‘খুলিলে মনের দ্বার না লাগে কপাট’ – পয়লা উপন্যাস যদি অমরত্ব লাভ করে, তবে পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা অর্জনের কাজটি বেশ খানিকটা সহজ হয়ে যায় সৃষ্টিকর্তার পক্ষে। সেটা সাহিত্য হোক কিংবা চলচ্চিত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস। এ ভাবেই বাজিমাত করেছিল ‘পথের পাঁচালী’ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর দুই প্রজন্ম ধরে বাঙালি পাঠক কেবলই পড়েছে তাঁকে আর তাঁর সৃষ্টিকে। তাঁর দৈনন্দিন রুটিনটাও ছিল ভারী মজার। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। প্রবল গরম হোক বা প্রবল শীত, স্নান করতে যেতেন ইছামতীতে। ফিরে লিখতে বসতেন। প্রথমে দিনলিপি। তার পর চিঠিপত্রের উত্তর। ৭টা নাগাদ প্রাতরাশ। ৯টা নাগাদ স্কুলের পথে যাত্রা। শোনা যায়, গোপালনগর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে যাওয়ার সময় সদ্য-ভাঙা গাছের ডাল বা বাঁশের কঞ্চি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে যেতেন বিভূতিভূষণ। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জলযোগ। ইছামতী অথবা বাওড়ের ধারে শক্তপোক্ত গাছের ডালের উপরে গিয়ে বসতেন। খানিক বাদে আবার পড়ানো। প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আসত তাঁর কাছে। পড়াতেন, গল্প বলতেন। রাতের খাওয়ার পরে কোনও কোনও দিন আড্ডা দিতে বাইরে যেতেন। বাড়ি ফিরতে হয়তো একটা বেজে যেত। আর এই পুরো সময়টাই প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতেন। বিশেষত, বিকেল আর বেশি রাতে। গাছের ডালে বসে আকাশের বদলাতে থাকা রং দেখতেন। গভীর রাতে দেখতেন গভীর কালো আকাশ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘বিভূতিভূষণ আর সমস্ত সার্থক-কর্মা দিব্যদৃষ্টি লেখকের মত এই দুইটি প্রধান বিষয় বা বস্তু নিয়েই যা কিছু বলবার তা ব’লে গিয়েছেন।’’ সেই দু’টি প্রধান বিষয় হল প্রকৃতি আর মানুষ। প্রকৃতির কথা কিছু হল। মানুষ নিয়ে আরও ভয়ের কিছু বাস্তব এঁকেছিলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু এসবের বাইরে ছিলেন এমন এক বিভূতিভূষণ – যিনি সকলের অজানা। যিনি বিশ্বাস করতেন পরলোকচর্চায়, বিশ্বাস করতেন পরজন্মে, বিশ্বাস করতেন আত্মায়, বিশ্বাস করতেন অলৌকিক ঘটনায়।
তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরীর (১৯৯১৭-১৮) অকালমৃত্যুতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের দাম্পত্য জীবনে যতি পড়ে গিয়েছিল। তারপর কুড়ি বছর পার হয়ে গিয়েছিল। বিভূতিভূষণ তখন প্রৌঢ়। সেই সময়ই অন্তত তিরিশ বছরের ছোট, তাঁর সাহিত্য-অনুরাগী রমা চট্টোপাধ্যায় সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব পেড়েছিলেন বিভূতিভূষণের কাছে। ঘটনাটি না শুনলে বোঝা যাবে না, বিয়ের আগে থেকেই রমা কতটা অনুরক্ত ছিলেন তাঁর প্রতি। রমা দেবীর প্রস্তাব শুনে বিভূতিভূষণ গায়ের জামা খুলে বুকের কাঁচাপাকা রোম দেখিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “দ্যাখো, আমার অনেক বয়স হয়েছে, আর ক’দিনই বা বাঁচব?” জবাবে সদ্য যুবতী রমা অবলীলায় বলেছিলেন, “আপনি যদি আর মাত্র একটা বছরও বাঁচেন, তাহলেও আমি আপনাকেই বিয়ে করব।” ১৯৪০, ৩রা ডিসেম্বরে তাঁদের বিয়ে, আর ১৯৫০, ১লা নভেম্বর বিভূতিভূষণের প্রয়াণ। মাত্র দশ বছরের বিবাহিত জীবন ছিল তাঁদের। মাত্র সাতাশ বছরের ভরা যৌবনে শিশুপুত্র নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন রমাদেবী। কিন্তু নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসমবয়সী প্রেমিক-স্বামীর ভালবাসায় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন রমাদেবী। অথচ তাঁর নিজেরও ছিল সাহিত্য-প্রতিভা। ছোট থেকেই লিখতেন। হাতে লেখা পত্রিকা বার করতেন। ‘দেশ’ সাহিত্য পত্রিকার কোনও এক সংখ্যায় একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল রমা চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘স্বপ্ন’ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্ন বাসুদেব’। সারাটা জীবন স্বামীকে ‘আপনি’, অথচ আদর করে নিজের দেওয়া ‘মঙ্কু’ নাম ধরে ডাকতেন। আর বিভূতিভূষণ? ‘কল্যাণী, তুই’। সব জায়গায় স্বামীর কায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে থাকতেন। যুগলে প্রচুর বেড়াতেন দেশ জুড়ে, এবং অবশ্যই জঙ্গলে। স্বামীকে আরাধ্য দেবতা মানতেন। ছাপা হয়ে বেরোনোর আগে ধরে ধরে পড়তেন সাহিত্যিক স্বামীর সমস্ত লেখা। প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন, আলোচনা করতেন। এমনকী সেই মতো তাঁর লেখায় অদল-বদলও করতেন অত বড় সাহিত্যিক। কখনও নিজের সাহিত্য প্রতিভাকে ‘কেরিয়ার’ করেননি। আর তার জন্য আপশোস? তিলমাত্র না।
অথচ নিজের প্রথম স্ত্রী গৌরীকে কোনদিনই ভুলতে পারেননি বিভূতিভূষণ। জানা যায়, তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরীর মৃত্যুর পর শোকে ভেঙে পড়েছিলেন বিভূতিভূষণ। ‘‘গৌরীকে দেখাবেন? আমার গৌরী! একটি বার শুধু দেখা করিয়ে দিন!’’ – বলে আকুতি করতেন দিনের পর দিন! তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কিছু দিন পর তাঁর বোন মণিও মারা গিয়েছিলেন। ব্যারাকপুরের বাড়িতে পর পর দুটি আঘাতে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল বিভূতির। তাঁর কলেজের বন্ধুরা একরকম জোর করে তাঁকে কলকাতা নিয়ে এসেছিলেন। একদিন টালিগঞ্জের দিকে একলা ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দেখা হয়েছিল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। তিনিই বিভূতিকে অশরীরী আত্মার বিচরণ সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্রের কথা বলেছিলেন। তাঁর কাছে বিভূতি অবাক হয়ে শুনতেন, বৃহদারণ্যকে জনকসভায় মহর্ষি আত্মা-তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেই শুরু হয়েছিল। তারপরে সারা জীবন বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করে গিয়েছিলেন আত্মা-চর্চায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, আত্মাকে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়; শুধু ডাকার মতো ডাকতে জানা চাই। মৃত গৌরীকে দেখতে চেয়েই তিনি সেই সন্ন্যাসীর কাছেই শিখেছিলেন ‘মণ্ডল’। অর্থাৎ প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা। কিন্তু পরে সেই সন্ন্যাসীকে আর খুঁজে পাননি বিভূতি। লোকের কাছে শুনেছিলেন তিনি তীর্থভ্রমণে গিয়েছেন। এরপরে তিনি যেখানেই গিয়েছিলেন, আমৃত্যু সেই সাধনা করেছিলেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে ডাকতেন তাঁর প্রিয় গৌরীকে। গৌরীর সাথে কথা বলতেন একা একা গভীর নিশীথে। গৌরীর সাড়া না পেলে কান্নায় প্রিয়তমার শোকে আকুল হতেন। সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আত্মা-আবাহনের কৌশলটি রপ্ত করার পর সেটা নিয়ে কয়েক দিন তুমুল মেতেছিলেন তিনি। বিস্তৃত এই পরলোকচর্চার স্বাদ পেয়ে, নাম লিখিয়েছিলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতেও। এক সময় যার সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তখন তিনিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেতে উঠেছিলেন আত্মার সঙ্গে নিভৃত সংলাপে। সেই সোসাইটির সদস্য হয়ে বিভূতি যেন নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিলেন। জেনেছিলেন ‘চক্রাধিবেশন’। থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে আত্মা ও পরলোক বিষয়ক দেশবিদেশের বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকার নাগাল পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। সেখানকার প্ল্যানচেটের আসরেও যোগ দিয়েছিলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘অন দি সোল’ বইখানাকে তাঁর মনে হয়েছিল মৃত্যু আঁধারে এক জ্যোতিশিখা। ধীরে ধীরে বিভূতিভূষণ জানতে পেরেছিলেন, তাঁর কল্পলোকের দেবতা রবিঠাকুরও প্ল্যানচেট করেছেন। জানতে পেরেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিশিরকুমার ঘোষের প্ল্যানচেটচর্চার খবর। এও জেনেছিলেন, বিদ্যাসাগর যে দিন চলে যান, বৃন্দাবনের আকাশে তাঁর আত্মা দেখেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী! শুনেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দকে কোনও আত্মা এসে তাঁর পিণ্ড দানের অনুরোধ করেছিল! প্ল্যানচেটের উৎসাহের সঙ্গেই আত্মার পরমতত্ত্ব জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন বিভূতিভূষণ। নতুন এক জগতের দরজা খুলে যাচ্ছিল তাঁর সামনে। বিভূতির সেই সময়ের প্রিয় বন্ধু নীরদ সি চৌধুরী পরে লিখেছিলেন, বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার মতিগতি। নীরদ মনে করতেন, বিভূতির পরলোকে বিশ্বাস ঠিক ‘বিশ্বাস’ নয়, কুসংস্কার হয়ে উঠেছিল। নিছক তাই কি? পরলোক নিয়ে এত অগাধ পড়াশোনার পর সেও কি সম্ভব! কেন না, বিভূতি তো ঘোর বাস্তববাদী ছিলেন। কিন্তু তাঁর চর্চা সেখানেই থেমে থাকেনি। জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে যখন পড়াতে গিয়েছিলেন, তাঁকে ঘিরে কয়েকজন ঠিক জুটে গিয়েছিল পরলোকচর্চার জন্য। বিভূতিভূষণের বন্ধু ইস্কুলের অস্থায়ী প্রধানশিক্ষক বৃন্দাবন সিংহরায়ও সেই আসরে যোগ দিতেন। একটা অন্ধকার ঘরে টেবিল পেতে তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসতেন। তাঁদের উপস্থিতিতে বিভূতি এক একদিন ডেকে আনতেন পরলোক থেকে প্রিয়দের। কিন্তু এই প্রেতচর্চাই একদিন কাল হয়েছিল তাঁর। জাঙ্গিপাড়ার হাওয়ায় নানা কথা রটতে শুরু হয়েছিল। গ্রামের একটা শিবিরে এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। তাঁদের আর্জি পৌঁছেছিল শ্রীরামপুরের সাব-ডিভিশনাল অফিসারের কাছে। ব্যাপার খতিয়ে দেখতে এক সরকারি কর্তা এসেছিলেন। বিভূতিভূষণের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর তাঁর বিশ্বাসকে একরকম চ্যালেঞ্জই জানিয়েছিলেন সেই পরিদর্শক – বলেছিলেন প্ল্যানচেটে বসবেন তিনিও, আত্মা আনতে পারবেন কি বিভূতিভূষণ? বিভূতিভূষণের পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ছিলনা। আসর বসেছিল। মিডিয়ামের হাতে নড়ে উঠেছিল পেনসিল। হার মেনেছিলেন পরিদর্শক। কিন্তু স্কুলবাড়িতে মাস্টার প্রেত নামায়, কথাটা অভিভাবকরা ভালভাবে নেননি। স্কুলে ছাত্র কমতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিপদ বুঝে, একপ্রকার বাধ্য হয়ে স্কুল কমিটি বিভূতিকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তবুও বিভূতিভূষণ কখনও সরে আসেননি প্রেতচর্চা থেকে। এরপরে যখন হরিনাভি-রাজপুরে যখন অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইনস্টিটিউশনে পড়াতে গিয়েছিলেন, সেখানেও অল্প বিস্তর জানাজানি হয়েছিল তাঁর পরলোকচর্চার খবর। ক্রমশঃ পরলোক নিয়ে তাঁর বিশ্বাসও ঢুকে পড়েছিল তাঁর লেখা গল্পে, উপন্যাসে। কখনও সখনও তা নিয়ে সচেতন হয়ে তিনি সেগুলো ছেঁটেও ফেলতেন তাঁর মূল লেখা থেকে – সেই আধি-ভৌতিক প্রসঙ্গগুলো। তবু শেষ রক্ষে হয়নি! ওদিকে বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীদেবীর পিতা নিজেই একজন ষোড়শীকান্ত তান্ত্রিক ছিলেন। দীক্ষাও নিয়েছিলেন এক ভৈরবীর কাছে। তাঁকে নিয়েই বিভূতি ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ লিখেছিলেন। জামাইয়ের পরলোক নিয়ে অতি উৎসাহে অবাকই হতেন ষোড়শীকান্ত। জীবনের শেষ পর্বে বিভূতিভূষণ যখন ব্যারাকপুরে ছিলেন তখন সেখানে দেখাও পেয়েছিলেন এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছেন জেনে, বিভূতিও তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত বাড়িয়েছিলেন। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! বিভূতিভূষণ রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস। মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে। মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা? শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে? কী ভাবে উড়ে যায়? ফিরে আসে কি? সব প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে তাঁর লেখায়। তাঁর জীবনীকার কিশলয় ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘‘যে সময় ‘দেবযান’ প্রকাশ হচ্ছে, তার বহু আগে থেকেই বনগাঁর বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। তিনিও পুত্রশোকে কাতর ছিলেন। দুঃখ ভুলতে প্ল্যানচেটে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। বীরেশ্বরবাবুর সংগ্রহে ছিল পরলোকচর্চার নানা বই। সে সব বইতে বিভূতি ডুবে থাকতেন। পাতায় পাতায় নিজের নোটও লিখে রাখতেন।’’ বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার বিষয়টি সে সময় লেখকদের অনেকেই খবর রাখতেন। বিভূতির জীবনকথা জানাচ্ছে, প্রমথনাথ বিশীর ছোট ভাই মারা গেলে, শোক-সন্তপ্ত গোটা পরিবার বিভূতির কাছে এসেছিলেন। বিভূতি শ্লেটে দাগ টেনে মৃত ব্যক্তির আত্মার গতিপথ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের এও বুঝিয়েছিলেন, আত্মার জন্য শোক করতে নেই! তাতে আত্মার দহন বাড়ে! এরপরে তাঁর জীবনের দিন দিন যত ফুরিয়ে এসেছিল, পরলোকে বিশ্বাস যেন তত বেড়েছিল তাঁর।
‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযানে’র লেখক পরলোক এবং জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তাঁর হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিলনা। প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’’
স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।” এই ‘টুকরা রহস্য’ বলতে যে ঘটনা, তা ঠিক প্ল্যানচেটের ব্যাপার না হলেও এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যায়। সজনীকান্তের মেজদার মৃত্যুর আগে তাঁর বাবা রুগ্ন পুত্রের শিয়রে জেগে ছিলেন। শেষ প্রহরে দেখলেন একটা অস্বাভাবিক লাল আলোয় ঘর ভরে গেল আর মুমূর্ষু পুত্র উঠে বসে কাকে যেন বলল – এই যে আমি যাচ্ছি। এই ধরণের অভিজ্ঞতা সজনীকান্তের বাবার জীবনে প্রথম নয়। তিনি বুঝলেন তাঁর অজু চলে যাচ্ছে। এবং তাই হল। কিন্তু তার পরদিন দুপুরে যা ঘটল, সজনীকান্তের বিবরণে – “হঠাৎ বাবা কী দেখিয়া মাকে ডাকিলেন – আমরাও তাকাইলাম, আমরা সকলেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া দেখিলাম, মেঝের ঠিক মাঝখানে রক্ষিত একটি চেয়ারে একটা লাল আলোয়ান গায়ে জীর্ণ শীর্ণ মেজদাদা আসিয়া বসিয়াছেন। মা – ‘বাবা আমার’ বলিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন, পরক্ষণেই দেখি সে অন্তর্ধান হইয়াছে।”
প্ল্যানচেট ছাড়া আরো অনেক ঘটনায় বিভূতিভূষণ পরলোকের ছায়া দেখেছিলেন। তাঁর জীবনের একেবারে শেষবেলায় তাঁর পুত্র তারাদাস অসুস্থ হয়ে পড়লে, একদিন স্নান সেরে ফিরে তিনি নাকি দেখেছিলেন, ছেলের মাথার কাছে বসে রয়েছে কেউ। বিভূতি সঙ্গে সঙ্গে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তারাদাসকে। সেই ছায়াকে নাকি বলেছিলেন, ‘‘ওকে দেব না।’’ সেই বিদেহী আগন্তুক তখন নাকি বলে উঠেছিলেন, ‘‘তোমার ছেলের আয়ু নেই। ওকে যেতে দাও আমার সঙ্গে।’’ বিভূতি সন্তানকে আঁকড়ে বলেছিলেন, ‘‘আমার আয়ু দিচ্ছি। তুমি চলে যাও।’’ এরপরে বিভূতি শেষবারের জন্য যখন ঘাটশিলা গিয়েছিলেন, সেখানে এক সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিতও যেন দিয়েছিলেন! তিনি মনে করতেন, মানুষের সংবর্ধনা মানেই সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার আগেই ‘শেষ লেখা’ গল্পে সেই ‘দেবযান’-এর সুর পাওয়া যায়। তাঁর পরলোকে বিশ্বাসের শিকড় ক্রমশঃ এত গভীরে গাঁথা পড়েছিল যে, তিনি সর্বক্ষণ মরণের কথা ভাবতেন তাঁর জীবনের শেষের দিনগুলোয়। বিভূতিভূষণের ভাই নুটুর স্ত্রী যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপল ব্যথিত গতি’-তে বিভূতির শেষ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনার কথা মেলে। যমুনা লিখেছিলেন, ঘাটশিলায় মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ফুলডুংরি ঘুরতে গিয়েছিলেন বিভূতি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অনেকেই। দল থেকে আলাদা হয়ে একটি জায়গায় নাকি বিভূতি দেখেছিলেন ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে, খান কয়েক পাথর সাজানো, একটি শববাহী খাট ওল্টানো, আর একটি খাটিয়ায় মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া। বনের মধ্যে, বিভূতিভূষণ গিয়ে টান মেরে মৃতদেহের ঢাকা সরিয়ে ফেলেছিলেন! আর তার পরেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটা আর্ত চিৎকার! কারণ তিনি অন্য কারও প্রাণহীন দেহ দেখেননি, দেখেছিলেন মৃতদেহের ধড়ের উপর যে মুখটি, সেটি অবিকল তাঁর মতন দেখতে!
তবে প্ল্যানচেটকে তার প্রাপ্য গুরুত্বের বেশি দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর শাশুড়ির মৃত্যুর পর প্ল্যানচেট শুরু করেন। সেই সময় এক চিঠিতে বিভূতিভূষণ তাঁকে লেখেন – “প্রেতলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করবার কিছু নেই। পৃথিবীর ঊর্ধ্বে বহু স্তর বিদ্যমান, বিশ্বে বহু লোক, বহু স্তর, বহু গ্রহ, মৃত্যুর পর যেখানে জীবনে গতি হয়। এই সব ‘সুপারমানডেইন ওয়ার্ল্ডসে’ আছে এবং ঋষিরা প্রাচীন যুগে তাঁদের অস্তিত্ব জেনেছিলেন। বৃহদারণ্যক ও ঈশোপনিষদে এদের কথা আছে। এগুলির আকর্ষণ অতি তীব্র – পৃথিবীর জীবনের পরে যখন এই সব লোকে গতি হয় তখন পৃথিবীর আনন্দ এদের আনন্দের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয় বটে, কিন্তু সেই আসক্তি বা কামনাই পুনর্জন্মের বীজ বপন করে। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে এই সব বিভিন্ন লোকালোকের আসক্তি ও মায়া কাটিয়ে সর্বলোকাতীত বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা। ভগবানকে পাওয়া এরই নাম। ধর্মজীবনের আরম্ভ তখনই হবে যখন আমাদের মন নিরাসক্ত হবে জাগতিক রসাকাঙ্ক্ষায়। তাঁকে জানলেই সব জানা হল। নতুবা প্রেতলোকের আবিষ্কারের আর নতুন একটা দ্বীপ আবিষ্কারের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। দুটোর কোনটাই আধ্যাত্মিক ঘটনা নয়।”
বিভূতিভূষণ, প্রকৃতপক্ষে, এই আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানী ছিলেন।
তবে বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চা নিয়ে সবচেয়ে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় রসরাজ ‘শিবরাম চক্রবর্তী’র লেখা থেকে। বরাবরের মতন সেবারও বেজায় টাকার টানটানি চলছিল শিবরামের। শেষে কাবুলিওলার থেকে ধার করবেন কি না ভাবছিলেন। খবর পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। তখনও দুইজনের মধ্যে তেমন ভাল পরিচয়ও ছিলনা। তবু বিভূতি নিজেই সেধে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘কেন ভাই কাবুলির থেকে ধার করবেন? কত টাকা চাই আপনার?’’ শিবরাম অম্লানবদনে বলেছিলেন, ‘‘এই ধরুন টাকা পঞ্চাশেক পেলেই আপাতত চলে যাবে।’’ ‘‘এই নিন টাকা, ওসব কাবুলির থেকে নিতে হবে না। ওদের বড্ড চড়া সুদ,’’ বলে বিভূতিভূষণ পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে দিয়ে শিবরামকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সলজ্জ শিবরাম তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার এই ঋণ আমি জীবনে শুধতে পারব না।’’ এবং যথারীতি শুধতে পারেনওনি। মানে কখনও ইচ্ছে থাকলেও উপায় আর উপায় থাকলেও ইচ্ছে হয়নি আর কি! দু’জনে দেখা হলে বিভূতিভূষণ তাঁর প্রাপ্য টাকার কথা তো কখনই তুলতেন না। শিবরাম যদিও বা কখনও বলতেন, ‘‘দাদা আপনার ওই টাকাটা এখনও বাকি …।’’ বিভূতি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলে উঠতেন, ‘‘আরে থাক থাক সেসব কথা। পরে দেবেন।’’ ‘‘বেশ তাহলে সুদটাই নিন।’’ বলে শিবরাম টাকার বদলে দু’চার পয়সার তেলে ভাজা কিংবা চিনেবাদাম তুলে দিতেন বিভূতিভূষণের হাতে। বিভূতি তাতেই খুশি হতেন। আসলে টাকা পয়সার ব্যাপারে চিরকালই বিভূতিভূষণ ছিলেন বেজায় উদাসীন। খানিকটা শিবরাম গোছের, আবার খানিকটা একেবারেই অন্য ধারার। টাকা হাতে পাওয়ার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ যথেষ্ট ছিল, কিন্তু সে-টাকা একবার হাতে এসে গেলে সেগুলো যে খরচও করতে হয় কিংবা সঠিকভাবে জমানো, তার ব্যাপারে কোনই আগ্রহ ছিল না বিভূতিভূষণের। আর এখানেই শিবরামের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত অমিল।
শিবরাম জানতেন আধ্যাত্মিকতা, পরলোকচর্চায় খুবই আগ্রহ ছিল বিভূতিভুষণের। ‘দেবযান’ উপন্যাস নিয়েও তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল শিবরামের। শিবরাম এটাও জানতেন যে পুনর্জন্মে খুব বিশ্বাস করেন বিভূতি। একদিন তিনি শিবরামকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো আর বিয়েথা করলে না। তোমার ছেলে মেয়ে নেই। আর সেই জন্যই তোমার পূর্বপুরুষরাও পূনর্জন্ম নিতে পারছেন না। আর তাঁদের পূনর্জন্ম না হলে তোমারও নতুন জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেই। সবাই পর পর লাইনে আছেন কিনা। তাই তুমি বে থা না করে নিজে তো বটেই, তোমার আগের সাতপুরুষও বায়ূভূত হয়ে ঘুরবে। আমি বিয়ে করব এবার। ফিরতি বার্থ রিজার্ভেশন করে রাখা চাই বুঝলে ভায়া।’’ শিবরাম একটু অবাক হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘সে কি দাদা আপনি এই বয়েসে বিয়ে!’’ বিভূতিভূষণের উত্তর ছিল, ‘‘কেন সামান্য চল্লিশ বছর তো বয়স আমার।’’ শিবরাম কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন তখন বিভূতিভূষণের বয়স চল্লিশের অনেক বেশি।
শেষে একদিন দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন বিভূতিভুষণ। তারপর অনেক দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিলনা শিবরামের। একবার দুর্গাপুজোর সময় শিবরাম গিয়েছিলেন বিভূতিভুষণের ঘাটশিলার বাড়ি। পুজোর ছুটি ওখানেই কাটাবেন এমন ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেখানে গিয়ে দেখেছিলেন বেশ স্বাস্থ্যবান একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বিভূতিভুষণ বাগানে ঘুরছেন। শিবরাম বুঝেছিলেন, শিশুটি বিভূতিরই। সহাস্যে বিভূতিকে জিজ্ঞসা করেছিলেন, ‘‘তা আপনার ঘাড়ে কি সেই ফেরবার টিকিট?’’ বিভূতি বলেছিলেন, ‘‘একদম ঠিক ধরেছ। ওর নাম দিয়েছি কাজল। ওর মাধ্যমেই তো আবার আমাকে ফিরতে হবে।’’
বিভূতিভুষণের সেই পারলৌকিক বিশ্বাস যে কতটা তীব্র ছিল, বারেবারে টের পেয়েছিলেন শিবরাম নিজে। এমনকি বিভূতির মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক শ্মশানে নিজের মৃতদেহকে নাকি নিজের চোখে দেখতে পাওয়ার ঘটনাটাও জানতেন শিবরাম। আর বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পর? সে এক অদ্ভুত ব্যাপার!
একদিন রিপন কলেজের বেশ কিছু ছেলে এসে শিবরামকে জানিয়েছিল, ‘‘আমরা এই বছর বিভূতিভূষণের জন্মদিন পালন করব, আপনাকে সভাপতি হতে হবে।’’ শিবরাম বলেছিলেন, ‘‘বেশ হব। কিন্তু অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা থাকবে তো? মানে একটু ভাল মন্দ।’’ ছাত্রদের একজন জানিয়েছিলেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। স্বয়ং বিভূতিবাবুও আসবেন ওইদিন।’’ সেটা শুনে অবাক হয়ে শিবরাম বলেছিলেন, ‘‘মানে? উনি আবার কী করে আসবেন? উনি তো পরপারে।’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘আজ্ঞে উনি আমাদের ত্রিকোণ চক্রে মাঝেমাঝেই আসেন। আমরা প্ল্যানচেট করে ডেকে আনি তাঁকে। কথাবার্তাও হয়।’’ চোখ কপালে তুলে শিবরাম তাঁদের শুধিয়েছিলেন, ‘‘বলো কি! তা জীবিত আর কাকে কাকে ডাকছ ওইদিন?’’ ছেলেরা বলেছিল, ‘‘ভেবেছিলাম অনেককেই ডাকব, কিন্তু শেষ প্ল্যানচেটে বিভূতিবাবুই বললেন যাকেই ডাকো, কেউই আসবেন না।’’ শিবরাম বলেছিলেন, ‘‘তার মানে পরলোকে গিয়ে উনি তাঁর লেখকবন্ধুদের ভালমতই চিনেছেন। বেশ বেশ।’’ ছাত্ররা জানিয়েছিলেন, ‘‘সেইজন্যই আমরা আপনার কাছে এলাম। আপনি অন্তত যাবেন আশা করি।’’ শিবরাম সম্মতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ যাব বইকী। খাবার দাবারের ব্যবস্থা রাখবে বলছ যখন!’’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওইদিন সেখানে গিয়েও যাননি শিবরাম। বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ফিরে এসেছিলেন। এই বিষয়ে শিবরামের যুক্তি ছিল, ‘‘বিভূতিবাবু যখন ভেবেই নিয়েছেন তাঁর জন্মদিনে কোনও বন্ধু আসবেন না, তখন তাঁর সেই বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয়। আর দ্বিতীয়ত সেই যে পঞ্চাশ টাকা ধার রয়ে গিয়েছিল সেটা এখন যদি তার অনুগত ভক্তদের মধ্যে বলে ফেলেন, সে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে।’’ তাই বিদেহী বিভূতিবাবুর সঙ্গে দেখা করার চেয়ে স্বদেহে ফিরে আসাটাই ঢের ভাল বলে মনে করেছিলেন শিবরাম!
(তথ্যসূত্র:
১- আমাদের বিভূতিভূষণ, রমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমী পালিত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (১৯৯৭)।
২- আমার শিক্ষক বিভূতিভূষণ, আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১০)।
৩- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্ধানে: রুশতী সেন (সম্পাদিত)।
৪- বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি: সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত)।
৫- অনন্তের লুকোচুরি, সুভাষ ঘোষাল।
৬- প্ল্যানচেটে পরলোকের কথা, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত