বলা হয় তাঁর জহরের জন্মটা উনিশময়! জন্মতারিখে ১৯, জন্মসালেও ১৯১৯। সেপ্টেম্বর মাসে, পূর্ববঙ্গের বরিশালে। তবে তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী তাঁর জন্মদিন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘তারিখটা বলতে পারব না। কারণ ওঁর জন্মদিন আমরা কখনও পালন করিনি। শুনেছি ১৯১৯ সালের আশ্বিন মাসে ওঁর জন্ম।’’
কাকভোর। বেলতলা রোডে তখনকার প্রখ্যাত পরিচালক নরেশ মিত্রর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন নাদুসনুদুস কৌতুকাভিনেতাটি (বাড়িটা যে রাস্তায় সেই রাস্তার এখনকার নাম নরেশ মিত্র সরণি)। নরেশচন্দ্র মিত্র ছিলেন শিশির ভাদুড়ী, দানীবাবু (প্রকৃত নাম সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ; গিরিশচন্দ্র ঘোষের সুযোগ্য পুত্র) প্রমুখ কিংবদন্তী মঞ্চাভিনেতাদের সমসাময়িক অভিনয়-ব্যক্তিত্ব! যেরকম মঞ্চে, সেরকমই পর্দায়। পরিচালক হিসেবেও ছিলেন খ্যাতনামা; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে ‘গোরা’-র চিত্রনাট্য তুলে দিয়েছিলেন, এ ছবি এই সিনেমা শুরুর আগে দেখানো হয়েছিল। তা এহেন নরেশ মিত্রর বাড়িতে এই সাতসকালেই এসে হাজির হয়েছেন যখন অভিনেতাটি, তখনও পরিচালকের ঘুমই ভাঙেনি। তিনি দিব্যি নীচের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নরেশ মিত্র তারপর যখন এলেন, সটান তাঁর সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন অভিনেতা! নরেশ তো তাঁকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে গালাগাল করতে শুরু করে দিলেন! কিন্তু অভিনেতাটি তাতে একটুও বিচলিত হলেন না, ঠায় ওরকম কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। একসময় নরেশ নিজেই হাঁপিয়ে গেলে তারপর শান্ত হয়ে বললেন – ‘‘আর ওরকম করবি না কখনও। যা এখন, দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে! আর পরশু অফিসে গিয়ে জিগ্যেস করে আসিস, তোর শুটিং কবে আছে!’’ ব্যস, অভিনেতার মুখে চওড়া হাসি! তারপর নিজেই বললেন – ‘‘আজ্ঞে, অভয় দেন তো একটা কথা বলি!’’ নরেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘‘আবার কি কথা?’’ তখন অভিনেতা বললেন – ‘‘আপনার সম্পর্কে যে শুনেছি আপনি দানীবাবুকে স্টেজে এরকম করে জ্বালাতন করতেন! তা সেই পদ্ধতিটাই আপনার ওপর প্রয়োগ করে একটু দেখছিলাম!’’ একটু আগেই যিনি অত খিস্তিখেউড় করছিলেন রেগে গিয়ে, মুহূর্তে সেই তিনি, নরেশ মিত্র, একেবারে হাসিতে ফেটে পড়লেন। পুত্রসম অভিনেতাকে বললেন – ‘‘ওরে, তোর পেটে পেটে এত!’’ আসলে, ব্যাপার সেরকম গুরুতর কিছু না! আবার নরেশবাবুর দিক থেকে দেখতে গেলে বেশ গুরুতরও বটে! আগের দিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে নরেশের কোনও একটা ছবির (সম্ভবত ‘উল্কা’) শুটিং চলছিল। শট চলছে, এমন সময় হঠাৎ সবাই শুনল, পরিচালক ‘কাট’ বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা থেমে গেল, সেট লাইট জ্বলে উঠল, বড় আলোগুলো নিভে গেল, সেট লাইটের প্রপেলার ফ্যান চলতে লাগল! কিন্তু এদিকে আরেক গণ্ডগোল, নরেশবাবু বলছেন যে উনি তো ‘কাট’ বলেনইনি! তবে অবিকল পরিচালকের গলা করে কে ‘কাট’ বললেন? যথারীতি সকলে বুঝতে পারল, কালপ্রিটটি কে! কিন্তু তিনি ততক্ষণে পগার পাড়! প্রবীণ পরিচালক নরেশ, এমন বেইজ্জতি দেখে তিনি তো রেগে ফায়ার! ঘোষণা করলেন, ‘‘ওকে আর নেবই না, ওর জায়গায় অন্য আর্টিস্টকে দিয়ে কাজ করাব, আর যে দুটো সিন করেছে ফেলে দেব!’’ নরেশবাবুর গলাটি ছিল খানিক অনুনাসিক! আর সেটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নকল করতে পারতেন অসম্ভব প্রতিভাধর অভিনেতাটি! পর্দার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও এমনই রসিক মানুষ ছিলেন জহর রায়!
১৯৪৭। ভারত স্বাধীন হল। অর্ধেন্দুর পরিচালনায় ‘পূর্বরাগ’ মুক্তি পেল সেইবছর। জহরের সিনে-জগতে পদার্পণ! চলবে টানা তিরিশ বছর। তিনশোর কাছাকাছি ছবি। তবে শুরুটা কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না! প্রথম সিনেমার পর টানা একবছর কোনও কাজ পাননি! আবার ১৯৪৮-এ বিমল রায়ের পরিচালনায় ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে অভিনয় করেন! সিনেমা ছাড়াও জহর করেছেন অজস্র পাড়ার ফাংশান, কমিক-স্কেচ আর অবশ্যই নাটক তো বটেই! ফাংশান করার এক প্রবল নেশা ছিল তাঁর। কোনও বাছবিছার করতেন না! যেখানে সেখানে খুব অল্প পারিশ্রমিকেও কাজ করে দিয়েছেন! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একারণে প্রায় সবসময়ই বকুনি খেতেন, ভানু ছিলেন অত্যন্ত ইমেজ-সচেতন আর সেখানে জহরের নিজের ইমেজের দিকে কোনও খেয়ালই ছিল না! জহরের সহকর্মী ও বন্ধু, সেইসময়ের আরেক চরিত্র-অভিনেতা ও স্টলওয়ার্ট কমেডিয়ান অজিত চট্টোপাধ্যায় এই ফাংশানের ব্যাপারে জহরকে খুব সাহায্য করতেন, অনেকসময় এমনও হয়েছে, নিজের ফাংশান জহরকে পাইয়ে দিয়েছেন! ’৫০ আর ’৬০-এর দশকে ফাংশান-জহর রায়কে ছাড়া ভাবাই যেত না, আর শুধু তো কলকাতা নয়, কলকাতার বাইরেও গিয়ে করে দিয়ে এসেছেন ফাংশান! ফাংশান অনেকটা যেমন করতেন বাড়তি রোজগারের কারণে, তেমনই ভালোবাসা থেকেও! এরকমও হত, পরপর তিনটে ফাংশান অ্যাটেন্ড করেছেন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে! জনপ্রিয় চলচ্চিত্র-পত্রিকা উল্টোরথের সাংবাদিক রবি বসু, জহর যাকে নিজের ভাইয়ের মতই ভালোবাসতেন, তিনি যেমন একবার তাঁর দেশের বাড়ি তমলুকের একটা অনুষ্ঠানের জন্য যেতে জহরকে যখন নিমন্ত্রণ করতে যাচ্ছেন ৭১/১এ পটুয়াটোলা লেনের ‘অমিয় নিবাস বোর্ডিং’য়ে, যেখানে ছিল জহরের লাইব্রেরি আর অফিসঘর, তখন গলির মুখেই দেখেন, মির্জাপুর স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে পান চিবোচ্ছেন জহর। তখন বিকেল। জহর তাঁকে দেখে বলেন, ‘‘এবার কি আমার পান খাওয়া নিয়ে খবর করবি নাকি রে? তোরা যখন আমার নিউ ক্যাথেতে পান করা নিয়ে খবর করতে পারিস তখন সব করতে পারিস!’’ রবি যখন তাঁকে জিগ্যেস করেন যে, এখন এইসময় অফিসে না থেকে ঠা-ঠা রোদে জহর কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছেন, তখন জহর বলেছিলেন, আসলে গোবরডাঙায় একটা ফাংশানের উদ্যোক্তাদের আসার কথা, তারা তখনও আসেনি, তাদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু গোবরডাঙার পরে আরও দু’জায়গায় ফাংশানে যাওয়ার কথা, এখানেই দেরি হয়ে গেলে বাকি দুটোয় যেতেও কত দেরি হবে, সেই নিয়ে তিনি তখন চিন্তিত! তারপর রবির আসার উদ্দেশ্য জানতে পেরে বলেন – “তুই যখন রোদে রোদে তেতেপুড়ে ঘামতে ঘামতে এসেছিস তখন এ ফাংশানটা যে ‘খেপ’ নয়, বুঝতে পারছি। বাকি রইল ‘সংক্ষেপ’ আর ‘আক্ষেপ’। এর মধ্যে কোনটা ভেবে এসেছিস?” (জলসার লাইনে খেপ মানে মোটা পারিশ্রমিক, সংক্ষেপ মানে অল্প পারিশ্রমিক আর আক্ষেপ মানে হচ্ছে কোনও পারিশ্রমিক নয়, ভালোবেসে অনুষ্ঠান করে দেওয়া) রবি তাঁকে বলেন, ওই আক্ষেপ আর সংক্ষেপের মাঝামাঝি একটা, মানে উদ্যোক্তা খুশি হয়ে যা দেবে, শিল্পীকেও খুশি মনেই সেটা নিয়ে নিতে হবে! জহর নিরাশ করেননি, কোনোদিনই, কাউকেই! জহরের সাথে তমলুকের ওই অনুষ্ঠানেই গিয়েছিলেন অপরেশ লাহিড়ী, তাঁর স্ত্রী বাঁশরী লাহিড়ী এবং তাঁদের ছ’বছরের ছেলে বাপি! ছ’বছরের বাপি অসাধারণ তবলা বাজায় শুনে জহর রবিকে বলেছিলেন, তা তোরা কি আর ওকে তবলা বাজাতে দিবি ঠিক করে! একটু ভালো বাজালেই তো এমন মাথায় তুলবি, যে বারোটা বেজে যাবে! যাইহোক, জহরের সেই আশঙ্কা যে সত্যি হয়নি, সেটা অল্পদিনের জন্যে হলেও দেখে যেতে পেরেছিলেন তিনি, আর তাতে নিশ্চয় আনন্দই পেয়েছিলেন!
পানিং আর কথার পিঠে কথা তৈরিতে এককথায় রাজা ছিলেন জহর রায়! যেমন একবার উৎপল চক্রবর্তীকে সমরেশ বসু সম্পর্কে বলেছিলেন, সমরেশ বসুকে তিনি নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কালকূট না পানকূট! এত পান করেন কেন?” বোঝো, অথচ প্রশ্নকর্তা নিজেই কিনা নিয়মিত মদ্যপান করতেন, শেষ বয়সে ধারদেনায় ডুবে যে পানের মাত্রা লাগামছাড়া হারে বেড়ে গিয়েছিল! উৎপল একবার সরকারি কাজে মালদা যাওয়ার সময় ট্রেনে জহরের স্যুটকেস দেখে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলেন, একদিন দেখা করা যায় কিনা! উৎপলকে শিবরাম চক্রবর্তী ভানু-জহরকে দিয়ে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন করানো যায় কিনা, এ নিয়ে ভেবে দেখতে বলেছিলেন! সেটা আর হয়নি, হলে বাংলার দর্শক এক অনন্য সৃষ্টি দেখতে পেত, সন্দেহ নেই! উৎপলের সাথে জহরের ওই একবারই দেখা হয়েছিল, সেবার মালদাতেই! জহরের শরীরে তখন ভাঙন ধরেছে, বিশ্রামের উদ্দেশ্যেই আসা মালদায়! উৎপল শরীরের হাল কেমন জানতে চাওয়ায় উত্তর – “আগে রক্ত নোনতা ছিল। এখন মিষ্টি হয়ে গেছে। সুগার!” নিজের অসুখ নিয়েও মজা! ব্যক্তিজীবনে যেমন ছাপ রেখে গিয়েছেন সকলের মনে, আর অভিনয়-জীবনে তো সেকথা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না! তাঁর ওই গোলগাল চেহারায় হেসে হেসে মিষ্টি করে বলা কথা, অভিনয়ের গুণে মজাদার করে তোলা, এসব তো যারা দেখেছেন তাঁর সিনেমা, সকলেই জানেন! কিন্তু তার বাইরেও জহর যে আরেকটি জিনিস খুব দক্ষতার সাথে করতেন, সেটি হচ্ছে ওই পানিং এবং ডায়লগ-ইম্প্রোভাইজেশন! স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমত ডায়লগ জুড়ে দেওয়া আর তাঁর ওই কিংবদন্তীতুল্য পানিং এসব জহর করতেন প্রায় প্রতি সিনেমাতেই, এবং বলাই বাহুল্য, এত নিখুঁত আর উপভোগ্য হত, যে পরিচালকরাও তাঁকে সেই স্বাধীনতা দিয়ে দিতেন। আরও যেটা আশ্চর্য লাগে শুনলে, সেটা হচ্ছে তিনি কিন্তু এই জিনিস প্রথম সিনেমা ‘পূর্বরাগ’ থেকেই করে আসছেন! পূর্বরাগের জন্য অর্ধেন্দুর কাছে যখন অভিনয়ের টেস্ট দিতে চান জহর, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে’র একটি সিন পুরো অবিকল অভিনয় করে দেখান, এবং এটা দেখে অর্ধেন্দু নতুন করে শুধু জহরের জন্য এরকম একটা সিন রাখেন সিনেমাতে! এই সিনেমায় জহরের একটি বিখ্যাত ডায়লগ ছিল – “ফুর ফুর করে একটা নারকেল গাছ আকাশের দিকে উঠে গেছে!” ফুর ফুর করে হাওয়া বইছে একথা শুনেছি আমরা, কিন্তু ফুর ফুর করে নারকেল গাছ ওপর দিকে উঠে গেছে, এমন অদ্ভুত কথা কি শুনেছে কেউ কখনও? কিন্তু ওটাই যে জহর, প্রথম সিনেমাতেই নিজের তৈরি ডায়লগে মাত করে দিচ্ছেন দর্শকদের, বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি লম্বা, অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া! ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘অগ্নীশ্বর’, জহরের এইসব সিনেমার পরিচালক অরবিন্দ মুখার্জি তো বলেইছিলেন – “ও কোনোদিন বাঁধাধরা সংলাপে নিজেকে ধরে রাখতে পারত না। হয়ত কয়েক মিনিটের সংলাপ, ও বানিয়ে আরও কয়েক মিনিট বলে দিল”। জহর অবশ্য রবি বসুকে বলেছিলেন, এই এক্সটেম্পোর অভ্যাসটা তাঁর হয়েছিল অত অত ফাংশান করে করে! তবে এই অতিরিক্ত ডায়লগ বলার ফলে অনেকসময়েই তাঁর সহ-অভিনেতাদের যে অসুবিধায় পড়তে হয়, মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়, একথাও স্বীকার করতেন জহর, কিন্তু এই অভ্যাস (বা বদভ্যাস) থেকে কোনোদিনই বেরোতে পারেননি!
অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পূর্বরাগ’, সুশীল মজুমদারের ‘সাহারা’ বা বিমল রায়ের ‘অঞ্জনগড়’ ছবির মাধ্যমে বাংলা ছবির জগতে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিচিত করে তুলছিলেন ‘জহর রায়’। ঠিক সেই সময়েই আর এক ‘বাঙাল অভিনেতা’ বাংলা ছবির মহাকাশে পা রেখেছিলেন। বরিশালের জহর সেভাবে বাঙাল ভাষা বলতে পারতেন না। কিন্তু এই অভিনেতার আবার বাঙাল ভাষাই ছিল মূল অস্ত্র। তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় সমসাময়িক সময়তেই ‘জাগরণ’ ছবিতে ভানুর আবির্ভাব। জহর রায়ের সঙ্গে প্রথম থেকেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ভানুর। যে ভানু-জহর জুটি পরবর্তীকালে ইতিহাস তৈরি করেছিল, সেই জুটির পথ চলা শুরু প্রভাত মিত্রর ‘ইন্দ্রনাথ’ ছবি দিয়ে ১৯৫০ সালে। এরপর থেকে জহর-ভানু সম্পর্কে চিড় ধরা তো দূরে থাক, বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়েছে। দু’জনেই কমেডিয়ান হিসেবে সাফল্যের চূড়ায় অধিষ্ঠান করেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত সংঘাত বা পেশাগত রেষারেষির মনোভাব কোনওদিনই দু’জনের মধ্যে মাথাচাড়া দেয়নি। দু’জনেই নিজেদের অভিনয়ে স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখেছেন। শুধু পর্দাতেই নয়, পর্দার বাইরেও ভারী ভাব ছিল দুজনের। অথচ, বাজারে গুজব চালু ছিল যে ভানু আর জহর নাকি পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পারেন না। এসব কথা নিয়ে কেউ দু’জনকে প্রশ্ন করলে তাঁরা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তার জবাব দিতেন। ভানু বলতেন, ‘‘লোকের কথায় কী আসে যায়। আমি কী হেইডা জহর ভালো কইরাই জানে, আর জহর কী হেইডা আমি জানি।’’ অন্যদিকে জহর রায় বলতেন, ‘‘যাঁরা ওইসব কথা রটাচ্ছে তাদের মুখের মতো জবাব দেওয়ার জন্য একবার বাথরুমে যাওয়া দরকার। তাঁদের কথার উত্তর ওইসব জায়গাতে দাঁড়িয়েই দিতে হয়।’’ ভানুর তূণে প্রধান অস্ত্র যেমন ছিল বাচনভঙ্গি, তেমন জহরের অভিনয়ের অনেকটা জুড়েই ছিল শরীরী ভাষা। ভানু লিখেছেন, ‘‘জহরের সব থেকে বড় গুণ ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। … আর একটা গুণ হল ফিজিক্যাল ফিটনেস। নাকের ওপর একটা ঘুষি মারলে জহর সমস্ত শরীরটা ঠেলে দিয়ে এমনভাবে পড়ে যেত যে, সেটা কিছুতেই অভিনয় বলে মনে হতো না।’’ এই দুই অভিনেতার বন্ধুত্বে আরও দুই ব্যক্তির ভূমিকার উল্লেখ করতেই হবে। একজন পরিচালক ‘সুশীল মজুমদার’। তাঁর স্ত্রী ‘আরতি মজুমদার’ পাটনার মেয়ে ছিলেন। সেইসূত্রে সুশীলবাবু জহর রায়ের পূর্বপরিচিত ছিলেন। সুশীলবাবু আবার ছিলেন স্টুডিওপাড়ায় ভানুর গুরুস্থানীয়। ভানুর প্রথম ছবির পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন সুশীলবাবুই। এই সুশীলবাবুর বাড়িতেই এক সিনেমার আড্ডায় প্রথম আলাপ হয় ভানু ও জহরের। আর দ্বিতীয় যে ব্যক্তির বড় ভূমিকা ভানু-জহরের অভিনয় জীবনে তিনি হলেন আর এক হাস্যকৌতুকশিল্পী ‘অজিত চট্টোপাধ্যায়’। ‘ভানু-জহর-অজিত’ ছিলেন ‘এক আত্মা-এক প্রাণ’। ভানু-জহর যখন অভিনয় জীবনে স্ট্রাগল করছেন, জলসার জগতে তখন অজিতের বেশ নামডাক। ফলে তাঁর কাছে শো-এর বায়না আসত প্রচুর। অজিত প্রায়শই মফস্সলের জলসায় ভানু-জহরকে সঙ্গে করে হাজির হতেন। ধীরে ধীরে দুই বন্ধুকে এমন একটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি যেখানে দর্শক সংখ্যা আর শিল্পীর কদর দুই-ই অনেক বেশি। কখনও নিজের শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে, আবার কখনও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে ভানু-জহরকে মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন অজিত। বন্ধুর এই আত্মত্যাগের ফলে মঞ্চজগৎ থেকে অজিত চট্টোপাধ্যায় ধীরে ধীরে চলে গেলেন পিছনের সারিতে। আর উঠে এল ভানু-জহর জুটি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জহর রায়ের সম্পর্ক কীরকম ছিল তার অনেক গল্পই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাবার কথা বলতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছেন। তখনকার দিনে সিনেমার তারকাদের কাছে এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল ‘উল্টোরথ পুরস্কার’। যে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তোলা সত্যজিৎ রায়ের সহাস্য ছবিটিই নিজের ঘরে সাজিয়ে রেখেছিলেন জহর রায়। যাইহোক, এই পুরস্কারটি দর্শকদের ভোটে নির্ধারিত হতো বলে এর আলাদা মাহাত্ম্য ছিল। গৌতম একদা জানিয়েছিলেন, ‘‘উল্টোরথ পুরস্কার নিয়ে বাবার ভীষণ ইন্টারেস্ট ছিল। কারণ বাবা ১০ বার শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিল। এটা একটা রেকর্ড। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া কেউই এতবার এই পুরস্কার পাননি। বাবা গর্ব করে বলত, ‘২৯ ইঞ্চি বুকের ছাতি, এইরকম খারাপ চেহারা লইয়া, খারাপ কণ্ঠস্বর লইয়া, তুলসীদা, নবাদা (নবদ্বীপ হালদার), জহর, অজিতের মতো বাঘা বাঘা আর্টিস্টের সঙ্গে লইর্যা, বাইচ্যা আসি কম কথা না।’ …’’ প্রত্যেকবার ভানু ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার ঘোষণার আগে গিরীন সিংহের সঙ্গে দেখা করে বা ফোন করে কে ক’টা ভোট পেলেন, কে পুরস্কার পেলেন এইসব খবর সংগ্রহ করতেন। তখনকার দিনে সব আর্টিস্টই এরকম খবর নিতেন। ভানু ফোন করলেই ‘গিরীন সিংহ’ বলতেন, ‘‘মশাই বিরক্ত করবেন না, শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতার পুরস্কারটা আপনার বাঁধা হয়ে গিয়েছে।’’ গৌতম জানিয়েছিলেন, ‘‘একবার বাবা ফোন করাতে গিরীন সিংহ বলেন, ‘মশাই, খুবই আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, এবার পুরস্কারটা আপনি পাননি। জহরবাবু পেয়েছেন দুই বেচারা ছবির জন্য। অবশ্য আপনার জন্যই আপনি এবারটি পেলেন না।’ …’’ ভানু এই কথার অর্থ জিজ্ঞেস করাতে গিরীনবাবু বলেন, ‘‘আপনার শখের চোর আর হসপিটাল ছবি দু’টির মধ্যে ভোট কাটাকাটিতে জহরবাবু পুরস্কারটি পেয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ শখের চোর ছবিতে আপনি পেয়েছেন ৮০০ প্লাস, আর হসপিটাল ছবিতে আপনি পেয়েছেন ৭০০ প্লাস। এদিকে জহরবাবু দুই বেচারা ছবির জন্য ৯০০ ভোট পেয়েছেন। শখের চোর আর হসপিটাল মারামারি করাতে জহরবাবু বেরিয়ে গেলেন। ভালোই হয়েছে আপনাকে পুরস্কার দিতে দিতে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।’’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও পাল্টা বলে দেন, ‘‘জহর পুরস্কার পাইসে এ আমার হার নয়, অর পুরস্কার পাওনের অর্থ আমারই পুরস্কার জেতা।’’
কাজের প্রতি জহরের নিষ্ঠা কেমন ছিল, তার প্রমাণ দিতে কেবল একটা ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। নিজের মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও তিনি সেদিন ফ্লোর ছেড়ে বেরননি। অথচ, পরিবার ছিল তাঁর প্রাণ। পুজোর সময় যত কাজই থাকুক, ছেলেমেয়েদের জন্য দুটো দিন তাঁর বরাদ্দ ছিল। একদিন জামাকাপড় কেনা, অন্যদিন জুতো কেনা। আর দু’দিনই পছন্দের দোকানে সকলে মিলে খাওয়াদাওয়া। শত ব্যস্ততাতেও এই রুটিনের অন্যথা হয়নি। জহর রায়ের মেয়ে কল্যাণী পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার পরে এক বোন হয়েছিল। সে চোখে দেখতে পেত না। আমার পিসিরা ওকে বিহারে নিয়ে যায় চোখের অপারেশন করার জন্য। কিন্তু সে বাঁচেনি। এটা অনেকেই জানেন না।’’ ছোট মেয়ের অকাল প্রয়াণ জহরের জীবনে এতটাই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যে, দীর্ঘদিন তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি। অথচ, যখন মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পান, তখন তিনি শট দিচ্ছিলেন। কিন্তু শট অসমাপ্ত না রেখে অভিনয় চালিয়ে যান। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘পিতাপুত্র’ ছবির সেটে ওই ঘটনা ঘটে। ওই ছবিতে স্বরূপ দত্ত, তনুজা, গীতা দে, অনুপকুমার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন জহর রায়ও। ছবিতে ভীতু চাকরের চরিত্রে অভিনয় করে সকলকে খুব হাসিয়েছিলেন তিনি। সেদিনের ঘটনা সম্বন্ধে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় জানিয়ে গিয়েছেন – ‘‘ছবির নায়ক ডাক্তারি পড়ে। তাঁর পড়ার ঘরের সেট। সেই জন্য তাঁর ঘরে একটা কঙ্কাল রয়েছে। সেটাকে চাকর খুব ভয় পায়। সকালে জহর এল, পার্ট বুঝে অপূর্ব সব শট দিতে লাগল। একটু পরে কে যেন এসে ওকে বলল, ‘জহরদা, আপনার ফোন এসেছে।’ জহর অফিসে গিয়ে ফোনে কথা বলে এসে আবার শট দিতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ ব্রেক দিলাম। জহর বলল, ‘আমি কিছু খাব না। শরীরটা ভালো নেই।’ আমরা ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ সেরে বেরচ্ছি, এমন সময় মেকআপ ম্যান শৈলেনদা খুব নিচু স্বরে আমাকে বলল, ‘জহরদা মেকআপ রুমে বসে কাঁদছে।’ এ কথা শুনে আমি তো প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম। সেকি! দৌড়লাম মেকআপ রুমের দিকে। গিয়ে দেখি, টেবিলে মাথা গুঁজে জহর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে?’ জহর বলল, ‘একটু আগে টেলিফোনে খবর পেলাম, পাটনায় আমার ছোট মেয়েটা থাকত, হঠাৎ মারা গিয়েছে। আমাকে খুব ভালোবাসত রে।’ এই বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। এই কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় – ‘তোর মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তুই শ্যুটিং করে গেলি!’ ‘কী করব ভাই, তোর ক্ষতি হবে,’ বলল জহর। ‘কিচ্ছু ক্ষতি হবে না,’ বললেন ছবির প্রযোজক প্রকাশ চন্দ্র নান। আরও বললেন, ‘ঢুলুদা (অরবিন্দবাবু ইন্ডাস্ট্রিতে এই নামেই পরিচিত ছিলেন), এখনই প্যাকআপ করে দিন।’ তখন জহরই আমার হাত ধরে বলেছিল, ‘না, না প্যাকআপ করিসনি। বরং, শ্যুটিং করে খানিকটা হলেও দুঃখ ভুলে থাকতে পারব।’ সত্যি সেদিন সন্ধে ৭টা পর্যন্ত জহর অক্লান্তভাবে এমন এমন সব শট দিয়েছে, পরে হাজার হাজার দর্শক সেই সব দৃশ্য দেখে হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা তো আর জানতে পারেনি, এই শটগুলোয় হাসির কানায় কানায় লুকিয়ে রয়েছে নীরব চোখের জল।’’
জহর রায়ের এই শিশুসুলভ মনটাই আকৃষ্ট করেছিল সুচিত্রা সেনকে। জহর তাঁকে ডাকতেন ‘দিদিভাই’ বলে। আর সুচিত্রার কাছে তিনি ছিলেন ‘ভাইয়া’। তবে মাঝে মাঝে তাঁকে ‘চার্লি’ বলেও ডাকতেন। প্রত্যেক বছর দিদিভাই সুচিত্রার কাছ থেকে ভাইফোঁটা নিতেন জহর। আর বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির প্রত্যেকের ফোন করে সুচিত্রা সেনকে প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানানো ছিল মাস্ট। জহর রায় যখন প্রবল অসুস্থ, তখন সুচিত্রা অনেকবার কমলাদেবীকে ফোন করে তাঁকে দেখতে আসার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। কমলাদেবী রাজি হননি। কারণ, সুচিত্রা সেন বাড়িতে এলে তো ভিড় সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই শুনে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘‘কী হয়েছে। আমি বোরখা পরে যাব।’’ কমলাদেবীর সঙ্গে সুচিত্রার সম্পর্ক ছিল দারুণ। তিনি পাবনার মেয়ে। খাস বাঙাল। মাঝে মধ্যেই তাঁর শুঁটকি মাছ খাওয়ার সাধ হতো। কমলা ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ। সুচিত্রা একেক দিন গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর জন্য সেই গাড়িতে করে রান্না করা শুঁটকি মাছ নিয়ে যেতেন কমলাদেবী। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মধুর সম্পর্কের নানা টুকরো স্মৃতি জানা যায় জহর-কন্যা কল্যাণী রায়ের স্মৃতিচারণে। একদিনের ঘটনা। সুচিত্রা-কন্যা মুনমুনের তখন অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে। মুনমুন নার্সিংহোমে। এদিকে, জহর ফোন করে সুচিত্রাকে বলে দিয়েছেন যে, দিদিভাই, আজ বিকালে কমলা ও কল্যাণী তোমার বাড়ি যাবে। কল্যাণী রায়ের ভাষ্যে, ‘‘আমরা পৌঁছনোর আগেই আন্টি বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। বাহাদুর গিয়ে খবর দিয়েছিল যে, আমরা এসেছি। মা আসছেন খবর পেয়েই আন্টি দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলেন। দরজার সামনে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ওই রকম দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়িকা, যাঁর সঙ্গে সহকর্মীরাই সমঝে কথা বলতেন, তাঁর ওই রকম শিশুসুলভ আচরণ আমরা দেখেছি। গোটা বাড়ি আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। মাকে বলতেন, তোমার ছেলেমেয়েগুলো কী মিষ্টি হয়েছে। আমরা প্রণাম করতে গেলেই বাধা দিয়ে বলতেন, অ্যাই, তোদের বাবা বুঝি এই রকম ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে শিখিয়েছে!’’ সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জহর রায়ের অন্তরঙ্গতার আর এক সাক্ষী অভিনেতা ধীমান চক্রবর্তী। ‘আমি মন্ত্রী হব’ নাটকে অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছিলেন জহর রায়। উল্টোডাঙার কাছে থাকতেন মাস্টারমশাই সুনীল চক্রবর্তী। তাঁর লেখা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার ছিল এই নাটকটি। সেই সময়কার রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে সাজানো। একমাত্র জ্যোতি বসু ছাড়া ডান-বাম কোনও তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বোধ হয় ছিলেন না যিনি ‘আমি মন্ত্রী হব’ দেখেননি। এই নাটকে জহর রায় তাঁর অভিনয়কে স্যাটায়ার কমেডির কোন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা যাঁরা নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন বিলক্ষণ। শেষদৃশ্যে তাঁর অভিনয় দেখে দর্শকদের চোখে জল চলে আসত। এরকমই একদিন শো দেখতে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। ধীমান চক্রবর্তী পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার সঙ্গে থাকত জহরদার লাস্ট সিন। আমাদের গ্রিনরুম ছিল দোতলায়। সেদিনও আমরা নাটক শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, দেখি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম (সুচিত্রা সেন)। জহরদাকে জড়িয়ে ধরে তিনি অভিবাদন জানালেন, প্রশংসা করলেন। ওঁর মতো ব্যত্তিত্বময়ী অভিনেত্রী একজন কমেডিয়ানকে এভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এটা ছিল কল্পনাতীত।’’
‘কমেডিয়ান’ ট্যাগলাইনটা এত ট্যাজেডি নিয়ে আসে শিল্পীর জীবনে, সেটা পৃথিবীর সকল সফল কমেডিয়ানরাই বুঝেছেন! চার্লি যেসময় থেকে ওই ট্র্যাম্পকে সরিয়ে অন্যান্য চরিত্র করা শুরু করলেন, সেইসময় থেকেই জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়া শুরু! কাজ আগের মতই পারফেক্ট, ডিটেলিং, অভিনয়, সব আগের মতই আছে, কিন্তু হাসির পরিমাণ যেই কমছে, অমনি দর্শক আর নিতে পারছে না! এই একইভাবে ভুগতে হয়েছে আরও অনেককেই! তাছাড়াও আমরা এঁদের কমিক অ্যাক্টিং দেখতে পছন্দ করলেও খুব সম্মান কিন্তু এঁদের দিইনি! মানে আমাদের দেশে কমেডিয়ানদের কাজটাকে ‘লোক-হাসানো’ বলে যে তাচ্ছিল্যটা করা হয়, সেটা করতে গিয়ে আমরা ভুলেই যাই, যে এই হিউমার আনাটাই কতটা কঠিন! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তো চিরকালই স্পষ্টবক্তা, কোনও প্রিয়-অপ্রিয় ধার ধারতেন না, এক সাক্ষাৎকারে শ্লেষের সাথে বলেইছিলেন – “আমাদের দেশে সবচাইতে ভালোবাসে কাঁদতে। হাত-পা ছড়িয়ে বসে এত আরাম করে কাঁদতে বাঙালির মত কেউ ভালবাসে না। … আবার কিছু লোক আছে দেখবেন যারা সবসময়ই চুপ করে থাকে, গম্ভীর কথা হলেও চুপ করে থাকে। উনি উচ্চমার্গে বিচরণ করেন, এটা প্রমাণ করার একটা প্রসপেন্সিটি। আসলে কিছুই ঢোকে না তার মাথায়। এছাড়া আছে আধা-আঁতেল, এটা আরও ভয়াবহ”। সেই কারণেই এঁরা বারবার চেয়েছেন নিজেদেরকে ভাঙতে, দর্শক কীভাবে নেবে সেকথা তো সবসময় মাথায় রাখা যায় না! ভানু বলতেন – “আই অ্যাম স্টিল আফটার আ রোল!” কিন্তু ভার্সেটেইলিটিকে দর্শক সাময়িক উপেক্ষা করতে পারে, চিরকাল নয়! তাই এঁদের শুধুমাত্র অল-টাইম গ্রেট কমেডিয়ান না বলে অল-টাইম গ্রেট অ্যাক্টর বলাটাই বোধহয় বিবেচ্য হবে! জহরের কথায় ফেরা যাক! যেমন যাত্রিকের (তরুণ মজুমদার, শচীন মুখার্জি আর দিলীপ মুখার্জির ত্রয়ী) পরিচালনায় ‘পলাতক’-এর জহর! নীলকান্ত বৈরাগী, আয়ুর্বেদ চিকিৎসক, অথচ সন্ধের পর যাত্রার রিহার্সাল দেয়! তরুণ মজুমদার বলেছিলেন – “এক কবিরাজ, কিন্তু অসম্ভব যাত্রা পাগল, সন্ধের পর রোগী দেখে না, রিহার্সাল করে। ওর মেয়ের বিয়ে হয় বাউন্ডুলে এক ছেলের সঙ্গে। এতে ওর ইন্ধন ছিল। বিয়ের রাতে সে উধাও। মেয়েটা চুপ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে জহরদা পিছন থেকে ঘরে ঢুকে পড়লেন কিছু একটা খোঁজার অছিলায়। বাবার অসহায় অবস্থা, তাঁর অপরাধবোধ এত সুন্দর ফুটিয়ে তুললেন! এটাই আসল জহর রায়!’’ ‘পলাতক’-এর বাবা-মেয়ের জুটি বিজয় বসু পরিচালিত ‘বাঘিনী’তেও! জহর রায় আর সন্ধ্যা রায়! মাত্র দশ মিনিট থাকলেন সিনেমাতে! চোলাইয়ের কারবারি বঙ্কা বা বাঁকা, সর্বক্ষণ পুলিশের নজরকে তোয়াক্কা না করে চোলাই বানিয়ে যাওয়া অপরাধী, চারদিন বাদে বাড়ি ফিরে এসে মা-মরা মেয়ের সাথে অশান্তি করে, আবার মেয়েটার দুঃখে নিজের কাজে অনুতপ্ত বাবা কিছুক্ষণ পরেই ধার করে চাল-ডাল-তেল-নুন আর মেয়ের মান ভাঙাতে শাড়ি কিনে নিয়ে আসে, মেয়ে যখন বলে কেন ধার করে আনতে গেলে, তখন বুক চিতিয়ে বলে – “আমার মেয়ের জন্য আমি কাপড় আনব, আমি যেভাবে ইচ্ছে আনব, তোর কী?”, তারপরেই পায়ে মরচে-ধরা পেরেক বিঁধে টিটেনাস হয়ে মরে যায় – ওই কয়েকটা মাত্র মিনিটেই চিনিয়ে দিচ্ছেন জাত! কিংবা ‘নিশিপদ্মে’র মদ্যপ নটবর, যে কিনা ফুচকাতেও তেঁতুল জলের বদলে কালী মার্কা ব্র্যান্ডের বাংলা মদ ঢেলে খায়, তারপর পয়সা না থাকায় ফুচকাওয়ালাকে ‘কালীমার্কা’ বোতল ধরিয়ে দেয় জোর করে! এই সিনেমাতেই সেই জনপ্রিয় গান “না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না”-র চিত্রায়ণে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় অনঙ্গর ভূমিকায় অভিনয় করা উত্তরকুমারের সাথে নাচ! ‘অগ্নীশ্বর’এর বুকিং ক্লার্ক, যে প্রথমে ডাক্তার ষোলো টাকা ভিজিট নিচ্ছে দেখে ডাক্তারের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়, বিরক্তির সাথে ডাক্তারকে চেয়ার এগিয়ে দেয়! তারপর ডাক্তার যখন ওই ষোলো টাকা ভিজিটের পুরোটাই তার বিছানায় ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন ওই আকুল ভাবে ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু’ করে ছুটে যাওয়া জহর! সত্যিই যেন কোনও ডাক্তার তাঁর ভিজিটের সবটাই ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন তাঁর বাড়িতে, এমনই বাস্তবসম্মত সেই অভিনয়! সেই বুকিং ক্লার্কই ডাক্তারের চওড়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে হয়ে উঠছে তার শুভাকাঙ্ক্ষী! ডাক্তারকে যারা সরাবার ফন্দি আঁটছে, তাদের কাছে ডাক্তারকে ভালোমানুষ বলতে সে এতটুকু পিছপা হচ্ছে না, তারা তার থেকে উচ্চপদে থাকা সত্ত্বেও, ডাক্তারকে চুপিচুপি জানিয়ে যাচ্ছে, ওইসব দুর্নীতিপরায়ণ লোকগুলো কী ধরনের কুৎসা রটাচ্ছে ডাক্তারের নামে! মাত্র কয়েকটাই সিন, তাতেই আলাদা করে ছাপ রেখে যাওয়ার মুন্সিয়ানা!
আর ভিলেন জহর রায়? ইয়া তাগড়াই গোঁফ, গালপাট্টা-সমেত ভয়ালদর্শনের হাল্লার মন্ত্রী! কিন্তু ছোটদের জন্য বানানো সিনেমা, সেখানে এমন কিছু করলে চলবে না, যাতে বাচ্চারা ভয় পেয়ে যাবে! জহর তাঁর সিগনেচার শরীরী স্ল্যাপস্টিক আর ডায়লগ-থ্রোয়িংয়ের চূড়ান্ত হাস্যরসের ছোঁয়া দিয়ে দিলেন চরিত্রে! যুদ্ধঘোষণা হয়েছে, এদিকে সৈন্যদলের কেউ খেতে পায় না! অভুক্ত সেনাপতি সামান্য খাবারের কথা বললে, মুরগির ঠ্যাং খেতে খেতে মন্ত্রী বলেন – “আচ্ছা, তোমরা এত খাইখাই করো কেন বলো তো? আজ বাদে কাল যুদ্ধ হবে, চারিদিকে তোড়জোড় চলেছে, এর মধ্যে কোত্থেকে দু’ব্যাটা বাউণ্ডুলে এসে ব্যাগড়া দিতে শুরু করেছে! এর মধ্যে খাইখাইখাইখাই!” আবার আদুরে গলা করে শিশুমনের রাজাকে যুদ্ধের প্ররোচনা দেয় – “এই দ্যাকো, আবার ক-খ-গ-ঘ কতা বলে! দুদিন ভালো করে যুদ্ধু করে নাও, তাপ্পর তোমার ছুটি!” তাঁর চেয়ে ভালো হাল্লার মন্ত্রী হয়ত সত্যিই আর কাউকে পেতেন না সত্যজিৎ! নয়তো কেনই বা তিনি বলবেন – “জহর রায় অভিনয়ে না এলে ‘গুগাবাবা’ই হত না!” অরবিন্দ মুখার্জিও কি আরেকটা গোবর্ধন চৌধুরি পেতেন? মনে পড়ছে ‘ধন্যি মেয়ে’র শেষে শিল্ডটা যখন ‘গোবর চৌধুরি’কে দান করে দিয়ে চলে যাচ্ছে কালীগতি দত্ত (উত্তমকুমার), বদলে তার বাড়িতে অত্যাচারিত চিরদুঃখী ভাগ্নি মনসাকে (জয়া ভাদুড়ী) ভ্রাতৃবধূ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন নিজের দুর্বলতা, অন্যায়, পরাজয় সব ঢাকতে ‘ভাঙব তবু মচকাব না’-মার্কা সেই অবিস্মরণীয় ডায়লগটা, “হেঁহেঁ, বলিনি, শিল্ড আমি গাঁয়ের বাইরে যেতে দোব ন্না?” সিনেমা জুড়ে উত্তম-সাবিত্রী কিংবা পার্থ-জয়ার নায়ক-নায়িকা জুটিদ্বয়ের পাশেও এতটুকু ম্লান দেখায় না কালোবাজারি ক্লাব প্রেসিডেন্ট গোবর্ধন চৌধুরির ভূমিকায় অভিনয় করা জহর রায়কে! রেগে গিয়ে ভাগ্নিকে যখন মারছে, সেই দৃশ্যেও কী স্বাভাবিক অভিনয়! খেলা দেখতে দেখতে এমন করছেন যেন সত্যি সত্যিই মাঠে বসে খেলা দেখছেন! সেই একই উত্তেজনা শরীরে, নিজের দল গো-হারান হারছে দেখে প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টেনের (পার্থ মুখোপাধ্যায়) পায়ে লাঠির খোঁচা মারছেন, সাইডলাইন থেকে নিজের ক্লাবের খেলোয়াড়কে নির্দেশ দিচ্ছেন ক্যাপ্টেনের পায়ে ল্যাং মেরে তাকে আহত করে দিতে, রেফারি করে নামানো তোতলা পুরোহিত লম্বোদর ভটচাযের ফূর্তি দেখে তার উদ্দেশ্যে অসহায় রাগ দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচাচ্ছেন – “পুররর, দাঁড়াও তোমার পুররর করা আমি বের করছি! … রাস্কেল রেফারি হয়েছে! একটা পেনাল্টি দিতে জানে না, রেফারি হয়েছে, স্টুপিড কোথাকার! খেলা ভাঙুক, তারপর তোমার আমি ঠ্যাং ভাঙব!” ভিলেন গোবর্ধনের দুঃখে যত না আনন্দ পাচ্ছে দর্শক, তত বেশি হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে জহরের অভিনয়ের কৌশল আর ডায়লগ-থ্রোয়িংয়ের জন্য! কে জানে, ডায়লগের কতটা অরবিন্দর বানানো আর কতটা জহরের নিজের ইম্প্রোভাইজেশন! সে তর্ক থাক, সিনেমাগুলো আজও আমরা দেখব, বিশ্বকাপ ট্রফি-ধরা পুটিনের মুখে ডায়লগ বসিয়ে দিয়ে মিম ভাইরাল করব, আর জহর হয়ত মিটিমিটি করে হাসবেন, যেরকম দুষ্টু হাসিটা তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকত বরাবর! জয়া ভাদুড়ীকে বিরাট সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন জহর এই সিনেমার শুটিং চলাকালে! অরবিন্দকে বলেছিলেন, একে কোথা থেকে জোগাড় করলি রে! এ মেয়ে অনেকদূর যাবে! জহর তখন জহুরির ভূমিকায়!
আবার ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’য় এক সম্পূর্ণ অন্যরকম ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে জহরকে! মিশ্রচরিত্রের ফাউন্ড্রি ওয়ার্কশপের ফোরম্যান যোগেন মুখার্জি, যে কিনা একসময় নতুন আগত কেস হ্যান্ডলার ঈশ্বর চক্রবর্তীর বোন সীতাকে দেখে তাকে কত গল্প বলে, নতুন বাড়ির কথা কত সুন্দর করে সাজায়, ঈশ্বর ম্যানেজার হলে তার আনন্দ আর ধরে না, ঈশ্বরের পালিত ভাই অভিরামকেও সে ভালোবেসে ফ্যালে, তারপর যেই জানতে পারে অভিরাম আসলে বাগদি অর্থাৎ ‘নিচু জাত’ অমনি উপদেশ দিতে থাকে তাকে বিদেয় করার জন্যে! তারপর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত সমস্ত শেষে ঈশ্বর যখন সর্বস্বান্ত, অভিরাম আর সীতা দুজনেই নিয়তির কাছে হার মেনে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে, রেখে গেছে তাদের একমাত্র সন্তান বিনুকে, তখনই যোগেন মুখার্জি চিঠিতে লেখে, সে ম্যানেজার হয়েছে, ঈশ্বরের যা যা জিনিস বাংলোবাড়িতে আছে, সমস্ত যেন পত্রপাঠ নিয়ে চলে যায়! যোগেন মুখার্জি তখন আর কোনোভাবেই ঈশ্বরের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, ক্ষমতা পেয়ে গিয়ে সেও মুখ ফিরিয়ে নিল অসহায় ঈশ্বরের থেকে! জহরের অভিনয়ের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন একটা হল, বেশিরভাগ কথাই তিনি বলতেন হাসতে হাসতে, মিটিমিটি দুষ্টু হাসি, হাসির কথা বলার সময়েও, আবার যে কথায় দর্শক চরিত্রটাকে ঘৃণা করবে, সেরকম কথা বলার সময়েও! অভিনয়টা আসলে তাঁর কাছে ‘প্লেন অ্যান্ড সিম্পল’, চরিত্রের খাতিরে যেটুকু স্বাভাবিকত্ব বদলানোর দরকার, সেটুকুই, বাদবাকিটা একই থাকে!
অমিয় নিবাসের দুটো ঘর, তাঁর জীবনের অনেকটা জুড়েই ছিল। কাজ না থাকলে সারাদিন প্রায় সেখানেই থাকতেন। সেখানেও তাঁর ‘বন্ধু’, অজস্র! তবে রক্তমাংসের বন্ধু নয়, বরং তার চেয়েও আরও বেশি কিছু! বারোটা আলমারি ঠাসা কয়েক হাজার বই! সংগ্রহে ছিল মারি সিটনের ‘আইজেনস্টাইন’, হ্যারল্ড ডাউন্সের ‘থিয়েটার অ্যান্ড স্টেজ’, জর্জ হেনরি লিউইসের ‘অন অ্যাক্টরস অ্যান্ড দ্য আর্ট অফ অ্যাক্টিং’, এরল্ড ফ্লিনের ‘মাই উইকেড উইকেড ওয়েজ’, জন অসবর্নের ‘ইনঅ্যাডমিসিবল এভিডেন্স’, চার্লস ডারউইনের ‘দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল’, সমারসেট মমের ‘গ্রেটেস্ট শর্ট স্টোরিজ’, অ্যালফ্রেড হিচকক সম্পাদিত ‘সিক্সটিন স্কেলিটন ফ্রম মাই ক্লোজেট’, কনস্ট্যান্টিন স্তানিস্লাভস্কির ‘মাই লাইফ ইন আর্ট’, শেক্সপিয়রের একাধিক সংস্করণ, চার্লি চ্যাপলিনের বই, নিউ ইংলিশ ড্রামাটিস্ট সিরিজ, আরও কত কী! রোমান, আফ্রিকান, চাইনিজ মাইথলজি-সেসব নিয়েই একটা গোটা আলমারি! বাংলা বই তো ছিলই! হিন্দিসাহিত্যের প্রেমচাঁদ, কিষেণচাঁদও পড়তেন, অনুবাদে নয়, হিন্দিতেই! তবে বই কাউকেই পড়ার জন্য ধার দিতেন না! ঘরের মেঝেতে বিছানা পাতা ছিল, সেখানে বালিশে ঠেস দিয়ে বই পড়তেন! এই বইয়ের নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন নাট্য-ব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরি। জহর যাকে বলতেন অহীনবাবা। অহীন্দ্র চৌধুরি নিজেও প্রচুর বই পড়তেন, তাঁরও বাড়িতে নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল! তিনি বলেছিলেন – “জহর, বই পড়ো, বই পড়ো। যে লাইনে এসেছ সেখানে পৃথিবীর অন্য দরজাগুলো তোমার জন্য বন্ধ। কিন্তু বই পড়া তো তোমার কেউ আটকাতে পারবে না। বই পড়তে পড়তে দেখবে পৃথিবীর অন্য সব দরজাগুলো তোমার সামনে খুলে গেছে”। অর্থাভাবে ফর্মাল এডুকেশন হয়নি, সেটাকে পুষিয়ে নিয়েছিলেন সেলফ-এডুকেশনে! ‘সুবর্ণরেখা’ প্রকাশনীর ইন্দ্রনাথ মজুমদার, যিনি জহরের মৃত্যুর পরে তাঁর সংগ্রহের আড়াই হাজার বই কিনে নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে, তিনি বলেছেন – “১৯৫০ থেকে ৭০-এই কুড়ি বছরে কলকাতায় যত ভালো বই এসেছে তার প্রায় সবই ছিল জহরবাবুর সংগ্রহে”। বইপাড়ার একদম গায়েই লাইব্রেরি, ফলে ইচ্ছে হলেই কিনে আনার বাড়তি সুবিধা! বইপড়ার পাশাপাশি বইয়ের গন্ধ শোঁকারও একটা নেশা ছিল তাঁর। রবি বসুর লেখা থেকেই জানা যায়, লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতেও বইয়ে নাক গুঁজে গন্ধ শুঁকে নিতেন! এই মহৎ নেশা নিয়েও এমনকি, লোকে যা-তা বলে বেড়াত! ভানুর কাছে একবার একজন এসে বলেছে – “জানলেন, জহরের বাড়িতে অনেক বই দেখলাম। আসলে ওসব বুজরুকি, পড়াশোনা মোটেই করে না”। ভানুর তৎক্ষণাৎ চাবুক – “হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার সব বইতে মলাট দিয়ে রেখেছি, পাছে জহরের কাছে গিয়ে আবার না বলেন, ভানুটা কিসসু পড়াশোনা করে না!”
পর্দায় যেমন সকলকে আনন্দ দিয়ে অভিনয় করেছেন, নিজেও উপভোগ করেছেন, ব্যক্তিজীবনেও তেমনই আনন্দময়! রঙ্গ-রসিকতা, চটজলদি জবাব এসব তো ছিলই, আর ছিল প্রচুর বন্ধু! শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন, ঝামেলা-ঝগড়ায় বেশি জড়াতেন না, এমনকি ভানুকেও অনেকসময় বলতেন – “চেপে যা, ঝামেলা করিস না”। ভানুর সাথে তাঁর আজীবন হৃদ্যতা ছিল, নানাবিষয়ে মতের অমিল হলেও যেরকম পর্দায় তাঁদেরকে দেখে মনে হয়েছে ‘মেড ফর ইচ আদার’, পর্দার বাইরেকার জীবনেও দুজনে ছিলেন হরিহর আত্মা! দুজনের আলাপ যখন হয়েছিল, দুজনেই তখন সিনেমা-জগত থেকে বহুদূরে! দুজনেই তখন সদ্য কুড়ি পার করেছেন! ভানুর স্মৃতি বলে – “জহর রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চিত্র-পরিচালক সুশীল মজুমদারের বাড়িতে। সালটা হবে হয়ত ১৯৪১ কি ‘৪২। পুরনো পরিচয়ের সুবাদে ঢাকা থেকে এসে আমি ওই বাড়িতেই উঠেছিলাম। সুশীলদার স্ত্রী পাটনার মেয়ে, সেই পরিচয়ে জহর আসত ওই বাড়িতে”। সেইসময় জহরের মন জুড়ে কেবলই চার্লি, গ্রেট ডিক্টেটরের অভিনয় করে দেখিয়েছেন! তারপর দুজনে প্রায় একইসময়ে পদার্পণ করলেন সিনেমায়, ভানু বিভূতি চক্রবর্তীর ‘জাগরণ’-এ, আর জহর ‘পূর্বরাগ’-এ! ‘বসু পরিবার’ ছবিতে দুজনেই পাওনাদারের ভূমিকায় বেশ অনেকখানি জুড়ে, কিন্তু প্রথমে দু’জনের নামই রাখা হয়নি! তারপর বেশ ঝামেলার পর পাবলিসিটি অফিসার বাধ্য হলেন তাঁদের নাম রাখতে! একসময় যাঁদের নাম রাখতে দ্বিধাবোধ করতেন এইসব অফিসাররা, তাঁদের নামেই কিনা পরবর্তীকালে তৈরি হয়ে গেল সিনেমা! রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তাঁরা নাই পেতে পারেন, এই বিরল সম্মানের কাছে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও তো তুচ্ছ! ১৯৫২ থেকে ’৬২ অবধি উল্টোরথ পুরস্কার, যাকে বলা হত ‘বাংলার অস্কার’, টানা এগারো বছর এই পুরস্কার নিজেদের ঝুলিতে রেখেছিলেন এই দু’জন! ভানু দশ বার (‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ছেলে কার’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘দাদাঠাকুর’-এর মত ছবিতে কাজ করে) আর জহর এক বার (‘দুই বেচারা’ ছবির জন্য, ১৯৬০ সালে)। ১৯৬৮-৬৯ সালে যখন প্রোডিউসারদের সাথে টেকনিসিয়ানদের ঝামেলা শুরু হল, তখন ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘শিল্পী সংসদ’। ভানু ছিলেন অভিনেতৃ সঙ্ঘে, জহর শিল্পী সংসদে। বিরোধীপক্ষে থাকা সত্ত্বেও দুজনে নিজেদের বন্ধুত্বে সেই প্রভাব পড়তে দেননি! ভানুকে জহর ডাকতেন ‘ভেনো’ বলে, তেমনি জহরকে ভানু ডাকতেন ‘জহুরে’! এমনই বিশ্বাস ছিল সেই সম্পর্কে যে অনেক নিম্ন-মানসিকতার লোকই দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরাতে গিয়ে অপমানিত হয়েছে। দু’জনেরই কানে যেত কে কী রটিয়ে বেড়াচ্ছে! ভানু তো রেগে গেলে শ্লীল-অশ্লীল, ভদ্র-অভদ্র কোনও জ্ঞান করতেন না, কাঁচা খিস্তি দিয়ে কথা বলতেন আর জহর অবশ্য অতটা নয়, তিনি মিষ্টি কথায় যা বলার বলতেন। সাধে কী আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন – “ভানু-জহরও উত্তম-সুচিত্রার মতই অপরিহার্য ছিলেন!” পারিবারিক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তাঁদের বন্ধুত্ব! ভানুর স্ত্রী নীলিমা দেবীর যেমন মত, জহর রায়ের মতো কমিক অ্যাক্টিং কেউ করতে পারে না, আবার জহরের স্ত্রী কমলা রায় ভক্ত ছিলেন ‘ভানুদা’র! ভানু যখন গাড়ি কিনেছিলেন, তখন যত না ভানুর আনন্দ, তার চেয়ে বেশি আনন্দ জহরের! ভানুকে বলতেন, ও গাড়িতো আমারই! ভানুও যখনই জহর গাড়ি চাইতেন, পাঠিয়ে দিতেন! বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও জহর বেশির ভাগ সময়েই কলকাতা আর পাটনায় কাটানোর ফলে বাঙাল ভাষাটা অতটা বলতে পারতেন না। অনেকেই ঠাট্টা করত এ নিয়ে! জহরের সাফ উত্তর ছিল – “সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে রে। আমি গড়গড়িয়ে বাঙাল ভাষা বলতে পারলে ভানুর ভাত মারা যেত। ওকে আর করে খেতে হতনা”। এমন অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের ব্র্যাকেটটা, ভেঙে গিয়েছিল, হঠাৎই!
(তথ্যসূত্র:
১- বিষণ্ণ সেই জোকার, সোহম দাস, মাস্তুল পত্রিকা, সপ্তম সংখ্যা (২০১৫)।
২- আজও তারা জ্বলে, বর্তমান পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত শ্রী সন্দীপ রায়চৌধুরী লিখিত – জহর রায় বিশেষ সংখ্যা।
হাসি-রাজ ভানু-জহর, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, পাণ্ডুলিপি।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত