নিঃশব্দে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন আসে এবং চলেও যায় – কিন্তু চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালির স্মরণে তিনি তেমন ভাবে আসেন না। ১৯৫২ সালে ‘ঋত্বিক ঘটকের’ ‘নাগরিক’-এ তাঁর প্রথম অভিনয়। সে ছবি মুক্তি পায়নি তখন। তাই ১৯৫৩ সালে মুক্তি-পাওয়া ‘যোগবিয়োগ’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় বলা যেতে পারে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি নায়কের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেছিলেন ‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের’ ‘ময়লা কাগজ’ ছবিতে। তখন পরিচালক ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রোডাকশন হাউসে’ তিনি ‘সহকারী পরিচালক’ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ’ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। ‘উৎপল দত্তের’ সঙ্গে কলেজে ইংরেজি নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘আকাশবাণী’তে অডিশন দিয়েছিলেন ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের’ সঙ্গে। তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল ‘নায়কের বন্ধু’ গোছের চরিত্র দিয়ে। তখন ‘উত্তম-সুচিত্রা’ মধ্যগগনে। তারই মধ্যে ‘অগ্নিসংস্কার’ ছবিতে ‘সাইকোপ্যাথ ভিলেনের ভূমিকায়’ অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। প্রেস শো দেখে উত্তমকুমার তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘অনিল, তুই দেখিস, এ ছবিতে তোর খুব নাম হবে।’’ তার পর বেশ কিছু ছবিতে নায়কের ভূমিকায় তাঁকে দেখা গিয়েছিল – ‘আহ্বান’, ‘উল্কা’, ‘বালুচরী’, ‘নতুন জীবন’, ‘সোনাবউদি’।
অনিল চট্টোপাধ্যায় অসংখ্য ভাল ভাল চরিত্র জীবন্ত করে রেখে গেছেন সেলুলয়েডে। কে ভুলবে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র দাদাকে। ‘আগুন’ ছবির পরোপকারী তিন বন্ধুর এক বন্ধু ছিলেন তিনি। ‘সাগিনা মাহাতো’-তে হয়েছিলেন শ্রমিক নেতা, ‘কাঁচের স্বর্গ’-তে হয়েছিলেন ডাক্তার, ‘বনপলাশির পদাবলী’তে তিনি এক পা খোঁড়া রগচটা ডাক্তার, তিনি ‘নির্জন সৈকতে’র যুবকটি, আবার ‘আঁধার পেরিয়ে’-তে একজন সাংবাদিক, ‘অমানুষ’-এ এক সৎ পুলিশ অফিসার, ‘মহানগর’-এর চাকরি চলে যাওয়া নায়ক, ‘পোস্টমাস্টার’ চরিত্র, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় প্লেবয় – কত বিভিন্ন এবং বিচিত্র চরিত্রকে তিনি ফুটিয়েছিলেন অনবদ্য অভিনয়ে।
‘বসুশ্রী কফিহাউসে’ তিনি জমিয়ে আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডায় তিনি এমন সব কথা বলতেন যা অন্যদের অবাক করে দিত। এক দিন কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘অনেক হিট ছবির হিরো হয়েও উত্তমকুমারের ইমেজটা ছুঁতে পারলেন না কেন?’’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সেটা আমাদের অপারগতা। উত্তম তো আমাদের হাত দিয়ে আটকে রাখেনি। হলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেনি, অনিলের ছবি দেখবেন না। তা ছাড়া, সেই সময়ে আমি অনেক অফ বিট ছবি করেছিলাম যেগুলো সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল। মেঘে ঢাকা তারা, আহ্বান, অগ্নিসংস্কার, আগুন, মরুতীর্থ হিংলাজ এগুলো সো-কলড উত্তম-সুচিত্রার গল্পের অনেক বাইরের গল্প।’’ নিজের এক বন্ধুকে তিনি আরেকবার বলেছিলেন, ‘‘তবে কী জানিস, হলিউড ছবিতে দেখবি, সব সময় সেকেন্ড লিডে খুব জবরদস্ত অভিনেতাকে নেয়, যাতে হিরোর স্টার ইমেজের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। সে দিক থেকে আমি বাংলা সিনেমার কাছে ঋণী। ওরা আমাকে সেকেন্ড লিড চরিত্রটাতে সুযোগ দিয়ে এসেছে। উত্তমের সঙ্গে অগ্নিসংস্কার, আমি সে ও সখা, জতুগৃহ, বনপলাশির পদাবলী এগুলো তো প্যারালাল রোল। আতঙ্ক, এক যে ছিল দেশ, রাজা, আঁধার পেরিয়ে, সাগিনা মাহাতো তপন সিংহ কত ভাল ভাল চরিত্রে আমায় সুযোগ দিয়েছে ভাব। মানিকদার দেবী-তে ছোট্ট এক সিন সৌমিত্র’র বন্ধু হিসেবে। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে মহানগর-এ নায়ক।’’ অথচ এমন এক অভিনেতার কথা আমাদের কারও খুব একটা মনে পড়ে না!
অনিল চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্র অভিনেতা হয়ে ওঠার অনেক আগে, যখন সবে মাত্র পঁচিশ দিন হয়েছিল তাঁর অফিস যাওয়ার – জার্মান কোলাবরেশনের একটা কোম্পানি – যেখান থেকে তিনি মাস গেলে সাত-আটশো টাকা বেতন পেতেন এবং পঞ্চাশের দশকে টাকাটা কম তো নয়ই, বরং বেশ বেশিই ছিল, সেই তখন একদিন তিনি হঠাৎ বলেছিলেন, ‘‘ধুর, এ সব পোষায় না। ছেড়ে দেব।’’ তখন কিন্তু তিনি বিবাহিত। সেই বাজারে তখন চাকরি ছাড়লে, পরে কী হবে তার ঠিক ঠিক ছিল না, তবুও তাঁর স্ত্রী ‘অনুভা চট্টোপাধ্যায়’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘না পোষালে কোরো না।’’ যেমন কথা, তেমন কাজ। অনিল হঠাৎ করে মোটা মাস মাইনের চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিয়মে বাঁধা চাকরির বদলে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন চিত্রপরিচালক ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী’। ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়’, অনিলের ‘কালাচাঁদদা’ – তাঁর সহকারী হিসেবে অনিল মাইনে পেতেন পঞ্চাশ টাকা। ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়’ আর তাঁর ভাই ‘পিনাকী মুখোপাধ্যায়’, যাঁর ডাকনাম ছিল ‘পানুদা’, তখন থাকতেন হাজরায়। একদিন ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা যদি সিনেমায় না আসে, কী করে চলবে!’’ মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের স্কুলবেলার পড়াশোনা শেষ হয়েছিল দিল্লিতে। সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। পরে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতির অনার্স হয়েছিলেন। ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়’ ছিলেন অনিলের কেমন যেন আত্মীয়, তাঁর বাড়ি ছিল ভাগলপুরে। আর অনিলের মামাবাড়ি ছিল সেখানেই। যদিও বড় হয়ে দেশের বাড়ি বলাগড়ে তিনি কোনও দিন যাননি, অথচ ছোটবেলায় মামাবাড়ি শুনলেই নাকি এক পায়ে খাড়া থাকতেন! ফলে যা হয়। দুই পরিবারে জানাচেনা সবই ছিল। এভাবেই শুরু হয়েছিল অনিলের সিনেমা-জীবন, ক্যামেরার পিছনে। সেখান থেকে তাঁর অভিনয়ে আসাটা কিন্তু হঠাৎই। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ছবি হচ্ছিল, ‘যোগবিয়োগ’। তাতে কোনও এক শিল্পী অনুপস্থিত ছিলেন। পরিচালকের মুশকিল আসান হয়ে সেই প্রথম ক্যামেরার সামনে হাজির হয়েছিলেন অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। সেই ছবিতে তাঁর উল্টো দিকে ছিলেন ‘ছবি বিশ্বাস’, ‘সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়’। তাতে কী! জানা যায়, তাঁর অভিনয় দেখে ধাঁ মেরে গিয়েছিলেন ‘ছবি বিশ্বাস’, নিজেই আনমনা হয়ে ভুল করে ফেলছিলেন, কিন্তু তাতে অনিলের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অনিল চট্টোপাধ্যায় তাঁর কাছের লোকেদের স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘পৃথিবীতে এসেছিস। দাগ রেখে যা।’ চলচ্চিত্র-জীবনে তাঁর দাগ রাখার সেটাই ছিল শুরু।
স্ত্রী অনুভা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল ১৯৫১ সালে। অনুভারা তখন গ্রে স্ট্রিটের কাছে কালী দত্ত স্ট্রিটে থাকতেন। তাঁর পিতার ছিল একটা আস্ত চা-বাগান। তাঁর মা ছিলেন সাধারণ ঘরণী। সাত বোন, চার ভাইয়ের মধ্যে অনুভা ছিলেন অষ্টম। তাঁর পিসির বাড়ি নাকতলায়। সেবার নাকতলা হাই স্কুল তৈরি হবে। তাই ঠিক হয়েছিল, টাকাপয়সা তুলতে দুটো নাটক করা হবে। সেই দুই নাটকের একটা নাটক ছিল ‘কালিন্দী’, অন্য নাটকটা কোন এক ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে ছিল – কিন্তু নাম জানা যায় না। সেখানে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন পরবর্তী সময়ের আরেক বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়’। এই ‘সাবিত্রী’ বা ‘সাবু’ ছিলেন অনুভার কিশোরবেলার বন্ধু। সেই নাটকে ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘ধীরেন দাস’, ‘বাণী গঙ্গোপাধ্যায়’কে ডাকা হয়েছিল। নায়িকা বাছা হয়েছিল অনুভাকে। আর তাঁর বিপরীতে নায়ক হয়েছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এতে অনুভার বাবা বেঁকে বসেছিলেন। শেষে অনুভার পিসি জোর করে বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁর বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন। সেই নাটকের সূত্রে তাঁদের প্রথম আলাপ হয়েছিল। এর পর অনিলের যাতায়াত শুরু হয়েছিল অনুভাদের বাড়িতে। তাঁর এক দাদার সঙ্গে অনিলের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এর বছর দুই বাদেই অনিল-অনুভা বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সেই বিয়ে নিয়েও বাড়িতে চরম অশান্তি হয়েছিল। অনুভারা ছিলেন ‘কুমিল্লার গুপ্ত’। অনিলরা ছিলেন ‘এদেশি ব্রাহ্মণ’। তবে এই বিয়েতে অনুভার বাবার চেয়ে তাঁর মায়ের আপত্তিই ছিল বেশি। শেষে আবার রণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন অনুভার পিসিমা! বুঝিয়েছিলেন তিনি। শেষে নির্বিঘ্নে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। দিন কতক বাপের বাড়িতে থাকার পরে অনিল-অনুভার নতুন সংসার শুরু হয়েছিল ‘কলকাতার সুইস পার্কের কাছে, বখতিয়ার শাহ রোডে’। সেখানে বছর কয়েক কাটিয়ে তাঁরা উঠে এসেছিলেন ‘১৪/১০, গল্ফ ক্লাব রোডের ভাড়াবাড়িতে’। এর মধ্যে ছবিজগতে অনিলের ব্যস্ততা বাড়ছিল। এর জন্য রেডিয়োয় ঘোষকের চাকরি পেয়েও ছাড়তে হয়েছিল অনিলকে। কিন্তু রেডিওর ঘোষকের চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়েও একটা কাণ্ড ঘটেছিল। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল ‘পুলু’র সঙ্গে – ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’। সৌমিত্রও বসেছিলেন সেই পরীক্ষায়। তিনি হয়েছিলেন দ্বিতীয় আর অনিল হয়েছিলেন প্রথম। কিন্তু একটাই পদ ফাঁকা ছিল। ব্যস্ততার জন্য অনিল চাকরি নেন নি বলে, সৌমিত্র আকাশবাণীর ঘোষক হয়েছিলেন। কিন্তু সেই যে তাঁদের বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল, সেটা চলেছিল অনিলের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। দুই ‘চাটুজ্যে পরিবার’ একসঙ্গে পুরী বেড়াতেও যেতেন। ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন অনিল। একবার ‘কার্শিয়াং’য়ে বেড়াতে গিয়ে দুই চাটুজ্যে পরিবার ‘জেসমিন ভিলা’ নামে একটা বাড়ি ভাড়া করে টানা এক মাস ছিলেন। বলা বাহুল্য, হুজুগটা ছিল অনিলের। দুটো পরিবার মিলে বেড়াতে গিয়েছিল, তাই লোক সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। শুধু ট্রাঙ্কের সংখ্যাই হয়েছিল কুড়িটা! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও অনিলের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল ‘সুচিত্রা সেনের’ সঙ্গেও। সুচিত্রা ও তাঁর ‘স্বামী দিবানাথ’, যাঁর ডাকনাম ছিল ‘তুতু’, যখন বন্ডেল রোডে আদিনাথ সেনের বাড়িতে থাকতেন, তখন সুচিত্রা কন্যা ‘মুনমুন’ বছর চারেকের শিশু। তাঁকে অনিল-অনুভার কাছে রেখেই সুচিত্রা-দিবানাথ প্রায়ই বেরোতেন। দুই পরিবার একসঙ্গে সিনেমাও দেখতে যেতেন। একবার, সুচিত্রা সেনের জন্মদিনে দিবানাথ তাঁদের একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খাইয়েছিলেন।
কিন্তু অন্য সব বন্ধুত্ব-সম্পর্ক একদিকে আর ‘অনিল-উত্তম সম্পর্ক’ ছিল আরেকদিকে। উত্তম কুমারকে নিয়ে তাঁর জীবনের গায়ে গায়ে গল্প। একবার হাজরা মোড় দিয়ে ‘উত্তম কুমার’ যাচ্ছিলেন একটা গাড়িতে। যেহেতু তিনি জানালার ধারে বসেছিলেন, তাই হাত দিয়ে মুখটা অল্প আড়াল করে রেখেছিলেন যাতে কেউ চিনতে না পারে! অনিল তখন বসুশ্রী-কফিহাউসে তাঁর প্রতিদিনের আড্ডায় বসতেন। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়েছিল উত্তম কুমারের গাড়ি। তখনই দুষ্টুমি খেলে গিয়েছিল তাঁর মাথায়। চিল চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ‘‘আরে, গুরুউউউ, আমাদের একটু দেখো।’’ থতমত খেয়ে উত্তম কুমার ঘুরে দেখেছিলেন হা-হা করা হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাণের বন্ধুটি! রাস্তাসুদ্ধু লোক তখন তাঁদের দেখছিল! উত্তম কুমারও অবশ্য কম ছিলেন না। একবার বসুশ্রী সিনেমার সামনে দিয়ে যাবার সময় উত্তম দেখেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় পানের দোকান থেকে পান কিনে খাচ্ছেন। অতঃপর ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ অনবদ্য ভাষায়, ‘‘উত্তম … হঠাৎ গাড়ি ব্যাক করে ফুটপাথের সামনে গাড়িটা নিয়ে জানালা খুলে বলে, ‘এই যে অনিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে ঘ্যাচর ঘ্যাচর চিবিয়ে পান খাচ্ছিস, ট্রামে বাসে যত লোক যাচ্ছে তোকে দেখছে, কোন ব্যাটা উজবুক আছে পয়সা দিয়ে তোর সিনেমা দেখতে যাবে!’ …’’ অথচ, সেইসময় উত্তম ও অনিলের মধ্যে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল।
মজা করতে গিয়ে নিজের স্ত্রী অনুভাকেও কম অস্বস্তিতে ফেলেননি অনিল! একদিন লেক মার্কেটে বাজার করতে গিয়ে অনুভার টাকা কম পড়েছিল। তিনি বসুশ্রী-কফিহাউসে গিয়ে অনিলের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। তারপরে স্ত্রীকে ট্রামে তুলে দিয়েছিলেন। টিং টিং করে ট্রাম ছাড়তে হঠাৎ অনুভা শুনতে পেয়েছিলেন, তাঁর স্বামী তাঁর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘এই যে দিদি, শুনুন, আপনার স্বামী না আমার কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েও ফেরত দিচ্ছে না!’’ এমনই ছেলেমানুষ ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। তাঁর এই ছেলেমানুষি শেষ বয়সেও যায়নি। শেষ বয়সে যখন তাঁকে ব্লাডসুগারে ধরেছিল, তখন তিনি চকোলেট কিনে এনে আলমারিতে লুকিয়ে রাখতেন! একদিন রাত্রিবেলা হঠাৎ খসখস আওয়াজে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে অনুভা দেখেছিলেন, অনিল আলমারি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে চকোলেট নিয়ে খাচ্ছেন!
অনিলের জীবনের একটাই ‘মোটো’ ছিল, সেটা হল আনন্দে বাঁচা। না হলে স্টুডিয়োর মধ্যে কেউ ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানায়! তাঁর গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়িতে আসতেন ‘সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়’। ‘মাধবী চক্রবর্তী’ও আসতেন। আসতেন ‘সুপ্রিয়াদেবী’। তাঁরা সবাই তখন ছিলেন তাঁর পারিবারিক বন্ধু। এমনকী টেকনিশিয়ানদেরও অনেকে ছিলেন তাঁর পারিবারিক বন্ধু। আর গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে ‘মান্না দে’, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’, ‘শ্যামল মিত্র’ কে আসতেন না তাঁর বাড়িতে! মাঝে মধ্যেই অনিলের বাড়িতে তাঁদের গানের ঘরোয়া আসর বসত। ‘শর্মিলা ঠাকুরের’ সঙ্গে সেই কবে থেকে ছিল তাঁর সম্পর্ক! ‘বিকাশ রায়’ও তাই। ‘অশোককুমার’ আবার ছিলেন তাঁর মাসতুতো ভাই। একবার একটা অনুষ্ঠানে ‘অশোককুমার’ মজা করে বলেছিলেন, ‘‘হুম, অনিল আমার মাসতুতো ভাই, তবে ভাববেন না যেন চোরে চোরে!’’ মুম্বইয়ের অনেকের সঙ্গেই তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল – ‘অমিতাভ বচ্চন’, ‘স্মিতা পাতিল’, ‘শাবানা আজমি’। ‘শত্রুঘ্ন সিনহা’ তো অনিলের বাড়িতে এসে তাঁর মায়ের সঙ্গেও কত গল্প করতেন! ‘রাখী’র চলচ্চিত্রে আসার নেপথ্য-কাহিনীতেও ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। সেবার অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আহ্বান’-এর শ্যুটিং হচ্ছিল রানাঘাটে। ছবির নায়ক ছিলেন অনিল। নায়িকা ছিলেন সন্ধ্যা রায়। ওই আউটডোরে হঠাৎ করে ফ্রক পরা স্থানীয় একটি মেয়ে এসে প্রথমে সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল। তার পর সবার সঙ্গে। এক সময় সে কলকাতায় আসতে চেয়ে আবদারও করেছিল। তখন ‘সন্ধ্যা রায়’, ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’ আর ‘অনিল’ গিয়ে মেয়েটির বাবার কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন। এর পরই রাখীর কলকাতায় আসা। সন্ধ্যা রায়ের কাছে থাকতে শুরু করা। কলকাতাতে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায় নিজে। অনিলের পাড়াতেই থাকতেন ‘ঋত্বিক ঘটক’। এক-আধ দিন চলে আসতেন অনিলের বাড়িতে। ঋত্বিক ঘটকের প্রতি অনিলের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা! অনিল বলতেন, ‘‘লোকে ওর মদ খাওয়াটাই শুধু দেখে, ঋত্বিকদা যে কতটা টেকনিক্যালি সাউন্ড!’’ তবে ঋত্বিকদার ওপর একদিন অনিল প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। সেদিন বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ অনুভা শুনতে পেয়েছিলেন অনিলের চিৎকার, ‘‘আপনি নিজেই নিজেকে শেষ করবেন!’’ কী হয়েছিল কে জানে!
তবে অনিল চট্টোপাধ্যায় রোম্যান্টিক চরিত্র একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। একবার ‘হাইহিল’ বলে একটা ছবিতে তাঁকে নিয়ে প্রোডিউসার খুব ঝোলাঝুলি করেছিলেন! তিনি যত বলেছিলেন, এ চরিত্র আমার জন্য নয়, প্রযোজক তত ভেবেছিলেন, তাঁর আপত্তিটা বোধহয় পারিশ্রমিকের পরিমাণ নিয়ে। শেষে টাকা বাড়াতে বাড়াতে সে-আমলে উত্তম কুমার যা পেতেন, তার চেয়েও বেশি দিতে চেয়েছিলেন সেই প্রযোজক, কিন্তু অনিল পড়েছিলেন সঙ্কোচে। শেষে বলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমায় অত দিতে হবে না। আমি যা নিই, তাই দেবেন। করে দেব।’’এমনটাই মানুষ ছিল অনিল চট্টোপাধ্যায়! একবার তাঁর কাছে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের চরিত্র’ করার অফার এসেছিল। শুনেই বলে দিয়েছিলেন, ‘‘অমন মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার যোগ্য আমি নই।’’ কোনও ক্রমে যখন তাঁকে রাজি করিয়ে ছবিটি করা গিয়েছিল, সেই ছবি দেখে ‘দেশবন্ধু-স্ত্রী বাসন্তীদেবী’ পর্যন্ত প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে ‘অপর্ণা’ ফোন করে অনিলের কেঁদে ভাসিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘‘কত দিন বাদে বাবাকে দেখলাম যেন!’’
অনিল ছিলেন অসম্ভব ‘সেন্টিমেন্টাল’, কিন্তু ভীষণ নরম মন। একবােরর কথা। তাঁর পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছিলেন। সেই ভদ্রলোক জাহাজে কাজ করতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী বাচ্চাকে বেধড়ক মারতেন। একদিন সহ্য করতে না পরে লুঙ্গি পরেই অনিল সটান হাজির হয়েছিলেন তাঁদের ফ্ল্যাটে, ভীষণ রেগে তাঁকে বলেছিলেন ‘‘ভেবেছেনটা কী! এ ভাবে বাচ্চাকে মারবেন, আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব!’’
রীতিমতো ‘বইপোকা’ ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। আর কিছু একটা মাথায় চাপলেই হল, শেষ দেখে ছাড়তেন। একবার ঠিক করেছিলেন, উড়োজাহাজ নিয়ে পড়াশোনা করবেন। রাজ্যের বই কিনে ফেলেছিলেন। আর সময়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। তাঁর দেওয়া সময়ের কোনও দিন এক চুলও এ-ধার ও-ধার হতে কেউ দেখেন নি। জীবনে একবারই ট্রেন মিস করেছিলেন তিনি। সে দিন তাঁর মেয়ে ছিল অসুস্থ। স্ত্রীকে যেতে হয়েছিল মেয়ের স্কুলে, আর তিনি নিজে ছিলেন মেয়ের সেবায়।
রোজ রাতে ডায়েরি লিখতেন অনিল। সেটাও আবার এক কালিতে নয়, নানা রঙের কালিতে। সাথে তাঁর আঁকার হাতটা ছিল দেখবার মতো। নিয়ম করে যে খাতায় আঁকতেন, তা নয়। তবে কেউ হয়তো চিঠি পাঠিয়েছেন, তার ফাঁকা জায়গাটায় এঁকে ফেলতেন। কফিহাউসের বিল-এর পেছনেও এঁকে ফেলতেন। ডটপেন, পেনসিল, ক্রেয়ন, ওয়াটার কালার, চারকোল যখন যা পেতেন, তাই নিয়ে বসে যেতেন। স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তেও আঁকতেন। বলতেন, এতে নাকি মনঃসংযোগ বাড়ে!
ছেলেবেলায় অনিল স্কুলে হিন্দি, ইংরেজিতেই পড়েছিলেন। ফলে প্রথম প্রথম বাংলাটা তাঁর তেমন আয়ত্তে ছিল না। কিন্তু তার পর? এমন শান দিয়েছিলেন বাংলায়। রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো ছিল তাঁর বাংলা সাহিত্যের জ্ঞান। ভাষা নিয়ে তাঁর ছিল অদ্ভুত প্যাশন। জামাল নামের এক টেকনিশিয়ানের কাছে উর্দু শিখেছিলেন। জার্মানি যাওয়ার আগে শিখেছিলেন জার্মান, আর রাশিয়া যাওয়ার আগে রাশিয়ান। হিন্দিটা তো ভাল জানতেই। মুম্বইতে গিয়ে হিন্দি ছবি করেছিলেন ‘সন্নাটা’, ‘ফরার’। ‘অমল পলেকরের’ সঙ্গে ‘অন্কাহি’ করতে গিয়ে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তাঁর! অমল তাঁকে অনেকবার বলেছিলেন, ‘‘চলে আসুন এখানে।’’ অনিল যায়নি। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের’ বেলাতেও তাই। তাঁর বাংলা ছবি ‘রক্তপলাশ’ হেমন্ত করতে চেয়েছিলেন হিন্দিতে। কিন্তু অনিল কিছুতেই মুম্বাই যেতে রাজি হন নি। যাবে কী! তিনি প্রচণ্ড ঘরকাতুরে ছিলেন যে!
বার্লিন ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’। সেখানেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব ‘সিডনি পয়টরের’ সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। সিডনি তাঁর কাজের বহর শুনে আড্ডার ছলে বলেছিলেন, ‘‘চলে আসুন হলিউডে।’’ হলিউডে যাবেন অনিল! ক’দিন বাড়িছড়া থাকলে যিনি কিনা মরমে মরে যেতেন! এই হোমসিকনেসের জন্য একবার অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন। বার্লিন থেকে ইউরোপ ট্যুর করে ফেরার কথা ছিল তাঁর। এয়ারপোর্টে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তাঁর মনে হয়েছিল, এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। ফলে রইল ঝোলা, চলল ভোলা। ব্যাক টু ইন্ডিয়া!
বাড়ি। আড্ডা। কাছের লোকজন। এ সব ছাড়া অনিল ভাবতেই পারতেন না। খুব যে দায় নিয়ে আলুটা-মুলোটা বাজারহাট করে সংসার করেছিলেন তেমন নয়, কিন্তু তাও আপনজনের সঙ্গে লেপটেলুপটে না থাকলে, তিনি যেন কেমন হাঁপিয়ে উঠতেন। ছেলেমেয়ে বলতে অনিল ছিলেন অজ্ঞান। ছোট্ট একটা ঘটনা। তখন তাঁর মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। ভূগোলটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। মেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে। ‘‘আয় তো মামণি, কী প্রবলেম বল,’’ বলে এমন গোড়ার থেকে শুরু করেছিলেন অনিল যে, মেয়ে তখন পালাতে পারলে বাঁচে! কিন্তু এ সব জায়গায় তাঁর সারল্য, নিষ্ঠা ছিল দেখার মতন।
অনিলের নিজের শখ-আহ্লাদ, ন্যূনতম বললেও কম বলা হয়। নেশা বলতে ছিল ‘পান’। খাবার বলতে, শেষ দিকে খুব ভালবাসতেন পোস্তবাটা আর বোঁদে দেওয়া টকদই। ব্যস। যা রোজগার করেছিলেন, দু’হাতে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সতেরো-আঠেরোটা সংস্থার সঙ্গে যোগ ছিল, তাদের জন্য কী না করতেন! না ছিল তাঁর ব্যাঙ্কে টাকা, না নিজের বাড়ি। তাতে অনিলের বয়েই গিয়েছিল। নিজেই বলতেন, ‘‘আমি তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই।’’
মানুষের সঙ্গে মিশতে কোনও আড় ছিল না তাঁর। ‘উত্তম কুমার’ কত করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘একটু তো আড়াল রাখবি!’’ কে কার কথা শোনে! গ্রামে আউটডোর থাকলেই, এ-রাস্তা ও-জমি চষে, এর দাওয়ায় ওর সদরে বসে মাত করে দিতেন অনিল। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব কৌতূহল, প্রচণ্ড মায়া যে! এই মায়া থেকেই তাঁর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। তবে তাঁর এই একটা সিদ্ধান্ত একটু যেন খটমট লেগেছিল কারও কারও! তাঁকে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিশেষতঃ তাঁর স্ত্রী অনুভার একটাই অভিযোগ ছিল – ‘‘কেন তুমি নিজের শরীরটার দিকে একটু নজর দিলে না!’’ যদি তিনি নজর দিতেন তা হলে তো তাঁকে তিন ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে সেই ভরন্ত সংসারটা ছেড়ে অমন অকালে চলে যেতে হত না!
১৯৯৬ সালের ১৫ মার্চের গভীর রাত। হঠাৎ বুকে অসহ্য ব্যথা অনুভব করেছিলেন অনিল। কিছুতেই ব্যাথা কমছিল না। এ দিকে পরদিন ছিল তাঁর শ্যুটিং, তাই কিছুতেই হাসপাতালে যেতে রাজি ছিলেন না তিনি। ডাক্তার এসেছিলেন বাড়িতে। তাও কিচ্ছুটি হয় নি। শেষে তাঁকে জোরজার করে পিজি নিয়ে যেতে যেতে ভোর হয়ে গিয়েছিল। পরের দিনটা সকলের কেটেছিল ভীষণ উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে। শেষে রাত নেমেছিল। ‘মহানগর’ যখন আড়মোড়াও ভাঙেনি, আর তর সয়নি অনিল চট্টোপাধ্যায়ের। চলেই গিয়েছিলেন তিনি – চিরদিনের মতো। কীসের যে এত তাড়া ছিল তাঁর!
(তথ্যসূত্র:
১- এমন বন্ধু আর কে আছে: অনিল চট্টোপাধ্যায়ের জীবন কথা, অলোক চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
২- ১লা এপ্রিল ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় অনিল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী শ্রীমতী অনুভা চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার।
৩- সংবাদ প্রতিদিন, কলকাতা সংস্করণ, ১২ই এপ্রিল ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত