প্রমথ চৌধুরী একবার একটা দামি কথা লিখেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল – ‘‘কণ্ঠে যা যন্ত্রে যিনি কখনও সাতসুরের চর্চা করেননি, তাঁর পক্ষে সংগীতবিষয়ে কিছু বলা বা লেখা উচিত নয়।’’ কথাটা যুক্তিপূর্ণ। কেননা সংগীত ক্রিয়াত্মক শিল্প। তাকে রূপায়ণ করতে হয়। যন্ত্রে যখন সংগীত রূপায়িত হয়, তখন লাগে দীর্ঘদিনের অনুশীলন, যার কৌশলে যন্ত্র মুখরিত। গড়পড়তা যন্ত্রশিল্পী তথা বাদকের সংগীতবোধ সুরের জ্ঞান আর বস্তুগত যন্ত্রকে মৌন থেকে মুখর করবার কেরামতি ঠিক ঈশ্বরদত্ত শক্তি নয়, তা বহুলাংশে মানুষেরই উদ্ভাবন এবং সংগীতের অনুষঙ্গী বাদ্যযন্ত্রগুলি তো মানুষেরই নির্মাণ। তাতে লাগে ধ্বনিবিজ্ঞানের গভীর জ্ঞান। তুলনায় কণ্ঠসংগীত অনেকটাই ব্যক্তিনির্ভর, কারণ সকলের কণ্ঠে সুর মেলে না।
শ্রী সর্বানন্দ চৌধুরী লিখিত ‘একত্র মিলিল যদি: আলাউদ্দিন ও রবীন্দ্রনাথ’ (প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং) গ্রন্থটি থেকে শান্তিনিকেতনে সংগীতবিদ্যা দানের জন্য রবীন্দ্রনাথ কর্তৃত্ব বিশেষভাবে আহূত আলাউদ্দিনের সঙ্গে গুরুদেবের সঙ্গকথা এবং যন্ত্রসংগীতবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব কেমন ছিল – এই দুটি বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে শিক্ষকতার কাজে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে আহ্বান করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন, ক’দিন ছিলেন কবি–সান্নিধ্যে, কিন্তু বিশ্বভারতীতে যোগ দিতে সক্ষম হননি। কেননা, ১৯১৮ সাল থেকে বা তার আগে থেকে মাইহার রাজের আমন্ত্রণে ‘রাজগুরু’র দায়িত্ব নিয়ে যন্ত্রসংগীতের এক ক্রিয়াত্মক চর্চার পরিসর তিনি গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৩৫ সালে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রদক্ষ শিল্পী আলাউদ্দিনকে ডেকেছিলেন শান্তিনিকেতনে। কিন্তু আলাউদ্দিনকে মাইহার রাজা ছাড়তে রাজি হননি বলে আলাউদ্দিন সৌজন্যবশতঃ এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে, বিকল্প হিসেবে শান্তিনিকেতনকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই আয়েৎ আলি খাঁকে। ১৯৩৫ সালে আলাউদ্দিন যখন কিছুদিনের জন্য কবি–সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তখন ৩০শে শ্রাবণ এক বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়ে রবীন্দ্র–জীবনীকার লিখেছিলেন – ‘‘কবির শরীর অসুস্থ বলিয়া স্থির হয় যে, বর্ষা–মঙ্গলের উৎসবক্ষেত্রে তিনি আসিবেন না; কিন্তু জলসার মধ্যে হঠাৎ তিনি উপস্থিত হইলেন দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইল – শান্তিনিকেতনে থাকিয়া উৎসবে উপস্থিত না থাকা বা মন্দিরে উপাসনা না করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইত না। সেদিনের আকর্ষণ ছিল আলাউদ্দিন খাঁর যন্ত্রসঙ্গীত।’’ পরে আয়েৎ আলি খাঁ এনেছিলেন তাঁর তবলা ও এসরাজের শিষ্য ইয়ার রসুল খাঁকে। এ ছাড়া আলাউদ্দিনের সেজোভাই আফতাবউদ্দিনের শ্যালক আলি আহম্মদকেও আয়েৎ রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন যন্ত্রসংগীতের শিক্ষকতার জন্য। প্রসঙ্গক্রমে সর্বানন্দ ভারী চমৎকার একটা ঘটনার বিবরণ হাজির করেছেন। রবীন্দ্র–সান্নিধ্যে যে সময়ে খাঁ সাহেব ছিলেন, তাঁর প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানা যায়, যখন বোঝা গেল খাঁ সাহেব মাইহারে এবারে ফিরে যাবেন, তখন রবীন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুকে ডেকে মজা করে বলেছিলেন, ‘‘নন্দলাল, আলাউদ্দিনের মাথাটা রেখে দাও।’’ গুরুদেবের বাক্যের ইঙ্গিত বুঝে নন্দলাল বসু তাঁর শিষ্য রামকিঙ্কর বেইজকে দিয়ে আলাউদ্দিনের মুখটি ভাস্কর্যে স্থায়ী করে রাখেন।
এরপরে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ১১ বছর পরে ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতীর বিশেষ আমন্ত্রণে ‘দিনেন্দ্র অধ্যাপক’ পদে ভিজিটিং প্রফেসররূপে আলাউদ্দিন খাঁ এসেছিলেন এবং মাস দুয়েক সেখানে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পৌত্র আশিস খাঁ। সে সময়ে তাঁকে উদয়ন বাড়ির সামনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের পৌরোহিত্যে এবং ক্ষিতিমোহন সেনের উপস্থিতিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে আলাউদ্দিন খাঁকে যখন বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ১৯৫২ সালে যখন তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। লেখাটির শিরোনাম ছিল – ‘সংগীত–সাধক আলাউদ্দিন খাঁ’। একই সময়ে শান্তিদেব ঘোষের ছোটভাই শুভময় ঘোষ মুখে মুখে বলা ওস্তাদের জীবনকাহিনী লিখে নিয়েছিলেন, যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। কিছু পুরোনো সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে আলাউদ্দিন ‘মূল্হা’, ‘কেদারা’ ও ‘কল্যাণের’ মিশ্রণে ‘রবীন্দ্ররাগ’ সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাঁর জন্মশতবর্ষে কলকাতার পার্কসার্কাস ময়দানে রবীন্দ্রমেলার অনুষ্ঠানে সেটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
ওস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ – যাঁর জীবন কোন রূপকথার গল্পের থেকে কোন অংশে কম নয়, তাঁকে কিছু নির্ধারিত শব্দের মধ্যে ব্যাখ্যা করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। বিচিত্র তাঁর জীবন, ততোধিক বিচিত্র তাঁর সৃষ্টি – সেটা তাঁর সৃষ্ট কোন রাগই হোক বা তাঁর সৃষ্ট কোন সুরযন্ত্র। দ্বিতীয়টি নিয়ে একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। এক বার বাবা আলাউদ্দিন তাঁর সরোদ-শিষ্য মাইহার-নবাব ব্রিজনাথ সিংহের সঙ্গে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে চা খাচ্ছিলেন। নবাবের এক সৈন্যের হাত থেকে হঠাৎই একটা বন্দুক সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে যায়। নবাব এতে খুব অপমানিত হয়ে, ওই সৈন্যটিকে শাস্তি দেব-দেব করছিলেন, এমন সময়ে বাবার আবদারে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বাবা নবাবকে বলেছিলেন, গোটা বিশেক বন্দুক আনো দেখি! ব্রিজনাথ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই বন্দুকের নল কেটে বিভিন্ন মাপের অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘নল-তরঙ্গ’।
লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনের চেলসি ক্লয়েস্টার্স হোটেল অ্যাপার্টমেন্টে বসে এক সাংবাদিককে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন – ‘‘গুরুর থেকে গুরু, এ যন্ত্র থেকে ও যন্ত্র। কী খুঁজছেন, না রাগরহস্য! কোথায় জন্মালেন আর কোথায় না কোথায় ঘুরে মরলেন, শুধু গানের নেশায়। পুব বাংলার গ্রাম ছেড়ে এসে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নুলো গোপালের কাছে গান, স্বামীজির পরিবারের হাবু দত্ত কী লোবো মাস্টারেরর কাছে বেহালা, এক স্থানীয় আর্টিস্টের কাছে ক্ল্যারিনেট, ওস্তাদ হাজারি খানের কাছে সানাই, তারপর নানা জনের কাছে মৃদঙ্গ। এক সময় ওস্তাদ আহমেদ আলির সরোদ শুনে তাজ্জব হয়ে পণ করলেন ওঁর কাছেই সরোদ শিক্ষা করবেন। সেই পর্ব শেষে রামপুরের কিংবদন্তি ওস্তাদ উজির খানের কাছে সরোদ, সুরশৃঙ্গার আর রবাব। আর এই এত বাদ্যকারি, তন্ত্রকারির কী লক্ষ্য? রাগের রূপ ও রহস্য উন্মোচন করা। আসলে লক্ষ্যটা এক। সুরলোক চেনা, নাদব্রহ্মে পৌঁছনো। এই যে এত বিগ ব্যাং থিওরির কথা শুনছি, সেও তো মহানাদই হল!’’ পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতে স্টিফেন হকিং ও বাবা আলাউদ্দিনের লক্ষ্যটা ছিল এক।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর একটা কথা বারবার স্মরণ করাতেন। বলতেন, ‘‘বাবাকে নিয়ে এত গল্প রটে আছে জগতে যে, আমি চেষ্টা করি নিজের চোখে যা দেখেছি, সেটুকুই বলে যাবার। আর তাতেই অবাক হয়ে যাই এ সবও সত্যিই ঘটেছে!’’
পণ্ডিত রবিশঙ্করের ভাষ্যে বাবা আলাউদ্দিনের জীবনের দুটো মূল্যবান বৃত্তান্ত পাওয়া যায়।
প্রথম বৃত্তান্ত তাঁর বাগান করা নিয়ে – ‘‘বাবার আর-একটা হবি ছিল বাগান চর্চা করা। ওঁর কথায় মাইহারের জমি ছিল ভয়ঙ্কর বেসুরো এবং বেতালা। তার ওপর জলকষ্ট। তা ছাড়া ওখানকার মাটিতে এবং জলে চুনের ভাগ অনেকখানি। মাইহার তো হল গিয়ে চুনের আড়ত, দুনিয়ার যত লাইম ফ্যাক্টরি সব ওখানেই। কাজেই ওখানে সবুজ বাগান পয়দা করা, বা ফুল-ফলের খেত করা দুষ্কর ব্যাপার। কিন্তু ছোটবেলার থেকেই তো বাবার ছিল সেই অসম্ভবকে লড়ে পাবার জেদ। উনি গোটা পরিবেশটাকেই একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখলেন এবং সেই মতন ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই অসম্ভব কাজটাই সম্ভব করে তুলতে। এবং কয় বছর মেহনত করে বাবা যে-বাগান সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল মাইহারের রাজবাড়ির বাগানের পরে সবচেয়ে দর্শনীয় বাগান। তবে সে কী মেহনত! বাপরে! মালিটালি রাখার তো ধারই ধারতেন না। কাল্লু বলে একটা ওই অঞ্চলের একটা কোল-চাকর ছিল। যার প্রধান কাজ ছিল বাড়িতে এবং বাগানে জল সরবরাহ করা। কুয়োর থেকে তুলে তুলে। প্রত্যেক দিন চার-পাঁচ ঘণ্টা বাবা বাগানের সঙ্গে লড়াই করতেন। জল কম ঢাললে সেই কাল্লুকে তো বটেই সেই সঙ্গে বাবা গাছগুলোকে এবং জমিগুলোকে বকাবকি করতেন। একে ওঁর ওই রণমূর্তি – পরিশ্রম করে ঘেমে নেয়ে একাকার, গায়ে মাথায় মাটি – তার ওপর হাতে দা, কাস্তে, কোদাল কিছু না কিছু একটা। ভয়ে আমাদের পিলে চমকে যেত। ওঁর ত্রিসীমানা মাড়াতাম না।’’
রবিশঙ্করের বলা দ্বিতীয় বৃত্তান্তটা রাগের ঘটনা হলেও কিছুটা মজার ও মধুর। এবং তা তাঁদের দু’জনের সম্পর্কের ওপরও সুন্দর আলোকপাত করে। রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন – ‘‘শেখবার সময় কয়েক বার দেখেছি তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতাম বলে উনি খুব খুশি মেজাজই আমাকে শেখাতেন। কিন্তু যে দিন হয়তো ওঁর মেজাজটা আগে থেকেই খিঁচড়ে থাকত, ওঁর মুখটা মেঘাচ্ছন্ন দেখতাম, সে দিন আমারও মাথাটা কী জানি কীরকম ভোঁতা হয়ে যেত। ওঁর শেখানো জিনিসগুলো তুলতে অযথা দেরি হয়ে যেত। মারধর বা গালি না জুটলেও বুঝতাম বাবার মেজাজ আরও বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এবং তা প্রকাশ পেত তাঁর গলার কর্কশতায় এবং আওয়াজের ভলিউমের তারতম্যে। এ রকম অবস্থায় প্রায়ই দেখতাম বেশ কড়া সুরে বলছেন, তুমি বাজাও। বলেই উঠে যেতেন। আমার তো তখন বাজনা মাথায় চড়েছে। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসত। ভাবতাম মাথায় থাক বাজনা, আজকের বিকেলের ট্রেনেই এখান থেকে বিদেয় হব। যা হোক, এরকম পরিস্থিতি প্রায়ই দেখতাম। কিছু পরে উনি ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় আবার শেখাতে শুরু করতেন। অথবা বলতেন, যাও বাড়ি গিয়ে রেওয়াজ করো। পরে জানতে পেরেছিলাম – এখন ভাবলে হাসি পায় – যে উনি আমার ওপরে রাগ পুরোপুরি প্রকাশ করতে না পেরে, ফ্রাসট্রেটেড হয় একেবারে বাইরে চলে যেতেন। যাকে পেতেন তার ওপরই চেঁচামেচি করে রাগটা খালাস করে দিতেন, আর তার বেশি হলে অন্য কোনও ছাত্রকে দু’ঘা মেরে অথবা কোনও পাড়ার কুকুরকে লাঠির বাড়ি মেরে নিজের রাগটুকু ঝরিয়ে দিতেন। এবং সে রকম কাথারসিস হয়ে গেলে আমাকে শেখাবার জন্য আবার ফিরে আসতেন।’’
আলাউদ্দিন খান সাহেবের জীবন নিয়ে গল্পের অন্ত নেই। অথচ তাঁর জীবনের একটা বড় অংশের ঘটনাবলির কোনও সন-তারিখের বালাই নেই।
১৯৭২ সালে তাঁর প্রয়াণ হলে তাঁর জন্মসন নিয়েও কম তোলপাড় হয়নি। দেখা গিয়েছিল ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ যখন তাঁকে পদ্মভূষণ অর্পণ করেছিলেন (১৯৭১ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণও দেওয়া হয়েছিল) তখন পরিচয়-পত্রাদিতে তাঁর বয়স উল্লেখ করা হয়েছিল ৯২ বছর। সেক্ষেত্রে খান সাহেবের জন্মসন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল ১৮৬৬! মাইহার থেকে ১৮ই মে, ১৯৫৬ সালে তাঁর এক শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথকে লেখা চিঠিতে খান সাহেব তাঁর তখনকার বয়স জানিয়েছিলেন ৯০। তাতেও তাঁর জন্মসন দাঁড়াচ্ছিল ওই ১৮৬৬। তবে শেষ অবধি যে সনটি মান্যতা পেলছিল, সেটি ১৮৮১; যেটি ‘হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী’ এবং আরও কেউ কেউ অজস্র তত্ত্বতল্লাশি করে ধার্য করতে পেরেছিলেন।
গত শতাব্দীর গোড়ার থেকেই ইতিহাসের অলিন্দে ঘোরাফেরা ছিল আত্মভোলা আলাউদ্দিন খানের। তবে তারিখ দিয়ে তাঁর যে-সাড়াজাগানো বাজনার কথা নিয়ত চর্চায় আসে সেটা ১৯২৫ সালের চতুর্থ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সের, যার ক্ষেত্র ছিল লখনউ। সেখানে ১১ই জানুয়ারি খান সাহেব আসর মাত করেছিলেন বেহালায় কাফি ও তিলক কামোদ বাজিয়ে। তবলায় বারাণসীর বীরু মিশ্রকে নিয়ে সে নাকি এক অদ্ভুত প্রাণ উদ্বেল করা অভিজ্ঞতা ছিল। বেহালা যন্ত্রকে তখন তখন তার বিলিতি নাম ভায়োলিন হিসেবে প্রচার করা হলেও খান সাহেব সেটির নিজস্ব নামকরণ চালু করেছিলেন ‘বাহুলীন’, যেহেতু সেটি শিল্পীর বাহুতে লীন হয়ে থাকে। একই কনফারেন্সের আরেক দিন আলাউদ্দিন নতুন এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন খালিফা আবিদ হোসেনকে তবলাসঙ্গী করে গারা এবং দরবারি কানাড়া বাজিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত এই আসরের চাঞ্চল্যের উপকরণ হয়েছিল আবিদ হোসেনের সঙ্গে খান সাহেবের তাল-লয়কারির মারপ্যাঁচ, দ্বন্দ্ব। শেষের দিকে সে-খেলা এমন পর্যায়ে চড়ে গিয়েছিল যে পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে এবং লখনউয়ের রাজা নবাব আলি ঠাকুরের মধ্যস্থতায় লড়াইয়ের ইতি টানতে হয়েছিল।
ফের যাওয়া যাক কলকাতা মহানগরীতে আলাউদ্দিন খানের প্রথম দিককার দিনগুলোয়। যখন হাবু দত্তের কাছে তাঁর জটিল এবং উন্নত বেহালা শিক্ষা চলছিল, শুধুই কি বেহালা? নানা যন্ত্রে আলমের (খান সাহেবকে এই ডাকা হত তখন; ১৯৭৩ সালে পিতার এই নামটিকেই কুর্নিশ করেছিলেন আলি আকবর ‘আলমগিরি’ নামে এক অনুপম রাগ রচনা করে) খোঁজ ও হাতযশ দেখে ‘হাবু দত্ত’ তাঁকে হরেক যন্ত্র শিখতে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর এক দিন তাঁর প্রবল অর্থকষ্টের কথা জেনে তাঁকে নিয়ে সরাসরি হাজির হয়েছিলেন সে-যুগের সেরা নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাছে। উদ্দেশ্য ছিল মিনার্ভা থিয়েটারে আলমের একটা ব্যবস্থা করা। আলমের কাজ ছিল নাটকের সঙ্গীত পরিচালকের সুরের কাজে সহযোগিতা করা আর থিয়েটারের তাবৎ সঙ্গীতযন্ত্রের দেখভাল। এই করতে করতে মঞ্চের জন্য সুরারোপের কাজও শেখা হয়ে গিয়েছিল আলমের। যা দিব্যি নজরে এসেছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের। যিনি অচিরে তাঁকে নিজের নিকট বৃত্তে টেনে নিয়েছিলেন। এবং এক নতুন নামও দিয়েছিলেন – ‘প্রসন্নকুমার বিশ্বাস’।
একের পর এক সেই যে গল্পের শুরু হয়েছিল আলাউদ্দিন খাঁর জীবনে বাকি জীবনে তার আর ইতি হয়নি।
সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুর সন্ধানে ঘটানো তাঁর নানা কাণ্ড। বলা হয় যে, গান শিখবেন বলে ফুলশয্যার রাতে নববধূর গহনা নিয়ে নুলো গোপালের শরণে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলেন আলম। কিন্তু পাথুরিয়াঘাটায় পৌঁছে খবর পেয়েছিলেন যে তার ক’দিন আগে কলেরায় প্রাণ হারিয়েছেন তাঁর গুরু। অগত্যা শরণাপন্ন হয়েছিলেন হাবু দত্তের। সরোদগুরু উস্তাদ আহমেদ আলির কাছে চার বছরের শিক্ষাকাল আলাউদ্দিন খানের কেটেছিল কার্যত রাঁধুনিগিরি করে। নিজে মাংস খেতেন না, তাই ওস্তাদের জন্য রাঁধা মাংস যে তরিবত করে সব সময় পাকাতে পারতেন তাও নয়। কাজেই একটু এ ধার-ও ধার হলেই কপালে বকুনি ছিল। কিন্তু আলম সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন, সকালে গুরুর রেওয়াজটুকু শুনবেন বলে। তার পর গুরু বাড়ির বাইরে গেলে গোপনে স্মৃতি থেকে সেই বাজনার রেওয়াজ করতেন। আহমেদ আলি আলমকে বিলম্বিত ও দ্রুত গতের বাইরে কিছু শেখাতে রাজি ছিলেন না। আলাপ তো নৈব নৈব চ। কিন্তু আলমের স্মৃতি ও ধ্যানে তিনি বেড়ি পরাতে পারেননি। ফলে যা তিনি চর্চা করেছিলেন, তাই-ই শিক্ষা করে ফেলেছিলেন আলম। এমনকী তাঁর প্রিয়তম দরবারি গেড়ি রাগিণীটিও। এক দিন হঠাৎ করে বাড়ি ফিরে শিষ্যকে ওই রাগিণীতে রেওয়াজ করতে শুনে খেপে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন সরোদ-ওস্তাদ।
আহমেদ আলির থেকে বিদায় নেওয়ার পর রামপুর মহারাজার প্রাসাদ দ্বারে টানা ছ’মাস হাজিরা দিয়েছিলেন আলম। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সভাসঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ উজির খানের বীনের শিষ্যত্ব পাওয়া। কিন্তু রোজ তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিত দরোয়ানরা। শেষে তিনি মসজিদে গিয়ে আফিম খেয়ে মরার ছকও করেছিলেন। এক মৌলবীর দাক্ষিণ্যে সে-যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যান। মৌলবী দয়াপরাবশ হয়ে আলমের পরিস্থিতি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্বয়ং রামপুর নবাবকে। কিন্তু সে-চিঠি নবাবকে পৌঁছনো যাবে কী করে, আলম তাই চিঠি নিয়ে নবাব হামিদ আলির জুড়ি গাড়ির সামনে নিক্ষেপ করলেন নিজেকে। বাকিটুকু ইতিহাস। সে-সময় খবর হয়েছিল যে এক বাঙালি যুবক বোমা মারতে এসেছিল নবাবের গাড়িতে। তা জেনে আলম বলেছিলেন, ‘‘বোমা ছিল ঠিকই, তবে বারুদের নয়, স্বরের।’’ ওদিকে নবাব হামিদ আলি নিজেও গুণী সঙ্গীতকার ছিলেন। আলমের সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজে আয়োজন করেছিলেন উজির খানের কাছে তাঁর নাড়া বাঁধার। উজির খানের শুধু একটি শর্ত ছিল – আলাউদ্দিনকে তিনি সরোদ, সুরশৃঙ্গার ও রবাবে শিক্ষা দেবেন, কিন্তু বীণে নয়। আর তাতেই সম্মত হয়েছিলেন আলাউদ্দিন খান।
রবিশঙ্কর তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘‘কী সৌভাগ্য আমাদের যে, বাবার মধ্যে এই বিচিত্র তন্ত্রকারির শিক্ষা আমরা এক জায়গায় পেলাম! সারা জীবনের শেখা বিদ্যা তিনি বাকি জীবন কাজে লাগালেন অন্যদের শেখাতে।’’ গুরুমহিমায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন বাবা আলাউদ্দিন যে গোটা জীবন নিজের সব গুরুদের বন্দনা গেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথের সেতারিকন্যা অঞ্জনা রায় তাঁর আলাউদ্দিন-জীবনী ‘মিউজিসিয়ান ফর দ্য সোল’ বইতে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। উস্তাদ আলি আকবরের পিতা ও একমাত্র গুরু বাবা আলাউদ্দিন ছেলেকে নাড়া বাঁধিয়েছিলেন ওস্তাদ দবীর খানের কাছে। কারণ? দবীর খান ছিলেন ওস্তাদ উজির খানের বংশধর। এভাবেই উজির খানকে সম্মান ও ভক্তি জানানোর সুযোগ নিয়েছিলেন ভারতের সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরু।
বাবা আলাউদ্দিনের স্বভাব ও চরিত্রের দুটি সেরা শব্দচিত্র রেখে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর আনন্দবাজার পূজাবার্ষিকীর জন্য তাঁর লেখা ‘বেণীমাধবের ধ্বজা থেকে আইফেল টাওয়ার’ রচনায়। সেখান থেকে দুটো ছবি তুলে ধরা যাক। প্রথমটা উদয়শঙ্করের নৃত্যদলের সঙ্গে বাবার ইউরোপ যাত্রার প্রাকমুহূর্ত –
‘‘বোটে যখন উঠছে সবাই – মা, আমি আর বাবা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা তো মা’কে মা মা করতেন। রত্নগর্ভা, আপনার গর্ভে শিবশঙ্কর আইসে। দাদার কথা আর কী। মা’র হঠাৎ কী যে হল premonition, perhaps she knew.আমার হাতটা বাবার হাতে দিয়ে বললেন, উনিও বাবাই বলতেন। বাবা, আপনাকে একটা কথা বলব? – ‘বলেন মা বলেন’, বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলেন – আদেশ করেন – ‘না, আপনি তো জানেন, এর বাবা মারা গেছেন – বড় দুরন্ত ছেলে, এখন তো কেউ নেই। আপনি একটু দেখবেন একে। ভুলটুল মাপ করে দেবেন। কারণ মাও তো বাবার মূর্তি দেখেছিলেন, উনি চাইতেনও যে আমি বাবার কাছে শিখি। আমিও চাইতাম, কিন্তু সাহস হত না। মা বলার সঙ্গে সঙ্গে, বাপরে! বাবাও highly emotional. একেবারে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন – মা আপনে বলসেন কী, আপনে রত্নগর্ভা – আজ থিক্যে আলি আকবর আমার ছোট ছেলে – রবু আমার বড়ো ছেলে। আপনায় কথা দেলাম। মা আর বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কেন জানি না, ভেউ ভেউ করে কাঁদছি – বড় বিশ্রী পরিস্থিতি কান্নার মধ্যেই মা’কে আমি শেষ দেখছি। হাত নাড়ছি। মা দাঁড়িয়ে আছেন চশমা পরে। পরনে ঢাকাই শাড়ি, সেই শেষ দেখা।’’
আর বাবার অন্য ছবিটা কেমন রবিশঙ্করের স্মৃতিতে – ‘‘কয়েক মাস পরেই প্যারিসে খবর পেলাম – মা মারা গেছেন। বাবও কেমন যেন বদলে গেলেন – মানে আমার সম্পর্কে তাঁর মনোভাব। তবু উনি মাঝে মাঝে খুব রেগে যেতেন। কিন্তু আমাকে ঠিক বকতেন না। তখন আমরা প্যালেস্টাইনে ছিলাম (ইজরাইল হয়নি তখন)। তখন একটু একটু শেখাতে শুরু করেছেন আমাকে। গান শেখাচ্ছেন। গত শেখাচ্ছেন, আমাকে আর দুলালকে। আমরা ভাবলাম, বাবাকে একটা কিছু দেওয়া যাক। কী দেওয়া যায়? বাবা হুঁকোটা খুব miss করতেন। কড়া সিগারেট খেতেন। আমি আর দুলাল খুব ভেবেচিন্তে, খুব ভাল পাইপ, একেবারে best available, আর ভাল টোবাকোর পাউচ নিয়ে গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে রাখলাম। সেদিন ওঁর মুডটা কী কারণে যেন খারাপ ছিল। আর যায় কোথায়, দুর্দশা একেবারে – ‘আমার মুয়ে আগুন দিতে আইসে। কী ভাবস আমারে ঘুষ দিয়া শিখবা? আমি ওসব নিই না। আমি কারও পয়সা নিই না, আমি কারও পান খাই না।’ আমরা বুঝলাম এঁকে এসবেতে ফাঁসানো যাবে না। আর তার প্রয়োজনও ছিল না। উনি যে ভেতরে ভেতরে আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। বলতে গেলে he depended on me। আমার এক নতুন জীবন শুরু হল।’’
আজও সুর আছে মাইহারে। বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সাবেকি ডেরা ছিল সেই শহরেই। এলাহাবাদ থেকে সাতনা যেতে, মধ্যে পড়ে মাইহার। টিলা-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট সুন্দর শহর। দেখার মতো জায়গা চারটে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বসতভিটে – যেখান থেকে সংগীত শুরু ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের মতো প্রবাদপ্রতিমদের। বাড়ির নাম ‘মদিনা মঞ্জিল’। আরও আছে সারদা মন্দির, পাহাড়ের পথে ওই উঁচুতে। আর আছে নবাব ব্রিজনাথ সিংহের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাসাদ। আর আছে মাইহার ব্যান্ড। এই ‘মাইহার ব্যান্ড’, ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত ব্যান্ড – তৈরি করেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন-ই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মাইহারে প্লেগের মড়কে বেঁচে থাকা অনাথ শিশুদের নিয়ে, তাদের ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে তালিম দিয়ে, বাবা তৈরি করেছিলেন তাঁর সাধের ব্যান্ড। এখন অবশ্যই, সেই ব্যান্ডের প্রথম বাজিয়েরা আর বাজাচ্ছেন না। উত্তরসূরিরা সেই ঘরানাকেই বহন করে চলেছেন। আলি আকবর খাঁ সাহেব বেঁচে থাকতে মাইহারে যত বার আসতেন, ব্যান্ডটাকে ঘষেমেজে দিয়ে যেতেন। এখন আসেন আশিস খান। ফি বছর। আমেরিকা থেকে এসে তালিম দিয়ে যান যন্ত্রীদের।
(তথ্যসূত্র:
১- Acharya Ustad Allauddin Khan: Musician for the Soul, Anjana Roy, Xlibris Corporation (২০১০)।
২- Ustad Alauddin Khan, Sahana Gupta, Lustre (২০১২)।
৩- রাগ-অনুরাগ, রবিশঙ্কর, আনন্দ পাবলিশার্স।
৪- একত্র মিলিল যদি: আলাউদ্দিন ও রবীন্দ্রনাথ, সর্বানন্দ চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত