত্রুদের কেউ কেউ ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বিতর্কে’ ‘শ্রোতার আসনে’ শোভা পেতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা বিতর্ক শুনে অবাক হতেন, তাঁদের মনে শত দ্বিধা জেগে উঠত, সহস্র প্রশ্ন জেগে উঠত। সভার শেষে নতুন কিছু চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন ‘প্রতিপক্ষের পণ্ডিতরা’। সেই সব সভায় গড়ে চার শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক-সাধারণ মানুষ উপস্থিত থাকতেন। ততদিনে ‘সমাজের প্রভাবশালী হিন্দুদের’ টনক নড়ে গিয়েছিল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ডিরোজিও স্রেফ ছোকরা নন, একটা ধারালো ছোরা! ডিরোজিওর একের পর এক ঘা’য়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল তাঁদের ‘অন্ধকারের দোকানদারি’। ফলে ‘সমাজপতিরা’ ‘পাল্টা আঘাত’ করতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে ‘বাঙালি সংস্কৃতির দোহাই’ আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল এক বিদেশি ছোকরা ‘বাঙালি সংস্কৃতিকে’ গিলে খাচ্ছে! ‘ইংরেজি আধুনিকতার নামে’ ‘বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে’ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। কিন্তু এসব ধোপে টিকেনি। ডিরোজিও’র শিষ্যরা আসলে ‘সংস্কৃতির সাথে’ কোন বিরোধ করেননি। অথবা যৎকিঞ্চিৎ করেছিলেনও। কিন্ত তাঁরা মূলতঃ সংস্কৃতির শরীরে লেপ্টে থাকা পুরোনো ক্ষতগুলোর সাথে বিরোধ করেছিলেন। তাঁরা ‘অযথা অদরকারি অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে’ বলেছিলেন, ‘প্রচলিত অকার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য’ আন্দোলন করেছিলেন। শহরজুড়ে ‘গণপাঠাগার নির্মাণের কথা’ বলেছিলেন, সেইসব পাঠাগারে ‘বিশ্ব ইতিহাস ও দর্শনের বই’ রাখতে বলেছিলেন, ‘জ্ঞানার্জনের জন্য ইংরেজি শিক্ষার কথা’ বলেছিলেন। তাঁরা আরও বলেছিলেন ‘বসন্ত রোগ’ হলে ‘শীতলা পূজা’ দিয়ে লাভ নেই, ‘গঙ্গার সাথে’ পবিত্রতার কোন সম্পর্ক নেই, ‘বাল্য বিবাহ’ বন্ধ করতে হবে, ‘জাত নিয়ে বৈষম্য’ করা অমানবিক। তাঁরা বলেছিলেন, ‘শাস্ত্রবচন’ মাত্রই মান্য করা উচিত – এটি খুবই বাজে কথা। এসব কথার মাঝে সব কথা ছিল ‘কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে’, কয়েকটা বিষয় আবার ‘আধা উদারবাদী’ খেতাব পাওয়া ‘ব্রাহ্ম সমাজের বিরুদ্ধে’ও গিয়েছিল। তাই ‘ব্রাহ্ম বুড়োদের’ অনেকে ‘কিশোর ডিরোজিওর বিরুদ্ধে’ কথা বলতে শুরু করেছিলেন।
এরই মধ্যে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের’ মত আরও বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। প্রায় সব সংগঠনে সদস্য হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন ডিরোজিও। সংগঠন বেড়ে যাওয়ায় ‘আলোচনা’ও বেড়ে গিয়েছিল। আর আলোচনার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল ‘সমালোচনা’। শহরের আনাচে কানাচে শুরু হয়েছিল ডিরোজিও এবং তাঁর দলের ‘সুনাম ও বদনাম’। এদিকে লোকজন তাঁদের দলের একটা নামও দিয়েছিল। কেউ ডিরোজিওর দলকে বলতেন ‘ইয়ং বেঙ্গল’ অথবা ‘নব্য বঙ্গ আন্দোলন’, আবার কেউ কেউ ‘ইয়ং ক্যালকাটা’ও বলতেন। ‘ইয়ং বেঙ্গলের’ আমদানি করা ‘ডেভিড হিউম’, ‘জেরেমি বেনথাম’, ‘টমাস পেইন’, ‘ভলতেয়ারের’ মত ‘প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী চিন্তাবিদদের প্রভাবে’ কলেজ ছাত্ররা সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শুরু করলে সমাজে ‘চিন্তার সংঘাত’ দেখা দিয়েছিল। লোকজন বলাবলি করতেন – ‘‘যুক্তি ভালো, যুক্তি দেখাও। কিন্তু ধর্মকে যুক্তির বাইরে রাখো।’’ আসলেই, ধর্ম আর যুক্তিকে এক করা যায় না। আর করা গেলেও ‘হিন্দুসমাজের নেতারা’ তা করতে দেবে কেন? ‘হিন্দুধর্মের খোলাখুলি নিন্দা’ ‘ধর্মব্যবসায়ীরা’ সইবে কেন? কমবয়সী কতগুলো ছেলেপেলে, তাঁরা বলত “তামা পিতল মানি না, গঙ্গা মানি না!” এটা কি সহ্য হবার ছিল!? তখনকার সময়ে ‘ইয়ং বেঙ্গলের ইয়ংম্যানরা’ বেশ চঞ্চল ছিলেন। তাঁদেরকে সন্ধ্যা বেলায় জোর করে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে বসে ‘ধর্মগ্রন্থ’ পড়ার পরিবর্তে ‘হোমার’, ‘ইলিয়ডের বই’ থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করতেন। তাঁরা সকালে দেবদেবীকে প্রণাম করার পরিবর্তে বলতেন, ‘‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম!’’ দিনের বেলা লোকজনকে দেখিয়ে ‘গরুর মাংস’ ও ‘মুসলমানের রুটি’ খেয়ে ‘হিন্দুদের খাদ্যবিধিতে’ আঘাত করতেন। হাতের কাছে ‘ব্রাহ্মণ’ পেলে ‘‘আমরা গরু খাইগো’’ বলে উত্যক্ত করতেন। এভাবে করে ‘হিন্দুদের জাত্যাভিমানে’ আঘাত হানার জন্য যত ধরনের বুদ্ধি তাঁদের মাথায় আসত, তার সবটুকুর প্রয়োগ তাঁরা করতেন। কিন্তু তা ‘নির্বিঘ্ন’ হবে কেন! সব ধরনের সমাজে যেমন একজন ‘বিশেষ বার্তাবাহক’ থাকেন যিনি এ বাড়ির খবর ওবাড়ি সেবাড়ি করে বেড়ান, তখন কলকাতা শহরে সেরকম কয়েকজন ছিলেন। ‘ধর্মের পবিত্র দায়িত্ব’ নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে তাঁরা শহরজুড়ে ‘ইয়ং বেঙ্গলের তরুণদের নামে নিন্দা প্রচার’ শুরু করেছিলেন। ‘ইয়ং বেঙ্গলের’ বিরুদ্ধে ‘ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ক সত্য নিন্দা’র পাশাপাশি ‘মিথ্যা ও বানোয়াট নিন্দা’ও প্রচার করা হয়েছিল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিরোজিও নাকি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে, ‘ভাই ও বোনের মাঝে বিয়ে’ হওয়ায় দোষ নেই! ‘নিন্দা’টা যেহেতু ছিল ‘ধর্ম বিষয়ক’, ‘ভাই বোনের মাঝে বিয়ে’র মতো চাঞ্চল্যকর, সেহেতু ডিরোজিও আর পালাতেন কোথায়! ‘হিন্দু ধর্মের আভিজাত্যে হস্তক্ষেপের ফল’ পেতে তাঁকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। শুধু ‘কানেমুখে নিন্দা’ ছড়িয়ে ক্ষান্ত হননি তখনকার ‘গোঁড়া হিন্দুরা’। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামে তখনকার দু’টি ‘হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা’ ডিরোজিওর বিরুদ্ধে টানা ‘বিষোদগার’ করেছিল। যার মূল বাক্য ছিল ‘‘দুর্বৃত্ত ফিরিঙ্গিদের নকল করে চলেছে যে নাস্তিক পশুরা, তাঁদের জন্য বিপন্ন হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম।’’ এর পাশাপাশি ‘হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষকে’ আহ্বান করা হয়েছিল ডিরোজিওকে ‘বহিষ্কারের’ জন্য। কিন্তু ডিরোজিও বা ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ’, কেউই কোন ‘কর্ণপাত’ করেননি এসব অভিযোগ ও বিবৃতির দিকে। ফলে ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘হিন্দু কলেজ শিক্ষকদের চরিত্র হনন করে’ একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই চিঠি প্রকাশের পর ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যরা ‘কলেজ কর্তৃপক্ষকে’ চাপ দিয়েছিলেন ‘হিন্দু নেতাদের চিঠির প্রতিবাদ জানাতে’। সেই চাপে পড়ে ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ’ প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছিল। একই সাথে ‘ইন্ডিয়া গ্যাজেট’ পত্রিকায় ‘হিন্দু নেতাদের সমালোচনা করে’ একটি কড়া ‘উপসম্পাদকীয়’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেটা পড়ে অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে সেই ‘উপসম্পাদকীয়’ ডিরোজিও নিজেই লিখেছিলেন। এর আগে ‘কলেজ কমিটি’র পক্ষ থেকে ‘কলেজের অধ্যক্ষ ডি আন্সলেম’কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল যে, শিক্ষকরা যেন শ্রেণীকক্ষে বা এর বাইরে ‘ছাত্রদের সাথে ধর্ম বিষয়ে আলোচনা বা সমালোচনা না করেন’। ‘বিব্রতকর পরিস্থিতিতে’ পরে ডিরোজিওকে ‘মৌখিক শোকজ’ করেছিলেন ‘কলেজের অধ্যক্ষ’। এমনকি তিনি ‘কলেজের দৈনিক কার্যবিবরণীতে’ একটু খুঁত পেয়ে ‘উত্তেজিত হয়ে’ ডিরোজিওর গায়ে হাত তোলার জন্য তেড়ে গিয়েছিলেন পর্যন্ত। ‘আত্মরক্ষা করে’ সেখান থেকে সরে এসেছিলেন ডিরোজিও। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলায় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ‘ডেভিড হেয়ার’। ‘হেয়ারের’ প্রতিও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন অধ্যক্ষ। ‘হেয়ারের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি ডিরোজিওকে ‘আস্কারা’ দেন। আসলে ‘ডেভিড হেয়ার’ ছিলেন ডিরোজিওর ‘পাঠদান পদ্ধতির ভক্ত ও অন্যতম উৎসাহদাতা’। আসলে ১৮৩০ সালে ‘অ্যালেকজান্ডার ডাফ’ আয়োজিত বক্তৃতামালার প্রথম অধিবেশনের পরে থেকেই ‘হিন্দু সমাজে’ প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এর পরেই ‘হিন্দু কলেজের অভিভাবকরা’ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ‘হিন্দু কলেজের’ কিছু সংখ্যক ছাত্র কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারও কারও ‘অভিভাবক’ কলেজ থেকে তাঁদের ছেলেদের নাম পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে, আগে থেকেই ‘হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ’ ভীষণ চাপে ছিলেন।
অধ্যক্ষের তোপের মুখ হতে বেঁচে আসলেও ডিরোজিওর শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮৩১ সালের ২৩শে এপ্রিল ‘রামকমল সেন’ নামের ‘এক প্রবীন হিন্দু নেতার আহবানে’ ‘ডিরোজিওর বিরুদ্ধে বিচার সভার আয়োজন’ করেছিলেন ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ’। সেখানে ‘গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আসা ছাত্ররা’ এক জোট হয়ে ডিরোজিওর বিরুদ্ধে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ’ এনেছিলেন। ‘রাধাকান্ত দেব’-এর মত ‘রক্ষণশীল হিন্দু সমাজনেতার নেতৃত্বাধীন কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদে’ ডিরোজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছিল। সেই সভায় ডিরোজিওর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ তর্ক বিতর্ক শেষে ‘ডিরোজিও তরুণদের শিক্ষাদানের পক্ষে অযোগ্য’ প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষকদের মাঝে ভোটাভুটি হয়েছিল। ‘৬-৩ ভোটে’ ডিরোজিওর জয় হয়েছিল। কিন্তু সেই সভার ‘বাদী’ ছিলেন ‘কট্টর হিন্দু’, আর ‘বিচার’ক ছিলেন ‘রক্ষণশীলদের নেতা’, আর ‘বিবাদী’ ছিলেন ‘সংস্কারবাদী’। সুতরাং যা হবার তাই হয়েছিল। সেই বিচারে ‘ডাক্তার উইলসন’ ও ‘ডেভিড হেয়ার’ ডিরোজিওর পক্ষ নিলেও কোন লাভ হয়নি। কারণ ‘ডিরোজিওর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হিন্দুদের আকার আয়তন’ বেশ বড় ছিল। ‘রাধাকান্ত দেব’, ‘রামকমল সেন’, ‘রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘প্রসন্নকুমার’, ‘রসময় দত্ত’ এবং ‘চন্দ্রকুমার ঠাকুরের’ মত ‘হিন্দুসমাজনেতারা’ ডিরোজিওকে ‘বরখাস্ত করা’ ‘একান্ত প্রয়োজনীয়’ ‘সুবিধাজনক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘ডিরোজিওর অত্যাচারে হিন্দু ছাত্রদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্থ, নিজ ধর্মের অপমান দেখে ছাত্ররা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।’’ এমনকি এটাও বলা হয়েছিল যে ডিরোজিওর কারণে নাকি হিন্দু ছাত্ররা দলে দলে কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন! এসব দিক বিবেচনা করে ডিরোজিওকে ‘কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত’ নিয়েছিল ‘রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বাধীন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ’। কিন্তু ডিরোজিওর হাতে, সরাসরি ‘বরখাস্ত নোটিশ জারির সাহস’ তাঁদের হয়নি। তাই ডিরোজিও সম্মান করেন, এমন কাউকে খুঁজে বের করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ‘ডক্টর উইলসন’। তিনি ছিলেন ‘কলেজের পরিদর্শক’। ‘ডক্টর উইলসন’ ‘তিনটি গুরুতর প্রশ্নসহ পদত্যাগের সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে’ ডিরোজিওকে ‘কলেজের অফিসিয়াল মোড়কে’ একটি ‘আবেগমাখানো ব্যক্তিগত চিঠি’ লিখেছিলেন। প্রশ্ন তিনটি ছিল –
১) ‘ডিরোজিও তার ছাত্রদের নাস্তিকতার দীক্ষা দেন কিনা?’
২) ‘ছাত্রদেরকে পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার প্ররোচনা দেন কিনা?’
এবং
৩) ‘ভাই-বোনের মাঝে বিয়ে সমর্থন করেন কিনা?’
ডিরোজিও তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ‘উইলসনের চিঠি’ পেয়ে প্রথমে ‘পদত্যাগ’ করেছিলেন। নিজের ‘পদত্যাগপত্রে’ তিনি বেশ আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “কোন কিছু যাচাই না করে, আমার কথা না শুনে, বিচারের প্রহসনটুকুও না করেই আপনারা বরখাস্ত করেছেন আমাকে।” ২৫শে এপ্রিল ‘ডিরোজিওর পদত্যাগপত্র’ ‘কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে’ পৌঁছে দিয়েছিলেন ‘ডক্টর উইলসন’। ডিরোজিওর পদত্যাগে ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ’ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। ‘হিন্দু কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য’ ‘ডিরোজিওর পদত্যাগে’ খুশি হয়েছিলেন। শুধুমাত্র ‘শ্রীকৃষ্ণ সিংহ’ নামে এক শিক্ষক ‘ভিন্নমত’ দিয়েছিলেন এবং ‘বরখাস্তের বিষয়ে’ অখুশি হয়েছিলেন। ২৬শে এপ্রিল তারিখে ‘ডক্টর উইলসনের তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে’ বিশাল এক চিঠি লিখেছিলেন ডিরোজিও। ‘ভাই-বোনের বিয়ে’ বিষয়ে করা তৃতীয় প্রশ্নে তিনি যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এবং সরাসরি এমন ‘অভিযোগ অস্বীকার’ করেছিলেন। বাকি দু’টি প্রশ্নের তিনি ‘যুক্তি নির্ভর জবাব’ দিয়েছিলেন। ডিরোজিও বলেছিলেন, তিনি কখনই ছাত্রদেরকে ‘নাস্তিক’ বা ‘আস্তিক’ হওয়ার ‘উপদেশ’ দেন না। কেবলমাত্র ‘যুক্তি’, ‘প্রমাণ’ ও ‘পক্ষে-বিপক্ষে মতামত বিবেচনা করে সত্য অনুসন্ধানের উপদেশ’ দেন। ডিরোজিওর দেওয়া সেই জবাবের একাংশ ছিল নিম্নরূপ (অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাংলার রেনেসাঁ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত),
‘‘… ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে কোন কথা বলাই যদি দোষ হয়, তাহলে আমি দোষী। কেননা, এ বিষয়ে দার্শনিকদের সংশয়ের কথা আমি তাঁদের বলেছি – এটা স্বীকার করতে এতটুকুও ভীত বা লজ্জিত নই। কারণ ঐসব সংশয়ের সমাধানের কথাও তাঁদের সামনে তুলে ধরেছি। এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করা কি কোথাও নিষিদ্ধ? যদি তা-ই হয় তাহলে প্রশ্নটির পক্ষে বা বিপক্ষে কোন দিকেই যুক্তি দেওয়া উচিত নয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে শুধু একটি দিক হতে জানা এবং সেই দিকটির বিরোধী সবকিছু থেকে নিজেদের চোখ-কান সরিয়ে রাখা কি কোন জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? … কিছুদিন তরুণদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তাঁদেরকে ধৃষ্ট ও মূর্খ গোঁড়ামিবাদীতে পরিণত করাই কি আমার উচিত ছিল? … নিজ দায়িত্ব ভেবে কলেজের বেশ কিছু ছাত্রকে হিউম লিখিত ক্লিহেস ও ফিলোর সুবিখ্যাত কথোপকথনের সাথে পরচিত করেছি। ঐ কথোপকথনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সবথেকে সুষম ও পরিমার্জিত যুক্তিসমূহ উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু একই সাথে হিউমের বক্তব্যের যে তীক্ষ্ণ উত্তর দিয়েছিলেন ডক্টর রীড এবং ডুগান্ড স্টুয়ার্ট, তাও পড়িয়েছি। এই হচ্ছে আমার অপরাধ …।’’
‘হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার কাজে’ ইস্তফা দিলেও থেমে যায়নি তাঁর ‘জীবন সংগ্রাম’। এ সবের মাঝেই ডিরোজিও চালিয়ে গিয়েছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকা ‘সম্পাদনার কাজ’। থেমে যায়নি ‘ধর্মান্ধতা’, ‘অন্ধবিশ্বাস’ আর ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে’ তাঁর লেখালেখি। কিন্তু ‘পত্রিকার ব্যায়ভার’ বহন করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এর জন্য হেনরি একে একে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের ‘লাইব্রেরির সব বইপত্র এবং দামী আসবাবপত্র’। শেষের দিনগুলিতে তাঁকে পড়তে হয়েছিল ‘নিদারুণ অর্থাভাবে’। ডিরোজিও ‘পদত্যাগ’ করেছিলেন, ‘হিন্দু নেতারা’ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি ‘হিন্দু সমাজের’ আসলেই কোন লাভ হয়েছিল? ডিরোজিওর পদত্যাগের পর ‘রক্ষনশীল হিন্দুরা’ পড়েছিলেন মহা মুশকিলে। হাত মাত্র দু’টো। তা দিয়ে তাঁরা কান ঢাকবেন, নাকি নিজের দুইগাল স্পর্শ করে ভগবানের সামনে জিভ কাটবেন! প্রিয় শিক্ষককে কলেজ থেকে তাড়ানোর ঘটনা ছাত্ররাও মেনে নেননি, নেওয়ার কথাও না। তাই ডিরোজিওর শিষ্যদের ‘গলার জোর’ আরও বেড়ে গিয়েছিল, ‘কথাগুলো’ ‘আরও ধারালো’ হয়েছিল, ‘চিন্তাসমূহ’ হয়েছিল ‘আরও তীক্ষ্ণ’। হঠাৎ আসা এক ঝড়ে ‘হিন্দু ধর্মের সমালোচনা’ শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও যেতে শুরু হয়েছিল। ‘মত প্রকাশের পথে বাধাগুলো’ শক্তি হারাতে শুরু করেছিল। এবং ডিরোজিওর সাথে তাঁর ছাত্রদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে শুরু হয়েছিল। তখন কলকাতায় ‘ইউরোপিয়ান-এশিয়ান বংশদ্ভুতরা’ ‘সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ’ ছিলেন। ‘নিজ সম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনের কাজে’ও ডিরোজিও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সেই সময় তিনি তাঁর কিছু তরুণ হিন্দু শিষ্যকে ‘সাংবাদিকতা’ পেশা গ্রহণে এবং সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম’ ব্যবহার করে তাঁদের ‘প্রগতিবাদী ধারণাগুলি প্রচার করতে’ উৎসাহিত করেছিলেন। এই ভাবেই ১৮৩১ সালের মে মাস থেকে ‘কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দি ইনকোয়ারার’ নামে একটি ‘ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা’ এবং জুন মাস থেকে ‘দক্ষিণারঞ্জণ মুখোপাধ্যায়’ ও ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’ ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে বাংলায় (পরে ইংরেজিতেও) একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। ডিরোজিওর নির্দেশনায় সেইসব পত্রিকার মাধ্যমে ‘তরুণ প্রগতিবাদীরা’ ‘হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে’ তীব্র আক্রমণ চালিয়েছিলেন। কিন্তু ‘জীবনের পথে’ এরপরে আর বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি হেনরি ডিরোজিও। তাঁর মৃত্যু দিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল তাঁর জীবনের লড়াই।
‘ছাত্রদের উদ্দেশ্যে’ ডিরোজিও একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘Sonnet to the Pupils of the Hindu College’ শিরোনামে, যার বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ (অনুবাদের কৃতিত্ব শ্রী পল্লব সেনগুপ্ত)
‘‘না-ফোটা কুঁড়ির মতো তোমাদের মনগুলি দেখি
যখন পাপড়ি মেলে – কখনো বা সুস্মিত মধুরে
সঙ্ঘবদ্ধ ক্ষমতায় – উদ্যমে ডানা মেলে সে-কি
ছোট্ট পাখির মতো, মৃদুমন্দ গ্রীষ্মের দুপুরে
সময়ের সমীরণে – শুচিস্মিতা বৈশাখী বর্ষণে;
প্রথম প্রজ্ঞার বৃষ্টি ঝর-ঝর অযুত কণায়
নতুন ভাবনারাশি সমুজ্জ্বল সত্যের শরণে –
তোমাদের মগ্ন দেখি – লীন দেখি ধ্রুব সাধনায়
যখন, তখন আমি কী আনন্দে হই আত্মগত!
ভবিষ্য-দর্পণে দেখি সুনিপুন কালের বুননে
তোমাদের যশ্রোমাল্য গাঁথা হয়ে চলে অবিরত,
তখন তৃপ্তির ঢেউ দোলা দেয় আমার এ-মনে,
অনুভবে বুঝি তবে, ব্যর্থ নয় আমার জীবন –
কী সাফল্যে ধন্য হলো জীবনের পরম অর্জন।’’
ডিরোজিও ‘ঊনিশ শতকের শিক্ষা ক্ষেত্রে’ যে ‘নবজাগরণের ঢেউ’ এনেছিলেন, সেই ঢেউয়ের আঘাতে ‘রক্ষণশীলতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর’ ভেঙে পড়েছিল। ‘বাঙালি সমাজে’ যে নতুন আলোর সূচনা করেছিলেন তিনি, তার সুফল বাঙালি যথেষ্ট পরিমাণে পেয়েছিলেন বলেই ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালির আর্বিভাবের পথটি মসৃণ হয়েছে। আর বর্তমান সমাজে যে ভাবে ‘উগ্র ধার্মিক আবহের’ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বর্তমান সমাজে ডিরোজিওর মতো অসংখ্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
(তথ্যসূত্র:
১- ঝড়ের পাখি: কবি ডিরোজিও, পল্লব সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (২০০৯)।
২- মানুষ গড়ার কারিগর ডিরোজিও, মৃণালিনী দাশগুপ্ত, ক্যাম্প (২০১৫)।
৩- অনুবাদ-সমগ্র (সক্রেটিস-ডিরোজিও-বোদলেয়ার-র্যাঁবো-পাবলো নেরুদা), পাবলো নেরুদা, অনন্যা (২০১৪)।
৪- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী
৫- Henry Derozio: The Eurasian Poet, Teacher and Journalist, THOMAS EDWARDS
৬- বাংলার রেনেসাঁ, অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৭- ডিরোজিওর বাড়ি: নথিপত্রের আলোকে, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি।
৮- ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট ও ডিরোজিও, সফিউদ্দিন আহমেদ, বাংলা একাডেমি।
৯- ডিরোজিও এবং তাঁর কবিতা, সফিউদ্দিন আহমেদ, নান্দনিক।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত