দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে ১৪ বছর। কিন্তু এখনও মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে অনশনে বসলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ ৪ ডিসেম্বর। ১৪ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৬ সালে ঠিক এই দিনেই কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে অনশনে বসেছিলেন মমতা। যা কার্যত নাড়িয়ে দিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সিপিএম সরকারকে। অভিঘাত পৌঁছেছিল দিল্লী অবধি। তারপর একে একে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, ২০১১ ভোটে বাম বিদায়, মমতার মহাকরণে প্রবেশ— সব মিলিয়ে সোনার অক্ষরে লেখা এক সংগ্রামী ইতিহাস। ফিরে দেখা যাক আজ থেকে ১৪ বছর আগের সেই সময়কে।
২০০৬ সালের ১৮ মে শিল্পপতি রতন টাটাকে পাশে নিয়ে সদ্য শপথ নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন, হুগলির সিঙ্গুরে টাটা ১ লাখি ন্যানো গাড়ি তৈরি করবে। ৭০০ একরে গাড়ি কারখানা ও ৩০০ একরে অনুসারী শিল্প গড়া হবে। শুরুর দিন থেকেই চুক্তির অস্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছিলেন স্থানীয়রা। জমি দিতে রাজি ছিলেন না অনেকেই। ঘেরাও, বিক্ষোভের মধ্যেই দানা বাঁধছিল এক জোরদার আন্দোলন। সেসবে আমল না দিয়েই ২৫ সেপ্টেম্বরে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
এদিকে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে সেদিনই সন্ধ্যায় সিঙ্গুরে বিডিও অফিসে পৌঁছন মমতা। শুরু করেন বিক্ষোভ। গভীর রাতে বিক্ষোভকারী কৃষকদের ওপর লাঠিচার্জ করে মমতাকে অবস্থান থেকে তুলে দেয় পুলিশ। আহত হন শতাধিক। প্রতিবাদে ৯ অক্টোবর ধর্মঘট ডাকেন তৃণমূলনেত্রী। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরের বিডিও অফিসে পুলিশি অত্যাচারে গুরুতর আহত রাজকুমার ভুলের মৃত্যু হয়। রাজকুমার ভুলকে সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটি সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রথম শহীদের মর্যাদা দেয়। মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল রাজ্যজুড়ে সকাল ১১ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত পথ ও রেল অবরোধ করে।
কিছুতেই কিছু না হওয়ায় আরও কঠোর সংগ্রামের পথে হাঁটেন তৃণমূল নেত্রী। ৫ নভেম্বর টাটাকে কারখানা সরাতে ১২ দিন সময় বেঁধে দেন তিনি। দাবি জানান, কৃষকের অসম্মতিতে জোর করে জমে কেড়ে নেওয়া চলবে না। এরপর ৭ নভেম্বর সিঙ্গুরে দলে দলে পুলিশ মোতায়েন শুরু হয়। কার্যত র্যাফ ও সশস্ত্র পুলিশের দখলে চলে যায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। তা দেখে ২৬ নভেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, জোর করে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ওই জমিতে আলু বুনবেন তিনি। শুধু মমতাকে আটকাতে আলাদা করে ৩ হাজার পুলিশকর্মী মোতায়েন ছিল সেদিন।
৩০ নভেম্বর সিঙ্গুর যাওয়ার পথে মাইতিপাড়ার মোড়ে পুলিশ আটকে দেয় সিঙ্গুর ঢুকতে বদ্ধপরিকর মমতাকে। জারি হয় ১৪৪ ধারা। পুলিশের হাতে সেদিন নিগৃহীত হতে হয়েছিল তৃণমূলনেত্রীকে। এর প্রতিবাদে ১ ডিসেম্বর ১২ ঘণ্টার হরতাল ডাকে তৃণমূল। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর আমরণ অনশনে বসেন বাংলার অগ্নিকন্যা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মমতার ওই ২৫ দিনের অনশনই ছিল বাংলার রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সন্ধিক্ষণ। কারণ মমতার ওই অনশনের জেরেই শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর ছাড়ার কথা ঘোষণা করেন রতন টাটা। এবং তারপরেই বাংলার মসনদের যোগ্য দাবীদার হিসাবে উঠে আসে মমতার নাম।