’৫১ সালে চলে যাওয়া যাক। শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। শান্তিনিকেতন পৌষমেলায় গিয়ে তাঁর আলাপ হয়েছিল তিন যুবকের সঙ্গে। পরে যা গড়ায় মিত্রতায়। তাঁরা হলেন – সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও শুভময় ঘোষ। এঁদের মধ্যে অমিতাভ পূর্ণেন্দুর স্কেচবুকে রেখার ভুবন দেখে তাঁকে নিয়ে গেলেন রামকিঙ্করের কাছে।
‘‘কিঙ্করদা মানে রামকিঙ্কর? শান্তিনিকেতনের বাগানে যাঁর ওইসব দুর্ধর্ষ মূর্তি? সর্বনাশ! অত বড় শিল্পীর কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছ কেন?’’ – জিজ্ঞেস করেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী।
‘‘মানুষটাকে আগে দেখো, তারপর বুঝতে পারবে কেন নিয়ে যাচ্ছি।’’ – উত্তর দিয়েছিলেন অমিতাভ চৌধুরী।
কেমন দেখেছিলেন পূর্ণেন্দু রামকিঙ্করের ভূমণ্ডল?
ছাত্র শঙ্খ চৌধুরীর ছেড়ে দেওয়া রতনপল্লির মাটির বাড়িতে তখন উলঢাল রামকিঙ্করের ঘর-দুয়ার। পূর্ণেন্দু লিখছেন, ‘‘কুঁড়েঘরের মতো একটা ঘর। ভিতরে একটা চৌকি। চৌকির উপর অতি সাধারণ বিছানা। দেয়ালে দেয়ালে ঠেসান-দিয়ে-রাখা দরজা-সমান অয়েল পেন্টিং। এদিকে সেদিকে ভাস্কর্যের টুকরো-টাকরা। জনৈকা স্বাস্থ্যবতী যুবতীর মুখ। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে চোখটা চলে গেল চৌকির নীচেয়। সেখানে মেঝের উপর ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে হাজার খানেক কিংবা তারও বেশী চিঠিপত্র, খাম-পোস্টকার্ড-পার্সেল-প্যাকেট সব মিলিয়ে। মনে হল, অনেক চিঠির গায়ে প্রাপকের হাতের ছোঁয়াটুকুও পড়েনি এখনও।’’
আর মানুষটা?
‘‘কালো পাথরের একটি জীবন্ত ভাস্কর্য। খালি পা। পরনে আধময়লা লুঙ্গি কিংবা খাটো-ঝুলের পাজামা, যে রকমের পাজামা পরে টোকা মাথায় নন্দলাল হেঁটে যান শালবীথির ছায়ায়। শক্ত চোয়াল। সামনে এগিয়ে আসা ঠোঁট। পেশীবহুল আঁটসাট শরীর। চোখ দুটো যেন বুঁদ হয়ে আছে কিসের নেশায়। যে-রকম রোজ দেখা যায় সে রকম কোনও মানুষ নয় যেন।’’
পূর্ণেন্দুর করা স্কেচ দেখতে দেখতে একটিতে এসে থামলেন কিঙ্কর। সেই স্কেচে পৌষমেলার মাঠ, মাঠে দাঁড়িয়ে মালকোচা-মারা এক শিশু সাঁওতাল। তার এক হাতে একটা বাঁশি নিয়ে বাজাচ্ছে। অন্য একটি বাঁশি গুঁজে রাখা দুই জঙ্ঘার ফাঁকে। কিঙ্কর সেটা দেখিয়ে বললেন, ‘‘এটা বাদ দেওয়া উচিত ছিল। ঠিক হয়নি।’’
পূর্ণেন্দু বলেন, ‘‘ছেলেটার ওইখানে একটা বাঁশি ছিল।’’
এবার কিঙ্কর তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘‘সেটা তো বুঝতে পেরেছি। তুমি মন থেকে আঁকোনি। কিন্তু রিয়ালিটির সবটাই কপি করতে নেই।’’
সেদিন রামকিঙ্কর অমিতাভ-পূর্ণেন্দুদের তাঁর পাহাড়ি শহর শিলং সিরিজের ছবি দেখিয়েছিলেন। ওয়াশে আঁকা সে সব অরণ্যগন্ধী, এলিমেন্টাল ছবি দেখে পূর্ণেন্দুর মনে হয়েছিল, ‘‘শিলং যেন নড়ছে, চড়ছে, দুলছে গাছ, হাঁটছে মেঘ, রঙ বদলাচ্ছে রোদ, গাছ শিকড় নামাচ্ছে মাটিতে, খসে পড়ছে কিছু, কেউ যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে কারও সঙ্গে আলিঙ্গনে-মন্থনে।’
সবাই মারা গেছে, আমার দাদা-বোন-বাবা-মা – সবাই, সবাই। … মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়ই উদাসীন। একজন শিল্পী যতক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোনও ভাবেই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
নেশায় চুরমার হয়ে জীবন আর মৃত্যুর দ্বৈরথকে এ ভাবেই দেখতেন কিঙ্কর।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বন্ধু সমীর সেনগুপ্তকে নিয়ে এক বাসন্তিক বিকেলে হাজির হলেন শান্তিনিকেতন।
রিকশা থামল অনিবার্য ভাবে বাংলা মদের দোকান ‘আকর্ষণী’-তে। রিকশায় উঠল দু’ বোতল বাংলা। গন্তব্য রতনপল্লি, রামকিঙ্করের ডেরা।
‘‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা …’’
শক্তির হেঁড়ে গলায় হাঁক শুনে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাইরে এসেছিলেন রামকিঙ্কর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
‘‘আরে কবি এসেচিস – আয়, আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে? …’’
এর পরের আসরের বর্ণনা দিতে সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘‘শুয়োরপোড়া এল, ফুরিয়ে গেল, একটি রিকশওলাকে ধরে আরও দুটো বোতল আনানো হল, সঙ্গে ছোলাভাজা, সে দুটোও ফুরিয়ে গেল। আবারও দুটো আনানো হল বেশি পয়সা দিয়ে, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত বিড়ি, অফুরন্ত কথা, স্খলিত গলায় অফুরন্ত রবীন্দ্রনাথের গান।’’
ঢের রাতে ঘুম ভেঙেছিল সমীরের। অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে কোনও মতে চৌকাঠ পেরিয়ে দেখলেন, রামকিঙ্কর একটা টুলের উপর বসে রয়েছেন। উপর থেকে একটা লন্ঠন ঝুলছে। লুঙ্গিটা কোমর থেকে যে খুলে পড়েছে কিঙ্করের, সে খেয়াল নেই! সম্পূর্ণ নগ্ন! আর তাঁর সামনে একটা অসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন কিঙ্কর।
যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না।
রবীন্দ্রনাথের এই কথা বারবার আওড়াতেন তিনি। এ ছিল যেন কিঙ্করের জপমালা।
’৭৫ সাল। ঋত্বিক ঘটক শান্তিনিকেতন গিয়ে ১৬ মি.মি. রঙিন একটি তথ্যচিত্র করলেন কিঙ্করকে নিয়ে। অসুস্থ, তবু গেলেন। প্রতি ফ্রেমে নিজের মতো করে ভেঙেচুরে দেখালেন ভাস্করকে। গোড়ার দিকে একটি ফ্রেমে ক্লোজআপে দেখা গেল বুদ্ধের মুখ। ব্যাকড্রপে পাখোয়াজ।
একটু পরেই ফ্রেমে ঢুকল অদূরে ক্ষীণ কটি, দীর্ঘাঙ্গী বনবালা – সুজাতা। ইউক্যালিপটাসের ছায়া সুনিবিড় পথে মাথায় পায়েসের রেকাব নিয়ে সে যেন হেঁটে চলেছে।
মাদল আর বাঁশির আবহে কোপাই নদীর ধারে আদিবাসী গ্রাম, অনম্র বুক – সুঠাম আর ভারী কোমরের সাঁওতাল মেয়ে – ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে ঋত্বিক যেন কিঙ্করের রোদছায়া মাখা আদুল ক্যানভাস এঁকে চলেছেন। একটি ফ্রেমে ধরা দিলেন দুই শিল্পী। জড়ানো গলায় ঋত্বিকের সংলাপ, ‘‘কিঙ্করদা …!’’
‘‘হুঁ।’’
‘‘আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’
রামকিঙ্কর স্মৃতিতাড়িত হয়ে একচোট হাসলেন। তারপর বলেন, বলে চলেন, ‘‘উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’
ছবি এগোয়, কিন্তু শেষ হয় না। দৃশ্য ফুরিয়ে যায়। প্রায় পুরো ছবির শ্যুটিং শেষ করে প্রাথমিক সম্পাদনার পর ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাকের কাজ শুরুর মুখেই চিরবিদায় নিলেন ঋত্বিক। অসমাপ্ত তথ্যচিত্রের স্ক্রিনজুড়ে একসময় নেমে আসে দুই শিল্পীর মুখোমুখি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শোনা যায় ঋত্বিক আর কিঙ্করের কথা।
ঋত্বিক প্রশ্ন করেন, ‘‘এই যে আপনার চাল ভেঙে পড়ছে, জল পড়ছে, কী ভাবে সারাবার চেষ্টা করছেন আপনি?’’
কিঙ্কর বলেন, ‘‘পেনশনের টাকা যেটুকু পাই। সেইটুকু থেকে করছি আর কী!’’
‘‘সেটা কি ছবি টাঙিয়ে করা হচ্ছে?’’
কিঙ্কর হেসে ফেলেন। বলেন, ‘‘সেও আছে।’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘বড় বড় ক্যানভাস যেগুলো, সেগুলো উলটে দেওয়া আছে। অয়েল কালার কিনা। উপরে কোনও ক্ষতি হবে না। বৃষ্টি পড়ে কিনা, তাই ওগুলো ঝুলিয়ে দিই। … এগজিবিশনের জন্য ক্যানভাসগুলি নিয়ে যেতে হল, তখন আর কী ঝোলাব? …’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘খড় কিনতে হত, কিন্তু যেটুকু টাকা পাই …।’’
এখন কোনও কাজ নেই। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন তো আর আঁকতেও পারি না। … চোখে দেখতে পাই না কিছুই। পড়তেও পারি না, কেউ পড়ে দিলে শুনি। কেউ ধরলে হাঁটতে পারি। সমর্থ বয়সের অত্যাচার তার শোধ তুলে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়। পাগল পাগল লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। একেবারে বাতিল হয়ে গেছি। চোখ চলছে না, হাত চলছে না, চোখ অন্ধ। মনে মনে আঁকছি।
রামকিঙ্করের এক প্রিয় ছাত্র, শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রত্যেক বুধবার তাঁর সঙ্গে আমরা আশেপাশের গ্রামে চলে যেতাম কাজ করতে। সঙ্গে সারা দিনের খাবার, রং-তুলি-কাগজ। নিজে বসে দেখাতেন, প্রকৃতিকে কেমন ভাবে নিজের মতো করে ধরতে হয়। কেবলই হুবহু নয়—নিজের ভাবনা অনুভবেরও কেমন ভাবে প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। কিঙ্করদাকে কোনও দিন বেঁকে বসতে দেখিনি। শিরদাঁড়া টানটান করে সোজা হয়ে বসতেন। ছবি আঁকায়, মূর্তি গড়ায়, গান গাওয়ায় যে বলিষ্ঠতা, যে তীক্ষ্ণতা, যে শৌর্য কাজ করত, নিজের চলাফেরা, কথা বলা বা হাঁটাচলার প্রতিটি ভঙ্গিতে সেই লাবণ্য, সেই সৌন্দর্যই স্পষ্ট হয়ে ঝরে পড়ত।’’
রামকিঙ্করের শিল্পকর্মের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে আদিবাসী জীবন। তাঁর বিখ্যাত সাঁওতাল পরিবারের মূর্তিতে তিনি দেখিয়েছেন, এক সাঁওতাল যুবক তাঁর সঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে ঘরমুখো। বউয়ের কোমরে একটি বাচ্চা অন্য একটি বাঁকেতে। একটি কুকুরও হেঁটে চলেছে ওদের সঙ্গে। এ ছাড়া রয়েছে সংসারের অতি সামান্য কিছু উপকরণ। অত সামান্য প্রাপ্তিতেই যেন আনন্দ উপচে পড়ছে তাঁদের – চলার মধ্যে কী এক দৃপ্ত ভঙ্গিমা আর ঘরে ফেরার সুখানুভূতি!
আদিবাসী সমাজের বিয়ে, মহিলার ধান মাড়াইয়ের দৃশ্যপট – গ্রামজীবনের এমন ছবিই তাঁকে টানত বেশি। তাঁর ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া সবই ছিল প্রাণের আনন্দে। কারও ইচ্ছাপূরণের তাগিদে নয়।
ছাত্র থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে কলাভবনের অধ্যক্ষ। মূর্তি গড়েছেন, ছবি এঁকেছেন অসংখ্য। নুড়িপাথর আর সিমেন্ট-বালির মিশেল দিয়ে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সব মূর্তি। দারিদ্র্যের মধ্যেও হাসি ছিল, প্রাণখোলা হাসিতে সবার প্রাণ ভরিয়ে দিতেন। উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান, লালন ফকিরের গান –
‘‘ও আমার চাঁদের আলো,
আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার
পাতায় পাতায় ডালে ডালে।’’
আর একটি –
‘‘আজ তারায় তারায়
দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে
নিদ্রাবিহীন গগনতলে।’’
এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটি গাইতে ভালবাসতেন তিনি।
নিত্য ভাঙা-গড়ার খেলায় তাঁর সহজিয়া জীবন নিয়ে ক্রমশই জলঘোলা হল শান্তিনিকেতনে। তাঁর দরাজ গলার রবীন্দ্রনাথের গান শুনল না কেউ! বরং শান্তিনিকেতনী তর্ক তুলল তাঁর জীবনচর্যা নিয়ে। কিঙ্করের তখন ঘরে-বাইরে ‘জীবন্ত মানুষের নেশা’।
একবার, দিল্লি যাওয়ার পথে এক আদিবাসী রমণীর যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে তাঁর সঙ্গে নেমে গেলেন অজানা স্টেশনে। হারিয়ে গেলেন যেন। খবর নেই বহুকাল! হঠাৎ করে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছল ঠিকানাবিহীন এক টেলিগ্রাম। তাতে কিঙ্কর জানালেন, ‘I lost myself, search myself.’
‘‘জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব। … আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।’’
নিজের সম্পর্কে নির্দ্বিধায়ায় এমন করে আর কবে, কোন ভাস্করই বা অকপট হতে পেরেছেন! মডেলদের সঙ্গে রামকিঙ্করের সম্পর্ক নিয়ে নিত্য হাওয়ায় ছড়িয়েছে গসিপ।
তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘‘সব কিছুর মধ্যে যৌনতা আছে, যৌনতা ছাড়া সব কিছুই প্রাণহীন, ঊষর!’’
সে সবের প্রসঙ্গ তুললে কখনও এড়িয়ে যাননি কিঙ্কর। কাল্পনিক নয়, মডেলদের সম্পর্কে তাঁর সে-সব সত্য-স্বীকার আর উক্তিগুলো সেকথাই বলে।
এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হল তাঁর মডেল বিনোদকে নিয়ে। তিনি উত্তর দেন, ‘‘বিনোদ, মানে বিনোদিনী? সে আমার ছাত্রী, মণিপুরী মেয়ে। একটু একটু করে শরীরের বাঁক, উপবাঁকের ভুবন চিনিয়েছিল ও-ই। আলো-অন্ধকারে ওকে ঘুরিয়েফিরিয়ে এঁকেছিলাম অনেক। এক দিন চলে গেল, মণিপুরি ভাষায় একটি নাটকও লিখেছে আমাকে নিয়ে।’’
অসমের মেয়ে নীলিমা?
‘‘নীলিমা বড়ুয়া। নষ্ট হয়ে গেল ওর পোর্ট্রেট। আঁকতে আঁকতে কত বার যে রঙ লেগেছে শরীর থেকে শরীরে … সে সব কোথায় গেল! ভুল করেছি, তখন টাকার অভাবে ভাল রঙ কাজে লাগাতে পারিনি।’’
মনে আছে এসথার জয়ন্তী জয়াপ্পাআস্বামীর কথা?
‘‘মনে থাকবে না কেন? সে তো দক্ষিণী ছাত্রী জয়া। খুব ছিপছিপে ছিল। জয়া নামটা আমারই দেওয়া। সুজাতা করেছিলাম ওকে মডেল করে।’’
ভুবনডাঙার খাঁদু?
‘‘দীর্ঘাঙ্গী খাঁদু ফিরে ফিরে এসেছে আমার ভাঙা ঘরে। সুন্দর ছিল ওর ফিগার। প্রায়ই দুপুর দুপুর আমার একলা ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার চৌকাঠ ধরে। এক কাঁখে থাকত ছেলে। সে দুধ খেত মায়ের বুকের। যে ভাবেই দাঁড়াত শরীরে নৃত্যের ভঙ্গি। অজস্র স্কেচ করেছি ওর।’’
আর রাধি?
‘‘ওই তো রইল শেষ পর্যন্ত আমার কাছে। ওর সঙ্গে মেশা নিয়ে অনেকে আপত্তি করেছিল। ডেকে পাঠিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর কর্তারাও। তাও ওকে ছাড়িনি। ও ছাড়েনি আমাকেও। আসলে রাধারানীর সঙ্গে আমার জড়ামড়ি সম্পর্ক!’’
শিল্পী রামকিঙ্করের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। তিনি রাধারানী দেবী। তাঁর জন্ম বর্ধমানের আউশগ্রামের গুসকরার কাছে কোনও এক গ্রামে। ছোটবেলায় অজয়ের বন্যায় সব ধুয়ে মুছে গেলে বাবার সঙ্গে গোটা পরিবারটি উঠে এসে বসবাস করতে শুরু করে ভেদিয়ার রেলপাড়ে। সেখান থেকেই বাবার পছন্দের বোলপুরের এক মুদি দোকানের মালিক, বছর তিরিশের চণ্ডী গড়াইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাধারানীদেবীর। তখন তিনি ন’বছরের বালিকা। ভেদিয়ার গ্রাম থেকে বোলপুরে গিয়ে জীবন কাটছিল। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। বিয়ের কয়েক মাস পরেই সাংসারিক অশান্তি শুরু হয়। দিনে দিনে তা চরমে ওঠে। এ অশান্তির মাঝে বাবার কাছে ফিরে যাবেন এমন অবস্থা ছিল না রাধারানিদেবীর। কারণ, সে পরিবারেও অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
সমস্যার মেটাতে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে বোলপুরে কাজের খোঁজে এলেন রাধারানী। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা মীরাদেবীর বাড়িতে মাসমাইনে ও থাকা-খাওয়ার শর্তে কাজে বহাল হলেন। সেখানেই রাধারানীদেবী রবি ঠাকুরকে দেখেন। এখানেই প্রতিমাদেবীর সঙ্গে আলাপ হয় রাধারানীদেবীর। রাধারানীদেবীকে খুব ভালবাসতেন প্রতিমাদেবী। এক বার রাধারানীদেবীকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়ে ছিলেন, মীরাদেবী রাজি হননি।
মীরাদেবীর বাড়িতেই অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় রাধারানীদেবীর। সেখানেই প্রথম দেখা, ধুতির ওপর ফতুয়া পরা অগোছালো চেহারার মানুষটিকে। কালো, ঝাঁকড়া চুল উজ্জ্বল চোখের মানুষটি। তিনি রামকিঙ্কর বেইজ। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন। মীরাদেবীর কাছে এসে রাধারানীকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রামকিঙ্কর। এক বার নয়, বার বার। কারণ, বাড়িতে রান্না, দেখাশোনার লোক নেই। অবশেষে রাজি হন মীরাদেবী।
তবে সংসার সামলানোর পাশাপাশি, তাঁর শিল্পকর্মের সঙ্গেও জড়িয়ে গেলেন রাধারানীদেবী। রাধারানীদেবীকে নিয়ে নানা শৈল্পিক কাজ করেছেন রামকিঙ্কর। তাঁকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্যের কাজও করেছেন। সেই সময়ে দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে শান্তিনিকেতনে ঢি ঢি পড়েছিল। আপত্তিও উঠেছিল। এই খবর পৌঁছে গিয়েছিল রাধারানীদেবীর বাপেরবাড়ি পর্যন্ত। তার পর থেকে রাধারানীদেবীর বাবা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর কর্মকর্তারাও আপত্তি জানালেন! কিন্তু রামকিঙ্কর অনড়। দেশিকোত্তম পেয়েছেন রামকিঙ্কর। ছাত্ররা গিয়ে জানালেন, তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। উপাচার্যও থাকবেন সেই অনুষ্ঠানে। রামকিঙ্কর জানালেন, মঞ্চে উপাচার্য এবং তাঁর পাশে সম-মর্যাদায় রাধারানীকে আসন দিলে তবেই তিনি যাবেন। পরে সারা জীবনের সম্বলের কিছু দিয়ে ভুবনডাঙায় একটি খড়ের চালের বাড়ি রাধারানীদেবীর নামে কিনেছিলেন রামকিঙ্কর। সেটাই পরে দোতলা হয়। অনেক ভাস্কর্য সৃষ্টির সাক্ষী এই বাড়িটি এখনও রয়েছে।
রামকিঙ্করের জীবনের নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন রাধারানীদেবী। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও আছে ২১ ফুটের সেই যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। ১৯৫৪ সালে রামকিঙ্কর কুলু যাওয়ার পথে দেখলেন তাঁর পছন্দসই পাথর। ভাকড়া-নাঙাল ড্যামের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ব্লাস্ট করিয়ে পাওয়া গেল পাথরের টুকরো। ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে সেই পাথর আনাও ঝকমারি। বদলানো হল ওয়াগনের চেহারা। পাঠানকোটে এসে ব্রডগেজ ট্রেনে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে। ১৯৬৭-তে শেষ হল কাজ। রামকিঙ্কর চিঠিতে রাধারানীকে জানালেন, ‘যক্ষীটা তোমার আদলে। তোমার জন্য অনেকগুলি টাকা পেয়েছি। আমাদের বাড়ি ছেড়ে কখনও যাবে না।’
রামকিঙ্করের জীবনের বড় ভরসা হয়ে উঠেছিলেন রাধারানীদেবী। প্রতক্ষ্যদর্শীর বিবরণে পাওযায় যায়, চিকিৎসার জন্য শিল্পীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সে সময়েও রামকিঙ্কর শিশুর মতো কাকুতি মিনতি করেছিলেন রাধারানীদেবীর কাছে! সে কথাটাই বার বার বলতেন রাধারানীদেবী। শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে কলকাতায় এনে অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। হাসপাতালে ভাইপো দিবাকরকে দেখে তখন তিনি বলছেন, ‘ও দিবাকর, এসেছিস? ওই দিকে রাধারানীর বাড়ি, ওখানে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়।’ দিগভ্রান্ত তিনি, কলকাতায় খুঁজছেন রাধারানীদেবীর বাড়ি।
রামকিঙ্কর বেইজের মৃত্যুর পরে তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রির অর্থের একটা অংশ পেয়েছিলেন রাধারানী। সে টাকায় তিনি শান্তিনিকেতনের বেশ কয়েক জনকে, বাপেরবাড়ি ভেদিয়ার কয়েক জনকে সাহায্য করেছিলেন। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন রাধারানীদেবী। ১৯৮৮ সালের ১৮ই নভেম্বর রাধারানীদেবী, শিল্পীর করে দেওয়া ভুবনডাঙার বাড়িতেই শেষ মারা গিয়েছিলেন। শিল্পী রামকিঙ্কর আর রাধারানীদেবী প্রায়ই আসতেন অজয়ের কোলে বর্ধমানের ভেদিয়াতে। সেই স্মৃতি আজও আঁকড়ে আছে বর্ধমানের নাম।
‘‘রিয়ালিটির সবটাই কপি করতে নেই।’’
এত ভাঙাচোরা, এত সম্ভোগের পরও এ কথা বলতেন স্বয়ং কিঙ্কর।
রবীন্দ্রনাথের মতো রামকিঙ্করও চাননি শেষ সময় কলকাতায় চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হোক।
সর্বক্ষণের সঙ্গিনী, মডেল রাধারানী – যাঁর সঙ্গে কিঙ্করের দীর্ঘ জীবনের সম্পর্ক, তিনিও জানিয়েছিলেন, ‘‘উনি যেতে চাননি, ওঁর ভাইপো দিবাকর সই করে দিল। জোর করে ওরা নিয়ে গেল।’’
দিবাকরবাবু অবশ্য অন্য দাবি করেছিলেন, ‘‘ওঁরা আমার সই চাইছেন। একটা লিখিত অনুমতি চাইছেন। কিন্তু আমার দেবার ইচ্ছে নাই।’’
কিন্তু ডাক্তারবাবুদের কথায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘সই দিতে হল’। একরকম জোর করে কিঙ্করকে কলকাতায় আনা হয়। শান্তিনিকেতন থেকে আসার দিন তাই জড়ানো গলায় স্বজনদের বলেছিলেন, ‘‘যাচ্ছি শান্তিনিকেতন ছেড়ে। যাচ্ছি – কিন্তু আর ফিরব না। রবীন্দ্রনাথও ফেরেননি।’’
শিল্পীর যাবার বেলার কথাই সত্যি হল। ২রা আগস্ট ১৯৮০ সাল, কলকাতাতেই চলে গেলেন, রবিঠাকুরের ভাস্কর!
মৃত্যুর দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ছাত্রের হাত ধরে কিঙ্কর বললেন, ‘‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!’’
সে-ফেরা আর হল কই?
একসময় চিতা নিভে গেল।
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চাঁদের শশ্মান। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে ওপারে খোয়াই, বন-বনান্ত, কোপাই পেরিয়ে গগনতল ছুঁয়ে থাকা দিগন্ত।
একটু পরেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। মেঘের গুমোট কেটে সুদূর নীলিমায় দেখা দিল একফালি চাঁদ।
শেষ হল দাহ।
চলে গেলেন রামকিঙ্কর।
স্মৃতিবাসরে গাইতে বসে কেবলই উদাস হয়ে পড়ছেন মোহর (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)। কী গান … এমন দিনে কী শোনাবেন প্রিয় কিঙ্করদার স্মরণে?
তার আগেই নীলিমা গেয়েছিলেন, সাহানা রাগে, ‘হেরি অহরহ তোমারই বিরহ’। ভাবতে ভাবতেই মোহরের কানে ভেসে আসছিল কিঙ্করদার দরাজ গলায় গান, ‘মোর স্বপনতরীর কে তুই নেয়ে’। মনে পড়ল কিঙ্করদার প্রিয় আরও একটা গানের কথা। আশ্রমের নাটকে কত বার যে বিশুপাগল সেজেছে কিঙ্কর! তাঁর স্মরণ সন্ধ্যায় সেই গানই গাইলেন মোহর। – ‘ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার, দুখের পারাবারে’।
সুর নামল কোমলগান্ধার থেকে শুদ্ধ ঋষভে। আঁধার রাতে একলা এক পাগলের জন্য চোখের জলে তখন ভাসছে আদিগন্ত খোয়াই।
অনেক না পাওয়ার মধ্যেও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। মৃত্যুর ১০ বছর আগে ভারত সরকার শিল্পী রামকিঙ্কর বেজকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। ১৯৭৬-এ অকাদেমির ফেলো হন। বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ দেয় ১৯৭৭ সালে। এর পর ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট।
ব্যক্তিজীবন ছিল খুব অগোছালো, বন্ধনহীন। প্রেম ছিল হৃদয় পূর্ণ করে। কিন্তু তা উজাড় করে দেওয়ার মতো প্রাণস্পর্শীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কি না, কে জানে! জীবনভর যে রাধারানি ছিলেন তাঁর পাশে, জীবনের সর্বস্ব যিনি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন শিল্পীকে – তিনিই বা ঠিক কতটুকু পেয়েছিলেন, এ প্রশ্নও থেকেই যায়। যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কেন যেন তাঁরাও কখনও বুঝতে পারেননি, ‘রামকিঙ্কর’ নামের রক্তে-মাংসে গড়া এই শিল্পী মানুষটির মনের গভীরে দুঃখের নিশ্চুপ কোনও আসন পাতা ছিল কি না!
(তথ্যসূত্র:
১- দেখি নাই ফিরে, সমরেশ বসু।
২- অন্তরে বাহিরে, রামকিঙ্কর বেইজ, দীপ প্রকাশন।
৩- বিশ্বভারতী পত্রিকা, রামকিঙ্কর বেইজ সংখ্যা।
৪- শিল্প সংক্রান্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী।
৫- এক দুর্লভ মানিক, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।
৬- আমার বন্ধু শক্তি, সমীর সেনগুপ্ত।
৭- ঋত্বিক ঘটক, সুরমা ঘটক।
৮- Ramkinkar Baij: A Retrospective, 1906 – 1980; R. Siva Kumar, Delhi Art Gallery.
৯- অজানা-অচেনা শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, রাধামাধব মণ্ডল, সহযাত্রী।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত