ফুটবলপ্রেমী বাঙালির একটা প্রজন্মের কাছে ফুটবল মানেই ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। একটা সময়ে তুমুল বিতর্ক চলত সেরা কে? – পেলে নাকি মারাদোনা। তুমুল বিতর্ক চলত, মারাদোনা কি সত্যি ডোপ করেছিলেন, নাকি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন? বর্তমান ফুটবলপ্রেমী প্রজন্মের কাছে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো আছেন – আছেন আরও আন্তর্জাতিক স্তরের তারকা ফুটবলার, কিন্তু তাঁদের তুলনায় পেলে-মারাদোনা কয়েক হাজার মাইল এগিয়ে থাকবেন। মেসি-নেইমার-রোনাল্ডো সমেত বাকিদের তুলনা উঠলে, সবার আগে উঠে আসবে পেলে-মারাদোনার নাম। বাঙালিদের মধ্যে যদি বিশ্ব ফুটবল সমর্থকদের কথা ধরা হয়, তাহলে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দুটো দেশের সমর্থক সবচেয়ে বেশি – ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। আর ভিনদেশে আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থকদের জন্মের প্রধান কারণ ছিলেন মারাদোনা। কারও কাছে তিনি ছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র। কেউ তাঁকে ঈশ্বররূপে দেখার চেষ্টা করতেন। বুয়েনস আইরেসের তস্য গলি থেকে সাফল্যের রাজপথে বিচরণ করেছিলেন শুধু বাঁ পায়ের জাদুতে। সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছিলেন বিদ্যুৎ গতিতে। রাতারাতি হয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের ‘আইকন’। খ্যাতি আর বিতর্ক তাঁর জীবনে হাত ধরাধরি করে চলত। সীমাহীন ভালোবাসায় পূর্ণ ও বাঁধনহারা জীবন ছিল তাঁর। তিনি আর কেউ নন। ডিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
৩০শে অক্টোবর ১৯৬০ সালে বুয়েনেস আইরেসের এক বসতিতে জন্ম হয় তাঁর। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। অভাবের সংসারে থেকেও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা নজরে আসে স্থানীয় বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের। ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই সুযোগ পান সিনিয়র দলে। সেটাও রেকর্ড। সিনিয়র ফুটবলে প্রথম মরশুমেই আর্জেন্টিনার (Argentina) বহু সমর্থকের চোখের মণি হয়ে যায় সেই কিশোর। ডাক নাম হয়ে যায় ‘ফিওরিতো’ যার অর্থ, ফুলের মতো সুন্দর। কৈশোরেই তাঁর ফুটবল প্রতিভা সবার নজরে আসে। পরবর্তী সময়ে তাঁর ফুটবল প্রতিভার স্বাদ পায় গোটা বিশ্ব। তারই মধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে বারবার জায়গা করে নিয়েছিলেন খবরের শিরোনামে। কোনও কিছুতেই দমেননি মারাদোনা। ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন। ডিফেন্সের প্রাচীর ভেদ করে বল পাঠিয়েছেন বিপক্ষের গোলে। যা দেখে আট থেকে আশি উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠেছে, ‘ডিয়েগো…ডিয়েগো..।’ বেপরোয়া, প্রতিভাবান, আগ্রাসী এবং একজন অনুগত বন্ধু, নির্দয় শত্রু। মারাদোনা সর্বদাই ছিলেন ফুটবলভক্তদের জন্য তীব্র আকর্ষণীয় চরিত্র। তাঁর জনপ্রিয়তার একটা উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে আর্জেন্তিনার প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিকের লেখায়, ‘‘১৮ বছর বয়সে মারাদোনা আফ্রিকায় নেমে ঠিকমতো হাঁটতে পারেননি। তাঁকে একবার দেখার জন্য জনপ্লাবন আছড়ে পড়েছিল রানওয়েতে। বিমান আটকে গিয়েছিল। এই বিপুল জনপ্রিয়তাই বারবার বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল ডিয়েগোকে। খেলার পর মাদকে ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। কপিবুক মানতেন না মাঠে, জীবনেও। সেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার লড়াই চলেছে। কখনও ফিরে আসতে পারবেন ভাবিনি। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিল ডিয়েগো। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া যা সম্ভব ছিল না।’’
কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে ১৬ বছর বয়সে জাতীয় দলে সুযোগ পান ১৯৭৭ সালে। ৭৮-এর বিশ্বকাপে জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। যা কষ্ট দিয়েছিল যৌবনে পা রাখা দিয়েগোকে। পরের বছরই আর্জেন্টিনাকে তিনি জেতান যুব বিশ্বকাপ। এর বছর তিনেকের মধ্যেই তাঁকে সই করিয়ে নেয় বার্সেলোনা (Barcelona)। ১৯৮২ সালে মারাদোনার জন্য ১১ লক্ষ পাউন্ড খরচ করে কাতালান ক্লাবটি। তবে বার্সার জার্সিতে তেমন সাফল্য আসেনি। দুই মরশুম পরে মারাদোনাকে কিনে নেয় নাপোলি। ইটালির ফুটবলে তখন মধ্যমানের ক্লাব ছিল সেটি। কিন্তু মারাদোনা যোগ দেওয়ার পর ভাগ্য বদলে যায় নাপোলির। প্রায় একার দক্ষতায় এসি মিলান, ইন্টার, জুভেন্তাসের মতো বড় বড় ক্লাবকে পিছনে ফেলে নাপোলিকে চ্যাম্পিয়ন করে দেন দিয়েগো।
মারাদোনার জীবন বদলে দেয় ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ। বা পায়ের জাদুতে গোটা বিশ্বের মনজয় করেন দিয়েগো। খেলার মাঠে তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ মুগ্ধ করত বিপক্ষের ফুটবলারদেরও। নিমেষে ড্রিবল, ডস, জোরাল শট। দিয়েগোর পা থেকে কি না দেখেছে ফুটবলবিশ্ব।মারাদোনার বিতর্কিত জীবনের জনপ্রিয় অধ্যায় অবশ্যই ‘হ্যান্ড অব গড’। ৮৬’র বিশ্বকাপে প্রায় একক দক্ষতায় আর্জেন্তিনাকে খেতাব দিয়েছিলেন তিনি। তবে কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিভার উল্টো দিকটাও প্রকাশ পেয়েছিল। এরিয়াল বলে বক্সের মধ্যে হাত দিয়ে গোল করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। যে কারণে ইংল্যান্ডবাসী আজও হয়তো ক্ষমা করতে পারেনি ফুটবলের রাজপুত্রকে। কিন্তু একই ম্যাচে তিনি ৬০ মিটার দূর থেকে দৌড় শুরু করে পাঁচ ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে শতাব্দীর সেরা গোল উপহার দিয়েছিলেন ফুটবল জনতাকে। সেবারেই ফাইনালে ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় আর্জেন্টিনার। সোনার বুট পান মারাদোনা। নাম লিখিয়ে ফেলেন চিরন্তন কিংবদন্তীদের খাতায়। ২০০০ সালে পেলের সঙ্গে যৌথভাবে তাঁকে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করে ফিফা (FIFA)।
কেরিয়ারের সেরা সময়টা তিনি কাটিয়েছিলেন নাপোলিতে। ৮৭’তে নাপোলিকে প্রথমবার সিরি ‘এ’ শিরোপা উপহার দেন ডিয়েগো। তিন বছর পর আবারও মারাদোনার পায়ের স্পর্শে সেরার শিরোপা পায় ইতালির ক্লাবটি। তখন থেকেই নাপোলির সমর্থকদের চোখে আর্জেন্তাইন তারকা হয়ে ওঠেন ‘ঈশ্বর’। ততদিনে অবশ্য তাঁর অধঃপতনও শুরু হয়ে গিয়েছে সমান তালে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে দুর্বল দল নিয়েও ফাইনালে ওঠে মারাদোনার আর্জেন্তিনা। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ছোঁয়ার স্বপ্নভঙ্গে শিশুর মতো অঝোরে কেঁদেছিলেন ও কাঁদিয়েছিলেন ফুটবল জনতাকে।
কিন্তু বিতর্ক যেন কোনদিন পিছু ছাড়েনি ফুটবলের রাজপুত্রের। তাঁর মোহময়ী প্রতিভা মুগ্ধ করেছে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীকে। তাই দিয়েগো মারাদোনা আজও সুপারস্টার। কিন্তু শুধুই কি সাফল্য। চাঁদের যেমন কলঙ্ক আছে, মারাদোনারও ছিল। আসলে সব প্রদীপের নিচেই তো একটুখানি অন্ধকার থাকে।সাফল্যের শীর্ষে থেকে পতনের পথে বেশি সময় নেননি দিয়েগো। উশৃঙ্খল ব্যক্তিগত জীবন আর মাদকে আসক্তি বারবার তাঁর জীবনে ডেকে এনেছে বিতর্ক। কখনও একাধিক নারী সঙ্গ, কখনও নিষিদ্ধ মাদক সেবন। কখনও ইটালি, মেক্সিকোর ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ, বারবার জড়াতে হয়েছে আইনি বিপাকেও। ১৯৯১ সালে মাদক সেবনের জন্য ইটালির ফুটবল থেকে ১৫ মাসের জন্য নির্বাসিত হতে হয় তাঁকে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় মারাদোনার নাপোলি অধ্যায়। সেখান থেকে ফিরে যান আর্জেন্টিনায়। বিমানবন্দরে ধরা পড়েন কোকেন-সহ। ১৯৯৪ সালে সাংবাদিককে গুলি করার অপরাধে সাসপেন্ডেড জেল হয় তাঁর। না হাজতে রাত কাটাতে হয়নি। জরিমানা দিয়ে ছাড় পেয়েছেন। ১৯৯৪ দেশে বিশ্বকাপের মাঝপথে নিষিদ্ধ ড্রাগ সেবনের জন্য দেশে ফিরতে হয়। ২০০০ সালের পর অতিরিক্ত মাদক সেবনের জেরে বেড়ে যায় ওজন। ২০০৪ সালে একবার হার্ট অ্যাটাকও হয়। নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ কি হয় তা আদৌ জানতেন না বা মানতেন দিয়েগো মারাদোনা৷ ২০১৮ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার নাটকীয় জয়ে মারাদোনা নিজের মধ্যমা প্রদর্শন করেছিলেন৷ সেই প্রথম বিতর্কিত অঙ্গভঙ্গী করেছিলেন তাই নয় তিনি এর সপ্তাহখানেক আগে রাশিয়ার টিভি সঞ্চালকের সামনে জাতিবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছিলেন৷ ফ্যানদের কাছে ট্যানট্রাম দেখানোও পিছিয়ে যায়নি৷ তিনি এক ফ্যানকে লাথি মেরেছিলেন৷ একজন ফ্যান তাঁকে হাত ধরে টানছিলেন তখন তিনি তাঁকে লাথি মেরে দেন৷ একজন লেডেন্ডের কাছ থেকে এই ধরণের ব্যবহার অভিপ্রেত নয়৷ তিনি আর্জেন্টিনার সর্বকালীন সেরা৷ কিন্তু আর্জেন্টিনার বিশ্ববন্দিত অন্য তারকা মেসিকে নিয়ে করেছিলেন মহা বিতর্কিত মন্তব্য৷ প্যারিসে একটি ইভেন্টে হাজির ছিলেন মারাদোনা ও পেলে৷ সেখানে তাঁদের কথোপকথন মাইক্রোফোনে রেকর্ড হয়ে যায়৷ তিনি সেখানে মেসি সম্পর্কে বলেছিলেন মেসি খুব ভালো মানুষ তিন্তু কোনও ব্যক্তিত্ব নেই৷ তিনি আরও বলেন একজন নেতা হওয়ার জন্য যে গুণ থাকা দরকার সেটা মেসির নেই৷ বহুবার প্রকাশ্যে এসেছে তাঁর অসংলগ্ন ব্যবহার, বহুবার জড়িয়েছেন আইনি বিপাকে। সব কিছু পেরিয়ে ফিরেও এসেছেন। যে জনতার আবেগ ও ভালোবাসা তাঁকে ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে অক্সিজেনের জোগান দিয়েছে, কেরিয়ারের শেষ দিকে ক্রমশ তাঁদের থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে তাঁর।
তবে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ফুটবলের রাজপুত্রের বিদায়টা বড়ই হৃদয়বিদারক। মারাদোনা তখন চোট আঘাতে জেরবার। খেলছিলেন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের নিউওয়েলস ওল্ড বয়েস ক্লাবে। বিশ্বকাপে প্রাথমিক দলে তাঁর জায়গা হয় নি। শেষমেশ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে আর্জেন্টিনা যখন খাদের কিনারে, তখন তাঁর ডাক পড়েছিল। ১৯৯৪ সালের আমেরিকা বিশ্বকাপের খেলতে নেমেছিলেন মারাদোনা। তবে তখন তিনি অতীতের ছায়া মাত্র। গ্রিসের বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। গোল করেছিলেন মারাদোনাও। আস্ফালন করেছিলেন টিভি ক্যামেরার সামনে এসে। সেটাই হয়ে থাকল দেশের জার্সিতে তাঁর শেষ ম্যাচ। নিষিদ্ধ ড্রাগ এফেড্রিন নেওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। লিগ পর্যায় হেরে ফিরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনাও। ফিফা মারাদোনাকে ১৫ মাসের নির্বাসনে পাঠাল। দেশের হয়ে ১০০টা ম্যাচ খেলা হল না মারাদোনার। আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়েছিল ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল নিয়ে। ১৯৯৭ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলতে খেলতে ৩৭ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন মারাদোনা। রেকর্ড বইয়ে তাঁর নামের পাশে লেখা থাকল ৬৭৮ ম্যাচে ৩৪৫টা গোল। পরে ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে মারাদোনা ফিরেছিলেন বটে, কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ‘ভাল খেলোয়াড় মানেই ভাল কোচ নয়’। মারাদোনার ক্ষেত্রে যে এই প্রবাদ বাক্যটা ধ্রুব সত্যি। ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী যুরগেন ক্লিন্সম্যানের জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে পরাস্ত হয়েছিল কোচ মারাদোনার আর্জেন্টিনা। তারপরই পদত্যাগ। একাধিক ক্লাবে কোচিং করিয়েও সাফল্য আসেনি।
কিন্তু, সব ব্যর্থতা, সব বিতর্ক ছাপিয়ে মারাদোনা মারাদোনাই। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি অনুরাগীর চোখে তিনি ঈশ্বর। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা শুধু কিংবদন্তি ফুটবলার নন, তিনি লড়াইয়ের প্রতীক। লড়াইয়ের প্রতীক হয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন এক কিংবদন্তীরূপে আপামর ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। আদিওস দিয়েগো …
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত