সত্যজিৎ ছাড়া আর কেউই তাঁকে সেভাবে ব্যবহার করেননি। শেষ বয়সে অর্থকষ্ট গ্রাস করেছিল তাঁকে। বহু বছর ধরে বাতে পঙ্গু হয়ে শেষ জীবনটা একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন সোনার কেল্লার দুর্ধর্ষ ভিলেন। তবে বয়স বাহাত্তরে পৌঁছলেও মনকে বাহাত্তুরে হতে দেননি। বাতের ব্যথায় ন্যুব্জ শরীর না-ই বা পারুক নড়তে, ভণ্ড ভবানন্দের অপোগণ্ড চ্যালার পাখির পালকের মতো মন ঘুরে বেড়াত বেলুচিস্তান থেকে কামচাটকা হয়ে আরাবল্লীর আনাচে কানাচে। ২০০৩ সালে ৬ই ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে, সি আই টি রোডের বাড়ি থেকে শেষ যাত্রায় পাড়ি দিয়েছিলেন ‘নকল গ্লোবট্রটার’।
তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি যেমন বিচিত্র ছিলো তেমনই ছিলো তাঁর অভিব্যক্তি। এমনি কি ‘ফটিকাচাঁদ’-এ ‘হারুন-অল-রশিদ’ বা ‘হারুন’ ভরসা হয়ে উঠেছিল ফটিকের … ‘জাগলার হারুন’ই বোধহয় কামু মুখোপাধ্যায়কে সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছিলেন নিজেকে মেলে ধরার, তাই তো তাঁর অভিনীত সেই চরিত্র বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রিয় সিনেমাপ্রেমীদের। ‘শাখা প্রশাখা’ চলচ্চিত্রে মজুমদার বাড়ির লোকদের দেখাশোনার ভার ছিল তাঁর ওপরেই, সেটা চলচ্চিত্রে কতটুকু সময় আর? ‘সোনার কেল্লা’, ‘নায়ক’ বা ‘ফটিকচাঁদ’-এ কামুকে যতটুকু সুযোগ দিতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ – সন্দীপ রায় মিলে, ততটাও অন্যান্য পরিচালকরা তাঁদের সিনেমায় ব্যবহার করতে পারেননি। তবে যত স্বল্প সময়েরই রোল হত কামু পর্দায় আসলেই একটা আলাদা ভালো লাগা কাজ করত দর্শকদের মধ্যে, আর সেটা আজও আছে। কি তাঁর চাহনি, কি তাঁর সংলাপ ছু্ঁড়ে দেওয়া – সবেতেই যেন সব সময় একটা চ্যালেঞ্জের ছাপ পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায় মারা যাবার পর তাঁর মরদেহের পাশে বসে অঝোর নয়নে কেঁদেছিলেন কামু, সর্বজনবিদিত সে কথা। কাঁদবেন নাই বা কেন – মাণিকদার মতো তাঁকে কেউ সাহায্য করেননি যে! বলে না ‘‘জহুরি তে জহর চেনে’’, একদম সে রকমই ব্যাপার। কামুর সাহস আর অকুতোভয়ের ওপর ভরসা করেই সত্যজিৎ রায় তাঁকে ইচ্ছেমতো রোল দিতে পারতেন, ছোট্ট একটা চরিত্রে কম সময় হলেও তাঁকে দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করতেন৷ ‘গুগাবাবা ট্রিলজি’র সব সিনেমাতেই তিনি আছেন, কিন্তু সেখানে তাঁকে চিনতে গেলেই হার মেনে যাবেন দর্শকরা। যেমন – যাঁরা ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, সেখানে একটা দৃশ্যে ‘‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার’’ বলে দৌড়ে যাচ্ছে গুপি আর বাঘা, পালকির ভেতরে এক রাজা আঙুর খেতে খেতে স্তব্ধ … মনে আছে নিশ্চয়? ভেবে দেখেছেন কি ঐ ছোট্ট একটা দৃশ্য, তাও কতটা স্মরণীয়, সৌজন্যে – অবশ্যই কামু মুখোপাধ্যায়! ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তেও তিনি ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকরা তেমন উড়তে দেননি তাঁকে, সে ‘হংসরাজ’ ছবিতে ‘দালাল’ হোক বা ‘গৌতম ঘোষের’ ‘পার’ ছবিতে ‘পাটকলে কাজ দেওয়া সর্দার’-এর চরিত্র। এগুলোর সবকটায় ছিল ছোটো চরিত্র, তবে ক্যামেরার ফ্রেমে এলেই তিনি আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিতেন।
‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’ তাঁকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন, তাঁর ‘ফেরা’ চলচ্চিত্রে, ‘নাট্যদলের মালিকের ভূমিকায়’, তাতে জমিয়ে দিয়েছিলেন কামু। মহানায়ক উত্তম কুমার ও রঞ্জিত মল্লিক অভিনীত ‘মৌচাক’ সিনেমাতেও তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ঐ দেড় মিনিট – সেখানে তাঁকে সুপারভাইজারের মাথা ম্যাসেজ করতে দেখা যায়। বাংলা সিনেমাতে চরিত্রাভিনেতাদের রমরমা চিরকালই ছিল, নায়কদের ছাপিয়ে তাঁরা জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই কামু ব্রাত্যই থেকে গিয়েছিলেন, স্বল্প সময়ে ওরকম ‘স্ক্রিন প্রেজেন্স’ দিয়েও অন্যান্য বাঘা বাঘা পরিচালকরা তাঁকে সুযোগ তেমন দিতে আর পেরেছিলেন কোথায়? সে কথা টের পেয়েওছিলেন তিনি, এমনকি নিজেই মজা করে বলতেনও সে কথা – “মন্দার বোসের বাজার মন্দা!” সত্যজিৎ রায় খুব ভালোবাসতেন তাঁর ‘মন্দার বোস’কে। তিনি মারা যাবার পর চলচ্চিত্রে সেভাবে কামু মুখোপাধ্যায় সুযোগ পাননি, সন্দীপ রায়ও তাঁকে মনে রাখেননি। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তখনই হারিয়ে ফেলেছিল এক প্রতিভাবান, অসমসাহসী অভিনেতাকে, যিনি বারবার দুঃখবোধ করেছিলেন স্বচ্ছন্দে জায়গা না পাওয়ার জন্য। অথচ কোনো নায়কের অভিনয়ে তাঁর অভিনীত চরিত্র ঢেকে যায়নি, কেউ ঢেকে দিতে পারেননি। তিনি যে যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সেই নামও কেউ কেউ এখনও মনে রেখেছেন, এটা কয়জনের সঙ্গে হয়? এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়
১৯৭৯-তে মুক্তি পেয়েছিল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। পুরো শ্যুটিংটাই হয়েছিল বেনারসে। বেনারস মানেই তো নানা অলিগলি। বেনারসের গলিতে তখন শ্যুটিং চলছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ষাঁড় নেই! এমনিতে তো বেনারসের গলিতে ষাঁড় থাকেই। কিন্তু সেদিন ষাঁড় অনুপস্থিত। হঠাৎ দেখা গেল, শটের ঠিক আগে কামু মুখোপাধ্যায় কোথা থেকে যেন একটা ষাঁড় ‘জোগাড়’ করে, তার ল্যাজ ঘোরাতে ঘোরাতে টেনে আনছেন! সবাই অবাক! অদ্ভুত লোক ছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়! যেমন রসিক, তেমন অসমসাহসী!
‘সোনার কেল্লা’-র শ্যুটিং সেরে ফিরে এসে ‘শ্রী সন্তোষ দত্ত’ ওরফে ‘জটায়ু’ ওরফে ‘লালমোহন গাঙ্গুলী’ সকলের কাছে আরেক জনের কথা প্রায়ই বলতেন – তাঁর নাম ‘শ্রী কামু মুখার্জি’। গোটা শ্যুটিঙে খুব মজা করতেন কামু। এর পিছনে লাগতেন, ওর জুতো লুকোতেন, তাঁর জামা হারিয়ে দিতেন। আর খুব খেতে ভালবাসতেন। ওখানে ব্রেকফাস্টে থাকত কর্নফ্লেক্স, দুধ, কলা, ডিম …। অনেকেই পুরোটা খেতে পারতেন না। বাকিটা চলে যেত কামুর প্লেটে। তাঁর আগাম নির্দেশমতো। কামু নাকি অনায়াসে দু’লিটার দুধ, কী ছ’টা কলা বা চারটে ডিম খেয়ে ফেলতে পারতেন। এই কামু মুখার্জির সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে একবার কিন্তু একটু হলেও ভয় পেয়েছিলেন সন্তোষ দত্ত।
জয় বাবা ফেলুনাথ। মগনলাল মেঘরাজের ডেরা। সেই বিখ্যাত শট। জটায়ুকে দাঁড় করানো হয়েছে গোল চাকতিতে পিঠ ঠেকিয়ে। উল্টো দিকে ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে তাঁর বৃদ্ধ শাগরেদ ‘অর্জুন’ কামু। অর্জুনের হাতের ছোরা একে একে গিয়ে বিঁধবে জটায়ুর আশেপাশে। এ দৃশ্যর কথা আগের দিনই সত্যজিৎ রায় বলে দিয়েছিলেন সন্তোষ দত্তকে। সকালে শ্যুটিং যাবার আগে নিজের স্ত্রীকে সন্তোষ দত্ত বলেছিলেন, “আজ কী যে হবে জানি না বাপু। মানিকদা যা সব ছোরাছুরির কথা বলছিলেন, একটু এদিক ওদিক হয়ে গায়ে না গেঁথে যায়!” পরে হাসতে হাসতে সে-গল্প বহুবার বলতেন।
বাহারি লম্বা ঝুলপির পাশে শখের কাগজফুল। এক ঝটকায় ফেলে দিলেন ডক্টর হ্যাজরা। টিকটিকি সন্দেহ করছে। আর ভূপর্যটকের কিনা সাজের ঘনঘটা! অবশ্য ভূপর্যটক নিজেও এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিলেন সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব। সটান গিয়ে হাজির বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ির দরজায়। আপাদমস্তক বই ঠাসা বিখ্যাত বৈঠকখানায় বসা দীর্ঘদেহী পরিচালককে সরাসরি বলেছিলেন, “আমি আপনার ছবিতে কাজ করতে চাই”।
তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের বৃত্ত থেকে বহুদূরে থাকা তাঁর মতো একজন চরিত্রাভিনেতার পক্ষে এ কম দুঃসাহস নয়! জহুরির চোখ বুঝেছিল সেই দুঃসাহসের দৌড় বহুদূর। সেই কারণেই হয়তো এসেছিল হরলিক্সের খালি বোতলে বিছে ধরার সিকোয়েন্স। ‘সোনার কেল্লা’ ছবির শ্যুটিং-এ সত্যি ওভাবে বিছে ধরেছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়। কিন্তু পরে তা বাদ চলে যায় সম্পাদকের কাঁচিতে। কারণ পরিচালকের মনে হয়েছিল, ওই দৃশ্য ছবিতে থাকলে প্রদোষচন্দ্র মিত্রর তুলনায় মন্দার বোসকে বেশি সাহসী মনে হবে। শোনা যায়, মানিক দা’র এই সিদ্ধান্তে কিছুটা হলেও মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কামু। কিন্তু কোনওদিন তার জের বয়ে আনেননি সম্পর্কে। কারণ তিনি জানতেন মানিক দা’র মতো ‘জেম কাটার’ তো শত পূর্বজন্মেও মিলবে না।
আর জানতেন যেকোনও প্রয়োজনে, যত্সামান্য ভূমিকাতেও নিজেকে নিংড়ে দিতে। প্রথম ছবি ‘সোনার হরিণ’ থেকেই সেই বৈশিষ্ট্য টাল খায়নি একবারের জন্যেও। ‘ছবি বিশ্বাস’, ‘উত্তম কুমার’, ‘কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘ভানু বন্দ্যোপধ্যায়ের’ পাশাপাশি নজর কেড়ে নিয়েছিলেন নবাগত অভিনেতা। সেই অভ্যাস রয়ে গিয়েছিল অভিনয়জীবনের আগাগোড়া। পোড় খাওয়া চেহারার সঙ্গে কঠিন চোখ। ঝুলিতে খলনায়ক চরিত্র বেশি। তাই দিয়েই একের পর এক পালক জুড়েছিলেন নিজের অভিনয়ের তাজে।
‘নায়ক’-এর ‘প্রীতীশ সরকার’ থেকে ‘হংসরাজ’-এর ‘দালাল’ – চাহনিতে খামতি নেই খল ও ছলের। কিন্তু সেই চোখই ‘ফটিকচাঁদ’-এর ভরসার ‘হারুণ-অল-রশিদ’, যে নাকি প্রত্যাশা ছাড়াই নিঃস্বার্থভাবে আগলে রাখে ঠিকানা বিস্মৃত অপহরণের ফাঁদে পড়া কিশোরকে। শুধু ‘ফটিকচাঁদ’ বা ‘বাবলু’রই নয়, কামু মুখোপাধ্যায় বড় ভরসার জায়গা ছিলেন স্বয়ং সত্যজিত্ রায়ের কাছেও। কামু আছেন জেনে, চিত্রনাট্যে ইচ্ছেমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারতেন তিনি। ‘গুগাবাবা ট্রিলজি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘সোনার কেল্লা’ ছাড়াও কামু অভিনয় করেছেন ‘শাখা প্রশাখা’, ‘চারুলতা’, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে।
হারুণ তাঁর মাদারির খেলা দেখিয়েছিলেন সত্যজিতের চিত্রনাট্যের পাশাপাশি ‘গৌতম ঘোষ’, ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’, ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের’ পরিচালনাতেও। তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ‘পার’, ‘ফেরা’, ‘কখনও মেঘ’, ‘কমললতা’, ‘নিশাচর’ অন্যতম।
অভিনয়ের মতো ব্যক্তি কামু নিজেও ছিলেন স্পষ্টবাদী। রেহাই ছিল না রায় দম্পতিরও। একবার বিস্কুটে কামড় দিয়ে বিজয়া রায়কে কামুর প্রশ্ন ছিল, ‘‘বৌদি, বিস্কুটে কি সাইলেন্সর লাগিয়েছেন, নাকি?’’ হতভম্ব বিজয়া রায়কে হাসি থামিয়ে সত্যজিত্ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিস্কুট মিইয়ে গেছে। তাই মুচমুচে শব্দ ভ্যানিশ!
এভাবেই আপেলে কামড় দিতে দিতে আসল ডাক্তার হাজরাকে ভ্যানিশ করে দিয়েছিলেন ভূপর্যটক। তার আগে অবধি অবশ্য নাহাড়গড় কেল্লায় গিয়ে তাঁর স্পেনের কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু ম্যাট্রিকে ভূগোলে ছাপ্পান্ন পাওয়া মন তো। বিশ্বাসঘাতকতা করতে কতক্ষণ! খেয়ালই থাকে না অ্যাফ্রিকায় নেকড়ে নেই। তারপর শনি মনসা-চায়নায় হায়না-সাহারায় সীতাহরণ কত কী বলে ড্যামেজ কন্ট্রোল! কিনিয়ায় হাতির দাঁতের ব্যবসা করা মন্দার বোস বাস্তব জীবনে কিন্তু কেবল ‘মুখেন মারিতং’ ছিলেন না। বরং তাঁর মতো সপ্রতিভ ও দুঃসাহসী একজন কুশীলব ছিলেন বলেই পরিচালক ‘রামদেওরা’ থেকে চলন্ত ট্রেনে ওঠার দৃশ্য ভাবতে পেরেছিলেন।
অতি কঠিন সিকোয়্ন্সও নিজগুণে নাজুখ করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা ছিল অভিনেতা কামুর। নইলে ‘হরবংশপুরের রাজা’ বা ‘মগনলাল মেঘরাজের’ মতো জাঁদরেল মনিব সামলানো অর্জুনের পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয়। থোড়া বুখার আর ঝুঁকে পড়া শরীর নিয়েও অর্জুনের জামায় পদকের ঝনঝনানি আর ধারাল ছোরার শনশনানি পাল্লা দেয়। শ্যুটিঙের সেটে প্রশিক্ষিত জাগলার নেপথ্যে থাকলেও কামু মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা না থাকলে মগনলাল অর্জুনের তনখা বাড়াতেন না।
ছোরার মতো কামুর রসিকতার নিশানাও ছিল অব্যর্থ। গুপী গাইন বাঘা বাইনের শ্যুটিং-এ গিয়ে সবার নাগরাই জুতো বস্তাবন্দি করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন সিলিং থেকে। শেষে তিনি শিকে থেকে জুতো পাড়তে শুরু হয়েছিল শ্যুটিং। এভাবেই নিজের জীবনকেও মজায় ভরিয়ে রাখতেন কামু। কেরিয়ারে কতদূর এগোলেন, নাকি একই জায়গায় থেমে থাকলেন, আদৌ ভাবতেন না। সাপলুডোর বোর্ডকে ট্রেনের কামরার বাইরে আর আনেননি। সেখানে তাঁর জীবন মন্দার বোসের রুইতন-হরতন-ইস্কাবন জামার মতোই জটিল অথচ ফুরফুরে।
ধরা যাক মুকুল রাজস্থান গেছে ডাক্তার হাজরার সঙ্গে। এ কেল্লা সে কেল্লা দেখতে-দেখতে তারা যোধপুর সার্কিট হাউস পৌঁছল এবং নকল হাজরার সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল। সেও কোনও দুর্বুদ্ধি প্রয়োগ করে মুকুলকে হাতিয়ে নিয়ে জয়সলমীর গিয়ে সোনার কেল্লা খুঁজে বার করল আর ফেলুদা গিয়ে তাকে শায়েস্তা করল। এরকম হলে গল্পটা জমত কি? বোধহয় না।
আসলে মন্দার বোসের উপস্থিতি ছাড়া পুরো সোনার কেল্লা ছবিটাই ফিকে। ধর্মতলা থেকে কেনা সস্তার লেদার জ্যাকেট আর বাটার জুতো, তাও আবার পরের দ্রব্য, সেই পরেই আদ্যোপান্ত একটি বর্ণময় চরিত্রকে পর্দায় যিনি জীবন্ত করে তুললেন তিনি কামু মুখোপাধ্যায়। এক অসামান্য চরিত্রাভিনেতা, যিনি যে কোনও চরিত্রে, যে কোনও পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি তাঁর সমস্ত অভিনয় জীবনে ছোটবড় নানান চরিত্রের ভিড়ে মাত্র একটি ছবিতেই মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। এ বোধহয় শুধু ভারতবর্ষেই সম্ভব।
চলচ্চিত্রে কামু মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ সম্ভবত ১৯৫৯ সালে ‘সোনার হরিণ’ ছবিতে, ‘আবদাল্লা’র চরিত্রে। আগাগোড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত এই অভিনেতা তারপর একদিন নাকি নিজেই হাজির হয়ে যান সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে জানান তিনি সত্যজিতের ছবিতে কাজ করতে চান। ব্যস, এইটুকু বলেই তিনি উধাও। সত্যজিৎ কৌতুহলবশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আগন্তুক সিনেমা পাড়ায় যাতায়াত করেন, ছোটখাটো যে কোনও চরিত্র পেলে কাজ করেন।
সত্যজিতের সঙ্গে কামুর প্রথম কাজ করার সুযোগ মিলল ‘চারুলতা’ ছবিতে, ভূপতির বন্ধুর ভূমিকায় একটিমাত্র দৃশ্যে। শোনা যায় কামু একটু হতাশ হয়েছিলেন এত ছোট চরিত্র পেয়ে। কিন্তু পরিচালক তাঁকে বলেন, ছোট চরিত্রে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই আসল অভিনেতার দক্ষতা রয়েছে। সম্ভবতঃ সেই কথাটিকেই তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র করেছিলেন কামু। ভূপতির বাড়িতে এক ঘরোয়া পার্টির দৃশ্যে, চশমা ঠিক করতে-করতে বিশ্ববন্ধু পত্রিকায় চারুলতার লেখা দেখার একটি শট দিয়েছিলেন কামু। জহুরী জহর চিনতে ভুল করেননি। ওই একটি শটেই সত্যজিৎ বুঝে গিয়েছিলেন কি অসামান্য এক অভিনেতার হদিশ পেয়েছেন তিনি।
ছোটবড় যে কোনও চরিত্রে কামু ছিলেন অনবদ্য এবং অপ্রতিরোধ্য। এরপর একে একে তাঁকে দেখা যায় ‘কখনো মেঘ’, ‘কমললতা’, ‘মৌচাক’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘হংসরাজ’, ‘পাকা দেখা’, ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’ ও আরও অনেক ছবিতে। তবে সত্যজিতের ছবিতেই তাঁর অভিনয় দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছিল সব থেকে বেশি।
মন্দার বোসের চরিত্র ছাড়া কামুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় ‘সন্দীপ রায়ের’ ‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে, যেখানে তিনি ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। তবে কামুর তিনটি সেরা অভিনয় বেছে নিতে হলে ফটিকচাঁদ আসবে দু নম্বরে। একে অবশ্যই ‘মন্দার বোস’। ওরকম একটি ভয়ঙ্কর চরিত্র, যে কি না কাঁকড়া বিছে ধরতে পারে, কনকনে ঠাণ্ডায় চলন্ত ট্রেনের হিমশীতল লোহার হাতল ধরে ঝুলে-ঝুলে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় চলে যেতে পারে, আবার ঠাণ্ডা মাথায় একটা লোককে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলেও দিতে পারে। এই বেপরোয়া ডাকাতটি আবার ট্রেনে বসে সাপলুডো খেলে, মজার-মজার ম্যাজিক দেখিয়ে যা খুশি ভ্যানিশ করে দিতে পারে। এতরকম রঙে রঙিন একটা চরিত্র, বোধহয় এক কামু ছাড়া আর কারোর পক্ষেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না।
‘ফটিকচাঁদ’ ছবিতে ‘হারুন-অল-রশিদের’ ভূমিকায় দক্ষ ‘বাজিকরের’ চারিত্রিক বলিষ্ঠতা তথাকথিত ভদ্রলোককেও লজ্জায় ফেলে দেয়। বাংলা ছবির ইতিহাসে একেবারেই ব্যতিক্রমী এই চরিত্রে অসামান্য রূপদান করেছিলেন কামু।
এরপরেই আসবে ‘নায়ক’-এ ‘প্রিতীশ সরকারের’ চরিত্রটি, সে যুগের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত বাঙালি যে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে চায় যে কোনও মূল্যে। একদিকে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ অন্যদিকে লাগামছাড়া উচ্চাশা, এই দুইয়ের টানাপোড়েনকে পরিমিত অভিনয়ের মোড়কে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন কামু। এই চরিত্রটিতে শহুরে মধ্যবিত্তের মেজাজ এমনভাবে রয়েছে যেখানে অন্য পরিচালক হলে হয়ত অন্য কোনও অভিনেতার কথা ভাবতেন। কিন্তু এখানেই সত্যজিতের তুরুপের তাস ছিলেন কামু। একেবারেই অন্য ধরণের একটি চরিত্র, যে ভূমিকায় দর্শক তাঁকে সেভাবে দেখেনি, সেখানেই তিনি সুযোগ দিলেন কামুকে। কতটা দক্ষতার সঙ্গে উতরে দিয়েছিলেন তিনি, তা ছবিটি না দেখলে বলে বোঝানো অসম্ভব।
এছাড়া ‘হংসরাজ’ ছবিতেও তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। গুপি বাঘা সিরিজ়ের ছবিগুলিতে একাই পাঁচ-ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কামু। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ সত্যজিৎ রায় তাঁকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন। ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানটিতে প্লেব্যাক করেছিলেন কামু মুখোপাধ্যায় ও জহর রায়। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে কোষাগারের দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় একটি দৃশ্যে তিনি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সোজা মাটিতে পড়ে যান, যা সজ্ঞানে করা বেশ কঠিন। এমন সব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা কামুর কাছে ছিল জলভাত।
আর কেই বা ভুলতে পারবে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে একটিমাত্র দৃশ্যে অর্জুনের ভূমিকায় তাঁর ‘নাইফ থ্রোয়িং’-এর খেল। কামুর তখন স্বাস্থ্যবান চেহারা। কিন্তু সত্যজিৎ তাঁকে দিয়ে অভিনয় করালেন এক বৃদ্ধের ভূমিকায়। চাকু ছোঁড়ার খেলা দেখানোর আগে মগনলালের প্রশ্ন, ‘খেল দিখা সকোগে না?’ রোগভারে ন্যুব্জ অর্জুনের নির্লিপ্ত উত্তর, ‘থোড়া বুখার হ্যায়, ফির ভি কোই বাত নেহি।’ এই সংলাপ আর তার পরবর্তী দৃশ্য ভোলার নয়।
অভিনয় ছাড়াও নানান ব্যাপারে উৎসাহী মানুষ ছিলেন কামু। সত্যজিতের বহু ছবিতে ছোটখাটো চরিত্র করার পাশাপাশি ফিল্ম ইউনিটের একজন অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কাজ করতেন টেকনিশিয়নদের সঙ্গে। আদ্যন্ত আমুদে মানুষ কামু, শ্যুটিংয়ের ফাঁকে পুরো ইউনিটকে মাতিয়ে রাখতেন তাঁর নিত্য নতুন মজা আর দুষ্টুবুদ্ধি দিয়ে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রবল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। হীরক রাজার দেশে ছবিতে আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে গানটির দৃশ্যগ্রহণ হবে। প্রয়োজন একটি রোদ ঝলমলে দিন। কিন্তু শ্যুটিংয়ের সময় দেখা গেল, রোদ তো নেই-ই, উল্টে মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। গোটা ইউনিট গালে হাত দিয়ে বসে। সূর্যের দেখা না মিললে শ্যুটিং শুরু করা যাবে না। শোনা যায়, এমন সময় উঠে দাঁড়ালেন কামু। সত্যজিতের কাছে এসে বললেন, ‘‘মানিকদা, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে এই লাইনটা পাল্টে, আহা কি আনন্দ ফ্যাকাশে আকাশে করে দিন। তাহলেই এক্ষুণি শ্যুটিং চালু করে দেওয়া যাবে।’’ গোটা ইউনিটে হাসির রোল উঠেছিল। যাই হোক, রোদের দেখা মিলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই, আর গানের কথাও পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়েনি।
এমনকি রাজস্থানে শ্যুটিং করতে গিয়ে গোটা ইউনিটের সকলের জুতো লুকিয়ে রেখেছেন এমনও ঘটনাও ঘটেছে। কাশীর গলিতে ষাঁড় না পাওয়া গেলে ডাক পড়ত কামুর। নিজের আমুদে স্বভাবের গুণে এমনভাবে সকলের মন জয় করতেন তিনি যে স্বয়ং সত্যজিৎ বলেছিলেন তাঁকে নিয়ে একটা গোটা বই লেখা যায়। এমন অভিনেতা বিদেশে জন্মালে তাঁর সঠিক মুল্যায়ন হত হয়ত। কিন্তু এই বাংলায় তাঁর প্রতিভার যোগ্য সমাদর পাননি কামু।
(তথ্যসূত্র:
১- আজকাল পত্রিকা, ২৩শে মার্চ ২০১৯ সাল।
২- Manik and I: My Life with Satyajit Ray, Bijoya Ray.
৩- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত