নাম-যশের পিছনে কখনওই ছুটে যাননি বাংলা সিনেমার এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। নতুন বছরের শুরুতে বেশ কয়েকজন দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বুকলিস্ট ধরে বইখাতা, জামা-কাপড় কিনে দিতেন তিনি। বাংলার বন্যাত্রাণে তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী কমলা রায় ১১ ভরি সোনা দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারগুলো কমলাদেবী পছন্দ করতেন। স্বামীর হয়ে টেকনিশিয়ানদের বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা, জামাকাপড় দিতেন।
এই অভিনেতা ভালো উর্দু যেমন বলতেন, তেমনই ভালো ইংরেজিও বলতেন। প্রাইভেট টিউটর রেখে উর্দু শিখতেন। ‘মর্জিনা-আবদল্লা’ ছবিতে তাঁর উর্দু উচ্চারণ তার প্রমাণ। নতুন জিনিস শেখার আগ্রহটা যে ছিল অফুরান। লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে রাখতেন বই। জামাকাপড়, সুগন্ধী আর চটির খুব শখ ছিল। কত জোড়া যে জুতো ছিল! রিহার্সালে গেলে প্যান্ট-শার্ট পরতেন না, সবসময় পাজামা-পাঞ্জাবি। ধুতিও খুব প্রিয় ছিল। আর সাদা রুমাল। ধর্মতলার এক টেলার্সের কাছ থেকে জামা-কাপড় তৈরি করাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর হঠাৎ একদিন তাঁর তৈরি করতে দিয়ে যাওয়া জামা-কাপড় নিয়ে এসে হাজির হয়েছিলেন ওই দোকানের এক কর্মচারী। যার পেমেন্ট আগেই করে গিয়েছিলেন তিনি।
জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন এই অভিনেতা। একটি সিনেমা প্রযোজনার কাজে হাত দিয়েছিলেন। পোড়খাওয়া অভিনেতা হলেও প্রযোজনার গলি-ঘুঁজি তাঁর জানা ছিল না। বন্ধুরা তাঁকে ঠকিয়েছিল। তিল তিল করে জমানো কষ্টার্জিত টাকা সব শেষ হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। ছবিটির কাজ মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়। উল্টে ঘাড়ে চেপে যায় ৭৫ হাজার টাকার দেনা। ছ’য়ের দশকে ৭৫ হাজার টাকার মূল্য নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।
সেই দেনা শোধ করতে গিয়েই ফাংশনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। একেক দিন ২-৩ টি করে শো। সে ফাংশন হোক বা থিয়েটার কল শো হোক বা যাত্রা। বেড়েছিল মদ্যপানের মাত্রাও। যেটাকে জহরের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করেন। তাঁর দোসর অপর কিংবদন্তী অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বলতেন, ‘ও ওভার ওয়ার্কে মারা গিয়েছে।’
তাঁর শরীর দ্রুত ভাঙছিল। একটা সময় স্বাস্থ্যের প্রতি দারুণ নজর ছিল তাঁর। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচরণ থেকে জানা যায়, ‘বাতাসার সঙ্গে পেঁপের রস দিয়ে খেত, ছাগলের দুধ খেত।’ কিন্তু পরে লিভার আর পেরে উঠছিল না। ফিরে ফিরে আসছিল জন্ডিস। অনিয়ম করতেন। ইনসুলিন নিয়ে অনেক সময় না খেয়ে চলে যেতেন। এভাবেই সম্ভবতঃ না ফেরার পথের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি – তিনি জহর রায়।
১৯৭৪ সালে শ্যুটিং হয় ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কোর …’। ওই সময়ই মহানায়কের সঙ্গে ‘ব্রজবুলি’। তখন চেহারা প্রায় কঙ্কাল। সিনেমার কেউ আর কাজ দিতে চাইত না তাঁকে, এড়িয়ে যায়। রংমহলই সম্বল ছিল তাঁর। ওই মঞ্চেই রিহার্সাল করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর এক বন্ধুর সহায়তায় স্ত্রী কমলাদেবী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করেন। কমলাদেবী অনেকবার থাকতে চেয়েছিলেন অসুস্থ স্বামীর পাশে, কিন্তু ডাক্তাররা অনুমতি দেননি। সেই অভিমানে আর কোনওদিন মেডিক্যাল কলেজে পা রাখেননি তিনি।
ভর্তি করার পরের দিনই সকালে সেই বন্ধু এসে (জহর ‘মিত্র’ বলে ডাকতেন আর ছেলেমেয়েরা ডাকতেন ‘মিতে’) খবর দেন, জহর আর নেই। ১৯৭৭ সালের ১১ই আগস্ট। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ‘জহরের কি দেশের কাছে এইটুকুই পাওনা ছিল সৌমিত্র? অন্য দেশ হলে স্যার উপাধি পেত।’ খবর পেয়ে জহরকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। বেথুন কলেজের সামনে দাঁড়ায় শোক মিছিল। গাড়ি থেকে নেমে লরিতে ওঠেন সুচিত্রা। অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘তুমি চলে গেলে চার্লি!’ তারপর নিচু হয়ে মৃতের কপালে এঁকে দিয়েছিলেন চুম্বন। তখন জহরের মৃতদেহের পাশে ছিলেন ক্লাস এইটে পড়া ‘সব্যসাচী’ – তাঁর পুত্র।
বাঙালি ভাবনায় ভানু কখনও একা আসেন না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারিত হলে অবধারিতভাবে এসে পড়েন জহর রায়। হলিউডে যেমন লরেল-হার্ডি, টলিউডে যেন ঠিক তেমনই ভানু-জহর। বাবা সতু রায় ছিলেন গুণী মানুষ। একটু-আধটু অভিনয়ও করতেন। ফলে অভিনয়ের রেফারেন্সটা জহর রায়ের ছিলই। সতু রায়ের লেখালেখির হাতটাও বেশ ভালো ছিল। প্রথমদিকে জহর রায়ের বেশ কিছু কমেডি-সংলাপ ও কৌতুক-নকশা ছিল তাঁর বাবারই লেখা।
বরিশালে জন্ম হলেও জহরের লেখাপড়া পাটনাতে। সতু রায়ের ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রে জহর রায়ের ছোট থেকে কলেজ জীবনের বেশ খানিকটা সময়ই পাটনায় কেটেছে। সেখানে বি এন কলেজ থেকে জহর আই এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে। কী কী না কাজ তখন করতে হয়েছে তাঁকে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করেছেন, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত চাকরি করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসে। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেনের মতোই তাঁরও ওষুধের কোম্পানিতে সেলসম্যান হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসে প্রুফ রিডারের কাজ করেছেন ২০ টাকা মাইনেতে। এমনকী, কিছুদিন পাটনায় দর্জির দোকান খুলে হাতেকলমে জামাকাপড় কাটিং-সেলাইও করেছেন।
তবে যাই করুন, পাটনায় থাকতে থাকতেই যে কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাতেই বোঝা যায় তাঁর ভিতর ভবিষ্যতের ‘জহর রায়’ হয়ে ওঠার যাবতীয় রসদ মজুত ছিল। পারিবারিক সংস্কৃতি অনুযায়ী শুরু থেকেই বইপত্র পড়া ও অন্যান্য নানা বিষয়ে জানার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই তাঁর আদর্শ ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। লোকজনকে হাসানোর ইচ্ছে ও প্রতিভা দুই-ই ছিল জহর রায়ের। পাটনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চ্যাপলিনকে নকল করে, কথা-বার্তায়, নানা অঙ্গভঙ্গিতে আনন্দ দিতেন দর্শকদের। এমন করে নকল করতেন যেন তিনি নিজেই চার্লি চ্যাপলিন। নিজেকে বলতেন চ্যাপলিনের একলব্য শিষ্য। ধীরে ধীরে নাম হতে শুরু করল। নানা জায়গা থেকে ডাক আসতে লাগল। সেই সময় পাটনায় লোকমুখে তাঁর নামই হয়ে গেল ‘চার্লি’। পাটনায় একবার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন সে সময়ের আর এক প্রতিভাবান কৌতুকাভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায়। ওই অনুষ্ঠানেই জহর রায়ের ‘চার্লি’ প্রদর্শন দেখে মুগ্ধ হন তিনি। তখনই পরিচয় হয় দুজনের। কলকাতায় জহর আসার পর অজিত চাটুজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। অজিতবাবু পরে অনেক সাহায্য করেছেন জহর রায়ের উত্থানের ক্ষেত্রে।
অভিনয়ের পোকা যাঁর মাথায় গোড়া থেকেই কিলবিল করত, তাঁর পক্ষে কি অন্য কোনও কাজে মন দেওয়া সম্ভব? একদিন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মাত্র ৫০ টাকা পকেটে নিয়ে কলকাতাগামী একদল বরযাত্রীর গাড়িতে চেপে পাটনা থেকে কলকাতায় চলে আসেন জহর। ভাগ্যের চাকা কখন যে কার কোনদিকে ঘুরে যায়! কলকাতায় এসে যোগাযোগ হল সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নারায়ণবাবু তখন থাকতেন পটলডাঙায়। জহর রায় সেই বাড়িতেই এসে ওঠেন। জহরের চার্লিকে নকল করার অভিনয় নারায়ণবাবু তাঁর পরিচিত লোকজনকে ডেকে ডেকে দেখাতেন। একদিন নাট্যব্যক্তিত্ব রঙ্গশ্রীর সাধন সরকারের সঙ্গে আলাপে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় জহরকে বলেন চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ নকল করে দেখাতে। জহর সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে নকল করেন যে, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সাধনবাবু। গল্পের এখানেই শেষ নয়। পরের দিন আবার সাধনবাবুর সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর কাছে একটা আবদার করে বসেন জহর। সেদিনের চার্লি দর্শনের বিনিময়ে শোনাতে হবে মঞ্চের ডায়লগের কিছু অংশ। ‘আলমগীর’ নাটক থেকে কিছুটা শোনাতেই জহর রায় উঠে জড়িয়ে ধরেন নাটকের এই মহীরুহকে। দাবি, রঙ্গশ্রীর সদস্য করতে হবে, অভিনেতা হওয়ার পথ দেখাতে হবে। পরে অবশ্য রঙ্গশ্রীর সভ্য হয়েছিলেন জহরবাবু।
তাঁর প্রতিভার আভাস পেয়ে নারায়ণবাবুই জহরকে নিয়ে যান সে যুগের নামকরা পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তখন ‘পূর্বরাগ’ নামে একটা ছবি করছেন। পরিচয় করতে গিয়ে জহর দেখেন এ তো তাঁর দেশের কালাচাঁদদা! আসলে অর্ধেন্দুবাবুও বিহারের ভাগলপুরের মানুষ। জহর পাটনায় থাকতে কালাচাঁদদাকে (অর্ধেন্দুবাবুর ডাকনাম) চিনতেন। ফলে পূর্বপরিচিত দুই বিহার প্রবাসী বাঙালির নিজেদের আপন করে নিতে দেরি হল না। অর্ধেন্দুবাবুর ‘পূর্বরাগ’ ছবিতেই জহর রায়ের অভিষেক ঘটল। তখন ১৯৪৭ সাল। এর প্রায় বছর দুই পরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় চলচ্চিত্রে আসেন, ১৯৪৯-এ। শুধু সিনেমায় অভিনয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বয়সের মাপকাঠিতেও ভানুর থেকে জহর এক বছরের সিনিয়র। তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালে। তবে তারিখটা ঠিক জানা নেই। তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী জহর রায়ের জন্মদিন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তারিখটা বলতে পারব না। কারণ ওঁর জন্মদিন আমরা কখনও পালন করিনি। শুনেছি ১৯১৯ সালের আশ্বিন মাসে ওঁর জন্ম।’
পর্দায় তাঁকে দেখে হাসির ফুলঝুরি ছুটলেও ব্যক্তিগত জীবনে খুবই রাশভারী ছিলেন জহর। কলেজ স্কোয়ারের কাছে কর্পোরেশন অফিস, তার পাশের গলি রাধানাথ মল্লিক লেনের ২১/১ নম্বরের তিনতলা বাড়িটির একতলায় স্ত্রী কমলা রায়, পুত্র সব্যসাচী আর তিন মেয়ে সর্বাণী, ইন্দ্রাণী ও কল্যাণীকে নিয়ে সপরিবারে ভাড়া থাকতেন তিনি। গলি থেকে বেরিয়ে একাত্তর বাই একের পটুয়াটোলা লেনের ‘অমিয় নিবাস’-এর তিনতলায় দুটো ঘর নিয়েছিলেন জহরবাবু। এটাই ছিল তাঁর লাইব্রেরি কাম অফিসঘর। কাজের জন্য না বেরলে সেখানেই সারাদিন থাকতেন। রাতে গলির ভিতরের বাড়িতে শুতে আসতেন। খুবই ঘরোয়া ও সাধারণ জীবনযাপন করেছেন বরাবর। কোনওদিন নিজের গাড়ি ছিল না। ট্যাক্সিই ছিল একমাত্র সম্বল।
পূর্ববঙ্গের বরিশালে জন্ম হলেও জহর রায় কিন্তু গড়গড় করে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারতেন না। একথা তাঁকে কেউ বললে তিনি হেসে বলতেন, আমি বাঙাল ভাষা বলতে না পারায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। কারণ আমি যদি গড়গড়িয়ে বাঙাল ভাষা বলতাম, তাহলে তো ভেনোর ভাত মারা যেত। ওকে আর করে খেতে হতো না। বিখ্যাত কমেডিয়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি ‘ভেনো’ বলে ডাকতেন।
যাইহোক, অভিনয় শুরুর গল্পে ফিরি। ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে দুরন্ত অভিনয় করলেও জহর রায়ের হাতে অনেকদিন পর্যন্ত কোনও কাজ ছিল না। কাজের সন্ধানে এ দরজা থেকে ও দরজায় ঘুরেছেন। বিমল রায় সেইসময় অসম্ভব বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন ‘উদয়ের পথে’ ছবিটি পরিচালনা করে। বিমল রায়ের জহুরির চোখ জহরকে চিনতে ভুল করল না। নিউ থিয়েটার্সের ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে সুযোগ পেলেন জহর। আর এই ‘অঞ্জনগড়’ ছবিটাই দর্শকদের সুযোগ করে দেয় তুলসী চক্রবর্তীর পাশাপাশি এই অভিনেতাকে আলাদা করে চিনে নিতে।
জীবনের একটা পর্যায়ে কোন দিকে যাওয়া উচিত সেটা নিয়ে হয়তো একটু দ্বিধায় ছিলেন জহর। তখন তিনি মঞ্চে ছোট ছোট কমিক স্কেচ করছেন। একদিন সাধন সরকারকে জিজ্ঞেস করলেন,‘সাধন, কোন পথে যাব, সিরিয়াস না কমেডি?’ সাধনবাবু তাঁকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘জহর, কমেডি তোমার সহজাত। ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাকে তোমার দ্বিধাহীনভাবে ব্যবহার করাই উচিত।’ এই উপদেশটা যে শুনেছিলেন জহর, তার জন্য বাংলা ছবির দর্শকরাও ভাগ্যবান।
স্টেজ বা অভিনয়ে জহরের দাপট ছিলই। ভয় ছিল একটা বিষয়েই। দারিদ্র্যে।
তাঁকে নায়ক করে বেশ কয়েকটি ছবি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু জহর রায়ের একপ্রকার মন্দ ভাগ্য বলা যায় যে, তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বা তুলসী চক্রবর্তীর মতো একটা বা দুটো অথর ব্যাকড চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ কোনওদিন পাননি। আসলে তাঁর অভিনয়ের মজাটাই এমন ছিল যে, তিনি একটু সুযোগ পেলেই চরিত্রটিকে নিজের মতো করে গড়ে নিতেন। হাত পা নাড়িয়ে অভিনয় করাটা একরকম। আর আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ একটা চরিত্রকে ছোট ছোট ডিটেল মারফত উল্লেখযোগ্য করে নেওয়া সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা আর্ট। সেই ‘আর্ট’-এ জহর রায় ছিলেন ‘মাস্টার’।
সত্যজিতের ‘পরশ পাথর’ ছবিটার কথা ভাবুন। তুলসী চক্রবর্তীর বাড়িতে কাজের লোকের ভূমিকায় ব্রজহরি। কী ছোট্ট একটা রোল। খুচরো ওই সিন পেয়ে কী কাণ্ডটাই না করলেন জহর। তুলসী উঠে পায়চারি করছেন পাথরটা নিয়ে। আর ‘সোনা’, ‘সোনা’ বলে আপনমনে হেসে উঠছেন। তুলসী খুব গোপনে দেখতে চাইছেন পাথরটার ছোঁয়ায় লোহা আসলে সত্যিই সোনা হয় কি না। তিনি পরীক্ষাটা করতে যাবেন এমন সময় ঘরে ব্রজহরির প্রবেশ। দর্শকের চোখ তুলসী চক্রবর্তীর দিকে, কেমন করে তিনি তাঁর ইচ্ছেকে লুকিয়ে রাখেন। তাঁর হাতের দিকেই সকলের লক্ষ্য। এদিকে জহর ঢুকলেন গামছা কাঁধে এক হাতে ধুনো আর অন্য হাতে পাখার বাতাস করতে করতে। কোনও সংলাপ নেই। এ তো ধুনো দেবে, অতি সাধারণ ব্যাপার। কারও চোখ যাবেই না। আর এখানেই জহর রায়ের কৃতিত্ব যে কেউ তাঁকে আলাদা করে খেয়ালই করছেন না। জহর এমনভাবে ধুনো দিতে থাকলেন যেন এটা তাঁর রোজকার অভ্যেস। ধুনো দিতে দিতে একবার ভক্তি ভরে ঠাকুরের ছবির সামনে পেন্নাম ঠুকলেন। তারপর আবার ধুনো। তুলসী খানিক বিরক্ত ব্রজহরির উপস্থিতিতে। বললেন, ‘যা যা হয়েছে হয়েছে।’ বাবু তুলসীকে খানিক অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে একটু ভ্রূ কোঁচকালেন জহর, মুখে ‘অ’। ওইটুকু সংলাপ। তারপর আবার ধুনো দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন। সহজ দৃশ্য, প্রায় পুরোটাই তুলসী চক্রবর্তীর দৃশ্য, কিন্তু তবু চোখে পড়েন জহর। বা ওই ছবিরই আর একটি দৃশ্যর কথা মনে করুন। তুলসীবাবু বুঝতে পেরেছেন বস্তুটি আসলে পরশ পাথরই। আর মাটিতে স্ত্রীর কাছে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এমনসময় হাতে বাবুর চায়ের কাপ নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঢোকেন জহর। জানেন না বাবুর কী হয়েছে, কিন্তু বাবুকে ওরকমভাবে কাঁদতে দেখে তাঁরও যেন বুক ঠেলে কান্না আসে। ঠোঁট উল্টে তিনিও কাঁদতে থাকেন, হাতের কাপ থরথর করে কাঁপে। ছোট্ট একটা টাচ, কাপটা কাঁপানো। জহর দৃশ্যটাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন সেখানেই।
এই ‘পরশ পাথর’ ছবির সেটেই জহর রায়ের কথা শুনে আকাশ ফাটানো হাসি হেসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। শ্যুটিংয়ের ব্রেকে নির্ভেজাল আড্ডা চলছিল। সবাই বেশ খোশমেজাজে। শিল্পী, কলাকুশলীরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। রয়েছেন পরিচালক সত্যজিৎও। বয়স নিয়ে কথা উঠল। কার কত বয়স এই নিয়ে সকলে হিসেব কষতে বসলেন। কথায় কথায় জানা গেল, সত্যজিৎ রায়ের থেকে বছর দু’য়েকের বড় জহর রায়। জহর জন্মেছেন ১৯১৯ সালে, আর সত্যজিতের জন্মসাল ১৯২১। তাই শুনে তো সত্যজিৎ অবাক। বলে ওঠেন, ‘এ কী কথা জহরবাবু, আপনি তো দেখছি আমার থেকে দু’বছরের বড়। তাহলে আমাকে মানিকদা বলে ডাকেন কেন?’ জহর সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘ঠিক কথা। আমি আপনার থেকে এজে বড়। কিন্তু আপনি আমার থেকে ইমেজে অনেক অনেক বড়। তাইতো আপনাকে মানিকদা বলি।’ জহরের মুখে এইরকম পানিং শুনে হা হা করে হেসে উঠেছিলেন সত্যজিৎ।
‘অঞ্জনগড়’ ছবিটায় সুযোগ পাওয়ার আগে জহরের এমনও দিন গিয়েছে যে, দু’বেলা পেট পুরে খেতে পাননি। একবেলা খেয়ে কাজের সন্ধানে বেরতে হয়েছে। একটা সময় ঠিক করে ফেলেছিলেন, অনেক হয়েছে আবার সব ছেড়েছুড়ে পাটনাতেই ফিরে দর্জির দোকানে বসবেন। ঠিক তখনই মির্জাপুর স্ট্রিটে এক চায়ের দোকানে তাঁর সঙ্গে নরেনবাবুর আলাপ হয়। আর এই নরেনবাবুর ভরসাতেই মত বদলান জহর। কলকাতায় থেকে যাওয়াটাই মনস্থির করেন।
জ্যোতিষবিদ্যায় একদমই বিশ্বাস ছিল না জহর রায়ের। কিন্তু এজি বেঙ্গলের কর্মী, অবসর সময় হাত দেখে সময় অতিবাহিত করা নরেনবাবুই তাঁর ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠলেন। একদিন মির্জাপুর স্ট্রিটের এক চায়ের দোকানে মনমরা হয়ে বসে আছেন জহর রায়। মনে মনে ভাবছেন এত চেষ্টা করছেন, তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এমনসময় নরেনবাবু নিজে যেচে আলাপ করে তাঁর হাত দেখতে চাইলেন। প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না জহর। পরে ভাবলেন, লোকটা যখন নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে এসে হাত দেখতে চাইছে, দেখাই যাক না একবার। ক্ষতি কী! অনেকক্ষণ ধরে খুব মনযোগ দিয়ে জহরের হাত দেখে নরেবাবু বললেন, আপনার তো সাংঘাতিক হাত মশাই। ঠিকুজি কোষ্ঠী কিছু আছে আপনার? সেসব নেই শুনেও দমলেন না ভদ্রলোক। হাতিবাগানের এক জায়গার ঠিকানা দিলেন। সেখান থেকে একটা কোষ্ঠী তৈরি করিয়ে নিয়ে জহরকে তাঁর সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে বললেন। জহর রায়ের কী হল কে জানে, নগদ টাকা দিয়ে কোষ্ঠী তৈরি করে একদিন সাতসকালে হাজির হলেন নরেনবাবুর বাড়ি। অনেকক্ষণ ধরে কোষ্ঠীবিচার করে নরেনবাবু মন্তব্য করেছিলেন, ‘পাটনা ফিরে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দাও ভায়া। এই কলকাতা শহরেই একদিন তোমাকে নিয়ে এমন মাতামাতি হবে যে টাকা রাখবার জায়গা পাবে না।’ ভদ্রলোকের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছিল বিলক্ষণ। মাস ছয়েকের মধ্যেই দু-তিনটে ছবিতে সই করে ফেললেন জহর। হাতে কিছু নগদও চলে এল। একদিন মিষ্টি কিনে জহর হাজির হলেন তাঁর বাড়ি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আর দেখা হল না। গিয়ে শুনলেন, মাস দু’য়েক আগে ধর্মতলায় ট্রামের নীচে চাপা পড়েছেন জহর রায়ের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নরেন।
তবে জহর রায়ের জ্যোতিষচর্চায় আগ্রহ না থাকলেও তিনি যে ঈশ্বরভক্ত ছিলেন, একথা অনেকেরই অজানা। জহরের ঈশ্বরপ্রীতির কথা বলতে গিয়ে তাঁর ছোট মেয়ে ‘কল্যাণী’ অনেক পরে জানিয়েছিলেন, ‘বাবাকে নিয়ে কথা উঠলেই সকলে তাঁর মদ্যপানের কথা বলেন। কিন্তু বিখ্যাত মানুষদের মতো সাধারণ মানুষরাও তো অনেকে পানাসক্ত থাকেন। বাবা মদ্যপান করলেও কখনও আমাদের প্রতি অবহেলা করতেন না। সবসময় চাইতেন তাঁর পরিবার যেন ভালো থাকে। তাই নিজের হাতে সব কিছু তদারক করতেন। তেমনই তাঁর ঈশ্বরভক্তিও ছিল প্রবল। বাবার উপাসনার কথা অনেকেই জানেন না। শ্যুটিংই হোক বা ফাংশন বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে বাইরে যাওয়াই হোক, তিনি কিন্তু সবসময় ঠাকুরের ছবি কিনে আনতেন। ঘরে কোনও ঠাকুরের ছবি বাদ ছিল না। তবে বাবা ছিলেন একনিষ্ঠ কালীভক্ত।’
ঈশ্বরপ্রীতির জন্যই হয়তো জহর রায়ের জীবনে সবসময় কোনও না কোনও মানুষ এসেছেন পথপ্রদর্শক হয়ে। নরেনবাবুর মতোই তাঁর জীবনে এরকম আর একজন হলেন রঙ্গশ্রীর সাধন সরকার। ‘সাহারা’ ছায়াছবির সংলাপ লিখছেন সাহিত্যক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ছবির নায়ক ছিলেন সাধন সরকার। তাই নারায়ণবাবুর বাড়িতে তাঁর যাতায়াত লেগেই থাকত। এছাড়া নতুন নাটকের ব্যাপার তো ছিলই। একদিন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে সাধন দেখেন জহর তাঁর ঘরে বসে রয়েছেন। জহরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়ে নারায়ণবাবু বলেন, ‘খুব হাসাতে পারে জহর। মনে হয় কমেডিয়ান হিসেবে খুব নাম করবে একদিন।’ তখন সাধন সরকার বলেন, ‘সাধনা করতে করতেই তো মানুষ সিদ্ধ হয়। আবার সিদ্ধ হওয়ার পরও সাধনা করতে করতে কোনও ফাঁকে একটা ‘প্র’ এসে ওই সিদ্ধর ঠিক আগে জুড়ে বসলে মানুষটা হয়ে যায় প্রসিদ্ধ।’ কথাটা শুনে জহর হো হো করে হাসতে লাগলেন। তখন নারায়ণবাবু জহরকে বলেন, কী হে তোমার সেই চার্লির ‘গ্রেট ডিক্টেটরটা সাধনকে একবার দেখিয়ে দাও তো।’ জহর কোনও ইতঃস্তত না করেই উঠে দাঁড়িয়ে চার্লি হয়ে গেলেন।
মুগ্ধ সাধন সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণবাবুকে বলেন, ‘নারাণদা সম্ভব হলে জহরবাবুর এই গ্রেট ডিক্টেটর সাহারায় পার্টির দৃশ্যে ফিট করে দিন না।’ হয়েছিলও তাই।
জহর রঙ্গশ্রীর সভ্য হওয়ার পর একদিন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়েরই লেখা ‘রামমোহন’ নাটকের মহলা চলছে। রামমোহনের জীবন নিয়ে নাটক ভারতবর্ষে সেটাই প্রথম। জহর পেয়েছিলেন ডেভিড হেয়ারের চরিত্র। ছোট্ট রোল। কিন্তু ওইটুকু পার্ট কী যত্ন করেই না করতেন জহর! পারফেক্ট করার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন। পার্টের একটা জায়গায় ঠিক সাধন সরকারের মতো করে বলতে চাইতেন তিনি। আর সেটা শেখার জন্য রোজ সকালে এক ঠোঙা জিলিপি হাতে সাধনের বাড়ি পৌঁছে যেতেন জহর। তাঁকে ডেকে এনে ক্লাব খুলিয়ে চলত ডেভিড হেয়ার হয়ে ওঠা আর জিলিপি খাওয়া।
রামমোহনের মহলা শেষে সাধন একদিন জহরকে ডেকে বলেন, ‘জহর তোমার কপালটা আর একটু চওড়া হলে ডেভিড হেয়ার ভালো মানাতো।’ সেই কথার কোনও উত্তর দেননি জহর। অভিনয়ের দিন মাথায় একটা ওস্তাদি টুপি পরে শ্রীরঙ্গমে এসে হাজি হলেন। সাধনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে টুপিটা খুললেন। জহরকে সেইরূপে দেখে সাধন তো অবাক! কপালের ওপরে অনেকটা অংশ কামিয়ে ফেলেছেন তিনি। সাধন কিছু বলার আগেই জহর বলে ওঠেন, ‘কপালকে চওড়া করে ফেলেছি। কী এবার ডেভিড হেয়ার লাগছে তো!’
আমাদের অনেকেরই ধারণা হাসি আমাদের জীবনে খানিকটা অতিরঞ্জিত বস্তু। যেন পানপাত্রে উপচে পড়া ফেনা। দেখতেই ভালো লাগে, কিন্তু ঠোঁটে তেমন প্রয়োজন নেই। একবার ভাবুন, ‘সুবর্ণরেখার’ মতো গম্ভীর ও বিষণ্ণ ছবিতে জহর রায় যদি নিয়তিতাড়িত হয়ে মুখুজ্জেবাবু রূপে ধরা না দিতেন, তাহলে ঋত্বিক ঘটকের মহাপ্রস্থানের পথ সুগম হতো কী! জহর রায় রূপী ওই মুখুজ্জেমশাই হলেন নরকের দেবদূত। তিনি না থাকলে যে বাংলা সিনেমার অনেক রান্নাই পানসে হয়ে যেত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অভিনয় ছাড়াও তাঁর জীবনে ছিল বই সংগ্রহের নেশা। জহর রায়ের বই সংগ্রহের মজার কৌশলের কথা জানা যায় তাঁর এক সময়ের সহকর্মী ধীমান চক্রবর্তী’র স্মৃতিচারণে। একদিন তিনি অমিয় নিবাসে গিয়েছেন, সেই সময় জহর ঘরে ছিলেন না। ধীমান তখন আলমারি থেকে বিভিন্ন বই বের করে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করেন জহর। ঢুকেই তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বইগুলো ভালো লেগেছে? বাড়ি নিয়ে যাবি?’ ধীমান বললেন, ‘হ্যাঁ, দু’-তিনটে বেশ ইন্টারেস্টিং।’ জহর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘একদম নয়। গ্লাস গ্লাস চা এনে দিচ্ছি। বিস্কুটও যত ইচ্ছে খাও। যতক্ষণ খুশি থাক। কিন্তু বই নিয়ে যাওয়া নেই। বই কেউ নিয়ে গেলে আর ফেরত দেয় না।’ ধীমান বলেন, ‘দাদা, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এমনটা হবে না।’ শুনে জহর হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুই কী গ্যারান্টি দিবি রে! এখানে যত বই দেখছিস তার অনেকগুলো আমার এই উপায়েই সংগ্রহ করা।’
ভারি মজার মানুষ ছিলেন জহর। নিজের ছেলেমেয়েদের যাবতীয় দায়িত্ব স্ত্রী কমলাদেবীর উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতেন। কালীমায়ের বড় ভক্ত ছিলেন। ছোট মেয়ে কল্যাণীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। মাঝে মাঝে এসে বলতেন, ‘তুমি আমাকে কোলে নেবে তো মা?’ উত্তরে কল্যাণী তখন বলতেন, ‘আমি কী করে কোলে নেব তোমাকে, আমি তো অনেক ছোট!’ তখন অবাক জহর প্রশ্ন করতেন, ‘তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়?’
পাটনাতে নিজের বাড়ি বা মধুপুরে বোনেদের বাড়ি খুব একটা না গেলেও নিজের শ্বশুরবাড়ি যেতেন নিয়মিত। সেখানে তাঁর কদর ছিল খুব। জহরের বাবা সতু রায়ের গান-বাজনার চর্চা ছিল। ছোট বোন হাসি ভট্টাচার্য ও ভগ্নীপতি প্রণব ভট্টাচার্য পাটনার রেডিও স্টেশনে গান গাইতেন। তাঁদের মেয়ে সুমিতা চক্রবর্তী জগজিৎ সিং-চিত্রা সিংয়ের কাছে গান শিখেছেন। জহরের এই পারিবারিক ঐতিহ্যের জন্যও কমলাদেবীর বাড়িতে তাঁর খাতির ছিল। আর জামাইটিও শ্বশুরবাড়ির সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন। এই সাঙ্গীতিক পরিবেশের গুণটা জহরের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ‘সাহেব বিবি তোমরা বাবু, আমরা গোলাম’ আর ‘রাবণ রাজা পেয়েছে কেমন কেমন সাজা’ নামে দুটো গান লিখেছিলেন জহর। সেগুলো সুর দিয়েছিলেন তাঁর সুরকার বন্ধু বলরাম দাস। গেয়েছিলেন কার্তিক কুমার ও বসন্ত কুমার। রেকর্ডিংও হয়েছিল। যদিও রেকর্ডটা আর পাওয়া যায় না। পরে তাঁর স্ত্রী কল্যাণীদেবী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সেই কাজেরও দাম পেলেন না। উনি যে ভালো গান লিখতে পারতেন, সেটা কতজন জানে বলুন তো!’
আর তাঁর মৃত্যুর ৪৩ বছর পেরিয়ে এসেও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আক্ষেপ – ‘এই ভানু-জহর কোনওদিনই তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পেলেন না। কেউই তাঁদের জন্য কিছু করেনি। এ নিশ্চিত বাঙালির লজ্জা!’ এই ‘লজ্জা’ কোনদিন ঘুচবে কি?
(তথ্যসূত্র:
১- হাসি-রাজ ভানু-জহর, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, পাণ্ডুলিপি (২০১১)।
২- Jahar Roy: Ten legendary comedy actors of Bengali cinema, The Times of India, May 7, 2018.
৩- আজও তারা জ্বলে, বর্তমান পত্রিকা।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত