‘ব্রজমোহন বিদ্যালয়’, যা ছিল তাঁর স্কুলবাড়ি, আজও হুবহু একই রকম আছে! যে ‘বিএম কলেজে’ পড়িয়ে পিছনের ‘পশ্চিম বগুড়ার’ যে সড়ক ধরে তিনি ফিরতেন ঘরে, তা আজও শুয়ে আছে মরা ময়ালের মতো! শুধুমাত্র তাঁর বসত বাড়ির চেহারাটা গেছে বদলে। সদরের দ্বারটুকুই যা দাঁড়িয়ে তাঁর জ্বলজ্বলে স্মৃতিফলক বুকে করে। ‘লাশকাটা ঘরটা’ যেন কোন দিকে? ‘মন্তাজ মিঞার আস্তাবল’? কিংবা সেই মাঠ, আলো আঁধারির জ্যোৎস্নারাতে যেখানে ঘাস খেয়ে বেড়াত মিঞার ঘোড়ারা? ‘ধানসিড়িটির তীরে’ জীবনানন্দ দাশ যেন আজও বেঁচে আছেন তার হাওয়াবাতাসে।
‘রূপসী বাংলা’ ঠিক কেমন রূপসী? যদি রূপসী বাংলা বলতে বোঝেন ‘ধানসিড়ি’, ‘ধলেশ্বরী’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘পায়রা’, ‘সন্ধ্যা’ নামের অপরূপ সব নদী জড়ানো ‘বরিশাল’, তা হলে মানতেই হবে সে-রূপসী ভাষায় ধরা দেয় না। ছবিতে হয়তো কিছু বলে। ধরা দেয়, ধরা যায়, শুধু জীবনানন্দের কবিতায়। ‘রূপসী বাংলা’ পূর্ণত জীবনানন্দ প্রদেশ! কে জানে, হয়তো সেটাই সত্যি, যেটা কবি ভাবতেন – বাংলার যে-মুখ দেখলে পৃথিবীর রূপ আর খুঁজতে যাওয়ার টান থাকে না। আজও কেউ ধানসিড়ির পাশে এসে দাঁড়ালে কবির মরণোত্তর প্রকাশিত গোটা ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁর মগজে এসে ভর করে। আশপাশের গোটা প্রকৃতি এবং ৬১টি কবিতায় ভরানো বইটি একে অন্যের আয়নাচিত্র। যাঁরা সেখানে গিয়েছেন তাঁদের মনে পড়ে, সেখানে কোথাও এসে শুয়ে পড়ে মরে যাওয়ার কী বাসনাই না ছিল কবির!
শেষ বারের মতো বরিশাল ছেড়ে কলকাতা যাবার পর তাঁর আর ফিরে আসা হচ্ছিল না। তার মধ্যে দেশভাগ হয়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত চাকরি বদল আর বাসা বদলের ফাঁকে ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি রংপুরের ‘কায়সুল হক’কে লিখেছিলেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তান আমার জন্মস্থান, সেখানে যেতে আমি অনেক দিন থেকেই ব্যাকুল, কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে জোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।’’ এর বছর খানেক আগে, ১৯৫২ সালে, জলপাইগুড়িবাসী তাঁর ভক্ত ‘সুরজিৎ দাশগুপ্ত’কে তাঁর আমন্ত্রণের উত্তরে লিখেছিলেন, ‘‘জলপাইগুড়ি ও ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জঙ্গল – বেশ দেখার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার যেতে খুব ইচ্ছে করে।’’ কিন্তু এর চার মাস পরেই আবার লিখেছিলেন, ‘‘এখন যাবার কোনও সম্ভাবনা নেই। পরে কখনও যাবার চেষ্টা করব।’’ বরিশাল বা জলপাইগুড়ি কোথাওই যাওয়া হয়নি কবির। কিছুকাল পরে ট্রাম দুর্ঘটনায় পড়ে, ২২শে অক্টোবর ১৯৫৪ সালে তো পরপারেই চলে গিয়েছিলেন।
দিনে দিনে, এত দিনে, তাঁর প্রিয় ‘ধানসিড়ি’ ক্ষয়ে ক্ষয়ে অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু ‘সুগন্ধা’ নামের তুলনায় বড় নদীর থেকে বাঁক নিয়ে ভেতরে ঢুকে এখনও যে চেহারায় ‘ধানসিড়ি’ বইছে, তা চাক্ষুষ করলে বোঝা যায় কেন এর বিস্তীর্ণ বটের নীচে শোওয়ার এত আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। কবিতায় আঁকা তাঁর সেই কল্পনার দৃশ্য ভোলা যাবে কখনও? …
‘‘বাঁকা চাঁদ জেগে রবে – নদীটির জল
বাঙালি মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে …’’
তার পরের দৃশ্য আরও সুন্দর, ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর। কবি দেখবেন –
‘‘দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছে চিতা
বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ চেয়ে রবে;’’
আজও প্রশ্ন রয়ে গেছে, ১৯৩৪-এ ‘রূপসী বাংলা’-র কবিতা সব লেখা হয়ে যাবার পর আমৃত্যু কবি তা প্রকাশ হতে দেন নি কেন? অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, জীবনানন্দের এই সব কবিতা রবীন্দ্রনাথ পড়ে যেতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কবির যে-কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ পত্রে (৩রা অক্টোবর, ১৯৩৫ সালে) মন্তব্য লিখেছিলেন, ‘‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে,’’ তাতে বাংলার মুখ তো আছেই, সঙ্গে কবির স্বভাব মৃত্যুভাবনা। নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা ,…’’ আর সেই কবিতার নাম? ‘মৃত্যুর আগে’! তবে অপরূপ স্ফূর্তির কারণ এও যে ওই ১৯৩৫-এই ‘কবিতা’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল কবির বহু বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’, যাকে কবিতা জগতের ‘মোনালিসা’ বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না।
জীবনানন্দের ‘গুণগ্রাহী ও জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়’ (ইনি সুচিত্রা সেনের জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় নন) তাঁর ‘জীবনানন্দ’ বইয়ে লিখছেন – ‘‘এক দিন সকালে গেছি। গেলে ঘরে বসিয়ে বললেন – আমার ‘বনলতা সেন’ কবিতার বইটা সিগনেট প্রেস বার করেছে। … এই বলে তিনি আমার হাতে একখানা ‘বনলতা সেন’ দিয়ে বললেন – কাগজ, ছাপা, বাঁধাই সবই ভাল, কিন্তু কভারের ছবিটা আমার আদৌ পছন্দ হয়নি। আমি বইটা খুলে দেখছি। সেই সময় তিনি আর একটা ‘বনলতা সেন’ নিয়ে তাতে আমার নাম লিখে আমার হাতে দিলেন। আমি বইটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – দাদা, বনলতা সেন কে? আপনি তো লিখেছেন – ‘নাটোরের বনলতা সেন’। এই নামে সত্যিই আপনার পরিচিতা কেউ ছিল নাকি? আমার কথা শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন। কোনও কথা বললেন না।’’
আজও প্রশ্ন ওঠে, বনলতা সেন সত্যিই কি কেউ? আর কবির নিজের বরিশাল থাকতে সে নাটোরেরই বা কেন? যাঁরা জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েছেন ও নাটোর গিয়েছেন, তাঁদের নাটোরের বিখ্যাত রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন মনে এসেছেই – এবং আসাটা অস্বাভাবিকও নয়। নাটোর থেকে মাত্র বাইশ-চব্বিশ মাইল দূরের ‘পাবনা’ শহর আরেক কুহকিনী সেন উপহার দিয়েছিল বাঙালিকে – তিনি ‘সুচিত্রা সেন’। তবে বনলতা বনলতাই। বরিশালের ‘ধানসিড়ি’, ‘ধলেশ্বরী’ বা ‘সন্ধ্যা’র পাশে দাঁড়ালে আজও অনেকের কৌতূহল হয় – এমন সব নদীর বেষ্টনী থেকে নাটোরের মতো নিতান্ত সাদামাটা নগর কী করে তাঁকে হাতিয়ে নিয়েছিল? এবং এমন ভাবে, যে পৃথিবীর যেখানেই বাংলা কবিতা পড়া হয় সেখানেই এই নারী ও নগরীর নাম একই নিঃশ্বাসে এসে যায়।
কেউ বলেছেন, তিনি ‘অন্তর্মুখী’, ‘আত্মসমাহিত’। কেউ বলেছেন, তিনি ‘নির্জনতম’। কেউ বলেছেন তিনি ‘সংসার-পলাতক’। আবার কেউ গলার পর্দা আরও একটু চড়িয়ে বলেছেন তিনি ‘অমিশুক’, ‘অসামাজিক’। বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরাও কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিরূপ এ ভাবেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু এ পরিচয় জীবনানন্দের সত্যিকারের পরিচয় নয়। যাঁরা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছিলেন, তাঁরা দেখেছিলেন, তিনি ‘সহজ’, ‘সরল’, ‘মিশুক’, ‘গল্পপ্রিয়’, ‘পরিহাস-পটু’ এক ‘সামাজিক মানুষ’। হাসাতে পারতেন, নিজে হাসতেও পারতেন। এবং যে সে হাসি নয়। একেবারে লোককে চমকে দেবার মত হাসি। পরিচিত মহলে তাঁর হাসি বিখ্যাত ছিল। তাঁর হাসিকে কেউ বলেছেন, ‘উৎকট হাসি’, কেউ বলেছেন ‘অট্টহাসি’, কেউ বলেছেন ‘মেজাজি হাসি’ ইত্যাদি। হাসির সময় জীবনানন্দ স্থান কাল ভুলে যেতেন। এই হাসির মধ্যেই ধরা পড়ত তাঁর সহজ সরল অন্তঃকরণ। বড়িষা কলেজে এক সহকর্মীর কাছে তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘‘বুদ্ধদেব বসু, নির্জন কবি নির্জন কবি বলে আমার সম্পর্কে একটা লিজেন্ড খাড়া করেছেন যেটা আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।’’ বোন ‘সুচরিতা দাশ’ তাঁর ‘কাছের জীবনানন্দ’ তেও লিখেছেন, কবিকে ঘিরে জনশ্রুতি কতটা ভুল। জীবনানন্দের পথচলা ও আড্ডার সঙ্গী সুবোধ রায় লিখেছেন, জীবনানন্দ কতটা আড্ডাপ্রিয় ও পরিহাসপ্রিয় ছিলেন তার কথা। সুবোধ রায়ের স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়, কবি গল্প করতে এতটাই ভালবাসতেন যে তাঁর বাড়িতে সন্ধেয় গল্প করতে গেলে অনেকদিনই রাত্রি একটা-দেড়টা হয়ে যেত।
জীবনানন্দের জীবনের (১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ থেকে ২২শে অক্টোবর ১৯৫৪) শেষ চাকরি হাওড়া গার্লস কলেজে। এই কলেজেই প্রথম জীবনানন্দ পেয়েছিলেন অধ্যাপনার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ। জীবনানন্দকে এই কলেজে ছাত্রী, শিক্ষক সবাই ভালবেসেছিলেন। তিনিও কলেজকে ভালবেসেছিলেন। পরিবেশ নিজের মনের মত হলে তিনি নিজেকে মেলে ধরতেন। হাওড়া গার্লস কলেজেও তার অন্যথা হয়নি। এই কলেজে জীবনানন্দের সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক ‘অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’। অসিতবাবু জীবনানন্দকে বর্ণনা করেছেন ‘হাস্য-পরিহাসের অংশভাগী’ ও ‘বন্ধুবৎসল’ বলে। এই কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ ‘কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী’ জীবনানন্দকে বলেছেন ‘একজন সঙ্গলোভী সামাজিক মানুষ।’ তিনি লিখেছেন, ‘‘জীবনানন্দের যে বিচিত্র মনোরম পরিচয় আমরা পাইয়াছি, স্মৃতির ভাণ্ডারে তাহার মূল্য অপরিমেয়।’’ জীবনানন্দ সম্পর্কে গড়ে ওঠা ‘জনশ্রুতি’ নিয়ে তাঁর স্ত্রী ‘লাবণ্য দাশ’ এক বার কবিতা সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উষ্মাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে বাড়িতে যে মানুষটিকে সর্বক্ষণ দেখেছিলেন, তিনি যে একেবারেই আলাদা। বিয়ের পরে স্ত্রী যাতে ঠিকমত পড়শোনা করতে পারে তার জন্য যত্নশীল, বোন-ভাইয়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে আগ্রহী, নীতির প্রশ্নে আপসে যেতে নারাজ এবং যথেষ্ট ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। এই মানুষটিকে তিনি ওই সব জনশ্রুতির সঙ্গে মেলাবেন কী ভাবে! তাঁর কাছে বাইরের ওই সব কথা অনেকটাই ‘বানিয়ে তোলা’। বোন ‘সুচরিতা দাশ’ লিখেছেন, ‘‘জীবনানন্দ বাড়িতে এত মজার মজার কথা বলতেন যে সবাই হেসে কুটিপাটি হত। সে সময় দাদাটিকে দেখলে কে বলবে, ইনিই এত গুরুগম্ভীর কবিতা লেখেন!’’ মজার মজার কথা বলে অন্যকে হাসানোর স্বভাব জীবনানন্দের ছেলেবেলা থেকেই ছিল। এই স্বভাব সম্ভবত তিনি পেয়েছিলেন মাতুল বংশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। জীবনানন্দের দাদামশাই ‘চন্দ্রনাথ দাশ’ ছিলেন রসিক মানুষ। তিনি অনেক হাসির গানও লিখেছিলেন। ভাই ‘অশোকানন্দ’ লিখেছেন, ‘‘পার্কে, রাস্তায় কোথাও হিউমারের গন্ধ পেলেই জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে যেতেন। তারপর আড়ালে গিয়ে সঙ্গী বন্ধুর কাছে, অথবা বাড়িতে এসে নিকটজনেদের কাছে তা রসিয়ে পরিবেশন করতেন।’’
জীবনানন্দের রঙ্গ রসিকতার নানা গল্প তাঁর কাছের মানুষেরা লিখে গিয়েছেন। সত্যি জীবনানন্দের হদিশ পেতে গেলে সেই সব গল্পে একটু কান পাততে হবে। কয়েকটা উদ্ধার করা যাক।
‘অশোকানন্দ’ আর তিনি তখন কলকাতার অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন। তিনি ‘বিএ’, আর অশোকানন্দ ‘আইএসসি’। এক দিন সকালবেলা বাইরে থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ভাইকে একজন ধনী, নামজাদা অধ্যাপকের নাম করে বলেছিলেন, ‘‘শিগগির আয়। দেখে যা হোস্টেলের সামনে দিয়ে কেমন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন!’’ নামজাদা, ধনী অধ্যাপক মশাই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন শুনে ‘অশোকানন্দ’ একটু অবাকই হয়েছিলেন। দাদার সঙ্গে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখেছিলেন, মলিন শার্ট পরে এক জন ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁর সঙ্গে অধ্যাপক মশাইয়ের চেহারার অনেক সাদৃশ্য। অশোকানন্দের লেখা থেকে দাদার কৌতুকপ্রিয়তার আর একটি গল্প। সেই সময় তিনি দিল্লিতে অশোকানন্দের কাছে ছিলেন। ভাইয়ের বাড়িতে অনেক বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সমাগম হয়েছিল। এক দিন সকালবেলা অশোকানন্দ নিজের ঘর থেকে দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘তোমার বাথরুম খালি আছে কি?’’ জীবনানন্দ জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘দিল্লির মসনদ কি কখনও খালি হয়?’’ হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনাকালীন তাঁর রস-রসিকতার অনেক কথা জানা যায়। যেমন, এক দিন এক অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়েছিলেন সবার সঙ্গে। অধ্যাপক বন্ধুটি ছিলেন স্পষ্টবাদী এবং স্পষ্ট কথাটা বলতেন বেশ কড়া ভাবে। সবার জন্য চা-জলখাবার এসেছিল। জীবনানন্দ চায়ে কয়েক বার চুমুক দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘চা-টা যদি আপনার কথার মত কড়া হত, তা হলেও উপভোগ্য হত।’’ জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ বন্ধু ‘সুবোধ রায়’ লিখেছেন, ‘‘রাস্তায় কোনও মোটা পুরুষ অথবা মহিলা দেখলে তিনি তাদের নিয়ে আড়ালে এসে নির্দোষ মস্করা করতেন। তাঁর আর একটি মস্করার বিষয় ছিল তাঁর মাথায় গজিয়ে ওঠা টাকটা নিয়ে।’’
জীবনানন্দের পরিচিত মূর্তির সঙ্গে এ সব মিলবে না। যেমন মিলবে না, সংসারে শান্তি আনার জন্য তাঁর ভাড়াটেকে উৎখাত করার তৎপরতা। আর্থিক দুরবস্থা ঘোচাতে নিজের ফ্ল্যাটের একটা ঘরে এক মাঝবয়সী মহিলাকে ভাড়াটে হিসাবে বসিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই প্রকাশ পেয়েছিল মহিলার স্বরূপ। মহিলার ঘরে অন্যধরনের লোকের সমাগম হতে শুরু হয়েছিল। কবির ‘মানসিক অশান্তি’ শুরু হয়েছিল। তিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন মহিলাকে উৎখাত করতে। সাহায্যের জন্য অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। আইনি পথে সুবিধা করতে পারবেন না ভেবে, এক সময় গুন্ডা দিয়েও মহিলাকে উৎখাত করার কথা তিনি ভেবেছিলেন। এরপরেও কি জীবনানন্দকে ‘সংসার-পলাতক’ বলা যাবে? অনেকের মতে বাড়ির এই দুশ্চিন্তাতেই ১৯৫৪ সালের সেই অভিশপ্ত ১৪ই অক্টোবর ট্রামলাইন দিয়ে হাঁটার সময় তিনি অমন অন্যমনস্ক ছিলেন।
তাঁর জীবনকালে তাঁর প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুশো’র একটু বেশি, অথচ তাঁর মৃত্যুর ষাট বছরে তোরঙ্গ থেকে উদ্ধার হয়েছিল অসংখ্য অসূর্যম্পশ্যা কবিতা! সেগুলোর পাতার পর পাতা থেকে সেই হস্তাক্ষর, সেই কণ্ঠস্বর, সেই শৈলী, সেই মানুষ আর তাঁর নির্জনতা ঝরে পড়ছে। তাঁর প্রিয় ‘ইয়েটস’-এর ভাষায় এও এক ‘সেকেন্ড কামিং’, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন জীবনানন্দের এক অভিনব ‘সম্ভবামি’। তবে এও সত্যি যে, কবির মরণোত্তর জীবনই ঢের বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর তাঁর অকাল প্রয়াণের পর। ১৯৪৮ সালের মে-জুন মাসে রচিত তাঁর দুই উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’ প্রকাশনার আলো দেখেছিল তাঁর মৃত্যুর পর। লেখার দু’বছরের মধ্যে এর একটি প্রকাশ পেলেও পেতে পারত, কিন্তু পায়নি। সেটা ১৯৫০-এ ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য’কে লেখা একটা চিঠিতে ধরা পড়েছে। কবি তাঁকে লিখেছিলেন – ‘‘বেশি ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি চার-পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি, পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটি উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয় – ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি, আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে পূর্বাশা’য় মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই – আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এ রকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন – সে জন্য গভীর ধন্যবাদ।’’ চিঠির ‘সবই ভবিষ্যতে’ কথাটা ব্যঞ্জনাময়। কত কিছুই যে লেখার পরিকল্পনা মাথায়, অথচ লেখা হয়ে গেছে এমন অজস্র কিছু সম্পর্কে কী নির্ভার (নাকি গুরুভার?) উদাসীনতা! তাঁর পাণ্ডুলিপির ছবি দেখলেই স্পষ্ট হয় ওঁর ওই অপরূপ মরমি পঙ্ক্তি সব কত সচেতন কাটাকুটি পেরিয়ে, প্রায় সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে কবিতায় এসেছে; তা হলে এত কিছুর পরও তারা কেন, কী ভাবে কুমারী, অন্তরালবর্তিনী রইল?
পরে ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য’ লিখেছিলেন – ‘‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’’ এই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতামত উল্লেখ করে জীবনানন্দের ছাত্র ‘অরবিন্দ গুহ’ কবির স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন – ‘‘জীবনানন্দের মুখে শুনে তাঁর পারিবারিক ঘটনাই সঞ্জয় ভট্টাচার্য জেনেছেন, সে সব ঘটনা খুব সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিদিন জীবনানন্দের একটা দ্বন্দ্বের কথা সঞ্জয় ভট্টাচার্য অকপটে ব্যক্ত করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে জীবনানন্দ তার থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন।’’ কবির গণনাতীত ভক্তের মধ্যে যাঁরা পারিবারিক এই ছবির আঁচ পাননি তাঁরাও ‘মহাপৃথিবী’ সঙ্কলনের ‘ফুটপাথে’ কবিতার এই সূচনা স্তবকের দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে পারেননি। কবি যেখানে তাঁর নিলয়যাত্রাকে প্রায় নিটোল অনুমানে এনেছেন এভাবে –
‘‘ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত
কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়
‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক – ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই
কখন এমন হয়ে হায়!
আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে
কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।’’
ট্রাম বা ট্রামলাইনও যে এক সময় রূপকালঙ্কার হয়ে ওঁর গদ্যকেও ভর করেছিল তাও ভক্তরা লক্ষ করছিলেন এমন সব বর্ণনায় –
‘‘শচী … প্রকাশের বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল; এই শীতের ভেতরেও প্রকাশের কপাল ঘামিয়ে উঠেছে – আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে স্বামীর কপাল মুছে ফেলে শচী দরজা জানালাগুলো সব খুলে দিল। বড় রাস্তাটার দিকের জানালাটার পাশে এসে রাতের কলকাতার দিকে একবার তাকাল সে – ট্রামলাইনগুলো খালি পড়ে আছে – রাস্তার সেই বিরাট হাঙরদের এখন ঘুমোবার সময়।’’ (গ্রাম ও শহরের গল্প)
এই যে ভক্তদের কথা বলা হল, তাঁদের একজন ছিলেন ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’। যিনি উঠতি যৌবনে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে চার আনায় এক কপি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কিনে বোধ করেছিলেন কে যেন দু-চোখে ঘুসি মারল! তিনি অকপটে লিখেছিলেন – ‘‘আমি পাগলের মতন জীবনানন্দ দাশের ভক্ত হয়ে গেলাম। ভক্ত কিংবা ক্রীতদাসও বলা যেতে পারে।’’ এই ভক্ত কিংবা ক্রীতদাস কবির শেষ যাত্রার নাতিদীর্ঘ মিছিলে ছিলেন। লিখেছিলেন, ‘‘শবানুগমনে খুব বেশি লোক হয়নি। আমাদের অল্পবয়সি কাঁধ বেশ শক্ত, আমরা কয়েকজন কাঁধ দিয়েছিলাম পাল্লা করে। জীবনে একবারই মাত্র সেই কবির শরীর স্পর্শ করেছি, তখন নিস্পন্দ।’’ জীবনানন্দের সেই শবযাত্রায় সাক্ষী ‘অরবিন্দ গুহ’ নজর করেছিলেন যে, ‘‘শ্মশানের পথে পড়ল সেই জায়গাটা, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ট্রামলাইনের সেই জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস – আশ্চর্য, শানবাঁধা কলকাতায় জীবনানন্দের জীবনের চরম দুর্ঘটনা এমন জায়গাতেই ঘটল যেখানে ঘাস, ঘাস – যে ঘাসের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রগাঢ়, প্রবল। আর তাঁর মৃত্যু হয় যখন, কোন তারিখ? রাত্রি ১১টা ৩৫মি। ৫ই কার্তিক।’’ এই কার্তিকের রাত্রির সংযোগটাও আশ্চর্য করেছিল অরবিন্দকে, যাঁর মামাবাড়ি ছিল বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের কাছে। যে-ব্রজমোহন স্কুলের ছাত্র ছিলেন জীবনানন্দ; পরে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপকও, অরবিন্দ লিখেছিলেন – ‘‘লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন থাকত মামাবাড়িতে। নেমন্তন্ন সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। কোজাগরি পূর্ণিমার রাত। একাধিকবার দেখেছি, স্কুলের মস্ত মাঠ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে, মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের কয়েকটি ঘোড়া জ্যোৎস্নার মাঠে ঘাস খাচ্ছে। বহু কাল পরে জীবনানন্দের ‘ঘো়ড়া’ নামক একটি বিখ্যাত কবিতায় পড়েছি— ‘মহিনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে/প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন – এখনও ঘাসের লোভে চরে/পৃথিবীর কিমাকার ডাইনোসর ’পরে। … ‘ঘোড়া’ কবিতাটি পড়ে আমি অনেক দিন ভেবেছি – জীবনানন্দ কি কোনও দিন ওই জ্যোৎস্নার মাঠে স্বচক্ষে মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের ঘোড়াদের ঘাস খেতে দেখেছেন?’’ অরবিন্দ ভাবেননি, তবে ভাবতেও পারতেন, শেষ আশ্বিনের ওই ভয়ানক সন্ধ্যার অপঘাতও কি জীবনানন্দ মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন কখনও? কিংবা আধোঅচেতন অনুরাগে অনুভব করেছিলেন, যেমনটি লিখে গেছেন ‘ফুটপাথে’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে –
‘‘কোন্ দিকে যেতে হবে? নিস্তব্ধ শহর কিছু জানে নাকো
সে শুধু বিছায়ে আছে
বিশ্বাসীর বিধাতার মতো।
কোলে তার মুখ রাখি – বিশ্বাস করিতে চাই, তবু মনে হয়
শহরের পথ ছেড়ে কোনও দিকে হেঁটে যদি চলে যেত আমার হৃদয় …।’’
‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য’কে তো লিখেইছিলেন , আরও অনেককেই মৌখিক ভাবে জানিয়েছিলেন জীবনানন্দ যে তিনি আত্মজীবনীতে হাত দিতে চান। তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যকর হলেই। সেটা আর হয়নি। এক, শরীর ঠিক জুতে আসে নি। আর দুই, হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় বালিগঞ্জগামী ট্রামটা এসে পড়েছিল তাঁর গায়ের ওপর। অথচ ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ তিনি নিয়মিত ‘লিটারারি নোটস’ নামে দিনলিপি লিখে গিয়েছিলেন। লিখেছিলেন ইংরেজিতে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গল্পের প্লটলাইন ধরে রাখতে। মাঝে মাঝে বাংলাও মিশে গেছে ক্রমশ ডায়েরি হয়ে ওঠা খাতাগুলোয়। জীবনানন্দের ইংরেজিতে ডায়েরি লেখা নিয়ে যাঁরা কিছুটা চমকিত সেগুলো প্রকাশ্যে আসায় আরওই চমৎকৃত হয়েছিলেন আরেকটি তথ্যে। কবি ১৯১৬-য় কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ইংরেজিতে!
ডায়েরির ইংরেজির স্টাইলটাকে বলা যায় ‘টেলিগ্রাফিক’। গল্পের ভাবনার বাইরে যে দিনের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় তা বড়ই মর্মান্তিক, পড়তে পড়তে মনে ভেঙে যায়। কর্মহীন জীবনের দৈনন্দিন বিড়ম্বনার ধারাবিবরণী। সদ্য বিবাহিত জীবনে সুখের অভাবেরও ইঙ্গিত এসে পড়ছে থেকে থেকে। মনে হচ্ছে এ বিবাহ না হলেই ভাল ছিল। পথে-ঘাটে কোনও মেয়েকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে কোনও গ্রাম্য কিশোরীর মুখ এবং উন্মনা হচ্ছেন। কবির কষ্টের ইঙ্গিত দিতে তিনটে ছোট্ট এন্ট্রির উল্লেখ করা যেতে পারে।
২৭. ৭. ৩১-এর পাতায় তিনি লিখেছিলেন – ‘‘দুপুরটা কাটল চাকরির আবেদন লিখে লিখে ডাকে পাঠাতে, খেলা দেখে যে একটু আরাম স্বস্তি পাব তা আর কপালে নেই: জীবন থেকে বহু কিছুই উবে গেছে।’’ তার পর লিখেছিলেন – ‘‘ঢ্যাঁড়শই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। একই সঙ্গে মাধুর্য ও পরিহাস।’’ লিখেছিলেন – ‘‘বেজায় গরম, ঘুমনো গেল না। একবারটি চায়ের দোকান হয়ে আসতে হবে, তবে তিন পয়সার বেশি খরচের মুরোদ নেই। অভাবে থেঁতলে দিচ্ছে, ভাবছি খবরের কাগজ রাখা বন্ধ করে দেব।’’
এছাড়া ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী’ পঙ্ক্তিটির রচয়িতা ৯.৮.৩১ তারিখের রোজনামচায় তিক্ততা ঝরিয়ে লিখেছিলেন – ‘‘চাকরি নেই, লোকে প্রশ্ন করছে, ‘বসে আছ?’ …’’ … ‘‘… on ‘বসে থাকা’ – বেকার কখনও বসে থাকে না – they stand and run, throb and palpitate; it is only the well-placed who have the external charm of the easychair or cushions, sofas and bed for themselves.’’
শেষ বয়সে কবি যে-আত্মজীবনীর কথা ভাবছিলেন তাতে কি দিনলিপির এত শোকশোচনার পূর্ণ বয়ান থাকত? আমরা জানি না, অনুমানও করতে পারি না, তবু একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়, এত রক্তক্ষরণ যে-হৃদয়ের, তিনিই তো লিখে রেখে গিয়েছিলেন, ‘তার স্থির প্রেমিকের নিকট’ নামের কবিতায় –
‘‘বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই – আমি বলি না তা
কারও লাভ আছে – সকলেরই – হয়তা বা ঢের
ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে
পেয়েছি ধবল শব্দ – বাতাসতাড়িত পাখিদের।’’
কবির যে দুটি বিখ্যাত বই দিয়ে বাঙালি পাঠকের সাধারণত পরিচয় ঘটে ওঁর সঙ্গে সেই ‘বনলতা সেন’ বা ‘রূপসী বাংলা’ পড়ে তাঁদের ধারণায় আনাও কঠিন কবির ব্যক্তিজীবনের ওঠাপড়া। অথচ নিয়তি এমন যে, এক সময় ওঁর জীবনের সঙ্গেই মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ার প্রয়োজন হয় তাঁর কবিতা। শুধু কাব্যোপভোগের জন্যই নয়, এক আধ্যাত্মিক আরাম ও দার্শনিক সুকৃতি অর্জনের জন্য। শুধু তাঁর কবিতা পড়ে এক আশ্চর্য জীবনানন্দকে জানা হয়; আর ওঁর জীবন ও কবিতা পাশাপাশি ও মিলিয়ে পড়লে এক পরমাশ্চর্য জীবনানন্দকে আবিষ্কার করে ফেলা যায়। আর এখানে তুলনাটা খুব সহজেই এসে পড়ে তাঁর প্রিয় কবি ‘জন কিটস্’-এর। প্রকৃতি, নির্জনতা, মৃত্যু ও অন্ধকারের প্রতি দু’জনেরই স্বভাবটান। কিন্তু নক্ষত্র, আকাশ, সমুদ্র, নাবিক ও অভিযান যে ভাবে বেঁধেছে দুই কবির দুই সেরা কবিতাকে তা কলেজের প্রথম বর্ষে আবিষ্কার করে যে-হিল্লোল জেগেছিল ভেতরে সে-রোমাঞ্চ আজও ছেড়ে যায়নি অর্ধশতাব্দী পরেও। কিটসের কবিতা ‘‘On First Looking into Chapman’s Homer’’ একটি চতুর্দশপদী, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ দ্বাদশ পদে ধরা। প্রথমে কিটসের প্রথম চার লাইন –
‘‘Much have I travel’d in the realms of gold,
And many goodly states and kingdoms seen;
Round many western islands have I been
Which bards in fealty to Apollo hold.’’
এর পর জীবনানন্দের প্রথম চার পঙ্ক্তি –
‘‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;’’
এর পর জীবনানন্দের শেষ ক’টি পঙ্ক্তি –
‘‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’’
এ বার কিটসের সেই শেষ কটা অবিস্মরণীয় লাইন –
‘‘Then felt I like some watcher of the skies/When a new planet swims into his ken;
Or like stout Cortez when with eagle eyes
He star’d at the Pacific – and all his men
look’d at each other with a wild surmise –
Silent, upon a peak in Darien.’’
আত্মজীবনী লেখা না হলেও নিজের বাবা ও মা’কে নিয়ে সুন্দর একটা প্রবন্ধ রেখে গেছেন জীবনানন্দ, যার শিরোনামাটিও সরল— ‘আমার মা বাবা’। এর শুরুটাও সরল – ‘‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ ১৩ … সালে ২১শে পৌষ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাঝে মাঝে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন মনে পড়ে। তার পরে কলেজে উঠেও তাঁকে কোনো কোনো সময় তাঁর নিজ জীবন ও নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা ভাবনা লিখে রাখতে দেখেছি। সে সব লেখা কোথায় তিনি রেখে দিয়েছিলেন— কিংবা নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছেন কিনা কিছুই জানি না। তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোনো লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। এখন সে সব কবিতাও খুঁজে পাচ্ছি না।’’
এই মায়ের ওপর নির্ভরতার একটা মিষ্টি ছবি আছে ছাত্রাবস্থায় হার্ডিঞ্জ হস্টেলে থেকে তাঁকে লেখা জীবনানন্দের একটি চিঠিতে। লিখেছিলেন – ‘‘Golden Treasuryটা পাঠাইতে লিখিয়াছিলাম, পাঠাইয়া দিও। আমার Hostel ও Law College-এর টাকা এখনও আসিতেছে না কেন? তা ছাড়া বইর জন্য ৫০ টাকা পাঠাইতে হইবে। … Paradise Regained আমাদের পাঠ্য। আগে কিনি নাই। আজকাল তো পাওয়া যাইতেছে না। জিতেন মুখার্জ্জীর বইটা থাকিতে পারে। ভুবন যদি তাহার নিকট হইতে সেই বইটা এবং Scott-এর নভেলের তিনটা (Kenilworth, Old Morality, Talisman) লইয়া আসে তাহা হইলে ভাল হয়।’’
নিজের বাবা সম্পর্কে জীবনানন্দের বিচারটা এমন ছিল – ‘‘একমাত্র জ্ঞানযোগই যে বাবার অন্নিষ্ট ছিল সে কথা সত্য নয়; কিন্তু মধ্যবয়স পেরিয়েও অনেক দিন পর্যন্ত সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান এমনকি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চায় তাঁকে প্রগাঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি মানুষের জীবন ও চরাচর সম্বন্ধে যত দূর সম্ভব একটা বিশুদ্ধ ধারণায় পৌঁছবার জন্যে, নিজের হিসেবে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। উচ্ছ্বাস দেখিনি কখনো তাঁর, কিন্তু জীবনে অন্তঃশীল আনন্দ স্বভাবতই ছিল – সব সময়ই প্রায়। কিন্তু গদ্য লেখা ছাড়া বাবা সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেননি, কিন্তু পাঠ করেছিলেন অনেক, আলোচনার প্রসারে ও গাঢ়তায় আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন – দৃষ্টি তিনিই খুলে দিয়েছিলেন।’’
নাতিদীর্ঘ এই রচনা থেকে জীবনানন্দের চিন্তা ও চলনের উৎসমুখ শনাক্ত করা অসুবিধের না। এই প্রবন্ধ এবং ‘লেখার কথা’, ‘কেন লিখি’, ‘কবিতা সম্পর্কে’ শীর্ষক রচনাত্রয়ী এবং ওঁর চিঠিপত্র, দিনলিপি ও কবিতার বইগুলো মিলিয়ে পড়লে কবির একটা আত্মজীবনী পড়া হয়ে ওঠে।
বোন সুচরিতা দাশের বিবরণে জানা যায় কী ‘ভীষণতম হিংস্র দুর্দিন’ ঘনিয়ে আসায় সাধের বরিশাল ছাড়তে হয়েছিল কবিকে। কিন্তু তাতেও তাঁর ‘এষণাশক্তি, ভাবনাপ্রতিভা, mother wit’ (কথাগুলো কবির থেকেই নেওয়া) বিস্রস্ত হয়নি এতটুকু। সুচরিতা লিখেছিলেন – ‘‘বাইরে থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁরা তাঁকে গম্ভীর নির্জন, স্বপ্নালোকবাসী বলেছেন, বলেছেন সর্বক্ষণ একটা অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করে তাঁর নিজের চারিদিকে তিনি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতেন। … যে মানুষ অত গুরুগম্ভীর কবিতা লিখতেন, তিনি যে অমন চারিদিক উচ্চকিত করে প্রকম্পিত হাসি হাসতে পারতেন, বা অন্যকেও হাসিয়ে হাসিয়ে ক্লান্ত করে দিতে পারতেন, তা যেন না দেখলে বিশ্বাস করাই যায় না।’’
জীবনানন্দের যাবতীয় রচনার সাক্ষ্যে একটা ভয় কিন্তু থেকে যায়। তা হল আত্মজীবনীটা লিখে ফেললেও নিজের witty, কৌতুকপ্রিয় সত্তাটাকে সেখানে মেলে ধরতেন কিনা। এখানেও তুলনাটা এসে পড়ে অন্য নির্জন কবি কিটসের। যাঁর চরিতের জীবনোচ্ছল ছবিগুলোর জন্য নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক ও জীবনীকারদের বৃত্তান্তে। আমাদের সৌভাগ্য জীবনানন্দের এরকম একজন ছিলেন ‘অরবিন্দ গুহ’, যিনি ‘অগ্নিমিত্র’ নামে চমৎকার রসরচয়িতা হয়েছিলেন পরে। তাঁর বর্ণিত জীবনানন্দের কতিপয় রসিক ছবির একটি দিয়ে শেষ করা যাক – ‘‘সিনেমায় গান লেখার ব্যাপারে একদা জীবনানন্দ কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছেন, তিনি আমাকে এক দিন জিজ্ঞেস করলেন – সিনেমায় গান লিখলে নাকি অনেক টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এ বিষয়ে? আমি জানি না এমন কোনো বিষয় জগতে নেই, আমি সর্বজ্ঞ – আমার নিজের মতে। সর্বজ্ঞের গলায় বললাম – হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সিনেমায় গান লিখলে অনেক টাকা পাওয়া যায়। তিনি বললেন- আমি লিখতে পারি না? বললাম – নিশ্চয়ই পারেন। তিনি বললেন – আমাকে কী করতে হবে? বললাম – বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের খুব নামডাক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? জীবনানন্দ বললেন – খুব ভালো। আমি বললাম – তা হলে আর কী কথা? তাঁকে বলুন। উনি অনায়াসে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। দিন কয়েক বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম – প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছিলেন? জীবনানন্দ বললেন – না, এ বার করে ফেলব। ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেছি – সর্বজ্ঞের অনেক দায়। আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। বললাম – প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে …। জীবনানন্দ বললেন – না, এখনও ঠিক হয়নি, কিন্ত এ বারে আর দেরি করব না। বললাম – থাক, এ ব্যাপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? জীবনানন্দ বললেন – খুব ভালো। আমি তুড়ি মেরে বললাম – তা হলে আর কথা নেই। ওঁকে বলুন সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে ওঁর দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে। জীবনানন্দ আগ্রহী হলেন – কী কথা? বললাম – প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না। এই অবস্থায় … আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জীবনানন্দ বললেন – বুঝেছি, আর বলতে হবে না। আমি শিগগিরই শৈলজাকে বলব। বললাম – ঠিক আছে। দশ-বারো দিন বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে এক দিন। নির্ঘাত শৈলজানন্দের সঙ্গে কথা বলেছেন? জীবনানন্দ বললেন – না, তোমার সঙ্গে কথা আছে। বলে আমাকে নিয়ে গেলেন ফুটপাথের এক পাশে। সেখানে সাবধানে গোপন কথা বললে আর কারও শোনার আশঙ্কা কম। বললেন – শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জান? বললাম – না। কেন? খুব হতাশভাবে বললেন – যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তা হলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাধে-এ-এ-এ ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়’। এখনো আমার মনে গেঁথে আছে চোখমুখের সকৌতুক ভঙ্গির সঙ্গে জীবননান্দের গলায় – রাধে-এ-এ-এ … বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, ইহজন্মে সিনেমার গান লেখার সৌভাগ্য জীবনানন্দের হয়নি।’’
মৃত্যুশয্যায় এই জীবনানন্দকে দেখে অরবিন্দর মনে হয়েছিল যেন নীচের ঠোঁট কামড়ে দুরন্ত হাস্যস্রোতকে ঠোঁটের ওপারে বন্দি করে রেখেছেন। হয়তো খানিক আগেই সেই নিজস্ব হাসি হেসেছেন। নাকি একটু পরেই হেসে উঠবেন প্রচণ্ড শব্দে?
জীবনানন্দ ব্যক্তিগত জীবনে ত্রস্ত ছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু কোথাও তাঁর একটা স্থির বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রও ছিল! হয়তো সে বিশ্বাসে শাণিত তরবারির স্পর্ধা ছিল না। কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল ফসলসম্ভবা মাটির মতো নরম অথচ ঋজু। না হলে তাঁর বিরুদ্ধে যখন লাগাতার ধূসর, পলায়নকারী মানসিকতা, দুর্বোধ্য, বিশেষণগুলি (নেতিবাচক অর্থেই) ক্রমাগত ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন কেন বলবেন, ‘‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয় …’’ অথবা ‘ক্যাম্পে’ কবিতার অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে কেন লিখবেন, ‘‘যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তা জীবনের – মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর।’’ কর্মজীবন টালমাটাল হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, ‘‘যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?’’ এই উচ্চারণের জন্য তো স্পর্ধা লাগে, সাহসও। যেমন ভাবে বিশ্বাস লাগে এই সারসত্যটুকু বলতে, ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।’ এই নিষ্কম্প বিশ্বাস তাঁর কলকাতার উপরেও ছিল। এমনিতে ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবন, ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে এবং আবার কলকাতায় ফেরা পর্যন্ত, এ শহরে তাঁর আবাস-মানচিত্রে ছিল কখনও মেস, কখনও অশোকানন্দের বাড়ি, কখনও ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়ি। কর্মজীবনে টালমাটাল মুহূর্তে অন্য জায়গায় চাকরির সুযোগ হচ্ছিল, কিন্তু তবু তিনি যাচ্ছিলেন না বলে সাম্প্রতিক অতীতে জানিয়েছিলেন অশোকানন্দ পুত্র অমিতানন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘অসমে, পঞ্জাবে ও অন্যত্র চাকরি হলেও কলকাতা ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না!’’ দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায় ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেয়েছিলেন। ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সাল নাগাদ কিছু দিন খড়্গপুর কলেজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে শহরে ফিরে কখনও বড়িশা কলেজ, ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজে কাজ করেছিলেন। আর শহর ছেড়ে যাননি! এ শহরও তখন তাঁকে আস্তে আস্তে চিনছিল। তত দিনে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল (যদিও সব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে তখনও দেড় হাজারেরও বেশি কবিতা, উপন্যাস, গল্প)। স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন তিনি, জুটছিল পুরস্কারও। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি, আর বুদ্ধদেব বসুর মতো যাঁরা ভাষাবিন্যাসে অচলায়তন ভাঙার সমর্থক ছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি তো তখন রীতিমতো আবিষ্কার! তাই শহরের সমস্ত সাহিত্য আলোচনায়, কবিতাপাঠে তিনি আমন্ত্রিত হতেন।
কিন্তু তার পর সে দিন! ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর। আগের দিনই রেডিয়োয় ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। তা নিয়ে সে দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তার পর প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁটা যে তাঁর অভ্যেস ছিল। ও পার বাংলায় বাল্যকালের সেই স্টিমারের জেটি। কিছুটা দূরে ঝাউয়ের সারি। লিচু, অজস্র ফুল-ফল সমারোহে বিশাল কম্পাউন্ড নিয়ে ব্রাউন সাহেবের কুঠি। সে সব পার হয়ে ব্রাহ্ম সমাজ সার্কিট হাউসের গির্জা, তা ছাড়িয়ে গেলে শ্মশানভূমি, লাশকাটা ঘর। সে সব পথ হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘ দেখে বালক জীবনানন্দ ভাইকে বলতেন, তিনি একটা মনপবনের নৌকা তৈরি করবেন। সে দিনও কি জীবনানন্দ আকাশে মেঘ দেখে মনপবনের নৌকার কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর জখম জীবনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন অপরিচিতেরা। সেখানেই আট দিনের লড়াই -মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে।’
(তথ্যসূত্র:
১- জীবনানন্দ: স্বাতন্ত্র্য সন্ধান, পঞ্চানন মালাকর, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।
২- জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, হরিশংকর জলদাস, অবসর প্রকাশনা সংস্থা।
৩- জীবনানন্দ দাশ: বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
৪- কবি জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, কবি প্রকাশনী।
৫- অনন্য জীবনানন্দ: জীবনান্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী, ক্লিন্টন বি সিলি, প্রথমা প্রকাশন।
৬- বিমূঢ় বিস্ময় জীবনানন্দ দাশ, রকিবুল হাসান, সমাচার।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত