গত ৫ই অক্টোবর নীরবে চলে গেছে তাঁর ৯৪তম জন্মবার্ষিকী, সামনে আসছে তাঁর ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জন্মদিন আর মৃত্যুদিন – দুটোই বড় কাছাকাছি, একই মাসে, দুটোর মধ্যে মাত্র ছয় দিনের পার্থক্য। অথচ তাঁর জন্ম-মৃত্যু কোনটাই নিয়ে খুব একটা হৈচৈ সামাজিক গণমাধ্যমে দেখা যায়না, দেখা যায়না তাঁর নিজের জন্মভূমিতেও। এই তো বিগত কয়েক বছর ধরে তাঁর সম্মানে একটা পুরষ্কার ঘোষণা হয়েছে, বিগত বছর পর্যন্ত সেটা দেওয়াও হয়েছে – কিন্তু সেটা নিয়েও খুব একটা হৈচৈ হয়না। কিছুদিন আগেও সামাজিক গণমাধ্যমে একটা ছবি নিয়ে বিস্তর হৈচৈ হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লাইক, লক্ষ লক্ষ দুঃখী ইমোজি, লক্ষ লক্ষ শেয়ার হয়েছিল সেই ছবি। ছবিটা তাঁরই ছিল – কিন্তু ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘‘ফাঁসির পরে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ছবি’’! হায়রে, ইতিহাস! হাতে গোনা কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম যে গিমিকে চলে! অধিকাংশ মানুষই সেই প্রতিবাদে কর্ণপাত করেননি। কেউ জানার চেষ্টাও করেননি – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ ১৮ বছরের ক্ষুদিরাম বসু নন, ১২ বছর ৬ দিন বয়সের ‘বাজি রাউত’। এবারে যদি প্রশ্ন হল যে, স্বাধীনতা সংগ্রামী কারা? যাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অকুতোভয় হয়ে লড়েছেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁরা হয়ত ব্রিটিশ হত্যা করেননি বা ব্রিটিশ হত্যা করতে উদ্যত হন নি, কিন্তু তাঁরাও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তাঁরাও স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবলমাত্র ইতিহাসের বইতে থাকা বড় বড় নামগুলো তে সীমাবদ্ধ নয়। এই বড় নামগুলো ছাড়াও আরও অনেক নাম আছে, যাঁরা ছিলেন অতীব সাধারণ মানুষ। ইতিহাসের বইতে যে বড় বড় নামগুলো আমরা দেখি, তাঁদের আন্দোলন বা সংগ্রামের সফলতার পিছনে মূল শক্তি ছিলেন এই সাধারণ মানুষেরা। তাঁরা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। তেমনই এক অসাধারণ সাধারণ বালক ছিলেন উড়িষ্যার ‘বাজি রাউত’। লাল পাগড়ির গুলি বুকে নিয়ে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে শহিদ হয়েছিলেন ইনি৷ বাজি রাউত – তিনিই এদেশের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী৷ অথচ ইতিহাসের বইতে কোথাও তাঁর নামোল্লেখ নেই। সর্বত্র আমরা এটাই পড়ি যে ভারতের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম বসু। যদিও বইতে লেখাটি হওয়া উচিত ছিল, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে, মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে ফাঁসি তে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম বসু’, আর ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বৃটিশ পুলিশের গুলিতে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে শহিদ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ শহিদ হলেন উড়িষ্যার বাজি রাউত’। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বৈপ্লবিক কার্যক্রম, শহিদদের সম্মান দিতে এই দেশ কখনই ভোলে না। কিন্তু কালের নিয়মে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় অনেক মুখ। ঠিক যেমন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা মনে রাখেননি অনেকেই।
১০ই অক্টোবর, ১৯৩৮। সকাল ৮ টা। উড়িষ্যার ভুবন গ্রামে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। প্রতিবাদে থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন গ্রামবাসীরা। বন্দিদের মু্ক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ তাঁদের কথায় কান না দিয়ে সোজা গুলি চালাতে শুরু করে দেয় নিরীহ গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে। মৃত্যু হয় দু’জনের। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ আরও বাড়ে। বিক্ষোভকারীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। ক্রুদ্ধ জনতার ভয়ে পালানোর চেষ্টা করে পুলিশ। নীলকন্ঠপুর ঘাট হয়ে তারা ঢেঙ্কানলের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১১ই অক্টোবর তারা নীলকন্ঠপুর ঘাটের দিকে রওনা দেয়। ব্রাহ্মনি নদী পার হয়ে যেতে হবে তাদের। সেইসময় একটি নৌকায় গার্ড ছিলেন কিশোর বাজি রাউত। আশ্বিনের রাতে মৃদুমন্দ বাতাসে নৌকোর ভিতরে চোখ লেগে এসেছিল ১২ বছরের ছেলেটার। আচমকা চাপা চিৎকারে সে ধড়মড়িয়ে উঠেছিল। সামনে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ সাহেব এবং গোরা পল্টন। হুকুম, পার করিয়ে দিতে হবে ব্রাহ্মণী নদী! তার আগেই অবশ্য ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসী হত্যার ঘটনার পৌঁছেছিল তাঁর কানে। তিনি এও জানতেন যে, জনতা ক্ষুব্ধ এবং ব্রিটিশদের যেভাবেই হোক আটকাতে হয়ে। সুতরাং লালপাগড়ির প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিয়েছিলেন বাজি। ব্রিটিশরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিন্তু অকুতোভয় বাজি কানও দেন নি পুলিশের কথায়৷ কোনও অবস্থাতেই যখন তাঁকে রাজি করানো গেল না, তখন বন্দুকের বাট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে এক পুলিশ। মাথায় ব্যাপক আঘাত পেয়েছিলেন ১২ বছরের এই কিশোর। মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আবার। জোর গলায় পুলিশকে বলেছিলেন ফিরে যেতে। বলেছিলেন, তিনি পার করে দিতে পারবেন না, অন্তত তিনি বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব নয়। এরপরই ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ পুলিশ বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। বাজি রাউত সহ তাঁর সঙ্গী ‘লক্ষণ মালিক’, ‘ফাগু সাহু’, ‘রুশি প্রধান’ ও ‘নাটা মালিকের’ ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় বাজি রাউতের বয়স ছিল ১২ বৎসর ছয় দিন। ইতিহাসের নথি বলে তাঁর জন্ম হয়েছিল ৫ই অক্টোবর ১৯২৬ সালে।
এই ঘটনায় নতুন করে কেঁপে ওঠে দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই নতুন করে জ্বলে ওঠে। বাজি রাউতকে শহিদের সম্মান দেয় গোটা দেশ। অন্য অনেকের মতো বাজি রাউতও তেমন পরিচিত নন৷ তবু মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে এরকম কত বলিদানের ইতিহাসই না লেখা আছে৷
অকালমৃত্যুর দিনকয়েক আগেই ছিল বাজির জন্মদিন। তবে, নামেই ‘জন্মদিন’, অভাবের সংসারে এর কোনও আলাদা অর্থ বিশেষ ছিল না। বাজির মা দিনভর পড়শিদের বাড়িতে ঢেঁকি পাড়তেন। তবেই ঘরে আসত সামান্য খুদকুঁড়ো। ১৯২৬ সালের ৫ই অক্টোবর ওডিশার ঢেঙ্কানল জেলার নীলকান্তপুর গ্রামে জন্ম হয়েছিল বাজি রাউতের। পেশায় মাঝি পরিবারের ছেলে। ব্রাহ্মণী নদী পারাপার করত নৌকা। তাতেই ছোট থেকে বাবার সঙ্গে ভেসে বেড়াত বাজি রাউত। মাঝির সবথেকে ছোট ছেলেটা ছিল একগুঁয়ে, জেদি। তার উপরে দুরন্তপনা। তাই ছেলেকে কাছছাড়া করতেন না বাবা। তাঁর বাবা ছিলেন নীলকণ্ঠপুর ঘাটের মাঝি। ব্রাহ্মণী নদী পারাপার করত তাঁর নৌকো। পারানি যা পেতেন, সংসারের অভাব দূর হত না। একদিন স্ত্রী-সন্তানদের আরও অকূল পাথারে ফেলে চোখ বুজেছিলেন নীলকণ্ঠপুর ঘাটের মাঝি। অপটু হাতে বৈঠা ধরা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বাজির কাছে। শুধু নদীঘাটের নয়, ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে ছোট বাজি-ই হয়ে উঠেছিলেন সংসারের মূল কান্ডারি-ও।
সে সময় ঢেঙ্কানলের দেশীয় রাজা ছিলেন শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেও। তাঁর অত্যাচারে খাজনা যোগান দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠত সাধারণ প্রজাদের। ধীরে ধীরে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিলেন মার্ক্সবাদের আদর্শে দীক্ষিত ঢেঙ্কানলের ‘বৈষ্ণবচরণ পট্টনায়ক’। ‘হরমোহন পট্টনায়কের’ সঙ্গে মিলে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘প্রজামণ্ডল আন্দোলন’। তার অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল ‘বানরসেনা’। স্থানীয় বালক ও কিশোরদের নিয়ে তৈরি সেই সংগঠনের কাজ ছিল নজরদারি। সংগঠনের সদস্য ছিল বাজি রাউতও। আন্দোলনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গিয়েছিল শাসকের অত্যাচারও। জারি হয়েছিল ‘রাজভক্ত কর’। যাঁরা সেই কর দিতেন না, হাতির পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হত তাঁদের কাঁচাবাড়ি। অত্যাচার আরও নির্মম করতে ঢেঙ্কানলের শাসকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় আরও কিছু শাসক। কলকাতা থেকে ২৫০ বন্দুকধারী সেনা পাঠিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
হরমোহন পট্টনায়কের সন্ধানে ভুবন গ্রামে শুরু হয়েছিল পাগলের মতো তল্লাশি। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছিল জেরা, তথ্য চাই তাঁর সম্বন্ধে। কিন্তু নির্যাতনের মুখেও গ্রামবাসীদের ছিল মুখে কুলুপ। ব্রিটিশদের কাছে খবর ছিল, গ্রামেই লুকিয়ে আছেন হরমোহন। বৈষ্ণবচরণ ছিলেন রেলকর্মী। তিনিও ব্রিটিশদের কাছে অধরা ছিলেন। এরই মধ্যে ব্রিটিশদের কাছে খবর এসেছিল, ব্রাহ্মণী নদী পেরিয়ে পালিয়েছেন হরমোহন। সেইমতো নীলকণ্ঠপুর ঘাটে বাঁধা বাজির নৌকোর কাছে পৌঁছেছিল তারা। বাজির উপর দায়িত্ব ছিল ঘাটের চারপাশে নজরদারি। তিনি নদী পার করানোর বদলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে শেষ প্রাণবিন্দু অবধি তিনি চিৎকার করে গ্রামবাসীদের সতর্ক করেছিলেন, যে নদীর ঘাট অবধি পৌঁছে গিয়েছে ব্রিটিশ সেনা। বাজির চিৎকারে ভিড় জমতে দেরি হয়নি। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে আবারও গুলিবৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশ সেনা। তাতে মারা যান আরও চারজন। বাজি-সহ সবার দেহ পাঠানো হয়েছিল কটকে। ময়নাতদন্তের পরে কটকের রাস্তায় শোকযাত্রার পরে সম্পন্ন হয়েছিল শেষকৃত্য। হাজারো জনতা সমবেত হয়েছিলেন, বাজি ও বাকি শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে।
আজ মানুষ সবই ভুলে গেছে। তাই প্রায় সকলের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ১২ বছর বয়সী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ। আরও অনেক শহীদের মতন তিনিও তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। কিন্তু আজও যখন ব্রাহ্মণীর পাড়ে সূর্য ওঠে, একটি নামেই ছড়ায় তার আলো। তিনি বাজি রাউত।
(তথ্যসূত্র:
১- Shaheed Bhagat Singh and the Forgotten Indian Martyrs, page 192, Reginald Massey, Abhinav Publications (২০১৪)।
২- https://www.odisha.gov.in/content/eminent-personalities)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত