তপন সিনহার শৈশবে তাঁর বাড়ির ঠাকুর তৈরি করতে আসতেন গোপাল বৈরাগী। তাঁর প্রিয় গোপালদা। গোপালদা গুন গুন করে গান গেয়েই যেতেন। তাঁর একটা গান ছিল – ‘মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না’। তখন বোন গীতাকে নিয়ে তন্ময় হয়ে ঠাকুর গড়া দেখতে দেখতে আর গান শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগত তাঁর। এর অনেক পরে যখন ‘হারমোনিয়াম’ ছবি করেছিলেন তপন সিনহা, তখন তাঁর ফেলে আসা কৈশোরের সেই গোপালদার গানটাই ঝেড়েমুছে সিনেমায় লাগিয়েছিলেন। কত যে ছবিতে গান নিজেও লিখেছিলেন আর সুর দিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তার জন্যও বোধ হয় তাঁর সেই ছেলেবেলাটা দায়ি ছিল। তাঁর বাড়ি ছিল ভাগলপুর। কিন্তু তাঁর পারিবারিক আদি বাস ছিল বীরভূমে, মুরারই স্টেশনের কাছে হিলোরায়। তাঁর বাবা ত্রিদিবেশচন্দ্র ছিলেন মাঝারি মাপের জমিদার। তাঁর মা প্রমীলাদেবী ছিলেন লর্ড সিনহার পরিবারের মেয়ে। তপনের জন্মের সময় নাকি লর্ড সিনহা নিজে এসেছিলেন তাঁর মুখ দেখতে। ছেলেবেলা থেকেই তপন সিংহ দেখেছিলেন বাড়ি গমগম করত লোকজনে। সে প্রায় জনা চল্লিশেক লোক তো হবেই। তাঁর মা-ই ছিলেন পরিবারের একমাত্র মহিলা-কর্ত্রী। বাড়ি আঁটোসাটো নিয়মে সকলে বাঁধা ছিলেন। দুপুরে বারোটার মধ্যে পরিবারের সকলকে খেয়ে নিতে হত। বাড়ির কাজের লোকজন খেতেন দুপুর একটার ভেতর। এর পর তাঁর মা সোজা দোতলায় গিয়ে ‘ভারতবর্ষ’, নয় ‘প্রবাসী’ খুলে বসতেন। বেলা আড়াইটে হলেই তাঁদের বাড়িতে এসে পড়তেন পোস্টাপিসের ডাক পিওন হরেনদা। তাঁর খাবারও রাখা থাকত। হরেনদা খেয়েদেয়ে আবার চিঠি বিলি করতে বেরিয়ে পড়তেন। তপন সিনহার বাবার চোখে তাঁর মায়ের দুটি দোষ ছিল। এক, লোকজন ডেকে ডেকে খাওয়ানো। আর দুই, যদি কোনও মেয়ে মাথায় করে মাছ বা সবজি বিক্রি করতে আসতেন, তাঁর কাছ থেকে সবটাই কিনে নিতেন তিনি। তাঁর মা তাঁকে বলতেন, একটি মেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে রোদ-বৃষ্টিতে পাঁচগ্রাম ঘুরে বেড়াবে, অসভ্য দেশ হলেই এমনটা হয়। সেই সময় যাঁরা কলেজে পড়তেন, তাঁরা গাঁয়ে পুজোয় বা গরমের ছুটিতে এলে তপন সিনহার মা তাঁদের রাজবংশী পড়াতেন নাইটস্কুলে। আবার কারও বাড়িতে ঊনুনের ধোঁয়া না উঠতে দেখলে তাঁকে ডেকে এনে চাল-ডালও হাতে দিয়ে দিতেন।
গরমকালে সেই গাঁ-ঘরে বড্ড গরম লাগত। তাই বিকেল থেকেই বালতি বালতি জল ঢালা হত ছাদে। রাতে লম্বা লম্বা বিছানা করে ছাদেই শোওয়া হত। তাঁর বাবাকে কোনও দিন ভেতর-বাড়িতে শুতে দেখেননি তপন। তাঁর বাবার তদারক করতেন ফণিদা আর হাকিমদা। তাঁদের সঙ্গে আরও ক’জন ছিলেন। তারা ভরা আকাশের নীচে শুয়ে তাঁর মা গান গাইতেন, ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিভে যায় বারে বারে।’ নিজের মায়ের কাছেই তপন শিখেছিলেন রবি ঠাকুরের গান – ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না।’ তাঁর বাবা ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। তাঁর জমিদারি মেজাজ ছিল বটে কিন্তু তার আড়ালে তাঁর একটা কাব্যিক মনও লুকোনো ছিল। সেটা তপন বুঝেছিলেন, যখন তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর বাবা-ই তাঁকে প্রকৃতি চিনতে শিখিয়েছিলেন। তিনি রাতে পাশে শুইয়ে তপনকে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’ শোনাতেন। তাঁর বাবা ছিলেন গান্ধীবাদী। পনেরো-বিশটা চরকা ছিল তাঁদের বাড়িতে। সারা দুপুর সবাই চরকা কাটত। গান্ধীজি মারা যেতে তাঁর বাবা অশৌচ পালন করেছিলেন। গোপালদার হাতে প্রতিমার দু-মাটির প্রলেপ লাগলে কলকাতা রওনা দিতেন তাঁর বাবা। জওহরলাল পান্নালাল থেকে বাড়ির সকলের পুজোর জামাকাপড় কিনে তবেই ফিরতেন। তপন সিনহার কথায়, ‘‘বাবা ফিরলেই মনে হত, পুজো এসে গেল।’’ তাঁদের অনেকগুলো পুকুর ছিল। তার প্রত্যেকটার আবার আলাদা-আলাদা নাম ছিল। তাঁর বাড়ির একদম লাগোয়া পুকুরটার যেমন নাম ছিল ‘রানা’। তার পরেরটার নাম ছিল ‘সিদাগড়’। আর তারও পরেরটার নাম ছিল ‘ব্রজের পুকুর’। তাঁদের গ্রামের একেবারে শেষ সীমানায় ছিল ‘ময়দান দিঘি’। ভরা ভাদরে ভাগীরথীর জল উপচে ভেসে যেত গোটা গাঁ। লোকে বলত বান এসেছে। তেমনই এক বানের জলে এক বার কুমির এসে পড়েছিল পুকুরে। তাঁর বাবা উঠে পড়ে লেগেছিলেন যে কুমিরটাকে মারতে হবে! নিমতিতা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল কুমির-ধরা বঁড়শি। লম্বা বাঁশে মোটা দড়ি বেঁধে বঁড়শি লাগানো হয়েছিল। তাতে টোপ দেওয়া হয়েছিল পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি। বন্দুকে টোটা ভ’রে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাবা। গোটা গাঁ ভেঙে পড়েছিল পুকুরপাড়ে সেই কুমির শিকার দেখতে। মরণকালে জল থেকে লাফিয়ে উঠে হাঁ মুখ করে তাঁর বাবার দিকে এমন তেড়ে এসেছিল কুমির, সে-স্মৃতি কোনও কালে তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি।
ন’বছর বয়স হলেই তপনকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে। এম ই মানে, মিডল স্কুল, ক্লাস সেভেন অবধি। ওই পর্যন্ত পড়া হলে বিহারের যত এম ই স্কুল ছিল তার সবগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা হত। পাশ করলে তবেই হাই স্কুলে ভর্তি হওয়া যেত। ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের দূর সম্পর্কের মামা। তাঁর ছিল সাদা শনের মতো আধা বাবরি চুল, পড়তেন ধবধবে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে সোনার পাঁসনে চশমা নীল সিল্কের সুতো থেকে ঝুলত তাঁর গলায়। হেড মাস্টারমশাই বেহালা বাজাতেন। স্কুলে প্রতিদিন প্রার্থনাসভায় যে-গানটি গাওয়া হত, সেটিও তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন – ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা।’ ছাত্ররা গাইত। সঙ্গে বেহালা বাজাতেন তাঁদের হেডস্যার। হেডস্যার স্বপ্ন দেখতেন এমই স্কুলকে একদিন হাইস্কুল বানাবেন। হয়েছিলও তাই। বছর কয়েক বাদে দুর্গাচরণ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল প্রথম ব্যাচের জনা কুড়ি ছাত্র। বাংলা স্কুলের পুরনো বিল্ডিং-এর পাশেই ছিল বিরাট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল। সংক্ষেপে, সিএমএস। তার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মিস্টার হার্ডফোর্ড। ছাত্রদের তিনি ক্রিকেট শেখাতেন। ক্রশ-ব্যাটে খেললে খুব রেগে যেতেন। স্কুলের কাজ সারা হলে সারাটা শহর চক্কর মারতেন সাইকেলে। ইহুদি কোহেন সাহেবের অনেক সম্পত্তি ছিল ভাগলপুরে। বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল তাঁর আমবাগান। টাকা ধার দেওয়ারও কারবার ছিল তাঁর। কোহেন সাহেবের তিন কন্যা ছিল। অতীব সুন্দরী ছিলেন তাঁরা – সেরা, ডোরা, ফ্লোরা। তাঁদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তাই নিয়ে তর্ক লেগে যেত তপনের বন্ধুদের মধ্যে। ডোরার টিকালো নাক, আয়ত চোখ। কোনও মেকআপ ছাড়াই তাঁকে সুন্দর লাগত তপনের। খুব ইচ্ছে হত পরিচয় করার, কিন্তু সে আর কোনদিন হয়ে ওঠেনি। তপনের স্কুলে ইতিহাস আর ইংরিজি পড়াতেন গুরুদাসবাবু। বড় সুন্দর ছিল তাঁর পড়ানোর ধরন। এক দিন ফরাসি বিপ্লব পড়াতে পড়াতে চলে এসেছিল চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিজ’-এর প্রসঙ্গ। কারণ ওই সময়ই ভাগলপুরে এক সিনেমা হলে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ ছবিটি এসেছিল। পাঠ্য বই ছেড়ে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ পড়িয়েছিলেন তপনের ইতিহাস স্যার। দিন দুয়েক বাদে ছাত্রদের বলেছিলেন, ‘‘যাও এ বার ছবিটি দেখে এসো।’’ ওই ছবি দেখাতেই বোধহয় প্রথম বারের মতো তাঁর মধ্যে বীজ পুঁতে গিয়েছিল সিনেমার।
এর মধ্যে ঘটেছিল আরও কিছু কাণ্ড! একবার গান্ধীজি এসেছিলেন ভাগলপুরে। তপন তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ভিড়ের মাঝে গান্ধীকে দেখতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে তাঁর পাঁজরের তাঁর হাড় ভেঙেছিল। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে আসতে হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। তিন মাস লেগেছিল তাঁর সুস্থ হতে। ভাগলপুরে একবার নেতাজি সুভাষচন্দ্রও এসেছিলেন। ঝলমলে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তপন সিনহার বড় সুন্দর লেগেছিল তাঁকে।
কলেজের পাঠ শেষ করে ভাগলপুর ছেড়েছিলেন তপন ’৪৩ সালে। কলকাতা শহর তাঁর একেবারে অপরিচিত ছিল না। তাঁর জন্মই তো হয়েছিল কলকাতায়। বছরে দু’তিন বার আসাও হয়ে যেত সেখানে। কিন্তু ’৪৩ থেকে ’৪৬ কলকাতার ছাত্রজীবন যেন দুঃসহ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর কাছে। এক দিকে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রকোপ, অন্য দিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ম্যালেরিয়া আর মহামারী। কলকাতার রাস্তায় তখন পড়ে থাকত অনাহারে মৃত মানুষের লাশ। ’৪৬ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি শেষ করে ঢুকেছিলেন নিউ থিয়েটার্সে, আজ থেকে ঠিক চুয়াত্তর বছর আগে। তার পর থেকে প্রায় শেষ দিন অবধি নাগাড়ে তাঁর মনের গভীরে বয়ে গিয়েছিল ছায়া আর ছবির খেলা। গুনগুন করে একটানা একটা গান – ঠিক যেন তাঁর শৈশবের সেই গোপাল বৈরাগীর গানের মতো।
তিনি ছিলেন ছবির কথক। আরও ভালো করে বললে, চলচ্চিত্রের কথক। যেমন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর … যে ছবি লেখে? তেমনই বোধ হয়, কোন তপন … যে গল্প দেখায়? তরুণ মজুমদার বলেছিলেন, যখন ত্রিমূর্তি অর্থাৎ, সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিক পূর্ণ শক্তিতে সৃজনশীল, তখনও রোদের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে, হলের বাইরে কাতার দিয়ে দর্শক দাঁড়িয়ে থাকতেন তপন সিংহের ছবি দেখতে। এই দর্শকরাই কিন্তু ঐ ত্রিমূর্তির কোর দর্শক মন্ডলী। কিন্তু তাঁদের বৃহৎ অংশ ত্রিমূর্তিকে অবিমিশ্র শ্রদ্ধাশীলতায় গ্রহণ করেছেন মেধার মঞ্চে। তপন সিংহের জন্য আলাদা করে হয়তো হৃদয়ের কোনও একটা কোণ সংরক্ষিত থেকে গিয়েছিলো। মানুষের চিরকালীন আবদার ‘গল্প ভালো আবার বলো’। সমস্ত ফলিত শিল্প তো গল্পই বলে। এমনকি গল্পহীন যে প্রতিগল্প, তারো তো গল্প লাগে, নয়তো সে স্রোতের বিপরীতে যাবে কী করে?
ঊনিশ শো পঞ্চাশে পশ্চিমে গিয়ে ছবির কারিগরী কুশলতার সব পাঠ নিয়ে ছিলেন তিনি। নিও রিয়ালিস্টদের কাছ থেকে ছবি করতে দেখেছেন তিনি। প্রিয় ছবিকর, বিলি ওয়াইল্ডার, জন ফোর্ড, ক্যারল রীড বা ফ্র্যাংক কাপরা। ছোটবেলায় ভাগলপুরে হলে বসে দেখা রনাল্ড কোলম্যানের আ টেল অফ ট্যু সিটিজ, তাঁর কাছে চিরকাল ছবি তৈরির আদর্শ প্রতিবিম্ব হয়ে থেকে গেছে। অথচ সবার উপরে তাঁর চিত্তাকাশ আবৃত ছিলো রবীন্দ্রনাথ নামে এক সৃষ্টিপর মূল্যবোধে, যা তিনি আজীবন কারণে অকারণে বারম্বার উচ্চারণ করে গেছেন। এজন্যই হয়তো বিংশ শতকের বাঙালির মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি অতো সহজে ছবিতে নিয়ে আসতে পারতেন। তা বলে তাঁর সৃষ্টিশীলতা সীমাবদ্ধ ছিলো, একথা তাঁর অতি বড়ো শত্রুও বলতে পারবে না। ভাবা যায় ১৯৫৫ র আগে ১৯৫৪তে ছবি করলেন অঙ্কুশ, একটি হাতি যার নায়ক। কিন্তু তারও একটি গল্প আছে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আমার বিচারে বিষয়বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তাঁর তুলনা তিনি নিজে। অন্তত এই ডিপার্টমেন্টে সত্যজিৎও তাঁর থেকে ঈষৎ পিছনে। যদিও সে বিষয়ে হয়তো কেউ কেউ অন্যমতও হবেন। যাঁরা চলচ্চিত্রের আপোসহীন ভিজ্যুয়াল শুদ্ধতায় আস্থাধারী, তাঁরা অবশ্যই স্বীকার করবেন না যে এই চলচ্ছবি শুধু গল্প পৌঁছে দেবার মাধ্যম। সেটা অবশ্যস্বীকার্যও বটে। কিন্তু প্রাচ্যের আবহমান সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে এপিক মাত্রার প্রভাব এতো বেশি যে সব ধরণের কলামাধ্যমই কোনও না কোনও প্রোটাগোনিস্ট কেন্দ্রিক। সে রাম বা গোরা বা সাগিনা মাহাতো, যেই হোকনা কেন। সিনেমার মূল উদ্দেশ্য যদি উপযুক্ত দর্শকের কাছে নিজের বোধকে সঞ্চারিত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে, তবে তপন সিংহের সাফল্যকে কেউ খর্ব করতে পারবে না। যতই তাঁকে লিনিয়ার ট্রিটমেন্ট দোষে অভিযুক্ত করা হোকনা কেন।
তপন সিংহ সম্পর্কে বলা হয় তিনি ছিলেন একজন quintessential বাংলা ছবিকর। এই বিশেষণটি প্রয়োগের কারণ এমন নয় যে তাঁর ছবি গ্রাম বাংলা বা তৎকালীন নাগরিক বাঙালির কথাই শুধু বলে। তিনি বাঙালি ছিলেন তাঁর সংবেদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ও রবীন্দ্র-সহজাত ন্যায়-অন্যায়বোধে। তাঁর আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি ছিলো একজন গড় বাঙালির বিশ্ববীক্ষার মাপদন্ড যা সত্যজিতের থেকে খানিকটা ভিন্ন। ছবির বিষয় বৈচিত্র্যে তিনি অনন্য, আগেই বলেছি, কিন্তু গঠনকৌশল ও সৌন্দর্যবোধের নিরিখে তিনি ক্ল্যাসিসিস্ট। তিনি কেন ছবি করছেন সেই ধারণাটি খুব স্পষ্ট ছিলো তাঁর কাছে। দর্শককে তাঁর যেকথাটি বলার আছে সেটি তিনি এক গল্পের আধারে বলবেন। গল্পটিকে সঠিক মাত্রায় গ্রহণযোগ্য করতে যা যা প্রয়োগকৌশলের আশ্রয় প্রয়োজন, সব নেবেন তিনি সমস্ত উৎস থেকে, কিন্তু চমক লাগানো প্রয়োগকৌশলের মোহকে দূরে সরিয়ে রাখবেন এক সন্ন্যাসীর নির্লিপ্তিতে। একটি নির্মাণ যখন সৃষ্টি হয়ে ওঠে, তখন তার নিবেদন (dedication) ও বিনোদনের (entertainment) কোনও পৃথক মাত্রা (dimension) থাকেনা। একই সঙ্গে একটি ছবি সিরিয়াস ও বিনোদন-উচ্ছল হয়ে উঠতে পারে। একজন প্রকৃত চলচ্চিত্র শিল্পীকে আলাদা করে exploitation আর entertainment এর ছবি করতে হয়না। প্রকৃষ্টতম উদাহরণ চ্যাপলিন। অবশ্যই তপন চ্যাপলিন নন, কিন্তু ঘরানাটি একই। এই জাদুটিই তপনকে এতো জনবরেণ্য শিল্পী করে তুলেছিলো। তিনি গৌতম বুদ্ধ কথিত চিরন্তন ভারতীয় মধ্যপন্থার পথিক। সংবেদনশীলতায় তিনি দৃঢ়, অশ্রুসজল সেন্টিমেন্টকে বর্জন করেন , আবার প্রতিবাদে তিনি কঠোর, কিন্তু উচ্চকিত স্ট্রীটফাইটার নন। যখন পিরিয়ড ছবি বানাচ্ছেন, তখন তিনি তাঁর প্রিয় ছবিকর কোলম্যানের মডেলটি অনুসরণ করছেন, অনেক বেশি জনপ্রিয় ও উচ্চকিত সিসিল ডি’মেল তাঁর অভীষ্ট নন। ‘ঝিন্দের বন্দী’ বা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ তৈরি করার সময় তিনি জাঁকজমকের চেয়ে বঙ্গীয় sensibilityকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়েচেন। এর সব চেয়ে বড়ো উদাহরণ আমরা দেখি রবি’ছবি বানাবার সময় তাঁর অবস্থান থেকে। সে সব ক্ষেত্রে আমরা দেখি তাঁর ক্যামেরা মূলতঃ কাঁধের উচ্চতায় থাকছে। সেখানে তিনি গল্পটি বলছেন একজন কথক হয়ে এবং দর্শক ভাগ করে নিচ্ছেন কথকের দৃষ্টি। পরিচালক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ভরতের মতো, যে জানে দর্শকের হৃদয়ের সিংহাসনে তিনি নেই, আছে সেই মূল স্রষ্টার পাদুকা। তিনি শুধু তাঁর গুরুর নামে এই ছবিটি তৈরি করেছেন। শিল্পী হিসেবে নিজের সব অহমিকা তিনি ডুবিয়ে দিয়েছেন দর্শককে আরও কাছে পেতে। তাঁর অতি উচ্চকোটীর সৃজনশীলতার ফুলঝুরিকে সংযত করে রেখেছেন যাতে তা সাধারণ দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে না দেয়। তাঁর একান্ত কামনা ছবিটির অধিরাজ যেন রবীন্দ্রনাথই থাকেন, তপন নয়। এই সৃষ্টির আনন্দে পরিচালক ও দর্শক একাত্ম হয়ে পড়েন। এখানেই তাঁর সিদ্ধি। এখানেই তিনি সত্যজিতের থেকে পৃথক হয়ে যান। কারণ সত্যজিতের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। একান্ত ও ব্যক্তিগত।
যাবতীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও তাঁর প্রকৃত খেলার মাঠ ছিলো আমাদের চারপাশের জীবন থেকে উঠে আসা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভাসমান জলছবিগুলি। জলছবির অনুপ্রেরণা থেকে অজন্তা বা আলতামিরার গুহাচিত্র সৃষ্টি করে ফেলা তাঁর ক্ষমতার রাজপাট । ‘লৌহকপাট’, ‘হাটে বাজারে’, ‘আরোহী’, ‘আপনজন’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘রাজা’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘আতঙ্ক’, ‘এক ডক্টর কি মৌত’, ‘অন্তর্ধান’, ‘হুইলচেয়ার’, সব তো এই সূত্রেই আমরা পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে কেউ বুনুয়েলের নাম করে, কিন্তু আমি ডি’সিকার নামও নেবো। এমনকি আমাদের নিজেদের মৃণাল সেনও অবশ্য স্মর্তব্য। একই ঘটনাক্রম যখন বিভিন্ন বড়োমাপের শিল্পী নিজেদের মতন করে ভিজ্যুয়ালাইজ করেন, তা সব ভিন্ন ভিন্ন রাগরাগিণী হয়ে ওঠে। আমাদের মতো ইতর দর্শকদের এটাই বৃহৎ প্রাপ্তি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, যদি বিষয়বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়, তবে তপন সিংহের সঙ্গে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের নামই নেওয়া যেতে পারে। তিনি কখনও পুনরাবৃত্তি করেননি। সর্বদা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন আদ্যন্ত, গভীর মানবতাবাদী। তাই ‘স্টোরিটেলার’ হিসেবে শুরু করেও তিনি একজন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছবিনির্মাতা হয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি সচেতনভাবেই তাঁরা স্বভাবসিদ্ধ সরলরৈখিক ন্যারেটিভ শৈলিকে চিরকাল আশ্রয় করে থেকেছেন। কোনও ‘আভাঁ-গার্দ’ আঙ্গিককে আমল দেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সরাসরি দর্শকের হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্পর্শ করা। কোনও শৈল্পিক ঘোরা পথে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। একেবারে চলিত নাটকীয় টেকনিকগুলিকে সফলভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সূক্ষ্ম শিল্পমুহূর্ত তৈরি করে ফেলার সিদ্ধি তাঁর আয়ত্ত ছিলো। তপন যখন ব্যক্তিমানুষের গভীরতম অনুভূতি থেকে উঠে আসা ছোটো বড়ো তরঙ্গগুলিকে নিয়ে ছবি করেন, সেখানেও কেন্দ্র থেকে পরিধির বৃত্তে দোলাচলিত সূক্ষ্মতম অনুভবগুলিকে অবলীলায় পর্দায় তুলে আনেন নির্জন সৈকতে, জতুগৃহ, এখনই বা শতাব্দীর কন্যায়। মৃণাল সেন ব্যাপারটি খুব গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তপন সিংহ আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ ‘মধ্যপন্থী’ চিত্রকার। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ‘‘We differed in many ways and I did not agree with him all the time, but that does not mean that I do not consider him one of the finest directors in India. I have also never found a human being as good and as powerful as Tapan Sinha.’’
বাংলা ছবির ফ্যান্টাসি শাখার এখনও পর্যন্ত সফলতম স্রষ্টা তপন সিংহ। গল্প হলেও সত্যি, এক যে ছিলো দেশ, বাঞ্ছারামের বাগান, আজব গাঁয়ের আজব কথা, তো এখনও বেঞ্চমার্ক। এর আগে যমালয়ে জীবন্ত মানুষ বা এ জাতীয় দুচারটে ছবি ছাড়া এই শাখায় বাংলা ছবিতে উল্লেখ্য কিছু নেই। সবার শেষে নাম নিচ্ছি আদমি অওর আওরতের। এই ছবিটি পৃথক উল্লেখ দাবি করে। যদিও এটি টেলিছবি, তবু একটি অনন্য সৃষ্টি। তাঁদের যাবতীয় স্ববিরোধ, মূর্খামির কথা মনে রেখেও বাঙালি সমাজের চালিকাশক্তি যথারীতি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। তাঁদের মানসিক গঠনটি সম্বন্ধে বিনয় ঘোষ মশাই একসময় লিখেছিলেন ‘মেট্রোপলিটান মন, মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ নামক সন্দর্ভটি। ইংরেজের নিয়ে আসা সংস্কারমনস্কতার সঙ্গে মধ্যবিত্তের ক্রোমোজোমে প্রকট যে সামন্তবাদিতা, উভয়ের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত সংস্কারের প্রতিই পক্ষপাত দেখিয়ে থাকেন। উত্তম-সুচিত্রা মাথায় থাকলেও সামন্ততান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে তৈরি করা বাংলা বাজারধন্য ছবিগুলির ঊর্ধে গিয়ে তাঁদের অন্য কোথাও একটা পৌঁছোনোর টান চিরকাল থাকে। তপন সিংহ এই টানটিকে তাঁর সৃষ্টির মূলস্রোত করে তুলেছিলেন। মধ্যবিত্তের মধ্যচিত্তে তোলপাড় সাধ ও সাধ্যের টানাপড়েন, যার নিয়ন্ত্রণ থাকে তাঁদের উদারনৈতিক সংস্কারী প্রবণতাগুলিতে, চিরকাল তপনকে ভাবিয়েছে। তাই সে অর্থে কখনও আপোস না করেও তাঁর ছবি দর্শকের অনাবিল আনুকূল্য লাভ করেছে চিরকাল। নিছক বিনোদন বা মেধাচর্চার মাঝখানে যে বিপুল সিনেমাটিক স্পেস, সেটিকে তিনি খুব সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সিনেমা যে শুধুমাত্র মেধাচর্চার আখড়া নয়, তা একটি গণমাধ্যম, সে বিষয়ে তাঁর ধারণাটি খুব স্পষ্ট ছিলো। সিনেমার হিস্ট্রি বইয়ের থেকে মানুষের মগজের মহাফেজখানাটা যে অনেক বড়ো আশ্রয়, তাও তিনি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এই উপলব্ধিটি তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। তাঁকে অনুসরণ করে অন্যান্য বাঙালি পরিচালকদের কাফিলা বহুদিন ধরে এগিয়ে গেছে। সফলও হয়েছে। দর্শকদের ঝুলিও কখনো খালি যায়নি।
(তথ্যসূত্র:
১- মনে পড়ে, তপন সিংহ, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- কিছু ছায়া কিছু ছবি, তপন সিংহ, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ (২০০৯)।
৩- চলচ্চিত্র আজীবন, তপন সিংহ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত