১৮৫৬ সালের কলকাতা। ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহের আবেদনের প্রতিবাদ করে রাজা রাধাকান্ত দেব সরকাব সমীপে পাঠিয়েছিলেন এক পাল্টা আবেদনপত্র। ঈশ্বরচন্দ্রের আবেদনে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও কম। আর বিধবা-বিবাহ আইনের প্রতিবাদ করে রাজা রাধাকান্ত দেবের আবেদনে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ছিল তেত্রিশ হাজার! শোভাবাজারের রাজা বাহাদুর নিজের বেতনভুক কৰ্মচারীদের গ্রাম-গ্রামান্তরে পাঠিয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এনেছিলেন। এর পরেই এই প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে বোম্বাই, পুণা, ত্রিপুরা, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আরও বহু স্বাক্ষরসম্বলিত আবেদনপত্র জমা পড়তে শুরু হয়েছিল। গণনা করে দেখা গিয়েছিল যে, বিধবা বিবাহের সমর্থকদের চেয়ে এই প্ৰস্তাবের প্রতিবাদকারীর সংখ্যা ছিল বহুগুণ বেশী। বিপক্ষীয়রা যে ঈশ্বরচন্দ্রের যুক্তি খণ্ডন করতে পেরেছিলেন তা নয়, তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল এই যে, বিধবা বিবাহ হবে কি হবে না, সেটা হিন্দুসমাজের ব্যাপার, এ ব্যাপারে বৈদেশিক রাজশক্তির হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই। রাজশক্তি অবশ্য এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকেনি। তিন তিনবার বিবেচনার পর হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ আইন পাশ হয়ে গিয়েছিল ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই। হিন্দু বিধবার বিবাহে কোনো আইনি নিষেধ থেকেই নি, উল্টে দ্বিতীয়বার বিবাহিত নারীর সন্তান তাঁর পিতার সম্পত্তির বৈধ অধিকারী হবে বলেও আইনে স্থির হয়ে গিয়েছিল। বিধবা বিবাহের পক্ষে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা কম হলেও ইংরেজ সরকার মনে করেছিলেন যে এই ধরনের সমাজ সংস্কারের কাজে শুধু সাহসী লোকেরাই এগিয়ে আসে এবং সব দেশেই তাঁদের সংখ্যা কম হয়।
আইনটি পাশ হবার পর কয়েকদিন খুব উল্লাসের মাতামাতি হয়েছিল বটে, কিন্তু অল্পকাল পরেই বোঝা গিয়েছিল, আদতে সেটা একটি পর্বতের মুষিক প্রসব! এরপরে শুরু হয়েছিল বিপক্ষীয়দের উল্লাসের পালা। অনেকেই ভেবেছিলেন যে, আইনটি পাশ হওয়া মাত্রই দেশে বিধবা বিবাহের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। অল্পবয়সী বিধবা বালিকার সংখ্যা ছিল অজস্ৰ, তাঁদের দুঃখে অনেকেই সংবাদপত্রে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। কিন্তু আইন পাশ হবার পর কয়েক মাসের মধ্যেও একজনও কেউ বিধবা বিবাহ করার জন্য এগিয়ে আসেননি।

কলকাতায়, জগমোহন সরকারের বৈঠকখানায় এই নিয়ে খুব আমোদ আহ্লাদ শুরু হয়েছিল। ভুটুর ভুটুর শব্দে আলবোলা টানতে টানতে পরিতৃপ্তভাবে তিনি তাঁর প্রধান মোসাহেবকে ফটিকচাঁদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী হে ফটিকচাঁদ, তোমাদের বিদ্যেসাগর কী কল্পে গো? এ যে শুদুমুদু মল খসিয়ে লোক হাসালে?’’ ফটিকচাঁদ বলেছিল, ‘‘আজ্ঞে হুজুর, কবি ধীরাজ কী গান বেঁধেচে, শুনবেন?’’ কত্তা বলেছিলেন, ‘‘কই শুনি শুনি, গাও তো!’’ ফটিকচাঁদ গান ধরেছিল –
‘‘বিদ্যেসাগরের বিদ্যে বোঝা গিয়েছে
পরাশরের ইয়ে মেরে দিয়েচে!’’
শুনে উপস্থিত পঞ্চজন বিরাট হাসির হুল্লোড় তুলেছিলেন! জগমোহন বলেছিলেন, ‘‘আরে ছ্যা ছ্যা ছা। বিদ্যেসাগরের সাগরেদরা এত করে তোল্লা দিয়ে, শেষমেষ সব ন্যাজ তুলে পালালো! কেউ একটা বিধবা বে করলে তবু আমরা খানিকটা তামাশা দেকতুম!’’ আর একজন মোসাহেব তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘হুজুর, সেই যে কতায় আচে না, বড় বড় বানরের বড় পেট, লঙ্কায় যাইতে করে মাথা হেঁট, এ হলো গে সেই ব্যাপার!’’ কত্তা বলেছিলেন, ‘‘তা বিদ্যেসাগর নিজেই একখানা বিধবাকে বে করে তো দেকাতে পারে সব্বাইকে!’’ মোসাহেব উত্তর দিয়েছিল, ‘‘তিনি তো বুদ্ধি করে আগেভাগেই নিজের বেটি সেরে রেকেচেন। ওঁর সাগরেদরাও সবাই নিজেরা ঠিকঠাক জাত-কুল মিলিয়ে বিবাহ-টিবাহ সেরে এখুন বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে! বুইলেন না, নিজের বেলা আটি শাটি, পরের বেলা দাঁত কপাটি!’’ জগমোহন বলেছিলেন, ‘‘তা থাকলেই বা বিদ্যেসাগরের আগে একটি বিয়ে। আর একটিতে দোষ কী? বেধবা মানেই তো দু নম্বুরী! সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মেয়েছেলে যাকে বলে!’’ মোসাহেবী সভায় হাসির রোল উঠেছিল। এক মোসাহেব বলেছিলেন, ‘‘হে-হো-হো-হে! এ কতটি বড় ভালো বলেচেন, হুজুর! সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মেয়েছেলে! দোকানে গিয়ে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড জিনিস কেনার মত লোকে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড বিয়ে করবে!’’ কত্তা প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘ভাড়া করা মাগা আর রাকতে হবে না। কারুকে। সরকার অতি উত্তম ব্যবস্থা করেচেন। বাড়িতে যাঁর যাঁর বউ রইলো, আর বাইরে বেধবা রাঁড়ের সঙ্গে একটু ফুসমস্তর পড়ে নিলেই সস্তায় কেল্লা ফতে! নেড়ানেড়িদের কণ্ঠী বদলের মতন!’’ এমন সময়ে এক মোসাহেব আসরে ঢুকতে ঢুকতে জগমোহন সরকারকে বলেছিলেন, ‘‘হুজুর, আর এক কেচ্ছ শুনেচেন? বিদ্যেসাগরের এক চ্যালা কী কাণ্ড করেচে!’’ জগমোহন উৎসাহী কণ্ঠে শুধিয়েছিলেন, ‘‘কী, কী, শুনি?’’ মোসাহেব জানিয়েছিল, ‘‘সে বেটার নাম শ্ৰীশচন্দ্র। এখন সকলে বলচে ছিছিচন্দ্ৰ!’’ অর্ধেক উত্তরে কিছু বুঝতে না পেরে ভারী বিরক্ত হয়ে কত্তা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আরে বাপু, সবটা খুলে বলো না! কে শ্ৰীশচন্দ্ৰ!’’ মোসাহেব জানিয়েছিলেন, ‘‘সে যে-সে লোক নয় কো! শ্ৰীশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, মুর্শিদাবাদের জজকোর্টের পণ্ডিত! মুকে তাঁর কত বারফট্টাই! আইন পাশ হবার আগে থেকেই সে চিগারেচে, বিধবা বে কবে, বিধবা বে কর্বো! য্যানো বেটা এক মস্ত বড় রিফর্মার!’’ কত্তা শুধিয়েছিলেন, ‘‘তাঁরও আগে একটা ঠিকঠাক বউ রয়েচে বুঝি?’’ মোসাহেব জানিয়েছিল, ‘‘তা জানি না, শুনিচি তো ব্যাচিলার! কেমনধারা ব্যাচিলার তা মা ভগাই জানেন!’’ কত্তা আবার শুধিয়েছিলেন, ‘‘এখুন। সেও পিচিয়ে গ্যাচে, এই তো? এতে আর কেচ্ছ কী আচে?’’ মোসাহেব তাঁকে জানিয়েছিল, ‘‘আরও আচে, হুজুর! শুদু বে কর্বো বলে চ্যাঁচায়নি। আগে থেকেই সে শান্তিপুর থেকে এক বেধবা মাগীকে ভাগিয়ে এনেচে!’’ উত্তর শুনে বিস্মিত হয়ে জগমোহন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আঁ? ভাগিয়ে এনেচে? ভদ্দরলোকের বাড়ির মেয়ে? কোতায় এনেচে?’’ মোসাহেব তাঁকে জানিয়েছিল, ‘‘এই কালকেতাতেই কোতাও রেকেচে, কিন্তু ঠিক কোন জায়গাতে রেকেচে, তা জানি না।’’ উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে জগমোহন সরকার বলেছিলেন, ‘‘আ মোলো যা! তোদের নিয়ে আর পারি। নে! তোদের এত খাওয়াই দাওয়াই, ফুর্তির খর্চা দি, আর তোরা একটু ভালো করে খপরও আনতে পারিসনি! লোক লোগা, লোক লাগা, ভালো করে খপর নে, সে মাগী কোতায় আচে! খোলাখুলি রাঢ় রাকবার মুরোদ নেই, বে করার নাম করে ভদ্রবংশের বাড়ি থেকে মেয়ে ভাগিয়ে আনা! সমাজ কি একেবারে রসাতলে গেল? আমরা বেঁচে নেই! এর একটা বিহিত কর্তেই হবে। বিদ্যেসাগর সব বাড়ি থেকে কচি কচি বেধবাদের টেনে রাস্তায় বার করে বাজারের মাগী করচে! মামলা দায়ের করবো। মেয়েটা কোতায় আচে খুঁজে বার কর আগে। আর সেই শ্ৰীশচন্দ্ৰ কোতায় গেল?’’ মোসাহেব বলেছিল, ‘‘সেই ছিছিচন্দ্ৰ এখন কোতায় ঘাপটি মেরে লুকিয়েচে। কেউ তাঁর পাত্তাই পাচে না!’’ জগমোহন উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘তাঁকেও খুঁজে বার কর। জেলের ঘানি ঘোরাবো তো বেটাকে দিয়ে! ভদ্রপরিবারের মেয়েদের নিয়ে এই কাণ্ড!’’ তারপরে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জগমোহন সরকার বলেছিলেন, ‘‘কালই আমি এ বৃত্তান্ত রাজা রাধাকান্ত দেবের কানে তুলবো, এর একটা বিহিত করতেই হবে। মামলায় ফাঁসাবো। ওদের সক্কলকে!’’
এই সময় ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর রোগে পড়েছিলেন। মানুষের কর্মক্ষমতার একটা সীমা আছে। একদিকে তিনি বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, অন্যদিকে রাত্রি জেগে রাশি রাশি শাস্ত্রগ্রন্থ মন্থন করে সমাজ সংস্কারের পক্ষে যুক্তর তীক্ষ্ম শর প্রস্তুত করছিলেন। বিধবা বিবাহের সমর্থন আদায়ের জন্য ঘুরছিলেন লোকের বাড়ি। তিনি পাঁচশত টাকা বেতন পেতেন, পাঠ্যপুস্তক রচনা করে তার থেকেও যথেষ্ট উপার্জন করতেন, তাঁকে একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য করা হত। কিন্তু নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করেছিলেন অকাতরে। এত ঘোরাঘুরির সময় সব জায়গায় পাল্কি ভাড়া করারও সামর্থ্য তাঁর থাকত না, পা দুখানিই ছিল তাঁর সম্বল। হাঁটতে তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। কিন্তু এরপরে তিনি আর পারেননি। অসুখের কারণ ছিল তাঁর শরীর নয়, মন। দীর্ঘদিন পরে সেই অনমনীয় গোঁয়ার পুরুষটিও ভেঙে পড়েছিলেন। বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার সময়ে শান্তিপুরের তাঁতীরা শাড়ির পাড়ে তাঁর প্রশস্তিতে একটা গান ছেপেছিল –
‘‘সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।’’
সেই গান-ছাপা শাড়ি সেই সময় লোকে কিনেছিল বেশী দাম দিয়ে। খোল কর্তাল বাজিয়ে অনেকে তাঁর বাড়ি বয়ে এসে তাঁকে সেই গান শুনিয়ে গিয়েছিল। তারপরে আবার একটা প্যারডি হয়েছিল সেই গানের।
তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে বিদ্যাসাগর তখন রোগশয্যায় শায়িত। তাঁর শয্যাজ্বলুনি হয়েছিল, ছটফট করছিলেন সারা পালঙ্ক জুড়ে, কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলেন না। শত দুঃখে কষ্টেও যে মানুষ কখনো টু শব্দটি করেননি, তখন তাঁর বুকের একেবারে ভেতর থেকে একটা মোচড়ানো কাতর আওয়াজ ভেসে আসছিল! রাজকৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে নীরব হয়ে বসে থাকতেন তাঁর শিয়রের কাছে। ডাক্তার বৈদ্য দেখানো হয়েছিল, কিন্তু সব ওষুধই ব্যৰ্থ হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের এই অবস্থায় একদিন বাইরে থেকে একটা গানের আওয়াজ আসছিল, রাজকৃষ্ণ সচকিত হয়ে জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘থাক, থাক, বন্ধ করো না! ওরা গাইছে গাক। ওদের মনোবাসনাই পূর্ণ হবে!’’ বাইরে তখন একদল ইয়ার গোছের লোক নেচেকুঁদে গাইছিল সেই প্যারডি গান –
‘‘শুয়ে থাক বিদ্যেসাগর চিররোগী হয়ে!
শুয়ে থাক বিদ্যেসাগর চিররোগী হয়ে!’’
ঈশ্বরচন্দ্ৰ সেই গান শুনতে শুনতে বলেছিলেন, ‘‘ওরে আমি চিররোগী হয়ে শুয়ে থাকতে চাই না। এখন মরলেই আমার জ্বালা জুড়োয়। আমি শীঘ্র শীঘ্ৰ মরে ওদের খুশী করবো!’’ গান শুনে স্তম্ভিত রাজকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে নিজে সেটা চেপে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র সবচেয়ে বেশী আঘাত পেয়েছিলেন শ্ৰীশচন্দ্ৰ ন্যায়রত্নের ব্যবহারে। তিনি তাঁকে একজন তেজী আদর্শবাদী যুবক হিসেবে জানতেন। মুর্শিদাবাদে জজ কোর্টে তাঁর চাকরি পাওয়ার ব্যাপারেও ঈশ্বরচন্দ্ৰ সুপারিশ করেছিলেন। সেই লোক এমন ব্যবহার করবেন সেটা তিনি কোনদিন ভাবতে পারেননি। ইয়ং বেঙ্গল দল ঈশ্বরচন্দ্ৰকে বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁরা সব সময় ঈশ্বরচন্দ্রের পাশে থাকবেন। রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ, কিশোরীচাঁদ বলেছিলেন, আইন পাশ হলেই তাঁরা দেশ জুড়ে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। দেশ জুড়ে দূরে থাক, বাংলাতেও একটি বিবাহও হয়নি। ইয়ং বেঙ্গলের দলই বলেছিল, প্ৰথম বিবাহ করবে শ্ৰীশচন্দ্ৰ। নিজেই শান্তিপুরের একটি মেয়েকে পছন্দও করেরেখেছিল শ্ৰীশচন্দ্র। মেয়েটির নাম ছিল কালীমতী, বয়েস এগারো বৎসর। মেয়েটির বাড়ির কেউই বিধবা বিবাহে সম্মত ছিলেন না, তবু ইয়ং বেঙ্গলের দল বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোনোক্রমে কন্যার মাতা লক্ষ্মীমণি দেবীকে রাজি করিয়েছিলেন। মাতা সমেত কন্যাকে নিয়েও আসা হয়েছিল কলকাতায়। বিবাহের তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এই সময় বেঁকে বসেছিলেন শ্ৰীশচন্দ্ৰ। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর জননী নাকি বুকের সামনে একটি ছুরি ধরে বসে আছেন, তাঁর পুত্র বিধবা বিবাহ করলেই তিনি আত্মঘাতিনী হবেন! তাতেই মাতৃবাধ্য, সুপুত্র সেজে গিয়েছিলেন শ্ৰীশচন্দ্ৰ। প্ৰথমে এ খবর শুনে রাগে জ্বলে উঠেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কোন মা কবে পুত্রকে ইহ সংসারে রেখে আত্মঘাতী হয়? এ সমস্তই তো ভয়-দেখানো কথার কথা! উপযুক্ত শিক্ষিত ছেলে যদি কোনো কাজকে ন্যায় বলে জানে, এবং তার মা যদি বিপরীত কথা বলে, তা হলে সেই ছেলে তার মায়ের ভুল বোঝাতে পারবে না? তা হলে কিসের সুপুত্র সে? কিসের জন্য। তবে বিদ্যাশিক্ষা? শিক্ষিত হয়েও যে পিতা-মাতার কুসংস্কার মেনে নেয়, সে আসলে মূর্খ! কিন্তু শ্ৰীশচন্দ্র যখন সমস্ত রকম কথার খেলাপ করে একেবারে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, তখন একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্ৰ। রোগশয্যায় শুয়ে তখন আর তিনি বিধবা বিবাহের নাম-উচ্চারণও সহ্য করতে পারতেন না তিনি। তাঁর মনে হত, চুলোয় যাক বিধবারা! যার যা খুশী করুক; তাঁর আর কোনো দায় নেই, তিনি আর বাইরে বেরুবেন না, লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না।
এই সুযোগে রাজা রাধাকান্ত দেব বহু গণ্যমান্য লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আর একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন সরকারের কাছে। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিধবা বিবাহ আইন পাশ হলেও সে আইন রদ করে দেওয়া হোক। সরকারের আইন যদি কার্যে পরিণত না হয়, তা হলে সরকার হাস্যাম্পদ হবেন। এ দেশে বড় জোর দুটি একটি বিধবা মেয়ে যদি বা পুনর্বিবাহের জন্য এগিয়ে আসতে চায়, কিন্তু তাঁদের বিবাহ করবার জন্য একটিও পুরুষ এগিয়ে আসবে না। এতদিনে তাই তো দেখা গেল। সুতরাং, এমন আইন রাখার মানে কী হয়!
ওদিকে কালীমতীর মা লক্ষ্মীমণিকেও একদল লোক বশ করে ফেলেছিল। তাঁরা তাঁকে বুঝিয়েছিল যে, বিবাহের নামে যে মেয়ে একবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, সে কোনোদিন আর ঘরে ফিরতে পারবে? সমাজে আর তার স্থান হবে না, সে কলঙ্কিনী হিসেবে গণ্য হবে। তাঁদেরই প্ররোচনায় ও সাহায্যে লক্ষ্মীমণি এক মামলা দায়ের করেছিলেন আদালতে। তাঁর বক্তব্য ছিল, শ্ৰীশচন্দ্ৰ মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কালীমতীকে শান্তিপুর থেকে কলকাতায় এনে কলঙ্কের ভাগী করেছে, এখন সে হয় কালীমতীকে বিবাহ করুক, অথবা চল্লিশ হাজার টাকা খোরপোষ দিক।
দেশের বহু সংবাদপত্র এই সময় তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রূপে মেতে উঠেছিল। সাহেবরা লিখেছিলেন, এই তো দেখা যাচ্ছে ইয়ং বেঙ্গলের সমাজ সংস্কারের দৌড়। কেউ লিখেছিলেন, কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না যে, শ্ৰীশচন্দ্ৰ, সে আবার জজ কোর্টের পণ্ডিত? এর কাছ থেকে কে সুবিচারের আশা করবে? এর চাকরি যাওয়া উচিত এবং কালীমতীর কাছে কান মূলে ক্ষমা চেয়ে চল্লিশ হাজার টাকা দণ্ড দেওয়া উচিত!
রোগশয্যায় শুয়ে যথাসময়ে এই মামলার কথাও ঈশ্বরচন্দ্রের কানে এসেছিল। সব শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বেশ হয়েছে!’’
একদিন রাজকৃষ্ণের সঙ্গে দু-চারজন বন্ধু দেখা করতে এসেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা দেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছেন! রাজকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি অ্যাত ভেঙে পড়চো কেন, ঈশ্বর। এক জায়গায় ব্যর্থ হয়েচি, আমরা অন্য বিধবা মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।’’ ঈশ্বরচন্দ্ৰ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ছাই করবে! আর আমার কাছে ওসব কথা বলতে এসো না।’’ উপস্থিতদের মধ্যে একজন ছিলেন তখনকার একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করচি। সার্থক হবো নিশ্চয়!’’ ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘সে আপনাদের যা খুশী করুন গে! আমাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না। অনেক পণ্ডশ্রম করেছি। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে!’’ সম্পাদকটি বলেছিলেন, ‘‘এ কথা বললে চলবে কী করে! আপনি আমাদের সেনাপতি!’’ ঈশ্বরচন্দ্ৰ মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের এই সেনাপতি অসুস্থ, মুমূর্ষ, একে দিয়ে আর আপনাদের কাজ হবে না। আপনারা অন্য সেনাপতি ধরুন।’’ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘‘না, না, আপনি এমন কিছু অসুস্থ নন। আপনার কী-ই বা বয়েস?’’ ঈশ্বরচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘দেখছেন না, চলৎশক্তি পর্যন্ত নেই! কানা খোঁড়া সেনাপতি দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? বয়েস ছত্রিশ হলো, এমন কিছু কম কী?’’ সম্পাদক একটু হেসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘সেনাপতি অসুস্থ হলেও যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেন। সব সময় কি আর সেনাপতিকে সমরক্ষেত্রে যেতে হয়! তাঁবুতে বসেই নির্দেশ দেন। এই দেখুন না, মুলতানের যুদ্ধের সময় জেনারেল হুইকের দারুণ জ্বর বিকার হয়েছিল, তবু শুধু শিবিরে শুয়ে শুয়েই কেমনভাবে পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধ জয় করলেন। আপনি শুয়ে থাকুন, শুধু কলকাতা ছেড়ে যাবেন না, তাতেই আমাদের জয় হবে।’’ ঈশ্বরচন্দ্র জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘শুধু কলকাতা কেন, আমার এখন ইহলোক ছাড়বার সময় হয়েছে!’’
এর দু’দিন পর একদিন দ্বিপ্রহরে ঈশ্বরচন্দ্ৰ যখন সেই ঘরে নিদ্রিত ছিলেন, ঘরে আর কেউ ছিলেন নক, এমন সময় একজন ব্যক্তি চুপি চুপি সে ঘরে প্রবেশ করে ঈশ্বরচন্দ্রের পা চেপে ধরেছিলেন। চোখ মেলে ঈশ্বরচন্দ্ৰ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কে রে?’’ লোকটি বলেছিল, ‘‘আজ্ঞে আমি শ্ৰীশচন্দ্ৰ।’’ ঈশ্বরচন্দ্ৰ এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যুবক শ্ৰীশচন্দ্র ন্যায়রত্নকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পা সরিয়ে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলেছিলেন, ‘‘আমার মরতে যেটুকু বাকি আছে, তুই বুঝি সেটুকুও শেষ করে দিতে এসেছিস?’’ করুন কণ্ঠে শ্ৰীশচন্দ্ৰ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’’ ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমি তোকে ক্ষমা করবার কে! যা করবার করবে আদালত।’’ শ্ৰীশচন্দ্র জানিয়েছিলেন, ‘‘আজ্ঞে, আদালতে সব মিটে গেছে। কিন্তু আপনার কাছেই আমি সবচেয়ে বেশী অপরাধী। আপনি ক্ষমা না করলে আমি সারা জীবনে শান্তি পাবো না।’’ ইশ্বরচন্দ্র রেগে উঠে বলেছিলেন, ‘‘দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে!’’ শ্ৰীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘বিয়ের সব ঠিকঠাক। আপনি প্ৰসন্ন না হলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে!’’ ঈশ্বরচন্দ্ৰ সেটা শুনে ভীষণ শ্লেষের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘ও! বিয়ের সব ঠিকঠাক! হঠাৎ রাজি হবার কারণটা কী? চাকরি যাবার ভয়, না চল্লিশ হাজার টাকা জরিমানা দেবার ভয়?’’ শ্ৰীশচন্দ্র আবার ঈশ্বরচন্দ্রের পা চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলেছিলেন, ‘‘আপনি যদি আমায় অবিশ্বাস করেন, তা হলে আমি বিবাগী হয়ে চলে যাবো। আপনি এতকাল আমায় দেখেছেন, সত্যভঙ্গ করা কি আমার স্বভাব? আমার মা অবুঝ হয়েছিলেন, সন্তান হয়ে মায়ের ওপর জোর করা যায় না, তাই দিবারাত্র তাঁর পাশে বসে থেকে বুঝিয়েছি, সেইজন্যই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। মা আজ সকালে সম্মতি দিয়েছেন, তারপরেই ছুটে এসেছি আপনার কাছে।’’ উত্তর শুনে একটু নরম হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘শুধু আমার কাছে এলে কী হবে? আগে পাত্রীর মায়ের কাছে ক্ষমা চা গে যা!’’ শ্ৰীশচন্দ্র তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘আজ্ঞে সেখানেও গোসলুম। তাঁরা সব বুঝেছেন। লক্ষ্মীমণি দেবীকে আমি বারবার বলে পাঠিয়েছি যে, এ বিবাহ হবেই, শুধু কিছু বিলম্ব হচ্ছে এই যা। কিছু কু-লোকের মন্ত্রণায় তিনি মামলা দায়ের করেছিলেন। আপনার বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য আমি কন্যাপক্ষের নিমন্ত্রণাপত্রের মুসাবিদা পর্যন্ত সঙ্গে করে এনেছি।’’ এই বলে শ্ৰীশচন্দ্ৰ ফতুয়ার পকেট থেকে একটি কাগজ বার করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বালিশটা আমার মাথার কাছে তুলে দে!’’ খানিকটা উঠে তিনি বালিশে মাথা হেলান দিয়ে বসেছিলেন। তারপর চিঠিখানি মেলে ধরেছিলেন চোখের সামনে। তাতে লেখা ছিল –
‘‘শ্ৰীশ্ৰীলক্ষ্মীমণি দেব্যাঃ বিনয়ং নিবেদনম
২৩ অগ্রহায়ণ রবিবার আমার কন্যার শুভ বিবাহ হইবেক, মহাশয়েরা অনুগ্রহপূর্বক কলিকাতার অন্তঃপাতী সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভকর্ম সম্পন্ন করিবেন, পত্র দ্বারা নিমন্ত্ৰণ করিলাম ইতি। তারিখ ২১ অগ্রহায়ণ, শকাব্দ ১৭৭৮।’’
চিঠিখানি দু’বার পড়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তারপর গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, ‘‘কন্যার শুভবিবাহ শুধু লিখেছে কেন? লিখতে বল বিধবা কন্যার শুভবিবাহ। আমি কোনো লুকোচাপা পছন্দ করি না। যারা আসবে, তাঁরা যেন বিধবা বিবাহের কথা জেনেই আসে।’’ শ্ৰীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘আজ্ঞে তাই হবে।’’ ঈশ্বরচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘এ বাড়িতেই বিবাহ হবার কথা লিখেছিস, সে বিষয়ে আগে রাজকৃষ্ণের মত লওয়া প্রয়োজন নয়? রাজকৃষ্ণকে ডাক।’’ শ্ৰীশচন্দ্র জানিয়েছিলেন, ‘‘আজ্ঞে রাজকৃষ্ণবাবুকেও আগেই বলা হয়েছে। তিনি সাগ্রহে রাজি হয়েছেন।’’ অর্থাৎ সকল কাজ পাকা করে তারপরই শ্ৰীশচন্দ্র এসেছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছে।
পক্ষকালের মধ্যেই সঙ্ঘটিত হয়েছিল কলকাতায় প্রথম হিন্দু সমাজে, ব্ৰাহ্মণের মধ্যে বিধবার পুনর্বিবাহ। ঈশ্বরচন্দ্র তখনও পুরোপুরি সুস্থ নন, কিন্তু তবু তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন তদারকির জন্য। তাঁর লক্ষ্য ছিল যেন কোনো অনুষ্ঠানের ত্রুটি না হয়। প্রায় দু হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিদ্যাসাগর নিজে গিয়েছিলেন কয়েকটি বাড়িতে। এ যেন তাঁরই কন্যাদায়। সুকিয়া স্ট্রিটে তিনি যে গাড়িতে থাকতেন, সে বাড়িতেই বিবাহ হয়েছিল, সুতরাং তিনি কন্যাকর্তা তো ছিলেন বটেই।
নিমন্ত্রণ করতে গিয়েও এক জায়গায় দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। যেখান থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়ার আশা করেছিলেন, আঘাত এসেছিল সেখান থেকেই। তিনি গিয়েছিলেন রামমোহন রায়ের গৃহে, রামমোহনের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়কে বিয়ের সময় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করবার জন্য। সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিগণ যত বেশী উপস্থিত থাকবেন, তত বেশী এরূপ বিবাহ সম্পর্কে লোকের বিরূপতা দূর হবে, এটাই ছিল তাঁর ভাবনা। কিন্তু রমাপ্রসাদ রায় একটু যেন আমতা আমতা করতে শুরু করেছিলেন। বিধবা বিবাহ প্ৰস্তাবের আবেদনে তিনি স্বাক্ষরও দিয়েছিলেন, মুখে সমর্থনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিবাহ সভায় উপস্থিত থাকার কথায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে আর এর মধ্যে টানা কেন? আমি না হয় না-ই গেলাম।’’ মুখখানা বিবৰ্ণ হয়ে গিয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের। তাঁর চোখ গিয়েছিল দেয়ালের দিকে। সেখানে রামমোহনের একটি আবক্ষ ছবি ঝুলছিল। সতীদাহ নিবারণের জন্য যে পুরুষসিংহ সমাজের বিরুদ্ধে এত লড়েছিলেন, আজ বিধবা বিবাহ উপলক্ষে তাঁর পুত্রের মুখে এ রকম কথা! উঠে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তবে আর ঐ ছবিটা বুলিয়ে রেখেছেন কেন? টান মেরে মাটিতে ফেলে দিন! আপনি না গেলেও এ অনুষ্ঠানের কোনো ত্রুটি হবে না।’’
কালীমতীকে আগে থেকেই এনে রাখা হয়েছিল রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। বর এসেছিলেন রামগোপাল ঘোষের বাড়ি থেকে। বিবাহের লগ্ন ছিল রাত্রি দ্বিপ্রহরে। কিন্তু যদি কোনো গোলযোগ হয়, সেইজন্য সন্ধ্যাকালেই আনা হয়েছিল বরকে। রামগোপাল ঘোষের গৃহ থেকে বিবাহের মণ্ডপ পর্যন্ত পথের দু’পাশে দু’হাত অন্তর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুলিশ। পথ ছিল একেবারে লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে কত লোক হুজুকখোর, কত লোক স্বপক্ষের আর কত যে বিপক্ষীয় তা বোঝা দুষ্কর ছিল। রামগোপাল ঘোষের সুসজ্জিত জুড়ি গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন বরবেশে শ্ৰীশচন্দ্র, তার সঙ্গে ছিলেন রামগোপাল ঘোষ নিজে, তাঁর বন্ধু হরচন্দ্র ঘোষ, শম্ভুনাথ পণ্ডিত ও দ্বারকানাথ মিত্র। এক সময় মনুষ্যের ভিড়ে অশ্ববাহিত গাড়ি আর অগ্রসর হতে পারছিল না। কারা যেন তুমুলভাবে চিৎকার করছিল। তা স্বপক্ষের জয়ধ্বনি না বিপক্ষের বিদ্রুপ, তা বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা পটকা ফেটেছিল। শ্ৰীশচন্দ্র রামগোপালের হাত চেপে ধরেছিলেন। শোনা গিয়েছিল যে, বিপক্ষীয় লোকেরা লাঠিয়াল এনে বরের শোভাযাত্রার জন্য হামলা করবে সেইজন্যই এত পুলিশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। রামগোপাল শ্ৰীশচন্দ্ৰকে বলেছিলেন, ‘‘ভয় নেই।’’ তারপর বন্ধুদের নিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়েছিলেন পথে। তাঁরা জুড়ি গাড়ির দু’পাশে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। কেউ অবশ্য গোলযোগ অথবা বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। সকলে নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠানেই বিবাহ হয়েছিল। দু’পক্ষের দু’জন বিশিষ্ট পুরোহিত উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন বিদ্যাসাগরের পক্ষপাতী সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতরা। ইয়ং বেঙ্গলের দল ছিলেন, রাজা দিগম্বর মিত্র থেকে শুরু করে বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ পর্যন্ত প্ৰসিদ্ধ ধনীরাও প্রথম থেকে সর্বক্ষণ বসে ছিলেন। রমাপ্রসাদ রায়ও শেষ পর্যন্ত চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে না এসে পারেননি। এবং এসেছিলেন অনেক মহিলা। সমস্ত মন্ত্র পাঠ, কন্যা সম্প্রদান, নানাবিধ অলঙ্কার ও দান সামগ্ৰী, উলুধ্বনি, দ্বারষষ্ঠী ঝাঁটাকে প্ৰণাম, স্ত্রী-আচার, নাক-মলা, কান-মলা, কড়ি দে কিনলেম দড়ি দে বাঁধলেম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যাঁ করো তো বাপু ইত্যাদি কিছুই বাদ পড়েনি সেই বিয়েতে। তারপর হয়েছিল ভূরিভোজ। পরম আনন্দে এবং বিনা বাধায় অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়েছিল। সেদিন সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত, উৎকণ্ঠার শেষে অবসন্ন কিন্তু পরিতৃপ্ত মুখে দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।
(তথ্যসূত্র:
১- জীবন সন্ধানী বিদ্যাসাগর; রামরঞ্জন রায়।
২- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪।
৩- সেই সময়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত