‘সন্ধিপূজা’ দুর্গাপূজারই এক বিশেষ অঙ্গ। সেকালের সব পূজাতেই গাম্ভীর্যের সাথে সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হতে। ‘অষ্টমী তিথির শেষ চব্বিশ মিনিট’ আর ‘নবমী তিথির প্রথম চব্বিশ মিনিট’ মিলে ‘মোট আটচল্লিশ মিনিট সন্ধিপূজার সময়’। ‘অষ্টমী-নবমীর মহাসন্ধিক্ষণে’ এই পূজা আসলে ‘চামুণ্ডারুপিনী দুর্গা’র বিশেষ আরাধনা। দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধে রত, তখন মহিষাসুরের দুই সেনাপতি ‘চণ্ড’ ও ‘মুণ্ড’ অন্যদিক থেকে তাঁদের বিশাল বাহিনী নিয়ে দশভূজাকে আক্রমণ করতে এসে যে দেবীকে তাঁরা দেখেছিল – তাঁর মাথায় ‘করবী-বন্ধন’, কপালের ঊর্ধে ‘অধোমুখী চন্দ্রকলা’, নিচে ‘ঊর্ধ্বমুখ তিলক’, গণ্ডস্থলে ‘মণিময় কুন্তল’, কর্ণদ্বয় ‘উজ্জ্বল কর্ণপুরে অলঙ্কৃত’, অঙ্গে ‘পীতবস্ত্র’, দশভুজে ‘দশ আয়ুধ’। দেবীর রূপে মুগ্ধ হলেও ‘চণ্ড’ ও ‘মুণ্ড’ তখন দেবীকে আক্রমণে উদ্যত, রাগে দেবীর মুখমণ্ডল হয়ে ওঠে ‘কৃষ্ণবর্ণ’। তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে বেরিয়ে আসেন ‘খড়্গ ও পাষানধারিণী’ এক ভয়ঙ্কর দেবী, যাঁর ‘মুখ অতি বিস্তৃত’, ‘জিভ রক্তাক্ত’, ‘চোখ দুটি রক্তবর্ণ ও কোটরাগত’। তিনি প্রচণ্ড হুংকারে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে খড়্গ দিয়ে ‘চণ্ড ও মুণ্ডের’ শিরচ্ছেদ করেছিলেন। যুদ্ধের সেই সময়টি ছিল ‘অষ্টমী তিথির শেষ দণ্ড’ ও ‘নবমীর প্রথম দণ্ড’। এই সন্ধিক্ষণেই ‘চামুণ্ডারুপিনী দুর্গা’ অনন্তকাল ধরে পূজিত হয়ে আসছেন।
অতীতে এই সন্ধিপূজার সময় জানার জন্য বনেদি পরিবারের পূজায় ‘তাঁবি’ বসানো নামে একটি প্রথা চালু ছিল। দণ্ড-নির্ণায়ক ছোট্ট ছিদ্রযুক্ত একটি গোল তমার বাটি জলভর্তি বড় একটা মাটির হাঁড়িতে বসিয়ে দিলে ঠিক ‘একদণ্ডে’ (অর্থাৎ এক প্রহরের সাড়ে সাত ভাগের এক ভাগ বা চব্বিশ মিনিট) বাটিটি জলে ডুবে যেত। এই ভাবে নির্দিষ্ট সময়ে অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণ নির্ণয় করা হত। এখনও কিছু প্রাচীন পারিবারিক পূজায় ‘তাঁবি’-বসানো প্রথা চালু আছে।
সেকালে সুতানুটির যত বাড়িতে দুর্গাপূজা হত, সবাইকে সন্ধিপূজার আয়োজন করে জমিদার বাড়ির পূজার ‘তোপধ্বনি ও বাজনা’ শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হত। সুতানুটির জমিদার শোভাবাজার রাজবাড়ীর সন্ধিপূজা শুরু হলে ‘তোপধ্বনি’ করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হত সন্ধিপূজার সময় হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সব দুর্গামণ্ডপে ‘সন্ধিপূজার বলিদান ও আরতি’ আরম্ভ হয়ে যেত। কোনও কোনও সাবেকি পূজায় সন্ধিপূজার ‘ফুলপড়া’ ছিল অন্যতম আকর্ষণ। সেই শুভ মুহূর্তের জন্যেও অনেকে অপেক্ষা করে থাকতেন। শাস্ত্রীয় বিধান মেনে দণ্ড পল অনুযায়ী ‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর’ পূজা হত ধুমধামের সঙ্গে। রাজবাড়ীর সন্ধিপূজার সূচনা ও সমাপ্তিতে গর্জন করে উঠত ‘পলাশীর কামান’। লর্ড রবার্ট ক্লাইভ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে সেই কামান উপহার দিয়েছিলেন। কামান দাগার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠত ‘একশো আটটি ঢাক ও নহবতে সানাইয়ের মিঠে সুর’। রাজবাড়ীর কামানের আওয়াজ আর ঢাকের বাজনা শোনার জন্যে সেই সময় গ্রাম-বাংলার দূর গ্রামের পূজার উদ্যোক্তারা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতেন। শোনা যায়, এই সন্ধিক্ষণেই ‘শিখরভূম রাজবাড়ীর পূজার’ প্রতিমার পদতলে রাখা রেকাবির সিঁদুরের ওপরে দেবীর পায়ের ছাপ পড়ত এবং ‘ধলভূমগড়ের রাজবাড়ীর পূজায়’ ‘মানুষের চামড়ার তৈরি বিশাল দামামাটি’ আপনা থেকেই বেজে উঠত। সন্ধিপূজার ঠিক সেই ক্ষণটিতে কোন কোন পূজামণ্ডপে পাশাপাশি রাখা ‘জাগ-প্রদীপের শিখা’ নাকি এক হয়ে জ্বলে উঠত। ‘বীরভূমের সুরুলের সরকার বাড়ীর’ প্রাচীন পূজায় আজ বিত্ত বৈভব ও সমারোহ না থাকলেও সেই বাড়ির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সন্ধিপূজার বলিদান ও আরতি দেখতে আজও দূর দুরন্ত থেকে মানুষের আগমন ঘটে। সন্ধিপূজার কথায় বীরভূমের আরেক দুর্গোৎসবের উল্লেখ করতে হয়। ‘লাভপুর থানার শীতল গ্রামে’ এক ‘বাজিকর সম্প্রদায়’ বাস করেন। তাঁরা অতীতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জাদু দেখিয়ে বেড়াতেন। শারদীয়া পূজা বলতে তাঁরা ‘পটের পূজা’ করেন। কিন্তু তাঁদের সন্ধিপূজাটি অভিনব। শীতল গ্রামের সন্ধিপূজা না হওয়া পর্যন্ত সন্নিহিত কোন গ্রামেই সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয় না। অষ্টমীর সন্ধ্যায় বাজিকরদের মায়ের থানে সিঁদুর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর গামছা বা কাপড় দিয়ে সিঁদুর-লিপ্ত জায়গাটিকে ঢেকে দেওয়া হয়। তাঁদের বিশ্বাস যে ওই সিঁদুরের ওপরে মায়ের পায়ের ‘পাঁজ’ বা ছাপ পড়বে। এই ‘পাঁজ’-এর জন্য ভক্তরা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করেন। ‘পাঁজ’ দেখার পর তাঁরা বাংলার অন্যতম পীঠস্থান ‘লাভপুরের ফুল্লরা মন্দিরের ঘাট বাঁধানো পুকুরপাড়ে’ হাজির হন। পুরোহিত ও পুণ্যার্থীদের বিশ্বাস, জলের ভিতর দিয়ে তোপধ্বনির মতন শব্দ হলেই বুঝতে হবে মায়ের নির্দেশ হয়েছে সন্ধিপূজার। আর তখন ঢাক, ঢোল, কাঁসির বাজনায় বনস্থলী কাঁপিয়ে শুরু হয়ে যায় সন্ধিপূজা।
সন্ধিপূজার উপাচার ‘একশো আটটি পদ্মফুল’, ‘গোটা ফল’, ‘শুকনো চালের নৈবেদ্য’, ‘একশো আটটি প্রদীপ’, ‘বস্ত্রালঙ্কার’, ‘বেলপাতা’ ও ‘জবাফুলের মালা’। এছাড়া বনেদি বাড়ির পূজায় সাধারণ কিছু সামগ্রী নিবেদন করার প্রথাও ছিল। যেমন – ‘পাঁড়-শশা’, ‘মোমবাতি’ ও ‘বুঁদিয়ার মিঠাই’। নবমীর রাতে এক হাঁড়ি ‘শিবা-ভোগ’ বা পায়েস সন্নিহিত বনে রেখে আসা হত। ‘বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়িতে’ চামুণ্ডা পূজা হয় ‘ল্যাটা’ আর ‘ফলুই’ মাছ পুড়িয়ে। দুর্গোৎসবে এই সব ‘কৌলিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে’ সেকালের ‘সামাজিক প্রতিচ্ছবি’ ফুটে ওঠে। এই সব লুপ্তপ্রায় প্ৰথার ক্ষীণ স্মৃতিবাহী কিছু আচার আজও কোথাও কোথাও পালিত হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর।
২- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- দুর্গা দেবীর তথ্য প্রশ্ন ও মন্ত্র সাধারণ জ্ঞান, প্রেমেন্দ কুমার সাহা, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।
৪- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, নন্দী কেশ্বর পুরাণোক্ত, বুক চয়েস।
৫- কালিকাপুরাণোক্ত: শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
৬- বাংলার দুর্গোৎসব, নির্মল কর।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত