নকলদের খপ্পরে পড়ে তাঁর অবস্থা এতই করুন হয়েছিল যে শেষে তিনি নিজেকে ‘শ্রী হীন’ করতে বাধ্য হন। ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে নকল বা ভেজালের খপ্পরে পড়ে নিজের নামেই হাত দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। তারাশঙ্কর যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন যথারীতি তাঁর নামে ছাপা হতে লাগল বই। যেগুলো তিনি লেখেনই নি, সেই বইও তাঁর নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি হতে শুরু করল। আর এসব অখাদ্য বই এই ঔপন্যাসিকের নামের সঙ্গে যতই যুক্ত হতে থাকল, তিনিও ঠিক ততটাই অহেতুক সমালোচনায় আক্রান্ত হতে থাকলেন। তাঁর তখন ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। কয়জনকে তিনি বোঝাবেন, এসব তিনি লেখেননি। তাঁর নাম ব্যবহার করে বই বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই – একদম পাইকারি হারে। একসময় নকলদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন আসল তারাশঙ্কর। শেষ নকল থেকে নিস্তার পেতে নিজের যাবতীয় নতুন ও পুরোনো বইয়ের নতুন সংস্করণে দীর্ঘ ভূমিকা লিখতে হলো তাঁকে। এমনকি পাঠককে আসল-নকল চেনার উপায়ও বাতলে দিতে হল। রাগে-ক্ষোভে তিনি লিখলেন, ‘‘… ‘শ্রীময়ী’র শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীময় থাকুন, আমি এখন হইতে শ্রীহীন হইলাম।’’ এরপর থেকে নিজের নামে আর ‘শ্রী’ লাগাতেন না তিনি, শুধু লিখতেন – ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’।
‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ সিনেমা হবে শুনে তারাশঙ্কর অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তা নিয়ে যে কাণ্ড করেছিলেন, রীতিমতো অদ্ভুত। মূল কাহিনির পটভূমি ছিল বীরভূমের লাভপুর। তপন সিংহকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন সেখানে। মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। লোকেশন দেখে বেড়াতেন। অন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তারাশঙ্করের ক্লান্তি ছিলনা। চোখের দৃষ্টি যেন মাঝে মাঝে দিগন্ত ছাড়িয়ে কোথায় উধাও হয়ে যেত। ধ্যানমগ্ন ঋষি যেন! এক বার বলেছিলেন, ‘‘জানো তপন, এই লাভপুরের আশেপাশে পাঁচ-ছখানা গ্রামে ক’খানা গাছ আছে, তা’ও বলে দিতে পারি আমি।’’ সেই কোপাই নদী। গাঁ-ঘর। তার লোকজন। এমনকী করালীর পিসতুতো ভাই নসুবালা, যে মেয়ে সেজে ঘুরে ঘুরে বেড়াত, তাকেও চিনিয়ে দিয়েছিলেন তারাশঙ্করই। দিনের শেষে কাজের পর লাভপুরের বাংলোয় বসে মহাভারতের গল্প শোনাতেন তারাশঙ্কর। তেমনই এক দিন।
তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘হঠাৎ এক জন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল। … ‘কেরে নসু নাকি … আয় আয়।’ সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর। ‘হ্যাঁ বাবু, ভাল আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র নসুবালা। এ বার ভাল করে দেখলাম – যাঁকে বৃদ্ধা ভেবেছিলাম সে আসলে একজন পুরুষ। …. নসুবালা নাচে, গান গায়, তামাক খায়, মদ খায়, ঢোল বাজায়। … হঠাৎ তারাশঙ্কর বললেন, ‘এই নস্যে, বাবুকে একটা গান শোনা।’ কানে এক হাত দিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে নসুবালা শুরু করলে – ‘আহা – আমায় এ হিদি মাঝারে আঁকা হয়ে গেলা শ্যামের চরণখানি।’ …’’ নসুকে এত কাছ থেকে দেখেও সিনেমায় তাঁকে ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তপন সিংহ। পরে ভুল বুঝেছিলেন। তখন আপসোসের অন্ত ছিল না!
সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকে, তখন তিনি গল্প লিখছেন। তাঁর লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ‘‘হুঁ লোকটা লিখছে বটে কিন্তু লেখাগুলো বড্ড স্থূল। যাত্রার মতো চড়া।’’ এগুলো শুনে তাঁর মন খারাপ লাগত। হয়ত সমালোচকদের কথাই ঠিক, সেই ভেবে রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠাতে ভয় করত তারাশঙ্করের। কিন্তু একদিন যা-হবে-হোক ভেবে মরিয়া হয়ে দুটি বই পাঠিয়েই দিলেন শান্তিনিকেতনের ঠিকানায়। ধরেই নিয়েছিলেন কোনও উত্তর আসবে না। কিন্তু পাঠানোর এক সপ্তাহ পরেই এক বিচিত্র খামের চিঠি তাঁর বাড়িতে। সাদা খামের এককোণে ‘র’ অক্ষর লাল কালিতে ছাপা। অমন খাম বাংলাদেশে একজনেরই ছিল। সবাই চিনত। তারাশঙ্কর খাম খুলবেন কি? তার আগেই বুক ঢিপঢিপ। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত পা কাঁপছিল উত্তেজনায়। খামটা কোথায় খুলে দেখবেন সেটাই বুঝে পারছিলেন না। শেষে লাভপুর পোস্ট অফিসের পুবদিকে কল্কে ফুলের বনে গিয়ে নিরালায় খুলেছিলেন খামটি। ভেতরে ছিল সেই অপূর্ব হাতের লেখায় তাঁর বহু আকাঙ্খিত চিঠি।
‘‘কল্যাণীয়েষু,
আমার পরিচরবর্গ আমার আশেপাশে উপস্থিত না থাকায় তোমার বই দু’খানি আমার হাতে এসেই পৌঁচেছে। কিন্তু তাতে পরিতাপের কোনও কারণ ঘটেনি। তোমার ‘রাইকমল’ আমার মনোহরণ করেছে।’’
ওই পর্যন্ত পড়ে আবার বুক ধড়াস। ভাল লেগেছে! কবিগুরুর ভাল লেগেছে! আর কী চাই জীবনে! সঙ্গে সঙ্গে কবিকে পালটা চিঠি লিখেছিলেন দ্বিগুণ উৎসাহে, ‘‘রাইকমল সম্পর্কে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন কিনা জানি না। কারণ আমার সমসাময়িকরা আমার লেখাকে বলেন স্থূল।’’ এই চিঠি পাঠানোর চারদিন পরেই আবার কবির উত্তর এসেছিল, এবারের চিঠি আগের বারের থেকেও বড়। চিঠির শুরুতেই লেখা ছিল, ‘‘তোমার কলমের স্থূলতার অপবাদ কে বা কারা দিয়েছেন জানি না, তবে গল্প লিখতে বসে যারা গল্প না লেখার ভান করে, তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাওনি, এতেই আমি খুশি হয়েছি।’’ ব্যস, তাঁর মনের ভেতর যেটুকু নিরাশা, ক্লেদ জমে উঠেছিল, সব ধুয়েমুছে গিয়েছিল। কবি লিখেছিলেন, ‘‘শান্তিনিকেতনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করো।’’
তখন চৈত্রমাস। কবির এমন ডাক পেয়ে তাঁর আর ধৈর্য্য সয় নি। আগাম না জানিয়েই রওনা দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। একে তো কালো রোগা চেহারা, তার ওপর জেল খেটে সামান্য শ্রীটুকুও গিয়েছিল। পরনের জামাকাপরও ছিল ময়লা। আগে কোনও দিন যাননি শান্তিনিকেতনে। সোজা গিয়ে উঠেছিলেন শ্রীনিকেতনে। গেস্টহাউজের অধ্যক্ষকে বলেছিলেন, ‘‘কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, রাত্তিরটা এখানে থাকতে চাই।’’ অধ্যক্ষ ভুরু কুঁচকে ময়লা জামা পরা লোকটিকে বলেছিলেন, ‘‘দেখা তো হবে না।’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘সে আমি ব্যবস্থা করে নেব। আপনি শুধু আজ রাত্তিরটা থাকার ব্যবস্থা করে দিন।’’ সে ব্যবস্থাও হয়নি। অগত্যা শ্রীনিকেতনের বাইরে একটি পান্থ নিবাসের ঘুপচি ঘরে রাত্রিবাস করতে হয়েছিল। সেটাও স্মরণীয়। মশার কামড়ের জন্য একই মশারির ভেতর তারাশঙ্কর, আরও চারটি তরুণ ছেলের সঙ্গে প্রায় সারারাত জেগেই পার করেছিলেন। সকাল হতেই আবার ছুটেছিলেন শান্তিনিকেতনে। এবারে কবির কাছে খবর গিয়েছিল তারাশঙ্কর এসেছেন। কবি বলেছিলেন, ‘‘ডাকো তাকে এখুনি, আমার কাছে ডাকো।’’ তারাশঙ্কর গিয়েছিলেন। দুরুদুরু বুকে ঘরে ঢুকেছিলেন। কবি বসে ছিলেন। দেখেই বলেছিলেন, ‘‘এ কী, এ তো চেনা মুখ। কোথায় দেখেছি তোমাকে?’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আজ্ঞে বোলপুরেই তো বাড়ি আমার। আপনাকে বেশ কয়েকবার দূর থেকে দেখেছি, তখন হয়তো …।’’ কবি বলেছিলেন, ‘‘না না কাছ থেকে দেখেছি। কোথায় দেখেছি বলো তো?’’ তারাশঙ্করও তখন স্মৃতি হাতড়ে যাচ্ছিলেন। শেষে মনে পড়েছিল বছর পাঁচেক আগের কথা। সমাজ-সেবক কর্মীদের একটা সভা হয়েছিল, সেখানে কবি কর্মীদের সঙ্গে কিছুক্ষঁণ দেখা করেছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন তারাশঙ্করও। কিন্তু সে কথা কি এত দিন পর কবির মনে আছে? তবুও উল্লেখ করেছিলেন সেই কথা। কবি আনন্দে বলে উঠেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি তো ওদের মুখপাত্র ছিলে। আমার সামনে বসেছিলে।’’ তারাশঙ্কর অবাক হয়েছিলেন কবির স্মরণশক্তি দেখে, এত দিন পরও সব মনে রেখেছেন! কী সাংঘাতিক স্মৃতিশক্তি! তারপরের কথোপকথন এরকম –
‘‘তা কী করো?’’
‘‘করার মতো কিছুই মন লাগেনি। চাকরিতেও না, বিষয়কাজেও না। দেশের কাজ করতে গিয়ে জেল খেটেছি।’’
‘‘ও পাক থেকে ছাড়া পেয়েছ?’’
‘‘মনে হয় পেয়েছি।’’
‘‘তাহলে তোমার হবে। তুমি দেখেছ অনেক। তোমার মতো গ্রামের কথা আমি আগে কখনও পড়িনি।’’
‘‘কিন্তু গুরুদেব, লোকে যে আমার লেখাকে স্থূল বলে। আবার আক্ষেপ।’’
কবি বললেন, ‘‘দুঃখ পাবে। পেতে হবে। যত উঠবে তত তোমাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। এ দেশে জন্মানোর ওই এক কঠিন ভাগ্য। আমি নিষ্ঠুর দুঃখ পেয়েছি।’’
একটু থামলেন কবি। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বলে উঠলেন, ‘‘মধ্যে মধ্যে ভগবানকে বলি কি জানো তারাশঙ্কর? বলি, ভগবান পুনর্জন্ম যদি হবেই তবে এদেশে যেন না জন্মাই।’’
শুনে শিউরে উঠেছিলেন তারাশঙ্কর। কার মুখ থেকে শুনছেন এ কথা! বলেছিলেন, ‘‘না না গুরুদেব একথা বলবেন না … দয়া করে এই কথা বলবেন না।’’
শুনে হেসেছিলেন কবিগুরু। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘‘তোমার এইটুকু যেন বেঁচে থাকে। বাঁচিয়ে রাখতে পারো যেন।’’
আরেক বার ডাক পেয়েছিলেন কবির কাছ থেকে। তারাশঙ্কর গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। উত্তরায়ণের সামনে যেতেই থমকে গিয়েছিলেন। কবি তাঁর সামনে বসে থাকা একজন লোকের সঙ্গে তীক্ষ্ণ কঠিন গলায় কথা বলছিলেন। কেদারায় হেলান দিয়ে নয়, সোজা বসে। গলা চড়ছিল। আর সামনে এগোতে সাহস পাননি তারাশঙ্কর। ওখানেই থেমে গিয়েছিলেন।
স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘‘হঠাৎ কবি উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন, বনমালী! বনমালী! তারপর ডাকলেন মহাদেব! মহাদেব! কণ্ঠস্বর পর্দায় পর্দায় চড়ছে। এর পরই ডাকলেন সুধাকান্ত! সুধাকান্ত! এরা কি ভেবেছে বাড়ির মালিক মরে গেছে? তখনকার কবির মূর্তি বিস্ময়কররূপে প্রদীপ্ত। যেন প্রখর রৌদ্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখ-ঝলসানো দীপ্তিতে প্রখর হয়ে উঠেছে। সমস্ত উত্তরায়ণ যেন সেই কন্ঠস্বরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এ-পাশের ও-পাশের বাড়ি থেকে দু একজন উঁকি মারলেন। তাঁদের মুখে শঙ্কার চিহ্ন। দু-একজন উত্তরায়ণের প্রবেশ-পথে যাচ্ছিলেন তারা থমকে দাঁড়ালেন। আমার মনে হল গাছগাছালিগুলিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সুধাকান্ত ছুটে গেলেন কবির কাছে এবং প্রথমেই সেই লোকটিকে উঠতে অনুরোধ করলেন। তিনি উঠে চলে গেলেন। কবি কথা বলছেন সুধাকান্তর সঙ্গে। তখনও গলার তেজ কমেনি তাঁর।’’
তারাশঙ্কর ভেবেছিলেন আজ আর দেখা করে দরকার নেই। পালালেই ভাল। নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিলেন। তখনই সুধাকান্ত আবার দৌড়ে কাছে এসে বলেছিলেন – ‘‘আরে আপনি চললেন কই? গুরুদেব ডাকছেন।’’ তারাশঙ্কর ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন, ‘‘আজ আর গিয়ে দরকার নেই। খুব রেগে আছেন উনি।’’ সুধাকান্ত তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন – ‘‘আরে না না, আপনি চলুন। আসলে হয়েছে কি ওই লোকটি শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষকে অশিষ্ট ভাষায় অপমান করেছে। সেই কারণে কবি প্রচণ্ড রেগেছেন, কিন্তু উনি যেহেতু অতিথি তাই সরাসরি কিছু বলতেও পারছেন না। সেই রাগটাই চিৎকার করে ওই বনমালী, মহাদেব আর শেষে এই আমার ওপর দিয়ে বার করলেন। আপনি যান, কোনও ভয় নেই।’’ আশ্বাস পেয়েও যথেষ্ট ভয় নিয়েই কবির কাছে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। তখনও কেদারায় পিঠ সোজা করে বসে ছিলেন। তারাশঙ্করকে দেখেই কবির প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘‘শান্তিনিকেতন জায়গাটা তোমার কেমন লাগে?’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আজ্ঞে ভালই লাগে তো বেশ।’’ কবির পাল্টা প্রশ্ন ছিল – ‘‘তাহলে তুমি সবার কাছে শান্তিনিকেতনের নিন্দা কেন করে বেড়াও?’’ এই কথা শুনে তারাশঙ্করের মাথায় হাত। কবি কী বলছেন! বলেছিলেন – ‘‘আজ্ঞে আমি তো এমন কথা কখনও …।’’ রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘‘তাহলে শান্তিনিকেতনে তুমি আসো না কেন? তোমার বাড়ি তো কাছেই। একটু যাতায়াত তো রাখতে পারো। আমি ভেবেছিলাম শান্তিনিকেতনের এক কোণ তুমি একটু আগলে বসবে। তা তো নিলেই না। আমার সঙ্গে একটু দেখাও করতে আসো না।’’ এমন স্নেহের কথায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন তারাশঙ্কর। কী উত্তর দেবেন বুঝে না পেয়ে আমতা-আমতা করে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘মানে এদিকটায় আসা হয়ে ওঠে না।’’ অপর দিক থেকে উত্তর এসেছিল – ‘‘বুঝেছি।’’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন কবি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, ‘‘তাহলে তোমায় টানা অন্যায় হবে। তোমার ইচ্ছে নেই।’’ একটু মৃদু হেসেছিলেন। তারপর আবার বলেছিলেন, ‘‘এ জেলার লোকের কাছে শান্তিনিকেতন বিদেশই রয়ে গেল। কোথায় যে রয়েছে মাঝখানের খাতটা!’’ কথাগুলো বলার সময়ে গুরুদেবের যে করুণ কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন তা জীবনে ভুলতে পারেননি তারাশঙ্কর।
কলকাতায়, মনোহরপুকুর লেনের ছোট্ট একটা টিনের ঘরে তখন তিনি একা থাকতেন। ভোরবেলা উঠে দূরের টাইমকল থেকে জল এনে রাখতে হত। পাইস হোটেলে দু’বেলা খাওয়া সারতেন। ঘরের কাজ করে দেওয়ার জন্য জুটেছিল এক বিনি মাইনের চাকর। নাম ছিল তাঁর ষষ্ঠীচরণ। তাঁর আবার বাবুর প্রতি খুব মায়া ছিল। মাঝেমাঝে তারাশঙ্করকে সে বোঝাত, ‘‘বাবু এইসব লেখালেখি না করে একটা চাকরিবাকরি করুন।’’ শুনে মিটিমিটি হাসতেন তারাশঙ্কর। বলতেন, ‘‘আমি তো এ ছাড়া আর কিছু পারি না রে, ভালও লাগে না।’’ ওদিকে ষষ্ঠীচরণ মুখে এই কথা বললেও বাবুর লেখা গল্প শোনার খুব সাধ ছিল তাঁর। এই ষষ্ঠী তারাশঙ্করের বহু গল্পের প্রথম শ্রোতা ছিলেন। শুধু তাই নয়, গল্প শোনার পর তিনি যা মতামত দিতেন তা মন দিয়ে শুনতেন তারাশঙ্কর। এক বার বলেছিলেন, ‘‘বাংলার অতি সাধারণ মানুষদের আমরা আধুনিক লেখক-শ্রেণি যে নির্বোধ বা রসবোধহীন মনে করি, এর চেয়ে ভুল আর কিছু হয় না। যারা রামায়ণ মহাভারত বুঝতে পারে, কৃত্তিবাসী কাশীরামদাসীই শুধু নয়, গদ্য-অনুবাদ – যেগুলির ভাষায় ছাঁকা সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য এবং ভাগবতের কথকতা যারা বুঝতে পারে, তারা একালের লেখাগুলি বুঝতে পারবে না কেন? দেশের ভাষায় লেখা বিষয় যদি দেশের মানুষই না বুঝতে পারে, তবে সে কেমন লেখা?’’
তিনি চিরকাল স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছিলেন। নিজের অবস্থাকে আড়াল করেননি কোনও দিন।
বড় ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তারাশঙ্করের মনে হয়েছিল, ভাবী বেয়াইকে নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে জানানো উচিত। চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আপনাদের অর্থনৈতিক অবস্থা হইতে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা-অসমৃদ্ধ। সেই হিসাবে আমি নিজ হইতেই আপনাকে সর্বাগ্রে সকল কথা খুলিয়াই জানাইতে চাই। আমার পূর্ব পুরুষেরা জমিদার ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি তাহার যাহা পাইয়াছি, তাহার বার্ষিক মুনাফা, আমার অংশে-আন্দাজ ১০০০/ ১২০০ টাকা। চাষের জমি-আমার অংশে ৭৫/৮০ বিঘা। বাগান পুকুর যাহা আছে, তাহা আপনি অবশ্যই জানেন যে-কেবল পল্লীতে ভোগের সামগ্রী, কোনও আর্থিক আয় তাহা হইতে হয় না। বর্তমানে জমিদারির অবস্থাও জানেন। আমার কর্ম্মজীবনে আমি সাহিত্যিক। … বর্তমানে আমার আয় ৩০০/৪০০ টাকা মাসিক, ইহার অধিক নয়। তবে ইহার একটা স্থায়িত্ব আছে বলিয়া আমি মনে করি। কারণ আমার বইগুলির সংস্করণ দ্রুত শেষ হইতেছে …। কথাগুলি আমার পক্ষে লেখা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে না লিখিয়া উপায় নাই বলিয়াই লিখিতেছি।’’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯৮ খৃস্টাব্দের ২৩শে জুলাই পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীল জীবনের সমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কলকাতা শহরে। তারাশঙ্কর তাঁর বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্য থেকে অন্ততঃ ১০টি উপন্যাস এবং বেশ কিছু অনন্য সাধারণ ছোট গল্পের জন্য স্বকালের সীমা ছাড়িয়ে উত্তরকালের অগণিত পাঠককে স্পন্দিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এ অর্থেই তিনি বাংলার চিরায়ত কথা সাহিত্যের কালজয়ী শিল্প প্রতিভা। বিলীয়মান সামন্ত সমাজের এ ক্ষুদ্র জমিদার পরিবারে তারাশঙ্করের জন্ম। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তাঁর পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বৈমাত্রেয় পিসি শৈলজা ঠাকুরাণী ছিলেন তারাশঙ্করের ভাষায় ‘সেকালের প্রতিনিধি’। পক্ষান্তরে মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সমর্থক এ বিদুষী মহিলা। এক দিকে ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল।
প্রভাবতীর বাস্তব দেশপ্রেম শৈশবেই তারাশঙ্করকে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর (৩০শে আশ্বিন) যেদিন বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকরী হয় সেদিনই তিনি ৭ বছরের শিশু পুত্রের হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন। পিতার রাজদ্রোহী মনোভাব, মা-এর দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে মাতৃকুলের সংশ্রব কৈশোরেই তাঁর মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। বিপ্লবী রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী সংযোগও ঘটে তাঁর। এর পর ১৯২১ খৃস্টাব্দে গান্ধী আহূত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় থেকেই তিনি শর্তহীন গান্ধীপন্থী এবং রাজনীতির পরিভাষায় কংগ্রেসম্যান। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে তারাশঙ্করের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি গ্রেফতার হন। তারাশঙ্করকে বিচারের জন্য সিউড়ি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে তাঁর কারাদন্ড হয়। সি ক্লাস বন্দীরূপে তিনি কয়েকমাস জেল খাটেন। কারাগারেই তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রকাশ ঘটে। এখানেই তিনি লেখা শুরু করেন ‘পাষাণপুরী’ আর ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। বাংলার কংগ্রেস রাজনীতির উপদলীয় কোন্দল ও সংঘাতের কারণে রাজনীতির প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কারামুক্তির দিনেই তারাশঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেন যে, সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন। তিনি ১৯৪৭ খৃঃ পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব রক্ষা করেন। ১৯২৯ সাল থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর কালজয়ী উপন্যাসগুলো রচনা করেন। তাঁর উপন্যাসের প্রধান গুণ মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও জীবন জিজ্ঞাসার গভীরতা। বিশ শতকের শিল্পী হয়েও তারাশঙ্কর ঐতিহ্য অনুসরণ থেকে দূরে সরে যান। আধুনিক হওয়ার গলদঘর্ম প্রচেষ্টা তাঁর ছিল না। উচ্চকণ্ঠে স্বতন্ত্র ঘোষণা বা রুগ্ন মানসিকতা কিংবা কারু-সর্বস্বতা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন। তবু বর্তমান যুগের তরঙ্গ সঙ্কুলতা তিনি উপলব্ধি না করে পারেন নাই। সমাজের ও জীবনের সর্বস্তরের ক্ষয়িষ্ণুতা তাঁর কাছে গভীর বেদনার বাণী বহন করে এনেছিল। সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের পর্বে পর্বে তিনি সেই বেদনার সমাধান প্রত্যাশা করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এর পর ক্রমান্বয়ে তিনি রচনা করেন ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯), ‘কালিন্দী’ (১৯৩৯), ‘গণদেবতা’ (১৯৪৩), ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪), ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪), ‘সন্দীপন পাঠশালা’ (১৯৪৬), ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’ (১৯৪৬), আর ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৬-৪৭) যেখানে সমাজ ও রাজনীতি পরস্পরিত হয়ে রাঢ় বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের শিল্পসাক্ষ্য নির্মিত হয়। অন্যদিকে রচিত হল ‘রায় কমল’ (১৯৩৫) ও ‘কবির’ (১৯৪২) মত রাজনীতি নিরপেক্ষ কালজয়ী উপন্যাস।
‘চৈতালী ঘূর্ণি’ এই উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র চাষী গোষ্ঠী আর তার স্ত্রী দামিনী গ্রাম্য শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরে আসে। গোষ্ঠ কারখানায় চাকরি পায়। স্বামী-স্ত্রী বস্তিতে থাকে। গোষ্ঠ মজুরদের ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে, যার সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কর্মীরাও জড়িত ছিল। তারাশঙ্কর বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন বক্তব্য নিয়ে আসেন।
তারাশঙ্করের সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বে (১৯২৯-১৯৪৭) কালজয়ী উপন্যাসের পাশাপাশি রচনা করেন অসামান্য এক গুচ্ছ ছোট গল্প। তারাশঙ্করের প্রথম ছোটগল্প সঙ্কলন ‘ছলনাময়ী’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬খৃঃ। তার ছোটগল্পের সমষ্টি ‘জলসা ঘর’ (১৯৩৭), ‘রসকলি’ (এপ্রিল ১৯৩৮) ও ‘হারানো সুর’ এর মাধ্যমেই বাংলা ছোটগল্পে তার তর্কাতীত প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়। তার ছোটগল্পগুলোতে রাঢ় দেশের জীবনযাত্রার শাখা-চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘জলসা ঘর’-এ আভিজাত্য বংশ মর্যাদার সাথে নিম্নস্তরের সামাজিক পরিবেশের তুলনামূলক সমাজ-চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘হারানো সুরে’ নিম্নশ্রেণীর জীবনযাত্রার ছায়াছবি অবলম্বনে কাহিনীর পরিবেশন করতে চেয়েছেন। ‘রসকলি’ গল্প সংগ্রহে ভাবের অকৃত্রিমতায়, বিষয় বৈচিত্রে ঘটনাগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এ গ্রন্থে যেমন গ্রাম্য পরিবেশে আত্মদ্বনদ্ব এবং সামাজিক কোলাহল স্থান পেয়েছে তেমনি পশুত্ব এবং মানবতার মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি রসানুভূতি পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। তারাশঙ্করের ভাষা সরল কিন্তু ঋজু। তিনি কোথাও রাজনৈতিক উম্মাদনায় বিভ্রান্ত হন নাই বরং সহজ সরল গ্রাম্য সহজ জীবানুভূতিতে দীপ্তিমান। জলসাঘর, তারিনী মাঝি, রসকলি, কাল পাহাড়, অগ্রদানী, বেদেনী, যাদুকরী, নটু মোক্তার, সওয়াল, কামধেনু, পিতা-পুত্র, ডাইনী, শ্মশানের পথে, অসংখ্য ছোট গল্পের কয়েকটি নাম।
উত্তর স্বাধীন ভারতে শিল্পী তারাশঙ্করের শিল্প চেতনায় বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে কংগ্রেসী রাজনীতির শীর্ষনেতৃত্বের নিষ্ঠ সান্নিধ্য আসার সুযোগ ঘটে তার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধান সভার সদস্য মনোনিত হন তিনি। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পেলে কেন্দ্রীয় রাজ্য সভায় সদস্য হিসাবে উন্নীত হন ১৯৫২।
চীন-ভারত মৈত্রী শক্তিশালী করার জন্য উভয় দেশের সরকার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রতিনিধি দলের মধ্যে শুভেচ্ছা সফরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই সূত্রে ১৯৫২ সালে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় চীন সফরে যান। পরে ১৯৫৭ সালে আফ্রো এশিয়া সাহিত্য সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসবে রাশিয়ার তাসখন্দ ভ্রমণ করেন। তারাশঙ্কর ১৯৫২ সালে ‘আরোগ্য নিকেতন’ লেখেন। এ গ্রন্থের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। রাধা উপন্যাসে ইতিহাসকে অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ধর্মবোধ, পার্থিব প্রত্যাশাসমূহ উপজীব্য করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে গণদেবতা’কে মুখ্যত স্মরণে রেখে তার সমগ্র সাহিত্য জীবনের পুরস্কারস্বরূপ তাকে ‘জ্ঞানপীঠ’ প্রদান করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে অনুকূল জনমত গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির সভাপতির গুরুত্বপূর্ণ পদ। এ সময় তিনি দু’টি উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘সুতপার তপস্যা’। অপরটি ‘একটি কালো মেঘের কথা’। পশুপ্রেমের যে তিনটি গল্প বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে, সেগুলি হল শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’ আর তারাশঙ্করের ‘কালাপাহাড়’। তিনটি গল্পই করুণ রসে আর্দ্র। পড়ামাত্রই পাঠকহৃদয় সিক্ত হয়ে যায়। এই ত্রয়ী গল্পের তৃতীয়টি অর্থাৎ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালাপাহাড়’ গল্পটি প্রকাশের আশি বছর পূর্তি হল সম্প্রতি। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ২০শে নভেম্বর দেশ পত্রিকায়।
তাঁর ঠাকুর্দা শিবদাস ছিলেন মস্ত উকিল। বিশাল নামডাক। বাবার মতো নিজে উকিল হতে পারেননি বলে বড্ড আফসোস ছিল তারাশঙ্করের বাবা হরিদাসের। খুব ইচ্ছে ছিল ছেলে উকিল হোক। তারাশঙ্করের বয়স যখন মোটে আট, তখন থেকেই হরিদাস ছেলেকে বলতেন, ‘‘তুমি উকিল হবে। মস্ত বড় উকিল। কাশ্মিরী শাল দিয়ে তৈরি উকিলের শামলা রেখে গেছেন আমার বাবা, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। সেই শামলা মাথায় দিয়ে কোর্টে যাবে। অল্প বয়সে তোমার সওয়াল দেখে লোকে বলবে, হবে না আবার! ওর ঠাকুরদা যে মস্ত উকিল ছিলেন।’’ তারাশঙ্করের ওই আট বছর বয়সেই হরিদাস মারা যান।
তিনি খেলতেন যথেষ্ট ভাল। গ্রামে ভাল ফুটবলার হিসেবে নামও ছিল। শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেনিস খেলাতেও ছিল সমান দাপট। কলকাতার মাঠে নিয়মিত ফুটবল ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন। একবার প্রবল বৃষ্টির দিনে এক বন্ধুর সঙ্গে মাঠে মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে ভিড় আর পুলিশের গুঁতোয় প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ফিরে এসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর মাঠে যাওয়া নয়। তবে তার পরেও গেছেন। খেলা দেখার নেশা আর ছাড়তে পারেননি। আচমকাই লেখা ছেড়ে দিলেন। টানা তিন বছর কিচ্ছু লিখলেন না। অথচ সাহিত্যিক হিসেবে তিনি তখন মধ্যগগনে। পরে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘লিখতে ইচ্ছে হয় না। লিখি না। লেখা ছেড়েই দিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করলাম। বসে বসে ভাবি। আর কাঁদি। একলা কাঁদি। পূজার সময় কাঁদি। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে কাঁদি।’’
শাক্ত-পরিবারের ছেলে ছিলেন। বাড়ির বিশ্বাস, মা তারার দয়ায় তাঁর জন্ম হয়েছেন, তাই নাম রাখা হয়েছিল তারাশঙ্কর। রক্তে ছিল আধ্যাত্মিকতা। মন অশান্ত, কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। কীসের অতৃপ্তি বুঝতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমির মতো পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু পুরস্কার পাবার আনন্দ কই? কিছুই যেন স্পর্শ করত না। ছটফট করত ভেতরটা। কলকাতার রাস্তায় এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সারাদিন সে সন্ন্যাসী আগুন ছুঁয়ে সাধনা করেছিলেন। মনে ধরেছিল সেই সাধুকে। সন্ন্যাসী বলেছিলেন তাঁর বাস কাশীতে। সংসার ছেড়ে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব নেবেন ঠিক করে যেদিন আবার দেখা করতে গেলেন শুনেছিলেন সন্ন্যাসী ফিরে গেছেন। তাঁর সন্ধানে তারাশঙ্করও রওনা দিয়েছিলেন কাশী। দেখা হয়ে যায় সেই সময়ের বিশিষ্ট বাঙালি আনন্দসুন্দর ঠাকুরের সঙ্গে। কথায় কথায় তারাশঙ্কর তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘একটা কিছু ধরতে চেয়ে যেন ধরতে পারছি না। তার জন্য আমার মনে অশান্তির শেষ নেই।’’ তা শুনে আনন্দসুন্দর বলেছিলেন, ‘‘আপনার সাধনার পথ হল সাহিত্য। তাকেই জীবনের সাধনা করুন, শান্তি পাবেন।’’ ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। নিজের মা-কে গুরু করে দীক্ষা নিয়েছিলেন। নিত্যপুজো, চণ্ডী, গীতা-পাঠ চলছিল। তাও শান্তি পাননি, কী যেন জীবন ছেড়ে চলেই গিয়েছিল চিরকালের মতো।
এমনই এক সময়ে বর্ধমানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। হাওড়া-স্টেশন পৌঁছেও তিনি ট্রেনে না চেপে বসে ছিলেন প্ল্যাটফর্মে। সেখানে দেখা হয়ে গিয়েছিল বহুদিনের বন্ধু ভ্রাতৃপ্রতিম জগদীশ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। সব শুনে ধমকই দিয়ে বসেছিলেন তিনি। ‘‘এসব কী করছেন দাদা! আপনার এমন আচরণে গোটা বাংলার মানুষ ছি ছি করছে! আপনার নিন্দুকদের কথাই তা’হলে সত্যি হল?’’ ‘‘কী সত্যি হল?’’ ‘‘তাঁরা বলে আপনি শেষ। আর কখনও লিখতে পারবেন না।’’ এমন কথায় যেন যেন কেঁপে উঠেছিলেন তারাশঙ্কর। এবার সাহিত্যিকের অহংকারে ধাক্কা লেগেছিল বহুকাল পর।
পুজোর আর মাত্র আড়াই-মাস বাকি। ভেবেছিলেন কিছুই লিখবেন না, আর সেই বছরই ওই অল্পসময়ে চারটে পুজো সংখ্যায় লিখেছিলেন গল্প। দেশ পত্রিকায় ‘রাধা’, আনন্দবাজার-এ ‘বিচারক’ শনিবারের চিঠি-তে একটি একাঙ্কিকা আর তরুণের স্বপ্ন-য় ‘পঞ্চপুত্তলী’। প্রকাশ পাওয়া মাত্র আবার হই- হই পড়ে গিয়েছিল পাঠক মহলে। ফিরে এসেছেন, তারাশঙ্কর আবার ফিরে এসেছেন! আর ‘গণদেবতা’-র লেখক ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া শান্তি।
তাঁর গোটা জীবনটা যেন অমসৃণতায় ভরা। বারবার অশান্তির বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন। আঘাত পেয়েছেন অসংখ্য। জীবনের সাহিত্যচর্চা শুরুর সঙ্গেও তো জুড়ে আছে আঘাত পাওয়ারই কাহিনী। তখন তাঁর বয়স সাত, কী আট। তিন বন্ধু মিলে বাড়ির উঠোনে খেলেছিলেন, হঠাৎই গাছ থেকে খসে পড়েছিল একটি পাখির ছানা। দৌড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। ছানাটিকে নিজের মুঠোয় তুলে নিয়েছিলেন কিশোর তারাশঙ্কর। বাঁচানোর চেষ্টা চলেছিল নানা উপায়ে। তবু পাখি বাঁচেনি। মা পাখিটা এসে তাঁদের মাথার ওপর ঘুরেছিল। তাই দেখে তিন কিশোর কষ্ট পেয়েছিলেন। ভেতরে ভেতরে জমে ওঠা দুঃখকে উগরে দিতে তারাশঙ্কর চকখড়ি নিয়ে বাড়ির দরজায় লিখে ফেলেছিলেন,
‘‘পাখির ছানা মরে গিয়েছে
মা ডেকে ফিরে গিয়েছে
মাটির তলায় দিলাম সমাধি
আমরাও সবাই মিলিয়া কাঁদি।’’
এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম কবিতা। যন্ত্রণা পেয়ে লেখা। কিন্তু এর পর যেন লেখা নেশায় পেয়ে বসেছিল। ওই বয়সেই এক বার পুজোর সময় দুই বন্ধু মিলে কবিতা লিখে লিফলেটে ছাপিয়ে পাড়ায় বিলি করেছিলেন। আরেকটু পরের দিকের কথা। তখনও লেখক হিসেবে তেমন পরিচিতি মেলেনি। মাঝেমাঝে কবিতাই লেখেন। সে কবিতা ছাপাও হয়। সম্পাদকরা কবিতা লিখতে উৎসাহও দেন, কিন্তু কবিতা লিখে যেন তাঁর মন ভরত না। নাটক লেখার শখ হয়েছিল। লিখেও ফেলেছিলেন। আত্মীয়-বন্ধু নির্মলশিববাবু তখন নাট্যকার হিসেবে নাম করেছিলেন। তারাশঙ্করের নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘তোমার এই নাটক মঞ্চস্থ হলে চারদিকে হই হই পড়ে যাবে। নিশ্চিন্ত থাকো।’’ স্বপ্ন দেখেছিলেন তারাশঙ্কর, শহরের পোস্টারে নাট্যকার হিসেবে তাঁর নাম। কিন্তু সে নাটক কলকাতার এক নামকরা গ্রুপের ম্যানেজারকে জমা দিতে গিয়ে প্রবল অপমানিত হতে হয়েছিল নির্মলবাবুকে। অধ্যক্ষ নাটকটি তো পড়েনই নি, উল্টে বলেছিলেন – ‘‘শুনুন মশাই, নিজে নাটক লিখে নাম করেছেন ঠিক আছে, কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনকে এনে ঢোকাবেন না।’’ নির্মলবাবু অনুরোধ করেছিলেন – ‘‘আপনি একবার পড়ে তো দেখুন। ভাল লেখা।’’ উত্তর এসেছিল – ‘‘সে যেমনই হোক। আমরা এখানে কোনও শরিক বরদাস্ত করব না। আজকে সুচ ঢোকাব কাল ফাল হয়ে বেরোলে আমাদের পস্তাতে হবে। আপনি ও নাটক নিয়ে যান।’’ মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলেন নির্মলবাবু। সব শুনে এত অপমানিত বোধ করেছিলেন তারাশঙ্কর যে বাড়ি ফিরে পুরো খাতাটাই উনুনে গুঁজে দিয়েছিলেন। ছারখার হয়ে গিয়েছিল তাঁর নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন।
অপমান যেন কিছুতেই তাঁর পিছু ছাড়ে নি। তা যে শুধু সাহিত্যের জীবনে, তা নয়, যখন রাজনীতিতে এসেছিলেন, সেখানেও। পৈতৃক জমিদারি থেকে পাওয়া ক্ষতিপূরণের সমস্ত টাকা একবার দেশের স্বার্থে বিনোবাজির ভূদান আন্দোলনে দেওয়ার জন্য ভেবেছিলেন। তাতে বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ বলে বসেছিলেন, ‘‘আপনি তো মশাই নাম কেনার জন্য বিনোবাজিকে টাকা দেন।’’ তারাশঙ্কর তো শুনে থ। আর ছোটখাট রাজনৈতিক নেতারা তো উঠতে বসতে কথা শোনাতেন। বলতেন, ‘‘আরে, উনি তো ধান্দাবাজির জন্য রাজনীতি করেন।’’ অথচ তিনি জমিদারের ছেলে হয়েও দেশের কাজের জন্য জেল খেটেছিলেন। অর্থ, আয়েসি জীবন সব ছেড়েছুড়ে দিন রাত এক করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন। তাতেও ‘জমিদার তনয়’-এর ‘দুর্নাম’ তাঁর যায়নি।
একবার তো অপমানের চূড়ান্ত হয়েছিল। তারাশঙ্করের এক খুব কাছের বন্ধু এবং সেই বন্ধুর এক আত্মীয় নির্বাচনে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তারাশঙ্কর তাঁর বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হয়ে প্রচার করেছিলেন। লড়াই তুঙ্গে উঠেছিল। হঠাৎই দুই আত্মীয়ের মিটমাট হয়ে যায়। মর্নিং কোর্টে সেই আত্মীয় মনোনয়ন তুলে নিয়েছিলেন। বেলা হয়ে গিয়েছিল। বন্ধু একপ্রকার জোর করেই দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী সেই আত্মীয়েরই বাড়িতে। সেখানে খেতে বসেছেন সকলে। সবে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে যাবেন, ঠিক তখনই সেই আত্মীয়র বড় ছেলে বলে উঠেছিলেন, ‘‘তারাবাবু, আপনি আমাদেরই বিরোধিতা করে এখন আমাদের বাড়িতেই পাত পেড়ে খাচ্ছেন! লজ্জা করে না আপনার?’’ হাতের গ্রাস নামিয়ে রেখেছিলেন তারাশঙ্কর। বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লজ্জাহীনতার যে কাজ আমি করতে যাচ্ছিলাম সঠিক সময়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখনও মুখে তুলিনি, এই নামিয়ে রাখলাম,’’ বলেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। অভুক্ত বেরিয়ে এসেছিলেন সেই বাড়ি ছেড়ে। কেউ বাধাও দেয়নি।
এ তো গেল তাঁর অতিথি হিসেবে অন্যের বাড়ি গিয়ে তাঁর হেনস্তা হওয়ার কথা। অন্য দিকে তাঁর বাড়িতে কেউ যখন অতিথি হয়ে যেতেন, যত্নের ত্রুটি হত না কোনও। সে কথা পাওয়া যায় সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর লেখায়। আশাপূর্ণা লিখেছেন, ‘‘আমি এসেছি ওর বাড়িতে, যেন শ্বশুরবাড়ি থেকে ছোটবোন এসেছি। তেমনি আগ্রহ, তেমনি আনন্দ। নিজের সৌভাগ্যে অভিভূত হচ্ছিলাম।’’ তারাশঙ্কর নিজেই দেখভাল করেছিলেন আশাপূর্ণা কোন ঘরে থাকবেন, কোথায় শোবেন, কী খাবেন, কোথায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা। আশাপূর্ণা বর্ণনা করছেন, ‘‘মশারির ভেতর শুতে পারি না শুনে অস্বস্তির অন্ত নেই। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন ওটা অসম্ভব। লাভপুরের মশাকে তুমি চেনো না আশাপূর্ণা, মশারি না টাঙালে সকালে উঠে আর তুমি নিজেকে এখানে খুঁজে পাবে না। দেখবে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেছে। স্নেহের প্রশ্রয়ে আমিও বলে ফেললাম, লাভপুরের মশারাও আমাকে চেনে না দাদা। ওদের যে কী অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারি আমি। তা জানে না ওরা।’’ শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছিল, আকণ্ঠ চাদরে ঢেকে মাথার সামনে টেবিলফ্যান ঘুরিয়ে শোওয়া হবে। পাখাটা মশা ওড়াতে আর চাদরটা ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে। পাখা বসানোর পরেও তারাশঙ্করের শান্তি হয়নি। নিজে হাতে একটা কম্বল নিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘‘দেখো আশাপূর্ণা, রাতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ওই পাতলা চাদরে কিছু হবে না,আবার ফ্যানও মশার জন্য বন্ধ করা যাবে না। তখন এটা গায়ে দিয়ো।’’ তারপর লক্ষ করেছিলেন ফ্যানের টুলটা নড়ছে, অতয়েব কিছুটা ঘটঘট শব্দ হচ্ছে। কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে পাট করে দিয়ে দিয়েছিলেন টুলের পায়ার তলায়। দেখেছিলেন ঘরে খাবার জল আছে কি না। শুধু তাই নয়, পরদিন ফিরে আসার সময় তারাশঙ্কর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘ও গো শুনছ, আশাপূর্ণাকে একটা নতুন শাড়ি পরিয়ে দাও।’’ তাই শুনে আশাপূর্ণা অবাক হয়েছিলেন। তারাশঙ্কর বুঝতে পেরে বলেছিলেন বাংলাদেশের নিয়ম হল, ‘‘মেয়েরা বাপ-ভাইয়ের বাড়ি থেকে যখন শ্বশুরবাড়ি যায় তখন নতুন শাড়ি পরে যায়।’’
বরাবরই তিনি স্বভাবকোমল ছিলেন। অথচ এই নরম মনের ওপরেই একের পর এক আঘাত এসেছিল প্রায় সারাটা জীবন জুড়ে। এক বারের আঘাত তো চরম। সে বার তাঁর ছয় বছরের মেয়ে বুলু মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তাঁর হাতে একটা পয়সা ছিলনা। সেই অবস্থায় আত্মীয়ের কাছে পাঁচটা টাকা ধার চাইতে গিয়েছিলেন। মুখের ওপর ‘না’ করে দিয়েছিলেন সেই স্বজন। চোখের জল চেপে মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলেন তারাশঙ্কর।
আরেক বারের ঘটনা, জেলে থাকার সময়েই উপন্যাসের প্লট ভেবে রেখেছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর লিখে ফেলেছিলেন, ‘চৈতালি ঘূর্ণি’। কিন্তু ছাপবে কে? লিখে অতি সামান্য আয় হত। তাতে একবেলা চলত তো আরেকবেলা চলত না। তার মধ্যেই নিজের খরচে বই করে ছাপিয়েছিলেন। সে-বই বিক্রি হয়নি। একদিন নিজেই পাঠক সেজে বইয়ের দোকানে নিজের বই কিনতে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় দোকানি যখন জানতে পেরেছিলেন বইটির লেখক তিনিই, সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘মশাই আপনার বইয়ের এক কপিও বিক্রি নেই। এখুনি ঝাঁকা মুটে ডেকে দিচ্ছি, সব বই ফেরৎ নিয়ে যান।’’ সঙ্গে আরও গোটা কয় কটুবাক্য শুনিয়েছিলেন। অপমানে লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিলেন রসকলির স্রষ্টা। আরেকদিন সেই ‘চৈতালি ঘূর্ণি’রই এক দপ্তরি এসে হাজির হয়েছিলেন। এসেই তারাশঙ্করকে সকলের সামনে সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন, ‘‘ও মশাই আপনার বই বাঁধার টাকা পাই, এখুনি শোধ করুন, নয় তো গোডাউনে যত বই পড়ে রয়েছে সব ফুটপাতে হকারদের কিলো দরে বেচে দেব।’’ লজ্জায় পা কেঁপে গিয়েছিল তারাশঙ্করের। কিন্তু এই ঘটনার শেষটি অনেকটাই অন্য রকম হয়েছিল। কোথা থেকে তখনই সামনে এসে উদয় হয়েছিলেন এক ব্যক্তি। সেই সময়ের সাহিত্য জগৎ যাঁর সমালোচনার ভয়ে কাঁপত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও যিনি ছেড়ে কথা বলেননি। দোকানিকে গম্ভীর গলায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখুনি সব বই আমার দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। আর বিল করে দিন। এখুনি সব মিটিয়ে দিচ্ছি।’’ তারাশঙ্কর হতবাক হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তারাশঙ্করের দিকে চেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনার বই আমি ছাপব।’’ তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। এর পর এই দু’জনের আজীবনের বন্ধুত্ব তো আজ এক ইতিহাস।
শত্রুতা যেমন পেয়েছেন, ভালবাসার বন্ধুও পেয়েছেন তিনি। তেমনই এক বন্ধু ছিলেন আরেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। কেমন ছিল সেই বন্ধুত্ব? একবারের ঘটনা। রাতের ট্রেনে দুই বন্ধু তারাশঙ্কর আর বিভূতিভূষণ যাচ্ছিলেন দূরের এক সাহিত্যসভায়। রাতের খাবার এত বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন বিভূতিভূষণ যে, হাতমুখ না ধুয়েই সটান বার্থে শুয়ে পড়েছিলেন। নড়াচড়ার ক্ষমতাও ছিলনা। তারাশঙ্কর যখন দুজনের এঁটো গুছিয়ে হাতমুখ ধুচ্ছিলেন, বিভূতিভূষণ কাতর আবদার করেছিলেন, ‘‘ভাই আমার মুখ হাতটা একটু ধুয়ে দিবি? এত খেয়ে ফেলেছি যে আর নড়তে পারছি না।’’ তারাশঙ্কর মুচকি হেসে খুব যত্ন নিয়ে বন্ধুর এঁটো হাতমুখ ধুইয়ে, ধুতির খোট দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছিলেন। নির্বিকার বিভূতি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পাশ ফিরে।
অন্যবারের কথা। তখন তারাশঙ্কর মটরগাড়ি কিনেছিলেন। তখন তিনি সাহিত্যিক হিসেবে তো বটেই আর্থিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। আর বিভূতিভূষণ রাস্তাঘাটে যাঁকে পেয়েছিলেন, তাঁকেই তুমুল আহ্লাদ করে বলেছিলেন, ‘‘আরে শুনেছ তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে।’’ শুধু দেখা হলে নয়, পয়সা খরচ করে লোকের বাড়ি-বাড়ি গিয়েও সে-খবর দিয়েছিলেন অন্যদের। তাতে এক বন্ধু একবার একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘তারাশঙ্কর গাড়ি কিনেছে তো আপনার কী?’’ এ কথায় বিভূতিভূষণের উত্তরটা একবার শুনুন। বলেছিলেন, ‘‘আরে একটা মানুষ শুধু লিখে একটা আস্ত মটরগাড়ি কিনে ফেলেছে, এতে আনন্দ পাব না!’’ তারপরেই নিচু স্বরে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, ‘‘আর জানো আমাকে একদিন ওর গাড়িতে চাপাবেও বলেছে!’’
ভাল কিছু বন্ধু ছিল বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত লেখাটা ছাড়তে হয়নি। আর সঙ্গে ছিল তাঁর অদম্য জেদ। এক বার তাঁর প্রাণের বন্ধু যামিনী রায় বলেছিলেন, ‘‘ভায়া শবসাধনা করতে গেলে যেমন শ্মশান প্রয়োজন, ঠিক তেমনই সাহিত্য সাধনা করতে দরকার কলকাতা। লাভপুরে থেকে সাহিত্য হবে না। কলকাতা চলে আসুন।’’ বন্ধুর কথাতেই সপরিবার কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। উঠেছিলেন যামিনী রায়েরই বাড়ির গায়ে লাগানো একটি বাসায়। তাঁর আর্থিক অবস্থা তখন শোচনীয়। স্ত্রী উমাশশী শয্যাশায়ী। শুধু লেখার টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম দশা হচ্ছিল। তখন তাঁর বয়স চৌষট্টি ছুঁয়েছে। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য ওই বয়সেও শনিবারের চিঠি-তে চাকরি নিতে হয়েছিল। তাই নিয়েও সেকালের কিছু সাহিত্যিক সারাক্ষণ ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে যেতেন। যাতায়াতের খরচটুকুও বাঁচানোর জন্য রোজ হেঁটে বাড়ি-অফিস, অফিস-বাড়ি করতেন। সারাদিন অফিস সামলে বাড়ি ফিরে রাতে মাটিতে আসন পেতে কোলের ওপর একটা সুটকেস নিয়ে তার ওপর কাগজ রেখে চলত লেখালেখি। ঘরে তখন পাখা লাগানোরও সামর্থ্য ছিলনা। তখন ‘কবি’ উপন্যাসটি লিখছিলেন। নিতাই কবিয়ালের গানের কলি ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’র সঙ্গে মিল রেখে ওরই দোসর চরণ রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। পাশে বিছানায় শুয়ে ছিলেন উমাশশী। দুর্বিসহ ব্যাধিতে তখন কাতর দশা তাঁর। তারাশঙ্করের তাতেও হুঁশ ছিলনা। লিখে যেতেন মন দিয়ে। এত নির্বিকার স্বামীকে দেখে এক দিন আর সহ্য করতে পারেননি উমাশশী। চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘তুমি এমন মায়াদয়াহীন! এমন পাষাণ! আমি এই ভাবে একদিকে পড়ে আছি, কাতরাচ্ছি আর তুমি সুটকেস কোলে নিয়ে লিখেই যাচ্ছ!’’ এর পরে যেন হুঁশ ফিরেছিল তারাশঙ্করের। লেখা ফেলে সাততাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার ডাকতে।
তাঁর ছয় বছরের মেয়ে বুলু মারা গিয়েছিল চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই। আর কলকাতায় যে দিন এসেছিলেন সেইরাত্রেই বড় মেয়ে গঙ্গার এসেছিল ধুম জ্বর। তাঁর হাতে তখন মাত্র পাঁচ টাকা ছিল। স্ত্রী ভয়ে দুশ্চিন্তায় বলেছিলেন, ‘‘এখুনি ডাক্তার ডাকো।’’ তখনও গড়িমসি করছিলেন তারাশঙ্কর। হাতে যে পয়সা নেই! ডাক্তার আনবেন কি! রাত বাড়তে জ্বরও বেড়েছিল। খবর কানে গিয়েছিল যামিনী রায়ের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন তিনি। এসেই বুঝতে পেরেছিলেন পুরো অবস্থাটা ঠিক কী। নিজের ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘যাও এখুনি ডাক্তার নিয়ে এসো।’’ ডাক্তার এসেছিলেন। ওষুধ দিয়ে জ্বর কমিয়েছিলেন তিনি। প্রাণে বেঁচেছিল তাঁর মেয়ে। ডাক্তার-ওষুধের সব দাম মিটিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু-সুহৃদ যামিনী রায়। বন্ধুত্বের এই সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল, বোঝাতে একটা ব্যাপার উল্লেখ করা যেতে পারে। একটা সময়ের পরে তারাশঙ্কর যখন অনেক অনেক রোজগার করেছেন, অনায়াসে পারতেন বন্ধুর পুরনো ঋণ শোধ দিয়ে দিতে। কিন্তু জীবনে কোনও দিন সেই ধারের টাকাটুকু তাঁর যামিনীদাকে শোধ দেওয়ার সাহস পাননি তিনি। কথা তুললে বন্ধু যে তুলোধনা করতে বাদ রাখবেন না, তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি। এ নিয়ে এক বার বড় ছেলেকে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। করতে নেই।’’
কংগ্রেসের সঙ্গে তখন তাঁর তিক্ততা তুঙ্গে। নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক কংগ্রেস নেতা তাঁকে মিথ্যে এক কাণ্ডে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি শেষে এমন দাঁড়িয়েছিল যে, সত্যি কথা বলতে গেলে তাঁকে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হত। একেবারে সরাসরি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সংঘাত উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র মিথ্যে কথা বললেই সেই সংঘাত এড়ানো যায়। কিন্তু মিথ্যে তো তিনি বলবেন না। তাই সত্যিটা জানাতে একদিন দুই বন্ধুর সঙ্গে নিজেই সরাসরি উপস্থিত হয়েছিলেন নেতাজির বাড়িতে। খবর গিয়েছিল নেতাজির কাছে। শোনামাত্র অন্য মিটিং ছেড়ে চলে এসে তিনি বলেছিলেন – ‘‘আপনি তারাশঙ্করবাবু? আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা খুব প্রয়োজন।’’ জবাবে তারাশঙ্কর কথা বলবেন কি, হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন নেতাজির দিকে। ঠিক ওইসময় সামনে ছিলেন অন্য এক কংগ্রেস-কর্মী। মুখ ফসকে তিনি বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ওই হল! এবার সাহিত্যিক নিয়ে জল-খাওয়ানো মজলিশ।’’ কথাটা কানে যাওয়া মাত্র এমন বাঘের মতো গর্জে উঠেছিলেন সুভাষচন্দ্র যে, সেই ভদ্রলোক কোথায় পালাবেন বুঝতে পারেননি। সুভাষচন্দ্র নিজের কাছে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তারাশঙ্করকে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি সাক্ষী দেবেন?’’ ‘‘আজ্ঞে দেব,’’ শিরদাঁড়া সোজা করে বলেছিলেন ‘রাইকমল’-এর লেখক। পাল্টা প্রশ্ন এসেছিল – ‘‘কেন দেবেন?’’ সোজা উত্তর দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর – ‘‘কারণ মিথ্যে বলতে আমি পারব না। আমরা যারা কংগ্রেসের কর্মী, তাঁরা দেশের সেবা করব বলে এসেছি। সুভাষ বোস বা অন্য কোনও ব্যক্তির সেবা করব বলে নয়। তাই সত্যি কথাটা বলার জন্যই সাক্ষী দেব।’’ যে দুই বন্ধু তারাশঙ্করের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁরা দু’জনে দুইপাশ থেকে প্রাণপণে ইশারায় থামতে বলেছিলেন তাঁকে। কিন্তু তারাশঙ্করও ছেড়ে কথা বলার লোক ছিলেন না। গোটা ঘর নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। সকলে অপেক্ষা করছিলেন এই বুঝি আবার গর্জন করে উঠবেন নেতাজি। কিন্তু তা হয়নি। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তারাশঙ্কর পরে লিখেছিলেন, ‘‘তাঁর মুখখানা কঠিন হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য, টকটকে রঙ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু পর-মুহূর্তেই তিনি হাসলেন। প্রসন্ন হাসি। বললেন, নিশ্চয়, মানুষকে দেবতা হিসাবে সেবা করলে পুরো সাধনাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সত্যি কী ঘটেছে তা জানতে চাই,’’ বলে আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন তারাশঙ্করকে। সব শুনেছিলেন, তারপর বলেছিলেন – ‘‘আমি অকপটে আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। আমি দুঃখিত, লজ্জিত। ওই নরেনবাবুর জন্যই এইসব হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করুন এ আমি চাইনি, এ আমি চাইনি।’’ এর পর আর তারাশঙ্কর কথা বলবেন কী! বিভোর হয়ে দেখেছিলেন, নেতাজির মতো এক জন মানুষ কী নির্দ্বিধায় নিজের ভুল স্বীকার করছেন! ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ বইটি তারাশঙ্কর উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে।
আরেক বার নেতাজি’র সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল বহু বছর পর। সে বার নেতাজি কী এক দরকারে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে। খবর পেয়ে তারাশঙ্করও গিয়েছিলেন বোলপুর স্টেশনে তাঁকে দেখবেন বলে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন নেতাজিকে। আচমকাই সুভাষচন্দ্রের চোখ পড়েছিল দূরে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তারাশঙ্করের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তারপর একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি তো তারাশঙ্করবাবু।’’ আবার বিস্মিত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর। কত বছর আগে মাত্র মিনিট কুড়ির জন্য দেখা হয়েছিল। আজও তাঁর চেহারা, এমনকী নামটাও মনে রেখেছেন তিনি!
তখন মাসে নিয়মিত রোজগার ছিল চল্লিশ টাকারও কম। বড় সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছিল। এর মধ্যেই কবি সমর সেনের ঠাকুরদা ডাক্তার দীনেশ সেনের মাধ্যমে এমন এক প্রস্তাব এসেছিল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত। বোম্বাইবাসী হিমাংশু রায় ডাক পাঠিয়েছিলেন। তাঁর একজন বাঙালি গল্পকার প্রয়োজন ছিল। শুরুতে মাস মাইনে ৩৫০টাকা। প্রতিবছর একশো টাকা করে বাড়বে।অভাবের সংসারে এতগুলো টাকা! রাজি হয়ে যাওয়ারই কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি যে তারাশঙ্কর। লিখছেন, ‘‘কী ভেবেছিলাম, কোন তর্ক, কোন হিসেব সেদিন মনের মধ্যে উঠেছিল – মনে নেই, তবে এইটুকু ভুলিনি এবং কোনও দিন ভুলব না যে – আমার মন সায় দেয়নি, মনে আমি কোনও উৎসাহ অনুভব করিনি। বরং বেদনাই অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল এই যাওয়া আমার সাহিত্য সাধনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে যাওয়া হবে।’’ প্রথমে শুধু জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার মায়ের অনুমতি পেলে যাব।’’ সারা রাত মাঠে বসে ভেবেছিলেন, কী করা উচিত। ভোর রাতে শুনেছিলেন মনের ভেতর থেকে কেউ যেতে বারণ করছে। সজনীকান্তকে পরদিন সব বলেছিলেন। শুনে সজনীকান্ত প্রথমেই বলেছিলেন, ‘‘চলে যাও। এখানে থেকে কী করবে?’’ উত্তর এসেছিল – ‘‘কিন্তু আমি যে যাব না ঠিক করেছি।’’ শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শনিবারের চিঠি-র সম্পাদক। তারপর জ্বলজ্বলে চোখে হাসিমুখে বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার জয় হোক।’’ নিজের মাকেও চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। ক’দিন পর মায়ের উত্তর এসেছিল, ‘‘তুমি এমন প্রলোভন জয় করিয়াছ জানিয়া আমি পরম তৃপ্তি পাইয়াছি। সুখী হইয়াছি। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি।’’ সেই চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন দীনেশবাবুর কাছে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন – ‘‘আপনি যাবেন না?’’ তারাশঙ্কর বলেছিলেন – ‘‘না। আমার মন চাইছে না। মনে হচ্ছে সব হারিয়ে যাবে।’’ এটা শুনে দু’হাত বাড়িয়ে তারাশঙ্করকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সেই বৃদ্ধ। বলেছিলেন, ‘‘আপনার হবে বাবা …। আপনারই হবে।’’
তাঁর এমনই জেদের অন্য আরেক প্রমাণ পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন বড় মাপের একটি পুরস্কার পেয়েছেন তারাশঙ্কর। তরুণ সুনীল গিয়েছেন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে। কথায় কথায় তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস একদিনে ছেড়ে দিলুম।’’ তাই শুনে সুনীল অবাক হয়েছিলেন। সিগারেটের নেশা ছাড়া যে কী কঠিন, নেশাড়ু মাত্রই জানেন। কৌতূহলী সুনীল জিজ্ঞাসাই করেছিলেন, ‘‘এত কঠিন কাজ একদিনে করলেন কী করে?’’ কোনও কথা না বলে বাঁ-হাতখানা উঁচু করে দেখিয়েছিলেন। সুনীল শিউরে উঠে লক্ষ করেছিলেন তাঁর বাঁ হাতের কবজি থেকে শুরু করে তালু পর্যন্ত অনেকগুলো গোল গোল পোড়া-ছ্যাঁকা দাগ। জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘‘ও কী? এটা কী?’’ তারাশঙ্কর বলেছিলেন – ‘‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’’
শুধু কি জেদ? তাঁর ধৈর্যও ছিল চমকে দেওয়ার মতো। তখন ভারতবর্ষ পত্রিকায় গণদেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ার পর বই হওয়ার কাজ চলছিল। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার লেখা। সবে আশি পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছিল। প্রকাশককে একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘‘ছাপানো থামাও। লেখাতে খামতি আছে। আবার নতুন করে লিখতে হবে।’’ বাকি পুরো ন’শো পৃষ্ঠা আবার নতুন করে লিখেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
মৃত্যুকে যেন তিনি টের পাচ্ছিলেন শেষ দিকে। শরীর ভাল যাচ্ছিল না। স্ত্রী উমাশশীকে তিনি ডাকতেন বড়বৌ নামে। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিলেন তিনি। কে আগে পৃথিবী ছেড়ে যাবেন তাই নিয়ে দোলাচল কাজ করত প্রায়ই। কেবলই ভাবতেন, যে পড়ে থাকবে সে যে চূড়ান্ত একা হয়ে পড়বে। তাঁর জীবনের শেষ দিকের লেখা ডায়রিতে বারবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছে। ১৯৬৮ সালের ৮ই এপ্রিল ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘‘আজ সনতের (বড় ছেলে) ঘরে আয়নায় নিজের খালি গায়ের ছবি দেখলাম। শরীরে-মৃত্যুর হাতের স্পর্শ লেগেছে- তা বোঝা যাচ্ছে। – আসুক সমাপ্তি আসুক। খুব ক্লান্ত আমি। মৃত্যুতে কোনও আক্ষেপ তো নেই আমার। … কিন্তু আমার বড়বৌ! আমার বৌকে ছেড়ে যেতে পারব? বড়বৌ নইলে যে আমার পৃথিবী অন্ধকার। সে যে আমার জীবনকে জুড়ে রয়েছে – মাটির উপরে বয়ে যাওয়া নদীর মত।’’
তবু চলে যেতেই হয়েছিল তাঁকে। ‘জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবন’-এ! আগে একাই চলে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। বড়বৌয়ের তাঁর কাছে আসতে তখনও তেরো বছর বাকি ছিল। সুস্বাস্থের অধিকারী তিনি কোনও কালেই ছিলেন না। অল্পবয়েস থেকেই অনিয়ম, শরীরের ওপর অত্যাচারের কারণে মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শেষ দিকে সংসারটি যখন সবে একটু থিতু হয়েছে তখনই তাঁর ঘনঘন অসুস্থতা শুরু হয়েছিল। রক্তচাপের ওঠানামা, চোখের দৃষ্টি কমে আসা, নার্ভের সমস্যা, পেটের সমস্যায় ভুগেছিলেন খুব। এমনকী রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকে এমনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে ছয় বছরে ক’দিন সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন হাতে গুনে বলা যায়। যেহেতু দেশের জন্য সব রকমের কাজ করেছিলেন, তাই শেষ জীবনেও কোনও কাজে ঘেন্না বলতে কিছু ছিল না। তখন পাইকপাড়ায় নিজের বাড়ি, গাড়ি সব হয়েছিল তবু ওই বয়েসেও নিজেই অক্লেশে নর্দমায় দু’হাত ডুবিয়ে নোংরা পরিষ্কার করতেন। তারপর ভাল করে হাত ধোওয়ারও বালাই ছিল না। ওই থেকেও শরীরে রোগ জীবাণু বাস বেঁধেছিল।
সেদিন সন্ধে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। বড় ছেলের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছিলেন অনেকক্ষণ। সারাদিনে সুস্থ মানুষটা রাতেই আচমকা আবার অসুস্থ হয়েছিলেন। ডাক্তার ছুটে এসেছিলেন। ব্রেইন ফিবার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ঝাপসা হয়ে আসছিল চারদিক। অনেক চেষ্টার পরেও আজীবন লড়াই করা ‘গণদেবতা’ শেষে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্যালেন্ডারে সেদিন তারিখ ছিল ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সাল।
(তথ্যসূত্র:
১- আমার সাহিত্য জীবন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
২- তারাশঙ্কর: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য (সম্পাদিত)।
৩- আমার পিতা তারাশঙ্কর, সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত