‘উত্তরবঙ্গের চাঁচোল’। শিবরাম তখন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র। সেই সময়টায় দেশ জুড়ে চলছিল ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার’। স্কুলে মাস্টারমশাই ক্লাসে প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছিলেন – ‘‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’’ ছাত্রদের কেউ লিখেছিলেন ‘ডাক্তার’, কেউ লিখেছিলেন ‘উকিল’। কিন্তু শিবরাম লিখেছিলেন, ‘‘দেশপ্রেমিক হতে চাই।’’ উত্তর পড়ে শিক্ষক অবাক হয়েছিলেন! স্কুল শেষে এক বন্ধু – ‘সতীশ’ তাঁকে আড়ালে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তুই দেশপ্রেমিক হতে চাইলে আমাদের দলে নাম লেখা। আমিও বিপ্লবী, আমার মতো দেশের কাজ করবি।’’ এরপরে শিবরাম যোগ দিয়েছিলেন সেই বিপ্লবীদের দলে। সেই দলে ছোটদের কাজ ছিল ‘গোপনে চিঠি আর অস্ত্র দেওয়া নেওয়া করা’, যাতে পুলিশ সন্দেহ না করে। তারপরে একদিন শিবরামের ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল এক সাহেবকে গুলি করে হত্যা করার। তা’ও আবার এক বিশাল সভার মাঝে। কিন্তু তার জন্য পিস্তল আর গুলি লাগবে যে! সেই ব্যবস্থাও হয়েছিল। অপেক্ষা ছিল একটা পার্শেলের। ‘‘অবশেষে একদিন পার্শেলটা এল। স্কুলের পথে পোস্টাপিসে খবর পেয়েই মামার নামের ফর দিয়ে ফরফরিয়ে আমার সই করে সেটার ডেলিভারি নিয়েছি। সটান চলে গেছি ইস্কুলে-সিঙ্গিয়ার আমবাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে। বাংলার সার সীতানাথবাবু ততক্ষণে এসে গেছেন ক্লাসে। পার্শেলটা দেখেই না লাফিয়ে উঠেছে সতীশ। অবশ্যি, বসে বসেই যতটা লাফানো যায় সারের নজর বাঁচিয়ে। ‘কী আছে রে ওতে?’ জানতে চেয়ে ফিসফিসিয়েছে পাশের ছেলেটি। ‘ডিকসনারি।’ ফাঁস করেছি আমি। ‘দেখবি নাকি? দেখতে চাস? খুলব?’ শুনেই সে আর দ্বিরুক্তি করেনি, দ্বিতীয় বার তাকায়নি সেদিকে–নাড়ানাড়ি করা দূরে থাক। খানিক বাদে বলেছে, ‘বিয়ের আগে কোনো নারীঘটিত ব্যাপারে থাকতে নেই ভাই! বি এ পাশ করার আগে কি কেউ ডিকসনারি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে?’ ‘নারী আর ডিকসনারির মধ্যে মিলটা কোনখানে?’ আমি জানতে চেয়েছিলাম। ‘নাড়ির সম্বন্ধ নেই?’ তার পাল্টা জিজ্ঞাসা। আমাদের ভেতরে সে একটু পরিপক্ক বলতে হয়, কেননা তার পুরুষ্টু গোঁফ বেরিয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল দিন কতক আগে। (তখনকার দিনে পাড়াগাঁয়ে বাল্যবিবাহ চালু ছিল বেশ) হয়ত সেই কারণেই ডিকসনারি নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা সে পছন্দ করেনি। আমি আর সতীশ আর কথা না বাড়িয়ে পিরিয়ড শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। তারপরে পিরিয়ড কাবার হতেই স্কুল পালিয়ে সতীশ আর আমি চলে গেছি আমবাগানে পিস্তলের তাক বাগাতে। ছায়াচ্ছন্ন নিরালা এলাকায় খোলা হল পার্শেল। তিনটে পিস্তল এবং আরো কতকগুলো কী যে দেখা গেল তার ভেতরে! ‘তিনটে কেন রে?’ শুধালাম আমি সতীশকে। ‘এর একটা তোর, একটা আমার। তৃতীয়টা কার জন্যে কে জানে?’ ‘কেন, তুই জানিসনে?’ ‘লীডার জানে। বলেনি সে আমায়। আমিও জানতে চাইনি। সেরকম চেষ্টা করাও অন্যায়। শুধু জানিয়েছিল যে তিনটে আসবে মোটমাট।’ ‘আর এগুলো সব কি রে?’ ‘কার্তুজ। আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যে।’ ‘এত কার্তুজ?’ ‘লাগবে না? সহজে কি কারো নিশানা দূরস্ত হয় নাকি? অবশ্যি প্র্যাকটিসের পরেও বেঁচে যাবে এর অনেক। পরে সেগুলো কাজে লাগাব আমাদের।’ আমাদের কিংবা আমাদের দলের। ‘সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি প্র্যাকটিস করতে আসবে না?’ ‘তার হাত দূরস্ত আছে–আগের থেকেই। তাছাড়া সে যে কে তাও আমি জানিনা। লীডার আমায় জানাননি। টের পাবো সেই অ্যাকশনের দিন। কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পেলেও হয়ত তাকে দেখতে পাব না।’ মনে হোল বলতে গিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস যেন সে চাপল। তিন তিনটে ঝকঝকে পিস্তল! বেশ দেখতে কিন্তু। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। তাকিয়ে দেখার পর তাক করে দেখতে লাগি তারপর। হাত তৈরি হবার পর সতীশ একদিন এসে জানাল – ‘এই শোন! আমাদের কষ্ট করে সদরেও যেতে হবে না আর। ম্যাজিস্ট্রেট কি পুলিস সাহেবকে জেলায় গিয়ে মারতে হবে না। এখানেই আসছেন তাঁরা কদিন বাদে আর।’ ‘তাই নাকি?’ আমি জানতে চাই – ‘কেন আসছে রে?’ ‘দুজন না হলেও ওদের একজন তো আসবেই নির্ঘাত। খবর পেয়েছে আমাদের লীডার।’ ‘ইস্কুল ভিজিট করতে বুঝি?’ ‘তা নয়। মীটিং করতে এখানে। বিলেতে যুদ্ধ বেধেছে না? বাংলাদেশে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হচ্ছে সেইজন্যে। তার সোলজার রিক্রুট করতেই তাঁরা আসছেন। ইস্কুলের ছেলেদের কি এখানকার যুবকদের কেউ সেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে চায় যদি।’ বেঙ্গল রেজিমেন্ট? হ্যাঁ, দেখেছি বটে কাগজে। স্কুল-কলেজের অনেক ছেলে সৈন্যদলে নাম দিয়েছে তাও জানি। ‘এখন, আমাদের প্ল্যানটা কিরকম হবে শোন্। সভাটা হবে স্কুলের মাঝখানে ড্রিল মাঠে সামিয়ানা খাটিয়ে–যেমনটা হয়ে থাকে ফি বছর প্রাইজ বিতরণ উৎসবের সময়। তবে এবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিস সাহেব আসছেন না? তাই এবার আরো জমকালো হবে সভাটা।’ ‘তা তো হবেই। সে আর বলতে হয় না।’ ‘যেমন হয়ে থাকে, সভার একধারে হবে ডায়াস–সেখানে চেয়ার সাজিয়ে বসবেন ঐ সাহেবরা, গাঁয়ের গণ্যমান্য যতো লোক, রেকটার, হেডস্যার আর মাস্টার মশায়রা, এমনি আমার আন্দাজ। আর তার সামনে সারি সারি পাতা বেঞ্চে বসব শুধু আমরা যত ছাত্ররা। ফি বছর বসে যেমন। তার আন্দাজে আমার ঢিল ছোঁড়া। তুই বসবি গিয়ে একেবারে সামনের সারিতে, বুঝেছিস। পকেটে গুলিভরা পিস্তল নিয়ে। আর আমি বসব ঠিক তোর পেছনে–কয়েক সারি পিছনে–আমার পকেটেও থাকবে পিস্তল।’ ‘তোর পিস্তল কিসের জন্যে রে! তুই কাকে মারবি আবার?’ আমি ভেবে পাই না, ‘ও বুঝেছি। পাছে আমার হাত কাঁপে, তাক ফসকে যায় যদি–তাকে শেষ করার জন্যেই বুঝি তুই …? মানে, আমার লক্ষ্য তেমন ঠিক হয়নি এখনও তোর ধারণা?’ ‘না, না, সেজন্যে নয়।’ সে বলে – ‘তাক কেন ফসকাবে তোর? তোর নিশানা অব্যর্থ। আমি দেখেছি। না, সেজন্যে নয়’ … ‘তবে কিসের জন্যে? তোর পিস্তল আবার কেন তাহলে?’ ‘তোর জন্যেই রে।’ বলে সে একটুখানি হাসে। তার হাসিটা আমার তেমন ভালো লাগে না। হেঁয়ালীর মতই লাগে কেমন! আমার জন্যে তার মানে? আমার পিস্তল তো রয়েছেই, তার ওপরে আবার কেন? আমারটা যদি কোন কারণে জ্যাম হয়ে যায়, যথা সময়ে গুলি না বেরয় যদি? ‘তোর পিস্তলটা যেমন তোর জন্যে, আবার ওই সাহেবটার জন্যেও যেমন, আমার পিস্তলটাও সেই রকম আমার জন্যেও-ফের আবার তোর জন্যেও তেমনি।’ ‘আমার জন্যও তেমনি? তার মানে?’ ‘তা আমি বলব না। মানা আছে বলবার।’ বলে সে একটুখানি ঢোঁক গেলে – ‘সব কথা কি সবাইকে সব সময় বলা যায়?’ ‘আমি কি সবাইকার মধ্যে হলুম? আমি তোর বন্ধু না?’ ফোঁস করে উঠি, ‘এক পার্টির ছেলে না আমরা?’ ‘বলতে পারি। গোপনে। কাউকে বলবি না বল?’ ‘বলব নে? এসব কথা কি বলাবলির?’ ‘যক্ষুনি তুই পুলিস সাহেবকে গুলি কবি, আর সে পড়ে যাবে-সেই মুহূর্তেই তোকে গুলি করতে হবে আমায়। বুঝেছিস? লীডারের এই হুকুম।’ ‘আমাকে মেরে ফেলবি! তুই!’ তার পিস্তলের তাক হবার আগেই যেন আমার তাক লেগে যায়। ‘আমি না মারলেও তোকে তো মরতেই হবে–তা কি তুই জানিসনে? গুলি করার পরই তো ধরা পড়ে যাবি। পুলিসের হাতে ধরা পড়বি তুই। চেনা ছেলে, সবাই তোকে চেনে, পালাবি কোথায়? আর ধরা পড়লেই তোর ফাঁসি হবে। হবে না?’ ‘তা হবে। তা হবে বটে।’ আমতা আমতা করে মানতেই হয় আমায়। ‘কিন্তু তাই বলে ফাঁসি যাবার আগেই … এই ভাবে মারাটা … মারা যাওয়াটা …’ আমার কথা আটকে যায়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে কি একটা যেন ঠেলে উঠতে থাকে। কান্নাই নাকি? ‘সেই তোকে মরতেই হবে। সেই মরবি কিন্তু পুলিসের হাতে অনেক মারধোর খেয়ে, অনেককে মেরে তার পরে মরবি-তার চেয়ে আগেই খতম হয়ে যাওয়াটা কি ভালো নয়? তোর পক্ষেও ভালো, দলের পক্ষেও।’ ‘দলের কাকে আমি মারতে যাচ্ছিলাম! কাউকেই তো চিনি না আমার দলের।’ ‘ধরা পড়ার পর থানায় নিয়ে পুলিস যা বেধড়ক মার লাগাত না, পুলিসের সেই পিটুনির বহর তো জানিসনে … জানলে তুই ঢের আগেই মরতে চাইতিস–নিজেকেই নিজে গুলি করে মরতিস। কিন্তু তখন আর সে উপায় নেই তোর। লেট হয়ে গেছে।’ ‘খুব মারে বুঝি পুলিস? থানায় নিয়ে গিয়ে খুব কষে ঠ্যাঙায়?’ ‘মারে না? নখের মধ্যে পিন ফুটিয়ে দেয়, কম্বলে মুড়ে রামধোলাই লাগায়, ঠ্যাং বেঁধে কড়িকাঠে লটকে ঝুলিয়ে রাখে …।’ ‘এই উলটো ফাঁসিটা কেন? আগের থেকে আসল ফাঁসির মহড়া দিয়ে রাখতেই নাকি?’ ‘কষে চাবকাবার জন্য, আবার কেন? তারও পরে আরো আছে … ন্যাংটো করে বরফের চাপড়ার ওপরে শুইয়ে রাখে …’ ‘ন্যাংটো করে? না না, ন্যাংটো হতে আমার ভালো লাগে না একদম। প্রবল আপত্তি আমার খালি গা হতে। লজ্জা করে ভারী।’ ‘তোর আপত্তি তারা শুনছে কি না। কারো লজ্জাফজ্জার ধার ধারে কি না তারা!’ সতীশ বেআবরু করে। ‘কেন, খালি গা হতে লজ্জাটা কিসের তোর? আমরা তো হেসটেলের ছেলেরা কেউ কেউ ফুটবল খেলার শেষে সন্ধ্যেবেলায় এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ি গিয়ে-পাড়ের ওপর প্যান্ট-শার্ট সব খুলে রেখে-খালি গায়ে সাঁতার কাটি কেমন আমাদের কই লজ্জা করে না তো।’ ‘আহা, তোর মতন শরীর হত যদি–দেখাবার মত অমন-আমারও খালি গা হতে লজ্জা করত না তাহলে, ইচ্ছেই করত বরং। কিন্তু দেখছিস তো এই প্যাঁকাটির মতন চেহারা, হাড় বার করা জিরজিরে এই শরীর নিয়ে কেউ কি কারো সামনে খালি গা হতে চায়?’ ‘সে আমি জানি না ভাই, তবে শোয়বেই ওরা বরফের চাঙাড়ে। এবং একেবারে দিগম্বর করে- কিছুতেই ছাড়বে না। যার যা দস্তুর। বরফের ওপর শুতে কেমন লাগে জানিস?’ ‘খেতে তো ভালোই জিনিসটা, শুতে কেমন কে জানে! কখনো তো শুয়ে দেখিনি। দেখতে পাবি বেঁচে থাকলে। টের পাবি হাতে হাতে তখন। দেখতে চাস নাকি?’ ‘না, কিন্তু শোয়াতে যাবে কেন তারা? তাতে লাভ তাদের? তারা তো সোজাসুজি নিয়ে আমায় ফাঁসিতে লটকে দিলেই পারে। শেষমেস তাই যখন লটকাবে, লটকাবেই ছাড়বে না, তখন তার আগে মড়ার ওপর এত খাঁড়ার ঘা মারাটা কিসের তবে?’ ‘কনফেসন আদায় করতে তোর। তোর দলে আর কে কে আছে তাই জানবার জন্যেই’ … ‘দলের কাউকেও তো আমি জানি না ভাই! কী জানাব? কার নাম করবো?’ ‘আমাকে তো জানিস। যন্ত্রণার চোটে আমার নামটা বলে দিবি নিশ্চয়। না বলে পারবি না। পার পাবি না। তখন তারা আমাকে পাকড়ে নিয়ে গিয়ে ওই সব কাভই করবে আবার। মারের চোটে আমিও বলতে বাধ্য হব তখন-যার নাম জানি তার। এই করে করে শেষ পর্যন্ত গোটা দলটাই ধরা পড়ে যাবে আমাদের। সেই কারণেই তোকে এই অঙ্কুরেই বিনাশ করা।’ শুনে আমি গুম হয়ে যাই। অঙ্কুরিত কিনাশের সম্মুখে প্রস্ফুটিত হবার কোনো উৎসাহ পাই না। সে কিন্তু গুমরে ওঠে তার পরেই – ‘পার্শেলের মধ্যে মোট তিনটে পিস্তল ছিল, মনে নেই তোর?’ ‘হ্যাঁ, ছিল তো। বেশ মনে আছে।’ ‘তার মানেটা কী জানিস?’ বলে সে একটুখানি থামে – ‘অকালে মরার জন্যে মন খারাপ করছে তোর? মনে কোনো দুঃখ রাখিসনে। কিচ্ছু ভাবিসনে। আমিও তোর সহযাত্রী ধরে নে না! তোর পরে আমিও হয়ত এই পৃথিবীতে আর থাকব না। ওই তৃতীয় পিস্তলটি, মনে হচ্ছে আমার জন্যেই হয়ত।’ ‘তোর জন্যে? তার মানে?’ অন্য আরেক ধাঁধার সামনে আমি বাধা পাই আবার। ‘মানে, সেদিন হয়ত কে জানে, সেখানেই আর কেউ অমনি বসে থাকবে আমার পেছনে আমাকে মারবার জন্যে তাক করে! সঙ্গে সঙ্গে সাফ করে দিতে আমায়। কেউ বলতে পারে?’ ‘তোদের লীডার না কি? না অন্য কেউ?’ ‘কী জানি কে? আমি কী জানি?’ ‘নিজের মধ্যে এই খুনোখুনি? না ভাই, ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালো লাগছে না।’ ‘যাই বল তুই। ভালো লাগালাগির কথা নয় তে, দলের কানুন। যে বিয়ের যা মন্তর বলে না? তাই।’ …’’ এরপরে শিবরাম ভেবেছিলেন, ‘‘অমন দুর্ধর্ষ জার্মান ফৌজ য়ুরোপ জুড়ে অতো লড়াই করেও যে ইংরেজদের মেরে ফৌত, করতে পারছে না, আমরা মুষ্টিমেয় বালক এখানে সেখানে তাদের এক আধটাকে কখনো সখনো খতম করে কি করে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিকেশ করব তা আমার হিসেবে আসেনা। আর সেই হেতু অকারণে অকালে এভাবে আমাদের নিজেদের হতাহত হওয়াটা একেবারের ভালো লাগে না আমার। তাছাড়া এই খুনোখুনি কাণ্ডে একটুও প্রবৃত্তি হয় না, সত্যি বলতে। কিন্তু কী করা যায় …’’ স্কুলের সেই সভাটা ছিল কোন এক শনিবারে। শিবরাম তখন নিজের মতিগতির হদিশ নিজেই করতে পারছিলেন না। তাঁর বিপ্লবী এবং শহীদ হবার … ‘‘মাঝপথে আমার গাইড সতীশ। যে মাঝখানে এসে হানা দেয় – ‘তৈরি আছিস তো শিবু? আসছে হপ্তাতেই সেই সভাটা। পুলিস-সাহেব আসবেন আমি খবর পেয়েছি। খতম করতে হবে তাকে। মনে আছে!’ ‘সেই মুহূর্তে আমাদেরকেও তো সেই সঙ্গে–? পরের খতমের সঙ্গে নিজের ক্ষতিটা না খতিয়ে আমি পারি না-কিন্তু যাই বল্ ভাই, কিছুতেই আমার মন টানছে না ওদিকে।’ ‘না টানলেও তোর রক্ষে নেই। আমাদের কারোই রক্ষে নেই। করতেই হবে তোক। নইলে আমাদের পার্টিই তোকে খতম করে দেবে। রেহাই পাবিনে, মনে রাখিস।’ ‘সে কথা কি ভুলবার? আমি বলি-অহরহই মনে রয়েছে আমার।’ ‘যেমন ঢিলে শার্ট পরে ইস্কুলে যাস তেমন যাসনে যেন সেদিনটায়। ভারী কোট পরে যাবি, তাহলে তোর পকেটের পিস্তলটা কারো নজরে পড়বে না। তৈরি থাকিস, আমি এসে ঠিক সময়ে নিয়ে যাব তোকে। আমার সঙ্গে প্যান্ডেলে যাবি, ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব, বুঝেছিস? এই শনিবার, মনে রাখিস।’ তার গলায় যেন অশনির আওয়াজ পাই। মনে মনে ভয় খাই। এদিকে শনিবার শনৈ শনৈ এগুতে থাকে।’’ এরপরে ‘শনিবারের সেই মারাত্মক দিনক্ষণ’ এসেছিল। ‘ভারী কোট পরে, তার ওপরে পিস্তলের ভারে জর্জর, ভারিক্কী হয়ে বসে’ অপেক্ষা শিবরাম করছিলেন – তাঁকে ‘অকুস্থলে অকুক্ষণে’ নিয়ে যাবার জন্যে যথা সময়ে সতীশ এসে হাজির হয়েছিল ‘‘… ‘তৈরি?’ ‘হ্যাঁ, ভাই।’ ‘দেখি কেমন তৈরি!’ বলে সে আমার পকেট হাতড়ে পিস্তলটা বার করে পরীক্ষা করল – ‘গুলি ভরে নিয়েছিস দেখছি।’ বেশ। তার পিস্তলটাও বের করে দেখালো – ‘আমায় আমারটাও ভর্তি। দেখেছিস!’ আমি আর দেখতে যাই না, নীরবে এগুতে থাকি ওর সঙ্গে। ‘এই হপ্তাতেই কলকাতায় তোর জীবনী বেরিয়ে যাবে-জানিস? আমাদের অমর শহীদ সিরিজে।’ যেতে যেতে সে জানায়। ‘আমার লাভ? আমি তো আর দেখতে পাচ্ছি না।’ ‘তা পাবি না বটে, সে কথা ঠিকই, তবে জেনে যা-ক্ষুদিরাম, কানাইলালের সঙ্গে একাসনে স্থান পাবি–এক সাথে নাম উচ্চারিত হবে তোর।’ ‘আমার জীবনী? লিখতে গেল কে? আমি যে নিজেই কিছু জানি না আমার জীবনের।’ বলে আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ি আমার জীবন তো শুরুই হয়নি, এখনো। … ‘পরলোকে পাড়ি দিতে চলেছি? আমার জীবন কাহিনী তোরা জানলি কি করে?’ ‘জানিনে আমরা? এতদিন একসঙ্গে আছি, দেখছি তোকে, জানিনে? তারপর তোর বাবার পদ্যের বই থেকেও কিছু নেওয়া, কিছুটা বানিয়ে দেওয়া। কে লিখেছে বলছিস? স্বয়ং আমাদের লীডার। লেখার বেশ হাত আছে তার।’ ‘আমার জীবনী লেখা হয়েছে এতদিন জানাসনি তো আমায়?’ ‘কবে লেখা হয়ে গেছে! ছাপাও শেষ, এখন শুধু বেরুনোর অপেক্ষায়। তোর ঐ কাটার পরেই ছাড়া হবে বাজারে। জানাইনি আগে বটে, তবে এখন, যাবার আগে কথাটা জেনে আনন্দ হচ্ছে না?’ ‘আনন্দ? জেনে আমার কিসের সুখ ভাই! অমর শহীদ হবার কোনোই সান্ত্বনা আমি পাই না।–লাভটাই বা কী আমার, বল?’ ‘তোর লাভ নয়, আমাদের লাভ। আমাদের পার্টির লাভ। কী লাভ, কেমন করে লাভ, বলছি শোন। বইটা বাজারে পড়তে না পড়তেই তো সরকার থেকে বাজেয়াপ্ত হবে, তল্লাসী করে তার কিছু কিছু বই এখানে সেখানে পেয়ে নিয়ে যাবে পুলিস। কিন্তু বেশির ভাগ বইয়েরই কোনো হদিশ মিলবে না। তখন সেইসব বই লুকিয়ে ছাপা হতে থাকবে আরো। এডিশনের পর এডিশন। আরো আরো লাভ।’ ‘তোর জীবনীও কি আমার সঙ্গে বেরুবে নাকি আবার?’ আমি জিগ্যেস করি। ‘বের হতেও পারে, টের পাইনি এখনো। লীডার কিছু বলেনি আমাকে।’ …’’ এরপরে ‘যথা সময়ে যথাস্থানে গিয়ে যথাযথ’ বসেছিলেন তাঁরা। ডায়াসের সামনের সারিতে শিবরাম, আর তাঁর ঠিক দু সারি পিছনে তাঁর উপরে নজর রেখে সতীশ। শিবরাম দেখেছিলেন কোটের পকেটে হাত পুরে রেখে সতীশ বসে আছে। শিবরামও তাঁর মতই পকেটের ভেতরে পিস্তল পাকড়ে বসেছিলেন। স্কুলের সেই সভায় সদর থেকে পুলিস সাহেব এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক পদস্থ সৈনিক। শিবরামের স্কুলের বন্ধু ‘কাবিল হোসেন’ তাঁকে বলেছিলেন – ‘‘হাবিলদার-টাবিলদার হবে কেউ।’’ শিবরামের ঠিক পাশেই বসেছিলেন কাবিল। কথায় বলে বিপদে পড়লে মাথা খেলে নাকি মানুষের। শিবরামও ডায়াসের সম্মুখে বিপদের মুখে–বসে বসে নিজের মাথা খেলাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন, ‘‘আচ্ছা, সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে-তেমনটা রা যায় না কি? আমাদের অভিশাপ ওই সাহেবটাও মোলো অথচ আমার দেহষ্টি অক্ষত রইল-এমনটা হয় না? অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের পরেই আমি যদি ধুপ করে বসে পড়ি-বসেই না বেঞ্চির সঙ্গে মিশিয়ে যাই, তাহলে, সতীশের তাক না ফস্কালেও, আমার গায়ে তার গুলির আঁচড়টিও লাগবে না। ধরাও পড়তে হবে না, পুলিসের থোলাই থেকেও বেঁচে যাব হয়ত। যেহেতু, সাহেবের পতন ও মৃত্যুর সাথে সাথেই দারুণ হইচই পড়ে যাবে। হট্টগোলের মধ্যে ভেঙ্গে যাবে সভা। সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিস, কে কোথায় পালাবে তার ঠিক নেই। আমিও ঘাড় গুঁজে সেই ভিড়ের ভেতরে ভিড়ে গিয়ে হারিয়ে যাব গভীরে। সেখান থেকে সটান চলে যাব সামসিতে। এক দৌড়ে মাইল দশেক দূরের আমাদের রেল স্টেশনে। খানিকক্ষণ কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে তারপরে কলকাতার ট্রেন ছাড়বার মুখটাতেই চট করে উঠে পড়ব সেই গাড়িতে। সরাসরি চম্পট কলকাতায় তারপরই।’’ ওদিকে জমজমাট সমাবেশ চলছিল। এক একজন কিছু বলতে উঠছিলেন, আর চটাচট হাততালি পড়ছিল। পাঁচশো ছেলের হাজার হাতের মুহুর্মুহু হাতুড়িতে গমগম করছিল সভা। সভায় প্রথমে বলতে উঠেছিলেন শিবরামের ‘স্কুলের রেটর মশাই’ ‘কামাখ্যাবাবু’, তিনি পরিচিতি দিয়েছিলেন মাননীয় অতিথিদের। বাংলার এককালের শৌর্যবীর্যের উল্লেখ করে বলেছিলেন – যে-সামরিক বৃত্তির পথ এতদিন বাঙ্গালীর কাছে অবরুদ্ধ ছিল, ভগবানের কৃপায় আজ তা আবার উন্মুক্ত হয়েছে, আবার কৃপাণ ধরবার সুযোগ পেয়েছে বাঙালি। বাঙ্গালী যুবকরা–যাঁরা শক্ত সমর্থ–এহেন সুযোগের সদ্ব্যবহারে যেন দলে দলে এই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করে-সেই আশাই উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর ভাষণে। সভায় সব শেষে বলতে উঠেছিলেন হাবিলদার সাহেব। বীরোচিত চেহারার সেই বাঙ্গালী সৈনিকটি। রণক্ষেত্রে নিজের বরামাঞ্চকর নানান অভিজ্ঞতার কথা এমন ভাষায় তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে, সত্যিই রোমাঞ্চ হয়েছিল শিবরামদের। শিবরাম জানিয়েছেন, ‘‘যুদ্ধে না গিয়েই গায়ে কাঁটা-দেওয়া সেদিনের আমার সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।’’ তারপরেই হাবিলদার সাহেব তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হবার জন্য ওজস্বিনী ভাষায় আহ্বান জানিয়েছিলেন সবাইকে। সেই মুহূর্তেই শিবরাম উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, পকেটের মধ্যে হাত মুঠো করে। সঙ্গে সঙ্গে সতীশও উঠে দাঁড়িয়েছিল তাঁরই পিছনেই, শিবরাম আড় চোখে দেখছিলেন তাকিয়ে। কিন্তু ‘‘… আমি উঠতেই না, চারধার থেকে এমন জোর হাততালি পড়ল যে এক লহমায় সব প্ল্যান ভেস্তে গেল আমার। হালিদার সাহেব আমায় ডাকলেন তার কাছে। ডায়াসে যেতেই তিনি আমায় বুকে জাপটে ধরলেন; ঘোষণা করলেন এই তরুণই এখানকার প্রথম বীর, আমাদের সৈন্যবাহিনীর। তারপর দুহাতে আমাকে উঁচুতে তুলে সবার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রদর্শনী করলেন আমার।তিনি নামাবার পর কামাখ্যাবাবু আমার মাথায় হাত রেখে তাঁর আশীর্বাদ জানালেন। গদ কণ্ঠে বললেন – ‘ধন্য! তুমি আমাদের মুখ রেখেছ। সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশনের মুখ উজ্জ্বল করেছ তুমি। যাও, বীরের মত যুদ্ধে যাও, বীরের মতই ফিরে এসে আবার। বীরের উপযুক্ত তোমার সংবর্ধনার জন্য সেদিনটির অপেক্ষায় থাকব আমরা।’ আবার চটপট হাততালি চারধার থেকে। ছেলেদের সে কী উল্লাস! পুলিস সাহেব আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন সহাস্যে। আমার পিছু পিছু সতীশও উঠে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখাদেখি আরো জনাকতক। সবাইকে ডাকা হলো সেই ডায়াসের ওপর। রিকুটের দলে নাম লেখা হলো সবাইকার। শুনলাম, সাহেবের সঙ্গে পরদিনই সদরে চলে যেতে হবে সবাইকে। আমার অপটু দেহের জন্য, বিস্তর বাহবা দিয়েও, শেষ পর্যন্ত আমায় বাতিল করে দেওয়া হল। ওদের সবাইকে কিন্তু ভর্তি করে নেওয়া হলো সৈন্যদলে। সতীশও গেল সেই সঙ্গে। … আমাকে আর কষ্ট করে নিজের মাথা খেলাতে হল না। কার লীলা কে জানে, অবলীলায় বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। কী করতে যে কী হয়ে যায়। আমাদের মাথার ওপরে আড়ালে থেকে কে যে নিজের মাথা খেলায়!’’ শিবরামের কোনটাই হল না! না বিপ্লবী হওয়া, না শহীদ হওয়া, এমনকি তাঁর জীবনীটাও প্রকাশ হবার আগেই বাতিল হয়ে গেল! যদিও সেই পিস্তল নিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে পরে বিস্তর ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল, কিন্তু শিবরামকে ওই কাঁচা বয়সে জেলে যেতে হয় নি। শিবরাম নিজেই বলেছিলেন, ‘‘কী চাইতে গিয়ে কী যে পায় মানুষ, কী পাবার পরে কী আবার চেয়ে বসে যে–হিসাবের খাতায় তার অঙ্ক কোনোদিনই মেলে না বুঝি!’’
কিন্তু দেশের কাজ করতেই হবে, নইলে যে জীবন বৃথা। এরপরে একবার চাঁচোলে সভা করতে এসেছিলেন ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’। গোটা এলাকা ভেঙে পড়েছিল ‘দেশবন্ধুর ভাষণ’ শুনতে। ‘কিশোর শিবরাম’ও পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই সভায়। আর ‘দেশবন্ধুর ভাষণ’ শুনে তিনি এমন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে ‘সিআর দাশ’ যেই ফেরার ট্রেনে উঠেছিলেন অমনই ওই বগিতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়েছিলেন শিবরাম। বলেছিলেন ‘‘… ‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাব।’ ‘কী করবে গিয়ে?’ ‘দেশসেবা। স্বদেশী করব।’ ‘চলো তাহলে।’ …’’ কলকাতায় এসে শিবরাম উঠেছিলেন এক মেসে, যেখানে সব ‘অল্পবয়েসি স্বদেশীরা’ থাকতেন, স্কুলে যেতেন, ‘চরকা’ কাটতেন। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ‘দেশবন্ধু’। তবে সাথে শিবরামকে এটাও বলেছিলেন, ‘‘শুধু দেশসেবা করলে হবে না, সঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে কিন্তু।’’ কলকাতায় আসার পর ‘বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি’র পরামর্শে শিবরাম কলকাতার ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন’-এর অধীনস্থ ‘গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে’ ভর্তি হয়েছিলেন। ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’ সে সময় সেই বিদ্যায়তনের ‘প্রিন্সিপাল’ ছিলেন। ‘দেশবন্ধুর সহযোগিতায়’ শিবরামের ‘ফরবেস ম্যানসনে’ ‘বিনে পয়সায় থাকা-খাওয়া’র এবং ‘নিয়মিত কিছু মাসোহারা’র ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। প্রথম বেশ কিছুদিন ভালো কাটলেও শিবরামের ‘বাউণ্ডুলে স্বভাবের’ কারণে সেই অবস্থা ও ব্যবস্থা আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই পড়াশোনা আর মেসের পাট চুকিয়ে তাঁকে আবারও রাস্তায় নামতে হয়েছিল। আবার শুরু হয়েছিল ‘শিবরামের ভবঘুরের জীবন’। আসলে সেই মেসের ছিল বেশ কড়া নিয়ম। মেস-ম্যানেজারের হাতে ‘দেশবন্ধু’ ‘দশটা টাকা’ দিয়ে বলেছিলেন, শিবরামের বই খাতা পেন জামা সব কিনে দিতে। কী করে যেন সেই টাকা শিবরামের হাতে চলে এসেছিল! আর তার পর? দু’দিনের মধ্যেই পুরো টাকা ‘সিনেমা দেখে’ আর ‘চপ কাটলেট খেয়ে’ শেষ করেছিলেন শিবরাম। ফলে ‘মেস ম্যানেজার’ তাঁর ওপরে চড়াও হয়েছিলেন। ‘কৈফিয়ত’ চেয়েছিলেন, ‘‘কোথায় তোমার বইখাতা? টাকাই বা কোথায় গেল?’’ জেরার মুখে ‘সত্যবাদী’ শিবরামের তখন ‘সরল স্বীকারোক্তি’ বেরিয়েছিল। ‘মেস ম্যানেজার’ তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে আর মেসে থাকতে হবে না। তুমি এখানে থাকলে বাকি ছেলেরাও গোল্লায় যাবে।’’ যদিও পরে ‘দেশবন্ধুর প্রচেষ্টায়’ সেই বিদ্যায়তন থেকেই ‘এন্ট্রান্স’ পাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ‘ম্যাট্রিক পাশ’ করেই আবার পুরোদমে ‘স্বদেশী আন্দোলনে’ জড়িয়ে পড়েছিলেন শিবরাম।
তবে যতই ‘স্বদেশী আন্দোলনে’ অংশ নিন না কেন, নিজের ‘ভোজনরসিকতা’ থেকে কিন্তু একটুও সরেন নি শিবরাম। ‘শিবরামের ভোজনরসিকতা’ নিয়ে খুব মজার কিছু ঘটনা জানা যায়। ‘স্বদেশী আন্দোলনে’ সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে শিবরাম সবসময়ই ছিলেন ‘পুলিশের নজরদারিতে’। একবার এক পুলিশের উপরে দায়িত্ব পড়েছিল তাঁকে ‘অনুসরণ’ করার। সেই পুলিশ পরে নিজের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে, শিবরামকে ধাওয়া করতে গিয়ে তিনি ‘মুটিয়ে’ গেছেন! তা কেমন করে হয়েছিল সেটা? সেই পুলিশ জানিয়েছিলেন, শিবরাম নাকি এখান থেকে ওখানে যেতেন, আর হোটেল বা খাবার দোকান দেখলেই থেমে ‘শিঙাড়া’, ‘রসগোল্লা’, ‘চপ-কাটলেট’ মুখরোচক যা পেতেন সেটাই খেতে বসে যেতেন। এখন শিবরামকে ধাওয়া করতে গিয়ে তাঁর পিছু পিছু হোটেলে গিয়ে তো খালি মুখে বসে থাকা যায় না। কিছু না কিছু অর্ডার করতে হয়। সেই করে খেতে খেতে পুলিশ অফিসার গিয়েছিলেন ‘মুটিয়ে’। সেই পুলিশ অফিসার পরে ‘আফসোস’ করেছিলেন, শিবরামের মতো লোকের পেছনে লাগার শিক্ষা তাঁকে পেতে হয়েছে গা ভর্তি ‘মেদের পাহাড়’ জমিয়ে। সমগ্র ভারতের আর কোন বিপ্লবী কী তাঁর উপরে নজরদারি করা পুলিশকে এমন শাস্তি দিতে পেরেছিলেন?
এরপরে যখন প্রবল ধরপাকড় চলছিল বিপ্লবীদের, তখন ‘বিপ্লবীদের দমন’ করার জন্য ‘স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ’ তৈরি হয়েছিল। এমনকি ‘পোস্ট অফিসে’ও সতর্ক দৃষ্টি ছিল গোয়েন্দাদের। ‘সন্দেহজনক’ চিঠি খুলে ‘গোপনে’ পড়ে দেখা হত। এমন সময়ে ‘জোড়াসাঁকো থানা এলাকার পোস্ট অফিসে’ যে গোয়েন্দার ডিউটি ছিল, তাঁর নজরে এসেছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। সেই এলাকায় ‘মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে’ ছিল শিবরামের মেস। ‘মেসের বোর্ডার’ শিবরামের নামে প্রতি মাসে ‘মানি অর্ডার’ আসত। কখনও ২০০, কখনও ৩০০ টাকা। শিবরাম তখন যুবক। কিন্তু তিনি সেই ‘মানি অর্ডার’ গ্রহণ না করে প্রতি বার ফেরত দিয়ে দিতেন। জানিয়ে দিতেন যে তাঁর টাকার দরকার নেই। টাকার দরকার নেই এমন মানুষ আছে না কি? তাই সন্দেহ হয়েছিল গোয়েন্দার। তিনি খোঁজখবর করেছিলেন গোপনে। জানতে পেরেছিলেন, শিবরাম ‘হতদরিদ্র মানুষ’। তাঁর দু-তিন মাস মেসের টাকা বাকি পড়ে আছে। সে সকালে ‘খবরের কাগজ বিক্রি’ করে। ‘পত্রপত্রিকায় লিখে’ কিছু পায়। কিন্তু ও সবে আর কত আয়, তাই তাঁকে ধার করতে হয়। সাথে অবশ্য গোয়েন্দা এটাও জানতে পেরেছিলেন যে, শিবরাম ‘ফেরেববাজ’ নয়, ধার শোধ করার চেষ্টা করে। ‘উত্তরবঙ্গের মালদার দিকে’ তাঁর বাড়ি। তাঁর মামার বাড়ি বেশ ধনী। এতে পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল, নির্ঘাত ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে’ যোগ দেওয়ার জন্য শিবরাম বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন। বিপ্লবীদের এ রকম ‘দুঃখবিলাসের কথা’ পুলিশ জানত। এখন সেটা ‘জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা’ও হতে পারে। যে নিজে খেতে পায় না, সে আবার গরিব-দুঃখীদের দান করে! আবার এটাও হতে পারে যে সেটা ‘ছদ্মবেশ’, এ ভাবে ‘পুলিশের চোখে ধুলো’ দিচ্ছে শিবরাম। এমনই সময়ে ‘জোড়াসাঁকো থানা’য় বদলি হয়ে এসেছিলেন ‘পঞ্চানন ঘোষাল’। তিনিও পত্রপত্রিকায় লিখতেন। তাই এক ‘পুলিশ লেখক’কে দিয়ে আর এক ‘লেখকরূপী বিপ্লবী’কে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন ‘পুলিশকর্তারা’। ‘পঞ্চানন ঘোষাল’কে ডেকে তাঁরা বলেছিলেন যে, ‘ছদ্মবেশে’ এক জন লেখকের সঙ্গে ভাব জমাতে হবে। ‘লেখক পরিচয়’ তাঁর বাইরের, আসলে সে এক ‘ভয়ংকর বিপ্লবী’। জানতে হবে তাঁর ‘হাল-হকিকত’। সফল হলে মিলবে পুরস্কার। পর দিনই শিবরামের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন ‘ঘোষালমশাই’। সেদিন ‘কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের একটা হোটেলে’ চেয়ারে বসে ছিলেন শিবরাম। একা। ‘ঘোষালমশাই’ তাঁর উলটো দিকের চেয়ারে বসেছিলেন। শিবরাম তাঁর দিকে ঘুরে হাসিমুখে বসেছিলেন, ‘‘আপনাকে চিনেছি।’’ চমকে উঠেছিলেন ‘ঘোষাল’। পুলিশ, গোয়েন্দাদের উপর বিপ্লবীদের খুব রাগ ছিল। তাই তাঁদের বাগে পেলে তাঁরা আক্রমণে দ্বিধা করত না। ‘ঘোষালমশাই’ আত্মরক্ষার জন্য পকেটের ‘পিস্তলে’ হাত দিতেই শিবরাম হেসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ভয় পাবেন না। আমি বাঘ-ভালুক নই। আপনার স্বগোত্র। আপনার মতো আমিও এক জন লেখক।’’ ‘ঘোষাল’ বলেছিলেন, ‘‘আপনি কী করে জানলেন আমি লিখি?’’ শিবরাম জানিয়েছিলেন, ‘‘সে দিন মৌচাক-এর অফিসে দেখলাম যে আপনাকে!’’ ‘সৌজন্যের খাতিরে’ ঘোষাল বলেছিলেন, ‘‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। সুন্দর লেখা।’’ শিবরাম হেসে বলেছিলেন, ‘‘ঠিক বলেছেন। আমি সুন্দর লিখি। কিন্তু ‘সুন্দরী’ লিখি না। সেই জন্য ভুগতে হয় অর্থকষ্টে।’’ … ‘‘চাকরি-বাকরি করেন না?’’ … ‘‘না মশাই। আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। পরের গোলামি আমার নাপসন্দ।’’ তার পর একটু থেমে শিবরাম তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আজ আপনি আমার অতিথি। আমরা আজ একসঙ্গে ডিনার খাব।’’ এরপরে খাওয়াদাওয়া শেষে ‘বিল’ এসেছিল – ‘১১ টাকা’! ‘ঘোষালমশাই’ অবাক হয়েছিলেন। এত টাকা! শিবরাম খোলসা করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এটা শুধু আজকের বিল নয়, এর আগে কয়েক দিন ধারবাকি খেয়েছি। সব মিলিয়ে ১১। আমি আপনাকে খাওয়ালাম, এ বার বিল মেটানোর ভার আপনার। আমার কাছে পয়সা থাকলে বিলটা আপনাকে দিতাম না। তবে হ্যাঁ, আগাম এ কথা বলে দিচ্ছি, পয়সা যে দিন থাকবে সে দিন আপনাকে ধরে এনে খাওয়াব।’’ এতে ‘ঘোষালমশাই’ বুঝতে পেরেছিলেন, শিবরাম আর যাই হোন, ‘বিপ্লবী’ নন। তবে তিনি আরও নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন, নইলে তাঁকে ‘উপরওয়ালাদের বিরাগভাজন’ হতে হত। তাই তিনি আরও ক’দিন ঘুরেছিলেন শিবরামের পিছনে। হয়তো শিবরাম তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই নিজেই এক দিন থানায় এসে হাজির হয়েছিলেন ‘পঞ্চানন ঘোষালের’ সামনে। তারপরে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘মশাই আপনি যে শুধু লেখক নন, আপনার যে আর একটা পরিচয় আছে সেটা আমি জানতাম। তাই সে দিন হোটেলে ইচ্ছে করেই আপনাকে বিল ধরিয়ে দিয়েছি। বিদেশি ইংরেজদের লুঠ করা টাকা কিছু খরচ হোক না!’’ শিবরামের কথা শুনে ‘ঘোষাল’ স্তম্ভিত হয়েছিলেন। এরপরে হাসতে হাসতে শিবরাম বলেছিলেন, ‘‘আজ আমার কিছু টাকা সত্যই প্রয়োজন। আপনার নিজের উপার্জিত কিছু টাকা বিনা সুদে ধার দিন আমাকে। এ ক’দিন আপনাদের দৌরাত্ম্যে আমার কিছু লেখা হয়নি। তাই উপার্জন শূন্য। না মশাই, ক্ষতিপূরণ চাইছি না। ধার চাইছি। এক জন লেখক আর এক জন লেখকের পাশে দাঁড়াবে না!’’ থানায় ‘পঞ্চাননবাবুর এক সহকর্মী’ শিবরামের ব্যাপারটা জানতেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনি তো ইচ্ছে করলে আজই বাড়ি থেকে টাকা আনাতে পারেন। একটা টেলিগ্রাম করলেই হল। আমাদের কাছে ধার চাইছেন কেন? আমরা তো ঘুষ খাই না যে সব সময় পকেট-ভর্তি টাকা থাকবে!’’ শিবরাম বলেছিলেন, ‘‘দেখুন পুলিশ ঘুষ খায় কি না অথবা ছাগলে ঘাস খায় কি না এটা আলোচনার বিষয় নয়। আমি এখানে এসেছি কোনও পুলিশের কাছে নয়, এসেছি আমার এক লেখক-বন্ধুর কাছে। বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইতে লজ্জা নেই। টেলিগ্রামের কথা বলছিলেন আপনি। হ্যাঁ, পৈতৃক সম্পত্তি আমাদের আছে। তবে সেটা তো পরোপার্জিত। আমি আমার স্ব-উপার্জিত অর্থে বাঁচতে চাই। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’’ ‘ঘোষালমশাই’ পরে এ সব কথা বিস্তারিত জানিয়েছিলেন ‘পুলিশকর্তাদের’। তার পর বন্ধ হয়েছিল পুলিশের ‘শিবরাম চক্রবর্তীর পশ্চাদ্ধাবন’।
পুলিশের তাঁর পিছনে ‘পশ্চাদ্ধাবন’ বন্ধ হলেও জেলে যাবার একটা সুপ্ত বাসনা শিবরামের মনের মধ্যে ছিল। তখন হাজারে হাজারে ছেলে জেলে যাচ্ছিলেন ‘বন্দেমাতরম’ বলে। শিবরামেরও খুব শখ হয়েছিল জেলে যাওয়ার। কিন্তু অমন ‘ল্যাকপেকে চেহারা’ দেখে পুলিশ তাঁকে কিছুতেই আর ধরছিল না। অবশেষে একদিন শিবরামকে পুলিশে ধরেছিল। বলা যায় তিনি নিজেই একপ্রকার ধরা দিয়েছিলেন। সেই জেলে গিয়েও অবাক হয়েছিলেন শিবরাম। ‘চাঁচোলে’ তাঁর কিশোরী প্রেমিকা ‘রিনি’, যে কলকাতায় চলে এসেছিল সেও ছিল ওই জেলেই। জেলের মধ্যেই আবার প্রেমিকার সঙ্গে ‘পুনর্মিলন’ হয়েছিল শিবরামের। কিন্তু বেশি দিনের সুখ তো শিবরামের কপালে ছিল না। এর কয়েক দিন পরেই অন্য জেলে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন শিবরাম। প্রথমে তাঁকে ‘প্রেসিডেন্সি জেলে’ কারাবন্দী করা হলেও পরবর্তীতে বদলির আদেশ এসেছিল। শিবরামের গন্তব্য ছিল ‘বহরমপুর জেলখানা’। ‘বহরমপুরের জেলখানা’ একরকমের ‘পাগলা গারদ’ বলেই শুনেছিলেন শিবরাম। তাই বদলির আদেশ শুনে প্রথমে খানিকটা ভয় পেলেও পরে যখন তিনি শুনেছিলেন যে সেখানে ‘কাজী নজরুল ইসলামের’ দেখা মিলবে, তখন তাঁর সমস্ত ভয় উবে গিয়েছিল। ‘বহরমপুর’ গিয়ে শিবরামের মন আনন্দে ভরে গিয়েছিল। সেখানে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ তাঁর স্বভাবসুলভ চাপল্যে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। আর তাঁর ‘গান-বাজনা’, ‘আবৃত্তি’ তো ছিলই। কিন্তু শিবরামের জন্য আরো একটি বিশেষ আকর্ষণীয় দিক ছিল। আর সেটা ছিল ‘নজরুলের হাতের রান্না’। ছেলেবেলায় ‘নজরুল’কে ‘অর্থাভাবে’ ‘হোটেলে’ কাজ করতে হয়েছিল, সেখান থেকেই রান্না শিখেছিলেন তিনি। তাঁর হাতের ‘অপূর্ব স্বাদের রান্না’ খেয়ে ‘বহরমপুরের দিনগুলো’ ভালোই কেটেছিলো শিবরামের। শিবরামের ভাষায়, ‘‘মনে পড়লে এখনও জিভে জল সরে। নিজেকে সজিভ বোধ করি! আর জেলখানার সেই খানা। আহা! আমি তো বহরমপুর জেলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টিঙটিঙে রোগা ছিলাম। তারপর দুইবেলা কাজীর খানা খেয়ে এমন মোগলাই চেহারা নিয়ে বের হলাম যে আর রোগা হলাম না। জেলখানায় আর জেলের খানায় গড়া এই চেহারা এতটুকু টসকায়নি।’’
এরপরে শিবরাম যখন ‘মুক্তারামের মেসে’ পাকাপাকি চলে এসেছিলেন, তখন একদিন রাতে ‘কুখ্যাত টেগার্ট সাহেব’ স্বয়ং এসে হাজির হয়েছিলেন সেখানে। চারদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের কাছে ‘পাকা খবর’ ছিল, ‘শিবরামের মেসে’ প্রায়ই নাকি বিপ্লবীরা এসে রাতে থাকেন। ‘টেগার্ট’ এসে শিবরামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘তোমার মেসে আর কেউ আসে?’’ … ‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ, যার যখন খুশি চলে আসে। চলে যায়, আবার আসে।’’ … ‘‘এর মধ্যে কে এসেছিল?’’ … ‘‘আজ্ঞে, তারক এসেছিল।’’ … ‘‘কেমন দেখতে?’’ এরপরে ‘শিবরামের বর্ণনা’ শুনে ‘টেগার্ট’ বলে উঠেছিলেন, ‘‘ইয়া দ্যাটস দ্য ম্যান। হি ইজ্ সিয়োরলি আ টেররিস্ট।’’ … ‘‘টেররিস্ট কি না জানি না স্যার তবে হি ইজ এ নভেলিস্ট।’’ … ‘‘নাউ হি ইজ আ রাইটার? নট এ টেররিস্ট ইউ মিন?’’ … শিবরাম জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘বাট টু লিসন টু হিজ রাইটিংস নট লেস এ টেরর স্যার। আই ডোন্ট লাইক, কিন্তু কী করব? জোর করে সে শোনাবেই।’’এবার ‘টেগার্ট’ কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেননি। শিবরামের ঘর সার্চ হয়েছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় নি। কিন্তু তার পর দিন থেকে শিবরাম পেয়ে গিয়েছিলেন অনেক কিছু। এলাকায় বিশাল নাম হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কেউ ভেবেছিলেন তিনি ‘পুলিশের চর’, আবার কেউ ভেবেছিলেন তিনি বড় ‘বিপ্লবী’। ফলে একটা সময়ে যাঁরা তাঁকে পাত্তাই দিত না তাঁরাই দুইবেলা তাঁকে খাতির করা শুরু করেছিলেন। তবে সেই ঘটনায় শিবরামের সব থেকে বড় পাওনা হয়েছিল ‘সাধনবাবুর সন্দেশের দোকানে’ ‘ধারে রাবড়ি পাওয়ার ব্যবস্থা’!
সে বার বেজায় টানাটানি চলছিল শিবরামের। সেই খবর কানে গিয়েছিল ‘দেশবন্ধুর’। শিবরাম চিরকালই তাঁর বড় প্রিয় ছিলেন, তিনি বারবার বলতেন, শিবরাম আলাদা জাতের। অনেক প্রতিভা। শিবরামের দুরবস্থা শুনে ‘দেশবন্ধু’ চিঠি লিখেছিলেন সুভাষ বসু’কে – ‘‘শিবরামকে আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও। ভালো লেখে ও।’’ গুরুদেবের আদেশে শিবরামকে চাকরিতে নিয়েছিলেন ‘নেতাজি’। কিন্তু মানুষটি যে শিবরাম! নিয়মকানুনের ধারে কাছে তিনি থাকতেন না। কোনও দিন অফিস যেতেন তো কোনও দিন যেতেন না। কখন অফিসে ঢুকলেন আর কখন বেরিয়ে যেতেন তা’ও কেউ জানতেন না। ‘সুভাষ বসু’র কানে গিয়েছিল সেকথা। এমন আচরণ ‘নিয়মনিষ্ঠ নেতাজি’র কোনও মতেই পছন্দ হয়নি। শিবরামকে তিনি ‘ওয়ার্নিং’ দিয়েছিলেন ঠিক সময়ে রোজ দপ্তরে আসার জন্য। কিন্তু শিবরাম কোনও দিনই বা কার কথা শুনে চলেছিলেন? ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। শিবরাম একদিন হাতে একটি খাম পেয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল ‘একশো টাকার একটি নোট’ আর ‘সুভাষচন্দ্রের একটি একলাইনের চিরকুট’। তাতে লেখা ছিল – ‘‘আপনাকে আর দরকার নেই।’’ চাকরি নেই। এ বার দিন চলবে কী করে? ভয়ে তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তিনি যে ছিলেন শিবরাম। হাতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়ে তিনি বরং ‘স্বস্তির নিঃশ্বাস’ ফেলেছিলেন! তবে শিবরামের ‘কাগজের চাকরি’ যেমন গিয়েছিল তেমনই একবার আস্ত একটা খবরের কাগজেরই মালিক হয়ে গিয়েছিলেন শিবরাম। কিন্তু তার জন্যই আবার জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
পরবর্তী সময়ে ‘যুগান্তর’ যখন দেউলিয়া হয়ে গেছে, প্রায় বন্ধই হয়ে যাবে এমন অবস্থা। তখন মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে শিবরাম কিনে নিয়েছিলেন ‘যুগান্তর’-এর ‘স্বত্ত্ব’। ‘সম্পাদক’ হয়েছিলেন। তখন অনেক কাগজেরই ইংরেজ সরকারের কোপে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল। ‘যুগান্তর’-এ ‘ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে’ লেখা ছেপে শিবরামও পড়েছিলেন ‘রাজরোষে’। একদিন দফতরের কাজ সেরে মেসের দিকে ফিরছিলেন, রাস্তাতেই খবর পেয়েছিলেন যে মেসে পুলিশ এসেছে। তাঁকে খুঁজছে। শিবরাম যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলেন। পুলিশের হাতে পড়ার আগেই ঢুকে পড়েছিলেন সামনে একটা মিষ্টির দোকানে, যুক্তি ছিল ‘‘যদি জেল হয় তাহলে কত দিন মিষ্টি খাওয়া হবে না, কে জানে! আর আজ নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে পুলিশি জেরায়।’’ সুতরাং সেখানে ‘কুড়িটা বড় সাইজের রসগোল্লা’র অর্ডার করেছিলেন। ধরা যখন পড়তেই হবে, তখন ‘রসগোল্লা’ খেয়ে ধরা পড়াই ভাল। টপাটপ কুড়িটা ‘রসগোল্লা’ আত্মসাৎ করার পর পকেটে হাত দিয়ে শিবরাম বুঝেছিলেন সেখানে একটা টাকাও নেই। অতঃপর, দোকানের মালিক শিবরামের সঙ্গে লোক দিয়ে দিয়েছিলেন, যে শিবরামের সঙ্গে তাঁর মেস পর্যন্ত গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। মেস বাড়িতে ঢোকার মুখেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শিবরাম। পুলিশকে বুঝিয়েছিলেন একজনকে টাকা মেটাতে হবে, একবার ঘরে ঢোকা দরকার। বলে পিছনে তাকাতেই তিনি অবাক হয়েছিলেন! সেই কর্মচারী বিপদ বুঝে কখন পালিয়েছিল! পাছে স্বদেশীকে মিষ্টি খাওয়ানোর অভিযোগে তাকেও জেলের ঘানি ঘোরাতে হয়! শিবরামের জেল হয়েছিল। একটা সময়ে ছাড়াও পেয়েছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় ‘জেলর’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার নিজের যা জিনিস আছে তা নিয়ে যেতে পারেন।’’ নিজের বলতে তো কোনকালেই কিছুই ছিল না তাঁর। জেল থেকে দেওয়া দুটো ‘কম্বল’ ছিল, যা বাইরে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম ছিল না, তবু শিবরাম কী করে যেন ওই দুটোকে বগলদাবা করে বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। তারপর ‘মুক্তারামের তক্তারামে’ ওই দুটো কম্বল পেতেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন বাকি জীবন। ‘জেলমুক্ত শিবরাম’ কিছু পয়সা জুটিয়ে আগে গিয়েছিলেন সেই মিষ্টির দোকানে। ধারের টাকা মেটাতে হবে যে! কিন্তু ঢুকতেই ‘দোকানের মালিক’ হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলেছিল – ‘‘দয়া করে বোমা মারবেন না। যা টাকা লাগবে বলুন দিয়ে দিচ্ছি।’’ আসলে তত দিনে ‘স্বদেশী’ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন শিবরাম। তখন কেউ জেলে যাওয়া মানেই তাঁকে লোকে ভাবত ‘সন্ত্রাসবাদী’। শিবরাম তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘না না আমি টাকা নিতে আসিনি।’’ … ‘‘আজ্ঞে যা আছে দিয়ে দিচ্ছি। স্বদেশের কাজ করেন, আমাদেরও তো সেবা করা উচিত।’’ বলে কাঁপা হাতে ক্যাশবক্সে হাত দিয়েছিলেন দোকানদার। শিবরাম আবার অভয় দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আরে কী মুশকিল, আমি এসেছি আপনার ধার মেটাতে।’’ শিবরামের কাছে সব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন দোকানদার। টাকা তো তিনি নেনই নি, উপরন্তু একজন মানুষ ‘এক সিটিং’-এ বসে ‘কুড়িটা রাজভোগ’ খেতে পারেন শুনে, আবার ‘কুড়িটা রাজভোগ’ শিবরামকে খাইয়ে নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন। এবং আরও ‘কুড়িটা রাজভোগ’ হাঁড়িতে ভরে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘বাড়িতে খাবেন আর দোকানে যখন খুশি এসে খেয়ে যাবেন। পয়সা লাগবে না।’’ কিন্তু না, দ্বিতীয় দিন থেকে আর ওই দোকানের ধারেকাছে যাননি শিবরাম। ‘‘ধারের ধার বেশি না ধরাই ভাল’’, এটাই ছিল ‘শিবরামীয় যুক্তি’।
(তথ্যসূত্র:
১- ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা, ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর, শিরোনাম শিবরাম: কোরক।
২- যষ্টি-মধু: শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা।
৩- গল্পমেলা: শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত