একে তো আগে থেকেই মন্দায় ভুগছিল বাজার। তার ওপর থাবা বসিয়েছে করোনা। আর এই জোড়া ফলায় ২০২০ সালের প্রথম দু’টি ত্রৈমাসিকেই অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে, তাতে এ বছর তার বহর সঙ্কুচিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে যখন ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড তখন এমনই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছে মুডিজ ইনভেস্টর্স সার্ভিস-সহ একাধিক মূল্যায়ন সংস্থা। এবার দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কও আশঙ্কার ডঙ্কা বাজিয়ে দিল। বাজার আরও ডুববে মেনে নিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বৃহস্পতিবার রাতেই আমরা এটা জেনে গিয়েছি।
প্রসঙ্গত, শক্তিকান্ত দাস আরও সুদ কমানোর কথা না বলায় অবশ্য অবসরপ্রাপ্তরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু সত্যি কি অবসরপ্রাপ্তদের কোনও লাভ হয়েছে? উত্তরটা এক কথায়— ‘না’। উল্টে কেউ তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা অবসরের পর ব্যাঙ্কের আমানত হিসাবে রেখে সুদ যদি ৬ শতাংশের একটু উপরে পেয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে— তিনি ব্যাঙ্ককেই টাকা দিচ্ছেন নিজের সঞ্চয় রাখার জন্য। কারণ প্রকৃত সুদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন শূন্যের তলায়!
তত্ত্ব বলে— সুদের হার থেকে মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিলে যা থাকে তা হল প্রকৃত সুদের হার। কারণ মূল্যবৃদ্ধির হার, সুদের হার থেকে বাদ দিলে আমরা যেটা পাই সেটা হল সেই সুদ যেটা জিনিসপত্রের দাম এক থাকলে আমরা হাতে পেতাম। তাই আজ যদি ৬ শতাংশ সুদের হার হয়, আর জিনিসপত্রের দাম বাড়ে ওই ৬ শতাংশ হারেই— তা হলে কিন্তু প্রকৃত সুদের হার গিয়ে দাঁড়ায় ওই শূন্যতে। আর দাম বাড়ার হার আরও চড়লে তো সুদের হার শূন্যের তলায়। আর সেটা হলে সঞ্চয়ের থেকে ঋণ নেওয়াটাই লাভের। কারণ প্রকৃত সুদের হার শূন্যের তলায় থাকলে কাউকে টাকা দিতে গেলে তাঁকে টাকা নেওয়ার জন্য নিজের পকেট থেকে আরও কিছু দিতে হচ্ছে।
নীতি নির্ধারকরা ভেবেছিলেন এভাবেই ঘুরিয়ে দেবেন অর্থনীতিকে। কিন্তু মাথায় রাখেননি একটা প্রয়োজনীয় কথা। বাজার ঘোরে বিনিয়োগে। সত্যি। বিনিয়োগ খরচ কম হলে, লোকে বেশি করে বিনিয়োগ করতে চাইতে পারে। সত্যি। কিন্তু তারও আগে দরকার বাজারের ওপর আস্থা। আর সেই আস্থা তৈরি করতেই ব্যর্থ হয়েছেন নীতি নির্ধারকরা। বলছে সরকারি তথ্যই। আর তার সমর্থন করছে শীর্ষ ব্যাঙ্কেও।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঋণে তড়িঘড়ি করে সুদ কমানোর পিছনে যুক্তি ছিল একটাই। সঞ্চয়ের বদলে আমার আপনার টাকাকে বিনিয়োগে ঠেলা। সোজা যুক্তি হল— বিনিয়োগের খরচ কমলে বিনিয়োগ বাড়বে। আর টাকার জোগান আসবে আমার আপনার সঞ্চয় থেকে। কিন্তু বিনিয়োগ যে করবে, বাজার থেকে সে তো আস্থা খুঁজবে! বিনিয়োগকারী যদি বাজারে আস্থা না পান, তা হলে বিনিয়োগ করে নিজেকে বিপদে কেন ফেলবেন?
চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা দেখাচ্ছে— ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে সেই যে ক্রেতাদের বাজারের ওপর আস্থা পড়তে শুরু করেছে, তা কিন্তু একই ভাবে নিম্নগামীই থেকে গিয়েছে। কোভিডের চাপে তা খানিকটা তীক্ষ্ণ হয়েছে বটে, কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাস, মানে লকডাউনের আগেও, এই পতনের গ্রাফের পথ পরিবর্তনের কোনও চিহ্ন ছিল না।
এবার ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ের হারের সঙ্গে, সুদ কমা এবং ক্রেতার আস্থা যোগ করলে দেখা যাবে সুদের হার কমলেও মানুষ সেই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখছেন। কারণ, বাজারের ওপর আর কারও কোনও ভরসা নেই। তাই সুদের হার যাই হোক না কেন, ঝুঁকি বাড়িয়ে বেশি আয়ের রাস্তায় না হাঁটার থেকে ঘরের টাকা ঘরে (পড়ুন ব্যাঙ্কে) রাখাই শ্রেয় মনে করছেন। শক্তিকান্ত দাস এ সব তথ্য হাতে নিয়েই তাঁর আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। যে আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন আগেই ব্যক্ত করেছিলেন, আর নীতি নির্ধারকরা তা ক্রমাগত উড়িয়ে দিয়ে এসেছিলেন।