জানবাজারের বিখ্যাত ধনী প্রীতিরাম মাড়ের পুত্রবধূ রাসমণি বিধবা হবার পর নিজেই তাঁদের বিপুল সম্পত্তি ও বৃহৎ সংসারের হাল ধরেন। মাহিষ্য বংশীয়া এই রমণীটি বিদ্যাশিক্ষা করেননি বটে, কিন্তু তাঁর জাগতিক জ্ঞান ছিল অতি প্রখর। বিষয়সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি কড়া নজর রেখেছিলেন। পূজাআচ্চা ছাড়াও প্রতিদিন তাঁকে সংবাদপত্র পাঠ করে শোনাতে হত। আরও আশ্চর্য, যোগাযোগ রক্ষার জন্য তিনি শহরের বিশিষ্ট সায়েবদের নিজের বাড়িতে ভোজসভায় নেমন্তন্ন করতেন এবং সেই উপলক্ষে জানবাজারের বাড়ি বিশেষ ভাবে সজ্জিত করতেন। তাঁর স্বামী রাজা ছিলেন না, কিন্তু স্বামীর নাম ছিল রাজচন্দ্ৰ, সেই সুবাদে রাজচন্দ্রের পত্নীকে অনেকে ‘রানী’ বলে অভিহিত করেন। এবং তিনি রানী নামের যোগ্যও বটে। শ্ৰীমতী রাসমণি ছিলেন যেমন রূপবতী, তেমন তেজস্বিনী। তবে রাজচন্দ্র ও তাঁর পিতা প্রীতিরাম মাড় যে-সে লোক ছিলেন না। রাজচন্দ্র ছিলেন দূরদর্শী ব্যবসায়ী। সেই সঙ্গে জমিদারি। যে দিন ২০/২৫ হাজার টাকা লাভ না হত, সেদিন আয় অতি অল্প হল বলে তিনি মনে করতেন। কোনও কোনও দিন লক্ষাধিক টাকাও লাভ করতেন। এই টাকায় তিনি কলকাতায় বিপুল সংখ্যক বাড়ি কিনেছিলেন। এই তালিকাটি দেখলে আজও বিস্মিত হতে হয়। পিতৃদেব প্রীতিরাম মৃত্যুকালে (১৮১৭) সাড়ে ছয় লাখ টাকার ধনসম্পত্তি রেখে যান। রাজচন্দ্রের দেহাবসান ৫৩ বছর বয়সে ১৮৩৬ জুন মাসে। তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর বয়স তখন ৪৪ বছর। মৃত্যুকালে তাঁর তিন কন্যা, তিন জামাতা, নাতি নাতনি ও স্ত্রী রাসমণি। সম্পত্তির পরিমাণ অগাধ, তা ছাড়া নগদ ৬৮ লাখ টাকা, বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শেয়ার ৮ লাখ টাকা, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দেওয়া ঋণ ২ লাখ টাকা এবং সায়েব কোম্পানি হুক ডেভিডসনকে দেওয়া ঋণ ১ লাখ টাকা।
রূপের জন্যই সামান্য দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও রাসমণি এত সম্পদশালী পরিবারের বধূ ও কর্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতা হন। জন্মস্থান হালিশহরের কাছে গঙ্গাতীরে কিশোরী রাসমণি একদিন স্নান করতে এবং জল তুলতে এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়েস এগারো। সেই সময় যুবক রাজচন্দ্ৰ গঙ্গাবক্ষে বজরায় বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে যাচ্ছিলেন কোনো তীর্থে। রাজচন্দ্রের তখন হৃদয় ভগ্ন, জীবনে শান্তি নেই। পর পর দুটি স্ত্রী পরলোকগমন করায় রাজচন্দ্রের আর বিবাহে মতি নেই। কিন্তু নদীকূলে ঐ রূপলাবণ্যবতী কিশোরীটিকে তাঁর চোখে লেগে গেল। রাজচন্দ্রের বন্ধুবান্ধবরাও বললেন, সত্যি, এমনটি আর হয় না। তাঁরা অনুসন্ধান করে জানলো যে, জাতের অমিল নেই, কন্যাটি পালটি ঘরের। পুত্রের বন্ধুদের মুখে সব কথা জানতে পেরে প্রীতিরাম ঐ মেয়েটিকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এলেন। বধূ সুলক্ষণা, তিনি আসবার পর এই পরিবারের উত্তরোত্তর শ্ৰীবৃদ্ধি হতে লাগল। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর আগে রানী রাসমণির নাম সর্বসাধারণের মধ্যে বিশেষ পরিচিত ছিল না। স্বামীর শ্রাদ্ধের সময়ই তাঁর খানিকটা পরিচয় পাওয়া গেল। এমন দানশীলা রমণী কেউ আর আগে দেখেনি। দানসাগর শ্রাদ্ধে পর পর দুদিন ধরে তিনি মুঠো মুঠো ধন দান করতে লাগলেন। তাঁর নির্দেশ, কোনো প্রার্থীই যেন ফিরে না যায়। তৃতীয় দিনে তিনি করলেন ‘তুলট’। শুদ্ধ বস্ত্ৰ পরে রানী রাসমণি বসলেন দাঁড়িপাল্লার একদিকে, অন্যদিকে চাপানো হলো শুধু রূপোর টাকা। তাঁর দেহের ওজন হলো ছ’হাজার সতেরোটি রৌপ্যমুদ্রা, সেগুলি সেই দণ্ডেই বিতরণ করা হলো পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে। তারপর থেকে যে কোনো মহৎ কর্মের উদ্দেশ্যে কেউ প্রার্থী হয়ে এলে রানীর কাছ থেকে আশাতীত দান পেয়ে যায়। রানী রাসমণি যেমন একদিকে অকাতরে দান করেন তেমনি অন্যদিকে বিষয় সম্পত্তিও বাড়িয়ে চলেছেন। কী জমিদারি পরিচালনায়, কী ব্যবসায় কাৰ্যে, তিনি পরিচয় দেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার। অর্থ উপার্জনে তাঁর যেমন আনন্দ, তেমনি ব্যয়ে। কলকাতার অন্য ধনীদের প্রায় সবার সঙ্গে রাসমণির একটি পরিষ্কার পার্থক্য চোখে পড়ে। অন্যরাও অনেক সময় দান ধ্যান করেন বটে, কিন্তু বিলাসে প্ৰমোদেও তাঁরা কম অর্থব্যয় করেন না। কিন্তু রানী রাসমণি ছিলেন শুদ্ধাচারিণী, বিশেষ বিশেষ তিথিতে তিনি ভূমিশয্যায় নিদ্রা যেতেন।
কলকাতার ধনীদের মধ্যে একমাত্র ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্ৰনাথ সমস্ত বিলাসিত পরিত্যাগ করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এক হিসেবে দেবেন্দ্ৰনাথও ছিলেন রানী রাসমণির প্রতিপক্ষ। দেবেন্দ্ৰনাথ প্রচার করছেন, দেশবাসী পুতুল পূজা পরিত্যাগ করে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করুক। আর রানী রাসমণি পূজা করতেন সাকার ঈশ্বরের। সমস্ত দেব-দেবীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি ছিল। হিন্দু ধর্মের মহিমা বিস্তারের জন্য তাঁর ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত ছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর স্বামীর কাছ থেকে এক সময় দু’লক্ষ টাকা কার্জ নিয়েছিলেন, যথাসময়ে তা শোধ করতে পারেননি বলে ঠাকুরদের জমিদারির একটি পরগণা চলে যায় রানী রাসমণির অধীনে। সুতরাং, প্রকারান্তরে দ্বারকানাথেরই জমিদারির টাকায় দেবেন্দ্ৰনাথ ও রানী রাসমণি পরস্পরবিরোধী দুই ধৰ্মকর্মে ব্যাপৃত ছিলেন। আতুড়ালয় স্থাপন, গঙ্গায় ঘাট নির্মাণ, বিভিন্ন তীর্থের দেবদেবীর অলঙ্কার সজ্জা, এ সব তো আছেই, তা ছাড়া এই নগরের উন্নতিকল্পেও তাঁর যত্নের অন্ত ছিল না। জানবাজারে রানী রাসমণির প্রকাণ্ড অট্টালিকায় দোল-দুর্গোৎসবের জাঁকজমকও কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রবাদ-প্রসিদ্ধি পেয়ে গেল। দুর্গোৎসব করতেন বটে পোস্তার রাজা সুখময় রায়, তারপর এই রানী রাসমণি। এই সব উৎসবে সারা শহরের লোক ভেঙে পড়ত তাঁর বাড়িতে। রথের দিন পথে বেরোত প্রাসাদতুল্য সম্পূর্ণরূপোয় নির্মিত রথ, তার পিছনে প্ৰায় আধ ক্রোশব্যাপী শোভাযাত্রা, তাতে অবিরাম শোনা যেত গীত, বাদ্য আর হরি বোল ধ্বনি।
দুর্গোৎসব উপলক্ষেই রানী রাসমণির অন্য একটি রূপ প্রকাশিত হলো একবার। মহালয়ার দিনের বোধন থেকে শুরু হয় উৎসব। সপ্তমীর দিনে খুব ভোরে ব্ৰাহ্মণরা নব পত্রিকা নিয়ে গঙ্গায় স্নান করাতে যায়, তাঁদের পেছনে পেছনে বাজনাদাররা ঢাকা, ঢোল, সানাই, করতাল বাজাতে বাজাতে চলে। সেই তুমুল বাদ্যরবে এক সাহেবের নিদ্রার খুব ব্যাঘাত হল। তিনি গবাক্ষ খুলে দেখলেন একদল অর্ধ উলঙ্গ নেটিভ বিকট শব্দ করে লাফাতে লাফাতে চলেছে। নেটিভদের অনেক প্রকার উদ্ভট মুর্খামির পরিচয় এর আগে পাওয়া গেছে, কিন্তু সূর্যোদয়ের আগে সকলকার ঘুম ভাঙিয়ে একি উৎকট আনন্দ! মুখ রক্তবর্ণ করে সাহেব দারুণ চেঁচামেচি করতে লাগলেন এবং তখনই হুকুম দিলেন বাজনা বন্ধ করার। কিন্তু রানী রাসমণির লোকেরা শুনবে কেন? তাঁরা কর্ণপাত না করে তেমনভাবেই ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল। ক্ৰোধে অগ্নিশর্মা হয়ে সাহেব খবর দিলেন কোতোয়ালিতে। পুলিসের সাহায্য চাইলেন, যাতে ফেরার পথে ঐ নেটিভরা তাঁর শান্তি ভঙ্গ করতে না পারে। দু-একজন অনুচর, এ সংবাদ জানালো রানী রাসমণিকে। তিনিও দপ করে জ্বলে উঠলেন রাগে। তিনি বললেন, ‘আমরা হিন্দু, আমাদের ধর্মকর্মে বাধা দেবার কী অধিকার আছে সাহেবের? সাহেবরা যে খৃষ্টীয় পরবে সারারাত্রব্যাপী হল্লা করে, তখন কি আমরা বাধা দিতে যাই? যা, আরও বেশী করে ঢাক ঢোল বাজা গে যা তোরা! শুধু তাই নয়, আজ সারাদিন ধরে এই পথ দিয়ে বাজাতে বাজাতে যাবি আর আসবি।’ তিনি কয়েকজন পাইকও পাঠিয়ে দিলেন ওদের সঙ্গে। দু’চারজন পুলিস সেই শোভাযাত্রাকে বাধা দিতে পারলো না। রাসমণির কর্মচারীরা বলল, ‘আমাদের মা বলে দিয়েছেন, এ রাস্তা আমাদের, এখানে আমরা যা খুশী করবো।’ সাহেব হাত পা কামড়াতে লাগলেন, সারাদিন ধরে অসহ্য ঢাকের বাজনা তাঁর কান ঝালাপালা করে দিল। সাহেব একটি মামলা ঠুকলেন রাসমণির নামে। ইংরেজের আদালতে ইংরেজ আনীত মামলার ফলাফল যা হবার তাই হলো, পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হল রাসমণির। কিন্তু এ রমণী বড় জেদী, কিছুতেই হার স্বীকার করার পাত্রী নন। জরিমানার টাকা জমা দিয়ে রাসমণি বললেন, বেশ, এর পর থেকে যে রাস্তা আমি বানিয়েছি, সে রাস্তা দিয়ে অন্য কারুর হাঁটা চলার এক্তিয়ার থাকবে না। বড় বড় গরাণ কাঠের গুড়ি দিয়ে তিনি জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে শক্ত বেড়া দিয়ে দিলেন। সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেল, নগর পরিচালকরা পড়লেন মহা অসুবিধেয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা আপোস করলেন রাসমণির সঙ্গে, ক্ষমা চেয়ে তাঁরা জরিমানার টাকা ফেরত দিলেন। রাসমণিও তুলে নিলেন পথের বেড়া। এক স্ত্রীলোকের এই জয় কাহিনীতে খুব আমোদ পেল নগরবাসীরা।
রানী রাসমণি আর একবার কোম্পানী বাহাদুরকে জব্দ করেছিলেন। সরকার থেকে হঠাৎ আদেশ জারি করা হল, গঙ্গায় আর জেলেরা ইচ্ছে মতন মাছ ধরতে পারবে না। মাঘে সরস্বতী পূজার পর থেকে সেই আশ্বিন মাস পর্যন্ত গঙ্গা থাকে ইলিশ মাছে ভরা, তখন গঙ্গাবক্ষ জেলে ডিঙিতে ছেয়ে যায়। এর ফলে জাহাজ চলাচলে অসুবিধা হয় বলে ঠিক হল যে যাঁর খুশী মতন আর সেখানে মাছ ধরতে পারবে না। এজন্য কর দিতে হবে। কর দিতে গেলেই জেলে ডিঙির সংখ্যা যাবে অনেক কমে। মৎস্যজীবীরা গিয়ে কেঁদে পড়ল রানী রাসমণির পায়ে। অনেকের জীবিকা নষ্ট হবার উপক্ৰম। এখন রানী না বাঁচালে তাঁদের কে বাঁচাবে? তিনি ছাড়া তাঁদের জাতের দুঃখে আর কে সমব্যাথী হবে? রাসমণি তখন আবার এক চমকপ্ৰদ বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। সরকার মাছ ধরার জন্য কর চেয়েছেন, ঠিক আছে, সেই কর তিনি একাই দেবেন। দশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ঘুষুড়ি থেকে মেটেবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গা ইজারা নিয়ে নিলেন সরকারের কাছ থেকে। তারপর জাহাজ লঙ্গর করার মোটা দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেললেন গঙ্গার সেই এলাকা, জেলেদের বলে দিলেন, এবার তোরা মাছ ধর, যত খুশী মাছ ধর। দড়ি দিয়ে ঘেরার ফলে সব জাহাজ আটকে গেল। কলকাতার বন্দরে আর কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না, কলকাতার জীবন অচল হয়ে যাবার উপক্ৰম। কলকাতার লোক সবাই সেদিন গঙ্গার তীরে গিয়েছিল রানী রাসমণির কীর্তি দেখতে। সে বড় অদ্ভুত দৃশ্য। মোটা দড়ির ওধারে সার বেঁধে থমকে আছে ইংরেজের জাহাজ, তার নাবিকরা সব হতভম্ব, আর এদিকে পতঙ্গের মতন অজস্র জেলে ডিঙি ভাসছে, জেলেরা উল্লাসে ‘হো হো – হা হা’ করছে। এই দৃশ্যে বড় মজা পেয়েছিল সাধারণ মানুষেরা। কলকাতার লোকেরা একে অপরকে বলেছিল, ‘দ্যাক দ্যাক, জানবাজারের জমিদারণী ইংরেজের মুখে চুনকালি দিয়েচে।’ ব্যতিব্যস্ত হয়ে সরকার রাসমণির কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করলেন। রাসমণির উত্তর অতি সরল। মাছ ধরার জন্য তিনি গঙ্গার অংশ ইজারা নিয়েছেন, এখন সেই অংশ তিনি জেলেদের মধ্যে বিলি করতে পারেন, সে অধিকার তাঁর আছে। এখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করলে মাছ ধরায় বিঘ্ন হবে। সরকার তাঁকে ইজারা দিয়েছেন। এখন তাঁর সুবিধে অসুবিধে দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। পুকুর জমা নিয়ে যখন বেড়া জাল ফেলে মাছ ধরা হয়, তখন কি পাড়া-প্রতিবেশীরা সেই পুকুরে আর নাইতে আসে? এরপরে কি আর বিতর্ক সাজে! জেলেদের আবার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হল, রানীও দড়ি কাছি গুটিয়ে নিলেন।
রানীর বয়েস তখন ষাট, কিন্তু স্বাস্থ্য অটুট, আর তেজও এক বিন্দু কমেনি। পরিণত বয়সে তাঁর রূপ আরও মহিমান্বিত হয়েছে, তখনও তিনি স্বয়ং জমিদারি পরিচালনা করেন, প্রজাদের দুঃখ দুৰ্দশার কথা শোনেন। তখন তাঁর জীবনের প্রধান ব্ৰত দুটি। প্রজাদের প্রতি অবিচার রোধ এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্থাপন। খৃষ্টানী এবং নিরাকার ব্রহ্মের পূজা, তাঁর দুই নয়নের বিষ। হিন্দু ধর্মের গৌরব তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে যাবেনই। তখন তিনি একটি অতি বৃহৎ কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং সেই ব্যাপারেই প্রবল আঘাত পেলেন দেশবাসীর কাছ থেকে।
রানী স্বাবলম্বিনী। বিধবা হবার পর তিনি প্রায়ই এক সঙ্গে অনেক বজরা সাজিয়ে, পাইক বীরকন্দাজ সঙ্গে নিয়ে নানান তীর্থ ভ্ৰমণে গেছেন। একবার তিনি কাশীধামে গিয়ে বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা দর্শন করে আসবেন মনস্থ করেছিলেন। কাশী অনেক দূরের পথ, দস্যু-তস্করের উপদ্রবের ভয় আছে, কিন্তু একবার কোনো কথা মনে এলে রানী আর নিরস্ত হন না। তিনি এক সঙ্গে পঁচিশখানা বজরা সাজালেন, তাতে নিলেন ছ’মাসের উপযোগী খাদ্যদ্রব্য আর প্রচুর লোকলস্কর ও অস্ত্ৰধারী প্রহরী। মধ্য রাত্রে জোয়ারের পর বজরার বহর ছাড়বে। আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে রানী আগেই নিজস্ব বজরায় উঠে শুয়ে পড়েছেন। ঘুমের মধ্যে কখন বজরা ছেড়েচে, তিনি খেয়াল করেননি। এমন সময় রানী একটি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন নয়, রানীর মনে হলো দৈব দর্শন। স্বয়ং জগৎ জননী মা কালী তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলছেন, তোর সন্তানতুল্য ছেলেরা খেতে পরতে পাচ্ছে না, তাঁদের ছেড়ে তুই কোথায় চললি? কাশী? এদের সেবা কর, তাতেই আমাকে পূজা করা হবে। এখানে এই গঙ্গাতীরেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেবার ব্যবস্থা কর, সেখানেই আমি তোর হাতের পূজা গ্রহণ করব। স্বপ্ন ভেঙে যেতেই রানী রাসমণি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে সিক্ত। স্বপ্ন নয়, যেন একেবারে সত্য। মা তাঁকে আদেশ দিয়ে গেছেন। একটুক্ষণ আচ্ছন্ন ভাবে বসে রইলেন তিনি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললেন, ‘ওরে, বজরা থামা, বজরা থামা!’ পরদিন প্ৰভাতে সবগুলি বজরার অন্ন বস্ত্ৰ স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে রানী ফিরে এলেন জানবাজারে। তাঁর যাত্ৰা ভঙ্গের কারণ আর কারুর কাছে ব্যক্ত না করে তিনি ডেকে পাঠালেন মথুরকে। রানীর পুত্ৰ সন্তান ছিল না। ছিল চারটি কন্যা। এর মধ্যে তৃতীয়া কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন এই মথুরের সঙ্গে। সেই কন্যাটি অকালে মারা যায়। তারপর চতুর্থ কন্যাটির সঙ্গেও মথুরেরই বিবাহ দিয়ে তাঁকে তিনি ঘরজামাই করে রেখেছিলেন। এই মথুর ছিলেন বেশ বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, রানীর বিষয়কর্মের ডান হাত। মথুরকে ডেকে তিনি বললেন, ‘তুমি গঙ্গার কুলে জমি দেখো, আমি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবো।’ গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারানসী সমতুল, সুতরাং পশ্চিম পারে জমি পেলেই ভালো হয়। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেদিকে পছন্দমতন এক লপ্তে অনেকখানি জমি পাওয়া গেল না, বরং পূর্বপারে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে জমি বিক্রয় আছে। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নী হেস্টি সাহেবের কুঠি, মুসলমানদের একটি পরিত্যক্ত কবরখানা ও এক গাজী সাহেবের পীরের আস্তানা, সব মিলিয়ে সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি, মূল্য সাড়ে বেয়াল্লিশ হাজার টাকা। সেখানে শুরু হলো একালের বৃহত্তম মন্দিরের নির্মাণের কাজ। গঙ্গার কূলে বস্তা বেঁধে আগাগোড়া বাঁধিয়ে দেওয়া হল, তৈরি হলো বৃহৎ স্নান ঘাট, তারপর দ্বাদশ শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, নবরত্ন চূড়াযুক্ত কালী মন্দির ও নাট মন্দির। যত লক্ষ টাকা লাগে লাগুক, তবু সব কিছু রানীর মনোমতন হওয়া চাই।
মন্দির গঠনের কাজে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেইজন্য রানী কঠোর কৃচ্ছতা অবলম্বন করলেন। ত্রি-সন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন গ্রহণ, ভূমিতে শয়ন এবং নিশিদিন ইষ্টদেবতার কাছে প্রার্থনা। কয়েক বছর ধরে চললো মন্দির নির্মাণের কাজ, প্রতিদিন তিনি মথুরের কাছ থেকে খবরাখবর নেন। এবং মাঝে মাঝে নিজে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে গিয়ে কাজের প্রগতি দেখে আসেন। আর বেশি বাকি নেই, বৎসরকালের মধ্যেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে, রানী এর মধ্যেই দিনক্ষণ দেখতে শুরু করেছেন। তবু বাধা এলো অন্য দিক থেকে। একদিন মথুর এসে বিষণ্ণ মুখে জানালেন সেই দুঃসংবাদ। ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা ফতোয় দিয়েছেন, জানবাজারের জমিদার-পত্নী রাসমণি দাসী দক্ষিণেশ্বর গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে, সে কাজ হবে অশাস্ত্রীয়। রানী একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। অশাস্ত্রীয়? তিনি শুদ্ধচিত্তে, ফলের প্রত্যাশী না হয়ে, তাঁর সমস্ত সম্পদ উজাড় করে মন্দির স্থাপন করতে চান, সে কাজ অশাস্ত্রীয় কেন হবে? মথুর জানালেন যে, ব্ৰাহ্মণরা বলেছেন, শূদ্রের কোনো অধিকার নেই দেবদেউল প্রতিষ্ঠার। শূদ্রের হাতের পূজা কোনো দেব-দেবী নেন না। টাকার গরম থাকলেই কি শাস্ত্ৰ উল্টে যাবে! এই বলে পণ্ডিতরা ঘোঁট পাকাচ্ছে। রানী হাহাকার করে বললেন, ‘কিন্তু মা যে স্বয়ং আমায় দেকা দিয়ে বলেচেন যে তিনি আমার হাতের পূজা নেবেন!’ ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা সে স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করবে না। স্বপ্নের কথা বলে শাস্ত্ৰ পাল্টানো যায় না। রানী রাসমণি গুম হয়ে বসে রইলেন। তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা, এ সবই তুচ্ছ? তিনি শূদ্র বংশীয়া, এটাই বড় কথা? তা ছাড়া, কে বলেছে। শূদ্র? মাহিষ্যরা মোটেই শূদ্ৰ নয়। ব্ৰাহ্মণরা যে-কোনো একটা ফতোয়া দিয়ে দিলেই হলো! জমিদারির কাগজপত্রে তাঁর নামের শিলমোহরে লেখা থাকে, ‘কালীপদ অভিলাষী শ্ৰীমতী রাসমণি দাসী’। পণ্ডিতেরা তাঁকে মায়ের পদ বন্দনা করতে দেবে না। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির বিগ্রহহীন শূন্য পড়ে থাকবে? ব্রাহ্মণরা অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করলে পাপের ভয়ে কেউ তো সে মন্দিরে যাবে না। একটু পরে রানী চোখের জল মুছে বললেন, ‘তা বলে তো ভেঙে পড়লে চলবে না, মথুর। হেরে যেতে আমি শিখিনি। কলকাতার পণ্ডিতরা বলেচে বলে সেটাই তো শেষ কতা নয়। তুমি লোক পাঠাও, কাশীতে, মারহাট্টাদের দেশে, দক্ষিণ ভারতে। সেখানেও বড় বড় পণ্ডিত থাকে, তেনাদের মত আনাও।’ কিন্তু দূর দূর দেশ থেকেও নৈরাশ্যজনক সংবাদ আসতে লাগলো। শূদ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার ভারতের ব্ৰাহ্মণ সমাজ মেনে নেবে না কিছুতেই। কলকাতার পণ্ডিতরা প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করলো। তাঁরা প্রচার করলো, রাসমণি দাসীর এই স্পর্ধা কিছুতেই সহ্য করা হবে না। এই ঘোর অনাচার মেনে নিলে হিন্দু সমাজে প্রবল বিকার দেখা দেবে। টাকা দিয়ে আর সব কেনা যায়, ধর্ম কেনা যায় না। রাসমণি দাসী আবার সেখানে অন্নভোগ দিতে চায়! শূদ্রের অন্ন দেওয়া হবে দেবতাকে! এর মধ্যেই কি কলির পাঁচ পা বেরুলো!
ধর্মপ্ৰাণা রানী রাসমণি ইংরেজের বিরুদ্ধে কূট কৌশলে লড়েছেন, কিন্তু ব্ৰাহ্মণ তাঁর চোখে দেবতুল্য, সেই ব্ৰাহ্মণের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন কী ভাবে! তাঁর মন ভেঙে গেল। তিনি ভূমিশয্যায় শুয়ে অনবরত রোদন করেন আর মাঝে মাঝে কাতর ভাবে বলে ওঠেন, ‘মা, মা, আমি শূদ্র বংশে জন্মে কী অপরাধ করেছি মা, যে তোমার সেবা করতে পারবো না? তুমি কি শূদ্রেরও মা নাও?’ রানীর এক এক সময় মনে পড়ে যায় নবদ্বীপের কথা। কয়েক বছর আগে তিনি নবদ্বীপে গিয়েছিলেন তীর্থ দর্শনে। চন্দ্রগ্রহণের রাতে নবদ্বীপের গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন। ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের তিনি রক্তবর্ণ পট্টবস্ত্র ও রৌপ্যমুদ্রা দান করেছেন। বিশিষ্ট সব শিরোমণি, তর্কসিদ্ধান্ত, ন্যায়রত্ন ও বিদ্যারত্নদের নিমন্ত্রণ করে তাঁদের প্রত্যেককে দিয়েছেন পঞ্চাশটি করে টাকা ও লাল রঙের বনাত। পণ্ডিতরা দু হাত তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন। সেই কথা মনে পড়ায় রানী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ব্ৰাহ্মণরা তাঁর দান গ্ৰহণ করতে পারেন, সেজন্য খুশী হয়ে আশীর্বাদ করতে পারেন, অথচ তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই ব্ৰাহ্মণদের আপত্তি! এ কেমন কথা? এ যে স্বার্থপর, লোভীদের মতন মনোবৃত্তি! পর মুহূর্তেই রানী আবার তিরস্কার করেন নিজেকে। না, ব্ৰাহ্মণদের সম্পর্কে এমন চিন্তা করাও যে পাপ! রানীর মুশকিল এই যে, তিনি ব্ৰাহ্মণদের শত্ৰু বলে মনে করতে পারছেন না। নইলে তো লাঠি কিংবা বুদ্ধির জোরেই তিনি কলকাতার ব্ৰাহ্মণ সমাজকে শায়েস্তা করতে পারতেন। টাকা দিয়ে কিছু ব্ৰাহ্মণকে কিনেও ফেলা যায়। কিন্তু পণ্ডিতসমাজ পুরো ব্যাপারটিকেই অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করলে জনসাধারণ তাঁর দিকে আসবে না। তাঁর চাই শাস্ত্রের সমর্থন। ব্ৰাহ্মণ ছাড়া পূজা হয় না। দেবেন্দ্র ঠাকুরের দল পূজা আচ্চা তুলে দিয়ে বেদ পাঠ করাচ্ছে। সে সবের বিরুদ্ধেই তো রানী রাসমণি পূজার মহিমা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। অথচ ব্ৰাহ্মণরাই তাঁকে প্রতিহত করছেন! মথুর মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দিতে আসেন, কিন্তু রানী কিছুতেই প্ৰবোধ মানেন না। তিনি কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। মা কালী নিজে এসে তাঁকে অন্নভোগ দিতে বলেছিলেন, আদেশ দিয়েছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্রনারায়ণের সেবা করতে, তা আর ইহজীবনে সম্পন্ন হবে না! একদিন মথুর হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘মা, মা, একটি সুসংবাদ আছে! এবার বুঝি একটা উপায় হয়েচে।’ রানী বিশেষ গরজ করলেন না, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘কী বলো?’ মথুর বললেন, ‘মা, আপনি উঠে বসুন। অনেক কথা আচে।’ রাসমণি উঠে মথুরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ঠাণ্ডাভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী উপায় হয়েচে, আগে শুনি!’ মথুর বললেন, ‘এক চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত জানালেন যে, আপনি যদি মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি কোনো ব্ৰাহ্মণকে আগে দান করেন। আর সেই ব্ৰাহ্মণ যদি মন্দিরে বিগ্ৰহ প্ৰতিষ্ঠা করে অন্নভোগের ব্যবস্থা করেন, তা হলে আর শাস্ত্রের কোনো বাধা থাকে না।’ রাসমণি বললেন, ‘এ আর এমন কি কথা। আমার গুরুদেবের নামে ঐ সব সম্পত্তি ব্ৰহ্মোত্তর করে দেবো, আমি হব তাঁর কর্মচারী। আমি তো নাম চাই না, মায়ের সেবার অধিকার পেলেই হল।’ মথুর বললেন, ‘বেশ, এই তো উত্তম বন্দোবস্ত।’ রানী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই পণ্ডিতের বিধান সবাই মানবে? ইনি কে? কোথায় থাকেন?’ মথুরবাবু বললেন, ‘কেন মানবে না? ইনিও যে-সে পণ্ডিত নন। আমি নিজে এই মাত্র তেনার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসচি। তিনি আমায় শাস্ত্রের বচন উদ্ধার করে শোনালেন।’ রাসমণি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘পণ্ডিতটি কে?’ মথুর বললেন, ‘পণ্ডিতের নাম রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। হুগলীর কামারপুকুরে বাড়ি। কলকাতায় এসে ঝামাপুকুরে টোল খুলেছেন। তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সতেরো বছর বয়সী এক ভাই, তাঁর নাম গদাধর। ছেলেটি বেশ ভালো গান গায়।’
রানী রাসমণির জেদ শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয়েছিল। এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহা সমারোহে। সমারোহ মানে কী, তেমনটি আর কেউ কখনো দেখেনি। বাংলায় তখন ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদার তো কম ছিলনা, কিন্তু আর কেউ এত বৃহৎ দেবালয়ের প্রতিষ্ঠাও করেননি, এ রকম বিপুল উৎসবের আয়োজনও কেউ করতে পারেননি শুধু অর্থ থাকলেই হয় না, সেই অর্থব্যয় করার মতন অন্তঃকরণও থাকা দরকার।
সেই সময়ে, যখন হিন্দুধর্ম নানাদিক থেকে বহু রকম আক্রমণে পর্যুদস্ত। অনেক হিন্দু শাস্ত্র এবং সংস্কৃত গ্ৰন্থ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায়, ইংরেজ পণ্ডিতগণই তা উদ্ধার করেন। আবার এক শ্রেণীর ইংরেজ সেই সব শাস্ত্র ঘেঁটেই প্রমাণ করতে চান যে, হিন্দু ধর্মের মধ্যে কত রকম বর্বর প্রথা ও বিশ্বাস রয়েছে। খৃষ্টান মিশনারিরা হিন্দু ধর্মের অকাট্য সব দোষ তুলে ধরেছেন ভারতবাসীর সামনে এবং সেই সুবাদে তাঁদের আকৃষ্ট করছেন খৃষ্টধর্ম গ্ৰহণ করতে। অন্যদিকে ব্ৰাহ্মরাও হিন্দু ধর্মের নানান ত্রুটির কথা প্রচার করছেন, দেব-দেবীরা তাঁদের চক্ষে পুতুল মাত্র, এবং এই পুতুল পূজা তাঁদের কাছে দু-চক্ষের বিষ। শুধু কি তাই, সম্প্রতি তাঁরা এমনও ঘোষণা করেছেন যে, বেদ অপৌরুষেয় নয় এবং বেদ বাক্য মাত্রই অভ্রান্ত নয়। হিন্দু ধর্মের পরম পবিত্র গ্রন্থের প্রতি এই আঘাত হেনে ব্ৰাহ্মরা আরও দূরে সরে গেলেন। শিক্ষিত ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার এবং অনৈতিক প্রথাগুলি সম্পর্কে ঘৃণা বোধ করেন। এই কি সেই মহান ধর্ম যা স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার বিধান দেয়। এই ধর্মে পুরুষের বহুবিবাহ প্রশস্ত। কিন্তু নারী যদি ছ-সাত বছরেও বিধবা হয়, তাহলেও তাঁকে সারা জীবন বঞ্চিত, অসহ দিনাতিপাত করতে হবে। এই সেই ধর্ম যেখানে একজন মানুষ বিদ্যায় বুদ্ধিতে অন্যের চেয়ে উচ্চ হলেও শুধু সে জন্ম কারণে শূদ্র বলেই ব্ৰাহ্মণ ইত্যাদি জাতির সঙ্গে একাসনে বসতে পারবে না! এই সেই ধর্ম, যে ধর্মের মানুষ মুসলমান চাষীর শ্রমে ফলানো ধান অম্লান বদনে আহার করবে, কিন্তু মুসলমানের হাতে ছোঁয়া জল পান করবে না। অনেক মুক্তমনা হিন্দু, যাঁদের মনের মধ্যে ধর্মের জন্য আকুতি আছে, কিন্তু বিজাতীয় খৃষ্ট ধর্মও গ্রহণ করতে চান না, ব্ৰাহ্মদের সম্পর্কেও পুরোপুরি আস্থা নেই, তাঁরাও নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন এই ধর্মের নানা দোষের কারণে। এই রকম সময়ই কালীপদ অভিলাষী রাসমণি দাসী পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মেই নতুন প্ৰাণ সঞ্চারের জন্য দক্ষিণেশ্বরে শুরু করলেন এই মহাযজ্ঞ।
জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথিযোগে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনটি শুভযোগ, সেইদিন হল প্রতিষ্ঠা-উৎসব। বরাহনগর থেকে নাটমন্দির পর্যন্ত পথের দু-পাশে টাঙানো হলো ঝাড়ি লণ্ঠন। মধ্যে মধ্যে এক একটি বাঁধা মঞ্চে বাজনাদাররা বাজনা বাজাচ্ছে। সামনের তোরণটি যেন আকাশচুম্বী এবং বহু বৰ্ণ সব কুসুমে সজ্জিত। শুধু নিমন্ত্রিতের সংখ্যাই প্ৰায় এক লক্ষ, এছাড়া অনাহুত, রবাহুত যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। রানী রাসমণির নির্দেশ যে কেউই অভুক্ত অবস্থায় কিংবা দান না নিয়ে ফিরে যাবে না। বারাণসী, পুরী, পুণা, মাদ্রাজ থেকেও তিনি বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতদের আনিয়েছেন; নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, কোটালিপাড়ার কোনো ব্ৰাহ্মণই বাকি নেই। দেশের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সকলকে। গঙ্গার বুকে পিনিস, বজরা বোট, ভাউলিয়া প্রভৃতি জলযান গিসগিস করছে, আবার রাজপথে গাড়িও অসংখ্য। মন্দির প্রাঙ্গণের এক পাশে অনেকগুলি হৃষ্টপুষ্ট গোরু বাঁধা, এক পাশে স্তৃপাকার পট্টবস্ত্র। এছাড়াও কয়েকটি পাহাড় সাজিয়েছেন, রৌপ্য মুদ্রার পাহাড়, সন্দেশের পাহাড়, পাকা কলার পাহাড়, অন্নের পাহাড়। কলকাতার বাজার তো বটেই, পানিহাটি, বৈদ্যবাটি, ত্ৰিবেণী ইত্যাদি সন্নিহিত সব এলাকার বাজার সাফ করে আনা হয়েছে সন্দেশ, সব মিলিয়ে পাঁচশত মণ। আর অন্নের পাহাড়টি তো অন্নমেরু পর্বত। রানী রাসমণি সম্মান অনুসারে ব্ৰাহ্মণদের গোধন, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং বস্ত্ৰ দান করবেন। এবং অন্ন ও মিষ্টদ্রব্য ইত্যাদি উৎসর্গ করবেন দেবতাকে।
উৎসবের কয়েকদিন আগে একটি বাধা দেখা দিয়েছিল। মাহিষ্য সম্প্রদায়কে গোঁড়া ব্ৰাহ্মণের দল শূদ্র বলে মনে করে, সেই শূদ্র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরকে ব্ৰাহ্মণরা অশাস্ত্রীয় বলে ঘোষণা করেছিল। তারপর ঝামাপুকুর টোলের রামকুমার পণ্ডিতের বিধান মতন দেবালয়টি রানী রাসমণি তাঁর গুরুদেবের নামে আগে উৎসর্গ করায় সে সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ঐ মন্দিরের প্রতিদিনের পূজারী হবেন কে? কোনো শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতই শূদ্রের বেতনভুক পূজারী হতে সম্মত হলেন না, সামাজিক অপবাদের ভয়ে। শেষ পর্যন্ত রানী রাসমণির নির্দেশে তাঁর জামাতা মথুর ঐ রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করার জন্য। সব ব্ৰাহ্মণই পূজারী নয়। বঙ্গে ভট্টাচাৰ্যরাই বংশানুক্রমিক পূজারী। চট্টোপাধ্যায় বংশীয় রামকুমার রানীর প্রস্তাবে কিছু দ্বিধা করেছিলেন প্রথমে। জীবিকার জন্য তিনি কামারপুকুর থেকে এসে কলকাতার ঝামাপুকুরে টোল খুলেছিলেন। পিতৃবিয়োগের পর রামকুমারের ওপরেই সংসারের ভার বর্তেছে। অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি বেতনভুক পূজারী হবেন? এদিকে রানী রাসমণি মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পর্যন্ত ঘোষণা করে ফেলেছেন, পুরোহিতের অভাবে যে সব পণ্ড হয়ে যায়! রামকুমার শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। নিয়তি নির্বন্ধে রামকুমারই হলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনের হোতা। সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই গদাধর, তাঁর বয়েস তখন ঊনিশ। গদাধর বড় লাজুক প্রকৃতির। গ্রাম থেকে এসে তখনও সে কলকাতার লোকজনদের সঙ্গে ঠিক মতন মিশতে পারে না।
রানী রাসমণি, তাঁর মুখখানি ভক্তি ও তৃপ্তির ভাবে বিভোর। অন্যদিকে বসে আছে যুবক গদাধর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে সে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পাশ ছাড়েনি একবারও। তাঁর দুই চোখ বিস্ময়াবিষ্ট, এত মানুষ, এত দ্রব্য, আর নবরত্নের মন্দিরটি যেন একটি পর্বত। গদাধরের এক ভাগিনেয় হৃদয়ও এসেছে সঙ্গে। সে বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও গদাধরের চেয়ে অনেক চটপটে, সে ঘোরাঘুরি করছে চতুর্দিকে।
রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে দেশের নাম করা ব্যক্তিরা প্ৰায় সবাই এসেছিলেন। সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতরা প্রায় সকলেই উপস্থিত, তাঁরা রানী রাসমণির অর্থ বস্ত্ৰ দান গ্ৰহণ করেছিলেন, শুধু অনুপস্থিত ছিলেন তাঁদের অধ্যক্ষ – পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কারণ তিনি ঘোর নাস্তিক। ঈশ্বরচন্দ্ৰকে বোধ হয় অনেকে সেকালে ব্ৰাহ্মণ বলেই মনে করতেন না। তিনি নাকি সন্ধ্যা-আহ্নিক করতেন না, কোনো ঠাকুর-দেবতার পূজা করতেও কেউ কখনো দেখেনি তাঁকে। এ কী ধরনের ব্ৰাহ্মণ? তা ছাড়া তিনি তখন বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মহা ব্যস্ত ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও আসেননি। ব্ৰাহ্মরা সদলবলে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। ইয়ংবেঙ্গলের দলও যে আসবে না, তা যেন জানাই ছিল সকলের, তবুও তাঁদের দু-একজন এসেছিলেন। সন্ধ্যা হতে না হতেই জ্বলে উঠেছিল রোশনাই। উৎসব অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিল। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে রানী রাসমণির দাক্ষিণ্য, মহানুভবতা এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাকে ধন্য ধন্য করা হয়েছিল দেশীয় সংবাদপত্রগুলিতে। শুধু ব্ৰাহ্মরা নীরব ছিলেন। পৌত্তলিকতা নিয়ে নতুন ভাবে এই আড়ম্বর তাঁরা সুনজরে দেখেননি।
(তথ্যসূত্র:
১- সেই সময় (অখণ্ড) (পটভুমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত), আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
২- রাণী রাসমণি ও তাঁর জীবনদর্শন, অমলেন্দু কুমার দাশ, অনুপম প্রকাশনী (২০১৩)।
৩- রাণি রাসমণি দেবী, গৌরী মিত্র, গ্রন্থতীর্থ (২০১০)।
৪- রানি রাসমণি, মালা দত্ত রায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৮)।
৫- আমি তোমাদেরই রাসমণি, শ্যামলী ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী (২০০৯)।
৬- রানি রাসমণি ও আলোকধাত্রী কাদম্বিনী, ডাঃ জগন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, জগতময় পাবলিকেশন্স (২০১৫)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত