১৯৩৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর, নিজের ‘ব্যক্তিগত সচিব এমিলি শেঙ্কল’কে একটি চিঠিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন – ‘‘সভাপতি আরও একবার নির্বাচিত হতে পারব কি না সে নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে বুঝলে। কারণ আমাকে হিংসে করে এমন লোকের তো অভাব নেই!’’
‘ঈর্ষা’, ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে’ – ‘‘বৃহতের ধর্ম, যা বনস্পতি মাঝে রাখে ব্যবধান’’। কিন্তু এ-ও কি সত্য যে, ‘ঈর্ষাজর্জরতার শিকার’ হতে পারেন, এমনকী তার জেরে হারতে অবধি পারেন ‘কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার লড়াইয়ে’ – এমন ‘দ্বিধা’ ও ‘দ্বন্দ্ব’, বাংলার দামাল ছেলে সুভাষ বসুকেও ছাড়েনি? তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে, হয়তো বা বিষণ্ণ করেছে।
২০১৪ সালে ‘রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের’ ‘নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস’ (পেঙ্গুইন বুক্স) বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। তার ষষ্ঠ অধ্যায়ে এক রুদ্ধশ্বাস আখ্যান বয়ান করেছেন লেখক, যে অধ্যায়ের নাম ‘দ্য এন্ড অফ ফ্রেন্ডশিপ’। ‘ফের নির্বাচিত না হতে পারার দোলাচল’ – মাখা আশঙ্কার কথা সেখানেই উন্মোচিত করেছিলেন লেখক।
১৯৩৬ সালে যখন ‘জওহরলাল নেহরু’কে অনুরোধ করা হয়েছিল দ্বিতীয় দফার জন্য কংগ্রেসের সভাপতিত্ব নির্বাহ করার জন্য, তিনি ‘গান্ধী’জিকে সাফ বলে দিয়েছিলেন – এই একটা বছরও যথেষ্ট নয় দল হিসাবে কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত ও নতুন ছন্দে আনার জন্য। সুভাষচন্দ্র বসুর উপলব্ধিও কতকটা তা-ই ছিল। সেজন্যই তিনি ‘দ্বিতীয়বার সভাপতির পদে’ ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারবেন কি? সেই সংশয় ও সন্দেহ জয় করতে পারেননি। এমন পরিপ্রেক্ষিত থেকেই ‘এমিলি’-কে লেখা হয়েছিল ওই চিঠি।
রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় অবশ্য অন্য একটা কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, ‘ঈর্ষা’ যদিও বা একটা ‘কারণ’ হয়, কিন্তু সেটাই ‘একমাত্র ও চূড়ান্ত কারণ’ নয়। যদিও কংগ্রেসের ভিতরের ‘একজনের সঙ্গে’ সুভাষের সম্পর্ক ‘প্রশ্নাতীত’ ছিল না। কে সেই ব্যক্তি? শুনলে অবাক লাগে, যাঁকে ‘লৌহমানব’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতে ভারতে যাঁর সর্বোচ্চ মূর্তি বসেছে – ‘সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল’। এই দু’জনের সম্পর্কে যে জন্য ‘আড়ষ্টতা’ ছিল, ‘হিমশীতল সম্পর্ক’ ছিল তার ‘প্রাথমিক কারণ’, শুনলে আরও অবাক লাগবে – একটি ‘উইল’। যে উইলটি ছিল বল্লভভাই প্যাটেলের ভাই বিঠ্ঠলভাই প্যাটেলের।
১৯৩৩ সালের ২২শে অক্টোবর মারা যান ব্রিটিশ ভারতের এক প্রধান রাজনৈতিক নেতা বিঠলভাই প্যাটেল। বিঠলভাই ছিলেন মতিলাল নেহরু এবং চিত্তরঞ্জন দাশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ পার্টির এক প্রধান নেতা। তিনি আবার সুভাষচন্দ্র বসুর গুণমুগ্ধ ছিলেন, এবং ওই ১৯৩৩ সালের গোড়ার দিকেই বিঠলভাই ও সুভাষচন্দ্র একযোগে একটি ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন, যার নাম ছিল ‘প্যাটেল-বোস’ ম্যানিফেস্টো। অসুস্থ অবস্থায় প্রাণপণে তাঁর সেবা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। মৃত্যুর আগে বিঠলভাই একটি উইল করে যান, তাতে বিঠলভাই তাঁর সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি লিখে দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। কী কারণে লিখে দিয়েছিলেন তিনি? চুম্বকে, ভারতের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের প্রকল্পে। ‘ফর দ্য পলিটিক্যাল আপলিফট অফ ইন্ডিয়া’। কিন্তু সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সেই উইলের যাথার্থ্য স্বীকার করে নেননি। উইলটি ‘জেনুইন’ কি না, তা নিয়েও তাঁর মনে খচখচানি ছিল। হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষ মেনে নেন বল্লভভাই প্যাটেলের প্রস্তাব, যে, ওই সম্পত্তির দায়িত্ব কংগ্রেসের কোনও বিশেষ কমিটি নিক। অথচ, এরপরেও প্রত্যাশিত সুষ্ঠু সমাধান এল না। কেন? কমিটির তরফে যে – যে শর্ত বা অনুশাসন রাখা হয়েছিল, তা দু’জনের কেউই মেনে নিতে পারেননি। এই বিবাদ ও মতানৈক্য অতঃপর আদালতে গিয়ে পৌঁছয়। এবং মহামান্য বম্বে হাই কোর্টের রায় সুভাষের বিরুদ্ধে যায়। দেশে ও বিদেশে কোনদিন যাঁর সততার দিকে একটাও আঙ্গুল কোনদিনই ওঠেনি – তাঁর দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তুলেছিলেন সর্দার প্যাটেল! সন্দেহই বা বলে চলে কি ভাবে, সেটা তো রীতিমতো অভিযোগ ছিল – তাঁর দাদার সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার অভিযোগ! না হলে কি আর বিঠলভাইয়ের করে যাওয়া ‘উইলের জেনুইনিটি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতেন সর্দার প্যাটেল? অপমানিত সুভাষচন্দ্র আদালতমুখো হননি। ফলে আদালতের রায় একতরফা হয়েছিল। ব্যক্তিগত কাদা-ছোড়াছুঁড়িতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাছাড়া বল্লভভাই প্যাটেল যেটা করেছিলেন সেটা নেতাজিকে অপমান করা ছাড়া আর কিছুই নয়। নেতাজি বিঠলভাইয়ের সম্পত্তির একটা পয়সাও হাতে পাননি তাঁর শেষ ইচ্ছাকে রূপ দেবার জন্য।
ব্যক্তিগত সম্পর্কে মসৃণতার অভাবটি হয়তো এই উইল ও সম্পত্তিগত কারণে রচিত হতে পারে, কিন্তু সেই কারণেই সুভাষের দ্বিতীয়বারের সভাপতি নির্বাচনের পথে বল্লভভাই প্যাটেল ‘প্রতিবন্ধকতা’ তৈরি করেছিলেন কি না, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। তবে হ্যাঁ, পছন্দ ও অপছন্দের যে সার্বিক শ্রেণিকরণ একজন মানুষকে অন্য ব্যক্তি সম্বন্ধে ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’ মন্তব্য রাখতে উৎসাহিত বা প্ররোচিত করে, সেই শ্রেণিকরণের নিরিখে ভাবলে বলতেই হয় – সুভাষচন্দ্র তিনের দশকের শেষ দিকে প্যাটেলের আনুকূল্য আদৌ পাননি। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ‘রাজেন্দ্র প্রসাদ’কে (তখন তিনি বেশ অসুস্থ) লেখা চিঠিতে প্যাটেল বলেছিলেন –
‘‘জওহর বিদেশে। অন্তত চারমাস তাঁকে পাওয়া যাবে না। আপনাকেও তো মাস ছয়েকের জন্য পাব না। এই অবস্থায় আমাদের এমন একজন সভাপতির সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে, যিনি নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে অবহিত নন।’’
‘অবহিত’ শব্দটিকে ‘যত্নবান’ লিখে রিপ্লেস করলেও মূল ভাবে তেমন অদলবদল আসবে না। ‘রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়’ লিখেছেন, সুভাষচন্দ্র নানা ধরনের সফরের মধ্যে থাকতেন। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আসার সুযোগ অল্পই ঘটত। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর অদম্য ও অফুরন্ত প্রাণশক্তির উল্লেখ যথেষ্টই করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও অনুল্লেখিত রাখেনি যে, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের ‘নিঃশব্দ সভাপতিদের একজন’। প্রথমবারের সভাপতিত্বের মেয়াদে ক’টা ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন, তা-ও নাকি হাতে গুনে বলা যায়!
এ বার ইতিহাসের আর একটি অধ্যায়ের প্রতি দৃষ্টি ফেরানো যাক।
প্যাটেল-বসু বিরোধ তুঙ্গে ওঠে ১৯৩৮-৩৯ সালের কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে। এই দ্বন্দ সঠিক ভাবে বুঝতে আরো কিছু আনুসাঙ্গিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
প্যাটেল কংগ্রেসের সভাপতি হন ‘করাচি অধিবেশনে’ (১৯৩৩)। ১৯৩৮ সালে নেতাজি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন হরিপুরা অধিবেশনে (১৯-২২শে ফেব্রুয়ারি)। এই অধিবেশনে নেতাজি সভাপতি হলেন বটে, কিন্তু সংগঠনের দ্বায়িত্ব ছিল সম্পূর্ন প্যাটেলের হাতে। এজেন্ডা, ভেনু-সব কিছুর দায়িত্বেই ছিলেন প্যাটেল।
আসলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ, কংগ্রেসে দুটি সমান্তরাল দল ছিল। একদিকে ছিলেন ‘গান্ধী’, ‘প্যাটেল’, ‘রাজেন্দ্রপ্রসাদ’, ‘কৃপালিনী’। অন্যদিকে তরুন বিগ্রেড ‘নেহেরু’ এবং ‘নেতাজি’। মুশকিল হচ্ছে এই তরুণ বিগ্রেডের জনপ্রিয়তা ছিল, কিন্ত তাঁদের হাতে সাংগঠনিক ক্ষমতার রাশ ছিল না। সেটি ছিল সর্দার প্যাটেলের হাতে। কারন কংগ্রেস চলত দেশীয় পুঁজিপতিদের (যেমন ‘জেডি বিড়লা’) টাকায়, এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তোলার ব্যপারে প্যাটেলেই ছিলেন শেষ কথা। ফলে কংগ্রেসের সংগঠনে, কে নেতা হবেন, কে কে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়াবেন সব কিছুই ঠিক করতেন সর্দার প্যাটেল।
প্যাটেলই নেপথ্য থেকে কংগ্রেসকে চালাতেন। ‘এ আই সিসি’র বৈঠকে যা ‘সর্বজন গ্রাহ্য সিদ্ধান্ত’ হত, ‘কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট’ যাঁকে বলা হত ‘রাষ্ট্রপতি’, সেই মতেই চলতেন। কিন্ত সুভাষচন্দ্র চললেন না। গান্ধী এবং প্যাটেলকে অগ্রাহ্য করে নিজের মতে চললেন। প্যাটেল প্রথমে সুভাষচন্দ্র কে দু’বার সাবধান করলেন। শেষে, নেতাজির দাদা ‘শরৎচন্দ্র বসু’কে লিখলেন সুভাষচন্দ্র কে সামলাতে।
কিন্ত সুভাষচন্দ্র কে কিছুতেই বাগে আনতে পারলেন না প্যাটেল। ফলে ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরি কংগ্রেসের জন্য ‘এ আই সিসি কমিটি’ চাইল ‘সীতারামাইয়া’কে। কিন্ত সুভাষচন্দ্র চাইলেন নির্বাচন। তাতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন প্যাটেল। কারন কংগ্রেসে বরাবর ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। কিন্ত সুভাষচন্দ্র বললেন ওটা ঐক্যমত না, গান্ধী-প্যাটেল যাঁকে চাইবেন, সেটা গোটা ভারতের মত হতে পারে না। ফলে নির্বাচন হল। প্যাটেলের বিশ্বাস ছিল সুভাষ হারবেন। কারন দলের সংগঠন ছিল তাঁর হাতে। কিন্ত দেখা গেল সুভাষের জনপ্রিয়তা প্যাটেল যা ভেবেছিলেন, তার থেকে অনেক বেশী।
১৯৩৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন – ‘পট্টভি সীতারামাইয়া’র থেকে ২০৩ ভোট বেশি পেয়ে সুভাষচন্দ্র জয়লাভ করেন। তার আগে অবশ্য সুভাষচন্দ্র যাতে নির্বাচনে না দাঁড়ান, সেই মর্মে সুভাষচন্দ্রের দাদা ‘শরৎচন্দ্র’কে একটি চিঠি লিখেছিলেন এক জন – তিনি হলেন সেই বল্লভভাই পটেল। শুধু তা-ই নয়, সুভাষচন্দ্র নির্বাচিত হওয়ার পর, ১৯৩৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ‘ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ’কে একটি চিঠি লিখে বল্লভভাই জানান যে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কাজ করা অসম্ভব। তার কয়েক দিন পরেই, ১৯৩৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, ওয়ার্ধায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল কংগ্রেস দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক, সেই বৈঠকে অসুস্থতার কারণে যোগ দিতে পারেননি সুভাষচন্দ্র, তিনি অনুরোধ করেছিলেন বৈঠক পিছিয়ে দিতে। তখন সুভাষচন্দ্রকে চাপে ফেলতে ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করেন, আর সেই পদত্যাগীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবার সেই বল্লভভাই।
তবে এই ঘটনাক্রমের একটা অন্য ইতিহাসও আছে। বল্লভভাইয়ের নেতৃত্বে ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করলেও করেননি দু’জন সদস্য— তাঁদের এক জন সুভাষচন্দ্রের দাদা ‘শরৎচন্দ্র’, কিন্তু আর এক জন কে? তিনি হলেন ‘বিঠলভাইয়ের স্বরাজ পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল নেহরুর পুত্র জওহরলাল নেহরু’। বল্লভভাই সরাসরি সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা করতে চাইলেও জওহরলাল করেননি, বরং গান্ধীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে তিনি পদত্যাগ করার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। জওহরলাল পদত্যাগ করেননি বলে বল্লভভাই এবং অন্যরা জওহরলালের ওপর বিস্তর চটে গিয়েছিলেন, এবং তাঁরা দু’টি গাড়ি নিয়েই সভাস্থল থেকে চলে গিয়েছিলেন। ফলে জওহরলালকে সেখান থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে ফিরতে হয়েছিল।
এরপরে ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জার্মানিতে অর্থ কষ্টে ভুগছিলেন নেতাজি পত্নী (?) ‘এমিলি শেঙ্কল’ এবং তাঁর সদ্যজাত কন্যা। সর্দার প্যাটেল নিজে দ্বায়িত্ব নিয়ে নেতাজির পরিবারের (?) জন্য মাসে ১০০০ টাকার মাসোহারা ঠিক করেন, যা ভিয়েনাতে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে দেওয়ার কথা ছিল (উল্লেখ্য, প্যাটেল কোনভাবেই এমিলি-নেতাজির সম্পর্ক যাচাই করেননি, এমিলি নেহেরু ও প্যাটেল – উভয়কেই সাহায্যের আবেদন জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন, নেহেরু পাত্তা দেননি, প্যাটেল দিয়েছিলেন)। কিন্ত ছ’মাস বাদে তিনি খবর পান যে, এমিলি শেঙ্কল সে টাকা পাচ্ছেন না। নেহেরুর কাছে সেই নিয়ে অভিযোগ জানালে, নেহেরু মাসোহারা ২৫০ টাকা করে ছ’মাসের প্রাপ্য ১২৫০ টাকা দূতাবাসকে পাঠাতে বলেন। এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন সর্দার প্যাটেল এবং নেহেরুকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা পুনঃবিবেচনা করতে বলেছিলেন।
তবে প্যাটেল কিন্তু এর পরেও থামেন নি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাঁর ‘নেতাজি বিদ্বেষ’ (নাকি ‘বাঙালি বিদ্বেষ?’) ও ‘আজাদ-হিন্দ বাহিনীর প্রতি বিদ্বে’ষ লেখা আছে। আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের নিয়ে সংঘটিত ‘নীলগঞ্জ হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেন নি। এমনকি স্বাধীনতার পরেও তিনি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে আজাদ-হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের নিয়োগের সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়। তিনি নেতাজিকে নিয়ে তিনি রেডিওতে যে কোন ধরণের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চেয়েছিলেন – সফল হননি, অন্যান্যদের বিরোধিতার জন্য, এমনকি ভারতের কোন সরকারি কার্যালয়ে ও থানায় নেতাজির ছবি রাখা যাবে না বলেও তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। নাঃ, এসব অপকর্মের জন্য – তাঁকে নেহেরুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়নি। কারণ, আমরা এটাই ভুলতে বসেছি যে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন ‘স্বাধীন ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’।
ঐতিহাসিক রসিকতাটি হল – ‘নেতাজি ও আজাদ-হিন্দ বাহিনীর তীব্র বিদ্বেষী’ হওয়া সত্বেও তিনি নাকি ‘লৌহমানব’! তিনি না থাকলে নাকি ভারত আজকের রূপ পেত না! তাই দেশের মধ্যে তাঁর সর্বোচ্চ মূর্তি বসে, আর যে মানুষটি দেশের জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁর নামে গোটা ভারতবর্ষ আজও একত্রিত হয় একই পতাকার তলায়, তিনি রয়ে যান রহস্য আর বিস্মৃতির অন্ধকারে!
বর্তমান ভারতের এক মাননীয় নেতা সুভাষচন্দ্রের মতো টুপি পরে সুভাষচন্দ্রের প্রতি ঘটে যাওয়া নানান অবিচারের প্রসঙ্গ এনেছেন। আবার তিনিই বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল মূর্তি উন্মোচনও করেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এটা বলতে শোনা যায় নি কেমন করে বারংবার বল্লভভাই প্যাটেল সুভাষচন্দ্রের পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন। জওহরলাল শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গ, কৃষ্ণ মেননকে লিখেছিলেন যে সুভাষচন্দ্র ঐক্যের ব্যাপারে খুব উৎসাহী, এবং প্রায় মরিয়া হয়ে গান্ধীকে লিখেছিলেন সমাধানের জন্যে। যদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জওহরলালের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ব্যাপক মতবিরোধ ঘটেছিল, সুভাষচন্দ্রের প্রতি জওহরলালের যে ব্যক্তিগত অপছন্দ ছিল না তা বলাই বাহুল্য। তবু, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সুভাষচন্দ্র বিষয়ে বলতে গিয়ে বল্লভভাই সম্বন্ধে নীরব থেকে বর্তমান ভারতের সেই নেতা পরোক্ষে জওহরলালকেই নিশানা করেছেন, যা বিস্ময়কর।
(তথ্যসূত্র:
১- Nehru and Bose: Parallel Lives, Rudrangshu Mukherjee, Penguin Books Limited (২০১৪)।
২- নেতা থেকে নেতাজি, অমলেশ ত্রিপাঠী, বিপ্লবীদের কথা।
৩- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, পূরবী রায়, এশিয়ান পাবলিকেশন (২০১৮)।
৪- বিতর্কের বিন্যাসে সুভাষচন্দ্র, পিনাকী ভাদুড়ী, পুনশ্চ (২০১০)।
৫- সুভাষচন্দ্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে নভেম্বর ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত