১৯৮০ সালের ২২শে আগস্ট, কলকাতার ভোরের আকাশে সে দিনও মেঘ ছিল। তাঁর শোকমিছিলে কেঁদেছিল তাঁর প্রিয় শহর। মিছিল পৌঁছেছিল রবীন্দ্রসদনে। পাটভাঙা গেরুয়া পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি পরে ফুলের আড়ালে ঘুমিয়েছিলেন জর্জ। কিছু দিন আগে সেখানেই শেষ সংবর্ধনা নিয়েছিলেন জর্জ। সকলের স্মৃতি থেকে যেন তাঁর গান ভেসে আসছিল। যেন ফিরে ফিরে গেয়ে চলছিলেন জর্জ – ‘আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে/ কাঁপন ভেসে চলে’। একসময় মিছিল হরিশ মুখার্জি রোড ধরে ঘাটের কাছে পৌঁছেছিল। চোখের জলে ফুরিয়েছিল গান, ‘একদিন কোন্ হাহা রবে/ সুর হারায়ে গেল পলে পলে/ আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’। প্রিয় মামার মুখাগ্নি করেছিলেন তাঁর প্রিয় ভগ্নিই। বাঁ দিকে হেলানো মাথা। হাতে লাঠি। একা, নিঃসঙ্গ জর্জ যেন হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলেন বাদল দিনের দিগন্তের ও পারে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কলকাতা। শোকসভায় কালো শাড়িতে জর্জের প্রিয় ‘দিদিমণি’ গেয়েছিলেন – ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার।’
কিন্তু সব শেষেরও যে একটা শুরু আছে। সেই শুরুর খোঁজে চলে যেতে হবে আরও পিছনে – সময় স্রোতের বিপরীতে।
১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগ, বাংলার বামপন্থী রাজনীতিতে সেই সময়টা বড়ই টালমাটাল। সেই টালমাটাল অস্থির সময়ের স্রোতে ভেলার মতন টাল খাচ্ছিল ঋত্বিক ঘটকের জীবন। অজস্র অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে দলের মধ্যে – মোট ‘তেইশটা চার্জ’। পার্টি তাঁর বিরুদ্ধে ‘ওয়ান ম্যান কমিশন’ বসিয়েছিল, ‘কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত’ ছিলেন তার মেম্বার। হওয়ায় পাক খাচ্ছিল একটা খবর – পার্টি তাঁকে ‘এক্সপেলড’ করবে! তাঁর প্রিয় ‘উমানাথদা’, ‘কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘মমতাজ আহমেদ খান’ সকলে নাকি তাঁর বিরুদ্ধে চার্জের সমর্থন জানিয়েছিলেন! এই অবস্থায় তাঁর ‘লক্ষ্মী’, ‘শ্রীমতী সুরমা ঘটক’ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন – ‘‘কমরেড জ্যোতি বসু তোমার পক্ষে। কিন্তু এই পার্টি, আইপিটিএ, তেইশটা চার্জ কোনও কাজ করতে দেবে না! নতুন দল করো। গ্রুপ থিয়েটার!’’ তখন ‘সংঘাত অনিবার্য।’ এ পক্ষ, ও পক্ষ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ‘জর্জ’ ওদের কথা শুনতেন। এক শনিবার, সন্ধেয় গোপন মিটিং করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে, বলা ভালো পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বসবেন বলে, একদিন সন্ধের তাসের আড্ডা বাতিল করে জর্জ নিজেই ঘরে ডেকেছিলেন বিজন, ঋত্বিকদের। ঋত্বিক হাজির হয়েছিলেন দুপুর তিনটেতেই। অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন। তিন-চার কাপ চা হয়ে গিয়েছিল। মাথার চুল মুঠো করে ধরছিলেন বার বার। একবার এই মোড়া, একবার ওই মোড়া। শেষে জর্জ আর থাকতে না পেরে বলেছিলেন, ‘‘আঃ! স্থির হইয়া বোসো না।’’ অস্থির ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সবাই আসবে তো!’’ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘খবর পাইছে হক্কলে, আইবে কিনা কইতে পারি না।’’ উত্তরে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সেইটাই প্রধান সমস্যা। বুঝলা, কেউ কারও মনের ভিতরটা জানে না।’’ একই কথা বার বার বলতে বলতে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন ঋত্বিক। মোড়ায় বসে, পা-টা তুলে দিয়েছিলেন খাটের ওপর। শীর্ণ, শিরা-ওঠা পায়ে ছিল কাদার ছোপ। অস্থিরভাবে পায়ের আঙুল নাড়তে নাড়তে বলেই চলেছিলেন, ‘‘ভাঙনের জয়গান, বুঝলে … ভাঙনের জয়গান! আমি একটু পার্কে ঘুরে আসি। মুক্ত বাতাস দরকার। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু!’’ ঝোলা কাঁধে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ঋত্বিক। জর্জ জানতেন ওই ঝোলায় কী আছে! বলেছিলেন, ‘‘মুক্ত বায়ু, না বোতল-বদ্ধ তরল! আমি সব জানি। আমার ঘরে হেই সব চলবো না। তুমি যাও, পার্কে বইস্যা যা খুশি করো।’’ মিটিং ভন্ডুল হয়ে যায়! বটুক আর বিজন ছাড়া কেউ আসেননি। তাঁরাও ফিরে গিয়েছিলেন এক সময়। জর্জকে অপেক্ষার আঁধার পেয়ে বসেছিল যেন। এমন সময় দরজায় হাজির হয়েছিলেন ঋত্বিক। সাড়ে সাতটার সময় ঋত্বিক ফিরেছিলেন। টালমাটাল পায়ে। কোনওমতে টাল সামলে জর্জকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘মিটিং হইল না? ডিসিশান দাও, দুই বছর এপাশ-ওপাশ ভালো লাগে না। ডিসিশান চাই … কোন পক্ষে যাব, কোন দলে? বলো, বলো?’’ জর্জ এর কী উত্তর দেবেন, জানতেন না। যন্ত্রণায় বুক ফেটে গিয়েছিল তাঁর। মাথা নিচু করে জর্জ চলে যেতে বলেছিলেন ঋত্বিককে। তাঁর গলা কেঁপে উঠেছিল। টাল খেতে খেতে ঋত্বিক চলে গিয়েছিলেন। গলির আলো-অন্ধকারে দীর্ঘ চেহারাটা হারিয়ে গিয়েছিল। ঘাড় কাত করে তাঁর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে ছিলেন জর্জ। ঋত্বিকের পিছনে পড়ে ছিল কলকাতার ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের জর্জের একলা ঘর। একটু পরে হারমোনিয়ামের সামনে বসেছিলেন জর্জ। গেয়ে উঠেছিলেন শ্রাবণের গান, ‘‘আমার যে দিন, ভেসে গেছে। চোখের জলে, আমার যে দিন …!’’ জর্জ কখনও মদ্যপান পচ্ছন্দ করতেন না। একদিন সন্ধের একটু আগে আবার এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। জর্জের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। জর্জ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আসবা না, এখন আসবা না।’’ ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘জর্জদা, টাকা দাও। মোড়ের বাংলার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’’ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘কত দেব, দশ টাকা?’’ এই বলে, তিনি দশ টাকা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ঋত্বিকের সে দিকে হুঁশ ছিলনা। কে ছুঁড়ে দিল, তাতে কিছু যায়-আসত না তাঁর। এমন দৃশ্য দু’দিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন জর্জের ভাগ্নি ‘পারমিতা’। শেষে একদিন জর্জ ঋত্বিক কে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে বিরক্ত কোরো না। টাকা নিয়ে চলে যাও।’’ জর্জ ঋত্বিককে খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘‘ঋত্বিক মানিকের থেকে অনেক ট্যালেন্টেড। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হল।’’
তখন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ করছিলেন ঋত্বিক। পরিচিত মহলে বলেছিলেন, ‘‘ছবিতে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকবে। এবং জর্জদাই গাইবেন।’’ ঘনিষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কোন গান ঋত্বিকদা?’’ ঘটকবাবু তো নিজেই জানতেন না, উত্তর দেবেন কী! অবশেষে দিন এসেছিল রেকর্ডিংয়ের। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োর স্কোরিং থিয়েটারে জর্জ এসেছিলেন। পরনে ছিল মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। সাদা পাজামা। কাঁধে ঝোলা, মুখে পান। বাঁ দিকে হেলানো মাথা। চশমার ফ্রেমের ভিতর, গহন চাহনিতে, অদ্ভুত এক মায়ারং-আলো খেলা করে যেন প্রতিক্ষণ। ফ্লোরে ঢুকেই ঋত্বিকের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘‘দ্যাখ ভবা, আমরা ঠিক আইস্যা পড়ছি।’’
ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সব কিছু রেডি আছে জর্জদা। একবার শোনালেই, ফাইনাল টেক হবে।’’ বিধি বাম। হঠাৎ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘আমি তো বাবা তোরে আগেই কইসি, গলা খারাপ। আমি গামু না!’’ সে কী! কে গাইবে এ গান? বুঝি চৌচির স্বপ্ন-সংকল্প! জর্জের গলার ওই বিস্তার, মন্দ্র সপ্তকে স্থিতি-গাম্ভীর্য? দিল খোলা মর্জি-গায়ন? ‘‘না। আমি তো তোরে আগেই কইসি। এ বার আমারে ছাইড়া দে। আমার ছাত্র সুশীল গাইব!’’ বার বার অনুরোধ করেছিলেন ঋত্বিকের। জর্জ শুনতে চাননি কিছুতেই। শেষে, ঋত্বিকের প্রায় কাকুতি মিনতি করে বলেছিলেন – ‘‘প্লিজ জর্জদা, প্লিজ এটা করবেন না। এ গান, ছবির যে সিচুয়েশন, আপনি না গাইলে হবে না! প্লিজ!’’ জর্জ তবুও অনড় ছিলেন। মেঝের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে তাঁর নির্লিপ্ত ভঙ্গি ছিল। সে দিন স্টুডিয়োতে ছিলেন ‘তুষার তালুকদার’। পরে যিনি ‘পুলিশ কমিশনার’ হয়েছিলেন। ‘উন্মুক্ত ব্রাত্যজন’ তথ্যচিত্রে তাঁর সে দিনের স্মৃতি এরকম – ‘‘ঋত্বিকদা কারও কাছে কাকুতি মিনতি করার লোক নন। বরং ওনার মর্জি মতো ব্যাপারটা না ঘটলে, ভীষণ রেগে গিয়ে এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, সেটা না বলা ভাল। কিন্তু, এই ব্যতিক্রম দেখলাম জর্জদার ক্ষেত্রে। এবং সেটা জর্জদার ক্ষেত্রেই সম্ভব। আলটিমেটলি একটা সমঝোতা হল যে, গানটা শুরু করবেন জর্জদা। ফলো করবেন সুশীল।’’ রেকর্ডিং হয়েছিল। জর্জ গেয়েছিলেন। সঙ্গে তাঁর ছাত্র ‘সুশীল মল্লিক’। রবীন্দ্রনাথের পঁচিশ বছর বয়সে লেখা গান। কাফি রাগে। ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’। ছবিতে অভিমানী জর্জের গায়ন আর এলোমেলো যাপনের ঋত্বিকের ক্লোজআপ ফ্রেম মিলেমিশে হয়েছিল একাকার। বাকিটা সেলুলয়েডের কিংবদন্তি।
শেষে ছিয়াত্তরে ঋত্বিক চলে গিয়েছিলেন। এমন হুট করে তাঁর চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারেননি জর্জ। সে সময়ের একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘ঋত্বিক ও বিজন তো আত্মহত্যা করল … এ বার বোধহয় আমার পালা।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঋত্বিকের শোকসভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিল। তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন জর্জ। বলেছিলেন – ‘‘ক্যান যামু, হারামজাদাটা না বইল্যা কইয়া চইল্যা গ্যালো, যামু ক্যান আমি, আপনারা মাফ করেন আমারে!’’
শ্রাবণ মেঘের আড়ালে ঢাকছে জর্জের ‘কইলকাত্তা’। কালো হয়ে আসছে আকাশ। কালো? মেঘ নামছে গঙ্গার জলের উপরে। গড়ের মাঠে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের নিভৃত গলিটার মাথায়। এক সময় মেঘদূত মহল্লার হাওয়ার গায়ে ভেসে এল যেন ধৈবত বর্জিত রাগের বন্দিশ। ‘রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি বুঁদন বরখে, তাসোই/ সোহাবন মন ভাবন শাবনকি ঋতু মোরে সজনুবাঁ’। মল্লারের খেয়ালে অনতিপর এল বৃষ্টি। ‘ঝিমুর ঝামর, আকাশ চেরা’ জলঝারিতে ভিজছে শহর। মেঘমেদুর বাদলের দিন মানেই জর্জ বড় একটা ছাতা নিয়ে ভাগ্নিদের ডেকে বসতেন গলির মুখে। রবিঠাকুরের বর্ষার গান যে ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়! ছাতার আড়ালে ভিজতে ভিজতে লিরিকের রেশ রেখে গেয়ে চলতেন, ‘শ্রাবণ মেঘে আধেক দুয়ার খোলা’, ‘বহু যুগের ওপার হতে’, ‘আবার এসেছে আষাঢ়’। মেঘের পাখোয়াজ শুনতে শুনতে বিরতিবিহীন কোনও কোনও দিন বা শোনা যেত, ‘এ কী গভীর বাণী এল’, ‘নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জছায়ায়’ ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া’। সে সব কথা এখনও তাঁর স্বজনের স্মৃতির মণিকোঠায়।
কলকাতার ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ঘরটিই ছিল জর্জ বিশ্বাসের সাম্রাজ্য। ভেজানো কাঠের দরজা। ও পারে ছোট্ট গলি। গেট খুলে বারান্দা। ঘরের ভিতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছোপধরা পিকদান। অগোছালো বিছানায় ডাঁই করে রাখা গানের খাতা। ক্যাসেট, হটব্যাগ, মারফি রেডিয়ো। ছোট্ট টিভি। ইনহেলার। কাঠের সেল্ফ। সেল্ফে স্বরবিতান। কাউকে হাত দিতে দিতেন না। সব হাতের কাছে রাখতেন। তার পর যখন অসুস্থ হয়েছিলেন, ডাক্তারের কথায় ঘরের ভিতরে জানালার জাল কেটে ফেলা হয়েছিল। সারাক্ষণ ইজিচেয়ারে থাকতেন। সেখানেই ঘুমোতেন। ঘুম? শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুমোননি কত কাল! সামনেই টুলের উপর রাখা থাকত হারমোনিয়ম। এ ঘরেই গান শেখাতেন জর্জ। তাঁর ভাগ্নি ‘পারমিতা’র কথায়, ‘‘রবিবার হলেই রাসবিহারী। মামার কাছে গান শিখতে যেতাম। দোতলা বাড়ি। মামা থাকত নীচের তলায়। প্রথম দিকে মা-বাবা নিয়ে যেতেন। পরে একাই যেতাম। গান করতে বসতাম যখন, মামা বলত, ‘‘আগে গানটা পড়েন।’’ সবাইকে আপনি-আজ্ঞে করত তো! বলত, ‘‘আপনারা এত খাওয়াদাওয়া করেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না কেন?’’ নিজে গেয়ে, তার পর সবাইকে গাইতে বলত। গান করতে করতে বই দেখা পচ্ছন্দ করত না। বলত, ‘‘আগেই চক্ষু খুইলা দ্যাখেন কী লেখা আছে।’’ খুব ভালবাসত রান্না করতে আর খাওয়াতে। পাবদা মাছ, তেল-কই, মাংস, তরকা …। দারুণ করত মুরগির রোস্ট। বাড়িতে কেউ এলেও মামাই রান্না করে খাওয়াত। মিষ্টি খেত খুব। চায়ে অনেক চিনি। আর রাতে যাদবের সন্দেশ মেখে ভাত। কখনও আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যেত ওর নিজের টিউশানিতে। বাইকে করে। কালো অ্যাম্বাসাডার কিনল পরে। বাইক চালাত জোরে। বসে থাকা যেত না। কিন্তু চার চাকার গাড়ি ড্রাইভ করত খুব আস্তে। মামা চাইত গান শিখি। কিন্তু কোনও দিন চায়নি আমি শান্তিনিকেতনের কোনও অনুষ্ঠানে গান করি। প্রথম দিন নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বভারতীতে। আমার ইচ্ছে ছিল, অ্যাকাডেমিক লাইন ছাড়া কিছু করব না। ওর ইচ্ছে ছিল গানটাও যেন শিখি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর, গানের চর্চাও শুরু হল সঙ্গীতভবনে। তখন বিকেলে ক্লাস হত। আমাদের গান শেখাতেন নীলিমা সেন, বীরেনদা।
খুব মনে পড়ে আমার ভর্তির জন্য মোহরদিকে চিঠি লিখেছিল মামা। যখন ইন্টারভিউ দিই, মোহরদি ছিলেন। সিলেক্ট হয়ে যখন প্রণাম করলাম ওঁকে, বললেন, ‘‘খুব ভাল গেয়েছিস। জর্জদা চিঠিতে এত কথা লিখল, কিন্তু তুই যে এত ভাল গান করিস, সেটা লিখল না! ‘আমার ভাগ্নিটা গেল, দেখবেন যেন’। দাঁড়া, জর্জদাকে আমি লিখব।’’ …’’
বাদল দিনের এক সকালে ছাত্র ‘অর্ঘ্য সেন’ এসেছিলেন গানের ক্লাসে। মুখে পান নিয়ে তখন মন্দ্র সপ্তকে সুর ভাঁজছিলেন জর্জ। একটু পরে ফের চুন নিয়েছিলেন জিভে। তার পর হারমোনিয়মের বেলোতেই মুছে দিয়েছিলেন চুনের হাত। কখনও লুঙ্গিতেও মুছতেন। শুরু করেছিলেন গান। বাইরে তখন আকাশভাঙা শ্রাবণ। অর্ঘ্য কী শিখেছিলেন প্রথম দিন? ‘কখন বাদল ছোঁয়া লেগে’। একদিন জর্জকে সাহস করে প্রশ্ন করে বসেছিলেন অর্ঘ্য, ‘‘জর্জদা, রেসের মাঠে যান কেন?’’ জর্জের জবাব ছিল, ‘‘তুমি বিয়া করো নাই কেন? তুমি যেমন বিয়া করো নাই, আমি তেমনই রেসের মাঠে যাই। এটা আমার চয়েস।’’
কখনও সখনও সেই ঘরেই ঢুকে পড়তেন ‘গীতা ঘটক’। জর্জ তখন অন্য ছাত্রছাত্রী চলে যেতে বলেন। গীতা সবটুকু দিয়ে গাইতেন, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। এক সময় গলির প্রান্তে ছোট্ট বাড়িটায় সুরের সঙ্গ-সুধা-রেশ রেখে চলে যেতেন গীতা। জর্জ মজা করে তাঁর পরিচারকদের বলতেন, ‘‘ম্যামসাহেবের সবই ভাল, শুধু গানটা পিছন ফিরা করলেই পারেন।’’
সেই বাড়িতেই গান শিখতে আসতেন ‘আরতি’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘পূরবী’রাও। রবিবার রবিবার তাঁর ভাগ্নি ‘পারমিতা’ও। একদিনের কথা। গান শেখাতে শেখাতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। সে দিন ‘শ্রীলা সেন’ এসেছিলেন। এত রাতে কোনও ছাত্রীকে একলা যেতে দিতেন না, মোটরবাইকে উঠিয়ে জর্জ গিয়েছিলেন তাঁকে বাড়ি ছাড়তে। উড়ো হাওয়ার বাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ভয় পাইবা না তো?’’ শ্রীলা বলেছিলেন, ‘‘উঁহু।’’ … জর্জ বপেছিলেন, ‘‘আমি জোরে চালামু।’’ জর্জের কথার ঝোঁকে যেন তেপান্তরের উড়ান ছিল। মজা লেগেছিল শ্রীলার। একটু ভয়ও! রাতের হাওয়ায় ঠিক শোনা যাচ্ছিল না। জর্জ ঘাড় ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী মনে হয় পক্ষীরাজে চড়স?’’
এক চিলতে এই ঘরের ইজিচেয়ারে শুয়ে, অভিমানী বাউল জর্জ কেবলই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে সব অর্থহীন মনে হত। গোপনে কান্নার গায়ে যেন রক্তের ছিটে রং দেখতেন। দিন দিন শ্বাসের টান যেন বাড়ছিল। রাতভর জেগে কাটত জর্জের। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে মাথার নীচে হাত দুটো রাখলে তখন একটু আরাম হত। কেউ গেলে, মোড়া দেখিয়ে বসতে বলেন। কথা বলেন খুব আস্তে। চলে যাওয়ার কথা। সেই অবেলায় পৌঁছে, তাঁর উদাস মন উড়ে যেত কাঁটাতারের ও পারে কিশোরগঞ্জে, কলকাতার প্রথম জীবনে। মনে পড়ে যেত অকালে চলে যাওয়া ভাগ্নে ‘খোকন’কে। দুই পরিচারক ‘শ্রীকান্ত’ আর ‘অনন্ত’র আড়ালে, নিভৃতে চোখের পাতা ভিজে যেত। জানালা দিয়ে যেন দেখতেন গগনতলে দেশের বাড়ির ছবি। কানে বাজত ‘বাবা দেবেন্দ্রকিশোর’, ‘মা অবলা’র গলা। ‘খোকা, খোকা!’ স্মৃতির ছবিতে এলোমেলো হয়ে ভেসে উঠত বাড়িটা। বাঁশ-বাতার গেট। গেটের পাশে বকুল গাছ। দুব্বো ঘাসের উঠোন পেরিয়ে টানা বারান্দা, টিনের চাল। সামনে বাগান। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে জর্জের হাত ধরে যে-বাগানে ভিজতে ছুটতেন বোন ‘ললিতা’। কখনও দিদি ‘সান্ত্বনা’। কত স্মৃতি। কত গান। প্রিয়-মানুষের স্মৃতি-তোড়ের ভাসান।
এমন বাদলের দিনে, জর্জের গানে উতলা হয়ে ভিজে উঠতেন ‘মঞ্জুশ্রী’ও। সে কথা কলকাতা জানে। দু’জনের দেখা হয়েছিল সেই ’৫২ সালে। ‘মঞ্জুশ্রী চাকী’ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী। এলিট সিনেমা হলের অনুষ্ঠানে জর্জ প্রথম দেখেছিলেন তাঁকে। জর্জ গেয়েছিলেন ‘নৃত্যের তালে তালে’। শাড়িটাকে একটু তুলে, গাছকোমর করে পড়েছিলেন মঞ্জুশ্রী। নেচেছিলেন, নিয়ম ভাঙার নাচ। প্রথম আলাপে যেন, ‘আগুন ছড়াল শুকনো খড়ে’। মঞ্জুশ্রীর যাতায়াত বেড়েছিল জর্জের বাড়িতে। খোকন রেগে যেতেন, কিন্তু মঞ্জুশ্রী এলে জর্জ যেন আশ্চর্য এক উন্মাদনা টের পেতেন। পঞ্চাশের দশকে কলকাতা শহরে একের পর এক অনুষ্ঠানে দেখা যেতে লেগেছিল পাশাপাশি দুটো নাম। জর্জের গান আর মঞ্জুশ্রীর নৃত্য। একসঙ্গে নাম ঘোষণা হলেই, শুরু হত অফুরান করতালি। বাঁধ ভাঙা গান আর ঢেউয়ের নাচে একে একে কোরিওগ্রাফি হত, ‘ও চাঁদ তোমায় দোলা দেবে কে’, ‘ঝরঝর বারিধারা’। বছর তিনেক বাদে জর্জ সমুদ্র কিনারে গিয়েছিলেন মঞ্জুশ্রীর পরিবারের সঙ্গে। উঠেছিলেন পুরীর স্বর্গদ্বারের একটা বাড়িতে। জোর গুজব রটে গিয়েছিল কলকাতার পথের হাওয়ায়। মোটরবাইকে করে নাকি শহর চষে ফেলছেন মঞ্জুশ্রী-জর্জ! দু’জনকে নাকি দেখা যাচ্ছে অনুষ্ঠানের শেষে গঙ্গার ধারে, প্রেসিডেন্সি চত্বরে, জর্জের রাসবিহারীর ঘরে! অফিস পাড়া থেকে লেক কালীবাড়ি। তখন গসিপ আর গসিপ। সে গসিপের ছায়া পাওয়া যায় দেবব্রত বিশ্বাসের নিকটাত্মীয় বাসব দাশগুপ্তর উপন্যাস ‘জর্জ’-এও। সেখানে ‘মধুশ্রী’ নামের ‘লম্বা, দোহারা চেহারা, ঈষৎ চাপা বর্ণ, আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘ চুল, কথা বলা চোখ’-এর মেয়েটি পরপর কয়েক দিন জর্জের কাছে না এলে, তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। – ‘‘ফোন করতে মন চায়, উপায় নেই ওর স্বামী নাকি আজকাল ঠারেঠোরে নানা কথা শোনায় ওকে। বলে কিসের এত রোজ রোজ একজনের বাড়ি যাওয়া? বাংলাদেশে আর কি কোনও গায়ক নেই? আসলে মধুশ্রীর নৃত্যভঙ্গি আর জর্জের গান এমন একটা আত্মিক বোধে যুক্ত হয় যে, সমস্ত শ্রোতা-দর্শকেরা ওদের যৌথ পরিবেশনায় প্রচণ্ড আনন্দ পায়।’’ বাইরের উড়ো কথা ঘরে এসে ঢুকেছিল। জর্জকে তাঁর দিদি-বোন-মা জিজ্ঞেস করেছিলেন মঞ্জুশ্রীর কথা। জর্জ রসিকতা করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘চিন্তার কোনও কারণ নাই।’’ শেষে একদিন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মঞ্জুশ্রীর। বিয়ের কিছু দিন পর বিদেশে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তার পরেও যখনই কলকাতায় এসেছিলেন, দু’জনে অনুষ্ঠান করেছিলেন। পরে, অনেক পরে, মঞ্জুশ্রী নিজেও খুব কাছের জনদের বলেছিলেন সেই-সব রটনার দিন-রাত্রির কথা। মঞ্জুশ্রীর মেয়ে হওয়ার খবরে ’৬৩-র মার্চে জর্জ তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘তোমার মা হওয়ার খবর শ্রীকান্তের মুখে আমি পেয়েছিলাম। … আমার সাড়াশব্দ নেই কারণ আমি নিজেই নেই – যদি দেশে ফেরো, আমায় চিনতে তোমার খুব অসুবিধে হবে – হয়তো পারবে না। বেলা আমার ফুরিয়েছে – তাই খেলাও শেষ।’’ দেশে ফিরে আমৃত্যু মঞ্জুশ্রী জর্জের গানকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিলেন। মঞ্জুশ্রীর মেয়ে ‘রঞ্জাবতী’ও প্রেমে পড়েছিলেন জর্জের গানের। জর্জকে ভোলেনি রঞ্জাও!
নিয়ত ভাঙন-প্রত্যাখ্যান সরিয়ে, রবিঠাকুরের গানই ছিল জর্জের নিজস্ব নিখিল। এই মানুষই কঠোর হয়ে যেতেন, মর্জির বিরুদ্ধে তাঁকে হাঁটতে বাধ্য করলে। সে সুরের সারিন্দা হোক বা, রাজনীতির পথ। শরিক ছিলেন উত্তাল সময়ের। দু’বার ঘুরে এসেছিলেন লাল-চীন। ’৩৮ থেকে সেই সখ্য ছিল ’৫৪ পর্যন্ত। কিন্তু কখনও পার্টির সভ্য হননি। মাঠে-বন্দরে গেয়ে বেড়াতেন ‘গণসঙ্গীত’। রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন লাল মঞ্চে বসে। অশোক মিত্রের কথায়, জর্জ বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানে যে-আগুন, তাতে সাধারণের অধিকার আছে। অচলায়তনকে তিনি ভেঙে চূর্ণ করতে পারবেন। তাঁর রোখ চেপে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গান জর্জের গলায় হয়ে উঠেছিল ‘গণসঙ্গীত’।
সে সময় কালিকা সিনেমা হলে ‘রক্তকরবী’ অভিনীত হয়েছিল। পরিচালনা করেছিলেন জর্জ নিজে। ‘বিশুপাগল’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জর্জ। ’৪৭-এর শেষের দিকে শ্রীরঙ্গমেও অভিনীত হয়েছিল রক্তকরবী। সেখানেও জর্জ হয়েছিলেন ‘বিশু’। নেপথ্য থেকে ‘রাজা’-র ভূমিকাটি পড়েছিলেন ‘শম্ভু মিত্র’। ‘নন্দিনী’ – ‘কণিকা মজুমদার’, ‘চন্দ্রা’ – ‘তৃপ্তি মিত্র, ‘সর্দার’ – ‘কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’। ‘বহুরূপী’ যখন ‘ছেঁড়াতার’ করেছিল, জর্জ হয়েছিলেন ‘মহিম’। সে-নাটকে উইংসের আড়ালে এস্রাজ বাজিয়েছিলেন ‘তুলসী লাহিড়ি’। অভিনয় করতে করতে গান গেয়েছিলেন জর্জ।
ষাটের দশক থেকে জর্জ গণসঙ্গীত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন! পার্টির ভাঙন কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি কোনও দিন। নির্ঘুম রাত জুড়ে যেন খানিকটা হতাশাও জমছিল তখন। ফ্রন্ট যে বার ভেঙে গেল, পার্টির দুঃসময়ে কষ্ট পেয়েছিলেন একা একা ঘরে বসে। বাসব দাশগুপ্তের ‘জর্জ’ উপন্যাসে সেই সব দিনের কথা উঠে আসে অবিকল শব্দ-ছবিতে।
মিত আলোর একটা ঘর। সেখানে বসে জর্জ একমনে সুপুরি কাটাতেন ছোট জাঁতিতে। ঘরে-বাইরে সর্বক্ষণ মিঠাপাতির এই এক নেশা ছিল তাঁর। কখনও মোটর সাইকেলে গোটা কলকাতা দাপিয়ে ধর্মতলা থেকে গণেশ অ্যাভিনিউয়ের দিকে যেতে যেতে গলির মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। পান কিনতেন। খুব করে দেখে, আদরে মুখে পুরতেন চুন-খয়ের-জর্দার মিঠাপাতি। এ দৃশ্য ছিল রোজকার। প্রিয় পানের দোকান ছিল, তাঁর বাসার কাছে রাসবিহারীর ফুটপাতের উপর। জাঁতিটা বিছানায় রেখে, সুপুরিগুলো ছোট্ট হামান দিস্তায় গুঁড়ো করে, পান সেজে দিলীপের জর্দা মিশিয়ে নিতেন। ডিব্বা সরিয়ে রাখতেন। অপূর্ব ছিল সে গন্ধ। সেই গন্ধে ভুরভুর করত তাঁর সারাটা ঘর।
তাঁর ঘরে কেবল একজনেরই ছবি ছিল। তিনি হলেন জর্জের ‘দিদিমণি’। ছিপছিপে গড়নের মেয়েটি কালোপাড়-সাদা শাড়িতে কলকাতার মঞ্চে গাইতেন, ‘কোন খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এলো’। জর্জ তাঁকে ‘দিদিমণি’ বলে ডাকতেন। বিশ্বভারতীর ছাত্রী হয়েও, তাঁর গানের মধ্যে ছিল ভিন্নতর আহ্বান। জর্জের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাঁরা একসঙ্গে গণসঙ্গীতের কত অনুষ্ঠানে যে গেয়েছেন! কোথাও কোথাও সকলে দেখেছিলেন, নৃত্যনাট্য শেষ হবার পরে ‘দিদিমণি’ কাঁদছেন জর্জের কাঁধে মাথা রেখে। কত বার! এ দিকে বিশ্বভারতীর সঙ্গে জর্জের বিরোধ বেড়েছিল ’৬২-তে মিউজিক বোর্ড থেকে অনাদি দস্তিদার সরে যাওয়ার পর। ’৬৪-তে জর্জের ফের দুটি গান আটকে দিয়েছিল বোর্ড। অনেকের সঙ্গে দায়িত্বে ছিলেন ‘দিদিমণি’। একদিন, জর্জের ‘দিদিমণি’ এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। দেখেছিলেন, লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে মোড়ায় বসে ডিম-ফুলকপি রান্না করছেন জর্জ। ‘দিদিমণি’ বলেছিলেন, ‘‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানে ‘চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে’র জায়গায় ‘চন্’ কথাটি স্বরলিপি মতো হয়নি।’’ জর্জ হেসেছিলেন। হারমোনিয়ম টেনে শোনাতে বলেছিলেন। ‘দিদিমণি’ গেয়েছিলেন। শুনে জর্জ বলেছিলেন, ‘‘… ‘চন্’ শব্দডা যে স্বরলিপি অনুসারে হইল না দিদিমণি।’’ চলে গিয়েছিলেন ‘দিদিমণি’। সে দিনের মতো বিরোধ মিটলেও দিদিমণির সঙ্গে সম্পর্কে কোথায় যেন দূরত্ব বাড়ার সেই শুরু হয়েছিল। কিছু দিন পর ‘শান্তিদেব ঘোষ’ অবশ্য জানিয়েছিলেন, জর্জই ঠিক। ১৯৬৯-এ ফের জর্জের দুটি গান আটকেছিল বোর্ড। আঘাত পেয়ে রেকর্ড বন্ধ করে দিয়েছিলেন জর্জ! অভিমানে কাতর হয়ে যখন তিনি থেমেছিলেন, তখন তিনি টপ ফর্মে। তাঁর রেকর্ড বিক্রি বেড়েই চলছিল। জর্জের ‘দিদিমণি’ হলেন কিংবদন্তী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী শ্রীমতী ‘সুচিত্রা মিত্র’।
ভাগ্নি ‘পারমিতা’র স্মৃতিচারণেও এসেছে জর্জের শেষবারের জন্য শান্তিনিকেতন আসার কথা, ‘‘তখন সবে খালেদবাবুর আঁকা ছবির প্রচ্ছদে ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ বেরিয়েছে। আমি বিশ্বভারতী থেকে পাশ করে ভর্তি হয়েছি বর্ধমানে। মামা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতি পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সেটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘‘যা, বন্ধুদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া কর।’’ আর গাড়ি থেকে একটা বই বের করে দিল। ততক্ষণে আমার বন্ধুরা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় করেছে। আমি বললাম, তুমি কী খাবে? বলল, ‘‘আমি আর কী খাব, শক্তিগড়ের ল্যাংচা।’’ সে বারই শেষ শান্তিনিকেতন আসা মামার। …’’
আবার তাঁর আশ্রয় হয়েছিল সেই একলা ঘর। সে সময় যাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি থেকে মেলে সেই সকাতর সময়ের ছবি। মাঝে মাঝেই একে-ওকে সামনে পেয়ে স্বরবিতান ধরিয়ে দিয়ে জর্জ বলতেন, ‘‘আমি গাইতাছি তুমি স্বরলিপির সঙ্গে মিলাইয়া বলো। বলো না, কোনখানে আমি ভুল করছি!’’
কেমন ছিল জর্জের সঙ্গে তাঁর ‘দিদিমণি’র সম্পর্ক? বয়সে চোদ্দো বছরের বড়, তবু সুচিত্রার কাছে তিনি ছিলেন শুধুই ‘জর্জ’! প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে জর্জ যে বার ভর্তি হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ শিশুমঙ্গল হাসপাতালে – অবচেতন জর্জের মুখে কখনও শোনা যেত, ‘সুচিত্রা’, কখনও ‘দিদিমণি, দিদিমণি’! জ্ঞান ফিরে দেখতে চেয়েছিলেন দিদিমণিকেই। ছুটে এসেছিলেন সুচিত্রা। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সুচিত্রা যখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন, জর্জ জ্বর নিয়ে একবার চিঠির প্রত্যুত্তরে সুচিত্রাকে লিখেছিলেন – ‘‘আজ আপনাকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বলছি – কথা হল এই – অসুখের মধ্যে আপনার চিঠিটা ভীষণ ভালো লেগেছে। এবং এত ভীষণ ভালো লেগেছে যে অনেকবার পড়ে ফেলেছি।’’ একটু পরেই আবার লিখেছিলেন, ‘‘মোহরের খবর কি? তাঁকে আমার কথা বলবেন।’’ এই সুচিত্রাই তাঁর অনুলিখিত আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘জর্জের গান বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড বাতিল করেছিল বলে যা এক সময় বহু জায়গায় প্রচারিত হয়েছে, তা ঠিক নয়। জর্জের কোনও গান বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড খারিজ করেনি।’’
ওদিকে জর্জ-ঘনিষ্ঠ, তাঁর ‘ওস্তাদ’ শিল্পী খালেদ চৌধুরী সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত ভাবে এক বার বলেছিলেন, জর্জের সঙ্গে অন্যদের রেকর্ড বিক্রির বিরাট অঙ্কের ফারাকটাই বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের লোকেরা মেনে নিতে পারেনি। তাঁদের ঈর্ষা ছিল। এও বলেছিলেন জর্জের পিছনে ‘‘সুবিনয় রায়, সুচিত্রা লেগেছিল, আবার লাগেনি।’’
উত্তাল সময়ে দীর্ঘ দিনের সহযোদ্ধা খালেদকে জর্জ কি কিছু বলেছিলেন? শেষ দিকে খালেদের সঙ্গে আলাপের গোড়ার কথাগুলো খুব মনে পড়ত জর্জের। গোয়াবাগানে আইপিটিএ-র সম্মেলনেই প্রথম আলাপ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পার্টিতে যখন মতবিরোধ, সকলের মনে ধোঁয়াশা, সে সময়ের অনেকে তাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ’৪৬ সাল। কলকাতায় রায়ট। উত্তাল মহানগর। কালীঘাট ট্রাম ডিপোতে লাশের স্তূপ। শুনশান রাসবিহারী। বারুদের হাওয়া কেটে একটা লোক পড়িমড়ি করে ছুটতে ছুটতে গলি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল জর্জের ঘরে। ছোট্ট ঘরে তখন জর্জের সঙ্গে বসেছিলেন ‘শম্ভু মিত্র’ ও ‘তৃপ্তি মিত্র’। লোকটাকে দেখে চিৎকার করে উঠে জর্জ বলেছিলেন – ‘‘শালা… বাঁইচা আছো।’’ সেই ‘লোকটা’ ছিলেন ‘কলিম শরাফী’ – পরে বাংলাদেশের বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ও পার থেকে গোপন আশ্রয় নিতে এসেছিলেন জর্জের ঘরে। পুলিশি-গ্রেফতারি এড়াতে সাত দিন সে-বাড়িতে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলেন কলিম। জর্জের ঘরে কয়েক দিনের জন্য আত্মগোপন করে ছিলেন আরও একজন। তিনি ‘কাইফি আজমি’ – অভিনেত্রী শাবানা আজমির পিতা। দেশে তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কবি, শিল্পী, নাট্যকর্মীদের একটি গোপন সভায় যোগ দিতে কলকাতায় এসে তিনি উঠেছিলেন জর্জের ডেরায়। হঠাৎ একদিন পুলিশের ইনফরমার খবর দিয়েছিল রেইড হবে। যে দিন রেইড হয়েছিল, সে দিনই কাইফিকে ধুতি আর পৈতে পরিয়ে ছদ্মবেশে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন জর্জ। তত ক্ষণে তাঁর বাড়ির চার ধারে থিকথিক করছিল পুলিশ। এক সময় দরজা ঠেলে পুলিশ কর্তারা ঢুকেই পড়েছিলেন বাড়িতে। প্রায় অন্ধকার ঘরে জর্জ তখন হারমোনিয়ম বাজিয়ে রবিঠাকুরের গানে একাত্ম ছিলেন – ‘চির সখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।’ উল্টো দিকে বসে মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন ‘কলিম শরাফী’!
সুরের আসমানে ভেসে থাকা জর্জের চিঠির ফাইল ছিল দেখার মতো। লেখা জুড়ে কৌতুক। পরিহাস। আবার বিরোধের কথা। সহজিয়া শব্দ-রেখায়। শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে খুব যত্ন করে একটা সময়ের পর থেকে নিয়মিত দিস্তের পর দিস্তে চিঠি লিখতেন প্রিয়জনদের। স্বজন-ভক্তদের। চিঠি আসতও নিয়মিত। সব চিঠির উত্তর দিতেন। আর সব ক’টির কার্বন-কপি করে রেখে দিতেন ফাইল-বন্দি করে। তাঁর কোনও চিঠি শুরু হত ‘কইলকাতা, ১৭৪-ই, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ’ দিয়ে। সে সব চিঠিই শোনাতেন তাঁর কাছে কেউ গেলে। নিজে কী উত্তর লিখেছিলেন, তাও শোনাতেন। চিঠির এক-এক ফাইলের নাম ছিল বিচিত্র – ‘ভালবাসার অত্যাচার বা পাগলামি’, ‘টিন এজার্স’, ‘কোলাকুলি ও গালাগালির ফাইল’ বা ‘সেন্টিমেন্টাল অ্যাডাল্টস’। তাঁর ভাগ্নি ‘পারমিতা’র স্মৃতিতে, ‘‘যখন আমি শান্তিনিকেতনে, মামা অনেক চিঠি লিখত, তার উত্তরও দিতাম। মজার সব চিঠি। একটাতে যেমন চিঠি শুরুর জায়গায় আমার মুখের ছবি এঁকেছে। চিঠির শেষে নিজের মুখের স্কেচ!’’
শেষ দিকের জর্জ যেন জেরবার হয়ে গিয়েছিলেন – শরীরে, মনে, সবেতে। রাসবিহারীর ভাড়াবাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার তাগাদা আসছিল। শরীর ভেঙে পড়েছিল তখন। বার বার ইনহেলার নিয়ে আরাম হচ্ছিল কতটুকুই বা! জ্বর আসছিল কেবল। অসহায় হয়ে পড়েছিলেন জর্জ। কিন্তু গান থেমে ছিলনা। কোনও কোনও গানে একই জায়গা গাইতেন বারবার – ‘ওহে চঞ্চল, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে’। কলকাতার ভরা ময়দানে অগণিত মানুষ নির্বাক হয়ে তখনও শুনতেন তাঁর গান। জর্জ তখন দাড়ি রেখেছিলেন। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, ফতুয়া। হাতের লাঠিটি সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। রোগজর্জর শরীর নিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বাইরের আকাশ দেখতেন। একবার ‘উত্তমকুমার’ এসেছিলেন শিল্পী-সংসদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে। জর্জ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনে আইছেন ক্যান? আমারে তো পুলিশ ডাকতে হইব?’’ অনেক করে উত্তম রাজি করিয়েছিলেন। জর্জ তাঁকে শর্ত দিয়েছিলেন দুটো। বিজ্ঞাপনে ‘দেবব্রত বিশ্বাস’ লেখা যাবে না। লিখতে হবে ‘এক বিতর্কিত শিল্পী’। আর মঞ্চেও তাই ঘোষণা করতে হবে। সেটাই হয়েছিল। উত্তমকুমার মাইকে বলেছিলেন, ‘‘এ বার গান শোনাবেন এক বিতর্কিত শিল্পী।’’ পর্দা উঠে গিয়েছিল, জর্জ গান শুরু করেছিলেন। হারমোনিয়ম একটু বেলো করে মাথাটা ঈষৎ উঠেছিল যেন। গান শুরু করার আগে সব আলো জ্বালিয়ে দিতে বলেছিলেন। গেয়েছিলেন, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’। তাঁর একের পর এক বর্ষার গানে খুলে গিয়েছিল মেঘের ডানা-ভাঁজ। স্থায়ী থেকে অন্তরায় ছড়িয়ে পড়েছিল মেঘমন্দ্র উচ্চারণের সম্মোহন। কোথাও ঘুরে ঘুরে একই লাইন গেয়েছিলেন। কখনও একটু সুরের রেশ টেনে, বেশি মাত্রা নিয়ে গেয়েছিলেন। শ্রোতাদের মনে হয়েছিল যেন বৃষ্টি-হাওয়ার নেশা পাক খেয়ে ঘুরছে ময়নাপাড়ার মাঠে।
একবার জর্জের রাসবিহারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন ‘সমরেশ বসু’ও। ‘মায়া সেন’ নিয়ে এসেছিলেন। জর্জ পা তুলে বসে ছিলেন। ঘরে সমরেশ বসু ঢোকার পরও পা নামাননি। মায়া সেন এ দিকে ইশারা করেই যাচ্ছিলেন, পা নামাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই আর পা নামাননি। শেষে চলেই গিয়েছিলেন সমরেশ বসু। মায়া সেন তাঁকে গাড়িতে চাপিয়ে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘‘জর্জদা, আপনি এটা কী করলেন?’’ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘যে এত অশ্লীল গল্প লেখে, তাঁকে আমি পছন্দ করি না।’’ তিনি ছিলেন এই রকমই! আরেক বারের কথা, উত্তমকুমার মারা গেলেন। তার কয়েক দিন বাদে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তাঁর ভাগ্নি ‘পারমিতা’। দুটো চিঠি দেখিয়ে জর্জ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এই দ্যাখ, উত্তমের দুটো শ্রাদ্ধের চিঠি এসেছে। সুপ্রিয়া পাঠাইছে, গৌরীদেবীও পাঠাইছে। কোনটায় যাব?’’ উত্তমকুমার কে নিয়ে জর্জের আরেকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন পারমিতা। টিভিতে একবার ‘আলো আমার আলো’ সিনেমাটা হচ্ছিল। জর্জ দেখে বলেছিলেন, ‘‘বাবা, কী বিচ্ছিরি! উত্তম-সুচিত্রা কী করেছে এ সব! কেউ দেখে! জঘন্য!’’ ভাগ্নি ভ্রু তুলে হাইমাই করে উঠতেই বলেছিলেন, ‘‘আমার তো দমবন্ধ লাগে।’’
শেষ দিকে রোগা হয়ে গিয়েছিলেন জর্জ। কেবল চলে যাওয়ার কথা বলতেন। মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হত। এ সবের মাঝেও কিন্তু বাড়িতে তাসের আড্ডাটা ঠিক বসত সন্ধ্যাবেলায়। কয়েক জন আসতেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি তাস খেলতেন। শেষের দিকে চোখেও কম দেখছিলেন জর্জ। আগস্টেই ‘গোলাম মুরশিদ’কে চিঠিতে লিখলেন, ‘‘আমার তো ভবনদী পার হবার সময় হয়ে এসেছে … বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আমার চোখে ছানি পড়তে শুরু হয়েছে। এখন স্পষ্ট দেখতে পাই না। আর কিছুদিন বাদে হয়তো অন্ধ হয়ে যাব।’’ মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কিংশুক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসদনে জর্জকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’। অনেক কষ্টে ‘কাকা’ জর্জকে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। জর্জ গেয়েছিলেন, ‘এখন আমার সময় হল, যাবার দুয়ার খোল’। কেই বা জানত সময়ের সেই কড়া নাড়া তখন তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন!
একেবারে শেষ দিকে যখন শরীরটা খুব ভেঙে গেল, তখন মনের দিক থেকেও তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। হাত নাড়িয়ে কেবল বলতেন, ‘‘ভাল নাই। ভাল নাই।’’ হয়ত নিজের ভাগ্নির সঙ্গে গল্প করলেন, কিন্তু বাইরের কেউ এলে, কথা বলতে চাইতেন না। শেষের দিকে কেবলই ভাগ্নি কে বলতেন, ‘‘তোকে এই রেকর্ড দিয়ে দিলাম। এই খাতা দিয়ে দিলাম।’’ তাঁকে বলতেন, কোথায় কী আছে। সব যেন বুঝিয়ে দিতে চাইতেন। শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ‘মৃত্যুকামনা’ করছিলেন নিজের। শেষ চিঠি লিখেছিলেন মৃত্যুর ১১ দিন আগে, আগস্টের ৭ তারিখে, সিউড়ির সোনাতোড় পাড়ার ‘অর্চনা বসু’কে। জর্জ তাঁকে ‘মাসিমণি’ বলতেন। শ্বাসরোগের যন্ত্রণায় কাতর জর্জ লিখেছিলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু বলেছেন আমার হাঁপানি একেবারে সারানো যাবে না – হয়ত আক্রমণটা কিছু কমতে পারে। … এই রকম অকর্মণ্য হ’য়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভাল – কিন্তু আত্মহত্যা করার সাহস আমার নেই!’’ চলে যাওয়ার সাত দিন আগে ভাগ্নি ‘পারমিতা’কে বলেছিলেন, ‘‘শোন, আমি আর এক সপ্তাহ আছি। সকালে উঠে দেবদুলালের গলায় রেডিওতে শুনবি, কুখ্যাত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছে!’’ তারপরেই এসেছিল ১৯৮০ সালের ১৮ই আগস্টের সেই বৃষ্টিভেজা-অশ্রুসিক্ত সকাল।
(তথ্যসূত্র:
১- ১৮ই আগস্ট ২০১৬ সালে আজকাল পত্রিকায় প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও জীবনীকার গোলাম মুরশিদ লিখিত ‘দেবব্রত বিশ্বাস: স্বকীয়তা ও অবদান’ প্রবন্ধ।
২- দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে, দেবব্রত বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং।
৩- জর্জ, বাসব দাশগুপ্ত।
৪- শ্রী দেবব্রত বিশ্বাসের ভাগ্নি পারমিতার সাক্ষাৎকার। আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে আগস্ট ২০১৫ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত