নিজেদের দমে আইএসএলে খেলতে গিয়েই শ্রী সিমেন্টের ফাঁদে পা দিয়েছে ইস্ট বেঙ্গল। যে কোনও মূল্যে দেশের পয়লা নম্বর লিগে ঢোকার জন্য মরিয়া ছিলেন লাল-হলুদ কর্তারা। খতিয়ে দেখেননি টার্মশিট। অত্যন্ত হঠকারিতার সঙ্গে তাঁরা ১ সেপ্টেম্বর মউ এবং টার্মশিটে সই করেন। আসলে কল্যাণ মজুমদাররা ভেবেছিলেন, ২৪ শতাংশ শেয়ার পাওয়াটাই তাঁদের নৈতিক জয়। কারণ, সংযুক্তিকরণের পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহন বাগানের হাতে রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ার। এই হিসেবে এগিয়ে থাকার কারণে অন্ধের মতো টার্মশিটে সই করেন ইস্ট বেঙ্গল প্রতিনিধি। যার ফলে এখন হাত কামড়াতে হচ্ছে।
ক্লাব বাঁচানো, আর স্রেফ বেচে দেওয়ার মধ্যে ফারাকটা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন ইস্ট বেঙ্গলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। কথা ছিল, আইএসএল-এ খেলবে লাল-হলুদ। তার জন্য দরকার ইনভেস্টর। সেটাও হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে চুক্তিপত্রে সই হলে ইস্ট বেঙ্গলের সেই ঐতিহ্য, সমর্থকদের ভালোবাসার জগৎটাই ধূসর হয়ে যাবে। চুক্তিপত্রের জালে ফেঁসে ঘটিবাটি সুদ্ধ বিক্রি হয়ে যাবে শতাব্দীপ্রাচীন ইস্ট বেঙ্গল। আর সমর্থকরা? তাঁদের কার্যত ঝ্যাঁটা মেরে দূর করে দেওয়া হবে ক্লাব থেকে।
কী আছে এই চুক্তিপত্রে? টাকা ঢালার বিনিময়ে ইস্ট বেঙ্গলের সবকিছুই অক্টোপাসের মতো গ্রাস করতে চলেছে শ্রী সিমেন্ট। মন্দিরসম ক্লাবে প্রবেশের জন্য এরপর অনুমতি নিতে হবে সদস্যদের। আর সমর্থকরা? তাঁদের ঠাঁই সেখানে নেই। অনুশীলন দেখার অধিকারটুকুও হারাবেন তাঁরা। সদস্য কার্ড নবীকরণ করতে হবে এরিয়ান ক্লাবের পাশে প্রস্তাবিত কাউন্টার থেকে। আইএসএলে প্রিয় দলের ম্যাচে সব সদস্যের সুলভে টিকিট পাওয়ার কোনও গ্যারান্টি নেই। নতুন বোর্ডে থাকবেন শ্রী সিমেন্টের আটজন। বাকি দু’জন ইস্ট বেঙ্গলের। বোঝাই যাচ্ছে, সাবেক কর্তারা পুতুলের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। কোলাবরেশন এগ্রিমেন্টে সই হলেই আগামী দিনে ক্লাবের কোনও বিভাগীয় সচিব তাঁবুতে বসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে একরাশ ধোঁয়াশা রয়েছে। ইস্ট বেঙ্গলের মাঠ, গ্যালারি, ড্রেসিং-রুম, ব্রডকাস্ট অফিস, ম্যাচ অফিসিয়ালস রুম, পার্কিং, অ্যাক্টিভেশন স্টল, স্টোর, অফিস, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ এরিয়া, এলইডি স্ক্রিন—সবই থাকবে শ্রী সিমেন্টের মালিকানাধীনে। এছাড়া দু’টি টিম বাস, রাজডাঙায় অবস্থিত লাল-হলুদ অ্যাকাডেমির বাড়িরও মালিক হবে হরিমোহন বাঙ্গুরের প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বিচ্যুত হবে গর্বের ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব।
কর্তারা প্রায়শই বলেন, সমর্থকরাই সব। কিন্তু টার্মশিটে সই করার সময় তাঁদের কথাই ভুলে গেলেন ক্ষমতাসর্বস্ব কর্তারা! আইএসএলের হোম ম্যাচে সদস্যদের সুলভে টিকিট দেওয়া হবে। কিন্তু ১০ হাজার সদস্যের মধ্যে কারা টিকিট পাবেন তা ঠিক করবে এসসি ইস্ট বেঙ্গলের বোর্ড। উল্লেখ্য, আই লিগে সব সদস্য সুলভে টিকিট পেতেন। টার্মশিট অনুসারে রক্ষিত হচ্ছে না সদস্যদের স্বার্থ। মনে রাখা প্রয়োজন, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, টেনিস, অ্যাথলেটিকসের নিয়ন্ত্রণ থাকবে শ্রী সিমেন্টের কাছে।
সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে নথিভুক্ত হওয়া ইস্ট বেঙ্গলের কাছে স্পোর্টিং রাইটস না থাকলে কার্যত বেকার হয়ে পড়বেন কর্তারা। শুধু তাই নয়, টার্মশিটে স্পষ্ট বলা রয়েছে, লাল-হলুদ কর্তারা ‘ইস্ট বেঙ্গল’ শব্দযুক্ত বিকল্প কোনও ক্লাব গড়তে বা এমন কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। জুলাই মাসের শেষে লিগের প্রোমোটার এফএসডিএল ট্যুইট করে জানিয়ে দিয়েছিল ২০২০-২১ সালের আইএসএলে দশটি দলই খেলবে। কিন্তু ওই ঘোষণার পরেও এক শীর্ষ কর্তা বলেছিলেন, ‘এবারের আইএসএলে খেলব আমরা। ওই ট্যুইটের পরেও ছিটকে যায়নি।’ অহঙ্কারের মোড়কে বলা সেই কথা রাখতে গিয়েই ঘোর সংকটের জটাজালে ইস্ট বেঙ্গল।