‘রশিদ কিদওয়াইয়ের’ লিখিত ‘ব্যালট – টেন এপিসোডস দ্যাট হ্যাভ শেপড্ ইন্ডিয়াজ ডেমোক্র্যাসি’ গ্রন্থ থেকে একটা মজার ঘটনার কথা জানা যায়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস ভাঙনের পরে ইন্দিরার ‘নতুন প্রতীক’ বেছে নেওয়ার ‘নেপথ্য কাহিনী’। ‘নতুন প্রতীক’ বেছে নেবার জন্য একদিন ইন্দিরার সাথে ‘ফোনে আলোচনা’ হচ্ছিল ‘পাঞ্জাবের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা বুটা সিংহের সাথে’। ‘‘হাতি না হাত’’, ফোনে বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘বুটা সিংহ’। ইন্দিরা গাঁধী ফোনে তাঁর ‘পঞ্জাবি উচ্চারণ’ বুঝতে না পেরে দু’টোই ‘হাতি’ শুনেছিলেন আর বাতিল করেছিলেন! তার পর কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে বুঝে ইন্দিরা ফোনটা এগিয়ে দিয়েছিলেন ‘পি ভি নরসিংহ রাও’কে। ‘পিভি’-র সঙ্গেই তখন তিনি ‘বিজয়ওয়াড়া’য় ছিলেন। ‘পিভি’ ফোনটা নিয়েই বুঝে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা আর চেঁচিয়ে ‘বুটা’কে বলেছিলেন, ‘‘পাঞ্জা বলুন পাঞ্জা!’’ তারপরে ইন্দিরা নিশ্চিন্ত হয়ে ‘পাঞ্জা’য় মত দিয়েছিলেন, আর তাঁর তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল ‘কংগ্রেস (আই)’-এর নতুন ‘নির্বাচনী প্রতীক’ ঠিক হয়েছিল। ‘রশিদ কিদওয়াই’ তাঁর গ্রন্থে জানিয়েছেন যে ‘গাই-বাছুরের প্রতীক’ ছেড়ে বেরোতে পেরে খুশিই ছিলেন ইন্দিরা। তাঁর দাবি, ‘ইন্দিরার প্রথম পছন্দ’ ছিল ‘আদি কংগ্রেসের প্রতীক জোড়া বলদ’। কিন্তু ‘নির্বাচন কমিশন’ সেটা তত দিনে হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ‘নির্বাচন কমিশন’ ইন্দিরাকে বেছে নিতে বলেছিল, ‘হাতি’, ‘সাইকেল’ অথবা ‘পাঞ্জা’ – এই তিন প্রতীকের মধ্যে যেকোন একটা। ইন্দিরা ভেবে দেখেছিলেন, ‘হাতি’ ভারতের সব অংশে ‘সমান শুভ’ বলে দেখা হয় না; আর ‘সাইকেল’টা বড্ড ‘সাদামাঠা’ মনে হয়েছিল তাঁর। অতএব ‘পাঞ্জা’ই ঠিক হয়েছিল!
১৯৬৭ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। ‘শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে’ এসেছিলেন ইন্দিরা। ‘বিশ্বভারতীর’ তিনি তখন ‘আচার্য’, ‘ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে ‘রাজনৈতিক জটিলতার অলিন্দে’ তাঁকে বিচরণ করতে হত। ১৯৬৭ সালে উত্তাল ছিল সময়, ‘নকশালবাড়ির নির্ঘোষ’ শোনা যাচ্ছিল। সেই সময়ে ‘দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা’ যাঁদের হাতে ছিল তাঁদের কাছে ‘সেই আন্দোলন’ ছিল ‘অশান্তির’, ‘দেশদ্রোহিতার’। সেদিন ‘শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে’ দাঁড়িয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা’ যেন নিজের ‘রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে যুক্তি’ সাজিয়েছিলেন। তবে না সাজালেও ক্ষতি ছিল না। সেটা তো কোন ‘রাজনীতির আসর’ ছিল না, ছিল ‘বিশ্বভারতীর সমাবর্তন মঞ্চ’। তবু ‘রাজনীতির কথা’ এসেই গিয়েছিল। উপস্থিত সকলকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে সেদিনের সেই ‘সমাবর্তন ভাষণ’ ‘কবিগুরুর প্রিয়দর্শিনী’ শুরু করেছিলেন ‘ঝরঝরে বাংলায়’। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে গুরুদেবের ‘শান্তিনিকেতনে’ ‘ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডী ডিঙিয়ে’ ‘ছাত্রী হিসেবে’ যোগ দিয়েছিলেন ইন্দিরা। বেশি দিন পড়েননি ‘কবির প্রতিষ্ঠানে’, ছিলেন মাত্র বছরখানেক। তখনই বেশ ‘বাংলা’ শিখেছিলেন, শিখেছিলেন ‘হিন্দি’ও। তাঁর ‘পিতা জওহরলাল’ মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন তাঁর ‘ইন্দু-বয়’ ‘ভারতীয় ভাষা শিক্ষায়’ মন দিক। কম বয়সেই ভাষা শেখা সহজ। ‘জওহরলালের ইচ্ছা’ ছিল একটু ‘প্রতিকূলতার মধ্যে’ দিনযাপন করুন ‘ইন্দু’। তখন ভোর সাড়ে চারটের সময় শান্তিনিকেতনে ঘুম ভাঙত ‘ইন্দু’র। ‘শ্রী-সদনে’ ফ্যান ঘুরত না মাথার ওপর। তবে একটা সময়ে তাঁর ‘বোলপুরের গরম’ সয়ে গিয়েছিল একটু একটু করে। ইন্দু মায়ের কাছে ‘আনন্দভবনে’ থাকলে ‘ব্রাউন ব্রেড’, ‘মাখন’, ‘টাটকা ফল’ খেতেন সকালে। সেখানে শান্তিনিকেতনে তাঁকে খেতে হত ‘ডাল আর পুরী’। তবে ভোর ছ’টার সময় সেই ‘পুরী আর ডাল’ যে অসহ্য তা পরে ‘জওহরলাল’ও খানিকটা মেনে নিয়েছিলেন। তবে এর আগে একটা চিঠিতে মেয়েকে এই বিষয়ে বেশ বকুনিই দিয়েছিলেন বাবা। শান্তিনিকেতনে এসে ইন্দিরা ‘থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা’ করবেন ভেবেছিলেন। ‘জওহরলাল’ মেয়েকে চিঠিতে বুঝিয়েছিলেন এমন ব্যবস্থা করলে কোনও সহপাঠীই ইন্দিরার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করবে না, আর ‘শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকেরা’ও ‘অপমানিত’ বোধ করবেন। যে কোনও পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া চাই, মিশে যাওয়া চাই সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে। ‘জওহরলাল’ সেই চিঠিতে ইন্দিরাকে লিখেছিলেন, তাঁর মতে ‘পড়াশোনা করার সময় পড়ুয়াদের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কিছুদিন থাকা উচিত’। এতে ‘শ্রম ও বাস্তব’ সম্বন্ধে ধারণা হবে। এমন ব্যবস্থা যখন করা যাচ্ছে না তখন ‘শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনের কঠোরতার মধ্যে’ কিছুদিন দিনযাপন করুক ইন্দিরা। ইন্দিরা বাবার কথার ‘অবাধ্য’ হওয়ার মেয়ে অবশ্য ছিলেন না। তাই ‘সাধারণ শাড়ি’ পরে ‘খালিপায়ে’ শান্তিনিকেতনের সহপাঠীদের সঙ্গে সহজেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের ‘ছোটখাটো সমস্যা’ নিয়ে সুযোগ থাকলেও তিনি কোন অভিযোগ নিয়ে কখনও ‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ’ হননি। তখন শান্তিনিকেতনের ‘বড় মেয়েদের দল’ নতুনদের খুব একটা পাত্তা দিত না। তাতে কী! ইন্দিরা নতুনদের সঙ্গে দল বেঁধে থাকতেন। এমনিতে তিনি ছিলেন ‘লাজুক’, খুব একটা বকবক করার অভ্যেস তাঁর ছিল না। তবে ‘শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ইন্দিরা’ ছিলেন ‘বন্ধুত্বে ভরপুর’। একবার ‘ত্রিবেণী’তে সদলে ঘুরতে গিয়েছিলেন তাঁরা। ‘গঙ্গার তীরে পুরনো মন্দির’ ইন্দিরার খুব ভাল লেগেছিল। জওহরলালকে উচ্ছ্বসিত চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেই যে ‘সহজ সাবলীল ইন্দিরা’, তিনি ছিলেন অতীতের – আর ‘১৯৬৭ সালে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে’ বাংলায় যিনি ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি তো ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী’। তবু ‘শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে’ এলেই যেন কোথাও তাঁর ‘নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার অবকাশ’ তৈরি হত। দেশনায়কের ভেতর থেকে উঁকি মারে বেরিয়ে পড়ত ‘মানুষ ইন্দিরা’। ‘জওহরলাল’ যখন আসতেন ‘শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে’ তখন ‘পুত্র সঞ্জয়’কে নিয়ে আসতে হত ইন্দিরাকে। একবার শান্তিনিকেতনের একটা অনুষ্ঠানে তাঁর একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, ওদিকে তাঁর বাবা ততক্ষণে মঞ্চে চলে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা ‘সঞ্জয়’কে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে পেছনে বসেছিলেন। ‘এক পুরনো সহপাঠিনী’ ইন্দিরাকে দেখে বলেছিলেন এগিয়ে যেতে। ইন্দিরা রাজি হননি। কারণ, বাবা যদি দেখেন ‘ইন্দু’র দেরি হয়েছে সমাবর্তন মঞ্চের কাছাকাছি আসতে তাহলে বকুনি খেতে হবে। কে আর যেচে বকুনি খেতে চায়। ১৯৬৭ সালে সেই সব দিন অতীত হয়ে গিয়েছিল। ‘গুরুদেব’ তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই চলে গিয়েছিলেন। ‘বাপু’ নিহত হয়েছিলেন স্বাধীনতার পর। আর তাঁর পিতা ‘জওহরলালের প্রয়াণ’ হয়েছিল ’৬৪ সালের মে মাসে। শান্তিনিকেতন থেকে ‘সুধীরঞ্জন দাস’ ইন্দিরাকে সে-সময়ে ‘শোকবার্তা’ পাঠিয়েছিলেন। ‘ছাত্রী হিসেবে’ শান্তিনিকেতনে যখন এসেছিলেন ইন্দিরা তার মাসখানেক আগে ‘অনিল চন্দ্র’কে চিঠিতে নিজের মেয়ে সম্বন্ধে কয়েকটা কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন ‘স্নেহশীল পিতা জওহরলাল’। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ‘শান্তিনিকেতনের শিক্ষা’ যেন ‘ইন্দিরাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সহায়তা করে’, নিজের পায়ে যেন দাঁড়াতে পারে সে। ‘পারিবারিক জীবনযাত্রা’ থেকে ‘মানুষের সেবা করা নিয়ে অগোছালো কিছু ভাবনা’ উঁকি দেয় তাঁর মেয়ের মাথায়। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানে’ সেই ইচ্ছা যেন ‘সুদৃঢ় ভিত্তি’ পায় । ’৬৭ সালে তাঁর পিতার সেই ছায়া ছিল না তাঁর মাথার উপরে। তাই ‘আম্রকুঞ্জে সেদিনের সমাবর্তন ভাষণের শুরুতে স্পষ্ট বাংলায়’ বলেছিলেন ইন্দিরা, ‘‘বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। শঙ্কিত হয়েছি বলব। এই আম্রকুঞ্জে আজকের এই পরিবেশে এ জাতীয় অনুভব না হওয়ারই কথা। কিন্তু আমরা যে অত্যন্ত উত্তেজিত।’’ ‘রাজনৈতিক উত্তেজনার মোকাবিলা’ করার জন্য ইন্দিরা ফিরে যেতে চেয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে’ – তাঁর মতে ‘রবীন্দ্রনাথও রাজনৈতিক উত্তেজনাকে সমাধান বলে মনে করতেন না’। ইন্দিরা ‘গণতন্ত্রের আদর্শকে’ সেদিনের ‘সমাবর্তনে’ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন । বলেছিলেন, ‘‘কেবল স্রোতধারাই তো নদী নয়, নদীতীর নদীকে নদী করে তোলে।’’ এই উপমার যুক্তি ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষাভঙ্গি’কে মনে করিয়ে দেয়। ‘১৯৬৯ সালে বিশ্বভারতীতে সমাবর্তন ভাষণে’ তাঁর কথাগুলি আরও বিস্তার পেয়েছিল। ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘‘দুটো প্রসঙ্গ এখন মানুষের সামনে বড় হয়ে উঠেছে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান, অসামঞ্জস্য তীব্র আকার নিচ্ছে। শান্তি বনাম সন্ত্রাসের লড়াই প্রবল হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় উপসর্গটি প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কিত।’’ এই শান্তির সঙ্গে সন্ত্রাসের লড়াইয়ে ছাত্রদের ভূমিকা কী? ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘‘কলকাতার একদল ছাত্র সন্ত্রাসকেই পথ বলে মনে করে – এ খবরে আমি শঙ্কিত।’’ ‘সমকালীন রাজনৈতিক চেহারার প্রেক্ষাপটে’ আবার তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে’। গুরুদেবও দরিদ্রদের উন্নয়ন চেয়েছিলেন। ‘শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে’ যে ইন্দিরাকে দেখা গিয়েছিল সেই ইন্দিরা কিন্তু ‘দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দের ইন্দিরা’ ছিলেন না। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর নানা সিদ্ধান্তে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে আস্ফালন’ পরবর্তীকালে চোখে পড়েছিল ‘শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জের ভাষণে’ সে ‘আস্ফালন’ ছিল না। বরং ‘আদর্শের সঙ্গে বোঝাপড়া’ ছিল। ইন্দিরা যখন ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান’ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ‘তাঁর অসুস্থ মায়ের সঙ্গে বিদেশে’ তখন সেই ছেড়ে যাওয়ার সময় ‘রবীন্দ্রনাথ’ তাঁকে লিখেছিলেন, ‘‘ইট ইজ উইথ অ্যা হেভি হার্ট উই বেড ফেয়ারওয়েল টু ইন্দিরা, ফর সি ইজ সাচ অ্যান অ্যাসেট ইন আওয়ার প্লেস।’’ ‘ইন্দিরা শান্তিনিকেতনের সম্পদ’ একথা যখন কবি লিখেছিলেন তখন তিনি সেই মেয়েটির মধ্যে দেখেছিলেন ‘নানা সম্ভাবনা’। আর শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলোর কথা হয়তো কখনও ভুলতে পারেন নি ইন্দিরা। ‘রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি ও আদর্শ’ শান্তিনিকেতনের সজল মেঘের মতো বারবার ভেসে ভেসে আসত তাঁর মনে। পরবর্তী জীবনে ‘প্রখর রাজনৈতিক বিতর্কে’, ‘ক্ষমতার অলিন্দে’ ইন্দিরা ক্রমশঃ একা হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল ‘শান্তিনিকেতন ছায়াঘন এক পরিসর’। সেখানে ‘কবির স্মৃতির কাছে’ এসে বসতেন দেশনায়ক। কবির সঙ্গে কথা বলে নিজের রাজনীতিকে নতুন করে সাজাতে চাইতেন। কিন্তু সব সময় পারতেন না।
এবারে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত ‘নিমাইসাধন বসু’ প্রণীত ‘আমি: ইন্দিরা গান্ধী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘ইন্দিরা গান্ধীর জীবন ও প্রাসঙ্গিক ঘটনাপঞ্জী’র দিকে চোখ বোলানো যাক।
১৯১৭ নভেম্বর ১৯ – এলাহাবাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল ‘মোতিলাল নেহরুর আনন্দ ভবনে’ রাত্রি ৯টা ১৪ মিনিটে জন্মগ্রহণ করেন ইন্দিরা। পিতা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর বয়স তখন ২৮ বছর, মাতা কমলা নেহরুর ১৮। নেহরু দম্পতির একমাত্র কন্যা ইন্দিরা। পিতামহ ‘মোতিলাল তাঁর জননীর নামে’ পৌত্রীর নামকরণ করেন, ইন্দিরা। জওহরলাল ও কমলা চেয়েছিলেন মেয়ের নাম হবে ‘প্রিয়দর্শিনী’।
১৯৩০ মার্চ – মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি অভিযান। আইন অমান্য আন্দোলনে সাহায্য করার জন্য ইন্দিরা কর্তৃক শিশুদের নিয়ে ‘বানর সেনা’ গঠন।
১৯৩৪ এপ্রিল – প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
১৯৩৪ জুলাই – শান্তিনিকেতনে এসে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন।
১৯৩৭ ডিসেম্বর – লন্ডনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজে’ শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাঁর পাঠ্য বিষয় ছিল ‘ইতিহাস’, ‘অর্থনীতি’ এবং ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’।
১৯৪২ মার্চ ২৬ – ‘ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী’র সাথে বিবাহ।
১৯৪৪ আগস্ট ২০ – বোম্বাইয়ে ‘প্রথম পুত্র রাজীবের জন্ম’।
১৯৪৬ ডিসেম্বর ১৪ – দ্বিতীয় পুত্র ‘সঞ্জয়ের’ জন্ম।
১৯৫০ – প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ‘একান্ত সচিবের’ কাজ গ্রহণ। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ‘অফিসিয়াল হোস্টেস’-এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৬০ সেপ্টেম্বর ৮ – ‘ফিরোজ গান্ধী’র মৃত্যু।
১৯৬২ নভেম্বর ২ – চিনের ভারত আক্রমণের সময়ে বেতারে ভাষণ। চিনা আক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত সৈন্যবাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ‘তেজপুর’ গমন।
১৯৬৪ মে ২৭ – জওহরলাল নেহরুর মৃত্যু।
১৯৬৫ সেপ্টেম্বর – পাকিস্তানের অতর্কিতে ভারত আক্রমণ।
১৯৬৬ জানুয়ারি ২৪ – ‘প্রধানমন্ত্রী’ রূপে শপথগ্রহণ।
১৯৬৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ – ‘উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি কেন্দ্র’ থেকে লোকসভায় নির্বাচিত।
১৯৬৭ মার্চ ১৩ – ‘দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী’ পদে।
১৯৬৯ জুলাই ১৯ – ‘১৪টি প্রধান ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ’।
১৯৬৯ নভেম্বর ১২ – ‘নিজলিঙ্গাপ্পার সভাপতিত্বে’ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে ইন্দিরাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল। ফলে কার্যত কংগ্রেস দু’ভাগ হয়ে গেল।
১৯৭১ মার্চ ২৭ – ২৬ মার্চ ‘বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম’ শুরু হলে নিপীড়িত মানুষের সমর্থনে বক্তৃতা।
১৯৭১ আগস্ট ৯ – ‘সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে’ ভারতের ২০ বছরের জন্য ‘শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদন।
১৯৭১ ডিসেম্বর ৩ – পশ্চিম সীমান্তে পাক বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ ও দেশে ‘আপৎকালীন জরুরি ব্যবস্থা’ ঘোষণা।
১৯৭১ ডিসেম্বর ৪ – ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা।
১৯৭১ ডিসেম্বর ৬ – ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’কে ভারতের স্বীকৃতি দান।
১৯৭২ – ‘সাধারণ বীমা ব্যবসা আইন প্রণয়ন’ দ্বারা ‘৫৫টি বীমা ব্যবসা সংস্থার জাতীয়করণ’।
১৯৭২ মার্চ ১৮ – ‘ঢাকা’য় ভারত ও বাংলাদেশের ‘২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর’।
১৯৭২ মে ২০ – ‘আনন্দবাজার পত্রিকার সুবর্ণজয়ন্তী’ উৎসবের উদ্বোধন করে বলেন, ‘‘আনন্দবাজার পত্রিকা গত পঞ্চাশ বছরের গৌরবময় ইতিহাসে বহু মহান আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছে।’’
১৯৭২ জুলাই ২ – ‘ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তি’ স্বাক্ষর।
১৯৭২ ডিসেম্বর ২৯ – ‘কলকাতা ময়দানে’ ‘পাতাল রেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন’।
১৯৭২ জানুয়ারি ৩০ – ‘৪৪৬টি কয়লা খনি জাতীয়করণ’।
১৯৭৪ মে ১৮ – ‘পোখরানে’ ভূগর্ভে ‘আনবিক বোমা বিস্ফোরণ’ ঘটিয়ে ভারত ‘বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী’ রূপে গণ্য হল।
১৯৭৪ জুন ১২ – ‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের’ ঘোষণা- ‘রায়বরেলি কেন্দ্র’ থেকে ১৯৭১-এর লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন ‘অবৈধ’।
১৯৭৪ জুন ২৪ – ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আয়ার’ কর্তৃক ‘প্রধানমন্ত্রী রূপে ইন্দিরা গান্ধীকে সংসদে যোগদানের অধিকার দান’, কিন্তু তাঁর ‘ভোটাধিকার’ রইল না।
১৯৭৪ জুন ২৬ – দেশের ‘অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য আপৎকালীন জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা।
১৯৭৪ জুলাই ১ – ‘অর্থনৈতিক নীতি’ পুনর্বিন্যাসের জন্য ‘বিশ দফা কর্মসূচি’ ঘোষণা।
১৯৭৪ নভেম্বর ৭ – ‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়’ ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ’ কর্তৃক নাকচ।
১৯৭৭ মার্চ ২১ – ‘রায়বরেলি কেন্দ্রে’ ‘জনতা পার্টির প্রার্থী’ ‘রাজনারায়ণের কাছে পরাজিত’।
১৯৭৭ মার্চ ২২ – প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা।
১৯৭৮ জানুয়ারি ২ – ‘দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেসের সভানেত্রী’ রূপে নির্বাচিত।
১৯৮০ জানুয়ারি ৭ – ‘উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি’ ও ‘অন্ধ্রপ্রদেশের মেদক’, উভয় কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ।
১৯৮০ জানুয়রি ৯ – ‘লোকসভায়’ ইন্দিরা কংগ্রেসের ‘দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ’।
১৯৮০ জুন ২৩ – নতুন দিল্লিতে ‘বিমান দুর্ঘটনায় সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু’।
১৯৮৪ জুন ৫ – ‘স্বর্ণমন্দির’ থেকে ‘উগ্রপন্থীদের বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে’ সেনা পাঠানো। অপারেশন ‘ব্লু স্টার’ শুরু।
১৯৮৪ জুন ৭ – ‘সন্ত জার্নাল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে’ ও তাঁর দুই প্রধান সহকারী ‘সাহেব সিংহ’ ও বেআইনি ঘোষিত ‘শিখ ছাত্র ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট অমৃক সিংহের’ গুলিবদ্ধ মৃতদেহ স্বর্ণমন্দির থেকে উদ্ধার করা হয়।
১৯৮৪ অক্টোবর ৩১ – সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে দফতরে যাওয়ার সময় নতুন দিল্লিতে ‘বাসগৃহ সংলগ্ন উদ্যানপথে’ নিরাপত্তারক্ষী ‘বিয়ন্ত সিংহ ও সতবন্ত সিংহের আতর্কিত আক্রমণে’ গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর কর্মময় জীবনের অবসান হয়।
ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের ‘অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায়’টি হল ১৯৭৪ সালে ‘দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য আপৎকালীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। দেশে জরুরি অবস্থা কেন হয়েছিল সেই বিষয়ে শ্রীমতী গান্ধী ‘নিমাইসাধন বসু’কে একটা সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। দেখা যাক তিনি কি বলেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত ‘নিমাইসাধন বসু’ প্রণীত ‘আমি: ইন্দিরা গান্ধী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
‘‘আমরা তো স্বাধীন ছিলুম না। ছিলুম বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন। আমাদের উপরে আরোপ করা হয়েছিল বিস্তর বিধিনিষেধ। ছিল সামন্ততন্ত্র, ছিল বর্ণশ্রেণীর বৈষম্য। সাধারণ মানুষ বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ধার ধারেনা; তাঁরা জানে ধর্মের আচার বিচারের কথাগুলি। জাতির উপরে এটা একটা মতন বোঝার মতন চেপে বসেছিল। তারপর এলো স্বাধীনতা। মহাত্মা গান্ধী সর্বক্ষণ সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, সুবিধে ভোগ করতে হলে দায়িত্বটাও পালন করা চাই; অধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত থাকে কর্তব্য। কিন্তু দায়িত্ব আর কর্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে শুধু লোকে লোকে শুধু সুবিধে আর অধিকারের কথাই ভাবতে শুরু করল। ভাবতে লাগলো যে, স্বাধীনতা যখন পেয়েছি তখন যা খুশি আমরা করতে পারি। কিন্তু তাতো নয়। আমার কোন কোন ভাষণে আমি বলেছি যে, নদী বলতে শুধু মুক্ত জলাধারকেই বোঝায় না, দু’দিকের সেই পাড়দুটিকেও বোঝায়, জলাধারকে যা বেঁধে রেখেছে। পাড় যদি না থাকতো, নদীর অস্তিত্বই থাকত না যে। আজ আমার মনে হয় যে, দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি ব্যাপারের উপরে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হয়নি। দেশে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল, এটা তার একটা কারণ তো বটেই। কিন্তু জরুরী অবস্থার অনেক অপব্যবহার হয়েছে, এবং সিদ্ধান্তটা যে খুব ভাল হয়েছিল এমনও আমি বলতে পারিনা কিন্তু তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা প্রথম পথভ্রষ্ট হয়েছি এবং দেশে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার পরেই আমার বিপক্ষে বেরোল আদালতের রায় এবং কাগজে কাগজে এই নিয়ে একটা হৈচৈ লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগও পেয়ে গেলেন বিরোধীরা। তখন আমার মনে হল যে, কংগ্রেস সরকার যদি চলে যায় তাহলে একটা ঘোর বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে এবং গণতন্ত্র বলতে কিছু থাকবে না। মনে হলো, দেশকে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার। কি করে দেবো, আমার কিছু সহকর্মীর তা নিয়ে আলোচনাও করেছিলুম তখন। দেশকে ঠিক পথে ফিরিয়ে এনে কর্তব্যের বিষয়ে তাকে সচেতন করতে চেয়েছিলুম। ঠিক জরুরি অবস্থার কথা আমি ভাবিনি। কিন্তু আমারই দুই দায়িত্বশীল মন্ত্রী বললেন যে, সংবিধান অনুযায়ী এটা করা যেতে পারে। এঁরা দু’জনেই আইনজ্ঞ মানুষ। এঁদের একজন পরে এই ব্যাপারে সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু তখন বলেছিলেন অন্য কথা। বলেছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী তো কাজ করতে হবে, তা সেই অনুযায়ী এটা করা যায়। তো এভাবেই আমরা জারি করেছিলুম জরুরি অবস্থা। সংবিধান লঙ্ঘনের কথা আমরা কোন সময়ই ভাবিনি। দীর্ঘকাল ধরে জরুরি অবস্থা চালু রাখার ইচ্ছাও ছিল না আমাদের। প্রথমটায় ভেবেছিলুম মাসখানেক এটা চালু থাকবে। রাজনৈতিক কিছু নেতাকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল, তা আপনারা জানেন। অন্য যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, জরুরি অবস্থা বলে কোন কথা নেই, যে কোনো অবস্থাতেই তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত ছিল। তাঁরা চোরাচালানকারী এবং এইরকমেরই সব দুর্বৃত্ত। কিন্তু জরুরি অবস্থার সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তো, তাই তাঁরাও রাজনৈতিক ভেক ধরল। আমারই এক আত্মীয়া (আন্ট) তাঁর বইয়ে এক যুবকের প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, বিনা কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁকে গ্রেফতার করেছিল শুল্ক বিভাগের কর্মীরা। বইখানি পড়বার আগেই অবশ্য তাঁর নামও আমি জানতুম না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতি মূল্যবান একটি প্রাচীন কোরান চুরি করে সেটি বাইরে পাচার করবার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সেই এবং তাঁরই মতো আরো অনেক তখন রাজনৈতিক হিরো বনে গেল। দেশের বাইরে কিছু ভারতীয় তখন জার্মানিতে থেকে যেতে চাইছিল। থাকবার অনুমতি না মেলায় তাঁরাও বলতে লাগল যে, তাঁরা রাজনৈতিক শরণার্থী। জার্মানি আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক শরণার্থীকে জার্মান নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। উপরন্তু প্রতি মাসে দেওয়া হয় কিছু টাকা। বেশ কিছু লোক জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল, এবং এমনভাবে এর অপ-ব্যবহার করেছিল যাতে নিজেদের দোষ ঢেকে রাখা যায়। এছাড়া আর কোনো অসুবিধে হয়নি। না নামাতে হয়েছে সৈন্যবাহিনী, নামাতে হয়েছে পুলিশ। গোড়ায় যখন কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয় একমাত্র তখন ছাড়া সত্যিই আর কখনোও পুলিশ নামাবার কোন দরকারই হয়নি। এমন কোন ঘটনাই কখনও ঘটেনি, যাতে এই ধরনের কোন ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার হয়। জরুরি অবস্থার অবসান ঘটবার কথা আমরা ভাবছিলুমও, কিন্তু ঠিক তখনই শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। ফলে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তার কিছুদিন বাদেই হত্যা করা হলো শেখ মুজিবের কারারুদ্ধ সহ কর্মীদের। এইসব ঘটনা ঘটায় আমার মনে হয় যে, কে জানে, রাশ ঢিল করবার সময় হয়ত এখনো আসেনি। আর তাছাড়া, জরুরি অবস্থার সময়ে সাধারণ মানুষজনেরা তো কোন অসুবিধে ভোগ করেননি, তাঁরা সুখেই ছিলেন। একটা দৃষ্টান্ত দিই। এক মহিলা আমাকে একটি চিঠি লেখেন। আমি তাঁকে চিনি না। তাঁর নামও আমার মনে নেই। তিনি আমাকে জানান যে, আমাকে কিংবা আমার নীতিকে তিনি কখনোও সমর্থন করেননি। কিংবা ভোট দেননি কংগ্রেসকে। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার খবর শুনে তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তিনি এই চিঠি লিখছেন। কর্মসূচির জন্য তাঁকে প্রচুর ঘুরতে হয়। ট্রেনে সাধারণত মহিলাদের কামরায় তিনি ভ্রমণ করেন। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পরে রকমের এক সফরের সময় কামরাটিকে নোংরা দেখে তিনি এক ঝাড়ুদারনিকে ডাকেন। অভ্যাসবশত তিনি বকশিশ দেবার জন্য মানিব্যাগ খুলছিলেন, কেননা বকশিস না পেলে তো কেউ কাজই করে না। কিন্তু ঝাড়ুদারনি তাঁকে জানায় যে, এ কাজের জন্য সে মাইনে পায়; সুতরাং বকশিশ সে নেবে না। ভদ্রমহিলা আমাকে লিখেছেন, ‘দশ বছর আমি এইভাবে ট্রেনে ঘুরছি, কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম হলো। আর তাই মনে হলো কথাটা আপনাকে জানানো দরকার।’ কিন্তু জরুরী অবস্থার একটা খারাপ দিকও ছিল বই কী। সত্যিই বেশ কিছু লোক তখন ভেবেছিলেন যে, জরুরি অবস্থার সুযোগে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নেবেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আমাদের কিছু মুখ্যমন্ত্রীও। পরে অবশ্য জরুরি অবস্থার সঙ্গে নিজেদের যোগসম্পর্কের কথা তাঁরা সবৈর্ব অস্বীকার করেন। বস্তুতঃ এমনও বলতে থাকেন যে, তাঁরা ছিলেন এর বিরোধী। কার্যত কিন্তু তাঁরা জরুরী অবস্থার সুযোগে নিজেদের রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার করেছিলেন। একটি রাজ্যে তো স্রেফ বিনা কারণে ৪০০ কংগ্রেসীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কথাটা আমার কানে যেতেই আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘এঁদের বিরুদ্ধে কি স্পষ্ট কোন অভিযোগ আছে? নয়তো এঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে কেন?’ শুনলুম, কোন অভিযোগ নেই। তাহলে দোষটা কী? না এঁরা সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী। এঁদের ছাড়িয়ে আনতে আমাদের বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল। একজন সাংবাদিকের কথা বলি। ইনি আমার সমর্থক ছিলেন না। যে কাগজের ইনি কর্মী, সেই কাগজ আজও আমাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই সময় এই সাংবাদিক এমন কিছু করেননি, যার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী চাইছিলেন তাঁকে গ্রেফতার করতে। দিল্লিতে থাকতে এই সাংবাদিকটিকে আমরা সর্বতোভাবে রক্ষা করেছিলুম। কিন্তু তিনি দিল্লী ছাড়তেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে গ্রেফতার করলেন। জরুরি অবস্থার শেষ দিকটায় অনেক অন্যায় করা হয়েছিল। নিচের দিকের লোকরাও এর অপব্যবহার করতে থাকে। অপব্যবহার করেছিল পুলিশও। ‘যা বলছি কর, নয়তো গ্রেফতার করব’ – এই ছিল তাঁদের কথা। তবে ভিত্তিহীন গল্প-গুজবও কম ছড়ায়নি। তখন আমরা এসব কথা জানতুম না। ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে জানতে পারি। এক সংসদ সদস্যের কাছে একটি ঘটনার কথা শুনেছিলুম। ভদ্রলোক দেরাদুন থেকে ফিরছিলেন। পথে তাঁর গাড়ি বিগড়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছেন কি করবেন, এমন সময় আর একটি গাড়ির আবির্ভাব। গাড়ির চালককে তিনি বললেন, ‘কাছাকাছি এমন কোথাও যদি আমাকে পৌঁছে দেন, যেখানে আমি একটা ট্যাক্সি পেতে পারি তো বড্ড ভালো হয়।’ চালক বললেন, ‘যাবেন কোথায়?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘দিল্লী’। তাতে তিনি বললেন, ‘আরে, আমিও তো দিল্লীই যাচ্ছি। তাহলে আর ট্যাক্সি নেবার দরকার কি। চলুন আমিই আপনাকে দিল্লিতে পৌঁছিয়ে দেব।’ পথে যেতে যেতে এক সময় বললেন, ‘জরুরি অবস্থা হয়ে কি বিপদ হয়েছে জানেন। এইতো সেদিন সঞ্জয় গান্ধী আমাকে ফোন করে বলল, তোমার যা জমি আছে, তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে দিতে হবে, নইলে তোমাকে গ্রেফতার করব।’ সংসদ সদস্যটি সঞ্জয় গান্ধীকে চেনেন। তিনি বললেন, ‘তার জন্য কি আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল?’ উত্তরে এবারেও তিনি বললেন, ‘না।’ সদস্যটি তখন বললেন, ‘সঞ্জয় বললেন না দিলে, আপনাকে গ্রেফতার করা হবে, অথচ আপনি বলছেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার। কেন আপনাকে গ্রেফতার করা হলো না বলুনতো?’ গাড়ি তখন দিল্লির কাছাকাছি এসে পড়েছে। যে সংসদ সদস্যের কথা বলছি তিনি একটু দুষ্টু মানুষ। বললেন, ‘এবারে আমাকে কোনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এর কাছে নামিয়ে দিন।’ চালক তাতে বললেন, ‘আরে না। কোথাও কোথায় যাবেন বলুন, সেইখানেই আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’ গাড়ি যখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে, সংসদ সদস্য তখন বললেন, ‘সম্ভবতঃ সঞ্জয়কে এখন বাড়িতেই পাওয়া যাবে। চলুন না তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি যে, কথাটা সত্যি কিনা।’ তাতে চালক বললেন, ‘কি জানেন, সঞ্জয় গান্ধী আমাকে ফোন করেননি। ফোন করেছেন মি: ধাওয়ান।’ তাতে সংসদ সদস্য বললেন, ‘মি: ধাওয়ানকেও ওখানে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। চলুন, তাঁকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করি।’ চালকটি তখন বললেন, ‘না না ধাওয়ানও নন।’ অর্থাৎ চালক ততক্ষণে অন্য সুর ধরেছেন। মোটকথা আমাদের বাড়িতে তিনি এলেন না। বুঝতেই পারছেন একেবারে বানানো। রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা তখন জরুরি অবস্থার অবসান ঘটাতেই প্রস্তুত। এদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা তখন বেশ এগিয়ে যাচ্ছি। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। জরুরি অবস্থার যদি অবসান ঘটাই, তো অর্থনৈতিক অগ্রগতি বন্ধ হবে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিচারে, জরুরি অবস্থার অবসান ঘটাবার পক্ষে সেটাই ছিল ঠিক সময়। অবসান ঘটালে নির্বাচনে আমাদের জিতবার সম্ভাবনা, আর অবসান না ঘটালে আশঙ্কা রয়েছে পরাজয়ের। এই অবস্খায় কি করবো আমি? দুটি পথের কোনটি বেছে নেব? তা আপনারা জানেন যে, কোন পথটা আমি বেছে নিয়েছিলুম। আমার মনে হয়েছিল, নির্বাচনে হারি কি জিতি, সেটা বড় কথা নয়। দেশকে যদি এমন একটা অবস্থায় পৌছিয়ে দিতে পারি, যেখান থেকে তার পদস্খলনের আশঙ্কা নেই,তো সেটাই বড় কথা। হার জিতে কিছু যায় আসে না। সত্যি বলতে কি, আমার কিছু সহকর্মী পরে আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে, তখন না হেরে যদি কিছুকাল পরে আমরা হারতুম, তো ভারতবর্ষকে ইতিমধ্যে একটা শক্ত জমির উপরে দাঁড় করিয়ে দিতে পারতুম আমরা, এবং তার সুফল হতো অনেক। কিন্তু আমার মনে হয়, সে জায়গায় এদেশ ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে। আর তাই, আরও একবার …’’
১৯৭৬ সালের ১৯শে নভেম্বর, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ‘প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি’ ‘প্রণব মুখোপাধ্যায়’ ‘ইন্দিরা গান্ধীর মূল্যায়ন’ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন –
‘‘শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মানসিক গঠনে কোথায় যেন একটা কঠিন শিলা প্রচ্ছন্ন আছে। স্বীয় সংকল্পে অটল থাকাটাই বড় প্রমান। অথচ মজার কথা এই যে, দেশের রাষ্ট্রের পরিচালনার হালখানি তিনি হাতে তুলে নেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দেশের মানুষ তাঁর চরিত্রের এই দিকটি সম্পর্কে ঘুণাক্ষরে ও টের পায়নি। লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাঁকে মন্ত্রী পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকেই অবস্থান পরিবর্তন শুরু হলো এই সময়ে বিপদে আপদে তিনিই হয়ে পড়লেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য মুশকিল আসান। ১৯৬৫ সালে যখন ভাষা নিয়ে তামিলনাড়ুতে দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠলো তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদের মধ্যে একমাত্র শ্রীমতি গান্ধী ই আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁদের ত্রাস মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হলেন তখন দেশের মানুষের প্রিয় নেতার কন্যার ওপরই কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে দেশের জনগণের ষোলো আনা আস্থার গৌরব অর্জন করে ফেলেছেন তিনি। জনসাধারণের একটা ধারণা হয়েছিল যে, মুক্তি সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষায় পোড়খাওয়া কংগ্রেস নেত্রী বাহিনী, স্বাধীনতার পর প্রশাসনের কলাকৌশলে ক্রমেই প্রজ্ঞা অর্জন করেছেন বলেই উত্তরোত্তর সার্থকতর উত্তরণের উদ্দেশ্যেই তাকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। তিনিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের স্বরূপ প্রকাশ করলেন। তাঁর তরফ থেকে জনগণের ইচ্ছা পূরনের আগ্রহও অচিরেই এল – তার প্রমাণ মেলে ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবের পরিস্থিতির মোকাবিলাতে আর ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তেলেঙ্গানাতে। পাঞ্জাবকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে শ্রীমতি গান্ধী ওই রাজ্যের জনসাধারণের মনস্কামনা চরিতার্থ করতে কার্পণ্য করেননি। কিন্তু শীর্ষতম জাতীয় নেতা হিসেবে তখনও তাঁর কাজ বাকি ছিল। দলের কোন নেতা নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে একটা অলীক ধারণা পোষণ করতেন, আসলে নিজের যা মূল্য তার চেয়ে নিজেকে ঢের বেশি মূল্যবান ভাবতেন। শ্রীএস কে পাতিলের কথাই ধরা যাক, ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগেই তিনি ভাবী প্রধানমন্ত্রী রূপে নিজের দাবি জাহির করে বসলেন। নির্বাচন এল। এই সময়ে কংগ্রেস দলকে যেভাবে ঢেলে সাজানো হল তাকে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো আখ্যা দেওয়া যায় না … এই গালাপালিশ একাধারে কংগ্রেস দলের এবং সারা দেশ জুড়েই হল। ‘প্রভুত্ববাদ’ যে দলের শক্তির মূলেই ঘূণ ধরিয়ে দিয়েছে সেটা সেবারই প্রথম ধরা পড়ল। জাতীয় সুনাম যে একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে গিয়েছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে স্বয়ং কংগ্রেস সভাপতি কামরাজের পরাজয়ে এবং সেটা ঘটল তাঁর নিজেরই নির্বাচনী এলাকায়, শ্রী এস কে পাতিল এবং শ্রী অতুল্য ঘোষও আপন রাজ্যে এর চেয়ে ভাল ফল দেখাতে পারলেন না। পার্লামেন্টের লোয়ার হাউস অর্থাৎ লোকসভায় কংগ্রেস মোট ২৮৩টি মাত্র আসন পেল। ১৯৬২ সালে লোকসভায় কংগ্রেস দল ৩৬১টি আসনে জয়ী হয়েছিল। ১৯৬৭ সালেই কংগ্রেসকে প্রথম জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্ব ছাড়া নির্বাচনে লড়তে হল। সেই প্রথম কংগ্রেস দল যথার্থ জাতীয় নেতার অভাব গভীরভাবে অনুভব করল। এই অবস্থাতেও ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা এবং সাম্প্রদায়িকতার উপর চরম বিদ্বেষ প্রকটিত হল – তিনি ১৯৬৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ডঃ জাকির হোসেনের নাম প্রস্তাব করলেন। কিন্তু জাকির হোসেন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীমতী গান্ধী দলের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু সংসদীয় দলের নেতৃত্ব নিয়ে শ্রীমতী গান্ধীকে শ্রীমোরারজী দেশাই-এর সঙ্গে কঠিন অন্তর্দলীয় সংর্ঘষের সম্মুখিন হতে হলো। প্রধানমন্ত্রীর অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না। হয় তাঁকে সম্মুখ সমরে নামতে হবে অন্যথায় দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়ে থাকতে হবে। ক্ষমতার আসনে থাকলে তাঁর জয় পাওয়ার কোন কারণ নেই এটা স্পষ্টই অনুভব করলেন। কিন্তু কংগ্রেসকে ১৯৬৭ সালের নির্বাচনের ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলতে হলে তাঁকে পাকা স্থপতি হতে হবে। শুধু তাই নয় নতুন মালমশলা জোগাড় করে গড়ে তোলার দায়িত্বও নিজেকে নিতে হবে। এদিকে পরবর্তীকালে ‘সিন্ডিকেট’ আখ্যাত জড়ভরত নেতাদের কুটচক্র প্রগতির পথে উত্তুঙ্গ বাধা হয়ে রয়েছে সামনে। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন শ্রী পাতিল, শ্রী সঞ্জীব রেড্ডি এবং তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনিজলিঙ্গাপ্পা। এই সিন্ডিকেট কাদের প্রতিনিধি? ভারত সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিয়েরেরে বলেছিলেন, এশিয়ার তুলনায় একদিক দিয়ে আফ্রিকা সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ। আফ্রিকা থেকে উপনিবেশবাদ একবার সমূলে উৎপাটিত হওয়ার পর তার আর দ্বিতীয় কোন আশ্রয় মেলেনি, যেটা এশিয়াতে, বিশেষতঃ ভারতে অর্থনৈতিক কায়েমী স্বার্থের সর্বেশ্বরদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। এই কায়েমী স্বার্থের মোকাবিলা মস্ত উপসর্গ। সিন্ডিকেট হচ্ছে এই কায়েমী স্বার্থেরই রাজনৈতিক হাতিয়ার। অতএব সিন্ডিকেটের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর এই সংগ্রাম বস্তুতঃ স্থানীয় শিল্প, বাণিজ্য ও ভূমির কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই। সেই সংগ্রামের কাহিনী সকলের জানা। তাঁর ব্রত পালনের পথে পদক্ষেপের নির্দেশন দেশীয় রাজাদের ভাতার সুবিধা বিলোপের বিলটি রাজ্যসভায় একটুর জন্য অনুমোদন পেল না, এই সংকটের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার ঘোষণা করলেন। পার্লামেন্ট যখন অবসিত হল, তখনও তার মেয়াদ ফুরোতে এক বছরের চেয়ে কিছু বেশি বাকি ছিল। পরের নির্বাচনে স্পিকারের আসন ছাড়া পরিষদের মোট ৫২০টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৩৬১টি আসনে জয়ী হল, ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে শেষ যে নির্বাচন তাতেও এই একই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কংগ্রেস দল জয়ী হয়েছিল। কংগ্রেস (সং) মাত্র ১৬টি আসন কুড়িয়ে বাড়িয়ে পেল। কংগ্রেস (সং) দলের অবস্থা আরও সঙ্গীন দাঁড়াল, ইন্দিরা-বিরোধীদের মতলবে তাঁরা দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের একটা জোট বেঁধে এই জোড়াতালির নাম দিলেন মহাজোট (গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স)। বাংলাদেশ পরিস্থিতির উদ্ভব দ্বিতীয় দফায় ছিন্নমূল জনস্রোতের ভারতে অনুপ্রবেশের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংঘর্ষ ভারতের সামনে বৃহত্তর সঙ্কটের আকার ধারণ করল। যুদ্ধে পাকিস্তানকে দুরন্ত ভাবে পরাজিত করার অনিবার্য ফলস্বরূপ শ্রীমতি গান্ধী এক অভূতপূর্ব গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তারই আশু পরিণতি দেখা গেল ১৯৭২ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে। কংগ্রেস ১৯৭২ সালের নির্বাচনে বৈপ্লবিক সাফল্য দেখাল। এই নির্বাচনগুলিতে কংগ্রেস দল ২৫২৯টি আসনে প্রর্থী দাঁড় করিয়েছিল, তার মধ্যে ১৯২৭টি আসনে বিজয়ী হল। শতকরা ভিত্তিক হিসাবে মোট ভোটের ৭০.৭৭টিই কংগ্রেসের স্বপক্ষে পড়েছিল। মূল দলকে একতাবদ্ধ রাখা আর রাজনৈতিক বিরুদ্ধ দলগুলিকে অকর্মন্য করে রাখার মধ্যেই এক জন দলনেতা বা দলনেত্রীর রাজনীতিজ্ঞতা আর রাজনৈতিক শক্তির পরিচয়ের শেষ কথা নয়। যথার্থ শক্তিসম্পন্ন নেতৃত্ব এক সময়ে দলের গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে জাতির উজ্জ্বল ও স্বার্থকতম লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হয়। এটা যখন ঘটে, বিরোধী দলগুলির অনুরূপ মনোভাবাপন্ন মানুষেরা শাসকদলের মত, উদ্দেশ্য, এমনকী আদর্শের মধ্যেও অনুরূপতা নিজের মতের মধ্যে আবিষ্কার করেন। আর্থনীতিক এবং সামাজিক অবস্থা তাঁদের শাসক দলের সঙ্গে সহযোগিতায় নামতে আগ্রহী করে তোলে, কতকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা এই পথ বেছে নেন। অন্যথায় তাঁদের জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মর্মান্তিক পরিণতি প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু অসন্তুষ্ট দল বা গোষ্ঠীর এতে তিক্ততা বাড়ে, তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। শ্রীমতি গান্ধীর ওপর দেশের মানুষের আস্থা যত বাড়তে লাগলো, জনগণের তরফ থেকে তাঁকে সমর্থনের উৎসাহ দিকে দিকে ততই প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতা ততই বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়লেন। তাঁরা জানেন যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি বা সংসদীয় হাতিয়ার দিয়ে শ্রীমতি গান্ধীকে শক্তির আসন থেকে নামানো সম্ভব হবে না। তাই তাঁরা ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপর একেবারে আস্থা হারিয়ে সংবিধান বিরুদ্ধ ফ্যাসিস্ট কায়দায় কার্যকলাপের আশ্রয় নিলেন। দক্ষিণপন্থী দলগুলির অনুসৃত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য আভ্যন্তরীন জরুরী অবস্থা ঘোষণার চাঞ্চল্যকর সিদ্ধান্ত সময়োচিত হয়েছে। শুধু যে ফ্যাসিস্ট উপদ্রব প্রশমনের দিক থেকেই এ ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ তাই নয় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এর সক্রিয় ভূমিকা বোধ করি আরোও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যাপারটা ষোল আনা নতুনও নয়। ২০ দফা আর্থনীতিক কর্মসূচির বহুমুখী প্রয়োগের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব প্রাণস্পন্দনের জেগেছে। এ বছরের এপ্রিল- জুলাইতে শিল্পসংক্রান্ত উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে, শতকরা ১৪.৩ ভাগ হারে এই বৃদ্ধি এই প্রথম। রপ্তানির হার শতকরা ৩২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমদানির হার শতকরা ১১ ভাগ নেমে গিয়েছে। বহু বছরের মধ্যে এই প্রথম ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ৮২ কোটি টাকা জমার খাতে হাতে আছে। গত এক বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে ভারতের রিজার্ভ তিনগুণ বৃদ্ধি বজায় আছে – এটাও নতুন রেকর্ড। চোরাচালানকারী আর বৈদেশিক মুদ্রার চোরাকারবারীদের দমন করবার জন্য গোপন আর্থনীতিক চক্রান্তের জড়ও নির্মূল হয়েছে। খাদ্যশষ্যের ক্ষেত্রেও এমন বিপুল উৎপাদন ইতিপূর্বে কখনও হয়নি – এ বারের পরিমাণ হল ১১ কোটি ১৮ লক্ষ টন। আমরা এক কোটি ৭০ লক্ষ টন খাদ্যশষ্য মজুত করতে পেরেছি। এই সুফলগুলিই মুদ্রাস্ফীতিকে দমন করতে সহায়তা করেছে, অথচ দুনিয়ার অন্যান্য উন্নতিশীল এবং উন্নত দেশগুলিতে এখনও এই মুদ্রাস্ফীতি আর্থনীতির কাঠামোর পরিপন্থী হয়ে রয়েছে। শ্রীমতি গান্ধী, যিনি ২০ দফা কার্যসূচিকে সর্বতো ভাবে সার্থক করার জন্য একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করছেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার যদি ২০ দফা আর্থনীতিক কর্মসূচি রূপায়ণের দিকে সর্বপ্রকার প্রযন্তে প্রয়োগ করে কাজ না করতেন, তা হলে আমাদের আর্থনীতিক অবস্থা উন্নতির দিকে মোড় নেওয়া মোটেই সম্ভব হত না। বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সংহতিই আজকের ভারতের এই সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছে। আমাদের জনসমাজের একটি অংশ এতকাল প্রায় সুপ্ত বা বিভ্রান্ত ছিল অথচ তাঁদের শক্তি অসামান্য – প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মনেও সাড়া জাগিয়েছেন, তাঁদেরও কর্মমুখর করে তুলেছেন। এঁরা হলেন, ভারতীয় যুবজন। আজ তাঁরা জাতীয় জীবনে নিজেদের সামিল করেছেন, তাঁরা পরিবার পরিকল্পনাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন, সাক্ষরতার প্রসার ঘটাচ্ছেন এবং আগামী দিনের মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন করছেন। তাঁর পিতা অনুজতর মানুষদের বরাবর এবং বারবারই একটা কথা বলতেন, “ভয়ঙ্কর ভাবে বাঁচো।” শ্রীমতি গান্ধী তখন সেই উত্তরসাধক তরুণ মানুষদেরই একজন ছিলেন। এই ভাবে বাঁচার সঙ্গে তিনি পিতার আরও একটি পরম নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন, সেটি – ‘‘যারা ভাবনায় ও কাজে অকুতোভয়, সাফল্য তাদের আয়ত্বগত।” কিন্তু আসলে দেশের সেবায় আত্মোৎসর্গ এবং সমাজবাদই এ দেশের একমাত্র অনুসৃতব্য পথ – এই বিশ্বাসই পিতা ও কন্যাকে এক অভিন্ন সূত্রে গেঁথে রেখেছে। এই পথই দেশকে শ্রী, সমৃদ্ধি ও অমেয় শক্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।”
‘প্রধানমন্ত্রী রূপে’ কি ছিল ‘ইন্দিরার দিনলিপি’। ‘প্রধানমন্ত্রীর একটি দিন’ দেখে নেওয়া যাক ‘নিমাইসাধন বসু’র বই থেকে। কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বা সভা না থাকলে তাঁর এই রুটিনের খুব একটা পরিবর্তন হত না। সমগ্র প্রবন্ধটি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়, ১৯৭৫ সালের ১৯শে নভেম্বর ছাপা হয়েছিল – অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনের দিন।
“১ নং আকবর রোড। প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের সংলগ্ন একটি বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহারের জন্যই রেখে দেওয়া আছে। সেখানে তিনি সর্ব-সাধারণের সঙ্গে দেখা করেন প্রতিদিন সকালে। সবুজ ঘাসে ঢাকা লন। আর আছে বড় বড় গাছ, নাম জানা, না জানা নানা জাতের মৌসুমী ফুল আর ফলের গাছ। রাস্তার ধারে খাঁচায় কিছু পোষমানা পশু আর পাখি। ভোরবেলা দেখা যাবে নাতি রাহুল তাঁর দাদীর হাত ধরে খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, নয়তো বাগানে ছুটোছুটি করছে। সওয়া আটটা বাজল। ইন্দিরাজী চললেন পাশের বাড়িতে দর্শনার্থীদের সামনে। আমিও প্রায়ই যাই। গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে ভাল লাগে। অজস্র মানুষ আসছেন। কারো হাতে ফুলের মালা, কারো হাতে ফুলের স্তবক, নিদেন পক্ষে একটি ফুল। শুধু রাজধানীর মানুষ নয়। দূর-দূরান্তের শহর গ্রাম গঞ্জ থেকে শ্রমিক, কৃষক, যুবক, ছাত্র, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা – কেউই বাদ নেই। ভাষা তাঁদের আলাদা, পোশাক ভিন্ন, কাপড় পরবার কায়দাও আলাদা আলাদা। কেউ বাঙালী ধাঁচে, কেউ সামনে শাড়ির প্রান্ত ঝুলিয়ে গুজরাতী ধরনে, কেউ মালকোছা দিয়ে শাড়ি পড়ে, রাজস্থানী ঘাঘরা, কাশ্মীরী ওড়না, হিমাচলী কাঁচুলি কিছু বাদ নেই। দেখতে ভাল লাগে। মনে হয়, এত রকমারী পোশাক, এত বিভিন্ন ভাষা, এক ধর্মের সঙ্গে এক ধর্মের কত ব্যবধান – তবু ভারতাত্মা এক অভিন্ন। বৈচিত্রের মধ্যে এই একতা সৃষ্টি শুধু ভারতেই সম্ভব। আর সেই ভারতেরই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের সংস্কৃতির প্রতীক, জীবন্ত মাতৃমূর্তি। এত ভাল লাগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখতে যখন অজস্র মানুষ তাঁকে ঘিরে অভিনন্দন জানায়। মা বলে কেউ ডাকছে, কেই বহিনজী, কেউ বলছে দিদি। তিনি যেন তখন হয়ে যান ওদের ঘরের একান্তের একটি মানুষ। সকাল সাতটা থেকে ভিড় জমতে শুরু করে বন্ধ দরজার সামনে। পৌনে আটটা নাগাদ সদর দরজা খুলে দেওয়া মাত্র লাইন করে, কখনও বা দলবদ্ধ হয়ে ঢুকতে শুরু করেন কাতারে কাতারে মানুষ। নিজের অসহিষ্ণু প্রকৃতির দিকে তাকাই আর মনে মনে ভাবি – সারা ভারতের সমস্ত দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, কী করে তিনি প্রায় প্রতিদিন দেখা করছেন হাসি মুখে শতাধিক মানুষের সঙ্গে, কী সুন্দর প্রশান্তির সঙ্গে শুনছেন তাঁদের কথা, কোন বিরক্তি নেই। ধৈর্যের সঙ্গে প্রত্যেকের প্রতিটি কথা শুনছেন, যদি প্রতিকারের মত কথা থাকে সঙ্গে সঙ্গে একান্ত সচিবদের কাউকে ডাকছেন, লিখে নিতে বলছেন। অনেককে বা মুখে না বলে লেখা কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছেন। সকাল ৮টায় শুরু হয়েছে – চলবে ১০টা পর্যন্ত। কেউ আসছেনে একা, কেউ বা দল বেঁধে। এক পাশে রয়েছে মাথার উপর আচ্ছাদন, বসবার কুরসি। তাতে সিকি লোকেরও জায়গা হবে না। যদি সবাইকে কুরসিতে বসতে দিতে হয়, বাগানের সর্বত্র কুরসি দিয়ে বোঝাই করে দিলেও চলবে না। তাই ব্যবস্থা রয়েছে শতরঞ্চির। গুচ্ছে গুচ্ছে বসে আছেন দর্শনার্থীরা। হাতে মালা, ফুল আর্জির কাগজ। শুধু দেখা করলেই হবে না। ইন্দিরাজীর সঙ্গে ছবি তোলাও চাই। তারও ব্যবস্থা আছে। ক্যামেরা কাঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। তাঁর কাজই হল শুধু ছবি তোলা। আকাশবাণী ভবনে কোথায় তাঁর স্টুডিও ঠিকানা আছে। ছবির খরচা দিলে তারিখ মিলিয়ে ঠিক বের করে নেওয়া যাবে ছবির কপি। আমার মত প্যাঁচার মুখ যাঁদের নয় তাঁরা নিশ্চয় সেই ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখবেন। ইন্দিরাজীর সঙ্গে পরম মুহূর্তটিকে স্মরণে রাখার জন্য। কেমন ধরনের লোকেরা আসেন দেখা করতে? একটি দিন আরেকটি দিন করে যদি রোজনামচা ঘেটে দেখা যায়, তবে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীর দিনগুলো কেমন কাটে। যে কোনও একটি দিন বেছে নিই। গত ১৩ই নভেম্বর। গিয়েছিলুম সকাল ৯টায় ১ নম্বর আকবর রোডে। গিয়ে দেখলুম তিনি এক এক বার দর্শনার্থী এক একটি দলের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। পাশ কাটিয়ে আসতে গিয়ে দেখলুম ঝুঁকে পড়ে একটি ছোট্ট শিশুকে আদর করছেন। বাচ্চাটির গলায় নিজের পাওয়া মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। মৃদু হাসলেন আমায় দেখে। সরে এক কোণে দাঁড়ালুম। তার আগে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কখন থেকে?’ বললেন, ‘আজ ঠিক আটটা দশ থেকে, তুমি প্রায় এক ঘন্টা লেট।’ নিত্য হাজিরা দিই না, দিতে ভাল লাগে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই কেমন করে তিনি জনতার মনে শান্তি আত্মবিশ্বাস জাগাচ্ছেন। একটি দুঃখীর মুখ ইন্দিরাজীর সামনে হাসিতে প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেই প্রসন্নতা সেই হাসিই আবার ইন্দিরাজীকে শক্তি জোগায়। তাই জনতার প্রীতি, বিশ্বাসই তাঁর নেতৃত্বের উৎস, শক্তির উপাদান। জনসাধারণ তাঁদের আকুন্ঠ সমর্থন এবং অবিচলিত বিশ্বাস দিয়ে নিজেরা শক্তিশালী হন আর তাঁদের নেত্রীকে শক্তিশালী করেন। জনসাধারণকে তিনি প্রেরণা দেন আর জনশক্তি তাঁকে প্রেরণা দেয়। জওহরলালকেও দেখেছি, যখন তিনি ক্লান্ত বোধ করছেন, বিশ্রামের জন্য মন উন্মুখ হয়েছে, শহরে কিংবা শহরের বাইরে, কোন গ্রামে গিয়ে তিনি জনসভা করছেন। তাঁর জনসভা মানে তো জনসমুদ্র। আর ভাষণ মানে তো নিদেনপক্ষে একটি ঘণ্টা। বিশ্রাম হল কই ক্লান্তির। কিন্তু ফিরে এলেন তিনি সম্পূর্ণ সতেজ, নতুন শক্তি নিয়ে। বার বার দেখা গেছে এই দৃশ্য। কী করে এ সম্ভব হত? হত কারণ জনসাধারণের অকুণ্ঠ প্রীতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস তাঁর ক্লান্তি দূর করত, নতুন উদ্যম দিত। কন্যা ইন্দিরাও ঠিক এই প্রকৃতিটির উত্তরাধিকারী। জনতার সমর্থন এবং প্রেরণা তাঁকে দেয় নতুন উদ্যম নতুন প্রেরণা। তাই ইন্দিরা আজ ভারতের অবিসংবাদী নেতা। ফিরে আসি ১৩ নভেম্বর দিনটিতে – সওয়া ন’টা বাজল। তখনও নতুন নতুন আসছেন দলবেঁধে। একটি বৃদ্ধাকে দেখলুম। অপূর্ব দৃশ্য। নিজের শক্ত সমর্থ ছেলের কাঁধে চেপে ঢুকলেন। সামনের শামিয়ানার তলায় রাখা চেয়ারে ছেলে তাঁকে পাঁজাকোলা করে নামালেন। ইন্দিরাজী ছুটলেন। অসুস্থ কি? সেবার বা চিকিৎসার প্রয়োজন আছে? না, অশীতিপর বৃদ্ধার ইচ্ছে – ক’দিন বা জীবনের বাকি আছে, একবার ইন্দিরা বেটীকে দেখিয়ে নিয়ে আয়। সেই একবার তাঁদের শহরে ইন্দিরাজী গিয়েছিলেন। আবার কি দেখা হবে? কে জানে! ‘দিল্লিতে নিয়ে গিয়েই আমাকে দেখিয়ে নিয়ে আয়।’ মায়ের ইচ্ছে ছেলে রাখবে না? ক’দিনই বা মা আর বাঁচবে! চলতে পারেন না, চোখের জ্যোতি কমে এসেছে। ছেলে কাঁধে চাপিয়ে রুগ্ন মাকে নিয়ে এসেছেন ইন্দিরা বেটীকে দেখাতে। ইন্দিরাজী পাশে দাঁড়িয়ে কিন্তু বৃদ্ধা ভাল করে মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। আরো ঝুঁকে পড়ে দেখতে চাইছেন। ইন্দিরাজী বুঝতে পেরে তিনিও ঝুঁকে নিজের মুখখানা আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরতে চাইছেন। বৃদ্ধা তার কাঁপা কাঁপা হাতখানা দিয়ে ইন্দিরাজীর মুখখানায় হাত বুলিয়ে আগের দেখা মুখের চেহারাখানা বুঝে নিতে চাইছেন। দেখতে গিয়ে দর্শকদের চোখ ভিজে উঠল। এত পরম স্নেহ মায়ের মনে বেটী কি সাড়া না দিয়ে পারেন? এই নিত্য ঘটছে। এই দৃশ্য ১ নম্বরে দাঁড়ালেই দেখা যাবে। সকাল থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে শতাধিক মানুষের সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর এলেন একদল বিদেশিনী। সোভিয়েট রাষ্ট্রের ইউক্রেন এবং তুর্কমান দেশের সুপ্রীম সোভিয়েটের সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে, পরমচক্র পাওয়া বীরাঙ্গনা, সঙ্গে আবার নামকরা অভিনেত্রী। বর্তমানে ভারত সফরে এসেছেন। এত দূর থেকে এসেছেন, প্রবল আগ্রহ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দেশজোড়া এত নামডাক – একবার তাঁকে দেখবেন, দুটি কথা বলবেন, সঙ্গে নিয়ে একটি ছবি তুলবেন। তাঁদের দেশের ভাষা রাশিয়ান নয়। সঙ্গে দোভাষী। যাঁরা তাঁদের ভাষা থেকে রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করবেন রাশিয়ান থেকে আরেকজন ইংরেজিতে। পরম আগ্রহ নিয়ে তাঁরা দেখা করে গেলেন। ঘড়িতে তখন পৌনে দশ। এক বিরাট দল এলেন। এঁরাও বিদেশী মহিলা। অল্প বয়স্কা। মধ্য বয়স্ক সাথী ভারতীয় কটি পুরুষ এবং মহিলা। আমার পরিচিত। সকলেই শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়। জিজ্ঞেস করলুম পরদেশীয়াদের পরিচয়। বললেন, এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা শ্রমিক আন্দোলন সংক্রান্ত শিক্ষাগ্রহণ করতে এদেশে এসেছেন বিশেষ শিক্ষণ সূচীতে। জাপান, ফিলিপিন্স, নিউজিল্যাণ্ড, ক্যানাডা কেউ বাদ নেই। এশিয়ার বাইরেও। দেখা করে, আলোচনা করে তাঁরা যখন গেলেন তখন দশটা দশ। ১০-২০ মিনিট। প্রধানমন্ত্রী সাউথ ব্লকে নিজের দফতরে পৌঁছে গিয়েছেন। শুরু হয়েছে সরকারি দফতরের নথি পুঁথি দেখার কাজ। উৎসুক হলুম – দিনের শেষে সংগ্রহ করব কী কী করলেন সারা দিন ধরে। যা দেখেছি, সারাদিনের দেখা সাক্ষাতের কাজ কি শেষ হয়েছে? নাকি সবে শুরু? সংগ্রহ করেছি দিনপঞ্জী। তাই তুলে দিলুম হুবুহু।
১৩ই নভেম্বর –
১০:৩০ মি- আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য।
১০:৫০ মি- আইনমন্ত্রী।
১১:১৫ মি- বিদ্যুৎ ও শক্তি মন্ত্রী।
১১:৩০ মি- কেরলের মুখ্যমন্ত্রী।
১২টা দ্বিপ্রহর- ডঃ জিরিয়ন, মেক্সিকো দেশের ডিরেক্টর জেনারেল (টেলিফোন সংস্থা)।
১২:৩০ মি- এথনো লজিকেল সায়েন্স কংগ্রেস সংস্থার পক্ষে ডেপুটেশন।
১:১৫ মি- নিজস্ব দফতরের অফিসার তিনজন।
১:৩০ মি- স্নান-আহারের জন্য এক ঘণ্টার অবকাশ।
২:৩০ মি- গান্ধীজীর সহকর্মী বিবি আব্দুল সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
২:৪৫ থেকে ৪টে পর্যন্ত – দফতরের কাজ।
৪:৩০ মি- আট জন সাংসদ সদস্যের একটি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
৪:৫০ মি- দফতরের কাজ, দলের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ (মন্ত্রী এবং অফিসাররা)।
৫টা থেকে ৭টা- অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটে গিয়ে জওহরলাল নেহরু বক্তৃতামালার বক্তৃতা দান।
৭:১৫ মি- গৃহে প্রত্যাবর্তন, রাত্রির আহারের পর পুনরায় সরকারী কাজ, রাত প্রায় দশটায় সে দিনের মত কাজ শেষ।
এই ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর জীবনের একটি দিন। এমনি দিনের পর দিন। এই সাক্ষাৎসূচীটি যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে – শিক্ষাসংক্রান্ত, আন্তর্দেশীয়, আন্তরাষ্ট্রীয় এক বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁকে অবাধে বিচরণ করতে হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রীর এই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হচ্ছে। কোন একজন বিশেষজ্ঞ তিনি তার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তাঁকে সব জানতে হবে, বিশেষজ্ঞরা যে সব সমস্যা তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। তাঁর কথাই যখন শেষ কথা তখন সম্পূর্ণ জেনেই তাঁকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এ অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাঁর প্রতিজ্ঞা – প্রতিশ্রুতি পালন করবই। তাই বিশ্রামের কথা ওঠে না। আজ তাঁর জন্মদিন। প্রার্থনা করি – তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা হোক। ভগবান তাকে রক্ষা করুন, শতজীবী করুন।’’
(তথ্যসূত্র:
১- Ballot: Ten Episodes that Have Shaped India’s Democracy, Rasheed Kidwai, Hachette India (২০১৮)।
২- আমি: ইন্দিরা গান্ধী, নিমাইসাধন বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- ১৯৭৬ সালের ১৯শে নভেম্বর, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ইন্দিরা গান্ধীর মূল্যায়নে লিখিত একটি প্রবন্ধ।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৫ সাল।
৫- Indira Gandhi: Child of Politics (Puffin Lives), Sreelata Menon, Puffin Books.
৬- The Dramatic Decade The Indira Gandhi Years, Pranab Mukherjee, Rupa Publications (২০১৫)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত