১৯০৮ সাল। ‘আলিপুর বোমা মামলা’। অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’ আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের। আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারী হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।” কথিত যে, দেশবন্ধু বিপ্লবীদের আইনি সহযোগিতা করতেন বিনা খরচে। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় সিংহের মতো লড়াই করে শ্রীঅরবিন্দ ও বারীন ঘোষকে ছাড়িয়ে আনলেন। ঠিকই, ‘প্রচলিত মিথ’ বলে, চিত্তরঞ্জন ‘বিনা পারিশ্রমিকে’ ‘আলিপুর বোমার মামলা’টি লড়েছিলেন। কিন্তু এই মামলায় ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা পাওয়া’ ‘বোমা-বিশারদ’ ‘বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস’ (কানুনগো)-র লেখা ‘বাংলায় বিপ্লবী প্রচেষ্টা’ বইটি অন্য কথা বলে। ‘ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড’কে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’ যে বোমা ছুড়েছিলেন, তা তৈরি করেছিলেন ‘হেমচন্দ্র’, তাঁর লেখা বই থেকে জানা যায় – ‘‘অরবিন্দবাবুকে সমর্থন করবার প্রথমে ভার নিয়েছিলেন মি. ব্যোমকেশ। তিনি আইনের মার-পেঁচে আমাদের মোকদ্দমা হাইকোর্টে তুলে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। বিফল হলো। কম ফীতে হাইকোর্ট ছেড়ে নিম্ন আদালতে আটকে থাকতে রাজি হলেন না। তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে ধরা হলো। তিনি এককালীন অগ্রিম ছ’হাজার টাকা এবং মোকদ্দমা শেষ করতে ১২ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। … সে যাবৎ লক্ষ টাকা পূর্বোক্ত ব্যারিস্টার সাহেবকে বিদায় দিতে ব্যয়িত হয়ে গেছল। অথচ সেই দিনই ছ’হাজার টাকা চাই। কারণ পরদিন মোকদ্দমা চলবার কথা ছিল। শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের মুখে পরে শুনেছি, একজন সহৃদয় মাড়োয়ারী ভদ্রলোককে বলা মাত্রই ছ’হাজার টাকা তক্ষুণি দিয়েছিলেন।’’ ‘ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন’ যে কেবলমাত্র ‘অরবিন্দের হয়েই’ এই মামলায় লড়েছিলেন সে কথা ‘ঋষি অরবিন্দের ভাই’ ‘বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আত্মজীবনী’ ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’তেও আছে। তিনি লিখছেন, ‘‘অরবিন্দের পক্ষে ব্যোমকেশ চক্রবর্তী ও কে এন চৌধুরী উকিল নীরোদচন্দ্র চ্যাটার্জ্জিকে বাহন বা সহযোগী করিয়া দণ্ডায়মান; মোকদ্দমা কিন্তু দু’পা হাঁটিতেই পট পরিবর্ত্তন হইয়া উক্ত ব্যারিস্টারদ্বয়ের স্থান গ্রহণ করিলেন দেশবন্ধু দাশ। বাকি বড় ও চুণাপুঁটিগুলির পক্ষে হইলেন ব্যারিস্টারের মধ্যে পি মিত্র, ই পি ঘোষ, এস রায়, জে এন রায়, আর সি ব্যানার্জ্জি, আর এন রায়।’’ ‘বিচারক বিচক্রফ্ট’-এর রায়ে ‘অরবিন্দ-সহ ১৭ জন’ বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেও, ‘বারীন ও উল্লাসকরের ফাঁসি’ এবং ‘হেমচন্দ্র-সহ ১০ জনের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের হুকুম’ জারি হয়েছিল। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে, সাত মাস পরে ফাঁসির হুকুম ‘রদ’ হয়ে ‘বারীন ও উল্লাসকরের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়’। অন্যদের সাজা কিছু কমে গেলেও, ‘হেমচন্দ্র দাস’ (কানুনগো) ও ‘উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর’ বজায় থাকে। মানসিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সরকার ‘উল্লাসকর দত্ত’কে ১৯২০ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ভারতে আসার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে গিয়ে তৎকালীন ‘ব্রিটিশ সরকার’ বেশ কিছু রাজবন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল। দীর্ঘ ১২ বছর ‘আন্দামানের সেলুলার জেলে’ সশ্রম কারাদণ্ডের পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছিলেন ‘বারীন’, ‘হেমচন্দ্র’ ও ‘উপেন্দ্রনাথ’। দ্বিপান্তর থেকে দেশে ফিরেও উল্লাসকর নতুন করে ঘর বাঁধতে পারেন নি। এদিকে যাঁর জন্য ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁকেও পাশে পাননি, কারণ অরবিন্দ তখন চলে গিয়েছিলেন পণ্ডিচারীতে। উল্লাসকর কলকাতা থেকে সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে, তাঁর লক্ষ্য ছিল অরবিন্দকে আবার সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আশ্রমে উপস্থিত হয়ে অরবিন্দের সাথে সাক্ষাৎ করার যে বিধিনিষেধ ছিল তার কোনটাই তিনি মানেন নি। সকলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, অরবিন্দ কেন সেখানে থাকবেন? তাই সবকিছু এড়িয়ে, সবাইকে এড়িয়ে তিনি সটান হাজির হয়েছিলেন অরবিন্দের সামনে। তারপরেই করেছিলেন এক আশ্চর্য আচরণ। যে লোক যুক্তি-তর্কের জালে জড়িয়ে অরবিন্দকে বাংলায় টেনে আনবেন বলে মনস্থির করে গিয়েছিলেন, তিনি অরবিন্দের মুখোমুখি হয়ে কোন কথা না বলে ফিরে চলে এসেছিলেন। বিপ্লবী উল্লাসকর না ঘরের হতে পেরেছিলেন, আর না পরের। সংসারেও নয়, সংগ্রামেও নয়। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ছন্নছাড়া বাজপড়া তালগাছের মতন। আর ‘একদা বিপ্লবী’ অরবিন্দ ‘ঋষি’ হয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিলেন পণ্ডিচারীতে।
নিজের ভাইয়ের ‘ক্ষমতালিপ্সা’ একসময় কালিমালিপ্ত করেছিল তাঁকেও, ভেঙে গিয়েছিল তাঁর নিজের উদ্যোগে দেশে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড করার গুপ্ত সংস্থাটি। ইতিহাসের পাতায় সেগুলো আজও লেখা আছে। ‘অরবিন্দ ঘোষ’ বরোদা থেকে বাংলায় বিপ্লব ঘটানোর উদ্দেশ্যে নিজের অনুগত সৈনিক ‘যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’কে কলকাতায় ও মেদিনীপুরে পাঠিয়েছিলেন। মেদিনীপুরে ছিলেন অরবিন্দর আত্মীয় ‘সত্যেন বসু’। ‘যতীন্দ্রনাথ’ ‘সতেন্দ্রনাথ’কে দিয়ে মেদিনীপুরে একটি ‘গুপ্ত সমিতি’ স্থাপন করান। এতে আশ্বস্ত না হয়ে ‘অরবিন্দ’ আবার পাঠিয়েছিলেন নিজের ভাই ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’কে। ‘বারীন্দ্র’ প্রথমেই ‘যতীন্দ্রনাথ’কে সরাবার উদ্যোগ করেছিলেন। ‘যতীন্দ্রনাথ’ এক আত্মীয়ার সঙ্গে ‘গুপ্ত সম্পর্কে লিপ্ত’ আছেন, এই ‘অভিযোগ’ তুলেছিলেন অরবিন্দর কাছে ‘বারীন’। ‘অরবিন্দ’ যতীন্দ্রনাথের বক্তব্য না শুনেই তাঁকে ‘বরখাস্ত’ করেন। এরপরে ‘ঈর্ষাকাতর’, ‘ক্ষমতালিপ্সু’ ‘বারীন্দ্রকুমার’ লেগেছিলেন তাঁর আত্মীয় ‘সত্যেন বসু’র পেছনে। এবারেও ওই একই নারীর সঙ্গে ‘গুপ্ত ভাবে লিপ্ত থাকার অভিযোগ’ তুলেছিলেন সতেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। ফলে তখনকার মতো গুপ্ত সমিতি ভেঙে গিয়েছিল। এ সব ১৯০০ ও তার অব্যবহিত পরের ঘটনা। ১৯০৫ সালে কলকাতায় এসে অরবিন্দকে নতুন করে সমিতি গঠন করতে হয়েছিল। তাতেও কিন্তু তাঁর ‘ভ্রাতৃপ্রীতি’ ঘোচে নি।
আলিপুর বোমা মামলার বিচারপর্বে অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে উপরে উদ্ধৃত যে উক্তিটি ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’ করেছিলেন, তা থেকে ‘জাতীয়তাবাদী নেতা’ হিসাবে অরবিন্দের ‘বহুবর্ণ ভাবমূর্তি’ নিখুঁত পরিস্ফুট হয়। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির এক অন্যতম পুরোধা’, স্বদেশী আন্দোলনে উত্তাল বঙ্গদেশে যাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দেশমাতৃকার জন্য ত্যাগস্বীকারে বঙ্গজ যুবসমাজকে তিনি যে ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ধরা আছে ইতিহাসের পাতায়। দ্বিমতও অবশ্য রয়েছে অরবিন্দের ব্যাপারে। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন অরবিন্দের তথাকথিত ‘বিভাজনমূলক রাজনৈতিক দর্শন’ নিয়ে। স্বাধীনতার এত বছর পরে, আজ কতটা প্রাসঙ্গিক ‘অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন’? ‘ইতিহাসবিদ সুগত বসু’ তাঁর ‘The Spirit and Form of an Ethical Polity: A Meditation of Aurobindo’s Thought’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখছেন, “অরবিন্দের রাজনৈতিক ভাবনা এবং তার নৈতিক ভিত্তিস্থল বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। তার কারণ হল, অর্ধশতক ধরে রাষ্ট্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার একরকম প্রথাগত অধ্যয়নের প্রভাব।” সাম্প্রতিক অতীতে, এক ইংরেজি দৈনিক কে দেওয়া এক ‘ই-মেল সাক্ষাৎকারে’ ‘ঐতিহাসিক রাহুল গোবিন্দ’ লিখেছিলেন, “এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের গবেষণা এবং বর্তমান ভারতে যে ধর্মীয় চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবধারার আধিপত্য, কোথাও গিয়ে যেন আশ্চর্যভাবে এক সূত্রে মিলে যায়। যাঁদের রাজনৈতিক-ভাবনার মধ্যে ওই ধর্মীয় চেতনার স্বর খোঁজার চেষ্টা হয়, অরবিন্দ তাঁদের অন্যতম। যদিও, অরবিন্দের বিষয়ে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি তেমন। বরং, ‘শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়’ এবং ‘সঞ্জয় পালশিকর’ তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘গীতা’-র বিষয়ে ‘অরবিন্দের বিশ্লেষণ’ পশ্চিমি ধারার ব্যাখ্যারই অনুগামী (‘হামবোল্ডট’-এর কথা স্বর্তব্য এখানে)। ‘শঙ্করা’-র মতো প্রাচ্য ঐতিহ্যের অনুসারী নয়।
১৯০৯। পরাধীন ভারতের এক অদ্ভুত মুহূর্ত। ইংরেজ শাসনের চাপ ক্রমবর্ধমান, কেননা স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষী যুবসম্প্রদায়ের তীব্র চাওয়া ফুটে উঠছিল নানা দিক থেকে। আর সেই সব চাওয়ার মাঝখানে অরবিন্দ ঘোষের মত এক যুবকের শিক্ষিত মেধাবী অসামান্য মনন আর অদ্ভুত দ্বিখন্ডিত, আশ্চর্য চুরমার জীবন, বেছে নিচ্ছিল আবেগের সঙ্গে মেধার উত্তুঙ্গ মেলবন্ধনের ‘কবিতা’ তথা ‘প্রার্থনা’, ‘স্বপ্ন’ তথা ‘কামনা’, ‘ভক্তি’ তথা ‘শপথের’ এক লেখা, ‘দুর্গা স্তোত্র’কে। ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত ‘সলিটারি কনফাইনমেন্টে’, ‘একাকি জেলবাসে’ থাকতে হয়েছিল শ্রী অরবিন্দকে। এই সময়েই তাঁর বিপ্লবী জীবন ‘আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে’ ঘুরে যেতে থাকে। আর সেই সময়ে তিনি লিখেছিলেন ‘দুর্গা স্তোত্র’। সেই ‘স্তোত্রে’ কবি কল্পনায় ‘শক্তিমূর্তি অনন্ত আশাপ্রদায়িনী’। কিন্তু ‘ভাষার ওজস্বিতা’ শ্রী অরবিন্দের এমনই ছিল যে, তিনি সে ভাষাকে কোথায় না নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ‘স্তোত্রে’। ‘সিংহবাহিনী মা’কে বঙ্গদেশের যুবকেরা বলছে, জীবন সংগ্রামে ভারত সংগ্রামে তোমার প্রেরিত যোদ্ধা আমরা, তুমি আমাদের প্রাণে মনে অসুরের শক্তি দাও অসুরের উদ্যম দাও। সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে মুহূর্তে সেই লেখা লেখা হয়েছিল; ‘ক্ষুদিরাম’, ‘প্রফুল্ল চাকী’, ‘যতীন বাগচী’দের আত্মদানের যে গৌরব তখন রচিত হচ্ছিল, তখন, ‘সাদাকালো’, ‘দৈবী শক্তি-আসুরিক শক্তির ভেদ মুছে দেওয়া’ সেই লেখাকে কী বলা যাবে, ‘কবির কল্পনা’, নাকি আজকের ভাষায় ‘সাবভার্শান’। ধর্মকে ব্যবহার করার নানা ফন্দিফিকিরে আক্রান্ত আমরা আজকের পাঠক, সেই লেখার ‘একমুখী বিশ্বাসী আবেগী অভিঘাতের সামনে’ নতজানু হই তাই। অরবিন্দের সেই লেখার সূত্র ধরে আজকের এই মুহূর্তে আর এক বড় প্রশ্ন আসে আমাদের সামনে। ‘দুর্গাপূজা’, সেটা কতটা ‘প্রতীকী’, আর কতটা ‘হিন্দু ধর্মের এক চিরাচরিত বিধিমাত্র’। এক প্রাতিষ্ঠানিক পূজা আচরণ। বসন্তের বদলে ‘অকালবোধনে’, শরতে ‘দুর্গাপূজা’ তো ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণের কাহিনী’র সঙ্গে জড়িত এক অন্য ‘বিধিভঙ্গ’। তাছাড়াও, এর ‘প্রতীকায়ন’ তো বার বার ঘটে গেছে এ বাংলার সংস্কৃতিতে। আর ‘বাংলা-উড়িষ্যা-অসম’ নিয়ে যে বৃহত পূর্বী ক্ষেত্র, সে ক্ষেত্রের সজল মাটিতে ‘দুর্গা’ তো নানারূপে আরাধিতা। বাড়ির মেয়ে, ‘ঘরের কন্যা উমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসা, ‘শক্তিপীঠের শক্তি পূজা’, আবার ‘দেশমাতৃকা’ অথবা ‘সত্য-ন্যায়-সম্প্রীতি-মানবতার পূজা’। সাংস্কৃতিক বোধে উদ্দীপিত এক সামাজিক বোধন। এই সব কিছুর সুদীর্ঘ ইতিহাসে, অরবিন্দের সেই ‘দুর্গা স্তোত্র’ও একটি মাইল ফলক, নয়কি? আজকের এই ক্ষতবিক্ষত, নৈরাশ্যময় সময়ে, এই বাণী, এই আবাহন, “আর বিসর্জন করিব না” বলে এই প্রতিশ্রুতি, আর সবশেষে, “আমাদের জীবন অনবিচ্ছিন্ন দুর্গাপূজা হউক”, এ শপথ, অনেক আত্মবলিদানের স্মৃতি মনে আনে, আবার নতুন করে উদ্বুদ্ধও করে না কি?
অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) ঘোষকে আমরা বলতে পারি ‘বিপ্লবী আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক’, ‘জাতীয়তাবাদী নেতা’, ‘আধ্যাত্মিক সাধক’ এবং ‘দার্শনিক’। ১৮৭২ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। পিতা ‘কৃষ্ণধন ঘোষ’ ছিলেন ‘বিলেতফেরত ডাক্তার’। ‘ডিস্ট্রিক্ট সার্জেন’। মাতা ‘স্বর্ণলতা দেবী’ ছিলেন কলকাতার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ‘ব্রাহ্মসমাজখ্যাত রাজনারায়ণ বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা’। একজন আলোকপ্রাপ্তা মহিলা। কবিতা লিখতেন। বোঝাই যায়, বনেদি পরিবার। বাবা মায়ের লক্ষ্য ছিল ছেলেকে ‘পাশ্চাত্য শিক্ষায় ও ভাবধারায়’ গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যে ছেলেকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ‘দার্জিলিং’ এর ‘লরেটো কনভেন্ট’-এ ভর্তি করা হয়। এরপর ১৮৭৯ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে, তাঁর অগ্রজ দুই ভাইয়ের সঙ্গে তাঁকেও বিলেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৮৮৪ পর্যন্ত তিনি ‘ম্যাঞ্চেস্টারের গ্রামার স্কুলে’ পড়েন। ‘কেমব্রিজ’ থেকে ‘প্রবেশিকা পরীক্ষা’য় উত্তীর্ণ হন। এর পর ‘কিংস কলেজে’ অধ্যয়ন করেন। ‘স্নাতক’ হন। ‘ল্যাটিন’, ‘গ্রীক’, ‘ফ্রেঞ্চ’ ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। মজার বিষয় হল, তাঁর ‘বাংলা ভাষা শিক্ষা’ শুরু হয়েছিল ইংল্যাণ্ডেই, ‘মিস্টার টাওয়ার্স’ নামের এক ইংরেজ শিক্ষকের কাছে। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন এবং আঠারো বছর বয়সে পৌঁছানোর মধ্যেই তাঁর মনে এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, ব্রিটিশদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে ভারতের মুক্তি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্জন করতে হবে। ছাত্র জীবন থেকে তিনি ‘ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ফরাসি বিপ্লবের নেতা ‘দাঁতে’ এবং ‘রোবসপিয়ার’ তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘পিটিশনের মাধ্যমে’ দেশের স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না, বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি ‘বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি’র প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮৯০ সালে অরবিন্দ ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস’ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু ‘অশ্বচালনা পরীক্ষা’য় অংশগ্রহণ না করায় ‘আই সি এস’ সম্পূর্ণ হয় না। বিলেতে থাকা অবস্থাতেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের কথা জানতে পারেন। সেখানেই তিনি তাঁর ভাইদের সঙ্গে এবং কিছু উৎসাহী ভারতীয় তরুণদের সাথে ‘Lotus and Dagger’ নামে একটি ‘গুপ্ত সমিতি’ গড়ে তোলেন। ফরাসী বিপ্লব ও আইরিশদের মুক্তি সংগ্রাম খুব সম্ভবত তাঁকে এইরকম একটি সমিতি গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছিল। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে ভারতকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার বাসনা জেগে ওঠে। কেম্ব্রিজে পড়াকালীন তিনি সেখানকার ‘ভারতীয় মজলিসের’ সম্পাদক ছিলেন। সেখানে তিনি এ নিয়ে নানা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। সেই সময়ে লণ্ডনেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ‘বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াডের’, যিনি ২০০ টাকা মাসিক বেতনে তাঁর ‘স্টেট সার্ভিসে’ অরবিন্দকে চাকরি দেন। ১৯০০ সালে অরবিন্দ ঘোষ ‘বরোদা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক’ হন। ১৯০৪ সালে ‘অধ্যক্ষ’ নিযুক্ত হন। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি ‘বরোদা’য় কাজ করেন। এখানেই তিনি ‘ভারতীয় ভাষা’, ‘সংস্কৃতি’, ‘ধর্ম’ ও ‘শাস্ত্র’ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। ‘সংস্কত’ শিখে অধ্যয়ন করেন ‘বেদ’, ‘উপনিষদ’, ‘গীতা’, ‘কালিদাস’, ‘ভবভূতি’, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘মনুস্মৃতি’ ইত্যাদি। ‘বাংলা’র পাশাপাশি শেখেন ‘গুজরাতি’ ও ‘মারাঠি’।
অরবিন্দের রাজনৈতিক সক্রিয়তার সূচনা হয় ১৮৯০ সালেই, কংগ্রেসের নরমপন্থী মনোভাবের বিরোধিতার মাধ্যেমে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটে স্বদেশি আন্দোলনের সময়, যখন তিনি ডাক দিয়েছিলেন ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ বা ‘Passive Resistance’-এর। ‘সুগত বসু’র মতে, “অরবিন্দের বক্তব্য ছিল, কৌশলগতভাবে ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই, তবে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যেও কোন অনৈতিকতা নেই। আমাদের সেই সংগ্রামের রসদ নেই, এই যা।”
১৯০১ সালে অরবিন্দ ঘোষ ‘বরোদা’য় থাকাকালীন ১৫ বছর বয়সী কলকাতার ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী, ‘ভূপালচন্দ্র বসুর কন্যা মৃণালিনী দেবী’কে হিন্দুশাস্ত্র মতে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল প্রায় ১৭ বছর। ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে ‘মৃণালিনী দেবী’ খুব কম সময়ই ‘স্বামী সান্নিধ্য’ পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময় দেশের কাজে ব্যস্ত থাকায় অরবিন্দ ঘোষ স্ত্রী ‘মৃণালিনী দেবী’র সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন চিঠিপত্রের মাধ্যমে। তিনি দেশের কাজে কবে কোথায় থাকতেন, তার কোনও ঠিক ছিল না। স্ত্রী ‘মৃণালিনী দেবী’ স্বামী সান্নিধ্য না পাওয়ায় মাঝে মাঝে ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ হয়ে পড়তেন। অরবিন্দ ঘোষ তাঁর অবস্থাটা চিঠির মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘আবার সেই কথা বলি, তুমি একজন সাধারণ লোকের স্ত্রী হও নাই, তোমার বিশেষ ধৈর্য ও শক্ততার দরকার। এমন সময়ও আসিতে পারে যখন একমাস কিংবা দেড়মাস নয়, ছমাস পর্যন্তও আমার কোনও খবর পাইবে না। এখন থেকে একটু শক্ত হইতে শিখিতে হয়, তাহা না হইলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখভোগ করিতে হইবে।’’
বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলনের মূল সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’। ১৯০৬ সালে শুরু হয় ‘যুগান্তর’ সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
যখন ব্রিটিশ শাসনের কঠোর দমননীতির বিরুদ্ধে বাংলায় সন্ত্রাসবাদ গড়ে উঠেছে, অরবিন্দ ঘোষ ‘আপস নয়’ (১৯০৩) নামে একটি বই লিখে বিপ্লবী দলের সদস্যদের মধ্যে গোপনে প্রচার করেন এবং এই কাজে তাদের উৎসাহিত করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলায় প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল। অরবিন্দ বরোদার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলায় চলে আসেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালে ‘কলকাতায় জাতীয় কলেজের’, বর্তমানে যা ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘প্রথম অধ্যক্ষ’ হন। একই সঙ্গে ‘বিপিনচন্দ্র পালের’ ‘বন্দেমাতরম্’ ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের জন্য ‘বিপিনচন্দ্র পাল’ এবং তিনি রাজদ্রোহে অভিযুক্ত হন। বিপিনচন্দ্রের ছয় মাস কারাবাসের সাজা হয়। প্রমাণাভাবে অরবিন্দ মুক্তি পান। পাঁচ বছর (১৯০৬-১৯১০) সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ‘বিপ্লবী দলের নেপথ্য নায়ক’ ও ‘কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতা’ হিসেবে পরিচিতি পান।
১৯০৫-০৬ সালের মধ্যে ভারতের সর্বত্র ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন’ গড়ে ওঠে। ‘বয়কট আন্দোলন’ ধীরে ধীরে ‘স্ব-রাজলাভের আন্দোলনে’ রূপ নিতে শুরু করে। ঠিক এমন সময় ‘বরোদা’ থেকে অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় চলে আসেন। তিনি ‘বরোদার রাজ কলেজে ভাইস-প্রিন্সিপাল’ হিসেবে চাকুরী করতেন। তখন তাঁর বেতন ছিল ১৫০০ (পনেরশত) টাকা। এত বড় অঙ্কের বেতনের চাকরি পরিত্যাগ করে তিনি কলকাতায় এসে অনেক কম বেতনে ‘ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ’ হিসেবে চাকুরী নেন। এখানে তাঁর বেতন ছিল মাত্র ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা। এর পিছনে মূল কারণ ছিল বরোদা থেকে বিপ্লবী দল পরিচালনা করতে তাঁর খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। বারবার কলকাতায় আসা-যাওয়া করে বিপ্লবী কাজ যথা সময়ে সম্পাদন করা যেত না। মাতৃভূমির বুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে মেনে নিতে পারছিলেন না অরবিন্দ ঘোষ। তাই সুবিধামত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সংগঠিত করে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার জন্য তিনি কলকাতায় চলে আসেন।
“রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান শাসকশ্রেনীর চরিত্রই হল তাদের অধীন জনগোষ্ঠীর কোনরূপ প্রতিবাদকে উগ্র এবং অপরাধমূলক বলে প্রতিপন্ন করা”, লিখেছিলেন অরবিন্দ ১৯০৭ সালে, ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায়। মধ্যতিরিশের অরবিন্দ তখন মনে করতেন, নিস্পৃহ প্রতিরোধ যে কোন সময় বদলে যেতে পারে সম্মুখসমরে। এবং যদি তা-ই হয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা যাবে না। যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যারা দ্বিধাগ্রস্ত থাবে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের সস্নেহ তিরস্কার।
‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় ‘The Morality of Boycott’ শীর্ষক আরেকটি নিবন্ধে অরবিন্দ কাব্যিক ভঙ্গিতে লিখেছিলেন “দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরানোর তৃপ্তি”-র কথা। ইতিহাসবিদ ‘এম. কে. হালদার’ অরবিন্দের রাজনৈতিক চেতনার বিষয়ে লিখেছেন, “সহিংসা বা অহিংসা তাঁর কাছে দেশের স্বাধীনতার জন্য দুটি বিকল্প পন্থার বেশি কিছু ছিল না।”
অরবিন্দের কাছে দেশমাতাকে স্বাধীন করাই ছিল এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। গবেষকরা কেউ কেউ তাঁকে ‘Matrist’ (‘মাতৃতান্ত্রিক’, মায়ের প্রতি অনুরাগ যার বাবার থেকে তুলনায় বেশি হয়) বলেও অভিহিত করে থাকেন। অরবিন্দ লিখেছিলেন, “মাতৃভূমি ছাড়া কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে পূজ্য নয়। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে অভীষ্ট নয়। এবং কোনও পন্থাই রাজনৈতিকভাবে শুভ বা অশুভ নয়, যতক্ষণ না তা জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সহায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে।”
‘বরোদা’য় বিপ্লবী সংগঠন গোপনে কাজ করত। অরবিন্দ তাঁদের সংস্পর্শে আসেন। অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত করে ওইরূপ দল গঠনের জন্য বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন।
১৯০২ সালে ‘বারীন্দ্র কুমার ঘোষ’ লন্ডন থেকে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের বহ্নি ছড়াতে থাকেন। কিন্তু বাঙালী ভদ্রলোকেরা মোটেই সাড়া দেয়নি। বিফল হয়ে তিনি বরোদায় বড়ভাই অরবিন্দ ঘোষের নিকট ফিরে যান। ‘বারীন্দ্র কুমার ঘোষ’ ‘বরোদা’য় বসে অনুধাবন করেন, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ হবে না। এজন্য তিনি ‘গীতা পাঠের সঙ্গে রাজনীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে’ ‘অনুশীলন সমিতি’র পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।
এরপর অরবিন্দর অনুপ্রেরণায় ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে তৈরি হয় সশস্ত্র বিপ্লবী ‘অনুশীলন সমিতি’ (দল)। ‘৩২নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি’টি ছিল বারীন্দ্রকুমার ঘোষদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সশস্ত্র বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর দলের আখড়া গড়েছিলেন এই মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির মাঝখানে ছিল ছোটো একটি পাকাবাড়ি। বাড়িটির চতুর্দিকে ছিল গাছপালা। অরবিন্দ ঘোষ এবং অপর দুই ভাই মনোমোহন ঘোষ ও বিনয় ঘোষ এই বাগানবাড়িতে বসবাস করতেন। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করেই ‘বারীন্দ্র কুমার ঘোষ’, ‘উল্লাসকর দত্ত’, ‘উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি’, ‘হেমচন্দ্র ঘোষ’, ‘অবিনাশ ভট্টাচার্যর’ মতো বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। এক সময় ওই ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র। ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবের বাণী প্রচারের অধ্যায়। এই সময় প্রকাশিত হতে থাকে ‘সন্ধ্যা’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘যুগান্তর’ প্রভৃতি পত্রিকা। ‘সখারাম গণেশ দেউস্কর’, ‘পি মিত্র’, ‘যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে’ বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নানা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিপ্লবী যুবকদের শিক্ষাদান পর্ব চলতে থাকে। ১৯০৩ সালে কলকাতায় ‘প্রমথ মিত্র’ ও ‘চিত্তরঞ্জন দাশ’ ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘প্রমথ মিত্র’ ১৯০৫ সালে ‘বিপিন চন্দ্র পালের’ সঙ্গে ‘ঢাকা’য় এসে ‘অনুশীলন সমিতির একটি শাখা’ স্থাপন করেন এবং ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’র দায়িত্ব গ্রহণ করেন ‘পুলীন বিহারী দাস’। এই সমিতির কেন্দ্র ছিল ‘ঢাকার উয়াড়ি’তে। বহু দেশপ্রেমিক যুবক স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন এই বিপ্লবী অনুশীলন দলে। দলের সদস্যরা বিদেশি শাসকের বুকে আঘাত হানতে ‘লাঠি খেলা’, ‘ছোরা ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষা গ্রহণ’ শুরু করেন। ১৯০৬ সালের দিকে বিপ্লবীদের দ্বিতীয় দল ‘যুগান্তর সমিতি’র জন্ম হয় কলকাতায়। ‘অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্র ঘোষ’ ‘যুগান্তর সমিতি’ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। ১৯০৫ সালে কার্জন সাহেবের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা সমগ্র বঙ্গদেশকেই আলোড়িত করে তোলে। বিক্ষুব্ধ বঙ্গবাসীরা বিদ্রোহের ধ্বজা নিয়ে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। ১৯০৬ সালে অরবিন্দ ঘোষ বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবাসীকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করার অভিযান শুরু করেন। এই সময় ‘বারুইপুরে’ ও ‘উত্তরপাড়ায়’ তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তাঁর ভগিনী নিবেদিতাও তখন বিপ্লববাদী যুবকদের সাহায্য করতেন। এই সময় বিপ্লববাদীদের প্রচারের ধারার নিদর্শন হিসাবে ১৯০৬ সালের একটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলার বিপ্লবীদের মুখপত্র ‘যুগান্তর’ ১৯০৬ সালে বরিশালে ব্রিটিশ শাসকদের নিষ্ঠুর দমনপীড়নের পর ২৬ এপ্রিল সম্পাদকীয়তে খোলাখুলি লেখে – ‘‘দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।’’
ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য বাংলার যুবকরা তখন জেগে উঠেছে। যেখানেই ইংরেজের অত্যাচার দেখছে সেখানেই তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই প্রতিবাদের জন্য তাঁরা নির্যাতিত হতে থাকে। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলার দিকে দিকে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দেবার জন্য অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকরা সংঘবদ্ধ হন। ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতন যতই বাড়তে থাকে, বাংলাদেশে সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিষয়টি ততই প্রবল হয়ে উঠে। ‘ঝামাপুকুর’ ও ‘মানিকতলায়’ বোমা তৈরির কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিপ্লবীরা। বিপ্লবের এই গোপন আয়োজন ক্রমে ক্রমে ‘মেদিনীপুর’, ‘চন্দননগর’, ‘কৃষ্ণনগর’, ‘শ্রীহট্ট’, ‘বগুড়া’, ‘রংপুর’, ‘বরিশাল’, ‘ঢাকা’তেও ছড়িয়ে পড়ে। ‘অনুশীলন সমিতি’র শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে উঠে ‘ঢাকা’য়।
১৯০৫ সালে অরবিন্দ ঘোষ ‘বরোদা’ থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন ‘স্ত্রী মৃণালিনী দেবী’কে। চিঠির একাংশে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলি হইবার চেষ্টা করিবে? অন্ধ রাজার মহিষী চক্ষুদ্বয়ে বস্ত্র বাঁধিয়া নিজেই অন্ধ সাজিলেন। হাজার ব্রাহ্মস্কুলে পড়িয়া থাক, তবে তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, হিন্দু পূর্বপুরুষের রক্ত তোমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই, শেষোক্ত পথই তুমি ধরিবে।’’ সেই চিঠিটিরই অপর অংশে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মার বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তবোধে আহার করিতে বসে? স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে? না, মাকে উদ্ধার করিতে পৌরোহিত্য করে?’’
১৯০৭-এ ‘কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে’ দলের ‘নরমপন্থী’ অংশের সঙ্গে অরবিন্দ সহ অন্যান্য ‘চরমপন্থী’ নেতাদের মতবিরোধ তুঙ্গে ওঠে। কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় এর কিছুদিন পরেই। অরবিন্দ অবশ্য ততদিনে কলকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি’-র মতো সহিংস সংগ্রামে বিশ্বাসী গুপ্ত সংগঠনগুলির নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন।
১৯০৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে স্বদেশি ইংরেজি ‘দৈনিক বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বিপ্লবী যুবকদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেন। অরবিন্দ ঘোষের সাথে যোগাযোগ ছিল ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপপাধ্যায়ের। এই স্বদেশি পত্রিকাগুলোর মূলমন্ত্র ছিল বিদেশির হাত থেকে যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া। সশস্ত্র বিপ্লবীরা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন এই স্বদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত জ্বালাময়ী নিবন্ধ পড়ে। বিপ্লবী যুবকরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াতে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিপ্লবী আখড়া গড়ে তোলেন। ‘রাজদ্রোহের অভিযোগে’ ১৯০৭ সালে ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করে ইংরেজ প্রশাসন। আসামি করে গ্রেপ্তার করা হল ‘অরবিন্দ ঘোষ’, ‘হেমচন্দ্রনাথ বাগচী’ ও ‘অপূর্বকৃষ্ণ বোস’কে। ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার ‘ম্যানেজার’ ছিলেন ‘হেমেন্দ্রনাথ বাগচী’ আর ‘অপূর্বকৃষ্ণ বোস’ ছিলেন পত্রিকার ‘মুদ্রাকর’। সেই সময় ‘কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট’ ছিলেন ‘মি. কিংসফোর্ড’। অভিযুক্ত আসামি তিনজনকে তোলা হয়েছিল মি. কিংসফোর্ডের আদালতের আসামির কাঠগড়ায়। সাক্ষ্যসাবুদ নেওয়া হয়েছিল ১৯০৭ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই মামলাটির নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘বন্দেমাতরম্ মামলা’। প্রমাণাভাবে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অরবিন্দ ঘোষ ও ‘হেমেন্দ্রনাথ বাগচী’কে। ‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারা’য় দণ্ডিত করা হয়েছিল ‘অপূর্বকৃষ্ণ বোস’কে। ‘বন্দেমাতরম্ মামলা’য় সরকার পক্ষ থেকে সাক্ষী মানা হয়েছিল ‘বিপিনচন্দ্র পাল’কে। সেইমত ‘চিফ্ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব’ বিপিনচন্দ্র পালের নামে ‘সমন’ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ‘বিপিনচন্দ্র পাল’ সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় ‘আদালত অবমাননা’ করার জন্য তাঁকে ছয়মাসের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মি. কিংসফোর্ড সাহেবের আদালতে যখন ‘বন্দেমাতরম্’ মামলাটির শুনানি চলছিল তখন একদিন ১৪/১৫ বছরের বালক ‘সুশীল সেন’ আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছিল, ‘বন্দেমাতরম্! বন্দেমাতরম।’ ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে নির্দয় কিংসফোর্ড বালক সুশীল সেনকে ১৫ ঘা বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এক দেশপ্রেমিক বালককে বেত্রদণ্ড দেওয়ায় বিপ্লবীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন। এঘটনায় শুধু ভারতবাসী নয়, অনেক ইংরেজও ক্ষুব্ধ হলেন। এই ঘটনায় বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে কিংসফোর্টকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই হত্যার দায়িত্ব নিলেন ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’।
‘বারীন ঘোষের নেতৃত্বে’ কলকাতার ‘মানিকতলা’য় তরুণ স্বদেশীদের ‘বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণ’ দেওয়া শুরু হয়। ‘মানিকতলা’র সেই জায়গাটি এখন ‘বোমার মাঠ’ নামে খ্যাত। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল। ‘ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ড সাহেব’কে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছেন ‘ক্ষুদিরাম বোস’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’। এই কিংসফোর্ড ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। সামান্যতম অপরাধে বিপ্লবীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতেন। কিন্তু এই হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বোমার আঘাতে দুজন ইংরেজ মহিলা মারা যান। ‘ক্ষুদিরাম’ ধরা পড়েন। ‘প্রফুল্ল চাকী’ ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যূবরণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’ এই দুটি নাম উচ্চারিত হলেই একটি ফাঁসি ও নিজের বন্দুক থেকে মাথায় গুলি করার একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে প্রতিটি ভারতবাসীর মানসনয়নে।
ব্রিটিশ প্রশাসকেরা বুঝতে পারেন ‘মজফ্ফরপুরে’ ‘কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে’ ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’কে কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল। তাই কলকাতার পুলিশ প্রশাসন আর অপেক্ষা না করে বিপ্লবীদের ডেরাগুলিতে হানা দিল। তল্লাসী শুরু হল ব্যাপকভাবে। পুলিশের কাছে আগে থেকেই অনেক গুপ্ত খবর ছিল। গুপ্তচরদের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯০৮ সালের ২রা মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি জায়গায় খানা-তল্লাশি চালায়। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’, ‘উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘উল্লাসকর দত্ত’ ও ‘নলিনীকান্ত গুপ্ত’সহ ১৪ জনকে। ৫ই মে, ‘৪৮নং গ্রে স্ট্রিট’ থেকে ‘অরবিন্দ ঘোষ’সহ তিনজনকে, ‘১৩৪নং হ্যারিসন রোড’ থেকে ৫ জনকে, ‘রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট’ থেকে ‘হেমচন্দ্র দাস কানুনগো’, ‘গোপীমোহন দত্ত লেন’ থেকে ‘কানাইলাল দত্ত’সহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। ‘১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি’ থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ ছাড়াও পুলিশ ‘৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি’ থেকে মাটির তলায় পুঁতে রাখা কতিপয় ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই ট্রাঙ্কগুলি থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু তাজা বোমা, কতকগুলি বোমা তৈরির খোল, বৈপ্লবিক পুস্তক-পুস্তিকা ও চিঠিপত্র। কিছু ডিনামাইট ও একটি রিভলভারও পাওয়া যায়। এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ‘বোমা ষড়যন্ত্রের ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা’। এই মামলাটিরই নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’। মোট ৩৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বিচারের জন্য চালান দেওয়া হয়। অচিরেই দেশের সাধারণ মানুষ জানতে পারেন ‘অরবিন্দ ঘোষ’, ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’, ‘উল্লাসকর দত্ত’, ‘নির্মল রায়’, ‘কবিরাজ ধরণীধর গুপ্ত’, ‘ইন্দুভূষণ সরকার’, ‘শচীন সেন’, ‘কুঞ্জলাল সাহা’ প্রমুখ বিপ্লবী নেতৃত্ব রাজদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। স্বাধীনতা-পিপাসু মানুষ এই সব দেশবরেণ্য বিপ্লবীদের গ্রেফতারের কথা জেনে ক্ষেপে উঠলেন। বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অগ্নিরোষ আরও গভীর হল। দিকে দিকে আওয়াজ উঠল ‘বন্দেমাতরম্’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর আলিপুরের ‘জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট্’-এর আদালতে ‘মুরারিপুকুর বোমা মামলা’র সূচনা হয়েছিল। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের পক্ষে মামলা লড়েন। অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশী সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের পরিসমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। এই মামলায় তিনি যে সওয়াল করেছিলেন তা জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন। বিচারের রায়ে ‘অরবিন্দ ঘোষ’ মুক্তি পান।
এই মামলা চলাকালীন স্বীকারোক্তিতে ‘বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’ সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন।
এই মামলায় প্রথমে তাঁদের ‘মৃত্যুদণ্ড’ দেওয়া হয়, যা পরে ‘কালাপানি’ অর্থাৎ ‘আন্দামান সেলুলার জেলে’ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল করা হয়। ১৯২০ সালে ‘জেনারেল এমনেস্টির’ ফলে, ১২ বছর আন্দামানের জেলে কাটিয়ে ‘বারীন ঘোষ’ সহ বাকি সকলে মুক্তি পান।
বিচার চলার সময় আরবিন্দ ঘোষ এক বছর ছিলেন ‘নির্জন কারাগারে’ বন্দী। এই নির্জন বন্দীদশা তাঁর জীবনে এনে দিয়েছিল এক পরম আশীর্বাদ। কারাগার তাঁর কাছে কারাগার ছিল না, হয়েছিল আশ্রম। যোগ আর তপস্যার একাগ্রতার মধ্য দিয়ে অরবিন্দ ঘোষ সেই বন্দীদশাতেই ভগবানের দর্শন লাভ করেছিলেন। এক বছরের হাজত বাস অরবিন্দ ঘোষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। এক বছর জেলে কাটানোর পর্বে তাঁর রাজনৈতিক ভাবাদর্শে ছোঁয়া লাগে আধ্যাত্মিক চিন্তার। অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।” জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরবিন্দ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতায়। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ রূপান্তরিত হলেন সাধক অরবিন্দ ঘোষ রূপে। তবে তিনি দেশসেবার ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। ধর্মপথে দেশসেবার ব্রত গ্রহণ করেন। তাঁর লেখনীতে তখন শুধু জাতীয়তার বাণীই থাকত না, আধ্যাত্মিক তত্ত্বও থাকত। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ জানা গেল যে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার চক্রান্ত করছে। কলকাতার নানা পরিচিত জনের বাড়িতে তখন তিনি আত্মগোপন করে থাকতে লাগলেন। ‘ভগিনী নিবেদিতা’র বাড়িতেও রইলেন একদিন। শেষে নিবেদিতাই তাঁকে চন্দননগরে চলে যাবার সুযোগ করে দেবার জন্য গঙ্গায় একটি নৌকায় তুলে দিলেন। তখন চন্দননগর ছিল ফরাসী অধিকৃত এলাকা। সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন পন্ডিচেরীতে। সেটাও ছিল ফরাসী অধিকৃত রাজ্য। ১৯১০ সালের ৪ঠা এপ্রিল তিনি পন্ডিচেরীতে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দর্শনবিষয়ক পত্রিকার নাম ছিল ‘Arya’।
ইতিহাসবিদদের মতে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন যে সব দেশনেতারা, অরবিন্দ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ই প্রথম ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ করেছিলেন রাজনীতিতে, তার পরে ‘বিবেকানন্দ’ও। ‘ইতিহাসবিদ এম কে হালদারের’ মতে, “অরবিন্দের হাত ধরেই ভারতীয় রাজনীতি ধর্মের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিল। সেই থেকেই ধর্ম ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।”
একটি লেখায় অরবিন্দ বলেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রথমে উপনিষদ, এবং তারপর ‘গীতা’ দ্বারা প্রভাবিত। ‘গবেষক ডেভি’ অবশ্য মানেন না যে অরবিন্দের রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল। ‘ডেভি’র মতে, “অরবিন্দ দার্শনিক ছিলেন। উপনিষদ তো বেদেরই নির্যাস, এবং বেদ কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলে না। বেদ মূলত দর্শনগ্রন্থ। ধর্ম তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক পরে, পরোক্ষভাবে।” ‘ডেভি’ আমাদের আরও মনে করিয়ে দেন, “হোমার সহ অন্যান্য ইউরোপিয় দার্শনিকদের কাজ মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন অরবিন্দ। পড়েছিলেন বৌদ্ধদর্শনও। তিনি ছিলেন এমন এক দার্শনিক, সব ধর্মই যাঁর কৌতূহলের বিষয় ছিল।”
‘সুগত বসু’ অবশ্য মনে করেন, অরবিন্দের ধর্মীয় চিন্তাকে নৈতিকতার কষ্টিপাথরে যাচাই করা উচিত, “তাঁর ‘ধর্ম’ বিষয়ে ধারণার অবিচ্ছেদ্য যোগ ছিল আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে, নৈতিকতার সঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘রাজনীতি থেকে ধর্মকে সরিয়ে নেওয়ার নামে রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে সরিয়ে নিও না’।”
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক ভাবধারার তুলনায় সবচেয়ে বেশি উদারমনা এবং উন্মুক্ত, এমনটাই ‘ডেভি’র মত।
ঋষি অরবিন্দ সম্বন্ধে বিস্ময়কর যা তা হল বিপ্লবী থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক সাধকে রূপান্তর প্রসঙ্গটি। জীবন যতই সামনের দিকে এগিয়েছে, ততই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য কী? কী আমাদের প্রকৃত কর্ম? ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ তাড়িয়ে স্বাধীনতা এলে মানবিকতা, প্রগতি এগুলোও আসবে তো? নাকি ব্রিটিশ রাজাদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে দেশি রাজাদের হাতে? আর আপামর জনগণের অবস্থা একই থাকবে? আসলে ক্ষমতার একটা নিজস্ব দোষ আছে। অধিকাংশ মানুষের মাথা ঘুরে যায়। পদস্খলন হয়, পাপ বাড়তে থাকে। এই বোধ ভেতরে যত জেগেছে, ততই অরবিন্দ সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কর্তব্য অন্বেষণে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমজ্জিত হয়েছেন।
১৯১০ সালে পন্ডিচেরীতে এসে তিনি সনাতন ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
এভাবে বিপ্লবী অরবিন্দ ‘ঋষি অরবিন্দে’ পরিণত হন। পন্ডিচেরিতে ‘যোগসাধনা’ নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত যোগসাধনা ও হিন্দুধর্ম-বিষয়ক রচনা প্রকাশ করেন। বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, গীতা, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৯১৪ সালে ফরাসী দম্পতি ‘মীরা রিচার্ড’ ও ‘পল রিচার্ড’ পণ্ডিচেরিতে এসে ঋষি অরবিন্দকে দেখে মুগ্ধ হন। ১৯২০ সালে মীরা রীচার্ড পণ্ডিচেরিতে বরাবরের মতো চলে আসেন। তিনিই পরবর্তীতে ‘Mother’ নামে খ্যাত হন এবং ১৯২২ থেকে আশ্রমের ভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালের ২৪শে নভেম্বর শ্রী অরবিন্দের ‘সিদ্ধি’ লাভ হয়। ১৯২৭ থেকে তিনি মাত্র ৪টি দর্শনের দিনে জনসম্মুখে আবির্ভূত হতেন এবং বাকি সময় নির্জনে সাধনা-মগ্ন থাকতেন।
পন্ডিচেরীতে থাকাকালীন অবশ্য অরবিন্দ রাজনৈতিক নিবন্ধও লিখেছিলেন। সুগত বসুর মতে, ‘The Sprit and Form of an Indian Polity’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যায়ন করেছিলেন। এবং বলেছিলেন, মুঘল সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজশক্তিদের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ও সহিষ্ণু ছিল। মুঘলদের সম্পর্কে অরবিন্দের ধারণা একেবারেই মেলে না আজকের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে।
শেষজীবন পন্ডিচেরির আশ্রমে অবস্থানকালে তিনি ধর্ম, দর্শন ও ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ইংরাজী ও বাংলা, উভয় ভাষাতেই বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮। যেমন: ‘The Life Divine’ (১৯৩৯), ‘Savitri’ (১৯৫০), ‘Mother India’, ‘The Age of Kalidasa’, ‘The Significance of Indian Art’, ‘Essays on the Gita’, ‘The Foundations of Indian Culture’, ‘Lights on Yoga’, ‘A System of National Education’, ‘The Renaissance in India’ ইত্যাদি। আর, ‘ভারতের নবজন্ম’ (১৯১৫), ‘পন্ডিচেরীর পত্র’ (১৯২১), ‘কারা কাহিনী’ (১৯২১), ‘ধর্ম ও জাতীয়তা’ (১৯৩১), ‘যোগ-সাধনার ভিত্তি’ (১৯৪২), ‘ভারতে রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা’ ইত্যাদি হল বাংলায় প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি।
তাঁর পন্ডিচেরীর জীবন ছিল যোগ সাধনার জীবন। সেখানে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে দীর্ঘ চল্লিশ বছর সাধনা করে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন ও অমৃতময় জীবনের সন্ধান পান। তাঁর সাধনায় আকৃষ্ট হয়ে দেশী বিদেশী বহু ব্যক্তি তাঁকে দর্শন করতে ও তাঁর আশ্রম পরিদর্শন করতে যেতেন। অনেকে স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করেন। অরবিন্দ ঘোষ পন্ডিচেরী আশ্রমে সাধনায় বসার পর বাইরের কোন লোক তাঁর দর্শন পেতেন না। শেষ দিকে বছরে তিন দিন মাত্র তিনি জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। ১৯৫০ সালের ২৪শে নভেম্বর তিনি তাঁর ভক্তদেরকে জীবনের শেষ দর্শন দিয়ে যান। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ সাল। সে দিন ছিল সরস্বতী পুজো। চৈতন্যধাম নবদ্বীপ থেকে কয়েকশো মাইল সুদূর দক্ষিণ ভারতের পুদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে এক ঐতিহাসিক যাত্রার সূচনা হচ্ছিল। যার পরিসমাপ্তিস্থল হিসাবে আগে থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিল নবদ্বীপ। ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিতে নবদ্বীপের একদম শেষপ্রান্তে গঙ্গার তীরে নিদয়া ঘাট সংলগ্ন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠছে অরবিন্দের ভাবাদর্শে পরিচালিত ‘বঙ্গবাণী’ নামে এক অভিনব আশ্রম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে তেরোটি বিষয়ে পৃথক পাঠ্যক্রম সম্বলিত এক বিরাট আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নবদ্বীপের সেই বঙ্গবাণী আশ্রমই প্রথম স্থান যেখানে পুদুচেরির বাইরে শ্রীঅরবিন্দের দেহাবশেষ স্থাপিত হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। সেই সময়ে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ১২ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুদুচেরি আশ্রমে শ্রীমা স্বয়ং বঙ্গবাণীর ১২ জন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দের দেহাবশেষ। অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী, সে কালের হাসির গানের রাজা এবং শ্রীঅরবিন্দের অনুগামী ‘নলিনীকান্ত সরকার’ তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর রচনা থেকে থেকে জানা যায়, কী ভাবে ওই চিতাভস্ম নিয়ে পরবর্তী ন’দিন ধরে কলকাতা-সহ নবদ্বীপ জুড়ে বিপুল উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল। সে কালের মাদ্রাজ মেলের বিশেষ ভাবে সুসজ্জিত একটি কামরা এ জন্য রিজার্ভ করে সেটি কলকাতা হয়ে নবদ্বীপে আনা হয়েছিল। পথে ‘মাদ্রাজ’, ‘মেলোর’, ‘ওঙ্গোল’, ‘বেজওয়ারা’, ‘ওয়ালটেয়ার’, ‘খুরদারোড’, ‘ভুবনেশ্বর’, ‘কটক’, ‘বালেশ্বর’, ‘ভদ্রক’, ‘খড়গপুর’, ‘বাগনান’, ‘সাঁতরাগাছি’ এবং ‘রামরাজাতলা’ প্রভৃতি স্টেশনে মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন হাওড়ায় এসে পৌঁছায় ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টের পর। দেহাবশেষ গ্রহণ করার জন্য স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মেয়র ‘ত্রিগুণা সেন’-সহ অনেকে। সেই দেহাবশেষ বিশেষ রথে রেখে এক বিরাট শোভাযাত্রা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে কলকাতার বুকে প্রায় পনেরো মাইল পথ অতিক্রম করে লেক ময়দানে পৌঁছয়। কলকাতার হাজার হাজার মানুষ সেই শোভাযাত্রায় যোগ দেন। এক দিন সেখানে থাকার পর ১৬ই ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে নবদ্বীপের পথে যাত্রা করে বিশেষ ট্রেন। নবদ্বীপে যখন দেহাবশেষ এসে পৌঁছয় তখন সন্ধ্যায় নেমে এসেছে। পরে ২১শে ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপের নিদয়া ঘাটে নির্মিত সমাধি মন্দিরে স্থাপিত হয় সেই দেহাবশেষ। এখনও নবদ্বীপে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত সেই দেহাবশেষ। ১৯৫৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শ্রীমায়ের জন্মতিথিতে শ্রীঅরবিন্দের পবিত্র দেহাবশেষ নবদ্বীপের স্মৃতিমন্দিরে স্থাপন করেন ‘শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন’। তখন তিনি বঙ্গাবাণীর সভাপতি। সেই থেকে ষাট বছর ধরে নবদ্বীপের অরবিন্দ আশ্রমে সংরক্ষিত দেহাবশেষ ঘিরে প্রতি বছর উৎসব হয়।
অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি, এমনটা বললে অত্যুক্তি হয় না। সুগত বোস থেকে ডেভি, অনেকেরই মত হল, অরবিন্দের দর্শনকে সম্যকভাবে অধ্যয়ন না করার ফলেই তাঁর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রজ্ঞা সেভাবে বন্দিত হয়নি আধুনিক ভারতে। পন্ডিচেরী চলে যাওয়ার পর তাঁকে অনেকাংশে আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবেই দেখা হয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে সাধকজীবনে রচিত রাজনৈতিক দর্শনমূলক লেখালেখি। অরবিন্দের প্রগাঢ় রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে গবেষকদের এই নিষ্পৃহতায় দক্ষিণপন্থীদের সুবিধে হয়েছে তাঁকে ‘আমাদের লোক’ বলে চিহ্নিত করতে, স্পষ্ট লিখেছেন ‘সুগত বসু’। তাঁর দ্ব্যর্থহীন মত, “যে লেখাগুলিতে অরবিন্দ বা বিবেকানন্দ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, সেগুলো না পড়ে যদি স্রেফ ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব হিসাবেই তাঁদের দেখা হয়, ধর্ম তো তাঁদের গ্রাস করতে চাইবেই।”
(তথ্যসূত্র:
১- মহাবিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, সমর বসু, বিপ্লবীদের কথা (২০১৪)।
২- অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
৩- ত্রয়ী, অরবিন্দ ঘোষ, সন্ধ্যা প্রকাশন।
৪- The lives of Sri Aurobindo by Peter Heehs, Sri Aurobindo Ashram Publication Department, Pondicherry.
৫- Twelve years with Sri Aurobindo by Nirodbaran, Sri Aurobindo Ashram Publication Department, Pondicherry.
৬- Beyond Man – The Life and Work of Sri Aurobindo and the Mother by Georges Van Vrekhem.
৭- Sri Aurobindo a Biography and a History by K.R.Srinivasa Iyengar.
৮- Sri Aurobindo: Saga of a Great Indian Sage by Wilfried Huchzermeyer.
৯- শ্রী অরবিন্দ ও বাঙ্গলায় স্বদেশী যুগ, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, অরুণা প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত