একবার কোন একটা উৎসব উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। দুটি অপরিচিত ছেলেমেয়ে এসে তাঁকে বলেছিল, লীলা মজুমদার একবার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। শুনে তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন। লীলা মজুমদার কেন ডাকবেন তাঁকে? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তখন তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। সত্যজিৎ রায়ের চিঠি নিয়ে মাঝে মধ্যে সে পত্রিকায় দু’একবার লিখেছেন- কোন লেখায় কি কিছু ভুল হয়েছে? শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে একটা চেয়ারে লীলা মজুমদার বসেছিলেন। তাঁর লেখায় যত মজা ও রঙ্গরস থাকত মুখের ভাবে কিন্তু তার কিছুই দেখতে পাননি সুনীল। বরং একটু কঠোর ভাব, ভ্রু কোঁচকানো মুখ তাঁর নজরে পড়েছিল। সুনীল তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘শোন, তুমি গল্প উপন্যাস কবিতা লেখোটেখো, তা আমি কিছুই পড়িনি। তবে তুমি ছোটদের জন্য কিছু লেখালেখি করছে দেখে খুশী হয়েছি। সব লেখকদেরই শিশু সাহিত্যের সেবার জন্য খানিকটা সময় দেওয়া উচিৎ। আর শোন, এইসব লেখার মধ্যে যেন খুনোখুনি, রক্তারক্তি বেশী এনোনা।’’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন তাঁর নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা করেছিলেন।
কবি শক্তিদা চট্টোপাধ্যায় একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘‘তা’ও রক্ষে, সুনীল মোটে একবেলা লেখে, দু’বেলা লিখলে সে যে কী দাঁড়াত!’’ আর কখনও কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে কথাটা বললে সুনীল তাঁর ট্রেডমার্ক মার্কা হাসিটা হাসতেন হুঁ হুঁ করে। এক-একবার মৃদু প্রতিবাদও করতেন, বলতেন – ‘‘তা হলে মদটা খাওয়া হত কখন?’’ দিনে একবেলা করে লিখে এবং বেড়ানোর দিনগুলোয় কোনও বেলা না লিখেও সুনীল যে সম্ভার রেখে গেছেন, তা শুনি আয়তনে ছাপিয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র রচনাবলীকেও। শেষ দিকে এ নিয়ে কেউ কিছু বললে একটু হাসি-হাসি লজ্জা-লজ্জা ভাব আসত তাঁর মুখে।
‘‘দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়েছে এক জনের। তাঁর নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়!’’ – ১৯৫০ সালে এক কিশোরী কথাগুলো বলেছিলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সেই কিশোরী জানতেন না তাঁর সামনে দাঁড়ানো ষোলো বছরের ছেলেটিই সুনীল। আর সেই কবিতা, ‘একটি চিঠি’ লেখা হয়েছিল সেই কিশোরীর কথা ভেবেই। তিনি জানতে পারেনি। পরে ‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে মেতে ওঠার পর্বে তাঁর সঙ্গে সুনীলের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা আর দ্বিতীয় কবিতার মধ্যে তিন বছরের ব্যবধান। লেখা বন্ধ ছিল না, কিন্তু ছাপতে দেননি কিছু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনে ওই তিনটে বছরই নীরবতার বছর। ওই প্রথম, ওই শেষ। ১৯৫৩ সালেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ কবিতা বেরিয়েছিল। চতুর্থটি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল আর অচিরেই আবু সয়ীদ আইয়ুবের সম্পাদনায় ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে নির্বাচিত হয়েছিল। ওই বছরই ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম ছোট গল্প, ‘বাঘ’। এবং আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘কৃত্তিবাস’। যার সম্পাদক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে ছিলেন দীপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচী। নিজেকে যে কত ভাবে ছড়িয়ে দেবেন সুনীল, ওই ঊনিশ বছর বয়স থেকেই তার দিকচিহ্নটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
ঊনিশ থেকে আটাত্তর – এর মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুধু বইয়ের সংখ্যাই আড়াইশোর বেশি। সম্পাদিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য এতগুলি শাখায় সাবলীল বিচরণের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারটি তাঁর জন্যই তোলা ছিল। যৌবনে ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’ বলে তকমা জুটেছিল যদিও। সুনীল কিন্তু পরে বলেছিলেন, তাঁর বিদ্রোহ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না। ছিল, ‘রাবীন্দ্রিকতা’র নামে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে।
আরও দু’টি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালি ‘মধ্যবিত্তসুলভ কূপমণ্ডূকতা’ তাঁর স্বভাবে কোনও দিন ছিল না। সুনীল মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। আর, সুনীল মানেই দরজা-জানলা খোলা একটা তরতাজা মন। অজস্র বিষয়ে আগ্রহ, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সদা সচেতন। স্পষ্টবাক, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত তা সে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়েই হোক বা রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া নিয়েই হোক। ‘নীরা কে’, এই প্রশ্নটি ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে কোনও প্রশ্নকর্তাকে কখনও নিরাশ করেননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে শান্তিনিকেতন, সবেতেই ছিল সুনীলের পরম উৎসাহ। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনও দুরাকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। কলেজজীবনে সুনীলের স্বপ্ন বলতে ছিল একটাই, জাহাজের খালাসি হয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। খালাসির চাকরি সুনীলকে করতে হয়নি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য ‘নীললোহিত’কে পেয়েছে। বাঙালির অভিধানে দিকশূন্যপুর শব্দটা চিরকালের মতো ঢুকে গিয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। সাবেক পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় মাইজপাড়া গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। বাবা ‘কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়’ ছিলেন কলকাতার টাউন স্কুলের শিক্ষক। সেই সূত্রে ১৯৩৮ সাল থেকেই উত্তর কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলেন সুনীল। চার ভাইবোনের মধ্যে সুনীলই ছিলেন বড়। সংসারে অনটন ছিলই। সেটা আরও বেড়েছিল দেশভাগের পর। বিশাল পরিবারে কালীপদর রোজগারই ভরসা ছিল তখন। তিনি উপার্জনের চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকতেন। ফলে বাবার সঙ্গে সুনীলের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সুনীলকে বই পড়ার নেশাটি তাঁর ধরিয়েছিলেন মা, ‘মীরা দেবী’।
তবে তাঁর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কিন্তু অনুঘটকের ভূমিকাটা বাবারই ছিল। সুনীল তখন টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক দিয়েছিলেন। ছুটির ক’মাসে ছেলে যাতে বখে না যায়, সেজন্য বাবা হুকুম দিয়েছিলেন সময়টা ইংরেজি চর্চার কাজে লাগাতে হবে। টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করে দেখাতে হবে। কিছু দিন সেটাই চলেছিল। সুনীল লক্ষ করেছিলেন, পরে তাঁর বাবা আর অনুবাদ আক্ষরিক কি না, মিলিয়ে দেখছেন না। সুতরাং নিজের ঈশ্বরীকে উদ্দেশ করে নিজেই লিখতে শুরু করেছিলেন কিছু লাইন আর সেগুলোই দেখতে দিতেন বাবাকে। এই ভাবেই তাঁর কবিতায় হাত মকসো করা শুরু হয়েছিল। সুনীল পরে লিখেছিলেন, “আমার সৌভাগ্য এই, আমার প্রথম বয়েস থেকেই আমি কোনও সাহিত্যিক গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়িনি। আমি পূর্ববঙ্গের গণ্ডগ্রাম থেকে আগত কিশোর, কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কোনও লেখককে চোখে দেখিনি, কোনও সম্পাদককে চিনতাম না …।” ডাকযোগে লেখা পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় তাঁর জানা ছিল না।
সিটি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র সুনীলের তখন বন্ধু ছিলেন দীপক মজুমদার। কফি হাউস, দেশবন্ধু পার্কে আড্ডা জমে উঠত। ওদিকে কমলকুমার মজুমদারের নেতৃত্বে হরবোলা ক্লাবে নাট্যচর্চাও চলছিল। তারই মধ্যে সিগনেট প্রেস তথা দিলীপকুমার গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল তাঁর। ডি কে-র পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়েই ‘কৃত্তিবাসে’র পথ চলা শুরু (শ্রাবণ, ১৩৬০ বঙ্গাব্দ) হয়েছিল। কলকাতার রাজনৈতিক আবহ তখন উত্তাল। প্রথম সম্পাদকীয়তে সুনীল লিখেছিলেন, ‘‘বিভিন্ন তরুণদের বিক্ষিপ্ত কাব্য-প্রচেষ্টাকে সংহত করলে বাংলা কবিতায় প্রাণছন্দের উত্তাপ নতুন আবেগে এবং বলিষ্ঠতায় লাগতে পারে এবং সকলের মধ্যে প্রত্যেকের কণ্ঠস্বরকেই আলাদা করে চেনা যেতে পারে।”
সম্পাদকের স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। এক মলাটে সুনীলদের সঙ্গে লিখতে শুরু করেছিলেন সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরা। পত্রিকার সপ্তম ও অষ্টম সংখ্যা উপহার দিয়েছিল আরও কয়েকটি নাম – শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় …। দ্বাদশ সংখ্যায় এসেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এই তরুণ ব্রিগেড শুধু মধ্যরাতের কলকাতাই শাসন করেননি, বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে গিয়েছিল এঁদেরই লেখনীতেই। সুনীল-শক্তির এক একটা পংক্তি বাঙালির কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েক জন’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৮ সালে। ১৯৬২ সালে কলকাতায় এসেছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। সুনীলের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল তাঁর। পরের বছরই আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন সুনীল। নিউ ইয়র্কে সালভাদর দালির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল তখনই। দেশে ফেরার পথে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বিলেত গিয়ে স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুনীলের। ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তারপর একা একাই সুইৎজারল্যান্ড, রোম, কায়রো হয়ে দমদম বিমানবন্দরে যখন পদার্পণ করেছিলেন সুনীল, তখন দেখেছিলেন তাঁর পকেটে দশ টাকা পড়ে আছে; এবং তিনি বেকার!
বেশ কয়েক বারই ছোটখাটো চাকরি করেছিলেন, আবার ছেড়েওছিলেন সুনীল। ’৭০ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। তার পরে দেশ-আনন্দবাজার মিলিয়ে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব সামলেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে চাসনালা খনি দুর্ঘটনা, ইন্দিরা গাঁধী হত্যা, বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো ঘটনা কভারও করেছিলেন। দু’-দু’বার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। চুনী গোস্বামী যেমন মোহনবাগানের, সুনীল তেমনই আনন্দবাজার সংস্থার ঘরের মানুষ। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’-এ, প্রথম উপন্যাসও তাই। ‘আত্মপ্রকাশ’ বেরিয়েছিল ১৯৬৬ সালে। তার পর একে একে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘অর্জুন’, ‘জীবন যে রকম’, ‘যুবক-যুবতীরা’ …। তাঁর হাতে সন্তু-কাকাবাবু সিরিজ শুরু হয়ে গিয়েছিল একাত্তরে, প্রথম গল্প ছিল ‘ভয়ংকর সুন্দর’। আশির দশকে তিনি হাত দিয়েছিলেন বৃহৎ উপন্যাসে। জন্ম নিয়েছিল ‘সেই সময়’। ক্রমান্বয়ে তাঁর কলম থেকে জন্ম নিয়েছে ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’ …।
কী পদ্য, কী গদ্য ঝরঝরে সুখপাঠ্য ভাষা, ঘরোয়া কথনভঙ্গি আর অব্যর্থ জনপ্রিয়তা, সুনীলের অভিজ্ঞান চিনে নেওয়া যায় সহজেই। দেশি-বিদেশি অজস্র ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর লেখা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকরা সুনীলের কাহিনি অবলম্বনে ছবি করেছেন। তাঁর গল্প থেকে একাধিক টেলি-ধারাবাহিক হয়েছে। সুনীলের নিজের চিত্রনাট্যে তৈরি ছবি ‘শোধ’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। ‘সিটি অফ জয়’ ছবির মুখ্য পরামর্শদাতাও ছিলেন সুনীলই। ভালবাসতেন কবিতা পড়তে, গান গাইতে। এমনকি মঞ্চেও অভিনয় করেছিলেন। কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন এক বার। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপকও ছিলেন। একেবারে শেষ জীবনে সাহিত্য অকাদেমির সভাপতির দায়িত্ব সামলেছিলেন।
তাঁর মতো মজলিসি মানুষ কম দেখা যেত। তিনি অকাতরে লিখতেন। বেশি লেখা ভাল কি না, এ নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না। নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিতেও চাইতেন না। প্রিয় বই কী, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘মহাভারত’। সেই মহাভারত লেখাতেই হাত দিয়েছিলেন। শেষ হয়নি। সুনীলও কথা রাখেননি। জীবনটা অর্ধেকই রয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের ২৩শে অক্টোবর তাঁর লেখা থেমে গিয়েছিল।
অনেক তরুণ লেখক-কবিকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। অনেক লেখক-কবিই তাঁর দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, অবজ্ঞাত হয়ে তাঁর প্রতি বিরূপও হয়েছিলেন। এহেন বিবিধ কারণে শেষজীবনে তাঁর মতো উদার এবং ভাল মানুষেরও খ্যাতির অপচয় ঘটে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মরে যাওয়ার আগে আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা। এই হানাহানি, রক্তপাত, কুৎসিত ধ্বংসলীলা বন্ধ হোক।” তাঁর বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধ শিবিরের যে, তিনি সারাজীবন তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাকে হিসেব কষে, মেপেজোপে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। না বলে উপায় নেই যে, এ হল হেরোদের যুক্তি। ক্লাসের ফার্স্টবয়কে কেউ বেশি পড়াশুনো ও বেশি বুদ্ধিমত্তার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে না। লিওনেল মেসিকে বেশি গোল বা সচিন তেন্ডুলকরকে বেশি রান করার জন্যও না। আফশোসটা হওয়ার কথা সুনীলের অনুরাগীদের। তাঁর কি একটা পদ্মভূষণ অন্তত প্রাপ্য ছিল না? কিংবা একটা জ্ঞানপীঠ? একদা এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন – “কী মনে হয় জানো, মানিকবাবুর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে সব লেখা বন্ধ করে দেব।’’ না! তিনি ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো কিছু লেখেননি। পদ্মভূষণ বা জ্ঞানপীঠও পাননি। এই সব খেতাব, পুরস্কার, পদে কী এসেছিল-গিয়েছিল সুনীলের মতো লেখকের? যাঁকে রবিশঙ্করেরর মতো মানুষ ‘সেই সময়’ পড়ে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘অভিভূত! আপনার গালে চুমো দিতে ইচ্ছে করছে,” তাঁর আবার কী সংশাপত্র চাই কোনও সংসদ বা সমিতির?
(তথ্যসূত্র:
১- সুনীল স্মরণে, হাসান হাফিজ, মাটিগন্ধা।
২- কথায় কথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উজ্জ্বল কুমার দাস, প্রিটোনিয়া পাবলিশার্স।
৩- মুহূর্তকথা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত