২০১৮ সালের ২৫শে ডিসেম্বর, কলকাতা শহর যখন এক ‘যীশু’কে বরণ করে নিচ্ছিল, তখন চিরবিদায় নিয়েছিলেন আরেক ‘যীশু’, তিনি ‘কলকাতার যীশু’। তিনি ‘অমলকান্তি’, যিনি ‘রোদ্দুর’ হতে চেয়েছিলেন এবং সেই দিন তিনি ‘রোদ্দুর’ হতে পেরেছিলেন। তিনি ‘নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’। সেদিন কলকাতায় সত্যিই ‘লালবাতির নিষেধ’ ছিল না। তবু উৎসবের দিনের জমজমাট ‘নন্দন-চত্বর’, ‘সান্তা টুপিধারী’ থিকথিকে ভিড়টাও সব ভুলে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। ২০১৮ সালের সেই মঙ্গলবার, বড়দিনের সন্ধেয় এক কবির শবদেহবাহী গাড়িটা তখন ‘রবীন্দ্র সদন’ থেকে ‘বাংলা আকাদেমি ভবনের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক আশ্চর্য সমাপতনে বাঙালির ‘যিশু দিবস’-ই ‘কলকাতার যিশু’-র কবির প্রয়াণ-দিবস হিসেবে লেখা হয়ে গিয়েছিল। সেদিন দুপুরে সাড়ে ১২টা নাগাদ কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর পুত্র ‘কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী’ সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘‘নিউমোনিয়া, বুকে জল জমা, কিডনির কষ্ট – অনেক কিছু লেগেই ছিল। তবে আসল সমস্যা বয়স! কয়েক বার অসুস্থ হয়ে সামলে নিয়েছিলেন। এ বার আর হল না।’’ সেদিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ‘নিমতলা শ্মশানে’ ‘২১টি গান-স্যালুটের পরে’ কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। তার আগে বিকেলে তাঁর মরদেহ ‘রবীন্দ্র সদনে’ রাখা হয়েছিল। এর আগে, ২০১৮ সালের ২৯শে জুলাই মারা গিয়েছিলেন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু সাহিত্যিক ‘রমাপদ চৌধুরী’। বন্ধুর স্মৃতিচারণায় ‘দেশ’ পত্রিকায় নীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না। … ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’’ সেই লেখার শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘এখন একদম শয্যাশায়ী অবস্থায় আছি। আর ক্রমাগত এই কথাটা ভাবছি, আমি শিগগিরি যাব …।’’ আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘শিগগিরি’ যে অত তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তা কি নীরেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন? কারণ, সেই বছর না ঘুরতেই চলে গিয়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কি কেবলমাত্র একজন ‘কবি’ ছিলেন? না। ‘কবিতা-ছড়া’র পাশাপাশি তিনি অসাধারণ ‘বাংলা গদ্য’ লিখতেন। সব মানুষের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে কী ভাবে কথা বলতে হয়, সেটাও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। ‘নির্ভুল’ এবং ‘নিঁখুত লেখার ভাষা’ নির্মাণ করতে হলে, অনেক কিছু জানতে হয়। ‘বানান’, ‘শব্দের প্রয়োগ’ ইত্যাদি। কঠিন শব্দকেও কী ভাবে সহজের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, যার ফলে শৈলিতে একটা ঢেউ তৈরি হয়, এটা তিনি ছাড়া সত্যি সত্যি আর কেউ পারতেন না। কারণ, ভাষাটাকে তিনি ‘স্রষ্টার জায়গা’ থেকে তো বটেই ‘ভাষা-ভাবুকের’ দিক থেকেও সৃষ্টি এবং ব্যবহার করতেন। বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর নানা ধরনের চিন্তা ছিল। ছিল ‘ভাষাসংক্রান্ত’ নানান কাজকর্মও। ‘শিক্ষাবিদ’, ‘ভাষাবিদ’, ‘লেখক’ ও ‘অধ্যাপক’ ‘শ্রী পবিত্র সরকার’ তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, ‘‘সেটা আশির দশকের গোড়ার দিক। নীরেনদা তখন আনন্দমেলার সম্পাদক। কিছু দিন আগেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর অনুরোধে কুন্তক ছদ্মনামে ‘ভাষার খেলা’ লিখেছেন। আমাকে নীরেনদা বললেন, ছোটদের জন্য লিখতে। বিষয়টাও বলে দিলেন। কী ভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে হবে, সেই বিষয়েই প্রকাশিত হল ‘বাংলা বলো’। এ সব লেখা তিনি ভেবে আমাদের দিয়ে লেখাতেন। তাঁর নির্দেশেও আমরা বাংলা ভাষার নতুন নতুন কাজ করতে পেরেছি। পরে নীরেনদা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। তখন বেশ কয়েকটা ভাল ভাল অভিধান বেরিয়েছে। সবগুলোর প্রুফ নীরেনদা নিজে দেখেছেন। শুধু তাই নয়, যত্ন করে দেখে কোন শব্দ অভিধানে দরকার নেই, আর কোন শব্দ যোগ করার প্রয়োজন – সেগুলো তিনি আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিতেন। খানিকটা নেপথ্যে থেকে কাজ করলেও বাংলা ভাষা নিয়ে তার কাজ কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমিও বাংলা ভাষা এবং বানান নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু, নীরেনদার সঙ্গে কখনও মতের অমিল হয়নি। তিনি যখন আনন্দবাজারের জন্য বানান সংক্রান্ত বই সম্পাদনা করেছেন, আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বানান নিয়ে আমার যুক্তি মেনেও নিয়েছেন। কবি হিসাবে নীরেনদাকে মনে রাখবে বাঙালি। কিন্তু, বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের তো বাঙালি তেমন করে চেনে না। বিশেষ খেয়ালও রাখে না তারা। তবে, নীরেনদা গোটা কাজটা এমন পর্যায়ে গিয়ে করেছেন, তাতে বাঙালি তাঁকে এই ক্ষেত্রেও মনে রাখবে।’’
পাক্কা বাঙালি ‘বিদ্যাসাগর’ তো স্বভাবে এক দিকে ‘খাঁটি ইংরেজ’ ছিলেন। ‘শেক্সপিয়রের’ ‘কমেডি অব এরর্স’ ‘বিদ্যাসাগরের গদ্যানুবাদে’ ‘ভ্রান্তিবিলাস’, পড়লে বোঝাই যাবে না সেটা ‘বিলিতি’! ‘বিদ্যাসাগরের’ নিজের চরিত্রে দেশি-বিদেশির এমন মিলমিশ বলেই ‘বিলিতি গদ্য’ দিশি হয়ে ওঠে। কিন্তু ছোটদের পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’র ভার নিয়ে নীরেন্দ্রনাথের কাজটা ছিল আরও শক্ত। ‘টিনটিনের মূল ছবি’ তো বজায় থাকবে, তা বজায় রেখেই কেবল তাঁর ভাষার গুণে ‘ক্যাপ্টেন-টিনটিন-ক্যালকুলাস’ বাঙালি হয়ে উঠেছিল। অনুবাদে বাংলা ভাষার সীমাকে যেমন তিনি সম্প্রসারিত করেছিলেন তেমনি বাংলা ভাষার অল্পবয়স্ক পড়ুয়াদের ভাষাটির প্রতি মনোযোগী করে তোলার জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন ‘ভাষাবিদ পবিত্র সরকার’ ও ‘কবি শঙ্খ ঘোষ’কে। স্কুলে স্কুলে তখনও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতোই তেতো বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হত, আনন্দমেলার পাতায় কিন্তু প্রকাশিত হত ‘বাংলা বলো’। ‘মুখের সজীব বাংলার রীতি-নীতি’ তাই ‘আমেরিকা ফেরত’ পবিত্র সরকারের লেখার বিষয় ছিল। ওদিকে শঙ্খ ঘোষ ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে লিখতেন ‘শব্দ নিয়ে খেলা’। ‘বানানের শুদ্ধি-অশুদ্ধি বিচার’ নিয়ে এমন সহজ-গভীর বই বাংলায় দু’টি নেই। ভাষার ছন্দ-ব্যাকরণ যে ক্লাসঘরে গম্ভীর মুখে আলোচনার বিষয় নয়, তা যে বৈঠকি-মেজাজে আড্ডার উপকরণ তা বিশ্বাস করতেন বলেই তো নীরেন্দ্রনাথ নিজেও কাগজের পাতায় লিখতে সাহস পেয়েছিলেন ‘কবিতার ক্লাস’। এমন মুচমুচে ছন্দ শেখার বইও বাংলা ভাষায় দু’টি হবে না।
বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ নির্মাণের যে চেষ্টা তাঁর সম্পাদনায় ‘আনন্দমেলা’র পাতায় শুরু হয়েছিল, পরে তা সম্প্রসারিত রূপ পেয়েছিল। ‘বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন’ নামের বিধিগ্রন্থ নীরেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন। ‘ঢাকা বাংলা একাডেমী’ থেকে প্রকাশিত দু’খণ্ডের ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের’ অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। চলিতের প্রতি, পথচলতি মানুষের প্রতি তাঁর বরাবর পক্ষপাত ছিল। যখন তিনি ল কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন আজ়াদ-হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের মুক্তির ছাত্র-আন্দোলনে পুলিশি হামলা দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন রাস্তার ওপর চাপ-চাপ রক্ত, ছেঁড়া বইখাতা, চপ্পলের পাটি, ভাঙা চশমা। সেই ছাত্র আন্দোলনে পুলিশি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তরুণ ‘রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়’। ১৯৪৫-এর নভেম্বর মাসের সেই ঘটনা নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা ‘শহিদ রামেশ্বর’ দেশ পত্রিকায় পাতা জুড়ে ছাপা হয়েছিল। নীরেন্দ্রনাথের বহুশ্রুত জনপ্রিয় কবিতাগুলিতে পথ ও মানুষ মিশে যায়। সমস্ত শহর যারা মন্ত্রবলে থামিয়ে দিতে পারে সেই কলকাতার যীশুদের নানা ভাবে দেখতেন তিনি। পথের মানুষদের সম্বন্ধে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল বলেই এক সময় জীবনানন্দের কবিতায় তিনি দেখেছিলেন ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’। জীবনানন্দ কিন্তু তাঁর সমালোচনায় ক্রুদ্ধ না হয়ে ‘শ্রীনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রীতিভাজনেষু’ লিখে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগে রেখে এসেছিলেন অনুজের জন্য এক কপি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। মতভেদ হতেই পারে, সৌজন্য বজায় থাকবে না কেন!
কবিতাই তাঁর ‘মাতৃভাষা’ ছিল। তবে, খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে নানা রকমের গদ্যও লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজে মনে করতেন, ‘‘কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।’’ বলতেন, ‘‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা। যেমন কলকাতার যিশু, উলঙ্গ রাজা, বাতাসি।’’ এ প্রসঙ্গেই তিনি লিখেছিলেন,
‘‘এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।’’
আরও একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাওয়া যাক …
৮০ এর দশকে কলকাতার একটি মহিলা-কলেজের সভামঞ্চে ভাষণ দিচ্ছিলেন ধবধবে সাদা পোশাকের ঋজু এক মানুষ। ঈর্ষণীয় বাকরীতিতে প্রতি মুহূর্তে অনুপম দ্যুতির উদ্ভাস; কথায় কথায় জানালেন তিনি – ‘‘… পড়াশোনায় আমি কোনও দিন দ্বিতীয় হইনি।’’ সামান্য যতি। শ্রোতারা একটু বিস্মিত। উচ্চারিত হল পরবর্তী বাক্যটি – ‘‘অবশ্য প্রথমও হইনি কোনও দিন।’’ তুমুল হাততালি আর হাসিতে ফেটে পড়ল কলেজ-হল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের ঘেরাটোপেই। ১৯২৪ সালের ১৯শে অক্টোবর অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। নীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘… সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের রেল-ইস্টিশানটিও ছিল চব্বিশ মাইল দূরে। … বাড়ির সংখ্যা বিশ থেকে বাইশের মধ্যে। পাকা বাড়ি কুল্যে একটি। তাও দোতলা নয়, একতলা। …’’ এমন এক পরিবেশই হয়তো সে দিন প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর কবিতার এই দুই সত্তাকে রোপণ করে দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। পরে এক সময় বলেছিলেন, ‘‘যেমন বিশ্বপ্রকৃতি, তেমনি মানবপ্রকৃতি। এ-দুয়ের যোগসম্পর্ক এতই নিবিড় যে, একটায় যখন আস্থা হারাই, তখন অন্যটাতেও আস্থা থাকে না।’’ আর, হয়তো সেই কারণেই তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দেন ‘নীরক্ত করবী’, ‘উলঙ্গ রাজা’ কিংবা ‘অন্ধকার বারান্দা’। ‘‘কোনও কোনও ঘটনায় ক্রুদ্ধ না হলে লিখতেই পারি না’’ এমন সহজ স্বীকারোক্তি কিংবা ‘‘আর না, মানুষ আর না’’ কথনের পরেও সাবলীল, ‘‘ওটা আসলে অভিমানের কথা। মানুষকে বড় ভালবাসি।’’ পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ‘ছড়াকার’, ‘প্রাবন্ধিক’, ‘ঔপন্যাসিক’, ‘গদ্যকার’, ‘গোয়েন্দা-গল্পকার’, ‘শিশুসাহিত্যিক’, ‘ভ্রমণ-কাহিনীর লেখক’, ‘সম্পাদক’ এবং ‘বানান-বিশেষজ্ঞ’।
ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’ … অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল …’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায় …’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
কেবলই কথার কথা নয়। যে কোনও রকম প্রশ্নের কাছে তিনি কখনওই জ্ঞানীর দূরত্ব রাখেননি, বন্ধুর আন্তরিকতায় পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন, জানার অহমিকা নিয়ে নয়, জানানোর আনন্দ নিয়ে। মানুষের প্রতি ভালবাসাই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের কাছে। এবং ক্রমশ এরই কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক প্রতিষ্ঠানস্বরূপ।
বাংলা কবিতার যে-সময়ে তাঁর আবির্ভাব, রবীন্দ্রনাথের প্রভা ও প্রভাব থেকে তখনও এই ভাষার কবিকুল পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। অনেকেই তোড়জোড় শুরু করেছেন রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হতে, কিন্তু সফল হচ্ছেন না! ক্রমে ঘরে বাইরে বহুমাত্রিক সঙ্কট, আর সেই সঙ্কটের বাতাবরণেই যেন জন্ম হল ত্রিশ-পরবর্তী কবিকুলের। নীরেন্দ্রনাথেরও। তাঁর কলমে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের জন্য প্রত্যক্ষ হুঙ্কার হয়তো ছিল না, কিন্তু ছিল মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্য অপরিসীম ভালবাসা। আর এতেই যৌবন পেরনোর আগেই হয়ে উঠলেন খ্যাতিমান, জনপ্রিয়, সাহিত্যের প্রিয় জন। একেবারে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, চার পাশের দেখা-জানা জগৎ, কথা বা কাহিনিতে মানুষকে জড়িয়েই তাঁর কবিতা। অনেকটাই গল্পের প্রকৃতিতে রচিত ‘বাতাসী’, ‘হ্যালো দমদম’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’, ‘স্বপ্নে দেখা ঘর-দুয়ার’ বা ‘কলঘরে চিলের কান্না’-র মতো অজস্র কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে আজ ইতিহাস করে দিয়েছে।
দীর্ঘকায় মানুষটির কাজের খতিয়ানও কম দীর্ঘ নয়! শিক্ষা-শেষে শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতার কাজ। ‘প্রত্যহ’, ‘মাতৃভূমি’, ‘অ্যাডভান্স’, ‘ভারত’, ‘কিশোর’, ‘সত্যযুগ’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় কাজের পর ১৯৫১-তে আনন্দবাজার সংস্থায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথকে দেখা গেল তুখড় সাংবাদিক হিসেবেই। আড্ডা-আলাপে বৈঠকি বাঙালির রসবোধে টইটম্বুর, সভায়-সমাবেশে স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা। ক্রিকেট ও ফুটবল-পাগল মানুষটি যৌবনে খেলার মাঠে যতখানি ক্ষিপ্র, ঠিক ততখানিই তাঁর ক্ষিপ্রতা, যখন তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সম্পাদক। কঠিন সম্পাদক কিংবা কোমল মানুষ ছাড়াও নীরেন্দ্রনাথের আরও বহু কাজের জন্য শুধু বাংলা কবিতার মানুষ নন, বাংলাভাষার প্রত্যেকেই চিরকাল ঋণী থাকবেন হয়তো। বাংলা ভাষার বানানরীতি ও সাধারণ-মান্য ব্যাকরণের ভাবনায় তিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’ কিংবা সম্পাদক ও লেখকদের জন্য একটি অভিধান রচনা ও সঙ্কলন তার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বা ‘কবিতার কী ও কেন’ বই দু’টিও কবিতার অনুরাগীর কাছে মূল্যবান। বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি সর্বজনবিদিত। অনুবাদের ক্ষমতা ছিল আশ্চর্য, বিশেষ করে ছোটদের জন্য অনুবাদের বেলায় তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভার বিকাশ আজও অবাক করে দেয়। তাঁর কর্মজীবন আমাদের জানায় যে, বেহিসেবি, অলস, আপনভোলা, উদাসীন জাতীয় নানা অভিধায় কবিকুল চির দিন চিহ্নিত হলেও, সে অভিধাই শেষ কথা নয়।
‘মোহনবাগান’-এর গোঁড়া ভক্ত নীরেন্দ্রনাথ ‘তাসের (ব্রিজ) নেশায়’ ছিলেন মশগুল। আবার, এই সমুদ্রভক্ত মানুষটি বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্ব করতে বহু বার পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে, ‘ভারত উৎসবে’। হয়তো সে কারণেই ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান-প্রতিম। ‘অন্নদাশঙ্কর রায়ের’ মৃত্যুর পর ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতির পদে’ তাই তাঁকেই দেখা গিয়েছিল। দেখা গিয়েছিল সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মানুষ তাঁকে বার বার টেনেছিল। ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ (’৭৪), ‘আনন্দ পুরস্কার’ (’৭৬), ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (’৯৬), প্রভৃতি অজস্র সম্মানে বাংলা ও বাঙালি তাঁকে ভূষিত করেছে তাঁর নানাবিধ সাহিত্যকীর্তির জন্য। মৃত্যুর আগে পেয়েছিলেন ‘বঙ্গবিভূষণ’।
তিন গুণী সন্তানের পিতা এই কবিই লিখেছেন অজস্র গদ্য, তা সে ‘কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ গান শোনার অভিজ্ঞতাই হোক বা ‘সত্যজিতের’ চিত্র-আলোচনা। লিখেছেন অজস্র গ্রন্থসমালোচনা, প্রথম জীবনের আত্মকাহিনী ‘নীরবিন্দু’, একাধিক রহস্য উপন্যাস। ছড়া ও কবিতায় শিশু মনের হালকা দুয়ার হাতের হালকা চাপে সরিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ছোটদের ‘এক আশ্চর্য পৃথিবী’।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মনে করতেন, ‘‘কঠিন ভাষা যাঁরা বলে, শোনে ও বোঝে, সহজ ভাষা বলে শোনে ও বোঝে তার চতুর্গুণ মানুষ। আর তাই আমার কবিতা যদি অনেক লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় তো ভাষার স্তর নির্বাচনে কোনও ভুল করলে আমার চলবে না, সহজ বাংলার জনপথ ধরেই আমাকে হাঁটতে হবে।’’ ‘কবি’, ‘লেখক’, ‘অনুবাদক’, ‘সম্পাদক’, ‘বাংলা ভাষার নীতি-নির্ধারক’ হিসেবে তিনি যা কিছু করেছেন তার মূল নীতিই ছিল লেখা ‘‘আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’’
বাংলা ভাষার কর্মীদের প্রধান কাজ যে আরও অনেকের কাছে পৌঁছে যাওয়া এই ভাবনা ঊনিশ শতকে বাংলা ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই দৃঢ় হয়েছিল। ‘বাঙ্গালার পাঠক পড়ান ব্রত’ নামের অস্বাক্ষরিত লেখায় বঙ্গদর্শন পত্রে মন্তব্য করা হয়েছিল – ছাপাখানা আসার আগে কথকেরা পড়তে-না-জানা মানুষের কাছেও বলার গুণে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিতেন, এখন লেখক সম্পাদকের দায়িত্ব পড়তে-জানা-মানুষদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। ‘আনন্দমেলা’-র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পাঠকদের রুচি গড়ে তুললেন। এখন পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যবর্তী যে বাঙালিরা বিশ্বের নানাখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাঁদের অনেকেই এই পত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষায় মজেছেন। বাংলা শিশু-কিশোর পত্রিকার আদিপর্বের অনেক পত্রের মতো এটি পারিবারিক পত্রিকা ছিল না, কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় সাহিত্য পত্রিকাটিকে ছড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ পাঠক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মধ্যবিত্ত সেই বামশাসনের প্রথম পর্বে খানিক স্থিতিশীলতার মুখোমুখি। এই মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের পাঠ-চাহিদাকে ‘নীরেন্দ্রনাথ-সম্পাদিত আনন্দমেলা’ যেমন পূর্ণ করেছিল, তেমনই তাদের পাঠ-পরিধিকে সম্প্রসারিত করেছিল। ‘অহিভূষণ মালিক’ ছিলেন নীরেন্দ্রনাথের ‘সত্যযুগ’ পর্বের বন্ধু। ‘আনন্দমেলা’-র পাতায় অহিভূষণ ‘নোলেদা’কে নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে ছবিতে গল্প লিখেছিলেন, ‘নোলেদা’র মুখের সঙ্গে অহিভূষণের আঁকা ‘ঘনাদা’রও অনেক মিল। ‘নোলেদা’ এক্কেবারে উত্তর-কলকাত্তাইয়া দাদার দুষ্টুমিতে ভরা। বাংলা জানা সাহেবকে মুখের বাংলা বলে কাত করে, ‘পেলেদা’কে বলে বলে গোল খাওয়ায়। তবে ‘আনন্দমেলা’-কে কলকাতা উত্তরেই আটকে রাখতে চাননি সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ। ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম কিশোর উপন্যাস’ ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ যে রহস্যময় রংদার মফস্বলের ধারণা সৃষ্টি করেছিল সেই মফস্বলেও ‘আনন্দমেলা’ গোগ্রাসে পড়ত পাঠকেরা। এই প্রসঙ্গে ‘সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি স্মৃতিচারণ’ অবশ্য উল্লেখ্য। সাহিত্যিক ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’ তখন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় সবে চাকরি করতে ঢুকেছিলেন। কিন্তু কোনও দিনই সময়ে লেখা দিতে পারতেন না। এটাকে তিনি নিজের একটা ব্যর্থতা বলে তিনি কোনদিনই অস্বীকার করেননি। এরপরে একদিন তিনি পড়লেন ‘আনন্দমেলা পত্রিকার সম্পাদক’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পাল্লায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যে – ‘‘নীরেনদা সোজা একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর সিগারেটের প্যাকেট ও একটা চায়ের ফ্লাস্ক রাখলেন। চোখ পাকিয়ে বলে গেলেন, ‘লেখা না পেলে ছাড়া পাবি না।’ দেখি সত্যি সত্যি যাওয়ার সময় ঘর তালাবন্ধ করে দিচ্ছেন!’’ সেদিন সত্যিই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সটান ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’কে দিয়ে। নিজের অনুজসম অধস্তন লেখককে বকাঝকা নয়, হুমকি নয়, এমনকি ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে নালিশও নয় – কিন্তু এভাবে লিখিয়ে নিতে ক’জন পারেন?
সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্র নামের মাধ্যমটির যে দলাদলি নেই গলাগলি আছে সম্পাদক হিসেবে তা বিশ্বাস করতেন বলেই ‘গুপী বাঘার গান’ ছাপা হয়েছিল আনন্দমেলার পাতায়। ‘শরদিন্দু’র ‘সদাশিব’ ‘তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য’য় ‘বিমল দাসের ছবিতে’ হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। কিশোর-কিশোরীদের জন্য পত্রিকা চালাতে গেলে যে শুচিবায়ুগ্রস্ত হতে নেই, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদার হতে হয় এই কাণ্ডজ্ঞান তাঁর ছিল। তাই বিদেশি ‘টিনটিন’কে বাঙালি করে তুলতেও এই পত্রিকা দ্বিধা করেনি। সেই কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বয়ং সম্পাদক।
এইভাবেই পথ চলতে চলতে একদিন এসেছিল তাঁর বিদায়বেলা। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে কবি শঙ্খ ঘোষ শোকবার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন,
‘‘জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়। সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত সেই কবি চলে গেলেন আজ। তাঁকে আমাদের প্রণাম।’’
মুখে ও মুদ্রণে বাঁচে ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান তার পরম্পরায়। এই দু’ভাবেই বেঁচে থাকবেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বেঁচে থাকবেন, বাংলা কবিতার মানুষ যত দিন বাঁচবে। কেননা, তিনিই তো বলেছেন তাঁদের,
‘‘বেঁচে থাকো, যে আছ যেখানে
বেঁচে থাকো।
যেমন করেই হোক,
মরতে-মরতে জোড়া-পায়ে মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে
বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।’’
বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি ‘রোদ্দুর’ হয়ে রয়ে গেলেন। তাঁর ‘কবিতার রোদস্পর্শ’ আমাদের ছুঁয়ে যাবে, কিন্তু তাঁকে আর ধরা যাবে না!
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন: আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহার বিধি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
২- কবিতার কী ও কেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নবযুগ প্রকাশনী (২০১৬)।
৩- কবি চেনে সম্পুর্ণ চেনে না, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দে’জ পাবলিশিং।
৪- দেশ পত্রিকা, ২রা জানুয়ারি ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত