এতদিন যা হয়নি, মোদী জমানায় এবার সেটাই হয়েছে। দেশের শিক্ষানীতিকে আমূলে বদলে ফেলছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। ‘বোর্ড পরীক্ষার চাপ কমাতে’ বুধবার নয়া শিক্ষানীতি অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। সাংবাদিকদের সামনে নতুন শিক্ষানীতির কথা ঘোষণা করতে গিয়ে সেই লক্ষ্যের কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন কেন্দ্রের স্কুলশিক্ষা সচিব। যা নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তীব্র সমালোচনা। বিরোধী নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মধ্যে প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন, এটা অসঙ্গত এবং স্বৈরতান্ত্রিক। ধন্দে পড়েছেন পড়ুয়া এবং অভিভাবকেরা। প্রশ্ন উঠছে, নতুন ব্যবস্থায় মাধ্যমিক পরীক্ষা কি পুরোপুরি অবলুপ্ত হয়ে যাবে?
নয়া শিক্ষানীতির প্রণেতাদের বক্তব্য, এক দিনের পরীক্ষায় ভবিষ্যৎ ওলট-পালট হয়ে যাবে, এমন ব্যবস্থার বদল চান তাঁরা। শিক্ষানীতিতে সেই কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু কী ভাবে তা বাস্তবায়িত করা হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার ও শিক্ষা বোর্ডের। এ দিকে, তাদের এড়িয়ে নয়া শিক্ষানীতি অনুমোদন করে দেওয়ায় মোদী সরকারের প্রতি খড়্গহস্ত বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি। সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত। ফলে রাজ্যের এক্তিয়ারে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করছে, এই অভিযোগও উঠেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এই সংঘাতের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত বোর্ড পরীক্ষার ভবিষ্যৎ ঘিরে ধোঁয়াশা থেকে যাবে। যার জেরে চাপ বাড়বে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের ওপর।
নতুন শিক্ষানীতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং তার আগের তিন বছর মিলিয়ে পাঁচ বছরে ভিত তৈরি, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি প্রস্তুতি পর্ব, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি মাঝারি পর্বের শিক্ষা ও নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিকে একটি ইউনিট ধরলে যে-সব স্কুলে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ানো হয়, তাদের কী হবে? পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক নবকুমার কর্মকারের প্রশ্ন, ‘মাধ্যমিক স্তরের সব স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত করার পরিকাঠামো কি সর্বত্র আছে? নিয়ম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে পড়ান স্নাতক শিক্ষকেরা। উচ্চ-মধ্য স্তরে পড়াতে হলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগে। তা হলে মাধ্যমিক স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক হলে পড়াবেন কারা? এত দ্রুত সব পরিকাঠামো পাল্টানো কি সম্ভব?’
রাজ্য পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘নবম থেকে দ্বাদশের মধ্যে আটটি সিমেস্টারের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এক-একটা ক্লাসে ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মতো। কিন্তু সেটা কি মাধ্যমিকের বিকল্প হতে পারে?’ আটটি সিমেস্টারের আয়োজন করে সময়ে ফল প্রকাশের পরিকাঠামো সব স্কুলে আছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। তবে অভীকবাবুর বক্তব্য, এখনই উদ্বেগের কারণ নেই। নতুন নীতি বলবৎ করতে হলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করাতে হবে। তা ছাড়া, শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত। তাই রাজ্যের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। আবার নিখিল বঙ্গ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছি।’
অন্যদিকে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির আগে তিন বছরের পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট শ্রেণিকক্ষ সব স্কুলে আছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসুর প্রশ্ন, প্রথম তিন বছর পড়ানোর মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছেন কি? ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না হলে গোড়ায় গলদ থেকে যাবে কচিকাঁচাদের। আবার নতুন নীতিতে অনলাইন শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার শতল কলসা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক পুলককুমার বসুর প্রশ্ন, ‘আমাদের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় অনলাইন ক্লাস কী ভাবে হবে?’ তিনি জানান, বহু গরিব পড়ুয়ার স্মার্টফোন নেই। নেট-সংযোগ দুর্বল। আগে অনলাইন ক্লাসের পরিকাঠামো দরকার।