‘‘আমার মনে হচ্ছে শিল্পী হিসেবে আমি মরে যাচ্ছি, মাথার উপরে দু’হাত পরিমাণ জল, নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, বেরুতে চাইছি বদ্ধ জায়গা থেকে, কিন্তু কাউকে তা বলতে পারছি না …।’’ এমনই একটা বদ্ধ অবস্থা থেকে ‘পলাতক’ হয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন অনুপকুমার। সেটা হয়েছিল তরুণ মজুমদারের হাতে। নিজের আত্মজীবনীতে, অনুপকুমার লিখেছিলেন – ‘‘আমি কাজ শেষ করে ওর ঘরে বসে বলতে শুরু করলাম যে দ্যাখো, আমার প্রবলেম হয়েছে যে আমি অনুপকুমার হয়ে গেছি। কারো কাছে গিয়ে আমি আজ কাজ চাইতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি মারা যাচ্ছি। আমার মনে হয়েছে তোমাকে বলা যায় তাই বলছি তুমি আমাকে এর থেকে বাঁচাতে পারো। আমার এই স্ট্যাম্পটা মুছে দাও। ছোট রোল হোক, তবু যে কোনও একটা রোল দাও যেখানে ওই হাসানোর কোনো দায়িত্ব থাকবে না।’’ ছোট রোল নয়, রীতিমতো নায়ক। তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’ ছবিতে। কিন্তু কলকাতার প্রযোজকেরা বেঁকে বসেছিলেন। অনুপকুমার নায়ক! ছবি চলবে না। শেষে শান্তারাম সাহস করে এগিয়ে আসেন। সেই ছবিতেই, অনুপকুমারের নিজেরই কথায় – ‘‘আমার একটা উত্তরণ হয়, একজন নতুন অনুপকুমার তৈরি হয়।’’ সেটা ১৯৬৩ সাল।
চলচ্চিত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি ছিলেন মূলতঃ ‘থিয়েটারকর্মী’। ‘নাট্যাভিনয়’ ছিল তাঁর জন্মগত প্রতিভা। এই নাট্যাভিনয়ই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শিখরে। কতটা জনপ্রিয় ছিলেন অনুপ কুমার, তার উদাহরণ পাওয়া যায় ‘তালদি’র ঘটনাটির মাধ্যমে। একবার অনুপ কুমারের অভিনয় দেখার জন্য ‘তালদি’তে ৫০ – ৬০ হাজার দর্শক সমাগম হয়েছিল। ভিড়ের ঠ্যালায় ব্যারিকেড খুলে দিতে হয়। অনুপ কুমার মঞ্চে উঠতেই দর্শক মহলে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা দেয়। ভিড়ের চাপে হুড়মুড়িয়ে মঞ্চ ভেঙে যায়। পুলিশ ও উদ্যোক্তারা অনুপ কুমারকে কোনও রকমে সেখান থেকে উদ্ধার করে জমির আল পথ দিয়ে একটা বাড়িতে নিয়ে যান। অনুপ কুমারের নাটক মঞ্চস্থ হবেনা শুনে মঞ্চে আগুন লাগিয়ে দেন দর্শকেরা। ভাঙা মঞ্চে আগুন লাগিয়ে দিযেছিলেন দর্শকেরা।
এছাড়াও তাঁর অন্য একটি চেহারা ছিল, যেটার কথা খুব কম মানুষ জানেন।
‘জ্বালা’ নাটকের রিহার্সাল করার জন্য ঘর পাচ্ছিলেন না ‘ঋত্বিক ঘটক’, অনুপ কুমার শ্যামবাজারে কাঠ মিস্ত্রীদের একটা বড়ো দোকান ঘর ঠিক করে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় অনুপ কুমার পাশের দোকান থেকে একটা ঝাঁটা চেয়ে নিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেছিলেন সেই ঘর। প্রতিষ্ঠিত তারকা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাটকের স্বার্থে নির্দ্বিধায় এ’কাজ করেছিলেন।
‘বিভাস চক্রবর্তী’ যখন থিয়েটার ওয়ার্কশপ ছেড়ে দিয়ে নতুন নাটকের রিহার্সাল করার জন্য কিছুতেই ঘর পাচ্ছিলেন না, তখন অনুপ কুমার নিজের তৈরি ‘শিল্পায়ন’ নাট্যদলের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিভাস চক্রবর্তী, তাঁর ‘অনুপ’দার সেই উপকারের কোনদিন ভোলেন নি।
‘গীতা দে’র কন্যার হঠাৎ অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা নেই। অনুপ কুমার টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
‘শমিত ভঞ্জ’র বড় মেয়ের অন্নপ্রাশন, দেশের বাড়ি থেকে যিনি টাকা নিয়ে আসছিলেন তাঁর টাকা পকেটমার হয়ে যায়। এদিকে প্যান্ডেল, খাওয়া দাওয়া, সব আয়োজন করা হয়েছে কিন্তু টাকার কি উপায় হবে? অনুপ কুমার শমিতকে সাত হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
‘তুমি যে আমার’ নাটকের প্রডিউসার চুক্তিমত টাকা না দেওয়ায় অনুপ আর্টিস্ট পেমেন্ট করতে পারছিলেন না। শেষে অনুপ নিজের একটা জমি বিক্রি করে ‘রবি ঘোষ’, ‘সন্তোষ দত্ত’, ‘মাধবী মুখার্জী’র মতো শিল্পীদের টাকা শোধ করেছিলেন।
‘অজিত গাঙ্গুলি’ তাঁর একটা ছবিতে মান্না দে কে দিয়ে গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। সেদিন পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারেননি অজিতবাবু। অনুপ কুমার নিজের গাঁট থেকে সেই টাকা দিয়েছিলেন।
এমনই মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এক পরপোকারী মানুষ ছিলেন অনুপ কুমার।
বাংলা মঞ্চ এবং চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অভিনেতা অনুপ কুমার। ১৯৩৫ সালে ‘ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি’ পরিচালিত ‘হালবাংলা’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৮ সালে। তারপর ১৯৪৬ সাল থেকে বিরামহীন ভাবে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর তাঁর ছবি মুক্তি পেয়েছিল। মোট ৩৬৫ টির বেশি বাংলা ছবিতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। শুধু বাংলা নয়। ছয়টি হিন্দি ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। যেমন ১৯৪৭ সালে ‘চন্দ্রশেখর’, ‘সব্যসাচী’, ১৯৭২ সালে ‘কিতনে পাশ কিতনে দূর’ ইত্যাদি। এছাড়া ওড়িয়া এবং বাংলা দেশের ছবিতেও তিনি সাবলীল ভাবেই অভিনয় করেছেন। অনুপ কুমার অভিনীত এমন প্রচুর ছবি আছে যেগুলি চিরকালীন সৌন্দর্যে মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে; যেমন – ‘পলাতক’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘বালিকা বধূ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘ঠগিনী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘প্রতিশোধ’ সহ বহু ছবিতেই তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছে। ‘পলাতক’ ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ‘বিএফজেএ’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ‘রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে’ ভূষিত হন ১৯৭১ সালে। এছাড়া ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ সহ বিভিন্ন সময়ে নানান পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি।
অনুপের পিতা ছিলেন খ্যাতিমান ‘সঙ্গীত শিল্পী’, ‘সুরকার’ এবং ‘অভিনেতা’। যে সময়ে ‘পঙ্কজ কুমার মল্লিক’, ‘কৃষ্ণচন্দ্র দে’ বাংলা সঙ্গীত জগতকে মাতিয়ে রেখেছিলেন সেই সময়েই অনুপ কুমারের বাবা ‘ধীরেন দাস’ বাংলা সঙ্গীত ও অভিনয় জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ধীরেনবাবু। নজরুল ইসলামকে তিনিই প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড করার সুযোগ দেন। ধীরেন দাসের সুরেই নজরুলের অনেক গান তৈরি হয়েছে। এছাড়া পেশাদারি ‘স্টার থিয়েটার’, শিশির কুমার ভাদুড়ীর ‘শ্রীরঙ্গম’ সহ অনেক নাট্যদলেই সুরকার ও অভিনেতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন ধীরেন দাশ। সেই ধীরেনবাবুর দ্বিতীয় সন্তান ‘সত্যেন দাস’ জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ১৭ই জুন। এই সত্যেনই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন ‘অনুপ কুমার’। অনুপেরা ছিলেন সাত ভাই ও পাঁচ বোন। বাবার হাত ধরেই মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ‘হালবাংলা’ ছবিতে অভিনয় করেন অনুপ। এই ছবির সুরকার ও অভিনেতা ছিলেন ধীরেন দাশ। ‘পলাতক’ ছবির সুবাদে তারকা হয়ে ওঠার আরও পঁচিশ বছর আগে ১৯৩৮ সাল নাগাদ অভিনয় জীবনের শুরু হয়েছিল তাঁর। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ডিজি-র ‘হালবাংলা’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেই আট বছর বয়সের একদিন থেকে, “সে সময় ‘হালবাংলা’ বলে একটা ছবি হচ্ছিল, ধীরেন গাঙ্গুলী – যাঁকে আমরা ‘ডিজি’ বলে জানি, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও পেয়েছেন, তিনি একটা ছবি করবেন, তাতে তাঁর অনেকগুলি ছেলেমেয়ে দরকার। তা এখন যেমন ছেলেমেয়ে ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়, তখন সেই অবস্থাটা ছিল না। আর বেশ ভদ্র চেহারার ছেলে দরকার, সেজন্যে যাঁরা কাজের সঙ্গে জড়িয়েছিল তাঁদেরকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কেন জানি বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা আমার মনে আছে এবং হয়ে যাবার পর সকলে খুব মজা পেয়েছিল। পিঠ চাপড়ে বলেছিল খুব সুন্দর। এই হচ্ছে আমার প্রথম জনসাধারণের কাছে চেহারা দেখানো। … এর পরে আমার সঙ্গে আর এই জগতের কোনওরকম যোগাযোগ বহু দিন ধরে ছিল না।”
অনুপ কুমারদের দেশের বাড়ি ছিল হুগলী জেলার পাণ্ডুয়াতে। তারপর বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বাসা বদল করেছিলেন তাঁরা, যেমন – ‘হাতিবাগান হরি ঘোষ ষ্ট্রীট’, ‘বরানগর’, ‘বেলগাছিয়া কৃষ্ণমল্লিক লেন’, ‘পাইকপাড়া’, ‘সল্টলেক’ ইত্যাদি। কৃষ্ণমল্লিক লেনে থাকার সময় সরস্বতী পূজো উপলক্ষে ‘চম্পট চম্পু’ এবং ‘জামাই ষষ্ঠী’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন ছোট্ট সত্যেন। এরপর ১৯৪২ সালে বাবার হাত ধরেই মাত্র ১২ বছর বয়সে স্টার থিয়েটারে প্রথম পেশাদারি অভিনয় করেন অনুপ কুমার। ‘মহেন্দ্র গুপ্ত’ পরিচালিত সেই নাটকের নাম ছিল ‘টিপু সুলতান’। ১৯৪২ সালে স্টার থিয়েটারে পেশাদার থিয়েটারের জগতে যখন অনুপকুমারের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল তখন সেখানেই, তাঁর পিতা ধীরেন দাস ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার এবং অভিনেতা। স্টার-এ নাটক হচ্ছিল ‘শ্রীরামচন্দ্র’। তাতে লক্ষ্মণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অনুপকুমার। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন – “স্টারে যখন ‘শ্রীরামচন্দ্র’ অভিনীত হচ্ছিল, তখন বাবা অভিনেতা পদটা ছেড়ে সুরকার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। হঠাৎ একদিন শুনলাম বাবা থিয়েটার দেখতে এসেছেন। শুনে আমার মনে হল বাবাকে একটু দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে বাবা আমাকে থিয়েটারে এনে ভুল করেননি। সে দিন অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশ জোরালো অভিনয় করলাম। বীররসের সঙ্গে বীরদর্পে বিশ্বামিত্রকে প্রায় নস্যাৎ করে দিলাম।”
‘মহেন্দ্র গুপ্ত’ পরিচালিত ‘টিপু সুলতান’ নাটকে শনি-রবি ডবল্ শো এর জন্য ‘তিন আনা জলপানি’ সহ ‘মাসে ২০ টাকা বেতন’ পেতেন অনুপ কুমার। জানা যায় যে, এই স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে টালা পার্কের মাঠের মাঝখানে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তিনি মহেন্দ্র গুপ্ত পরিচালিত ১৬ টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছিলেন স্টার থিয়েটারে, যেমন – ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’, ‘রাজসিংহ’, ‘সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত’, ‘রাণী ভবানী’ ইত্যাদি। এরপর ‘শিশির কুমার ভাদুড়ী’র ‘শ্রীরঙ্গম’ দলে যখন ‘ঘরে বাইরে’ নাটকে অভিনয়ের জন্য শিশুশিল্পীর প্রয়োজন হয় তখন শিশিরবাবুর দুই ভাই – ‘হৃষীকেশ’ ও ‘ভবানী’ অনুপের নাম প্রস্তাব করেন। ফলে শিশিরবাবুর আহ্বানেই অনুপ তাঁর বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন শ্রীরঙ্গমে। শিশির ভাদুড়ি একের পর এক নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন অনুপ কুমারকে। যেমন – ‘সাজাহান’ নাটকে ‘সোলেমান’, ‘জনা’ নাটকে ‘বৃষকেতু’, ‘তখ্তে তাউস্’ নাটকে ‘সম্রাটের বড় ছেলে’, ‘দুখির ইমান’ নাটকে ‘আতাউর’ চরিত্র সহ ‘সীতা’, ‘রঘুবীর’, ‘বিজয়া’, ‘পরিচয়’, ‘আলমগীর’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেন অনুপ কুমার। বাবা ছেলে দুজনেই একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বহু নাটকে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত শিশির ভাদুড়ীর শ্রীরঙ্গমে অভিনয় করার সময় থেকেই অনুপ নিজে নিজেই নানান ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করতেন। এই নাট্যদলেই অনুপের অভিনয় প্রতিভা বিকশিত হয়। পেশাদার মঞ্চে তাঁর অভিনয়ের শিক্ষাটা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে, শ্রীরঙ্গমে। এই নাটকেই নিজের মতো ইম্প্রোভাইজ করতে গিয়ে একটা বিষম বিপত্তির কথাও আত্মজীবনীতে অকপটে লিখেছিলেন অনুপকুমার – ‘‘দুঃখীর ইমানে রাম অবতারের চরিত্রে যিনি করতেন তিনি অনুপস্থিত থাকায় আমি ঐ চরিত্রটা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করায় উনি রাজি হয়ে গেলেন। … আমি ভেবেচিন্তে একটা ঠিক করেছিলাম খৈনি খাব। প্রথমেই আসব মাথায় গামছাটা খুলে নিয়ে হাওয়া খেতে খেতে। তারপরে কোমরে ঐ যে বেল্ট থাকে সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেব। এসে কথাবার্তা বলতে বলতে খৈনি খাব, খেয়ে থুথু ফেলব, ফেলে বাকি কথা বলব। মহানন্দে পার্ট করছি। হঠাৎ খৈনি খেয়ে থুথু ফেলতে গিয়ে চোখের সামনে দেখি জ্বলন্ত দুটো কাঁচ। অর্থাৎ নাট্যাচার্য একেবারে প্রথম সারিতে বসে অভিনয় দেখছেন। সারা শরীর শিউরে উঠল। সর্বনাশ!’’
সর্বনাশ অবশ্য হয়নি। শিশিরকুমার প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু থিয়েটারে যে নিজের মতো ইম্প্রোভাইজ করতে পারতেন সিনেমায় তার সুযোগ পাননি সে ভাবে। এই না-পাওয়া বয়ে বেরিয়েছিলেন সারা জীবন।
এক সময় যখন শ্রীরঙ্গমের নাট্যাভিনয় অনিয়মিত হয়ে পরে তখন ‘মিনার্ভা থিয়েটারে’ ‘ক্ষত্রবীর’ নাটকে অভিনয়ের জন্য অনুপ কুমারকে নির্বাচিত করেন ‘অহীন্দ্র চৌধুরী’। তখন ‘আড়াইশো টাকা’ মাইনে পেতেন অনুপ। সেই প্রথম তাঁর ছবি দেওয়া পোষ্টার ছাপানো হয়েছিল। অনুপ শ্রীরঙ্গম ছেড়ে দেবে জানতে পেরে শিশির কুমার অনুপের কাঁধে হাত রেখে কাতর অনুরোধ করে বারবার বলেছিলেন – ‘‘আমাকে ছেড়ে তুই চলে যাসনে, তুই অনেক বড় হবি।’’ শিশিরবাবুর এই কাতর অনুরোধ শুনে অনুপ কুমার গ্রিনরুমে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। অবশ্য কিছুদিন পর শ্রীরঙ্গম বন্ধ হয়ে যায়। তাই আবার স্টার থিয়েটারে ফিরে যান অনুপ। এরপর স্টার থিয়েটারে টানা কুড়ি বছর অভিনয় করেছিলেন অনুপ কুমার। স্টারে তাঁর অভিনীত কয়েকটি নাটক, যেমন – ‘শ্যামলী’, ‘পরিণীতা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘শ্রেয়সী’, ‘শেষাগ্নি’, ‘একক দশক শতক’, ‘দাবী’ ইত্যাদি। ‘শ্যামলী’ নাটকে ‘উত্তম কুমার’ ছিলেন ‘নায়ক’ আর অনুপ কুমার হয়েছিলেন ‘নায়কের ভাই’। এ নাটকের জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে দিনের পর দিন বহু চেষ্টা করেও সাধারণ মানুষ টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি। হল ছাপিয়ে দর্শকের ভিড় আছড়ে পরত রাস্তায়। শ্যামলী নাটক বাংলা অভিনয় শিল্পের মাইল স্টোন হয়ে থাকবে চিরকাল। তবে স্টার থিয়েটার ছাড়াও অন্যান্য ‘পেশাদারি মঞ্চ’, ‘অপেশাদারি মঞ্চ’, ‘গ্রুপ থিয়েটার’, ‘যাত্রা’, ‘বেতার’, ‘দূরদর্শন’ সহ সব ক্ষেত্রেই তাঁর অভিনীত নাটকগুলি ব্যাপক সাফল্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ‘নাট্য পরিচালক’ হিসেবেও যে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সে কথা কখনোই ভোলা যাবে না। ‘অভিনেতৃ সংঘের’ প্রযোজনায় ‘হঠাৎ নবাব’ নাটকটি ‘পরিচালনা’ করেছিলেন অনুপ কুমার। ১৯৭৬ সালে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে ‘নূর জাহান’ নাটকটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে থিয়েটার জগতে সারা ফেলে দিয়েছিলেন অনুপ কুমার। এইসময় হলটি আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলে নাটকটি রঙমহলে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাট্যপরিচালক হিসেবে তাঁর দুর্দান্ত প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে ১৯৮৬ সালে ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে’ ‘ইন্দ্রাণী’ নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে। ১৯৯৩ সালে তাঁর পরিচালিত নাটক ‘খুঁজে ফিরি’ ‘বিশ্বরূপা’য় মঞ্চস্থ হয়েছিল। অনুপের ‘নাম জীবন’ নাটকটি প্রথমে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে অভিনীত হলেও পরবর্তী সময়ে ‘যোগেশ মাইম একাডেমী’ লিজ নিয়ে সেখানে সেখানে মঞ্চস্থ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর পরিচালনায় অভিনীত হয় ‘মুক্তির উপায়’। অনুপ কুমার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নাট্যদল ‘ভদ্রকালী নাট্যচক্র’। অনুপের পরিচালনায় বহু কল শো হত এই নাট্যদলে। এই নাট্যদলে ছিলেন ‘সুধি প্রাধান’, ‘দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘মৃণাল সেন’, ‘শোভা সেন’, ‘তাপস সেন’ সহ অনেক গুণীজন। পরিচালনার পাশাপাশি অনুপ কুমার নিজেই সকলের মেক-আপ করতেন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবান বন্দী’ নাটকেও তিনি মেক-আপ করেছিলেন। নাট্যাভিনয় তাঁর কাছে পরে পাওয়া চোদ্দ আনা ছিলনা। কঠোর শ্রম, সময় ও মেধার গুণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং সম্পূর্ণ। ভদ্রকালী নাট্যচক্রের রিহার্সাল যখন অনেক রাত্রে শেষ হত তখন অনুপ কুমারকে সাইকেলে চাপিয়ে উত্তরপাড়া থেকে ডানলপ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হত। অনুপ সেখান থেকে হয় বাসে নয়তো পায়ে হেঁটেই বেলগাছিয়ার কৃষ্ণমল্লিক লেনের বাড়িতে ফিরতেন। একদিন রাত দুটোয় রিহার্সাল শেষ হয়, সেইদিন অনুপ নিজেই সাইকেল চালিয়ে বেলগাছিয়ার বাড়িতে ফিরেছিলেন। এভাবেই নাট্যাভিনয়কে তাঁর জীবন সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তিনি।
‘শিশু শিল্পী থেকে নায়ক’, ‘চরিত্রাভিনেতা থেকে কৌতুকাভিনেতা’, ‘মুখে হাসি চোখে জল’ সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার নজির গড়েছেন অনুপ কুমার। সেসময় ‘সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়’কে বলাহত ‘মঞ্চলক্ষ্মী’ এবং অনুপ কুমার’কে বলাহত ‘মঞ্চনারায়ণ’। ‘স্টার’, ‘শ্রীরঙ্গম’, ‘বিশ্বরূপা’ থেকে শুরু করে ‘কাশী বিশ্বনাথ’, ‘রঙ্গনা’, ‘সুজাতা সদন’, ‘তপন থিয়েটার’, ‘রবীন্দ্র সদন’, ‘শিশির মঞ্চ’, ‘একাডেমী’, ‘কলামন্দির’, ‘মহাজাতি সদন’, ‘বিজন থিয়েটার’ সহ অন্যান্য সব মঞ্চেই তিনি প্রচুর অভিনয় করেছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত অনুপ কুমার ‘যাত্রা মঞ্চের অধীশ্বর’ হয়ে উঠেছিলেন। যাত্রায় অভিনয় করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। সেই উপার্জিত টাকায় সল্টলেকে নিজের বসতবাড়ি তৈরি করেছিলেন। তাঁর অভিনীত যাত্রাগুলির মধ্যে ‘দাদা আমার পাগলা ভোলা’, ‘আজ ভাসুরের বিয়ে’, ‘ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে’, ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘আমি মায়ের ছেলে’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কলকাতা দূরদর্শনে তিনি মোট ১১টি নাটকে অভিনয় করেছেন, যেমন – ‘লুকোচুরি’, ‘বিনি পয়সার ভোজ’, ‘অঘটন’, ‘পরাশর’, ‘নাসিকা সংবাদ’ ইত্যাদি। এছাড়া ১৯৭৬ সালের ৫ই আগস্ট বেতারে সম্প্রচারিত হয়েছিল ‘পাখির চোখ’ নাটকটি এবং ১৯৭৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সম্প্রচারিত হয়েছিল বেতার নাটক ‘রটন্তী কুমার’। এইরকম আরও কয়েকটি বেতার নাটকে অনিন্দসুন্দর অভিনয় করেছেন অনুপ কুমার। অন্যদিকে ‘আই.পি.টি.এ’-তে যুক্ত হয়ে ‘জবান বন্দী’, ‘শহীদের ডাক’, ‘মশাল’, ‘বিচার’, ‘ইস্পাত’, ‘আজকাল’ ইত্যাদি নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অনুপ কুমারের একটি আশ্চর্য গুণের কথা উল্লেখ করতেই হয়। সেটি হল ‘অতিরিক্ত’ বা ‘মনগড়া সংলাপ’ বলে দর্শককূলকে মাতিয়ে রাখার অসীম ক্ষমতা। অবশ্য এর ফলে প্রতিদিনই ২০ থেকে ৩০ মিনিট দেরিতে নাটক শেষ হত। তাই দর্শকদের বাড়ি ফিরতে দেরি হত। অনুপের এই প্রবণতায় নাট্য পরিচালকেরা বিরক্ত হতেন। তবু রিহার্সালে যে ভঙ্গি করা হয়নি, যে সংলাপ উচ্চারিত হয়নি অনুপ সেসব করেই দর্শকদের মধ্যে হাস্যরোল তুলতেন, আনন্দে ভাসিয়ে দিতেন। এই ঘটনার সাক্ষী অনেকেই, যেমন – ‘গীতা দে’, ‘সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়’, ‘মাধবী মুখোপাধ্যায়’, ‘সন্ধ্যা রায়’ থেকে শুরু করে ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের’ মতো শিল্পী; যাঁরা অনুপ কুমারের সঙ্গে এক মঞ্চে অভিনয় করেছেন।
তবুও সিনেমায় অভিনয়ের প্রথম দিকে কখনও তিনি সেই টাইপ লোক হাসানোর জোয়াল কাঁধে নেওয়া অনুপকুমার হয়ে যাননি। দেবকীকুমার বসুর ডবল ভার্সান ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে চরিত্রটা ছিল ছোট প্রতাপের। এবং অনুপকুমার লিখছেন – “এরপর থেকে একের পর এক ছবিতে আমি কাজ পেতে শুরু করি এবং কিছু কিছু বেশ ভাল ছবি পেয়েছিলাম যাতে অভিনয় করে আনন্দ পেয়েছি। কিছু কিছু ট্র্যাজিক রোল ছিল, যেমন ‘বাঁকালেখা’। খুবই ভাল রোল এবং এটাই সম্ভবত আমার সিরিও-কমিক রোলের সূচনা। তারপর ‘সংকল্প’তে নায়ক হওয়ার সুযোগ এল। এরপর উত্তম এল, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘পথে হল দেরি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তম-সুচিত্রা-অনুপ একটা ব্র্যাকেটের মধ্যে পড়ে গেল। ‘বরযাত্রী’ অবশ্য তার আগে।”
তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কুড়িটা ছবি, দিলীপ রায়ের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ অন্য অনুপকুমারকে বার বার দেখা গেলেও শিল্পী হিসেবে মরে যাওয়ার সেই অতৃপ্তির কাঁটাটা ছিলই। নিজেই লিখেছিলেন – ‘‘আমার কাছে তখন অর্থ উপার্জনটা বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। অনেক খরচের দায়িত্ব আমার ওপরে এসে পড়েছিল। কাজেই সিলেক্টেড ছবি করার সুযোগ আমার জীবনে কখনো আসেনি। যদি নিজের ইচ্ছেমতো ছবিতে কাজ করতে পারতাম, তাহলে আমার আজকের পরিচয়টা অন্য এক মাত্রা পেত।’’
সারা বিশ্বের আপামর বাঙালির হৃদয়ে ভালোবাসার আগুন জ্বালিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর, ৬৮ বৎসর বয়সে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন বাংলা অভিনয় শিল্পের তারকা অনুপ কুমার। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ‘হাজার স্থির চিত্র’, ‘বিভিন্ন পুরষ্কার’, ‘পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য লেখা’, ‘ব্যবহার করা সামগ্রি’গুলি বুক দিয়ে আজও আগলে রেখেছেন অনুপ কুমারের ছোট ভাই ‘হিমাদ্রী দাস’। ‘১১ সি, নর্দান অ্যাভিনিউ’র বাড়িতে গিয়ে সেসব দেখে রোমকূপে শিহরণ জাগে, হৃদয় আন্দোলিত হয়, বারিধারা উঁকি দিয়ে যায়।
(তথ্যসূত্র:
১- জীবন পুরের পাঠক, অনুপ কুমার, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
২- চৌরঙ্গী পত্রিকা, অনুপ কুমার বিশেষ সংখ্যা, মার্চ ২০১৮ সাল।
৩- Remembering A Genius Called Anup Kumar, article on The Times of India, Dated – 17th June 2019.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত