এতদিন যা হয়নি, মোদী জমানায় এবার সেটাই হয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর দেশের শিক্ষানীতিকে আমূলে বদলে ফেলল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। যা নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তীব্র সমালোচনা। কেউ বলছেন, অসঙ্গত। কেউ বলছেন, স্বৈরতান্ত্রিক। কেউ বলছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আবার কেউ বলছেন, গৈরিক। দিল্লী থেকে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে বিরোধী নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষের এটাই মতামত। অনেকেই বলেছেন, শিক্ষা একটি যৌথ বিষয়। সেখানে রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়া কী করে এমন ঘোষণা করতে পারে কেন্দ্র?
বাংলার একাধিক শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। যেমন শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ তুলে দিতে চাইছে। সেই সব কলেজের ভবিষ্যৎ কী হবে, আমার কাছে পরিষ্কার নয়। শিক্ষক ও ছাত্ররা কোথায় যাবে? সমস্যা আরও বাড়বে। প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া উচিত ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, এটাকে জাতীয় শিক্ষানীতি না বলে ভ্রান্ত শিক্ষানীতি বলা উচিত। শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল।
তিনি বলেন, ১৩০ কোটির দেশে যেখানে দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে এমন ছাত্রছাত্রীরা পড়তেই পায় না, তাদের পড়ানোর ব্যবস্থা না করে পদার্থবিদ্যার সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইন পড়তে পারবে, পড়তে পড়তে চলে গেলাম, আবার খানিকটা খেলাধুলো করে এসে পরীক্ষা দিলাম ইত্যাদি বলা হচ্ছে। ১৩০ কোটির দেশে এই নীতি চলবে না। সমস্ত ভেঙে পড়বে। যাঁরা এটা তৈরি করেছেন তাঁরা চিন্তাভাবনা করেননি। আমাদের দেশের মাটির মানুষের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ এঁদের নেই। এদিকে অনার্সের চতুর্থ বর্ষে গবেষণার কথা বলা হচ্ছে। সমস্ত জিনিসটা দেখে মনে হচ্ছে গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন সচিব দেবাশিস সরকার বলেন, এই শিক্ষানীতি আগামী দিনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। বিশাল অংশের ছেলেমেয়ের কাছে শিক্ষা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। প্রযুক্তি যার কাছে থাকবে সে সুযোগ পাবে, যার কাছে নেই সে দূরে সরে যাবে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত ক্লাস্টারের কথা বলা হচ্ছে। মানে শিক্ষার কাঠামোকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। এবং বেসরকারি পুঁজির হাতে শিক্ষাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদারের সাফ কথা, গণতন্ত্র এবং সংবিধান বিরোধী নীতি। রাজ্যের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা ছাড়া, সংসদে কোনও আলোচনা ছাড়া কীভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাশ হল? স্কুল এবং উচ্চশিক্ষা নিয়ে রাজ্যের তরফে কিছু পর্যবেক্ষণ পাঠানো হয়েছিল। তার কিছুই এই নীতিতে নেই। শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত। সেখানে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করাটা সংবিধান বিরোধী। এই শিক্ষানীতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। যা বহুত্ববাদী ভারতবর্ষের পক্ষে বিপজ্জনক। এভাবে ফতোয়া জারি না করে রাজ্যগুলির মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদক সাংখ্যায়ন চৌধুরির মতে, ‘এই নীতি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত। কারণ এর জেরে একক কেন্দ্রীয় শিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এইচইসিআই গঠন করে রাজ্যের গুরুত্ব গৌণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, এই নীতি উচ্চশিক্ষায় বেসরকারীকরণকেই উৎসাহিত করবে। বিদেশি পুঁজির কাছে দেশের শিক্ষার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া কিন্তু মেধাবী পড়ুয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, এই শিক্ষানীতি ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ১০০ বছর পিছিয়ে দেবে। এতে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে।