‘অশ্লীলতা’ – শব্দটা কোনদিন পিছু ছাড়েনি সমরেশ বসুর। ‘অশ্লীলতার দায়’ তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল জীবনভর। তাঁর উপরে ‘অশ্লীল লেখক’ – এই ছাপটা যেন স্থায়ীভাবে বসে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, তাঁর ও জর্জ বিশ্বাসের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি নেওয়া যেতে পারে। ‘কলকাতার ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ঘর’টিই ছিল কিংবদন্তীসম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ‘জর্জ বিশ্বাসের’ সাম্রাজ্য। সেখানে একবার ‘জর্জের’ সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে গিয়েছিলেন ‘সমরেশ বসু’ও। ‘মায়া সেন’ তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। ‘জর্জ’ পা তুলে বসে ছিলেন। ঘরে ‘সমরেশ বসু’ ঢোকার পরও পা নামাননি। ‘মায়া সেন’ এ দিকে ইশারা করেই যাচ্ছিলেন, পা নামাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই আর পা নামাননি। শেষে চলেই গিয়েছিলেন ‘সমরেশ বসু’। ‘মায়া সেন’ তাঁকে গাড়িতে চাপিয়ে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘‘জর্জদা, আপনি এটা কী করলেন?’’ ‘জর্জ’ বলেছিলেন, ‘‘যে এত অশ্লীল গল্প লেখে, তাঁকে আমি পছন্দ করি না।’’ এখানেই শেষ নয়, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দে শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর উপন্যাস ‘প্রজাপতি’। তাকে ‘অশ্লীল’ বলে ‘নিষিদ্ধ’ করার আর্জি জানিয়ে ১৯৬৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করেছিলেন তরুণ আইনজীবী ‘অমল মিত্র’। সমরেশ বসুর পক্ষে সেই মামলার ‘প্রথম ও প্রধান সাক্ষী’ হয়েছিলেন সাহিত্যিক অধ্যাপক ‘বুদ্ধদেব বসু’।
তবে শুধুমাত্র কি ‘সাহিত্যের অশ্লীলতা’, তাঁর ‘ব্যক্তিজীবনের কেচ্ছা’, তাঁর ‘অসংগঠিত জীবন’ – বহু ‘বক্রোক্তি’, ‘আদিরসাত্মক’, ‘ব্যাঙ্গাত্মক’, ‘কঠিন প্রশ্নের’ সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সন্তানদের। ‘‘অ্যাই, তোর ছোটমাসি তোর বাবার কে হয় রে?’’ – শ্রদ্ধার মানুষটিকে নিয়ে পাড়ার বন্ধুদের কাছ থেকে ছুটে আসা এই বাঁকা প্রশ্ন সেই সময়ে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের কাছে ছিল বিরাট এক ধাক্কা। তবে এই প্রশ্নের মধ্যে থাকা ‘রসসিক্ত ইঙ্গিত’টিও যে মিথ্যে ছিল না! কারণ ছিল, সাহিত্যিক সমরেশ বসু ও ‘তাঁর শ্যালিকা’ ‘ধরিত্রী’র মধ্যে প্রবল প্রেম। সমরেশ তখন ‘চার সন্তানের পিতা’। ‘কল্যাণী’তে স্ত্রী ‘গৌরী বসু’ ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছিল তাঁর ভরা সংসার। ঠিক সেই সময়েই ‘নিজের ছোট শালি’র সঙ্গে ‘শরীর-মনের সম্পর্কে’ জড়িয়ে পড়েছিলেন সমরেশ। ‘গৌরী’ ছিলেন তাঁর নিজের বাড়ির বড় মেয়ে, আর ‘ধরিত্রী’ ওরফে ‘টুনি’ ছিলেন সেই বাড়িরই সবচেয়ে ছোট, প্রায় সমরেশের মেয়েরই বয়সী ছিলেন, ‘সমরেশ বসুর বড় মেয়ে বুলবুলের’ চেয়ে মোটে কয়েক মাসের বড়! সেই ‘ধরিত্রী’কে বিয়ে করে ‘প্যারালালি’ কলকাতায় ‘দ্বিতীয় সংসার’ পেতেছিলেন সমরেশ। ‘সমরেশের শ্বশুরবাড়ি’ ছিল ‘রক্ষণশীল পরিবার’। সেই বাড়ির ‘অন্দরমহলে’ বাইরের পুরুষের খুব একটা যাতায়াত ছিল না। কিন্তু সেখানে বড় জামাইয়ের ‘অবাধ প্রবেশাধিকার’ ছিল। সম্ভবতঃ সেই সূত্রেই ক্রমশ দানা বেঁধে উঠেছিল ‘টুনি’ আর সমরেশের সম্পর্ক। ‘লোকলজ্জা’র কথা ভেবে, চাইলে হয়তো সব দায় ঝেড়ে ফেলে তিনি বেরিয়ে আসতেই পারতেন, কিন্তু সে পথে হাঁটেননি সমরেশ। ‘শ্যালিকা’কেও ‘স্ত্রীর মর্যাদা’তেই ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ‘হিন্দু বিবাহ আইনে’ সেই বিয়ে সম্ভব ছিল না। সেই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করেছিলেন ‘গৌরী’ – ‘সমরেশের প্রথম স্ত্রী’, ‘ধরিত্রীর দিদি’। ‘গৌরী’ সমরেশের ‘দ্বিতীয় বিবাহে’ সম্মতি দিয়েছিলেন। তাঁর বুক ফেটে গেলেও মেনে নিয়েছিলেন নিজের বোনের সঙ্গে স্বামীর বিয়ে। সমরেশের জীবনের এই সব ‘অনালোচিত অংশে’ আলো ফেলেছিলেন ‘তাঁর ছোট ছেলে’, সাহিত্যিক ‘নবকুমার বসু’। কোনও রকম রাখঢাক না রেখে ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ প্রবন্ধে (‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০০৮) তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবাকে নিয়ে কত রকমের মন্তব্য, বাড়তি কৌতূহল তাঁকে শুনতে হয়েছিল – ‘‘সমরেশ বসুর আর একটা বউ আছে (ছিল) বুঝি?’’ এবং আরও অনেক কদর্য কথাবার্তা। ‘পারিবারিক টানাপড়েন’ আর ‘ছেলেবেলায় নিজের মধ্যেকার উথালপাথাল অনুভূতির কথা’ও সেই প্রবন্ধে ‘স্মৃতি থেকে’ বলেছিলেন ‘নবকুমার বসু’, লিখেছিলেন – ‘‘রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বাবা-মার চাপা ক্ষুব্ধ কথা কাটাকাটি, কখনো ভেঙে পড়া মা-এর কান্না। বুক ঢিপঢিপ করে। … উন্মেষ হওয়ার সেই বয়সে দুটি ব্যাপার সহ্য হত না কিছুতে। মা-এর চোখে জল, আর বাবার অন্য নারী গমন। সে নারী তো আবার পর-ও নয়। কিন্তু তার ভূমিকা, আর লেখক মানুষটিরও তার ডাকে তীব্রভাবে শারীরিক সাড়া দেওয়া, ভেতরে-ভেতরে ওলোটপালট করে দিচ্ছে।’’ ‘চিরসখা’ উপন্যাসেও ‘প্রোটাগনিস্ট’ ‘বিভাস চৌধুরী’র মধ্যে সম্ভবতঃ ‘সমরেশ বসুর জীবনের ছবি’ই আঁকতে চেয়েছিলেন ‘নবকুমার’। কেমন রসায়ন ছিল সমরেশের দুই স্ত্রীর সঙ্গে? প্রথম স্ত্রী ‘গৌরী বসু’র মৃত্যুর পরে সমরেশ বসু লিখেছিলেন, ‘‘আমার ভিতরে পুঞ্জীভূত অন্ধকার আবর্তিত হচ্ছে। তথাপি আমি সকল সত্তা দিয়ে অনুভব করছি, এ অন্ধকার মহান, অনির্বচনীয় তার রূপ। … এই অন্ধকারে একাকী আমি নিজেকে আবিষ্কার করছি, আর তাঁকে দেখবার চেষ্টা করছি।’’ এ কথা অনস্বীকার্য, সমরেশের জীবনে ‘গৌরী বসুর অবদান’ ছিল বিরাট। পরবর্তী জীবনে সম্ভবতঃ অনেকটাই ‘ধরিত্রী’র প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন সমরেশ। তবে, ‘সমরেশের দ্বিতীয়া’ ‘ধরিত্রী’কে ‘ট্র্যাজিক চরিত্র’ বলে মনে করেছিলেন ‘নবকুমার বসু’, কারণ বাধ্যতই নাকি তাঁকে নানা ভাবে ‘‘আমিই আসল বউ’’ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হত। ওদিকে, ২০১১ সালে ‘শব্দ’ পত্রিকার ‘কালকূট বিশেষ সংখ্যা’য় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ‘সমরেশ-ধরিত্রী’র একমাত্র ছেলে ‘উদিত বসু’ অবশ্য ‘সমরেশের অসংগঠিত জীবন’কে পরম মমতায় বেঁধে রাখতে তাঁর মায়ের অপরিহার্যতার কথা বলেছিলেন। তাঁর ধারণা অনুসারে, ‘‘বয়সজনিত কারণে বা দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায়’’ ‘গৌরী দেবী’র পক্ষে তা হয়তো আর সম্ভব হচ্ছিল না। সন্দেহ নেই সমরেশ বসুর জীবন ‘বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী। তাঁর জীবনে ‘কেচ্ছা’ ছিল, ‘কেচ্ছা থেকে না-পালানোর মতো মহত্ত্ব’ও ছিল।
১৯২৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে’ জন্মানো সমরেশ বসুর স্নেহশীল দাদা ‘মন্মথ বসু’র কাছে ছোট্ট সমরেশ ছিলেন ‘প্রবলেম চাইল্ড’। শৈশবে স্কুলের পড়াশুনোয় তাঁর একেবারেই মন ছিল না। পড়াশোনা বাদে বাকি সব কিছুতেই ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। ‘থিয়েটার করা’, ‘বাঁশি বাজানো’, এমনকী তাঁর ‘ছবি আাঁকার হাত’টিও ছিল বেশ পাকা। কৈশোরে সমরেশ কিছু দিন ‘ফুটবল’ নিয়ে মাতামাতি করেছিলেন, আর তার পরেই শুরু হয়েছিল তাঁর ‘ব্যায়ামাগারে’ যাওয়া আর ‘গঙ্গায় সাঁতরানো’। ততদিনে তাঁর পরিবার ‘নৈহাটি’র বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস নাইনে উঠেই সমরেশ শুরু করেছিলেন ‘গোপনে ধূমপান’, এবং সেই সঙ্গে ‘গোপনে প্রেম’। আর ক্লাস টেনে উঠতে না উঠতেই নৈহাটির ভিটে ছেড়ে নিজের থেকে বয়সে বড় প্রেমিকা ‘গৌরী’কে নিয়ে পিঠটান দিয়েছিলেন সমরেশ। দু’জনে সোজা ‘আতপুর’ গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানেই শুরু হয়েছিল সমরেশের ‘সংসার জীবনের অকাল বোধন’। তাঁর ‘আবাল্য বন্ধু’, ‘সহপাঠী’, পরবর্তী জীবনে এক ‘প্রাবন্ধিকের’ কথায়, সমরেশ ‘‘যা কিছু করেছে সারা জীবনে, তার মূল কথা হল কেটে বেরিয়ে পড়া। … মধ্যচিত্ততার দায়ভাগ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া। অমরনাথ যাত্রা, মোটর রেসে যোগ দেওয়া, মরুভূমিতে তাঁবু নিয়ে চলে যেতে চাওয়া – সব কিছুর মূলে রয়েছে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা।’’ ‘বিবাহিতা’, ‘স্বামী পরিত্যক্তা’, ‘তাঁর থেকে বয়সে বড়’ ‘গৌরী’কে নিয়ে ঘর বাঁধার মধ্যেও ছিল সেই একই রকমের চ্যালেঞ্জ। সেই ‘আতপুরে’ সমরেশের জীবন এক বড় বাঁক নিয়েছিল। ‘জগদ্দল-আতপুরের শ্রমিক পাড়া’, সেখানে ‘জীবিকার জন্য লড়াই’ ছিল সমরেশের ‘নৈহাটির কাঁঠালপাড়ার দিনযাপনের থেকে’ বহুলাংশেই আলাদা। এরপরে সমরেশ ‘ইছাপুরের বন্দুক কারখানা’য় একটা চাকরি পেয়েছিলেন। আর সেটাও কিনা আঁকতে জানেন বলে। তখন সেই অঞ্চলের ‘কিংবদন্তী রাজনৈতিক নেতা’ ছিলেন ‘সত্য মাস্টার’ – দীর্ঘদেহী, সুদর্শন। তাঁর কাছেই শুরু হয়েছিল সমরেশের ‘রাজনীতির পাঠ’। সমরেশকে ‘ছবি আঁকা’ থেকে ‘লেখালেখির জগতে’ নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে, ‘সত্য মাস্টারের’ সঙ্গে সমরেশের সাক্ষাৎ ‘বাংলা সাহিত্যেরই এক মাইল ফলক’। এক শোচনীয় বিস্ফোরণে ‘সত্য মাস্টারের’ মৃত্যু হয়েছিল। নিজের ‘সাহিত্য জীবনে’ দুশোরও বেশি ‘ছোট গল্প’র মধ্যে সমরেশ বসুর লেখা প্রথম গল্পটি হল ‘আদাব’, এবং তাঁর লেখা প্রায় একশোটি ‘উপন্যাসের’ মধ্যে প্রথমটি হল ‘নয়নপুরের মাটি’।
‘ছিন্ন পাতার তরণী’ প্রবন্ধে (‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০০৮) ‘নবকুমার বসু’ জানিয়েছিলেন, ‘‘সমরেশ বসুর জীবনের শেষ দিকের কিছু দিন আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। কোনও এক অজানা কারণে এই তৃতীয় সন্তানটিকে কৃতজ্ঞ করতেই বুঝি খ্যাতনামা মানুষটি আমাদের কাছে থাকতে এসেছিলেন। বাবা হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার কোনও দিনই আদিখ্যেতা মেশানো মাখোমাখো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাবা-মা’র চরম দারিদ্র্য আর কষ্টের জীবনের চারটি খুদে সহযাত্রী ছিলাম আমরা চার ভাইবোন।’’ কেমন ছিল সেই সব দিন?
‘উত্তর ২৪ পরগনা জেলা’র ‘শ্যামনগর’ এবং ‘জগদ্দলের’ মধ্যবর্তী গঞ্জ এলাকা ছিল ‘আতপুর’। সেখানে একটি ‘আধা বস্তির দেড় কামরা টালির চালের ঘরে’ ছিল সমরেশ বসুর পরিবারের ছ’টি প্রাণীর বসবাস। ঘরের চেয়ে বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়ানোতেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। কেননা টালির ঘরের ফাটা মেঝের উপর জলচৌকি রেখে দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে সমরেশ লিখতেন। আর ঘরের উলটো দিকে একফালি খোলা বারান্দায় ‘তোলা উনুনে’ (ভাঙা বালতির উপর মাটি লেপে বানানো) তাঁর স্ত্রী ‘গৌরী বসু’, রান্না করতেন। মাঝে মাঝে দু’-চার পাতা লেখা কাগজ নিয়ে সমরেশ উঠে যেতেন স্ত্রী’র কাছে। উবু হয়ে বসে, লেখা পড়ে শোনাতেন ‘গৌরী’কে। তিনি নিজের মতামত দিতেন সেই লেখা শুনে। ‘গৌরী বসু’ তাঁদের সন্তানদের মাঝেমধ্যেই স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘‘তোদের বাবা একজন লেখক।’’ কিন্তু ‘লেখক’ কী বস্তু! ‘নবকুমার’ নিজের প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন, ‘‘সেই ছোট বয়সে কোনও ধারণা ছিল না এই ‘লেখক’ শব্দটি সম্পর্কে। অথচ বাবার সেই পরিচয় দিতে গিয়ে মায়ের চোখেমুখে একটা গৌরবের আলো যাতায়াত করত। এখন কেন যেন মনে হয়, আমার অবচেতন মনে সেই গৌরবের আলোর প্রতিফলন ঘটেছিল। পরবর্তী কালে, হয়তো সেই আলোতেই আমি ব্যক্তি ও লেখক সমরেশ বসুকে একটু একটু করে আবিষ্কার করেছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম আমার বাবাকে।’’ এরপরে এক সময়ে ‘আতপুর’ থেকে পুনরায় ‘নৈহাটি’তে ‘সপরিবারে’ চলে এসেছিলেন সমরেশ। সেই সময়টায় তাঁদের জীবনের পরিবর্তন এসেছিল। তাঁরা ‘নৈহাটিতে’ চলে আসার কিছু দিন পরেই ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ‘নৈহাটি সিনেমা হলে’। সাহিত্যের জন্য সমরেশ তখন সমাজে মোটামুটি পরিচিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর লেখা ‘গঙ্গা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। আর তাঁর লেখা উপন্যাস ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ নিয়ে চলচ্চিত্র করার জন্য সেই সময়ের বম্বের খ্যাতনামা ‘চলচ্চিত্রপরিচালক বিমল রায়’ ‘চিত্রস্বত্ব’ কিনেছিলেন। তবে এত কিছুর পরেও তাঁদের জীবন যাপনে তখনও এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। তাঁর স্ত্রী ‘গৌরী’ যেন সেই সময় থেকেই একেবারে ‘দশভুজা’ হয়ে সংসারটির হাল ধরেছিলেন। যার পিছনে ছিল তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, ‘‘ও মানুষটাকে শুধু লেখা ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে না-টানা।’’ এরপরে একটা সময়ে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসাবে জেল থেকে ফিরে এসে সমরেশ যখন ‘ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি’র চাকরিটি হারিয়েছিলেন, তখন চারটি শিশুসন্তান থাকা সত্ত্বেও ‘গৌরী বসু’ সমরেশকে বলেছিলেন, ‘‘যা হওয়ার হবে, কিন্তু তুমি আর চাকরি করতে যেও না।’’ এটা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে যে কেউ ভাবলে তাঁর গায়ে কাঁটা দেবে! চাল নেই, চুলো নেই, চাকরি নেই, ছ’জনের সংসার, তার মধ্যে চারটি কচি ক্ষুধার্ত মুখ সব সময়ে হাঁ-করে রয়েছে; এরই মাঝখানে একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে বলছেন, ‘‘তুমি লেখো! চাকরি করতে হবে না!’’ এটা ‘গৌরী’র ‘পাগলামি’ ছিল না কি ‘আত্মবিশ্বাস’! এটা ‘গৌরী’র ‘ভালবাসা’ ছিল না কি ‘মরণঝাঁপ’! ‘জায়া-জননী-বন্ধু-কমরেড’, কে এমন ভাবে কারও পাশে দাঁড়ায়! সেখান থেকে সমরেশ বসু কিন্তু আর ফিরে দেখেননি। ফিরে দেখার সময় তাঁর অবশ্য ছিল না। শুধু ছিলেন ‘কয়েকজন সহৃদয় বন্ধু’। তাঁদের কেউ ‘পুরনো জামাকাপড়’ এনে দিতেন তাঁর ছেলেমেয়ের জন্য। আবার তাঁদের কেউ ‘কলাটা-মুলোটা’ দিয়ে যেতেন। ‘নবকুমার বসু’র লেখা থেকে জানা যায় যে, ‘এক গ্রাম্য গোয়ালা’ ‘গৌরী’কে এটাও বলেছিলেন, ‘‘পয়সা দিতে পারবে না বলে বাচ্চাদের দুধ বন্ধ করে দেব! অত অভাব আমার এখনও হয়নি! দুধ দেওয়া আমি বন্ধ করব না। যে দিন পয়সা হবে, সে দিনই দিও।’’ আর অভাবের সংসারে ঠেকা দেওয়ার জন্য ‘গৌরী বসু’ গান শেখাতেন, জামাকাপড় সেলাই করতেন। দেশভাগের পরে, এক মুসলমান পরিবারের পরিত্যক্ত টালির চালের দু’কামরা ঘরের একটিতে ছিল তাঁদের সংসার, আর দ্বিতীয় কামরাটি ‘গৌরী’ পুরো ছেড়ে দিয়েছিলেন সমরেশকে। এই বিষয়ে ‘গৌরী’র যুক্তি ছিল, ‘‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষটা সারা দিন লেখে’’ – সেই জন্য। একজন ‘সঙ্গীতশিল্পী’ হিসেবে ‘গৌরী বসু’ তখন রীতিমতো পরিচিত ছিলেন ‘মফস্বল অঞ্চলে’। ‘নৈহাটির বাড়িতে’ যে-ঘরে বসে সমরেশ লিখতেন, সেটার মেঝে ফুঁড়ে টালির চালের গোল ফাঁক দিয়ে উঠে গিয়েছিল একটা সুদীর্ঘ নারকেলগাছ। ও ভাবেই তৈরি হয়েছিল সেই বাড়ি। অতীতে সেই অঞ্চলের নাম ছিল ‘নারকেলবাগান’। ঘর ঘেঁষা ঝোপ-জঙ্গল আর এঁদো পোড়ো জমি মিলিয়ে জায়গা ছিল কাঠা তিনেক। ‘নবকুমার’ তাঁর ‘স্মৃতিচারণে’ লিখেছিলেন, ‘‘ওই টালির ঘরের মধ্যেই দেখেছি, বাবার উপন্যাস ‘গঙ্গা’ নিয়ে নির্মিত ছবির ইউনিট চলে এসেছে। ত্রিবেণীতে আউটডোর করতে এসে ওঁরা চলে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। স্ক্রিপ্ট পড়া হল। রাজেন তরফদার, দীনেন গুপ্ত, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, রুমা গুহঠাকুরতা, নিরঞ্জন রায়, সলিল চৌধুরী, সীতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সংলাপ বলছেন আর বাবা নিজে তাঁদের উচ্চারণ ঠিক করে দিচ্ছেন। সলিল চৌধুরী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে লাগলেন, মা-এসে গলা মিলিয়েছিলেন। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ। মুহূর্তে পরিচালক রাজেন তরফদারের নির্দেশে সকলে ছুটলেন ন্যাচারাল পরিবেশে, আলো-মেঘ-বৃষ্টিতে শ্যুট করতে। বাবাও ছুটলেন ধুতিতে মালকোঁচা মেরে। এখনও যেন কানে শুনতে পাই, বাবা মাকে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘বুড়ি, (মায়ের ডাকনাম) আমিও যাচ্ছি। কখন ফিরব জানি না, চিন্তা কোরো না।’ আমরা তখন নেহাতই ছোট, কিন্তু বিপুল উৎসাহে সব দেখছি, আত্মস্থ করে ফেলছি।’’
সমরেশ বসুর ‘জীবননদী’ বয়ে চলেছিল জোয়ার-ভাঁটায়। পড়েছিল বাঁকের মুখেও। কিন্তু থেমে যায়নি। উত্তরোত্তর তাঁর ‘জীবননদী’র গতিও সঞ্চারিত হয়েছিল। না, তৎকালীন ‘অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি’ জেল খেটে ফিরে আসার পরে প্রতিভাবান এই লেখকের পাশে আর দাঁড়ায়নি। তাঁর ‘কলমের উষ্ণতা’ পার্টি ব্যবহার করতে চেয়েছিল ‘রাজনৈতিক প্রয়োজনে’। কিন্তু তাঁর সংসারটি কী ভাবে টিকে থাকবে, তার কোনও হদিশ দেয়নি দল। একটা সময়ে ‘দিশাহারা’র মতো ঘুরতে ঘুরতে লেখক পৌঁছে গিয়েছিলেন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘কানাইলাল সরকার’, ‘সাগরময় ঘোষের’ কাছে। সেখান থেকে সূচনা হয়েছিল একটা ‘জীবনভর সম্পর্কের বাঁধনের’। ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ পরবর্তী কালে আজীবন ‘বিদ্রুপ’ করেছিল এবং ‘নেতিবাচক সমালোচনা’ করেছিল সমরেশ বসুর। এমনকী তাঁর মৃত্যুর পরেও ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী’ ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’ ‘‘লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু’’ বলে ‘পার্টির কাগজে’ একটা দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। ‘নবকুমার’ জানিয়েছিলেন, ‘‘অথচ ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, নৈহাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বাড়িতে আসতেন নিয়মিত এবং বাবা-মা দু’জনেই যথেষ্ট চাঁদা দিতেন তাঁদের!’’ এই সময় থেকেই সমরেশের ‘ব্যক্তিজীবনে’ও পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। ‘বদল’ তো স্বাভাবিক। ‘পরিবর্তন’ যে প্রকৃতিরই নিয়ম। সমরেশ বসু ‘ব্যক্তি এবং লেখক’, উভয় দিক দিয়েই যে ‘ব্যতিক্রমী’ সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা ছাড়াও কোথায় যেন এক ‘বিপরীতধর্মিতার জটিল রসায়ন’, যাকে হয়তো ‘প্যারাডক্সিক্যাল ইমোশন’ বলা যায়, ‘ক্রিয়াশীল’ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল সমরেশের মধ্যে। সাহিত্যে যাঁর কোনও ফাঁকি ছিল না, তাঁরই জীবনে ‘অদৃশ্য ফাঁক’ রচিত হয়ে যাওয়াই কি তাঁর নিয়তি হয়ে গিয়েছিল! না, হঠাৎ করে কিছু ‘রচিত’ তো হয়ে যায় না, কোন কিছু ‘রচনা’ করা হয় বলেই সেটা ‘রচিত’ হয়। এই ‘রচনা’ই কি ‘মনস্তত্ত্বের জটিল রসায়ন’? আপাতদৃষ্টিতে যে আচরণ বা সম্পর্কের কোনও ‘ব্যাখ্যা’ মেলে না, মনে হয় সেই সম্পর্ক ‘চূড়ান্ত বৈপরীত্যে ভরা’, অথচ সে দিকেই ‘তীব্র গোপন আনুগত্যের’ আশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়া … সেটাই কি ‘মনস্তত্ত্বের জটিল রসায়ন’? ‘সমরেশ বসুর জীবনকাহিনী’তে সেটাই যেন এক ‘বিস্মিত বিভ্রান্ত অধ্যায়’। ‘জীবনশিকারি’ লেখক ছিলেন তিনি, নিজেকে সে ভাবেই তিনি চিনিয়ে দিয়েছিলেন ‘সাহিত্য জগৎ’কে, নিজেই বলেছিলেন, ‘‘সাহিত্যের থেকে জীবন বড়।’’ আবার সেই মানুষই পরে ‘কবুল’ করেছিলেন, ‘‘কাঠ খেয়েছি, আংরা বেরুবে।’’ কোথাও কোন ‘অনুতাপ’ ছিল কি তাঁর? বা কিঞ্চিৎ ‘আত্ম-তিরস্কার’? ‘তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও বাস্তববাদী’, ‘আত্মবিশ্বাসী’ সাহিত্যিক সমরেশ বসুর আরও একটি সম্পর্কে ভেসে যাওয়ার ‘অপরিণামদর্শিতার অধ্যায়’ হল সেটি। সম্পর্ক-রচনার পাত্রীটির সঙ্গে তাঁর তো ‘রুচি-সংস্কৃতি-বুদ্ধিমত্তা’ কোনও কিছুরই মিল ছিল না। অথচ ‘নিশির ডাকের’ মতো টানে ‘ষাটের দশকে’ তিনি নিত্য ছুটে যেতেন ‘পূর্ব কাঁঠালপাড়ার সেই বাড়িতে’। যেখানে থমথম করত এক ‘মধ্যযুগীয় পরিবেশ’। সেই বাড়িতে ছিল ‘বড় দালানকোঠা’, ‘ছাদে কড়িবরগা’, ‘জানালায় খড়খড়ি’, ‘ছাদ থেকে জলনিকাশির বাঘমুখ নালা’, ‘বড় ইঁদারা’, ‘ফাটা চাতাল’ … ‘নবকুমার’ লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের মামার বাড়ির সেই নিঝুম পরিবেশে খ্যাতিমান লেখকটি ছুটে যেতেন, একমাত্র একটি যুবতীর আকর্ষণে! যে আকর্ষণে ধারাবাহিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাঁর পুত্র-কন্যারা। অসম্মানে, গ্লানিতে বিধ্বস্ত-ছারখার-ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর সেই ‘বুড়ি’!’’ সমরেশের জীবনের এতকিছু জানার পরও কিন্তু কোথাও একটা ‘গোলমাল-বিভ্রান্তি’ লেগেই থাকে। অথচ তাঁর দিন কেটে গিয়েছিল তার পরেও। সমরেশের ‘খ্যাতি-সুনাম-স্বাচ্ছন্দ্য’ … কোনও কিছুই এক জায়গায় পড়ে ছিল না, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমরেশ বসু মানুষটা যেন ছিলেন ‘পাঁকাল মাছের মতো’। কাদা-পাঁকের মধ্য দিয়ে চললেও, তাঁর গায়ে ছিল ‘আলোর ঝলকানি’। শেষে তিনি ছেলে-মেয়ে স্ত্রীকে ফেলে তাঁর ‘নতুন সংসার’ পেতেছিলেন কলকাতায়। সেখানে ছিল ‘স্বচ্ছলতা’। সেই ‘নতুন সংসার’ থেকে অপেক্ষাকৃত অধিক বয়সে আর একটি ‘সন্তানলাভ’ হয়েছিল তাঁর।
একটা সময়ে সমরেশের পুরানো সংসারটির প্রতি ‘দায়ভার’ দিনে দিনে কমে আসছিল। না কী, কমেও যেন কমছিল না। তাঁর ‘জ্যেষ্ঠা কন্যা’ চলে গিয়েছিলেন ‘শ্বশুরালয়ে’, তা সত্ত্বেও কোথায় যেন ‘টানাপড়েন’ ছিল। তাঁর ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র’ জীবিকা সন্ধানে নেমেও ছিলেন ‘পিতৃনির্ভরশীল’ এবং বিবাহিত। ওদিকে তাঁর ‘কনিষ্ঠ পুত্র নবকুমার’ তখন ‘ডাক্তারির ছাত্র’ এবং ‘হস্টেলবাসী’, তাঁর ‘কনিষ্ঠা কন্যা’ও তখন ‘পাঠরতা’। আর ‘সর্ব অর্থে’ সমরেশ বসুর ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘কমরেড ও জীবনসঙ্গিনী’ ‘গৌরী বসু’ তখন ‘নৈহাটির বাড়ি’ আর ‘বেঁচে থাকার অবলম্বন’ হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষায়তন ‘ফাল্গুনী’ নিয়ে হাঁটছিলেন ‘ক্লান্ত পদক্ষেপে’। তাঁর ‘শরীরে ভাঙন’ ধরেছিল, তবুও তিনি হেঁটে চলেছিলেন। সমরেশ কিন্তু তখনও নিয়ম করে ‘প্রতি সপ্তাহে’ ‘নৈহাটি’ যেতেন। তাঁর উপস্থিতিতে তখন ‘প্রাণময়’ হয়ে উঠত বাড়ির পরিবেশ। সেখানে ‘সান্ধ্য আড্ডা’ বসত ‘সমরেশের দোতলার ঘরে’। কোনও সময় তাঁর ‘কনিষ্ঠ পুত্র’ ‘নবকুমার’ও শামিল হতেন সেই আড্ডায়। ‘নৈহাটি-ভাটপাড়া-হালিশহর-কাঁচড়াপাড়ার সমরেশ-ভক্তরা’ এসে জুটতেন তাঁদের বাড়িতে। কোনও সময় ‘সমরেশ-গৌরী’ দু’জনে বসে কথা বলতেন। ‘গৌরী বসু’ তার মধ্যেও খেয়াল করতেন, সমরেশের চোখেমুখে ‘পরিশ্রমের ছাপ’। সমরেশের বয়সও তো বসে ছিল না! ‘গৌরী’ পুত্র ‘নবকুমার’কে বলতেন, ‘‘খুব ধকল যাচ্ছে লোকটার!’’ আর কী আশ্চর্য, তার মধ্যেই ঝলসে ওঠার মতো ‘গল্প’, ‘উপন্যাস’, ‘ভ্রমণ কাহিনী’, ‘গোয়েন্দা কাহিনী’, ‘কিশোর কাহিনী’ লিখেছিলেন সমরেশ। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘কোথায় পাব তারে’, ‘যুগ যুগ জিয়ে’ লিখেছিলেন। ‘বিবর’ পর্যায়ের পরে নক্ষত্রের মতো রচনা করেছিলেন ‘বাথান’, ‘টানাপোড়েন’, ‘তিন পুরুষ’, ‘শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়়া’। একটা সময়ে ‘কালকূট’ ঝুঁকেছিলেন ‘মানস ভ্রমণের’ দিকে, লিখেছিলেন ‘পৃথা’, ‘জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য’, ‘শাম্ব’… এই সমরেশ বসুকে অনেকেই মেলাতে পারেননি। অনেকেরই মনে হয়েছিল, বৈপরীত্যের মধ্যেই ‘জীবনের আকাশ’ ছুঁতে চেয়েছিলেন ‘এক ব্যতিক্রমী শিল্পী’। ‘নবকুমার’ লিখেছিলেন, ‘‘আমি সেই হস্টেল জীবন থেকেই বিচ্ছিন্ন, প্রান্তবাসী। এক শহরে থেকেও পাড়ের কিনারা ধরে হাঁটি। ১৯৮০-তে মাতৃবিয়োগের পর থেকেই মনে হতো, বাবা মানুষটা সব কিছুর মধ্যে, সব কিছু নিয়েও বড় নিঃসঙ্গ। একটু-একটু করে আবার যোগাযোগ হতে লাগল বাবার সঙ্গে। আমার স্ত্রী ও আমি তখন পায়ের তলায় মাটির সন্ধান করছি। প্রতিদিনের রোজগার থেকে বাঁচিয়ে ঘর উঠছে একটু-একটু করে। বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘সন্ধেবেলা কী করছ? চলে এসো না এখানে!’ …’’ পিতা-পুত্রের মধ্যে কথা হতো ‘ঘরবাড়ি-সংসার-অতীত-দায়দায়িত্ব-একাকীত্ব আর রামকিঙ্কর’ নিয়ে। ‘নবকুমারের’ মনে হত, মানুষটা যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন তাঁর কাছে এসে। বোধহয় সমরেশের ‘একঘেয়েমি’ এসে গিয়েছিল ‘কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল আড্ডায়’, ‘ক্লাবে’। খ্যাতিমান মানুষদের ‘দায়’ বেশি, তাই জীবনের একটা পর্যায়ে ‘নিঃসঙ্গতা’ তাঁদের অনিবার্য। ‘নবকুমারের’ মনে হত, যেন লেখার জন্যই সমরেশ নিজেকে আরও গুটিয়ে নিচ্ছিলেন বাইরে থেকে। সমরেশ বারবার বলতেন, ‘‘ধারাবাহিক উপন্যাস মানে তো মেল ট্রেন, চলতে শুরু করলে থামানো যাবে না।’’
১৯৮৭ সালে, সমরেশ বসুর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘রামকিঙ্কর বেজ’-এর ‘জীবনভিত্তিক সুদীর্ঘ উপন্যাস’ ‘দেখি নাই ফিরে’ ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। যখন মাস ছয়েকের মধ্যে উপন্যাস বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছিল, তখন সমরেশ বসু ‘যাদবপুরে’ থাকতে এসেছিলেন তাঁর ‘কনিষ্ঠ পুত্র’ ‘নবকুমার বসু’র কাছে। তখন তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। তার আগে তিনি দু’বার ‘হৃদরোগে’ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ দিকে বিগত আট-দশ বছর ধরে সমরেশ প্রায় চিরুনি তল্লাশির মতো তন্নতন্ন করে ‘রামকিঙ্করের জীবন, মেধা-মনন ও সময় সম্পর্কে’ তথ্য আহরণ প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছিলেন। আর ঠিক সেই সময়ই তাঁর শরীর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘নবকুমার’ তখন প্রান্তবাসী’। ‘নবকুমার বসু’ ও তাঁর স্ত্রী ‘রাখি বসু’ দু’জনেই পেশায় ছিলেন ‘চিকিৎসক’। ‘যাদবপুরে’ ‘নবকুমার বসুর শ্বশুরালয় সংলগ্ন জমিতে’ একটি ছোট নার্সিংহোম ছিল। সেখানে ‘‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’’ তাঁরাই করতেন। সেই নার্সিংহোমে বিদেশ থেকে ‘নেবুলাইজার পাম্প’ সহ আরও বেশ কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি তাঁরা এনেছিলেন। সেই সময় সমরেশ বসুর চিকিৎসা করতেন কলকাতার নামী চিকিৎসকরা। সমরেশের ‘শ্বাসকষ্টের জন্য’ ওগুলো ব্যবহার করা হত খ্যাতনামা ডাক্তারদের পরামর্শে। মানুষটা বেশ স্বস্তি পেতেন তাতে, আর স্বস্তি পেত তাঁর পরিবারও। ‘দেখি নাই ফিরে’-র শেষ কয়েকটি কিস্তি সমরেশ লিখেছিলেন ‘তাঁর পুত্রের নার্সিংহোমে বসে’। খামে করে ‘পাণ্ডুলিপি’ নিয়ে ‘নবকুমার’ নিজে গিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ‘সাগরময় ঘোষের’ হাতে দিয়ে আসতেন। লেখকের শারীরিক অবস্থার জন্য সম্পাদকের মুখে উদ্বেগের ছায়া ‘নবকুমার’ পড়তে পারতেন। সমরেশের তখন ‘সান্ধ্য আড্ডা’, ‘কিঞ্চিৎ মদ্যপান’ সবই প্রায় বন্ধ ছিল। তবে সেটা শুধু ডাক্তারদের বারণের জন্য নয়, ও সবে তাঁর আর ইচ্ছে ছিল না সেটা সকলেই বুঝতে পারতেন। সকলে চেষ্টা করতেন যতটা সমরেশকে যত্নে রাখা যায়, নিয়মে রাখা যায়। পুত্র ‘নবকুমার বসু’র ভাষায়, ‘‘কারণ তিনি আমার বাবা হলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু, তিনি ‘কালকূট’ – বহু জনের কাছের মানুষ। তাঁর সুচিকিৎসা করা আমার বড় দায়িত্ব।’’ ‘রামকিঙ্কর বেজ’ ছাড়া সমরেশের মাথায় তখন আর কিছু ছিল না। কোথায় যেন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর ‘জীবনধর্মী উপন্যাস’ লেখার একেবারে ‘পরিকল্পনাপর্বে’ ‘সত্যজিৎ রায়’ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়’কে নিয়ে লেখার জন্য। সমরেশ ভেবেছিলেন, কিন্তু ‘স্থিতধী’ হয়েছিলেন নিজের ভাবনা ও উপলব্ধির উপর। মানুষ এবং শিল্পী হিসেবে ‘রামকিঙ্কর’ অনেক বলিষ্ঠ চরিত্র বলে সমরেশ মনে করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘‘রামকিঙ্কর যেন এক বিশাল ঠাকুরের মূর্তি আমার ঘাড়ে … বিসর্জন দিতে পারব, না কি দিতে গিয়ে আমিই তলিয়ে যাব … ভাবি মাঝে-মাঝে।’’ আরও একটি কথা বলতে শুরু করেছিলেন, ‘‘শান্তিনিকেতন এবং তখনকার নানান লোকজন সম্পর্কে যে সব তথ্য পেয়েছি … কাহিনী ঘটনা হিসাবেও সে সব সাগরদা দেশে ছাপতে পারবেন কি না কে জানে?’’ ‘তৃতীয় পর্ব’ ‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলা’য় শুরু হয়েছিল ‘রামকিঙ্করের পূর্ণ যৌবন কালের কথা’। এই বারেই তো ‘সেই সব কথা’ আসবে। ‘নবকুমার’ জানিয়েছিলেন, ‘‘আজ ভাবি, ঈশ্বরের কী বিচিত্র বিচার! এই তৃতীয় পর্ব সূচনার গোড়াতেই বাবার কলম থেমে গেল। অসমাপ্ত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী নির্মাণ। জানতে পেরেছিলাম ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসের পাঁচটি পর্বের নামকরণ করেছিলেন এই রকম, ‘আরক্ত ভোর’, ‘সকালের ডাক – বিশ্বঅঙ্গনে’, ‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলা’, ‘ছায়া দীর্ঘতর’ এবং ‘অন্ধকারের আলো’। রামকিঙ্করের জীবনের গতি ও চলন অনুযায়ী ওই নামকরণ ও পর্বভাগ।’’
‘ব্যতিক্রমী মানুষ ও লেখক’ সমরেশ বসু প্রয়াত হয়েছিলেন ১২ই মার্চ, ১৯৮৮ সালে। তাঁর ‘লেখনী’ থেমে গিয়েছিল ‘যাত্রা অসম্পূর্ণ’ রেখেই। কিছু করার নেই। স্বয়ং ‘বিধাতার সৃষ্টি’ও তো ‘অসম্পূর্ণ’। তবুও কালের বিচারে কিছু ‘স্পষ্ট আভাস’ পাওয়া যায় তাঁর ‘সৃষ্টি-বৈচিত্র’ নিয়ে। নিরন্তর আলোচনায় ভেসে থাকেন সৃষ্টিকর্তাটিও। এমনকী রয়েছেন মৃত্যুর এত বছর পরেও!
(তথ্যসূত্র:
১- ‘ছিন্ন পাতার তরণী’, নবকুমার বসু, ‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’ পত্রিকা (২০০৮)।
২- ‘কালকূট বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’ পত্রিকা (২০১১)।
৩- সমরেশ বসু: জীবন ও সাহিত্য, বারিদবরন চক্রবর্তী, শিলালিপি (২০১৪)।
৪- ১৫ই জুলাই ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসুর পুত্র শ্রী নবকুমার বসু’র লেখা প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত