বাবার মৃত্যুর পর প্রদেশ কংগ্রেস তাঁকে আর যোগ্য সম্মান না দেওয়ায় আমৃত্যু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে থাকা সোমেন মিত্রের পুত্র রোহন মিত্র কি এবার তৃণমূলের পথে? গত কয়েক দিনে পর পর যে সব টুইট করেছেন তিনি, তাতেই উস্কে উঠেছে জল্পনা। তাঁর টুইটে প্রদেশ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা স্পষ্ট। এবং তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ‘শ্রদ্ধাশীল’ সে কথাও সাফ বলছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে সোমেন ‘প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস’ তৈরি করেছিলেন। পরে সে দলকে তিনি মিশিয়ে দেন তৃণমূলে। মমতার দেওয়া টিকিটে তিনি ২০০৯ সালে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে জেতেন। তাঁর স্ত্রী শিখা মিত্র পর পর দু’বার তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হন। কিন্তু ২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে সোমেন সাংসদপদ ছাড়েন। পরে শিখাও বিধায়ক পদে ইস্তফা দেন। দু’জনেই কংগ্রেসে ফেরেন। ২০১৮ সালে ফের প্রদেশ সভাপতি হন সোমেন। সেই থেকে সম্প্রতি প্রয়াণ পর্যন্ত তিনি প্রদেশ সভাপতি পদেই ছিলেন। তবে সোমেন পুত্র রোহন এখন ‘বেসুরো’ গাইতে শুরু করেছেন।
উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার কংগ্রেস বিধায়ক কাজি আবদুর রহিম (দিলু) সম্প্রতি দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। যাঁকে নিয়ে অধীর শিবিরের দাবি, তিনি অনেক দিন ধরেই তৃণমূলে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। সেই দিলুর বিষয়েই রোহন উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। দিলুর দলত্যাগের পর ৭ নভেম্বর পর পর তিনটি টুইট করেন রোহন। তার সারকথা— লাগাতার ‘অসম্মান’ করে উত্তর ২৪ পরগনার একমাত্র কংগ্রেস বিধায়ককে দল ছাড়তে বাধ্য করা হল!
লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে দিলুর সমঝোতার দলীয় তত্ত্বও রোহন নস্যাৎ করেছেন টুইটে। উল্টে বলেন, কোনও তারকা প্রচারক ছাড়াই দিলু ১ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘কোনো স্টার ক্যাম্পেনারের প্রচার ছাড়াই গত লোকসভা নির্বাচনে কাজী আব্দুর রহিম ( দিলু) এক লক্ষাধিক ভোট পেয়েছিলেন ; দক্ষিণবঙ্গে কংগ্রেস প্রার্থীদের মধ্যে সেটাই সব থেকে বেশি ভোট ছিলো। সেই দিলু দা’,কে অসম্মান করে দলের লাভ হলো না ক্ষতি হলো, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার বেচারাম মান্নাকে নিয়েও টুইট করেছেন রোহন। সে টুইট আরও ‘ইঙ্গিতবহ’। হরিপালের বিধায়কের ইস্তফা নিয়ে যখন হইচই চলছে, তখন রোহন বেচারামের ছবি সম্বলিত টুইটে লেখেন, ‘যাঁদের একদিন কোনও রাজনৈতিক পরিচয়ই ছিল না, আস্তাকুঁড় থেকে তাঁদের তুলে এনে কখনও প্রয়াত সোমেন মিত্র বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা একদিন সিংহাসনে বসিয়েছিলেন যে মানুষদের, তাঁরা কি আজ অন্য গন্ধ পেয়ে বেইমানির পথে হাঁটছেন’?
তার পর শুক্রবার ফের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সোমেন-পুত্র। টুইটে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণ কলকাতার ভোটার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার জেলা কংগ্রেসের কর্মী সম্মেলনে ডাকা হল না কার নির্দেশে? ক্ষোভের এই ধারাবাহিক বহিঃপ্রকাশ কি প্রদেশ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা? নাকি তৃণমূলের দিকে পা বাড়ানো? রোহনের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দুটোই ঠিক।
দীর্ঘ দিন ধরে মিত্র পরিবারের ঘনিষ্ঠ মধ্য কলকাতার এক কংগ্রেস কর্মীর কথায়, ‘শিখাবউদি এবং রোহনের কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নেই। গান্ধী পরিবারের প্রতি যে তাঁরা কৃতজ্ঞ, সে কথা রোহন বার বার বলেন। কিন্তু প্রদেশ নেতৃত্ব রোহনকে যোগ্য সম্মান দিচ্ছেন না। যাঁরা এক সময়ে দল ছেড়ে বিজেপি-তে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের দলে ফিরিয়ে এনে পদ দেওয়া হচ্ছে। এগুলো মেনে নেওয়া মুশকিল।’ রোহন-অনুগামীদের নিশানায় মধ্য কলকাতা জেলা কংগ্রেসের নতুন সভাপতি সুমন পাল।
রোহন নিজেও বলেন, ‘বিজেপি থেকে কিছু সুবিধাবাদী কীট আমাদের দলে ঢুকে দলের ক্ষতিসাধনের এজেন্ডা নিয়েছে।’ অন্যদিকে, মমতা প্রসঙ্গে রোহন জানিয়েছেন, ‘বাবার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক লড়াই ছিল ঠিকই। কিন্তু বাবা কখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক ভাবে ছোট করার চেষ্টা করেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে তৃণমূল স্তর থেকে উঠে এসেছেন, বাবা সেটাকে সব সময় সম্মানের চোখেই দেখতেন। কারণ, বাবা নিজেও তৃণমূল স্তর থেকে লড়াই করে উঠে আসা নেতা ছিলেন।’
তিনি কি তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন? সরাসরি জবাব না দিয়ে সোমেন-পুত্র বলেছেন, ‘আমি নিজে যুব কংগ্রেস থেকে উঠে এসেছি। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ যুব কংগ্রেসের ইতিহাস জানি। যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে এক সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠনকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা-ও জানি। যুব কংগ্রেস সভানেত্রী থাকাকালীনই তিনি প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। যুবনেত্রী তথা বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব মাইলফলক স্পর্শ করে গিয়েছেন, তাতে আমি তাঁর প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল।’