১৯৮৯ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর। মধ্য কলকাতার এক নার্সিং হোম। ‘‘সনৎ, সনৎ কোথায়? … খামগুলো ঠিকমতো পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে তো?’’ মধ্য কলকাতার নার্সিংহোমে শুয়ে শেষ বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা আগে বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সনৎ ছিলেন তাঁর ড্রাইভার কাম সেক্রেটারি। শেষ দিকে তাঁর প্রায় সব কিছু দেখতেন সনৎই। হেমন্তর তখন ক্ষীণ গলা। ক্লান্ত স্বর। তিনি নিশ্চিত জানতেন, তাঁর হাতে আর সময় বেশি নেই। তবু তার মধ্যেই খোঁজ নিয়েছিলেন, প্রতি মাসের পয়লা তারিখে খামে করে আঠেরো-উনিশজনকে যে অর্থসাহায্য তিনি পাঠাতেন, তার কী হল? জীবনের চল্লিশ বছর ধরে এটাই তো নিয়ম ছিল তাঁর। শেষ সময়েও তার যেন অন্যথা না হয় সেটাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।
এর আরও অনেক আগের কথা। ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলে পয়লা বৈশাখে মন্টু বসুর সেই বিখ্যাত জলসা হত তখন। প্রতি বার যে অনুষ্ঠানে হেমন্তকে সবার শেষে মঞ্চে উঠে পনেরো-ষোলোটা গান গাইতেই হত। সে বার বাড়ি বয়ে এসে অন্যতম উদ্যোক্তা অজয় বিশ্বাস অগ্রিম টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। হেমন্ত টাকাটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। অজয় বিশ্বাস চলে যাওয়ার কিছু বাদেই হেমন্তের কাছে এসেছিলেন এক মহিলা। তিনি ছিলেন এক বিখ্যাত শিল্পীর স্ত্রী। তাঁর স্বামী তখন প্রয়াত। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর প্রায় পথে বসার জোগাড় হয়েছিল, তাঁকে কিছু সাহায্য না করলেই নয়। কালক্ষেপ না করে ড্রয়ারে রাখা টাকার বান্ডিলটা বের করে মহিলার হাতে তুলে দিয়েছিলেন হেমন্ত। শুধু অর্থের ব্যাপারে নয়, জাগতিক অনেক কিছুতেই হেমন্ত ছিলেন গড়পরতা মানুষের অনেকটাই ঊর্ধ্বে।
রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির মনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন সুচিত্রা মিত্র। সেই সুচিত্রা মিত্র নিজের একমাত্র ছেলে কুনাল সঙ্গীত শিল্পী হতে চাইলে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা দেবব্রত বিশ্বাসের মতো শিল্পী হতে পারবে মনে করলে চেষ্টা করে দেখ, নইলে পড়ালেখায় মন দাও।’’ এই বক্তব্যটা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কতটা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন সুচিত্রা মিত্র। অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই কী অদ্ভুতভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি রেকর্ড বেরনোর পর। যার এক পিঠে ছিল ‘যখন ভাঙল মিলনমেলা’, আর অন্য পিঠে ছিল ‘আমার এ পথ’। ট্রেনার ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত-বিশেষজ্ঞ অনাদি দস্তিদার। প্রথম গানটিতে সঞ্চারীতে এসে তিনি গেয়েছিলেন, ‘ভেবেছিলেম ভুলব না আর আমার চোখের জল’। তিনি গানটি গেয়েছিলেন ‘গীতমালিকা’ দেখে। সেখানে কথায়, স্বরলিপি-তে অমনই লেখা ছিল। অথচ শেষে শুদ্ধিপত্রে লেখা ছিল, ‘ভুলব না’ নয়, হবে ‘ঝরবে না’। কেউই সেটা খেয়াল করেননি। সে ভাবেই রেকর্ড বেরিয়ে গিয়েছিল। ব্যস, পুরো দায় তখন যেন একা হেমন্ত’র হয়ে গিয়েছিল! অজস্র বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছিল আজীবন মিতভাষী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। রবীন্দ্রনাথের গানে এমন বিভ্রাট তাঁকে যে কতটা বিপন্ন করে তুলেছিল, যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁরা প্রত্যেকে জানতেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, সুচিত্রা মিত্রের মতন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী যে দুজনকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন – দেবব্রত বিশ্বাস ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – উভয়েই তাঁদের প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে সমালোচনার শরে বিদ্ধ হয়েছিলেন!
ওদিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেন ঠিক গান নয়, সাধনায় বসতেন। আর তাঁর সেই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মধ্যেও। ’৭০ এর দশকে রঞ্জি স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠানে মঞ্চে গাইতে উঠেছিলেন মহম্মদ রফি। দর্শক উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল। তাঁদের উল্লাস সাগরের ঢেউকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। তুমুল চিৎকারের মধ্যে মঞ্চ ছেড়েছিলেন রফি। এর পরেই উঠেছিলেন হেমন্ত। সকলে রুদ্ধশ্বাস হয়ে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা নিজেরাও ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না যে এমন উত্তাল জনতাকে কী করে বাগে আনবেন তিনি? হেমন্ত শান্তভাবে মঞ্চে উঠেছিলেন। হারমোনিয়াম ধরেছিলেন। তার পরেই অতি পরিচিত সেই জলদগম্ভীর স্বরে বেজে উঠেছিল – ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল …’। তখন কোথায় সেই আছড়ে ওঠা সাগর-ঢেউ! মুহূর্তে কোন এক জাদুমন্ত্রের মায়ায় নিশুতি রাতের নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে এসেছিল যেন …।
রবীন্দ্রগানকে যে কী ভাবে নিতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! তরুণ মজুমদারের ‘আলোর পিপাসা’ ছবির কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়। অনেক সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করতে হবে বলে, শাস্ত্রজ্ঞ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের এক ছাত্রীর কাছে তিনি উচ্চারণ শিখেছিলেন। নানা ভাষায় গান গেয়েছিলেন, প্রত্যেক বার এই একই ধরনের অধ্যবসায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য ছিল ‘চণ্ডালিকা’। চণ্ডালিকার সব চরিত্রের সব ক’টি গান তিনি অনায়াস দক্ষতায় গাইতেন। একবার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁর চিকিৎসার খরচ তুলতে কবির বন্ধুরা একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ‘চণ্ডালিকা’র গান গাওয়ার কথা সুচিত্রা মিত্র আর হেমন্ত’র। শেষ মুহূর্তে কোনও এক কারণে সুচিত্রা মিত্র আসতে পারেননি। উদ্যোক্তারা পড়েছিলেন মহা বিপাকে। হেমন্ত বলেছিলেন, ‘‘কোনও চিন্তা নেই। আমি গেয়ে দিচ্ছি।’’
’৭২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনিন্দিতা’ মুক্তি পেয়েছিল। ছবিতে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি ব্যবহার করেছিলেন হেমন্ত। এর আগে পঙ্কজ মল্লিক ‘মুক্তি’ ছবিতেও এই একই গান নিয়েছিলেন। কিন্তু হেমন্ত নিয়েছিলেন দুটো স্তবক বেশি। রেকর্ডের দু’পিঠ ধরে গানটি ছিল। আর দু’পিঠেই ছিল সুরকার হিসেবে পঙ্কজকুমার মল্লিকের নাম! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের খুব কাছের একজন তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন এই বিষয়ে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘অনিন্দিতা-র গান করার সময়ই মনে হয়েছিল, পঙ্কজদার সুরটা রাখব। তাই পরিবর্ধিত অংশটি নিয়ে ওঁকে শুনিয়ে সম্মতি চাইলাম। খুশি হয়েই অনুমোদন দিলেন। পুরো গানটারই সুরকার হিসেবে ওঁর নাম রাখলাম। তার দুটো কারণ। ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা। আর দুই, এতে ছবির অন্যতম সুরকার হিসেবে পঙ্কজদার কিছু অর্থপ্রাপ্তি হবে!’’ অথচ এরপরেও কিন্তু তাঁর সাথে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সম্পর্ক কেমন তা নিয়ে একটা বিতর্ক ছড়িয়েছিল! এর কারণ ছিল কলকাতা আকাশবাণীতে ১৯৭৬-এর ২৩শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়া। তার অনেক আগে আগে যদিও ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে বেশ কয়েকবার গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে গিয়েছিলেন বোম্বাই, রিহার্সাল করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। ‘বাণীকুমার’ বেঁকে বসেছিলেন, রিহার্সাল ছাড়া তিনি কাউকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দিতে রাজি ছিলেন না। যতই তারকা হোন, তবুও বাদ গিয়েছিলেন হেমন্ত। হেমন্ত গাইতেন ‘জাগো দুর্গা’। তাঁর জায়গায় সুযোগ পেয়েছিলেন ‘দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়’, আর সেই থেকেই অমর হয়ে আছেন দ্বিজেন। যখন দেবী ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছিল সে সময়ে দেশে জরুরী অবস্থা জারি হয়েছিল। যে বছর ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছিল, সেবছর তাতে অন্যান্য খ্যাতনামা শিল্পীদের সাথে গেয়েছিলেন হেমন্তও। পঙ্কজকুমার মল্লিকের জায়গায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজ করায় দু’জনের মধ্যে কি কোনও দ্বৈরথ সৃষ্টি হয়েছিল? পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র ‘শ্রী রাজীব গুপ্ত’ সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যম কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘পঙ্কজকুমার ও হেমন্ত, দু’জনেই খুব নম্রভাষী মানুষ ছিলেন। আমার দাদু অর্থাৎ পঙ্কজকুমার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সারাজীবনে কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছেন কিনা জানা নেই।’’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘অল ইন্ডিয়া রেডিওর পক্ষ থেকে জানানো উচিত ছিল। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে দাদুর দুটো অনুষ্ঠান হত। প্রথমটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর দ্বিতীয়টি ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বন্ধ করার পনেরো দিন আগে সঙ্গীতশিক্ষার আসর অনুষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সঙ্গীতশিক্ষার আসর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাদু একটা ধাক্কা পেয়েছিলেন। সে সময় উনি যে গানটি শেখাতে শুরু করেছিলেন, সেটাও ওঁকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি। তার পনেরো দিনের মধ্যেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঘটনাটা ঘটে। একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাদু জানতেন না, মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে অন্য একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে। অথচ সবার সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হত। পরপর দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দাদুর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু হেমন্তবাবুর সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সম্পর্ক এমন ছিল না যাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে। হেমন্তবাবু ওঁর সন্তানতুল্য ছিলেন। তাই দাদুর একটা ক্ষোভ থেকে থাকতে পারে, হেমন্তবাবু সব জেনেও ওঁকে কিছু জানাননি। কিন্তু ঝগড়া বা তর্কাতর্কি কিছুই হয়নি। হেমন্তবাবুও কখনওই দাদুর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। আসলে এই বিষয়টা এতটাই জটিল যে এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।’’
‘অনিন্দিতা’র ঘটনাটি যদি তাঁর উদারতার এক পরিচয় হয় তো, ‘বালিকাবধূ’-র ঘটনাটি কী গোত্রে ফেলা যাবে? ‘বালিকাবধূ’ ছিল তরুণ মজুমদারের ছবি। ’৬৭ সালে রিলিজ করেছিল। তার আগে আবহসঙ্গীত তৈরির সময় এক জায়গায় পরিচালক হেমন্তকে বলেছিলেন, ‘‘এইখানটা একটু অন্য রকম করলে ভাল হয়।’’ হেমন্ত বদলটা চাননি। কিন্তু পরিচালককে সম্মান দিতেই আবহের কিছু অংশে নির্দ্বিধায় পরিবর্তন এনেছিলেন। উল্লেখ্য, তখন কিন্তু বাংলা ছবিতে তাঁর কাজের বয়স কুড়ি বছর পেরিয়েছিল আর বম্বেতে পনেরো বছর। ‘ইন্দিরা’-তে প্রিমিয়ার শো হয়েছিল ‘বালিকা বধূ’-র। শো চলাকালীন ওই বিশেষ জায়গাটা পেরতেই তরুণ মজুমদারকে বাইরে ডেকে নিয়েছিলেন হেমন্ত। বলেছিলেন, ‘‘ভাগ্যিস, আপনার কথাটা মেনে নিয়েছিলাম, এখন বুঝতে পারছি, আপনি যেটা বলেছিলেন, সেটা একদম ঠিক।’’
কুণ্ঠাহীনভাবে নিজের দোষ কবুল করতে পারতেন হেমন্ত। তার জন্য বহু গুণী মানুষের সম্মান আদায় করে নিতেন। এমন একটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে সংগীতশিল্পী ‘মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের’ নাম। শিলিগুড়িতে একটি অনুষ্ঠান। অনেক গায়ক-গায়িকা গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান চলছিল। গ্রিনরুমে ছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হঠাৎই গোলমাল বেঁধে গিয়েছিল। কারণ, কয়েক জন শ্রোতা মানবেন্দ্রকে তাঁর জনপ্রিয় কিছু আধুনিক গান গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি কিছুতেই গাইতে রাজি হননি, শুধু নজরুলগীতি শোনাবেন বলে জেদ ধরেছিলেন। এ নিয়ে শুরু হয়েছিল তীব্র বাদানুবাদ। তার মধ্যেই কোনও এক উদ্যোক্তা মানবেন্দ্রকে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘আপনি পেশাদার শিল্পী। টাকা নিয়ে গাইতে এসেছেন যখন, শ্রোতাদের অনুরোধ আপনার রাখা উচিত।’’ তাতে মানবেন্দ্র আরও উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী, আমায় টাকা দেখাচ্ছেন! টাকা ফেরত নিন। আমি গাইব না।’’ অবস্থা ক্রমশঃ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মানবেন্দ্রকে ডেকে নিয়েছিলেন হেমন্ত। তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বোস, সব সময় আসর বুঝে গান গাইবি। নিজের জেদ ধরে থাকবি না। মনে রাখিস, শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়াটাই আমাদের কাজ। কয়েকটা নয় আধুনিক গেয়ে নজরুলগীতি গাইবি। এত রাগ করিস কেন?’’ মুহূর্তের মধ্যে দেখা গিয়েছিল, হেমন্ত’র পায়ে হাত ছুঁইয়ে মানবেন্দ্র বলছেন, ‘‘আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও অমন হবে না।’’ মানবেন্দ্র গান গেয়ে নেমে আসার পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা খুব তাড়াতাড়ি একটা রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করবেন। তাতে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইব। তুই নজরুলগীতি।’’ছ’সপ্তাহর মধ্যে পরের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। পনেরোটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে হেমন্ত নেমে যাওয়ার পর মঞ্চে উঠেছিলেন মানবেন্দ্র।
তাঁর অনুজ আরেক সঙ্গীত পরিচালক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে এক সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘হেমন্তদার কাছে ওঁর সুরে গান গাইবার অনুরোধ নিয়ে গেলে উনি বলতেন, গানটা কবে শেখাবে বলো।’’ তোলাবে নয়, শেখাবে। অনুজকেও এ ভাবে শিক্ষকের সম্মান দিতেন তিনি। সেই সম্মানটাই বোধহয় মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে এসেছিল তাঁর জীবনে। অনেকটা যেন সেই, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান।’ এক দিকে এই সম্মান-প্রদর্শন, অন্য দিকে ওই আকাশছোঁওয়া প্রতিভাধর হয়েও নতজানু থাকা, এই দুইয়ের আশ্চর্য সমাহার হেমন্ত’র দ্যুতি যেন আরওই বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক অতীতে গায়িকা ‘শ্রীমতী আরতি মুখোপাধ্যায়’ তাঁর ‘হেমন্তদা’-কে নিয়ে বলতে গিয়ে ‘মেহদি-প্রসঙ্গ’ ব্যক্ত করেছিলেন এক সংবাদমাধ্যমের কাছে। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণে তিনি বলছিলেন, ‘‘মধ্য কলকাতার এক নামী হোটেলে মেহদি হাসানকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সংবর্ধনার দিন মেহদি হাসানের সঙ্গে বসে আছি। হেমন্তদা হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত। হাসানসাহেব এক দৃষ্টিতে হেমন্তদাকে লক্ষ করছিলেন। এক সময় নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘ক্যায়া আওয়াজ পায়া হ্যায়! ইয়ে খুদা কি দেন্ হ্যায়।’ অনেক কষ্টে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি কোনও দিন কেউ হেমন্তদার আওয়াজ আর আপনার গায়কি নিয়ে জন্মায়?’ সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইন্শাল্লা! খুদা কি মর্জি। তব্ হী ইয়ে চমৎকার হো সকতে’ …।’’ অর্থাৎ, কেবল মাত্র খোদার ইচ্ছেতেই এমন জাদু ঘটা সম্ভব।
১৯৬২ সাল। তখনো ‘যাত্রিক’ নামেই ছবি করতেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। মনোজ বসুর ‘আঙটি চাটুজ্যের ভাই’ গল্প অবলম্বনে তিনি শুরু করতে চলেছিলেন ‘পলাতক’ ছবির কাজ। সেই কাহিনীর কেন্দ্রে ছিলেন এক ভবঘুরে গায়ক যাঁকে ঘর আটকাতে পারে না। প্রাণের টানে সে ঘুরে বেড়াত সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে। এই ছবিতেও সুর করার জন্য তিনি ডেকেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। গল্প শুনে হেমন্ত তাঁকে বলেছিলেন, “এ তো সবই লোকসঙ্গীত, আমি এ বিষয়ে একটু মাটো আছি।” তরুণবাবু নাছোড়বান্দা ছিলেন, তিনি হেমন্তকেই চেয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক রূপে। তখন হেমন্ত তাঁকে বলেছিলেন এক নতুন গীতিকারের কথা, যিনি তাঁর কাছে আসতেন গান লিখে নিয়ে। তাঁর লেখা গান খুব পছন্দের ছিল হেমন্তর। তরুণ মজুমদার আপত্তি করেননি, বরং তিনি খুশী হয়েছিলেন। আর গানে সুর করা শুরু হয়েছিল যখন, তখন ঘাড়ের ব্যথায় কাবু হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভর্তি হয়েছিলেন বম্বের নর্থকোট হসপিটালে। সেই অবস্থাতেই এক আজব কাণ্ড চলেছিল হাসপাতালে। গীতিকার তাঁর লিরিক লিখে লিখে পাতা দিতেন হেমন্তকে আর সুরকার ওই শোওয়া অবস্থায় একটু ভেবে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুর করে যেতেন কথায়!
সেই বছরেই (১৯৬২) প্রথম পুজোর গানেও মাতিয়ে দিয়েছিলেন সেই গীতিকার আর হেমন্তর জুটি। দুটি গান ছিল –
১) ‘তারপর? তার আর পর নেই …’
২) ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল …’
‘তারপর?’ – শব্দটির মহিলা কণ্ঠ ছিল ‘চাঁদ ওসমানি’র যিনি ছিলেন ঐ গীতিকারের স্ত্রী। তারপরেই শুরু হত হেমন্তর গলাতে –
‘‘… তার আর পর নেই নেই কোন ঠিকানা
যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না।। …’’
এখানেই প্রশ্ন। সুর কি সৃষ্টি করা যায়? না কি, সব সুর হয়েই আছে? শুধু খুঁজে নিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া! শিশু যেমন বিল্ডিং ব্লক্স খেলে! এ দিক থেকে দেখলে সুরসৃষ্টি ‘ইনভেনশন’ নয়, ‘ডিসকভারি’। নদী, ফুল, বিদ্রোহ, প্রার্থনা, প্রেম, যন্ত্রণা, শীৎকার, শেক্সপিয়র, রাত্রি, রবীন্দ্রনাথ – সব রয়েছে। সুর, স্বর, উপসুর, কম্পাঙ্ক – সবই। ‘পারমুটেশন-কম্বিনেশন’-এর রসায়ন জানা ইঞ্জিনিয়ার তা থেকেই ইতিহাস গড়েন! ধুতি-শার্ট তাই ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ। এবং তাঁর রসায়নাগারের ভিয়েনে উপচে পড়েছিল মেলডির রস। ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ শোনা শিশু বড় হয়ে ‘মেলডি’ শব্দটা শুনেছিল। কিন্তু প্রচলিত অর্থের সঙ্গে আভিধানিক ব্যাখ্যার মিল পায়নি। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ তাঁকে শুনিয়েছিল ‘চলো মন গঙ্গাযমুনাতীর’! বলেছিল ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’। কার দুর্গা, কোন পাহাড়ি, কোথাকার তিলক-কামোদ কিংবা কেদার – সে সব জানেন সঙ্গীতবেত্তারা! কিন্তু আভিধানিক আমগাছের খবর না রেখেও মেলডির আম খেতে অসুবিধা হয়নি। সে সুযোগ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটকেরা। এবং আজীবন ধুতি-শার্ট পরিহিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একবার বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক সি রামচন্দ্র এক বার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি তো গায়ক, সুরকার, প্রযোজক – তিন রকম ভূমিকাই পালন করেছেন। এর মধ্যে আপনার নিজের সবচেয়ে ভাল লাগে কোনটি?” হেমন্তর উত্তর ছিল, “অবশ্যই গায়ক।” অর্থাৎ সুরকার হিসেবে নিজের মূল্যায়নে খানিকটা উদাসীন ছিলেন তিনি নিজেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর-রচনা সম্পর্কে বাঁধা গতের কিছু কথা শুনতে আমরা অভ্যস্ত – খুব সহজ সরল সুর করতেন, বেশি খাটতে হত না, ইত্যাদি। একটু মনে করে দেখা যেতে পারে, কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের সুর তিনি করেছেন, কাকে দিয়ে কী গান গাইয়েছেন। ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর নিজের। ‘ফিল্মিস্তান’-এর সঙ্গে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী রাজি হয়েছিলেন শুধুমাত্র সুরকারের অনুরোধে। ছবিটির কথা হয়তো আজকের দর্শক ভুলেই গিয়েছেন, কিন্তু ‘বন্দে মাতরম্’-এর ওই ‘মার্চিং সুর’ আজও দেশাত্মবোধের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ‘হারানো সুর’-এ গীতা দত্তকে দিয়ে ‘তুমি যে আমার’ গানটি গাওয়ানোর জন্য বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। গানটি রেকর্ডিং হওয়ার পরও যখন পরিচালক আর নায়ক মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন, মনে হচ্ছে যেন বেশি ‘ফ্ল্যাট’ হয়ে গেল, সুরকার হেমন্ত কিন্তু বলেছিলেন, চিন্তা নেই, এ গান লাগবেই। ‘নাগিন’ ছবিতে হারমোনিয়াম আর ক্লাভিয়োলিন ব্যবহার করে সাপুড়ের বিনের আওয়াজ সারা ছবিতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ভারত মেতেছিল সেই সুরে। এর জন্যও পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে মতানৈক্য হয়েছিল তাঁর। বিনীত যুক্তিতে, অথচ গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের শেষ পর্যন্ত স্বমতে এনেছিলেন সুরকার। লতা মঙ্গেশকরকে বাংলা গানের জগতে নিয়ে আসার কৃতিত্ব তাঁরই। শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। পরে ‘প্রেম এক বারই এসেছিল নীরবে’ গানটি যখন লতাকে দিয়ে গাইয়েছিলেন, সকলের শুনে মনে হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রভাবেই গানটি এত শ্রুতিমধুর। অথচ এই গানেরই সুরে ‘আজ রোনা পড়া তো সমঝে’ গানটি যখন কিশোরকুমারকে দিয়ে তিনি গাইয়েছিলেন, তখন কিন্তু কারও মনে হয় নি তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুসারী গান শুনছেন। একই গান দু’জন বড় মাপের শিল্পীকে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গায়কিতে গাওয়ানো এবং দু’টি গানই সফল – এক জন সুরকারের পক্ষে এ কিন্তু কম সার্থকতার নিদর্শন নয়। ‘আনারকলি’ ছবিতে সি রামচন্দ্রের অসমাপ্ত কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, শুধুমাত্র পেশাদারি বন্ধুত্ব ও সৌজন্যের খাতিরে, অথচ সুরকার হিসেবে নিজে কৃতিত্ব দাবি করতে চাননি। সুরকার হিসেবে সমকালের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মনে প্রভূত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তপন সিংহ ‘ক্ষণিকের অতিথি’র সঙ্গীত পরিচালনায় ডেকে নিয়েছিলেন তাঁকে। ছবি দেখে হেমন্ত বলেছিলেন, “এ তো কাব্য। আবহে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতই ব্যবহার করব।” কিশোরকুমার ‘লুকোচুরি’ ছবির সুরারোপের দায়িত্ব নিজে না নিয়ে তুলে দিয়েছিলেন হেমন্তর হাতে। এই ছবিতে তাঁর নিজের সুরে গাওয়া ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে বিবিসি-র সমীক্ষায় পঞ্চাশ বছরের সেরা গানের তালিকায়। গুরু দত্ত ‘সাহিব বিবি আউর গোলাম’ ছবিতে সুরারোপের জন্য নির্ভর করেছিলেন তাঁরই উপর, বলেছিলেন, বাংলার সংস্কৃতি-আশ্রিত এই ক্লাসিকের আবহসঙ্গীতের উপর সুবিচার করার মতো আর কে আছে? তাঁর প্রযোজনায় ও সুরে সমৃদ্ধ ‘নীল আকাশের নীচে’ দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু বলে উঠেছিলেন, ‘‘You have done a great service to the nation’’; আবার বিদেশি পরিচালক কনরাড রুক্স-এর ছবি ‘সিদ্ধার্থ’-এ সঙ্গীত পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি গেয়ে উঠেছিলেন সেই ‘নীল আকাশের নীচে’র প্রাণমাতানো গান, ‘ও নদী রে’। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে তাঁকে স্পর্শ করে প্রবাসী ভারতীয়রা বলে উঠেছিলেন, “ইন্ডিয়াকে টাচ করছি।” আমাদের সুরের আকাশে শুকতারা হয়ে আজও জেগে আছেন তিনি।
হেমন্ত সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪২ সালে ‘অপরাধ’ ছবিতে ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে’ গানটি, সুপ্রভা সরকারের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। হেমন্ত প্লেব্যাক করেছিলেন ধ্রুব চক্রবর্তীর ঠোঁটে। আর সুপ্রভা দেবী প্লেব্যাক করেছিলেন মণিকা দেশাইয়ের ঠোঁটে। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাশ। ওই সময় তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু ছবিতে সহকারী সুরকার হিসেবে হেমন্ত কাজ করেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায় ১৯৪৩ সালে প্রণব দে সুরারোপিত ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি। ছবিতে গানটি রেডিয়োতে ভেসে আসছে, এমন দৃশ্যের মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়। ১৯৪৪ সালে গাওয়া ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ও ‘আমার আর হবে না দেরি’ গান দু’টি হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক রেকর্ডের রবীন্দ্রসঙ্গীত। খুবই জনপ্রিয় হয়। অনাদিকুমার ঘোষদস্তিদারের সঙ্গীত তত্ত্বাবধানে তিনি এই রেকর্ডটি করেছিলেন।
জানা যায়, কলকাতায় ফেরার ট্রেনের টিকিট কেটে চুপি চুপি মুম্বই থেকে পালিয়ে আসছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁকে প্রায় ধরেবেঁধে আটকেছিলেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। তিনি হেমন্তকে বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমাকে এখানে এনেছি। তুমি চলে গেলে, তুমি তো হারবে না, আমি হেরে যাব। একটা হিট ছবি দিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। আমি বাধা দেব না।’’ ‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিয়োর তখন সর্বেসর্বা ছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়। পরিচালক হেমেন গুপ্তকে দিয়ে ‘আনন্দমঠ’ ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে মুম্বইতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ফিল্মিস্তান-এর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক তখন অতি খারাপ বললেও কম বলা হয়। তবু তাঁকে দিয়ে ছবির জন্য ‘বন্দেমাতরম’ গাইয়ে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছিলেন হেমন্তকুমার। নিজে গেয়েছিলেন ‘জয় জগদীশ হরে’। গীতা দত্তের সঙ্গে ডুয়েট। গান তো জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু ছবি? সুপার ফ্লপ। তার পরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে আসতে চেয়েছিলেন কলকাতায়। ভিটি স্টেশন থেকে লুকিয়ে ফোন করে সে-খবর শশধর মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন হেমন্ত-পত্নী বেলা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আর ফেরা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! এর পরই যে ‘নাগিন’! যে ছবির গানের রেকর্ড কুড়ি বছর বাদে ভেঙেছিল ‘ববি’।
অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই কি’না এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরেছিলেন। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছিলেন, ‘‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান।’’ একবার ভেবে বসেছিলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তাঁর কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। যার একটি তো একেবারে ‘দেশ’ পত্রিকায় – ‘একটি দিন’। তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল ছিলেন। গায়ক-বন্ধুর ব্যাপারে স্কুলবেলার সহপাঠী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্ররা শুধু হাল ছাড়েনি। তাই রক্ষে। তাঁর প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাতে কারও কৌতূহল হয়, তিনি জানতে চান, ওটা কী! ধীরে ধীরে গান গাওয়া তখন অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়েছিল তাঁর। শচীনকর্তার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি কর্তার দু’কলি ভেসে আসে, অঞ্জলি পেতে নেবেন! রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেতেন কোনও বাড়িতে পঙ্কজ মল্লিকের গান বাজছে, স্তব্ধ হয়ে ভাবতেন, ‘‘আমারও গান কি কোনও দিন এমন ঘরে ঘরে বাজবে?’’ তখন যুবক হেমন্ত যদি জানতেন, ঘরে-ঘরে কেন, তাঁর শ্রোতার দলে এক দিন নাম লেখাবেন উস্তাদ আমির খান, মেহদি হাসান! দিল্লির এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে মুগ্ধ উস্তাদজি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার গান শুনছিলাম এতক্ষণ।’’ আর গজল-শাহেনশা মেহদি হাসান বলতেন, ‘‘দেখা হলে লতাজির কণ্ঠে একটা চুমু দিতে চাই।’’ আর পুরুষ-কণ্ঠ হলে? – ‘‘হেমন্তকুমারের। এই উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর হেমন্তকুমারের।’’
এই সবকিছুর বাইরেও ছিলেন একজন অন্য হেমন্ত। ধুতি-শার্ট পড়া একজন ‘ভালমানুষ’। তাঁর বাড়ির কাছে চায়ের দোকান চালানো সুকুমার ভুঁইয়াকে পড়াশোনা আর ফুটবল খেলার জন্য টাকা-পোশাক দিতেন যিনি। একবার তাঁর দেওয়া নতুন শার্ট বড় হয়েছিল বলে কী লজ্জা পেয়েছিলেন ধুতি-শার্ট পড়া সেই মানুষটি আর মাপসই নতুন জামা কিনে এনে দিয়েছিলেন তাঁর বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাতের চা-দোকানের তারাপদ দে’কে। সেই ধুতি-শার্ট পড়া ভালো মানুষকে আজীবন মনে রেখেছিলেন ইন্দ্রনাথ শীট’ও, যাঁর দোকানে চা খেতেন তিনি। এক কিংবদন্তী সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও ধুতি-শার্ট পড়া সেই ভালোমানুষটিকে আজও মনে রেখেছেন অজস্র মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষজন। তিনি হেমন্ত, চির হেমন্ত – তিনি ছিলেন, আছেন আর থাকবেন। আজও তিনি উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দধারা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন (২০১৩)।
২- বাংলা গানের গতিপথ, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ডি. এম. লাইব্রেরি (২০১৩)।
৩- বাংলা গানের ধারা: হাজার বছরের বাংলা গান, ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, প্যাপিরাস।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত