চিরাচরিত রীতি মেনে দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমীর দিন থেকে দাসাই পরবে মাতোয়ারা হলেন পূর্ব বর্ধমানের আদিবাসীরা। বর্ণ হিন্দুরা দুর্গাপুজোয় আনন্দে মাতোয়ারা হলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে এটা শোকের সময়। আদিবাসীদের কাছে দুর্গার পরিচিতি হুদুড় দুর্গা নামে। নাচের মাধ্যমে তাঁরা দুর্গা অর্থাৎ হুদুড় দুর্গাকে এইসময়ে খুঁজে বেড়ান। ছদ্মবেশে সেই হুদুড় দুর্গাকে খুঁজে বেড়ানোর পরবই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে দাসাই পরব নামে পরিচিত।
এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এদিন পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি দেবু টুডু দাসাই পরবের নাচে গানে অংশ নেন। তিনি সকল আদিবাসীকে দাসাই পরবে সামিল হবার বার্তা দেন। দেবু টুডু বলেন, ‘আদিবাসী সংস্কৃতির অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সেই চিরাচরিত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান।’
আদিবাসী সমাজের একাংশ মনে করেন তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। ২০১১-র জনগননা অনুযায়ী গোটা দেশে এখনও অসুর জনজাতির মানুষের বসবাস রয়েছে। এই আদিবাসী জনজাতির লোকজন মহিষাসুরের পূজারি। তাই দুর্গাপুজোর সময়ে তাঁরা মহিষাসুর অর্থাৎ হুদুড় দুর্গার পুজো করেন। রাঢ়বঙ্গ-সহ উত্তরবঙ্গের অসুর জনজাতির মানুষজন বিশ্বাস করেন দুর্গা আসলে কোন নারী শক্তি নয়। তাঁদের মতে দুর্গা শক্তিশালী বলবান পুরুষ। সেই কারণে তাঁদের কাছে দুর্গা হুদুড় দুর্গা নামেই পরিচিত।
আদিবাসী জনজাতীর মানুষজন বিশ্বাস করেন, অনার্যদের দেবতা হলেন অসুর। আর্যরা কখনই অনার্যদের দেবতা হুদুড় দুর্গার সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তাই দেবীরুপী দুর্গাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন দেবতারা। তাঁদের মতে চিরাচরিত দুর্গা পূজার কাঠামোয় অসুরকে যতই অত্যাচারি দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে মহিষাসুর ছিলেন ঠিক তাঁর উল্টোটাই। যুদ্ধে অসুর কোন মহিলা ও শিশুদের আঘাত করতেন না। সেই দুর্বলতা জেনে দেবতারা বিজয়লাভ করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দুর্গাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। নিজের নীতিতে অবিচল মহিষাসুর তাই দুর্গার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হন। এই বিশ্বাসে ভর করেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন দুর্গাপুজোর সময়ে ছদ্মবেশে নাচের মাধ্যমে তাঁদের অনার্য ভগবানকে খুঁজে বেড়ান। মূলত ভাদ্র মাস শেষ হতেই আদিবাসী মহল্লায় শুরু হয়ে যায় দাসাই পরব। পুরুষরা নারী সেজে ধামসা ও মাদল নিয়ে দাসাই নাচে মাতোয়ারা হন। দশমী পর্যন্ত চলে এই দাসাই পরব।
অসুর জনজাতির মানুষজন এই লোককথাকে বিশ্বাস করেই শতকের পর শতক দুর্গোৎসবের চারদিন শোকের পরব দাসাই পালন করে আসছেন। আদিবাসী পুরুষেরা নারীর বেশে, মাথায় ময়ূরের পুচ্ছ লাগিয়ে বুক চাপড় ‘ভুয়াং’ নাচের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে দুঃখের গান গেয়ে এই সময়ে খুঁজে বেড়ান তাদের মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গাকে।