গুরু দত্তের ‘ছায়াসঙ্গী’ ছিলেন লেখক-পরিচালক ‘আব্রার আলভি’। পরিচারককে বাদ দিলে, গুরু দত্তকে শেষ ‘জীবন্ত’ দেখেছিলেন এই ‘আলভি’-ই। ১৯৬৪ সালের ৯ই অক্টোবর রাতে গুরু দত্তের বাড়িতে ছিলেন শুধু তিনিই। দু’বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে বার বার দেখতে চাইছিলেন গুরু। কিন্তু গীতা কিছুতে পাঠাতে রাজি ছিলেন না। পর দিন সকালে, তিন বারের বার, গুরু দত্তের ‘আত্মহত্যার চেষ্টা সফল’ হয়। তিনি যখন মরণঘুমে গেলেন, গীতা কী যেন বুঝে পাগলের মতো ফোন করেছিলেন। পর দিন ছিল ‘মহাপঞ্চমী’। বেলা বাড়লে গুরু দত্তের চিতায় গীতারও অনেকখানি ছাই হয়ে গিয়েছিল। এর পরের প্রায় এক বছর নিজের তিন সন্তানকেও তিনি চিনতে পারতেন না। অনেকে বলেন ‘কাগজ কে ফুল’ সিনেমার এই গল্পই সত্যি হয়ে উঠেছিল পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা গুরু দত্ত এবং তাঁর স্ত্রী গায়িকা গীতা দত্তের জীবনে। সিনেমাটি শুরু হয় একটি গান দিয়ে, ‘বিছড়ে সাভি বারি বারি’ যার বাংলা করলে দাড়ায়, ‘একে একে সবাই ছেড়ে গেলো’ – এ গানটি গুরু দত্তের জীবনের নিদারুণ সত্য হয়ে ওঠে।
‘বসন্তকুমার শিব শংকর পাড়ুকোন’ – নামটা কেবল বার্থ সার্টিফিকেটেই রয়ে গেল ৷ কিন্তু গুরু দত্ত নামটাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের৷ গুরু দত্ত ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি সিনেমাস্কোপে শ্যুট করেছিলেন৷ অভিনেতার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, সবে হাঁটতে শিখেছিলেন ছোট্ট বসন্ত, খেলতে খেলতে একবার চলে গিয়েছিলেন কুয়োর ধারে৷ সেই সময় তাঁর ঠাকুমা এসে না বাঁচালে সেটাই হত তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত৷ সেই সময়ের ফাঁড়া কাটিয়ে উঠতে পারলেও ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর মাত্র ঊনচল্লিশ বছরে মৃত্যুর ফাঁড়া কাটাতে পারেননি তিনি৷ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ফিল্মি দুনিয়ার থেকে কম ছিল না৷ গুরু দত্তের মৃত্যু নিয়ে একটা সময় তোলপাড় হয়েছিল বলিউড৷ চলচ্চিত্র পরিচালক তথা অভিনেতার মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা! গুরু দত্তের ছোট ভাই ‘দেবী দত্ত’ বিশ্বাস করতেন গুরু দত্ত আত্মহত্যা করেননি৷ জীবনের একটা সময়ে এই অভিনেতা ও পরিচালক মানসিক অবসাদে ভুগতেন৷ সেই কারণেই ঘুমের ওষুধ খেতেন তিনি৷ দেবী দত্তের দাবি ছিল, তাঁর ভাই নিজের প্রাণ নেননি৷ অতিরিক্ত ঘুমের ওধুষ খাওয়ার কারণেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছিলেন অভিনেতা৷ দেবী তাঁর দাদার সঙ্গে দীর্ঘ এগারো বছর কাজ করেছিলেন৷ তাই এতটা বিশ্বাস নিয়ে তিনি এ কথা বলতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগের দিনও স্বাভাবিক এবং সুস্থ অবস্থায় ছিলেন গুরু দত্ত৷ ‘বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গি’ ছবির সেটে দেবীর সঙ্গেই ছিলেন তিনি৷ শ্যুট শুরু হতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি ছিল৷ হঠাৎই ছবির একজন মুখ্য অভিনেতা শ্যুট ক্যানসেল করায় বেশ রেগে গিয়েছিলেন তিনি৷ পরের দিন শ্যুট ক্যানসেল হওয়ার কারণে দেবী এবং গুরু দত্ত কেনাকাটা করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ কোলাবা থেকে নিজের দুই ছেলে অরুন এবং তরুনের জন্য তিনি জামাকাপড় কিনে ফিরে এসেছিলেন৷ কেনাকাটার পর একসঙ্গেই গুরু দত্তের অ্যাপার্টমেন্টে সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ ফিরে এসেছিলেন তাঁরা৷ মুম্বাইয়ের পেডার রোডের সেই ফ্ল্যাটে তখন একাই থাকতেন গুরু দত্ত।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘ভাব-গায়কির পাটরানি’ ‘গীতা দত্ত’কে বুঝতে হলে, ‘গুরু দত্ত’কে জানতে হবে। আর ‘গুরু দত্ত’কে জানতে গেলে ‘গীতা দত্ত’কে জানা অবশ্যই দরকার। আবার ‘গুরু দত্ত’কে জানতে গেলে তাঁর ‘চলচ্চিত্র’ বুঝতে হবে। ‘ক্লাসিক নোয়া’ ধারার ‘বাজি’ দিয়ে গুরু দত্ত ছবি পরিচালনা শুরু করেছিলেন। ‘এস ডি বর্মণ’ ‘বাজি’ সিনেমায় একটি গজলে পরিয়ে দিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের ঝংকার।
‘‘সেই গানটাই হল ‘তদ্বির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বনা দে’। লিপ দিয়েছিলেন গীতা বালি। ‘বাজি’র মহরত শট। ভাইয়ের প্রথম ছবি। উনি আমাদের বাড়ির সকলকে নিয়ে গিয়েছিলেন মহালক্ষ্মী স্টুডিয়োর মহরতে।’’ – গুরু দত্তের ছোট বোন, চিত্রশিল্পী ‘ললিতা লাজমি’ এমন ভাবে স্মৃতিগুলো সংবাদমাধ্যমের সামনে পরে পড়েছিলেন যেন তিনি চোখের সামনে ফেলে আসা সেই দিনগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন। ‘‘গীতাদিদি তখন আঠেরো। বিরাট স্টার। নানা ভাষায় প্রায় ন’শোটা গান গেয়ে ফেলেছেন। গলা তো মধুতে ডোবানো। নিখুঁত নাকমুখ। হরিণের মতো চোখ। আমার মা বাসন্তী পাড়ুকোন সে দিনই ওঁকে বাড়িতে আসতে বললেন। ওই গানটা যেন ভাইয়েরই ভাগ্যটা বদলে দিল।’’
‘‘গীতাদিদি লিমুজ়িনে চেপে আমাদের বাড়ি আসত। এসেই কোমরে শাড়ি গুঁজে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত। আনাজ কাটছে, গান শোনাচ্ছে। চিরকাল এমন ভার্সেটাইল। অগাধ ক্ষমতার অধিকারী। ওর কূল পাওয়া যায় না। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে হলেই আমার নাম বলে দিত। ওই লালি-র সঙ্গে বেরোচ্ছি। আমি ছিলাম ওদের চিঠি বওয়ার লোক।’’
দুই বাড়িই যে বাধা দিচ্ছিল সম্পর্কে। ‘কোঙ্কনি পরিবারের ছেলে’, সিনেমা করার চেষ্টা করে। সব দিক দিয়ে নাকি তাঁকে গীতার ‘অযোগ্য’ মনে করতেন ‘রায় পরিবার’। ‘ব্রাহ্মণ-কায়স্থ’ বিয়েতে ‘পাড়ুকোন’রাও একটু খুঁতখুঁত করছিলেন। ‘রায় পরিবার’ এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে গীতার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন। গীতা নাকি সেই যুবকটিকেও ‘আশকারা’ দিয়েছিলেন। কানে আসতে ছটফট করে উঠলেন গুরু দত্ত। এক দিন রাস্তাতেই গীতাকে আটক করলেন। গীতা দত্ত তাঁকেই কথা দিলেন। গীতার ছোট ভাই ‘মিলন রায়’ আজ চোখ বুজলেই সেই গোধূলি লগ্ন দেখতে পান। সংবাদমাধ্যমে তিনি পরে জানিয়েছিলেন – ‘‘১৯৫৩-য় ওই বিয়ে ছিল ‘বিগেস্ট ওয়েডিং এভার’। দু’মাইল গাড়ির লাইন। বৈজয়ন্তীমালা, নূতন, রফি সাব, লতা, পি সি সরকার, গীতা বালি … কে আসেননি!’’ সেই রূপকথার রাত ভোলেননি ‘ললিতা লাজমি’ও। তিনি জানিয়েছিলেন – ‘‘সবচেয়ে বেশি মনে আছে কনেকে। লাল বেনারসি, ওড়না, এক গা গয়না, কপালে চন্দন। ভাই পরেছিলেন সিল্কের ধুতি-পাঞ্জাবি। অল্প বয়সের দুটি ছেলেমেয়ে। সাতাশ আর একুশ। কী যে সুন্দর দেখতে হয়েছিল! খুব সুখী লাগছিল ওদের।’’
সুখ হল ‘পদ্মপাতায় জল’। বিয়ের কিছু দিন পরেই গুরু দত্ত নিজের ‘হোম প্রোডাকশন’ ছাড়া স্ত্রীর অন্যত্র গাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। গীতার গলায় তখন ‘যৌবনের ফাগুন’। তাঁর এগিয়ে যাওয়ার সময়। তখনই তাঁর পায়ে ‘দত্ত’ পদবির বেড়ি। প্রথমে অবশ্য ‘শাপে বর’ হয়েছিল। গুরু দত্তের ছবিতে গান নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এক চরিত্র। সে দ্রুত লয়ে কাহিনির বাঁক ঘোরায়, নায়কের সিদ্ধান্তে অনুঘটকের কাজ করে, দেখা দেয় লাস্যময়ী সুন্দরীর রূপে। ‘রাত নশিলি রং রঙ্গিলি’, ‘বাবুজি ধীরে চলনা’, ‘জানে কহাঁ মেরা জিগর গয়া জি’ গাইবার সুযোগ পেয়ে প্রতিভাকে বিকশিত করার সুবিশাল হরিৎক্ষেত্র পেয়েছিলেন গীতা।
কিন্তু গীতা আর গুরু স্বভাবে ছিলেন ‘সম্পূর্ণ বিপরীত’। সংসারজীবনে সেটাই চড়া ফাঁকের সৃষ্টি করেছিল। গীতা এই রাগতেন, আবার হিহি হাসতেন, তার পরই একটুতেই কাঁদতেন। ঠিক নিজের গানগুলোর মতো। তাঁর সব অনুভূতি ছিল একটু উচ্চগ্রামের। অন্য দিকে গুরু দত্ত ছিলেন ‘আত্মমগ্ন’ মানুষ, দিবারাত্র নিজের সেই নোয়া-পৃথিবীতে বুঁদ। ‘উল্লাস’ পছন্দ করতেন না। যে গুরু দত্তের সঙ্গে প্রায়ই পিকনিকে গিয়ে ভীষণ মজা করতেন গীতা ও গোটা পরিবার, হাতে সিনেমার সংখ্যা বাড়তেই তিনি ‘অন্য মানুষ’ হয়ে গিয়েছিলেন। কেবলই কাজ। গীতার থেকে আর একটু ‘গিন্নিপনা’ আশা করতেন। এ দিকে জীবনকে চেটেপুটে না চাখলে ‘বোহেমিয়ান’ গীতার গান আসত না। গীতার ভাই ‘মিলন রায়’ বলেছেন – ‘‘তিন-চার ঘণ্টা রেওয়াজ করত রাঙাদি। গলা বাঁচিয়ে চলত। টক, আইসক্রিম খেত না। বরাবরই আশ্চর্য সব ক্ষমতা ছিল। বিদ্যুতের গতিতে গান তুলতে পারত। দিনে ছ’টা গানও রেকর্ডিং করেছে। হয়তো ছ’টা গানই স্বতন্ত্র। রাঙাদির কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। কথাশিল্পীর সঙ্গে শব্দ নিয়ে কিছুক্ষণ বসত। তার পর বার কয়েক রিহার্সাল করেই টেক! এর পরেই হয়তো আমাকে স্কুল থেকে তুলে নিয়ে প্রিমিয়ারে ছুটল। কী ভীষণ ‘লাইফ’ ছিল ওর মধ্যে।’’
কথা ওড়ে। সংসার-সন্তানে আটকে যাচ্ছিলেন গীতা। মধুর-সঙ্গীতে তাঁর পাশাপাশিই লতা মঙ্গেশকরের জায়গাটাও জমাট ছিল। দিদির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তুলনায় আশাই বরং একটু কাঁচা মাটিতে ছিলেন। এমন দিনে গীতা হঠাৎ পশ্চিমে হেলতে, সুরকাররা আশাকেই আবার ডাকছিলেন।
তখন ‘ও পি নাইয়ারের’ সঙ্গে আশার ‘আন্তরিক সম্পর্কের গুঞ্জন’ ফিল্ম-মহল্লায়। এই ‘ও পি নাইয়ার’কে গুরু দত্তের সঙ্গে ‘আলাপ’ করিয়ে তাঁকে ‘ব্রেক’ দিয়েছিলেন গীতাই। চিরকালের ‘বিতর্কিত’ ও পি ‘কৃতজ্ঞতা’ নিয়ে মাথা ঘামান নি। তাঁর যা ভাল লাগত তাই করতেন। গীতার গলায় তাঁর সৃষ্টি ‘যাতা কহাঁ হ্যায় দিওয়ানে’ তখন সকলে গোপনে শুনতেন। কারণ ওই আবেদনকে ‘হজম’ই করতে পারেনি ‘পঞ্চাশের সমাজ’। ভীষণ ‘শরীরগন্ধী’ বলে সে গানকে ‘নিষিদ্ধ’ করে দিয়েছিল ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’। অনেক সমালোচনাতেও ও পি নিজেকে বদলাননি। তিনি দেখেছিলেন, গীতার ‘মাদক-স্বর’ই তাঁর প্রয়োজন। কিন্তু গীতার ‘অনেক বাধা’ ছিল। কাজেই অন্য কাউকে দিয়ে গাইয়ে নিলেই হয়। আশা খাটতে প্রস্তুত ছিলেন। পরে তিনি নিজেই এ কথা ‘স্বীকার’ করেছিলেন। বলেছিলেন, আশার প্রতি ‘পক্ষপাত’ করে তিনি গীতার প্রতি ‘অন্যায়’ করেছিলেন।
‘গুরু দত্তের শর্ত’, ‘সংসার ও সন্তানের অগ্রাধিকার’ শিরোধার্য করেও সুরকাররা ঠিক একটি করে গান গীতার জন্য তুলে রাখছিলেন। সেই গানই সিনেমার ‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠত। এই রাস্তাতেই ‘গীতা-ও পি’-র জুটি ফিরেছিল ‘শক্তি সামন্তের’ ‘হাওড়া ব্রিজ’-এ। ‘ভায়োলিন’, ‘ড্রামবাদ্য’, ‘হেলেনের তুফান-নৃত্য’ সব থাকলেও, সে গান আজ এত দূর আসতই না, যদি না গীতা তাঁর ‘রঙিন স্বর’টি ছোঁয়াতেন।
সুরকারের ‘দাক্ষিণ্যে’, লোকে বলে ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’, ভ্যাম্পের বদলে ‘হিরোইনের কণ্ঠের গান’ পেতে শুরু করলেন আশা। আর ‘সিনিয়র’ গীতার কপালে জুটতে লাগল ‘নর্তকীর গান’! ‘আইয়ে মেহেরবান’ গেয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আশা ভোঁসলে ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু ওই এক ‘ক্যাবারে গানে’ই মাত করলেন গীতা। আশার গান মুগ্ধ করল, গীতার গান শিরা-উপশিরার রক্ত চঞ্চল করে দিল। পরে এক সাক্ষাৎকারে ‘হাওড়া ব্রিজ’-এর অমোঘ ক্যাবারেটি প্রসঙ্গে ‘হেলেন’ বলেছিলেন, ‘‘দিদি আগুন লাগিয়ে দিতেন গানে। শটে আপনিই আমার সেরাটা বেরিয়ে আসত! কেয়া শোখি, জজবাত, অদা, নজাকত!’’
এই কালজয়ী ‘চিন চিন চু’ ‘গীতা-ও পি জুটি’-র শেষ গান! ‘ও পি নায়ার ক্লাসিকস’-সংকলনে আশা ভোঁসলের গান ৮১। আর গীতা দত্ত জ্বলজ্বল করছেন মাত্র ১৮টি রত্নের জৌলুসে। ‘হিটের স্ট্রাইক-রেটে’ অনেক অনেক এগিয়ে গীতা দত্ত।
এ ভাবেই যখন তিনি ‘শেষ’ হয়ে গিয়েছেন বলা হয়েছে, ‘আসমুদ্রহিমাচল কাঁপানো হিট’ নিয়ে ফিরেছেন। ‘উত্তম-সুচিত্রা-নচিকেতা-হেমন্তের’ সঙ্গে কাজ করে বাংলা গানে সোনা ফলিয়েছেন। সে সময়ে গুরু-গীতার ভুল বোঝাবুঝির ফাটলে জমছিল ‘সন্দেহের কালো মেঘ’। তৎকালীন ‘গসিপ কলাম’ লিখেই দিয়েছিল, ‘ওয়াহিদা রহমান’ গীতা দত্তের সংসারে ‘সাপ’ হয়ে ঢুকেছেন। গুরু দত্ত ছবি করায় ‘মন বসাতে’ পারছিলেন না। অন্য দিকে সুরকারদের ‘ধৈর্য ভাঙছিল’। গীতা দত্ত রিহার্সালেই আসছিলেন না। এর পর তাঁর গান আশার কাছে কেন চলে যাবে না? আশাই বা কেন সে সুযোগ হারাতে দেবেন? স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ‘প্রবল সুরাসক্ত’ ছিলেন। অষ্টপ্রহর চলছিল ‘বিষপান’।
গুরু দত্তের ‘ছায়াসঙ্গী’ লেখক-পরিচালক ‘আব্রার আলভি’ পরে বলেছিলেন, ‘‘গুরু দত্ত জিনিয়াস। জাগতিক চাওয়া-পাওয়া বোঝেন না। হয়তো ওয়াহিদা রহমানের মধ্যে তিনি কোনও ‘মিউজ’ পেয়েছিলেন। এই যেমন, ‘পিয়াসা’-য় ওয়াহিদা রূপোপজীবিনীর চরিত্র করবেন। কিন্তু নিজে কখনও এমন মহিলাই দেখেননি! গুরু দত্ত তাঁকে সেই পাড়ায় নিয়ে গিয়ে সত্যিকারের দেহপসারিণীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। সবই পরদার স্বার্থে। অথচ তার কত অপব্যাখ্যা হল! গীতা রেগে টং! ওয়াহিদার গলায় গান গাইতে চাইলেন না। গুরু দত্ত খেপে গেলেন। এ ভাবে নায়িকার গলায় না গাইতে চাইলে কম গুরুত্বপূর্ণ গানই তো জুটবে।’’ মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখিয়েছেন আলভি। বলেছেন, ‘‘গীতা দত্তও খুব সহজ মানুষ ছিলেন না। নিজেই ওয়াহিদার নাম দিয়ে ‘খুব দরকার, অমুক জায়গায় এলে ভাল হয়’ বলে চিঠি লিখে দেখা করতে বলেছিলেন। গুরু দত্ত চলে গেলেন। অমনি লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন গীতা ও তাঁর এক বোন। শুরু হল জেরা। গুরু দত্ত তিতিবিরক্ত। আবার গীতাকে ছাড়া থাকতেও পারছিলেন না। এ সবে কি শিল্প বাঁচে?’’
আলভির ‘দাবি’ করেছিলেন, ‘হুল্লোড়প্রিয়তা’ও গীতাকে ‘আর্থিক ও মানসিক ভাবে নিঃস্ব’ করেছিল। তাঁকে ঘিরে একটা ‘বিশ্রী বৃত্ত’ তৈরি হয়েছিল। গুরু দত্ত বলতেন, এঁরা গীতাকে ‘বিপথে’ নিয়ে যাচ্ছে। আলভি ‘সাক্ষী’, শুধু ‘ওয়াহিদা’ নয়, এই বন্ধুদের জন্যই এক যুবককে ঘিরে ‘তুমুল মনোমালিন্য’ হয়েছিল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।
ফিল্মপণ্ডিতদের মতে, শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের অভিনীত চরিত্রকে এক করে দেখার জন্য ইন্ডাস্ট্রির অনেক ‘ক্ষতি’ হয়েছে। ‘কাগজ় কে ফুল’-এর কাহিনি যেমন! সিনেমায় গুরু দত্তই ‘নায়ক’ ও ‘চিত্রনির্মাতা’-র ভূমিকায়! তিনি স্ত্রীকে ভুলে অভিনেত্রীতে মজেছিলেন। এই নবাগতা নায়িকা সেজেছিলেন ‘ওয়াহিদা’! বড় খেদে তাঁকে কণ্ঠ দিলেন গীতা। ‘ওয়ক্ত নে কিয়া কেয়া হসিন সিতম!’ জল্পনার ষোলো কলা পূর্ণ হল। ‘সাহিব বিবি অউর গুলাম’-এর পরিচালক ‘আব্রার আলভি’ বলেছিলেন, ‘‘ওয়াহিদার এক ভাই গুরু দত্তের সঙ্গে বোনের জোর করে বিয়ের রটনা ছড়িয়ে দেন। গুরু দত্ত কিন্তু সে ফাঁদে পা দেননি। গীতা বুঝলেন না। সেই থেকে ওয়াহিদার সঙ্গেও ভীষণ তেতো হয়ে গেল সম্পর্কটা। এই ছবিটির শ্যুটিংয়ের শেষে ওয়াহিদা-গুরুর বাক্যালাপই ছিল না।’’ তবু গুরু দত্তকে বিঁধেই চলেছিলেন গীতা। বাচ্চাদেরও সরিয়ে নিয়েছিলেন। ‘ললিতা লাজমি’ পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘ভাইকে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কোমা থেকে উঠে ‘গীতা’ ‘গীতা’ বলে চিৎকার করে উঠতেন। দুর্বোধ্য রসায়ন।’’
গুরু দত্তর জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ই জুলাই। তাঁর আসল নাম ছিল ‘বসন্তকুমার শিব শংকর পাড়ুকোন’। দক্ষিণ ভারতের ‘অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান’ ছিলেন তিনি। গুরু দত্ত ছিল তাঁর চলচ্চিত্রের ‘পর্দার নাম’। তাঁর বাবা-মা দুজনেই শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি।
কলকাতার ভবানীপুরে শৈশব কেটেছিল তাঁর। তিনি ‘বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী’ ছিলেন। বাঙালিদের মতোই বাংলা বলতে পারতেন। এই জন্যই বাঙালি নাম গ্রহণ করে হয়ে গিয়েছিলেন গুরু দত্ত।
গুরু দত্ত ছিলেন একাধারে ‘পরিচালক’, ‘প্রযোজক’, ‘চিত্রনাট্যকার’ ও ‘অভিনেতা’। এই চার ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন ‘সফল’। শুধু তাই নয় গুরু দত্ত এগিয়ে ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে। তাঁর পরিচালিত ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ ছবি দুটিকে বলা হয় বলিউডের শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম ‘সেরা সৃষ্টি’। তাঁর পরিচালিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘বাজি’, ‘বাজ’, ‘পিয়াসা’, ‘আর পার’, ‘জাল’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটিফাইভ’, ‘সয়লাব’। প্রযোজক ছিলেন ‘আর পার’, ‘সিআইডি’, ‘পিয়াসা’, ‘গৌরি’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘চৌধভিন কা চান্দ’, ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’,‘বাহারে ফির ভি আয়েগি’ ছবির। ‘অভিনেতা’ হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’ সহ বিভিন্ন ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন তিনি।
তাঁর বিবাহিত জীবন মোটেও সুখের হয়নি। পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে দারুণ গোছানো হলেও ‘ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ‘খামখেয়ালি’, ‘আবেগপ্রবণ’ ও ‘ছন্নছাড়া’ স্বভাবের। ‘ধূমপান’ ও ‘মদ্যপানে আসক্ত’ ছিলেন।
যে ‘ওয়াহিদা রহমান’কে কেন্দ্র করে তাঁর সাংসারিক জীবনে তাঁর স্ত্রী গীতা দত্তের সাথে ‘কালবৈশাখী’র সূত্রপাত, সেই ওয়াহিদা রহমানের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। ওয়াহিদা তখন তেলেগু ছবিতে অভিনয় করে খানিকটা খ্যাতি পেয়েছিলেন। এক ফিল্মি পার্টিতেই দু’জনের আলাপ হয়েছিল। সুন্দরী ও পরিশীলিত ওয়াহিদার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন গুরু দত্ত। তিনি তাঁকে মুম্বাই নিয়ে আসেন। ‘সিআইডি’ ছবিতে খলচরিত্রে সুযোগ দেন তাঁকে। এর পর ‘পিয়াসা’তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদা। ‘চৌধভিন কা চান্দ’ ছবিতে ওয়াহিদার বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেন গুরুদত্ত। তাঁদের ‘পর্দা-রসায়ন’ যেমন অনবদ্য ছিল, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও তাঁরা ছিলেন ‘পরস্পরের সেরা বন্ধু’। এটাই পরে গুরু দত্তের সাংসারিক জীবন বিষিয়ে তোলে।
‘ব্যক্তিগত জীবনের এই টানাপড়েন’ ‘নেতিবাচক ছাপ’ ফেলে গুরু দত্তের ‘ক্যারিয়ারে’। আশানুরুপ বাণিজ্যিক সাফল্যের দেখা পায় না ‘কাগজ কে ফুল’। এ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন ‘ওয়াহিদা-গুরু’ জুটি। যদিও ‘কাহিনী’, ‘পরিচালনা’, ‘অভিনয়’ সব দিক থেকে ছবিটি ছিল ‘এক অসামান্য সৃষ্টি’। কিন্তু বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে নায়িকার প্রেমের কাহিনী সে সময়ের দর্শক গ্রহণ করতে পারেনি। পরবর্তীতে অবশ্য ‘ক্ল্যাসিকের মর্যাদা’ পেয়েছে সিনেমাটি। আর ‘অনিচ্ছা সত্বেও’ এই চলচ্চিত্রে গীতা দত্তের গাওয়া ‘ওয়াক্ত নে কিয়া’ গানটি হয়ে গেছে অমর।
এ ছবির সে সময়কার ব্যর্থতা আবেগপ্রবণ দত্তকে আলোড়িত করেছিল। অন্যদিকে ওয়াহিদার ক্যারিয়ার তখন তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল সামনের দিকে। দেবানন্দের বিপরীতে তিনি তখন সফল নায়িকা। তাঁর অভিনয় যেমন ‘প্রশংসিত’ হয়েছিল তেমনি রূপের জন্যও তিনি দারুণ ‘জনপ্রিয়তা’ পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থতা ও পারিবারিক অশান্তির জেরে গুরু দত্ত হয়ে গিয়েছিলেন ‘একা’, ‘বড় একা’।
ইন্ডাস্ট্রির কেউই ভাবেন নি যে, অভিমানী গুরুদত্ত ‘আত্মহননের পথ’ বেছে নিতে পারেন। ‘একাকীত্বের হতাশা’ সম্ভবতঃ তাঁর জীবনকে ‘অসহনীয়’ করে তুলেছিল।
১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর ‘মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ’ মিশিয়ে পান করেন তিনি। ‘মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ’ ও ‘অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া’ ৩৯ বছর বয়সী এই শিল্পীর মৃত্যু ঘটায়। এর আগেও দু’বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। পরে আশা ভোঁসলে জানিয়েছিলেন যে, মৃত্যুর আগে গুরু ফোন করেছিলেন তাঁর বাড়িতে; জানতে চেয়েছিলেন গীতা সেখানে আছেন কি না। আশা ভোঁসলেই ‘শেষ ব্যক্তি’ যিনি গুরু দত্তের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। গুরু দত্তের ছেলে অবশ্য এই মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে মেনে নেননি। তাঁর মতে এটি ছিল ‘দুর্ঘটনা’।
মৃত্যুর আগে গুরু দত্ত নতুন ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং ‘পিকনিক’ ও ‘লাভ অ্যান্ড গড’ ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ‘পিকনিক’ ছিল তাঁর নিজের ছবি, যেটি শেষ করা হয়নি। ‘লাভ অ্যান্ড গড’-এর পরিচালক ছিলেন ‘কে. আসিফ’। ছবিটি প্রায় দু’দশক পর মুক্তি পায়। গুরু দত্তের পরিবর্তে সেটিতে অভিনয় করেছিলেন ‘সঞ্জীব কুমার’।
আর গুরু দত্তের মৃত্যুর পরে গীতা দত্ত? সন্তানদের মুখ চেয়ে ভাঙা টুকরোগুলো জুড়ে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। বাদ সাধল ফিল্মি দুনিয়ার স্বার্থপর সমীকরণ। গীতাকে আর ‘গাইতে ডাক দেওয়া হচ্ছিল না’। অজস্র স্টেজ শো করে, এমনকি বাংলা ছবিতে অভিনয় পর্যন্ত করে সংসার টানতে হচ্ছিল। ললিতার গভীর দুঃখের সাথে জানিয়েছিলেন, সে সময়ও কলকাতায় গাইতে গেলে কেমন তাঁর জন্য এক আলমারি শাড়ি আনতেন। প্রিয় ননদের শিশুকন্যা কল্পনা লাজ়মির জন্য আসত এক গাড়ি ভালবাসার উপহার। বিদেশনিবাসী ছোট ভাইটিকে একবেলার জন্য কাছে পেতে আচমকা প্লেনের টিকিট পাঠাতেন। স্বজনেরা দুর্জনের থেকে এই ঔদার্য আড়াল করতে বলতেন। কিন্তু দিদিটি যে গীতা দত্ত। নিজের দুঃখ ঢোঁক গিলে সয়ে গান করে নেন, কিন্তু অন্যের কষ্ট দেখতে পারেন না! সুযোগ নিয়েছিল অনেকে। তাঁর বাড়িতে তখনও চাটুকারের ভিড়। এদের সকলের ভরণ-পোষণ ভগ্নমন-ভাঙা স্বাস্থ্য গীতার কাঁধে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ লোকপ্রিয় এক পৃথুলা কৌতুকাভিনেত্রীর বিরুদ্ধে!
মিলন রায় বিষণ্ণ চিত্তে জানিয়েছিলেন, ‘‘গায়িকাদের মধ্যে সেরা সুন্দরীও আমার দিদি। গুরুদাই ওঁকে নায়িকা করে ছবি শুরু করেছিলেন। ‘গৌরী’। সেটা তুলতে পারলে আবার ইতিহাস হত।’’
একমাত্র এস ডি বর্মণই নাকি গীতার জন্য তুলে রাখা গান কিছুতে অন্যদের দিতে চাইতেন না। তিনি তাঁর এই সুর-দুহিতার জন্য একটা আলাদা সিনেমা হচ্ছে শুনেই রাতদিন এক করে দিয়েছিলেন। হাজারো কাজের ভিড়েও, এই একটি ছবি বাতিল হতেই ভীষণ ভেঙেও পড়েছিলেন। আক্ষেপ করতেন, ‘‘গীতার লগেই কম্পোজিশন। অর লগেই লিখা। অহন গানডার কী হইব!’’ সহধর্মিণীকে বলতেন, গীতা ছাড়া এ গানের জীবনবোধ কারও নেই। এই মেজাজ ধরতে হবে তো! সে তো যে কেউ পারবে না। কেবল হায় হায় করতেন তিনি।
গীতা দত্তের সংক্ষিপ্ত জীবন বেশি কষ্টের ছিল, না কি অকালমৃত্যু – তা নিয়েও তর্ক ওঠে। এই সকালে হাসপাতালে তাঁর প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসা চলছে, তো বিকেলেই তিনি স্টুডিয়োয় এসে দুষ্টু নায়িকার ‘লড়কপন’ ফোটাচ্ছেন অক্লেশে। ‘মুঝে জান না কহো মেরি জান’ বলে পঙ্ক্তিটির শেষ আখরে নিজেকে নিঃশেষিত করে দেওয়া সেই টান! রেকর্ডিংয়ে সকলে সন্ত্রস্ত। গায়িকা কুঁকড়ে গিয়েছেন, দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছেন না! তখনই খিলখিল হেসে উঠলেন তিনি। তাই নিয়েই আবার ঘুরেছিল রেকর্ড। সে হাসি কি নিষ্ঠুর জীবনকে তুচ্ছ করতে পারার ব্যঞ্জনা? এই সিনেমাটি ছিল বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’! ১৯৭১-এ মুক্তি পেতেই আবারও দিকে দিকে শুরু হয়েছিল গীতাবন্দনা। তখনও আশা ছিল।
ঠিক পরের বছর। বয়স মাত্র ৪১। ১৯৭২-এর ২০শে জুলাই, মুম্বইয়ের রোগশয্যায় পাখির কণ্ঠ দিয়ে সঙ্গীতের বদলে ভলকে ভলকে রক্ত উঠে এসেছিল। সে সময়ে বড় চোরাবালি-টান। রোগে বা স্বেচ্ছায়, পঁয়ত্রিশ পেরোলেই জীবনপ্রদীপ নিবিয়ে ‘হল অব ফেম’-এর ছবি হয়ে যাচ্ছিলেন নক্ষত্ররা। গুরু দত্তের পর ‘গীতা বালি’, ‘মধুবালা’। ইন্ডাস্ট্রি বলেছিল, ক’মাস আগে ‘মীনাকুমারী’র মতোই একই রোগে, প্রায় সম-আয়ুতেই ফুরিয়ে গেলেন গীতা দত্ত। সেই ‘সিরোসিস অব লিভার’। নায়িকা ও গায়িকা, দুই জীবনদাত্রীরই প্রাণ টেনে নিয়ে তাঁদের যেন বইয়েরই শেষ পাতায় আটকে রেখে দিয়েছিলেন ‘সাহিব বিবি অউর গুলাম’-এর ‘ছোটি বহু’। ঠিক গুরু দত্তের সিনেমার দৃশ্যের মতোই ঘোলাটে সেই রাতে এমন সব সমাপতনে অনেকেরই শরীরে শিহরন জেগেছিল।
এ খবরে নাকি অসুস্থ ‘এস ডি সাব’ বলেছিলেন, ‘যাক।’ হয়তো এই ‘যাক’-এর মানে জানে শুধু শচীন কর্তার নিজস্ব মিউজিক রুমটি। গীতা যখন আর গাইতে পারছিলেন না, তখন সেখানে হঠাৎ এক দিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন। সকালে শুধু মীরা দেববর্মণকে বলেছিলেন, ‘গৌরী’র ওই গানটা কোনও সিনেমায় দেবেন না। বিকেলে দুম করে রেকর্ডিংয়ে ঢুকে নিজেই কানে হেডফোন পরেছিলেন। যন্ত্রীদের বলেছিলেন, ‘‘বুজলা, য্যানো বিলের পাড়ে একতারা বাজতাসে।’’
(তথ্যসূত্র:
১- Geeta Dutt: The Skylark, Haimanti Banerjee, Poets Foundation (২০০৮)।
২- Guru Dutt: A Tragedy in Three Acts, Arun Khopkar, Penguin India (২০১২)।
৩- Ten Years with Guru Dutt: Abrar Alvi’s Journey, Sathya Saran, Penguin India (২০১১)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত