দিব্বি গানের সুর দিচ্ছিলেন মানুষটা। মিউজিক রুমে বসে যাঁরা শুনছিলেন তাঁদের সবার কান-মন কানায় কানায় ভরে উঠছিল সুরের ছোঁয়ায়। অনেক দিন পরে ‘মিলি’ ছবির গানে নিজেকে যেন নতুন করে উজাড় করে দিচ্ছিলেন শচীন কর্তা। এমনিতেই শচীন দেব বর্মনের গান মানেই মেঠো সুর। মিঠে সুর। বাবা ‘নবদ্বীপ চন্দ্র’ ছিলেন শচীন কর্তার গানের গুরু। ত্রিপুরা সম্বন্ধে এমনিতেই প্রবাদ আছে, সেখানকার রাজবাড়িতে রাজা-রানি, কুমার-কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত সবাই গান জানে। গান গায়। সেই পরিবেশে বড় হওয়া রাজকুমার শচীন কর্তা যে সুরের রসে মজে থাকবেন এবং মজাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে হঠাত্ এই বিশেষ ছবির গান নিয়ে আলোচনা কেন? আসলে তার বছর খানেক আগে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনা ভীষণ আহত করেছিল শচীন দেব বর্মনকে। তার পরেই এই ছবির গানে কর্তা নিজেকে আবার নতুন করে প্রমাণ করতে বসেছিলেন নিজের কাছে। বরাবর দু’জনকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল তাঁর। এক, ছেলে ‘আর ডি বর্মন’। দুই, ‘লতা মঙ্গেশকর’। ঘটনাচক্রে দু’জনেই তাঁকে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছিলেন। সেই আঘাত এতটাই ছিল যে কর্তা ঠিক করেছিলেন, গান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু ত্রিপুরার রাজকুমার ময়দান থেকে হেরে ফিরবেন, এটাও তো হওয়ার নয়। তাই ‘মিলি’ তাঁর হাতের শেষ অস্ত্র।
কিন্তু ময়দান ছাড়ার মতো কী এমন ঘটেছিল শচীন কর্তার সঙ্গে? মুম্বইয়ে শচীন কর্তার খুব প্রিয় মহিলা শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতার কথা উঠলেই তিনি বলতেন, ‘‘আমায় হারমোনিয়াম দে। লতাকে এনে দে। আর আধা ঘন্টা সময় দে। আমি সুর করে দিচ্ছি।’’ লতাজির ওপর এতটাই ভরসা করতেন যে গীতা দত্ত প্রথম পছন্দ হলেও যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন লাতাজির উপর। তাঁর মতে, ‘‘ওই মাইয়া আমায় জাদু করসে। ওরে ছাড়া আঁধার দেহি আমি।’’ পরে এই লাতাজি-ই প্রচন্ড অপমান করেছেন শচীন কর্তাকে। কোনো সুরকার কখনও নিজের তৈরি স্বরলিপি কাছছাড়া করেন না। শচীন কর্তা-ও এটাই করতেন। কিন্তু লাতাজি যখন সুরের দুনিয়ার মধ্য গগনে তখন বেয়াড়া আবদার করেছিলেন। তাঁর দাবি, গানের নোটেশন তাঁর হাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে তিনি সুর এদিক-ওদিক করে নেবেন। এই দাবি মানা কোনো সুরকারের পক্ষে সম্ভব? বিশেষ করে শচীন কর্তার মতো রাজবংশীয় ঘরানার মানুষ। যিনি বরাবরের স্বাধীনচেতা। সুরের স্বরলিপির দখলদারি নিয়ে প্রথম দ্বন্দ্বের শুরু। কর্তা লতাজিকে ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, এই আবদার মানা সম্ভব না। জিদ্দি লতাজিও অনড় তাঁর চাহিদা থেকে। নিরুপায় কর্তা বাধ্য হয়ে লতাজির বদলে নিলেন তাঁর বোন ‘আশা ভোঁসলে’কে। সেই সময় শচীন দেবের মতো অনেকেই লতাজিকে তাদের গান থেকে বাদ দিয়েছিলেন। এই ধাক্কায় মন ভেঙ্গে গিয়েছিল কর্তার।
এর কয়েক মাস পরেই ঘটল দ্বিতীয় ঘটনা। ‘দেব আনন্দ আর শচীন কর্তার জুটি’ প্রথম থেকেই সুপারহিট। ‘দেব আনন্দ’ পরিচালনায় আসার পর ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ বানাবেন বলে ঠিক করলেন। সুর দেবার জন্য ডাক পড়ল শচীন কর্তা আর পঞ্চমের। চিত্রনাট্য শোনার পর দু’জনে দু’জনের মতো করে সুর শোনালেন। পঞ্চমের গান বেশি পছন্দ হলো দেবের। তিনি শচীন কর্তাকে খুব নরম গলায় জানালেন, ‘‘এই ছবিতে পঞ্চমের সুর বেশি ভালো মানাবে। তাহলে পঞ্চম সুর দিক।’’ হাসিমুখে সম্মতি দিলেন কর্তা। ছেলের উন্নতি দেখলে কোন বাবা না খুশি হয়? আগ্রহ নিয়ে একদিন রেকর্ডিং রুমে ছেলের সুর-ও শুনতে এলেন। পঞ্চম সেদিন ‘দম মারো দম’ গান তোলাচ্ছিলেন আশাজিকে। দু’লাইন শোনার পরেই রাগে মুখ লাল এস ডি বর্মনের। দু’লাইন শুনেই রাগে মুখ লাল এস ডি বর্মনের। চেঁচিয়ে উঠে পঞ্চমকে বললেন, ‘‘আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে।’’ রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কর্তা যখন মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন, সবার দেখে মনে হলো, রাজা যুদ্ধে হেরে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
রেকর্ডিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক’দিন গুম হয়ে বাড়ি বসে রইলেন। তারপর শুরু করলেন ‘মিলি’ ছবির গান। সুর দিতে দিতেই ‘paralytic attack’ হলো কর্তার। কোমায় আচ্ছন্ন বাবার মাথার কাছে বসে ‘মিলি’র গানে সুর দিচ্ছেন পঞ্চম। এই সময় কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা চলছে। কর্তা আজন্ম ইস্টবেঙ্গল-এর সাপোর্টার। দল হারলে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতেন। কর্তার অসুস্থতার সময় ইস্টবেঙ্গল ৫-০ গোলে হারালো মোহনবাগানকে। পঞ্চম সেই খবর চেচিয়ে কর্তার সামনে বলতেই কোমায় আচ্ছন্ন এস ডি চোখ খুলেছিলেন একবারের জন্য! তারপর সেই যে চোখ বন্ধ করলেন, আর খোলেননি চলে যাওয়ার দিনটি পর্যন্ত – দিনটা ছিল ৩১শে অক্টোবর, ১৯৭৫ সাল।
কুমিল্লার ষাট বিঘা জমির উপর তৈরি বিরাট রাজপ্রাসাদের বসবাসকারী যুবরাজের সাধারণ লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করাটা রাজ পরিবারের রীতি বিরুদ্ধ ছিল। প্রাসাদে ছিল অনেক পরিচারক ও পরিচারিকা। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কুমার শচীনের হুকুম দেওয়ার সম্পর্ক ছিল। বাবার কাছে ‘নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মণ’ অবশ্য সঙ্গীত রসিক ছিলেন, সেতার বাজাতেন নিজে। তাই সঙ্গীতের প্রথম তালিম বাবার কাছেই পাওয়া। বাড়ির ছোট বলে ছেলে বাবার একটু বেশিই আদর দিতেন। তবু বালক শচীন্দ্র কি জানি কেন একটা টান অনুভব করত মাটির কাছাকাছি জগতটার জন্যে। তাঁর নিজের কথায়,
‘‘ত্রিপুরার ধানের খেতে চাষি গান গাইতে গাইতে ধান চাষ করে, মাঝিরা গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানেনা, জেলেরা গান গেয়ে মাছ ধরে, সেখানের লোকেদের গানের গলা ভগবান প্রদত্ত।’’
কিন্তু সেই জগতে তাঁর অবাধ বিচরণ করার অনুমতি ছিল না। তবে বাবার নির্দেশে সন্ধ্যাবেলায় ভাই বোনেরা মিলে যে উপাসনার আসর বসত, সেখানে উপাসনা ছাড়া মার্গ সঙ্গীত আধারিত গান বাজনার আসরও হত। তাঁর এক দাদা ‘কিরণ কুমার দেববর্মণ’ আর এক দিদি ‘তিলোত্তমা দেবী’ও ভাল গাইতেন। এ ছাড়া দোল উৎসবে বিখ্যাত গায়ক গায়িকারা আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন তাঁদের বাড়িতে গান শোনাতে। এ ভাবে বালক শচীন্দ্রের গান বাজনা শিক্ষা চলতে লাগল। ক্লাস ফাইভে উঠে স্কুলে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে গায়ক শচীন্দ্রের প্রথম পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স। সে গান সবার ভালো লেগেছিল। স্কুলের হেডমাস্টার মশাই তাঁর সুখ্যাতি করে শচীন্দ্রের বাবাকে একটা চিঠি দিয়েই বসলেন। এর পর তাঁর বাবা তাঁকে প্রথাগত ভাবে গান শেখাতেও আরম্ভ করলেন।
কিন্তু এই শিক্ষায় কোথাও একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে যেত কুমার শচীন্দ্রের মনে। কোথাও একটা সেই মাঠে ঘাটে শোনা গান সম্বন্ধে জানার আকুতি তাঁকে অস্থির করতো। কিন্তু রাজবাড়ির আভিজাত্যের বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কিন্তু একটা উপায় বোধহয় ঈশ্বরই করে দিলেন। জীবনের উপান্তে এসে, তাঁর স্মৃতি কথায় তাতে তিনি যে দুজন সঙ্গীত গুরুর নাম করেছিলেন, তাঁরা কেউ কোনও উস্তাদ সঙ্গীতজ্ঞ নন। তাঁদের একজনের নাম ‘মাধব’ আর আর একজনের নাম ‘আনোয়ার’। তাঁরা আসলে ছিল রাজবাড়ির দুই ‘পরিচারক’। মাধবের কাজ ছিল ছুটির দিনে দুপুর বেলা বাড়ির সবাইকে রামায়ণ পাঠ করে শোনানো। তাঁর সম্বন্ধে তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘… সে যখন রামায়ণ পড়ত তখন তান-খটকি ছাড়া সরল-সোজা গানের ধরণ গানের ধরণ আমাকে পাগল করে দিত।’’ আর আনোয়ার সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘… আনোয়ার রাত্রে তার দোতারা বাজিয়ে যখন ভাটিয়ালি গান করত, তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করারা দফারফা হয়ে যেত আর পরের দিন স্কুলে মাস্টারমশাই এর কাছে বকুনিও খেতাম। কিন্তু রাত্রে আবার ব্যাকরণ মুখস্থ ও অঙ্ক কষা ছেড়ে আনোয়ারের কোল ঘেঁষে বসে তাঁর ভাটিয়ালি সুরে ও কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম।’’
বহু বছর পরে যখন যখন শচীন কত্তা তাঁর বোম্বাইয়ের বাড়িতে বসে বিমল রায়ের ছবির জন্যে সুর করছিলেন, ‘আজ সজন মোরে অঙ্গ লগালো জনম সফল হো যায়ে
হৃদয় কী পীড়া, দেহ কি অগ্নি সব শীতল হো যায় …’
তখন হয়ত অলখ থেকে কোথাও হয়ত সেই রামায়ণ পড়া মাধব তাঁকে জুগিয়ে দিচ্ছিলেন সুর। আবার যখন সুর করছিলেন ‘শুন মেরে বন্ধু রে’, বিমল রায়ের জন্যে, তখন হয়ত চুপি চুপি তাঁর পাশে এসে বসেছিলেন সেই অঙ্ক ভুল করিয়ে দেওয়া, ভাটিয়ালি গাওয়া সেই ছোটোবেলার আনোয়ার।
কুমিল্লার যুবরাজ কুমার শচীন্দ্রের সঙ্গীত জগতের মুকুটহীন বাদশা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি পর্বটা ভালো করে বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে একটু বুঝে নিতে হবে সেই সময়টাকে আর সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার একটা ছোট্টো মফস্বল শহরকে।
বিশের দশকের শেষ আর তিরিশের দশক শুরু এ রকম একটা সময়। পরাধীন দেশ। স্বদেশ চেতনা বাঙ্গালির মর্মে মর্মে প্রবেশ করছে একটু করে। বেশির ভাগ উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা বন্দেমাতরম মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছে। পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়াম সমিতি, লাঠি খেলা চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠছে। লুকিয়ে বোমা বাঁধাও শেখা হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবু কিছু ছেলে মেয়ে স্বদেশী নেশার থেকে একটু দূরে থেকে লিখছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস। কিছু মেতেছে সঙ্গীত নিয়ে। শুধু কলকাতা নয়, ছোটো ছোটো শহর গুলিতেও গড়ে উঠছে নাটকের দল, সাহিত্য সভা, গানের দল। চলছে একে অপরের হাত ধরে। কুমিল্লাকে ঠিক পুরোপুরি শহর বলা যায় না। দু’পা ছাড়া এক একটা পুকুর, প্রচুর গাছপালা, সরু সরু রাস্তাঘাট নিয়ে এ শহরের মধ্যে যেন গা ঢাকা দিয়ে থাকে একটা গ্রাম। তবু একটা কারণে এ শহর বাঙ্গালিদের গায়ে লাগা একটা বদনামের তকমা দূর করেছিল। সে হল এ শহরের বাঙ্গালিদের ব্যাঙ্ক আর ইনস্যুরেন্স কোম্পানি খোলার উদ্যোগ। সে সব কোম্পানি বেশি দিন চলেনি সে অন্য গল্প। তবু উদ্যোগ টা মিথ্যে নয়। কিন্তু আমাদের গল্প-সন্ধান তো অন্য জায়গায়। সেটা এ শহরের সাংস্কৃতিক উন্মাদনার জায়গা। শুধু শচীন দেব বর্মণ নয় এ শহরে সেই সময়টায় ছিল, ‘ডাঁই করা প্রতিভা’। সে সময়ের এক টা চায়ের দোকানের কথা জানা যায় ‘শ্রী অশোক মিত্র’ মহাশয়ের লেখায়, ‘‘সেই চায়ের দোকানের আড্ডায় কাকে পাবেন না আপনি, অনুশীলন সমিতির অতীন রায়, ভিক্টোরিয়া কলেজে সদ্য অধ্যাপনায় ব্রতী অজয় ভট্টাচার্য তাঁর অনুজ সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তাদের প্রিয় সখা কাজপাগল সত্য প্রসন্ন দত্ত, যিনি ইতিমধ্যেই ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার একটি দুটি কপি ছাপাবার সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই ভিড়ে তো পাবেন একগাদা আরও অনেককে, কেউ কেউ কবি কেউ কেউ গায়ক, কেউ কেউ তখনও জানেননা কি হবেন শেষ পর্যন্ত। সুবোধ পুরকায়স্থ, রাগ সঙ্গীত ভক্ত মণিলাল শর্মা, সাহিত্যে একটু আধটু হাত পাকানো নারায়ণ চৌধুরী, ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে দেখা দেওয়া আঁকিয়ে অনিল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ( আলফা-বিটা), শিল্পোদ্যোগী নরেন্দ্র নাথ মশাইয়ের পুত্র বটু দত্ত, একটু একটু বাঁশি বা এস্রাজ বাজানোয় রপ্ত আরেক বটু দত্ত,তাঁর অনুজ কী হবে বা করবেন জানেন না কিন্তু গানের নেশায় মশগুল, হিমাংশু দত্ত। এই ভিড়ে ক্কচিৎ কখনো রাজবাড়ি থেকে দখিনা হাওয়ার মতো শচীন কর্তা, যাঁর খেলা ধুলায়, সেই সঙ্গে সঙ্গীত চর্চায়ও প্রবল উৎসাহ, এসে যোগ দিলে উৎসাহ উথলে উঠতো। শচীন কর্তা প্রায়ই চায়ের দোকানের দায় দরাজ হাতে মেটাতেন।’’
শচীন কর্তার মত না হলেও, কুমিল্লার চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া মানুষগুলি পরে কলকাতায় এসে সাংস্কৃতিক জগতে এক এক জন দিকপাল হয়ে উঠেছিলেন। কেউ সুরকার কেউ গীতিকার, কেউ চলচ্চিত্রকার, কেউ কবি, কেউ সাহিত্যিক। অনেকে পরবর্তীকালে শচীন দেবের সঙ্গে কাজও করেছেন। আরেকটা কথা বোধহয় বলে নেওয়া দরকার, কুমিল্লার গা ঘেঁষা আরেক শহরের ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেটা ছিল উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর জন্ম ভিটে। এ সব দেখে সন্দেহ হতে পারে ঐ অঞ্চলের জলবায়ু তে বিশেষ কিছু একটা দ্রব্যগুণ ছিল। যার প্রভাবে এত গুণী মানুষ ওখান থেকে উঠে এসেছেন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি এ পাশ করে ১৯২৪ এ শচীনদেব এলেন কলকাতায়। আরম্ভ হল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ত্রিপুরা ভবনে নতুন জীবন। শহর কলকাতা তাঁকে খুব একটা উৎসাহিত করেন নি। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতেন তিনি আবার সেই কুমিল্লার দিঘীর ধারে ঘুরে ঘুরে ‘টিপরাই বাঁশি’ বাজিয়ে যাচ্ছেন। গাছ পালা ক্ষেত খামার আর খোলা আকাশের নীচে গান বাজনার আনন্দটাকে চিরকাল তিনি মিস করেছেন। এমন কি বোম্বেতে গিয়েও। সেই জন্যেই তাঁর নিজের রচিত সুর দিয়ে সেই ফাঁকটাকে বুজিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সারা জীবন ধরে।
কলকাতায় তিনি এলেন বটে পড়তে। কিন্তু তাঁর আসল উৎসাহ তো ছিল অন্য জায়গায়। মাছধরা, খেলাধুলা আর গান বাজনা। গান শেখার জন্যে ভর্তি হলেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে। টেনিস খেলার জন্যে ভর্তি হলেন ‘চৌরঙ্গী ওয়াই এম সি এ’ তে। মাছধরা ক্কচিৎ কখনো চলত বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে। পড়া শোনায় মন দিতে পারছিলেন না। এক বছর পরে এম এ পড়া ছেড়েই দিলেন। ও দিকে টেনিস খেলার নেশায় অনেকটা সময় চলে যেত এবং তাঁর শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র আবিষ্কার করলেন অতিরিক্ত টেনিস খেলার পরিশ্রমে তাঁর গলা কর্কশ হয়ে যাচ্ছে। অতএব গানের গুরুর নির্দেশে বন্ধ হল টেনিস খেলা। একমনে রেওয়াজ করতে লাগলেন গানের। কিন্তু এম এ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন শুনে বাবা খুব অসন্তুষ্ট হলেন। গান বাজনা রাজা রাজড়াদের সখের ব্যাপার। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া তো দরকার। তিনি একদিন ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় এসে শচীন কে ভর্তি করে দিলেন আইন কলেজে। তাঁর স্বপ্ন শচীন কে পাঠাবেন বিদেশে। সেখান থেকে ফিরে এসে বড় সড় একটা সরকারি চাকরী করবেন। কিন্তু গানের টান বড় আজব টান। সেটান অন্তরে লাগলে অন্য সব টান কে তুচ্ছ করে দেয়। কিছুদিন যেতেই বাবাকে প্রচুর দুঃখ দিয়ে আইন পড়াও ছেড়ে দিলেন। তিনি তখন ‘কেষ্ট বাবু’র সঙ্গে সঙ্গে জলসায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন কি কখনো কখনো তাঁর সঙ্গে চলে যাচ্ছেন বাইজী বাড়িতে গান শুনতে। কেষ্ট বাবুর অনুমতি নিয়ে গান শিখতে গেলেন সে কালের প্রবীণ ওস্তাদ বাদল খাঁর কাছে। যাঁর কাছে গান শিখেছেন কেষ্টবাবু নিজেও। তবে ‘কৃষ্ণচন্দ্র দে’, যে দৃষ্টিহীন মানুষটির কাছে বাংলা এবং ভারতের সঙ্গীত নানা কারণে চিরকাল ঋণী থাকবেন, সেই সব কারণের মধ্যে একটি অবশ্যই থাকবে তরুণ শচীনদেব কে সঙ্গীতের সঠিক রাস্তাটিকে চিনিয়ে দেবার জন্যে। তখনকার বিখ্যাত বেনারসি ঘরানার ঠুংরি গায়ক এবং হারমোনিয়াম বাদক ‘শ্যমালাল ক্ষেত্রী’র কাছেও গেলেন গান শিখতে। পাগলের মত গান শুনে বেড়াতেন নানা আসরে। এই সব আসরে গিয়ে তাঁর আলাপ হয়েছিল বিশাল সব সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীত রসিকদের সঙ্গে। ‘ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়’, ‘গিরিজা শঙ্কর চক্রবর্তী’, ‘সুধীরেন্দ্র নাথ সান্যাল’, ‘হেমেন্দ্র কুমার রায়ের’ মতন মানুষদের সান্নিধ্যে শচীন দেবের সাংগীতিক জ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত হতে লাগল। এর মধ্যে ‘ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়’, যিনি ভারতীয় সঙ্গীতের এক জন মহাজ্ঞানী, যাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত নিয়ে পত্র বিতর্ক যে কোনও সঙ্গীত শিক্ষার্থীর মূল্যবান দলিল, তিনি বিশেষ ভাবে গায়ক শচীনদেবের গানের গুণগ্রাহী ছিলেন। নানা ভাবে তাঁকে উৎসাহ দিতেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘For temperament ‘mejaj’ or ‘tabiyat’ as it called, kumar sachindra Dev Burman is incomparable among the artist I have heard.’’
কলকাতায় শচীনদেবের যা কিছু তালিম নেওয়া, যে সব মানুষ দের সান্নিধ্য পাওয়া, তাঁরা সবাই কট্টর ভাবে ধ্রুপদ সঙ্গীত জগতের। তাই শচীনদেবের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল একজন ধ্রুপদ, খেয়াল বা ঠুংরি গায়ক। অথবা তাঁর গানের জগৎ হওয়ার কথা মূলত রাগ প্রধান সঙ্গীত। তিনি হতে পারতেন ‘ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়’, ‘জ্ঞান গোঁসাই’, ‘তারাপদ চক্রবর্তী’দের পদাঙ্ক অনুসরণকারী আর এক জন রাগপ্রধান বাংলা গানের শিল্পী। কিন্তু তা না হয়ে তিনি চলে গেলেন বোম্বাইয়ের ফিলমি দুনিয়ায়। তার কারণ তাঁর ভিতরকার এক ছটফটে সংগীতস্রষ্টা। তবে তার আগে এই কলকাতাই তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিল সৃষ্টিলোকের চাবিকাঠি।
কলকাতায় ‘All India Radio’ হবার আগে তার নাম ছিল ‘Indian State Broadcasting Co’। এই কোম্পানির কর্তাব্যক্তি ছিলেন ‘রাইচাঁদ বড়াল’, ‘নৃপেন মজুমদার’। তাঁরা তরুণ শচীনদেবকে সুযোগ দিলেন তাঁর নিজের সুরে দু’খানি গান রেডিওতে গাইবার। বিনিময়ে দিলেন দশ টাকা পারিশ্রমিক। সুরকার শচীনদেব বর্মণের যাত্রা এখানেই শুরু হল।
এখন শুনলে খুব আশ্চর্য লাগে ‘এইচ এম ভি কোম্পানি’ এক সময় তাঁর গান রেকর্ড করতে অস্বীকার করেন তাঁর ‘অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য’। সে সময় ‘চণ্ডীচরণ সাহা’ গড়ে তুলেছিলেন এক দেশীয় রেকর্ড কোম্পানি। সে কোম্পানীর অফিস ছিল ‘৬/১ অক্রূর দত্ত লেন’। কোম্পানীর ব্রান্ড নাম ছিল ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডস’। ১৯৩২ সালে শচীনদেব বর্মণের প্রথম গানের রেকর্ড হয় এই ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি’ থেকে। গানের কথা ছিল ‘শৈলেন রায়’ এবং ‘হেমেন্দ্রকুমার রায়ের’। সেই প্রথম রেকর্ডের একটি গান ছিল, ডাকলে ‘কোকিল রোজ বিহানে’। এর পর এই ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডস’ থেকে তিনি ১৩২টি বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। এই সব গানের গীতিকার ছিলেন ‘কাজি নজরুল ইসলাম’, ‘হেমেন্দ্র কুমার রায়’, ‘শৈলেন রায়’, ‘অজয় ভট্টাচার্য’, ‘জসিমুদ্দিন’, ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র’, ‘রবি গুহ মজুমদার’, ‘সুবোধ পুরকায়স্থ’, ‘মোহিনী চৌধুরী’, ‘গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার’ এবং ‘মীরা দেব বর্মণ’। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা বেসিক গানে তিনি এই সময়ে হয়ে উঠেছিলেন এক নম্বর শিল্পী। বেসিক গানের সুরকার হিসেবেও তিনি অসাধারণ কাজ করেন রাগ সঙ্গীতের সঙ্গে লোক গানের মিশ্রণ ঘটিয়ে। তা হলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদরা তাঁর গানে মুগ্ধ ছিলেন।
১৯৩৪ সালে ‘অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে’ তিনি গান গেয়ে ‘ওস্তাদ করিম খাঁ’র আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে ‘বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে’ ঠুমরি পেশ করে ‘আফতাব এ মৌসকী ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ’কে মুগ্ধ করেছিলেন। অন্যদিকে ‘শেখ ভানু’র রচনা ‘নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন মরমী কবি ‘জসীমউদ্দীন’কে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ সালে। লোক সঙ্গীতের সঙ্গে কাব্যসঙ্গীতের এই সমন্বয় এটা শুধুই গান বানানো নয়, এটি একটি অপূর্ব আইডিয়া। সেটিকে সারা জীবন আঁকড়ে থেকেছেন। এর মধ্যে তিনি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর শিক্ষা, শ্রুতি, বৈদগ্ধ্য এবং সৃজনশীলতা। এই সময়ে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রেও সুর দিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু এই সময়ে চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’, ‘রাইচাঁদ বড়াল’রা। শচীনদেব বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রের সুর দিয়েও ঠিক সুবিধে করতে পারলেন না। কেন পারলেন না সেটা বিধাতা পুরুষের কলকাঠি ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে। কারণ এই সময় বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি সুরকার হিসেবে সফল হলে হয়তো তাঁর আর বোম্বাই যাওয়া হয়ে উঠত না। বোম্বাই থেকে আগেও ডাক পেয়েছেন। কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখাননি। এবার ডাক এলো ‘ফিল্মিস্থানের মালিক শশধর মুখার্জী’র কাছ থেকে। তাও দোনামনা করছিলেন। কিন্তু বন্ধু ‘সুশীল মুখার্জী’র জেদাজেদিতে হয়তো কিছুটা অভিমান বুকে নিয়েই ১৯৪৪ সালে তিনি পাড়ি দিলেন বোম্বাই। কিন্তু প্রথমে বোম্বাই নগরীকে কত্তা বিশেষ পছন্দ করেন নি। তাঁর মনে হয়েছিল যে শহরে গঙ্গা নেই সে শহরে প্রাণের সাড়া নেই। আসলে সব বন্ধু বান্ধব সহ কলকাতা শহরের জন্যে খুব মন কেমন করতো। আর তিনি এটা বুঝতে পারছিলেন বোম্বাই যাওয়া মানে তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রাণের কুমিল্লার সম্পর্ক আরও ক্ষীণ হয়ে আসবে। তার উপরে বোম্বাইয়ের সিনেমার সঙ্গীতের জগৎ তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন – ‘নৌশাদ’, ‘ফিরোজশাহ মিস্ত্রী’, ‘কেশব রাও ভোলে’, ‘ও পি নাইয়ার’, ‘নাদিম শেরওয়ানি’, ‘মদন মোহন’, ‘অনিল বিশ্বাস’। ওখানে কল্কে পাওয়াই খুব কঠিন ব্যাপার।
প্রথম সুযোগ এল ফিল্মিস্থানের ছবি ‘শিকারি’ এ সুর করার। এ ছবির গান প্রশংসা পেল। কিন্তু গুণীজনের প্রশংসার চেয়ে জনসাধারণের এ গান কেমন লেগেছে তা জানতে শচীন কত্তা খুব উৎসুক। তিনি তার গান কোনও সাধারণ লোককে গুনগুন করে গাইতে শুনতে পেলেন না বলে মন খুঁত খুঁত করতে থাকলো। এই খুঁতখুঁতানিটা তাঁকে সারা জীবন তাড়া করেছে। চিরকাল তিনি ‘Public pulse’ কে খুব বেশি মূল্য দিতেন। এই সময় আরও একটি ছবি করার ভার পেলেন। সে ছবির নাম ‘দো ভাই’। তাতে তিনি একটি দুঃখের গানের সুর বসিয়ে রিহার্সাল করছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন পাশের ঘর থেকে রুম বয় গুণ গুণ করে সেই গান গাইছে। এই ঘটনাটিকে তিনি স্মৃতি কথায় বলেছিলেন, ‘‘চলচ্চিত্র জীবনের সব চেয়ে বড় অভিজ্ঞতার উন্মোচন হল।’’ কারণ তিনি সেইদিন বুঝলেন সিনেমায় ‘হিট’ গান কে হতে হবে সাধারণ মানুষের গাইবার যোগ্য। এ গান সত্যিই প্রচণ্ড হিট হয়ে গেল। তবে এই গানটি শুনতে শুনতে কিন্তু আমাদের আর একটি গানের আদল মনে পড়ে যেতে পারে। সেটি হল ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’। বলা যেতে পারে হিন্দি ছবিতে শচীন কত্তার প্রথম সাফল্য এলো রবি ঠাকুরের হাত ধরে। ‘Public pulse’ নিয়ে আর একটি অভিজ্ঞতার কথা তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। একদিন কারদার স্টুডিওতে গিয়ে বিকেলবেলায় তিনি তাঁর গাড়িতে নেমেছেন। গিয়ে দেখেন সেখানে অনেক লোক ভিড় করে আছে তখনকার দিনের ‘তারকা’দের দেখার জন্যে। তাঁর গাড়ি আসতেই তারা ভেবেছিল নিশ্চই কোনও বড় তারকা এসেছে। একটি লোক কৌতূহল বসে তাঁর গাড়ির সামনে এসে তাঁকে দেখে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন কিছু লোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করে গাড়িতে কে এসেছে। লোকটি উত্তর দেয় ‘আরে ইয়ার ওহ তো এক বাঙ্গালী আদমি হ্যায়’। শুনে কদিন খুব বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘুরে ছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েকদিন পরে বান্দ্রা স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন মালাডের ট্রেন ধরবেন বলে। সেখানে তিনি দেখলেন কয়েকজন দিনমজুর একসঙ্গে বসে তাঁদের কোদাল বেলচায় সঙ্গত করতে করতে যে গানটি গাইছে সেটি তাঁর সুর করা ‘শবনম’ ছবির একটি গান। ব্যাস তাঁর সব মন খারাপ ধুয়ে মুছে গেল। কারণ তিনি তো আসলে এটাই চান,এই রকম সাধারণ মানুষের ভালো লাগা গান বানাতে।
এই সময় সন্ধ্যা বেলায় একটা আড্ডা বসতো শচীন কত্তার বাড়িতে। সেখানে হাজির হতেন ‘গুরু দত্ত’, ‘চেতন আনন্দ’, ‘বিজয় আনন্দ’ এবং ‘দেব আনন্দর’ মত ব্যক্তিত্বরা। এঁরা প্রত্যেকেই, বিশেষ করে দেব আনন্দ এবং গুরু দত্ত শচীন কত্তার গানের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। আড্ডায় আলোচনা হত একটি সিনেমা প্রযোজনার কোম্পানি খোলার বিষয়ে। সে কোম্পানি সত্যি খোলা হল একদিন। নাম দেওয়া হল ‘নবকেতন’। প্রথম ছবি তৈরি হল ‘অফসর’। ‘চেতন আনন্দ’ পরিচালক, ‘দেব আনন্দ’ আর ‘সুরাইয়া’ যথাক্রমে নায়ক ও নায়িকা। ছবি খুব একটা না চললেও একটি গান প্রচণ্ড জনপ্রিয় হল। সেটি ছিল ‘সুরাইয়ার গলায়’। সেটি হল, ‘মন মোর হুয়া মতয়ালা’। নবকেতনে কাজ করে শচীনদেবের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়ে গেল। কারণ তিনি ঠিক যে রকম একটি মুক্ত আবহাওয়া চাইছিলেন কাজ করার জন্য, সেটা সেখানে পেয়ে গেলেন। এর পরে ছবি ‘বাজী’। পরিচালক ‘গুরু দত্ত’। গুরু দত্তের সঙ্গে কত্তার বড় মনের মিল ছিল। দু’জনে মিলে এই ছবির গান নিয়ে নানা রকমের আলোচনা হতে থাকলো। কত্তা ঠিক যে ধরণের গান চাইছিলেন তার জন্যে গানের কথায় একটা বিশেষ ধরন আনতে চাইছিলেন। তার জন্যে এই ছবিতে এক নতুন গীতিকারকে নিয়ে আসা হল প্রধানত শচীনদেবেরই উৎসাহে। তাঁর নাম ‘শাহির লুধায়ানভী’। এর পরে এই দুজনের জুটি বহুদিন পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করেছেন। বাজীর প্রায় সব গানই হিট করে গেল। বিশেষ করে ‘তদবীর সে বিগড়ি হুই তগদির বনালে’ গানটি গেয়ে ‘গীতা দত্ত’ যিনি এর আগে শুধু কোরাসে কণ্ঠ দিতেন, তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। আর একটা একটা কাণ্ড হল। সেটা হল ‘দেব আনন্দ’, ‘এস ডি বর্মণ’ আর ‘কিশোর কুমার’ এই ত্রয়ীর মিলিত যাত্রা, যা হিন্দি ফিল্মের ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় দাবি করে, তার শুরু হল এই সিনেমার গান দিয়ে, ‘মেরে লব্জোমে দেখো’। সেই সময়ে ‘রফি সাহেবের’ রমরমা। অন্যান্য সঙ্গীত পরিচালকেরা লিড সিঙ্গার পুরুষ কণ্ঠ হিসেবে ‘রফি সাহেব’ ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারতেন না। সে সময় প্রায় জোর করেই ‘কিশোর কুমার’কে গানের জগতে নিয়ে আসেন শচীন কত্তা। এর পরে সে ১৯৫১ এই ‘গুরু দত্ত’ আর একটি ছবির পরিচালনা করলেন অন্য ব্যানারে। সেটির নাম ‘জাল’। সেখানে ‘দেব আনন্দ’ নায়ক। সে সময় ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’ বোম্বেতে এসেছেন। কিন্তু তেমন সুবিধে করতে পারছেন না। ভাবছিলেন ফিরেই যাবেন কলকাতায়। এ সময়ে দেব আনন্দের লিপে শচীন কত্তা একটি গান হেমন্তকে দিয়ে গাওয়ানোর কথা ভাবলেন। হেমন্তের গায়কীতে তখন বাংলাগানের বিশেষ এক স্টাইলের প্রভাব খুব স্পষ্ট। হিন্দি উচ্চারণে কিছু সমস্যা ছিল। তবু প্রচুর খাটাখাটনি করে হেমন্ত কণ্ঠকে দেব আনন্দের লিপ দেবার উপযোগী করে তুললেন। এবারও প্রায় জোর করেই গান গাওয়ালেন ‘হেমন্তকুমার’কে দিয়ে। আর সে গানে ভারতবর্ষ মাতোয়ারা হল এবং ‘হেমন্তকুমার’কে বোম্বাইয়ের সিনেমা সাদরে গ্রহণ করে জগৎ স্থায়ী আসন করে দিল। ‘মান্না দে’ বম্বেতে গিয়েছিলেন কাকা ‘কৃষ্ণচন্দ্র দে’র হাত ধরে। পরে তিনি শচীন কত্তার সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করেন। ১৯৫০ সালে ‘নীতিন বসু’র পরিচালনায় ‘মশাল’ নামে একটি ছবি হয়। ছবিটিতে মান্না দে একটি গান গাওয়ান শচীন কত্তা। সে গান আজও ফিল্ম সঙ্গীতের জগতে একটি মাইলস্টোন হয়ে রয়ে গেছে।
যদিও ‘লতা মঙ্গেশকর’ তখন ‘অনিল বিশ্বাস’, ‘নৌশাদ’, ‘খেমচান্দ প্রকাশ’, ‘গোলাম হাইদার’, ‘সি রামচন্দ্র’দের সঙ্গীত পরিচালনায় অনেক গান গাইছিলেন, তবু শচীন কত্তার প্রথম দিকের ছবি গুলিতে মহিলা কণ্ঠের গানগুলি সে সময় গাইয়েছিলেন ‘গীতা দত্ত’, ‘সুরাইয়া’, ‘আমিরবাই’ – এঁদের দিয়ে। লতাজীকে প্রথম গান গাওয়ান ‘মশাল’ ছবিতে। সে গান উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়নি। কিন্তু পরে ১৯৫১ সালে প্রথম সাফল্য আসে ‘নৌজোয়ান’ ছবিতে এই গানটি গেয়ে। লতার এই গানটি এবং এর আগে রেকর্ড করা গানগুলি শুনলে বোঝা যায়, লতা এই গানে ‘নুরজাহান-সুরাইয়ার গায়কী’ থেকে বেরিয়ে এসে একটা নতুন কণ্ঠ পাবার দিকে অনেকটা এগিয়ে গেলেন। তার পরে শচীন কত্তার অনবদ্য কম্পোজিশনে আর লতাজির অনন্য কণ্ঠ মিলে অসংখ্য মৃত্যুহীন গান সৃষ্টি হয়েছে তা সকলের জানা।
শচীন কত্তা, ‘মহঃ রফি’ এবং ‘কিশোর কুমার’ দুই প্রধান পুরুষ কণ্ঠকেই এমন সুন্দর ভাবে ব্যাবহার করেছেন যে এটা বোঝা খুব মুশকিল যে তাঁর এঁদের দু’জনের একজনের প্রতি কোনও পক্ষপাত ছিল কিনা। আসলে তিনি গান তৈরি করার সময়েই ঠিক করে নিতেন তিনি ঠিক কার কণ্ঠকে ব্যবহার করবেন সে গানটির জন্যে। ব্যক্তিগত ভাবে কিশোর কুমারের প্রতি তাঁর স্নেহ একটু বেশি ছিল। কিন্তু তবু যেখানে মনে করেছেন এ গান ‘রফি’জীর গলা বেশি খুলবে সেখানে কোনও আপস করেন নি। যেমন ১৯৫৮ সালে নির্মিত ‘কালাপানি’ ছবিতে যদিও নায়ক ‘দেব আনন্দ’ এবং দেব আনন্দের স্ক্রিন ভয়েসের সঙ্গে কিশোরের সঙ্গীত কণ্ঠ সুন্দর ভাবে মানিয়ে যায় তবু এই গানটি তিনি গাওয়ালেন ‘মহঃ রফি’কে দিয়ে। আবার ১৯৫৩ সালে দেব আনন্দের ছবি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-এ দেবজীর লিপে একটি গানে ব্যাবহার করলেন ‘তালাত মেহমুদ’কে দিয়ে, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সে গানের সুরে যে ‘হালকা মুড়কি’ আছে তা তালাত মাহমুদের গলায় ভালো খুলবে। বাঙালি শ্রোতা অবশ্য এই গানের চলনে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছায়া আবিষ্কার করে নিতে পারবেন। সংখ্যা দিয়ে মাপলে তখনকার প্রধান গায়কদের মধ্যে ‘মুকেশ’কে দিয়ে শচীনদেব বর্মণ কম গান গাইয়েছিলেন। যাও গাইয়েছেন বেশির ভাগ ডুয়েট গান। কিন্তু যে গানটি মুকেশের সঙ্গীত জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান সে গানটি এসেছিল শচীন কত্তার কাছ থেকে। ‘বোম্বাই কা বাবু’ ছবিতে। ‘আশা ভোঁশলে’র গানের কথা উঠলে সাধারণতঃ ‘ও পি নাইয়ার’ এবং ‘আর ডি বর্মনের’ কথা ওঠে। কিন্তু আশাজীর কণ্ঠের যাদুকে প্রথম যে ভাবে ব্যাবহার করেন শচীন কত্তা সে ভাবে তাঁর আগে কেও করেন নি, ‘সুজাতা’ ছবিতে।
পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে যে কয়েকটি অবিস্মরণীয় কণ্ঠ হিন্দি সিনেমার গানের জগত কে মাতিয়ে রেখে ছিল সে সব কণ্ঠের সত্যিকারের ম্যাজিকের জায়গা গুলিকে শচীন কত্তা যেমন ভাবে প্রথম আবিষ্কার করে ছিলেন তা বোধহয় আর কোনও সুরকার করতে পারেন নি। শচীনকত্তা বিশ্বাস করতেন সঙ্গীতের মূল ঐশী শক্তি লুকান থাকে গায়ক বা গায়িকার ভোকাল কর্ডের অন্তঃস্থলে। তাকে নিংড়ে নিয়ে এসে কি ভাবে মেলডি সৃষ্টি করতে হয় তিনি জানতেন। গানে যন্ত্র সঙ্গীতের ব্যাবহারের ব্যাপারে তাঁর স্বভাব-কৃপণতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে গান্ধীজীর কৃচ্ছসাধিত জীবনযাপনের সঙ্গে। ষাটের দশকে যখন ‘সলিল চৌধুরী’, ‘শঙ্কর জয়কিশনের’ মত সঙ্গীতকাররা শতাধিক হ্যান্ডস নিয়ে গান রেকর্ড করা শুরু করেছেন, বড়কত্তা তখনো তাঁর ‘ten-piece orchestra theory’-তে অগাধ বিশ্বাস রেখে চলেছেন। শুধু আড়বাঁশির অনুচ্চ ইন্টারলিউড দিয়ে কি যাদু টাই তিনি সৃষ্টি করতে পারতেন। সেই ’প্যায়াসা’ ছবির ‘জানে কেয়া তুনে কহি’ গানটির অন্তরার দুটি কলির মাঝে একটি অস্ফুট বংশী ধ্বনি আজও আমাদের হৃদয় মুচড়ে দেয়। কিম্বা ‘অভিমান’ ছবির ‘পিয়া বিনা, বাঁশিয়া বাজে না’ গানে অসাধারণ বাঁশির ব্যাবহার গানটি কে একেবারে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
কুমার শচীন্দ্র দেববর্মণ তেমনি ছিলেন বাংলার লোক গানে ‘obsessed’ একজন সঙ্গীত সাধক। ধ্রুপদ সঙ্গীত সহ এ দেশের সব ধরনের এবং কিছুটা পশ্চিমেরও সঙ্গীত কে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের মত। নাড়া বেঁধে সঙ্গীত শিখেছিলেন ‘ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়’, ‘কৃষ্ণ চন্দ্র দে’, ‘বাদল খাঁ’, ‘আলাউদ্দিন খাঁ’র মত মার্গ সঙ্গীতের মহীরুহদের কাছে। কিন্তু অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন যা কি কিছু তাঁর মন কেড়েছিল তাকেই, তিনি নিজে গান গেয়েছেন সম্পূর্ণ নিজের মেজাজে। সে মেজাজের মধ্যে সুর সৃষ্টি করেছেন খোলা মন নিয়ে, একেবারে নিজের স্টাইলে। সে স্টাইলে ছিল সাংগীতিক মেধার সঙ্গে হৃদয়ের কমনীয়তার এক অসাধারণ মিশ্রণ। তিনি রূপকার ছিলেন লোক সঙ্গীতের সঙ্গে কাব্য সঙ্গীতের অসবর্ণ অথচ সার্থক বিবাহের। কিন্তু সুর রচনার সময়, বিশেষ করে সিনেমার সুর রচনার সময়, সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সাধারণ মানুষের কানের কাছে সে সুরের গ্রহণযোগ্যতাকে। প্রবীণ বয়সে এসে, যখন তাঁর আশিটি হিন্দি ছবিতে সুর দেওয়া হয়ে গেছে, এবং তার মধ্যে অসংখ্য হিট গান হয়েছে, তখন তাঁর একটি ‘স্বীকারোক্তি’ আমাদের বিস্মিত করে, ‘‘সব রকমের সুর আমি রচনা করেছি; কিন্তু লোকসঙ্গীতে আমার আত্মা যেন প্রাণ পায়। আমি যে মাটির মানুষের সঙ্গে, প্রকাশিত হয়েছি, তাই তাদের সহজ-সরল গ্রাম্য সুর আমার গলায় সহজে ফোটে। সে সুরই আমার কল্পনার রাজ্য, আপনা থেকেই জাগে, গলায় আপনা থেকেই তা বেজে ওঠে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গলায় এসে যায়। এর জন্য কোনও রেওয়াজের প্রয়োজন হয় না- এ সুর নিজের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে।’’
শচীন দেব বোম্বাই চলে যাওয়ায় বাংলা গানের যে অনেকটা ক্ষতি হয়েছিল এ কথা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। বাংলা বেসিক গানের জগতে তাঁর নিজের গাওয়া কয়েকটি গান ছাড়া সুরকার শচীনদেবকে আমরা পাইনি। ‘সলিল চৌধুরী’ যে ভাবে হিন্দি ফিল্মের জগত এবং বাংলা বেসিক গানের জগতটাকে একসঙ্গে সামলেছিলেন শচীনকত্তা তা করেননি। হয়ত হিন্দি ফিল্মের জগতে তাঁর অতিব্যস্ততা তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে আটকে রেখেছিল তাই বাংলা গানে মন দিতে পারেননি। হয়তো সেই দুঃখটাকে আড়াল করতে চেয়েছেন সেই গানে,
‘‘বাংলা জনম দিলা আমারে
তোমার পরাণ আমার পরাণ এক নাড়ীতে বাঁধারে
মা পুতের বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল।’’
১৯৭৫ সালের মে মাস। কুমারবাহাদুর শচীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ তখন ষাট বছর বয়সে পৌঁছেছেন। সুর করছেন ‘হৃষীকেশ মুখার্জী’র ছবি ‘মিলি’র। এর মাঝে সুর করেছেন শতাধিক ছবির। হিট গানের সংখ্যা অসংখ্য। ‘দেব আনন্দ-গুরুদত্ত’ থেকে ‘রাজেশ খান্না-অমিতাভ বচ্চন’, ‘সুরাইয়া-মধুবালা’ থেকে ‘শর্মিলা-জয়া’ দুই প্রজন্মের নায়ক নায়িকারা তাঁর সুরে গানের লিপ দিয়ে হয়ে গেছেন সুপারস্টার। কাশ্মীর থেকে কেরালা, গুজরাট থেকে নাগাল্যান্ডের আমআদমিরা, তাঁর মনোবাঞ্ছা অনুযায়ী, তাঁর সুর করা গান গুন গুন করে গেয়েছেন প্রায় তিন শতক ধরে। তবু সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্যে ষাট বছর কোনও বয়সই নয়। ‘রবীন্দ্রনাথ’ ষাট বছরের পরে কি অসামান্য সব সুর রচনা করেছেন। ‘বাবা আলাউদ্দিন’, ‘ভীমসেন যোশী’ এই বয়সে চুটিয়ে কাজ করেছেন। শচীন কত্তা অনেক গুলো পাহাড়ের চুড়া ছুঁয়েছেন বটে, তবুও আরও অনেক পাহাড় জয় করা বাকি তখনো। শেষ দিকে তাঁর সঙ্গীতে অর্কেস্ট্রেশনের ধরন পালটাচ্ছিল। পশ্চিমি বাজনা ব্যাবহারের ক্ষেত্রে তাঁর চিরাচরিত ‘minimalist স্টাইল’ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। অনেকে বলে থাকেন ‘রাহুল দেব বর্মনের মিউজিক্যাল এরেঞ্জমেন্ট’কে তিনি আরও বেশি করে গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু এই রকম একটা সময়ে, যখন এক নতুন ‘বর্মণদাদা’কে ইন্ডাস্ট্রি পেতে চলেছে সেই সময় একদিন মিলির রেকর্ডিং চলার সময়ে তাঁর প্যারালেটিক স্ট্রোক হয়ে গেল। গভীর কোমায় চলে যান তিনি। কিশোর কুমারের জন্যে ‘বড়ি শুনি শুনি হ্যায়’ গানের রিহার্সাল হয়ে গেছে। রেকর্ডিং হবে পরের দিন। পরের দিন রেকর্ডিং হল বটে রাহুলের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু বড় কত্তা তখন জীবন মৃত্যুর মাঝখানে অন্য এক ‘শুনি শুনি’ জগতে চলে গেছেন। এই অবস্থায় কোমায় প্রায় পাঁচ মাস বেঁচে ছিলেন। এই সময় পুত্র রাহুল আর স্ত্রী ‘মীরা’ তাঁর কাছে বসে জোরে জোরে বলতেন কুমিল্লার কথা, পরিবার বন্ধু বান্ধবদের কথা। যদি কিছু সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই তাঁর সাড়া পাওয়া যেত না। রাহুলদেব বলেছিলেন শুধু একবার সেদিনের একটি খবর তাঁর কানের কাছে যখন খুব জোরে বলেছিলেন রাহুল তখন নাকি তিনি একবার চোখ মেলেছিলেন। খবরটা ছিল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে হারিয়ে দিয়েছে। সঙ্গীতের পর তাঁর দ্বিতীয় প্যাশন ছিল ফুটবল। তাই হয়ত তাঁর প্রিয় ইস্টবেঙ্গল দলের জয়ের কথা শুনে মুহূর্তের জন্যে জীবনের ছোঁয়া পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩১শে অক্টোবরে এই বিরাট সঙ্গীতপ্রতিভার সৃষ্টিশীলতার জীবন শেষ হয়ে যায়। আগামী পৃথিবীর জন্যে তিনি রেখে যান এক সঙ্গীতশাস্ত্রের সোনার খনি যা ভাঙ্গিয়ে নতুন সৃষ্টির রসদ পাবে বেশ কয়েক প্রজন্ম, আর তাঁর সুযোগ্য পুত্রকে। যিনি উত্তরিধাকারী হলেন এমন এক সঙ্গীতের ধারাবাহিকতার যা ‘মেলডি-হারমনি-রিদম’ এর তিন সাংগীতিক ব্রহ্মাস্ত্র সম্বল করে এ দেশের লক্ষ লক্ষ আমআদমীর হৃদয়কে স্পর্শ করার কাজটি করে যাবে নতুন ভাবে। সব সৃষ্টিশীল মানুষই বোধহয় মৃত্যুর ছায়া অনুভব করতে শুরু করলে সব সৃষ্টি ছাপিয়ে গিয়ে একধরণের নির্লিপ্তির মধ্যে চলে যান। আর কোনও পাহাড়ের চুড়া নয় মাটির ধুলার কাছে থেকে যেতে চান। তিন মহান সাংগীতিক মেধা সম্পন্ন বাঙ্গালির লেখা থেকে এমনই অনুভূতির মিল পাওয়া যায়।
‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ’ লিখেছিলেন,
‘‘যখন রব না আমি মর্ত্যকায়ায়
তখন স্মরিতে যদি হয় মন
তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়
যেথা এই চৈত্রের শালবন।’’
‘সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন,
‘‘ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে রয়ে যাব এই কামনা, আর কিছু না
আগামীর পায়ে পায়ে আমিও পৌঁছে যাব সেই ঠিকানা, আর কিছু না।’
‘শচীন কত্তা’ তাঁর ‘স্মৃতিকথায়’ লিখে গেছেন,
‘‘জীবনের সায়াহ্নে আমার শুধু কামনা – আমি আর কিছু চাই না। শুধু চাই, সরগমের নিখাদ হয়ে তলানিতে পড়ে থাকতে।’’
(তথ্যসূত্র:
১- S. D. Burman: The Prince-Musician, Anirudha Bhattacharjee and Balaji Vittal, Tranquebar (২০১৮)।
২- Incomparable Sachin Dev Burman, R K Chowdhury, Toitambur (২০১৭)।
৩- সুরের কুমার: শচীন দেব বর্মন, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, অনন্যা (২০১৭)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত