বাস্তবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রাচীন শস্যের দেবী। যাঁর আরাধনা বঙ্গভূমিতে ৪০০০ বছর ধরে হয়ে আসছে, সেই অস্ট্রিকদের সময় থেকে। বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে ‘অস্ট্রিক’রা। কৃষি প্রধান বাঙালি জীবন ওই অস্ট্রিকদের থেকেই পাওয়া। অস্ট্রিকরা প্রকৃতি শক্তির আরাধনা করতেন। ‘গাছ’, ‘শস্য’, ‘নুড়ি’, ‘শীলা’ ইত্যাদির আরাধনা হত কিন্তু মনুষ্য বা পশু সাদৃশ্য মূর্তির পূজা করতেন না। নগর সভ্যতা ও স্থাপত্য, মূর্তি নির্মাণ এইসবই আদি দ্রাবিড়দের থেকে পাওয়া। অস্ট্রিকদের শস্যের দেবী কালক্রমে দ্রাবিড় প্রভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হয়ে ওঠেন। লক্ষণীয়, এখনও দুর্গোৎসবে ‘নবপত্রিকা’ (‘কলাবউ’) আবশ্যিক। অস্ট্রিকরা এই নয়টি শষ্যকেই দেবীরূপে আরাধনা করতেন।
দুর্গাপূজায় যাকে বলা হয় ‘কলাবৌ’, তারই শাস্ত্রীয় নাম ‘নবপত্রিকা’। আদ্যিকালে নবপত্রিকার জন্ম হয়েছিল এক লৌকিক আচারকে ভিত্তি করে। শরৎকালে ‘আমন ধান কাটার মরসুমে’ বাংলার মানুষ শস্য ও সমৃদ্ধির এক লৌকিক দেবীর পূজা করতেন। তারপর শরতে যখন লোকসমাজে দুর্গাপূজার প্রচলন হল, তখন ফলন্ত সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেবীর উপাসনা মঞ্চে আনা হল উদ্ভিদ ও বৃক্ষশাখার নয়টি মাঙ্গলিক উপাচারে সৃষ্ট নবপত্রিকাকে। মূর্তিপূজার চল যখন ছিল না, তখন এই নবপত্রিকাই ছিল ‘দুর্গার আদিরূপ’। আজও নানা স্থানে প্রতিমা পূজার বদলে মাতৃবোধে নবপত্রিকার পূজা করা হয়।
দেবীপুরাণে নবপত্রিকার নয়টি উপাদানের উল্লেখ আছে। যথা – ‘কলাগাছ’, ‘কচুগাছ’, ‘হলুদগাছ’, ‘জয়ন্তী’, ‘বেল’, ‘ডালিম’ ও ‘অশোকের ডাল’, ‘মানকচু’ ও ‘ধানগাছ’। দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা এক অপরিহার্য অঙ্গ। মহাষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন ও উপাসনা দিয়ে যখন মহাপূজার সূচনা হয়, নবপত্রিকার নয়টি গাছ তখন নয়জন অধিষ্ঠাত্রী দেবীতে পরিণত হন। শারদীয়া পূজার বিধিতে এই নয়জন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আসলে ‘দুর্গারই নয়টি রূপ’। তাই নবপত্রিকাকে কোথাও কোথাও নবদুর্গা রূপেও পূজা করতে দেখা যায়।
মহাসপ্তমীর ভোরে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ প্ৰতিষ্ঠার্থে নবপত্রিকার নয়টি গাছকে শ্বেত অপরাজিতার লতা ও নয়গাছা হলুদ সুতোয় বেঁধে স্নান করাতে হয়। পুজোর পদ্ধতিকারেরা নবপত্রিকা স্নানের এক রাজসিক বিধান দিয়ে গেছেন। অতীতে, রাজার অভিষেকে যেমন সমুদ্রের জল ও নদীর জলের প্রয়োজন হত, নবপত্রিকার স্নানেও তেমনি প্রয়োজন নদীর আর তীর্থের জল। সেই জল – ‘গঙ্গা’, ‘যমুনা’, ‘সরস্বতী’, ‘আত্রেয়ী’, ‘ভারতী’, ‘সরযূ’, ‘গণ্ডকী’, ‘শ্বেতগঙ্গা’, ‘কৌষিকা’, ‘ভোগবতী’ ও ‘মন্দাকিনী’র জল। নবপত্রিকার প্রতিটি গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকেও আলাদা-আলাদা মন্ত্রপাঠ করে ও নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আটটি ঘটের জলে স্নান করবার বিধান রয়েছে। প্রথম ঘটে থাকে ‘গঙ্গাজল’। এই জলে স্নান করাবার সময়ে ‘মালবরাগের বাজনা’ বাজানোর নিয়ম। দ্বিতীয় ঘটে ‘বৃষ্টির জল’ – ‘ললিতরাগের বাজনা’। তৃতীয় ঘটে ‘সরস্বতী নদীর জল’ – ‘রাগ বিভাস’, ‘বাজনা দুন্দুভি’। চতুর্থ ঘটে ‘সাগরের জল’ – ‘ভৈরবীরাগে ভীমবাদ্য’। পঞ্চম ঘটে ‘পখ পরাগ মিশ্রিত জল’ – ‘গৌড়রাগে মহেন্দ্রাভিষেক বাদ্য’। ষষ্ঠ ঘটে ‘ঝর্ণার জল’ – ‘বড়ারিরাগে শঙ্খবাদ্য’। সপ্তমঘটে ‘সর্বতীর্থের জল’ – ‘বসন্তরাগে শঙ্খবাদ্য’ এবং অষ্টমঘটে ‘তীর্থের জল’ – ‘ধানসীরাগে ভৈরবীবাদ্য’ বাজাবার রীতি। এছাড়া দুর্গার রূপ-বিশেষ ‘উগ্রচণ্ডা’, ‘প্রচণ্ডা’, ‘চামুণ্ডা’, ‘চণ্ডগ্রা’, ‘চণ্ডনায়িকা’, ‘চণ্ডীকা’, ‘কাত্যায়নী’, ‘ভগবতী’, ‘ব্রাহ্মণী’, ‘মাহেশ্বরী’, ‘বৈষ্ণবী’, ‘নরসিংহী’, ‘ডাকিনী’, ‘শাকিনী’র স্নানও বিধেয়। এঁদের প্রত্যেকের স্নানের উপকরণ আলাদা। যথা – ‘উগ্রচণ্ডার চন্দনজল’, ‘প্রচণ্ডা সুবর্ণজল’, ‘চামুণ্ডার কর্পূরজল’, ‘চণ্ডগ্রার অগুরুর জল’, ‘চণ্ডনায়িকার নদজল’, ‘চণ্ডীকার মধুর জল’, ‘কাত্যায়নীর মধুপর্কের জল’, ‘ভগবতীর শিশির জল’, ‘ব্রাহ্মণীর হাতির দাঁতে তোলা মাটিগোলা জল’, ‘বৈষ্ণবীর আদালত প্রাঙ্গণের মাটিগোলা জল’, ‘নরসিংহীর বারবণীতার গৃহপ্রাঙ্গণের মাটিগোলা জল’, ‘ডাকিনীর চৌমাথার মাটিগোলা জল’ এবং ‘শাকিনীর নদীর উভয় তীরের মাটিগোলা জল’।
নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। দুর্গা পূজার সময় যদি আমরা মণ্ডপে গিয়ে শ্রী গণেশ কে দেখি, তাঁর পার্শ্বে লাল পেড়ে শাড়িতে ঘোমটা তে ঢাকা একটি কলা বৃক্ষ দেখি। অনেকে এটি কে ‘কলা বৌ’ ও ‘শ্রী গণেশের স্ত্রী’ হিসাবে বলে থাকেন। কিন্তু আদৌ এটি ‘শ্রী গণেশের বৌ’ নয়। এটিকে ‘নবপত্রিকা’ বলা হয়। এটি ‘মা দুর্গা’। অর্থাৎ ‘গণেশের জননী’। শাস্ত্রমতে ‘গণেশের দুই স্ত্রী’ এবং তাঁদের নাম ‘রিদ্ধি’ ও ‘সিদ্ধি’।
‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘নয়টি গাছের পাতা’। তবে বাস্তবে ‘নবপত্রিকা’ নয়টি পাতা নয়, ‘নয়টি উদ্ভিদ’।
‘‘রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।’’
অর্থাৎ – ‘কদলী’ বা ‘রম্ভা’ (কলা), ‘কচু’, ‘হরিদ্রা’ (হলুদ), ‘জয়ন্তী’, ‘বিল্ব’ (বেল), ‘দাড়িম্ব’ (ডালিম), ‘অশোক’, ‘মানকচু’ ও ‘ধান’।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম ‘কলাবউ’।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়,
১) ‘কদলী’ বা ‘রম্ভা’: কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ‘ব্ৰাহ্মাণী’;
২) ‘কচু’: কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘কালিকা’;
৩) ‘হরিদ্রা’: হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘উমা’;
৪) ‘জয়ন্তী’: জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘কার্তিকী’;
৫) ‘বিল্ব’: বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘শিবা’;
৬) ‘দাড়িম্ব’: দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘রক্তদন্তিকা’;
৭) ‘অশোক’: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘শোকরহিতা’;
৮) ‘মান’: মান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘চামুণ্ডা’;
৯) ‘ধান’: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ‘লক্ষ্মী’।
একটি সপত্র কলাগাছের সাথে অপর আটটি সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে দুটি বেলের সাথে সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দুর্গা দেবীর ডান পাশে রাখা হয়। এটি গণেশের ডান পাশে দেখা যায়।
এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিতা হন।
“রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা,
দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী’’
সেকালের কলকাতার বাবুদের শারদোৎসবে নবপত্রিকা স্নানের এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার ছবি পাওয়া যায় ঊনিশ শতকের বাংলার সমাজ-চিত্রী ‘হুতোমের নকশায়’। ‘হুতোম’ লিখেছিলেন – ‘‘ষষ্ঠীর শর্ব্বরী অবসন্না হলে সুখতারা মৃদু পবন আশ্রয় করে উদয় হলেন, পাখিরা প্রভাত প্রত্যক্ষ করে ক্রমে ক্রমে বাসা পরিত্যাগ কত্তে আরম্ভ কল্লে। সেই সঙ্গে সহরের চারিদিকে যাজানাবাদ্দি বেজে উঠলো, নবপত্রিকা স্নানের জন্য কর্ম্মকত্তারা শশব্যস্ত হলেন – ভাবুকের ভাবনায় বোধ হতে লাগল, যেন সপ্তমী নতুন কাপড় পরিধান করে হাসতে হাসতে উপস্থিত হলেন। এদিকে সহরের সকল কলাবউয়েরা বাজনাবাদ্দি করে স্নান করতে বেরুলেন …।’’ স্নানযাত্রার শুরুতে থাকত ‘কাড়ানাগরা’, ঢোল ও সানাইদারেরা। পিছনে নতুন পোষাকে সজ্জিত ‘আশাসোঁটা’ হাতে বাড়ির দারোয়ানেরা। কলার খোলায় বসানো নবপত্রিকা কোলে পুরোহিত, পুঁথিহাতে তন্ত্রধারক, আচার্য-বামুন, গুরু ও সভাপণ্ডিত, লাল সাটিনের রূপোর লালছাতা মাথায় বাবুরা এবং মোসাহেবের দল। সবশেষে নৈবেদ্য, পুষ্পপাত্র, শঙ্খ-ঘন্টা, কুশাসন প্রভৃতি পূজার সরঞ্জাম মাথায় মালীরা। নদীতে বা জলাশয়ে স্নান ও স্তবপাঠের পর নবপত্রিকার জাঁকালো শোভাযাত্রা বাজনা-বাদ্যির সঙ্গে ফের বাড়িমুখো হত।
কিন্তু বর্তমানের শারদোৎসবে নবপত্রিকার বিশেষ ভূমিকা থাকা সত্বেও নবপত্রিকার চেয়ে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তির পুজোই প্রাধান্য পায় বেশি। নবপত্রিকা ঘিরে সেকালের মতন তেমন জাঁক হয় না। কেন-না, এত রকম জল সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। স্নানপর্বটি তাই নমঃ-নমঃ করে সম্পন্ন হয়। পূজার তিনদিন ১০৮টি উপকরণে দেবীকে স্নান করানো হয় ধাতব দর্পণ বা নবপত্রিকাকে মাধ্যম করে। নবপত্রিকার নয়টি গাছকে অপরাজিতার লতায় ও হলুদ সুতোয় একত্রে গুচ্ছাকারে বেঁধে ঢাকঢোল-কাসির বাজনা সহযোগে শাঁখের জলে স্নান করানো হয়। তারপর পরানো হয় নতুন লালপেড়ে গরদের শাড়ি, পাতায় সিঁদুরের টিপ। তাতে একগলা ঘোমটা টেনে অবগুণ্ঠিতা নবপত্রিকাকে আলপনা আঁকা পিঁড়ির উপর বসিয়ে দূর্বা আলোচালে, ফুলে, চন্দনে, ধূপে এবং মন্ত্রপাঠে আরতি করা হয়। তারপর তাকে স্থাপন করা হয় দুর্গার ডানদিকে। নববধূর সাজে সজ্জিত ও অবগুণ্ঠনবতী নবপত্রিকা কলাবৌ নামেও বিশেষ পরিচিত। এবং গণেশের পাশে এর অধিষ্ঠান বলে অনেকের ধারণা – কলাবৌ বুঝি গণেশের স্ত্রী। যদিও ধারণাটি ভয়ানক ভুল। আবার পূর্ববঙ্গের নানা জেলায় বিশেষতঃ বরিশাল ও চট্টগ্রামে বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের বাড়িতে এমনকি সাধারণ গৃহেও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন কলাবৌ লক্ষ্মীজ্ঞানে পূজিত হন। লক্ষ্মী ও দুর্গা যে এখানে অভিন্ন একথা শ্রীশ্রীচণ্ডীতেই রয়েছে।
নবপত্রিকার যে নয়জন দেবীর কথা বলা হয়েছে দুর্গাপূজার সঙ্গে তাঁদেরও তিনদিন ষোড়শোপচারে আলাদা পূজা ও আরতিতে শারদোৎসব সম্পন্ন হয়। প্ৰতিদিনের পূজা নির্ঘন্টের মতন দুর্গার প্রাণ-বিসর্জনেও আছে নানা আচার। অপরাহ্নে গঙ্গায় বা জলাশয়ে দেবী প্রতিমা নিরঞ্জনের সঙ্গে নবপত্রিকাকেও আলাদাভাবে বিসর্জন দিতে হয়।
নবপত্রিকা কি ভাবে দুর্গা পূজার সাথে মিশে গেলো – তা নিয়ে পণ্ডিতগণের নানা মত।
গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে ‘শস্যদেবীর পূজা’। ‘ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত’ লিখেছেন,
‘‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। … বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।’’
‘ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ মতে,
“Another important aspect of the Devi is her concept as the personification of vegetation spirit, which is emphasised by her name Sākambhari already noted. This finds clear corroboration in the present day Navapatrikāpraveśa ceremony in autumnal worship of Durgā in Bengal.”
তবে ‘হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য’ দুর্গাপূজার সঙ্গে শস্যদেবীর পূজার অনুষঙ্গটি স্বীকার করলেও, ‘শাকম্ভরী তত্ত্ব’টিকে নবপত্রিকার উৎসরূপে মানেননি। ‘যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি’ লিখেছেন,
“আমি নবপত্রিকার উৎপত্তি ও প্রয়োজন বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারি নাই। নবপত্রিকা নবদুর্গা, ইহার দ্বারাও কিছুই বুঝিলাম না। দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই। … নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে। … বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে।”
উল্লেখ্য, ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’ ‘নবপত্রিকা’র উল্লেখ নেই। ‘কালিকাপুরাণে’ ‘নবপত্রিকার উল্লেখ’ না থাকলেও, ‘সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ’ রয়েছে। ওদিকে ‘দেবী ভাগবতে’ ‘নব দুর্গার উল্লেখ’ থাকলেও ‘নবপত্রিকার উল্লেখ নেই’।
‘কৃত্তিবাস ওঝা’ বিরচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক ‘নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ’ রয়েছে,
“বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”
গবেষকরা অনুমান করেন যে, সম্ভবত ‘শবর জাতিগণ’ কোন এক সময় ‘নয়টি গাছ দিয়ে নব দুর্গার পূজা’ করতেন। সেই থেকে এই রীতি হয়তো দুর্গা পূজোতে প্রবেশ করেছে। আবার শস্য দেবীকে দুর্গা দেবীর সাথে মিশিয়ে দেবার জন্য হয়তো এই রীতির আয়োজন।
(তথ্যসূত্র:
১- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর।
২- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- দুর্গা দেবীর তথ্য প্রশ্ন ও মন্ত্র সাধারণ জ্ঞান, প্রেমেন্দ কুমার সাহা, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।
৪- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, নন্দী কেশ্বর পুরাণোক্ত, বুক চয়েস।
৫- কালিকাপুরাণোক্ত: শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
৬- বাংলার দুর্গোৎসব, নির্মল কর।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত