নবজাতককে লোকে মুখে দেয় মধু। ভ্রাতুষ্পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মুখে তিনি দিয়েছিলেন ‘চা’! তিনি তখন রীতিমত নামী চিকিৎসক। ‘ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়’। সাহিত্যিক হিসেবেও কেউকেটা নাম – ‘বনফুল’!
তাঁরা ছিলেন ছ’ভাই। বলাইচাঁদ সবার বড়। ‘শ্রী অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’, যাঁকে সিনেমাজগতের লোকজন ‘ঢুলুদা’ নামেও চেনেন, ভাইদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে ছোট। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় আর বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে বয়সের ফারাক ছিল কুড়ি বছর। অরবিন্দ তাঁর বড়দাকে এমনই সম্ভ্রম করতেন যে, কোনও দিন সামনে বসে গল্প করেননি। এমনকি চা খেলেও আড়ালে খেতেন।
সময়টা ছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। তত দিনে সাহিত্যে এক নতুন স্বরের সংযোজন করেছেন লেখকটি। সেই লেখকই একটি চিঠি পেলেন। চিঠি খুলে দেখলেন, ‘তোমার এই উপন্যাসে কোনও বে-দাগ চরিত্র পেলাম না।’ চিঠি-প্রাপক ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’। চিঠিটি এসেছিল সাহিত্যিক ‘বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়’ তথা বনফুলের কাছ থেকে। চিঠি দেওয়ার সময়ে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শীর্ষেন্দুবাবুর কোনও প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। কিন্তু শীর্ষেন্দুবাবুর ‘পারাপার’ উপন্যাসটি পড়ে চিঠি দিতে কসুর করেননি বনফুল। সব সময়েই কি এমন অযাচিত ভাবে আলাপ করেন বনফুল? তা বোধহয় একেবারেই নয়। অন্তত একটি ঘটনা এর প্রমাণ দেয়।
সময়টা খানিক পিছিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
১৯৩৫ সাল। রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা ‘রামচন্দ্র শর্মা’ নামে এক ব্রাহ্মণ মন্দিরে বলি বন্ধ করতে চেয়ে কালীঘাট মন্দিরের কাছে অনশন শুরু করেছিলেন। বেশির ভাগ বাঙালিই রামচন্দ্রের এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু ‘সমর্থন’ জানিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথের এই অবস্থানের বিরোধিতায় খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র দোল সংখ্যায় একটি কবিতা লিখেছিলেন বনফুল। কবিতা পড়ে ‘রাগ’ নয়, বরং কবির সঙ্গে ‘আলাপ’ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বনফুল জানিয়েছিলেন, তিনি ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘ডাক্তার’। তাই ‘কল’, অর্থাৎ ‘নিমন্ত্রণ’ ছাড়া কোথাও যান না। শেষমেশ ‘সপরিবার’ বনফুলকে নিমন্ত্রণই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিমন্ত্রণ পেয়ে পরিবার নিয়ে বনফুল গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন। আলাপ, খাওয়াদাওয়া সবই চলছিল। আচমকা বনফুলের শিশুপুত্র চিরন্তন আধো-আধো গলায় ‘দল’ চেয়ে বসল। জল দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিচারকটি কাছাকাছি নেই তখন। তা দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘মুখে কে যেন আবীর মাখিয়ে দিলে’। কেন এমনটা? বনফুলের মনে হয়েছিল, ওই শিশুকে জল ‘চাইতে হল’, এটাই অভিজাত রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্লানির ছিল!
সেই শুরু হয়েছিল তাঁর রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের। পরে সে আলাপ গড়িয়েছিল ঘনিষ্ঠতায়। সেই ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্য পর্বে রবীন্দ্রনাথকেও এক বার বেশ ‘বিড়ম্বনায়’ ফেলেছিলেন বনফুল। ঘটনাটা ছিল এ রকম। বনফুলের ‘মানুষের মন’ গল্পটি পড়ে ভারী খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চেয়েছিলেন, অনুজ লেখককে কিছু একটা উপহার দিতে। বনফুলের ‘আবদার’ ছিল, উপহার হিসেবে গুরুদেবের গায়ে দেওয়া একটি পুরনো জামা। রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই দেবেন না। বনফুলও নাছোড়। শেষমেশ এক দিকে ‘দামি পশম’, ‘অন্য দিকে রেশম’ দেওয়া একটি প্রকাণ্ড ‘জোব্বা’ উপহার মিলেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘মতান্তর’ও ঘটেছিল তাঁর। বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’-য় কিছু কবিতা রয়েছে। সেগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত ছিল, ‘ডাক্তারের ক্লিনিকে ওরা ভান করা সৌখিন রোগী’। বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটকের কিছু অংশও রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি। বদলানোর পরামর্শ দিলেও, বনফুল তা করেননি।
আসলে লেখক বা ব্যক্তি-জীবন, যাই-ই হোক না কেন, বনফুল এমনই ‘স্বাধীনচেতা’ ছিলেন। তাঁর একরোখা চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় একেবারে ছোটবেলা থেকেই। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বনফুল’ হয়ে ওঠার ঘটনাটাও এই একরোখা চরিত্রেরই উদাহরণ।
বনফুল তখন বিহারের সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলের ছাত্র। সেই সময়ে ‘বিকাশ’ নামে হাতে লেখা পত্রিকায় কবিতা লেখালিখি চলত। পরে ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছাপা হল। সকলেই খুশি। শুধু এক জন বাদে। ‘স্কুলের হেডপণ্ডিত’ ‘রামচন্দ্র ঝা’। পণ্ডিতমশাইয়ের ধারণা ছিল, সংস্কৃতে বলাই একশো পাওয়ার যোগ্য। পাচ্ছেন না ওই কবিতার কারণে। তাই নির্দেশ এসেছিল, ‘কবিতা লেখা চলবে না’। মহা ফাঁপরে পড়ল কিশোর বনফুল। উপায় বাতলালেন অগ্রজস্থানীয় ‘সুধাংশুশেখর মজুমদার’। সেই ছদ্মনাম নেওয়া ‘বনফুল’। কিন্তু ছদ্মনামে লিখেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়েই গিয়েছিলেন পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে। ‘নির্দেশ অমান্য কেন?’ জানতে চেয়েছিলেন পণ্ডিতমশাই। বলাইয়ের জবাব ছিল, ‘না লিখে পারি না যে’! এ বার আর পণ্ডিতমশাই বাধা দেননি। তবে কয়েকটা ‘টাস্ক’ দিয়েছিলেন, কিছু সংস্কৃত শ্লোক অনুবাদ করার। ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’-তে তা ছাপাও হয়েছিল। কবিতা লিখেও অবশ্য ১৯১৮-য় বনফুল ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন প্রথম বিভাগেই, স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়ে।
কিন্তু এত কিছু নাম থাকতে ‘বনফুল’ ছদ্মনাম কেন, সে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। এ কথার জবাব নিজেই দিয়েছেন বনফুল, ‘বন চিরকালই আমার নিকট রহস্য নিকেতন। এই জন্যই বোধহয় ছদ্মনাম নির্বাচন করিবার সময় ‘‘বনফুল’’ নামটা আমি ঠিক করিলাম।’
আসলে এই ‘রহস্য নিকেতনে’র সঙ্গে বনফুলের পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই।
বনফুলের জন্ম হয়েছিল ১৯শে জুলাই, ১৮৯৯ সালে। বাবা ‘সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়’। মা ‘মৃণালিনীদেবী’। বনফুলের জন্মের সময়ে ঘোর বৃষ্টি হয়েছিল। ‘গঙ্গা’ আর ‘কোশী’ নদীতে জল বেড়েছেছিল। চিকিৎসক সত্যচরণের কর্মস্থল, নিবাস বিহারের মণিহারীর বাড়িটির অবস্থান তখন দ্বীপের মত হয়ে গিয়েছিল। বনফুলের জন্ম-সংবাদ পেয়ে সত্যচরণের বন্ধু ‘প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়’ বাড়িতে এসেছিলেন। দেখেছিলেন, মৃণালিনীদেবীর একটু জ্বর এসেছে। মুহূর্তে নিদান, চা খেতে হবে। তখন বাড়িতে চায়ের চল ছিল না। শেষমেশ ঘাটের এক রেস্তরাঁ থেকে চা পাতা এনে ঘটিতে ভিজিয়ে গ্লাসে করে চা পরিবেশন করা হয়েছিল। জন্মের পরে অজান্তেই প্রকৃতির এমন বিপর্যয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল বনফুলের।
এ পরে বড় হওয়া। বনফুল বড় হয়েছিলেন বাড়িরই এক মুসলমান মজুর চামরুর বউয়ের দুধ খেয়ে। ‘জংলিবাবু’ বনফুল হাঁটতে শিখেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন একটা ছোট্ট লাঠি। আর দুধ-মায়ের সঙ্গে টলমল পায়ে দেখা শুরু হয়েছিল মাঠঘাট, বন। পূর্বপুরুষ সূত্রেও ‘বন’-এর সঙ্গে যোগ রয়েছে বনফুলের। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি বাড়ি ছিল হুগলির শিয়াখালা গ্রামে। বাস্তুভিটের কাছে কাঁটাবন থাকায় এই পরিবার ‘কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে’ নামে পরিচিত ছিলেন। জন্ম ও পরিবেশ সূত্রে বনের সঙ্গে এমন নিবিড় যোগাযোগ প্রকৃতির নিজস্ব রূপ-রং-গন্ধের সঙ্গেও পরিচিতি ঘটিয়েছিল বনফুলের। আর তাই পরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রসমাজের মধ্যে বড় হওয়া আয়কর বিভাগের আধিকারিক প্রদ্যোৎকুমার সেনগুপ্তের সাহচর্যে পাখি দেখার চোখটাও তৈরি হতে সময় লাগে নি। এই ‘দেখা’রই ফলশ্রুতি ‘ডানা’ উপন্যাসটি।
এমন দেখার চোখ আর সাহচর্য সাহিত্যিক বনফুলকে প্রভাবিত করেছে বার বার।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় তাঁর বাবার কথা। মায়ের মৃত্যুর পরে ছেলে বনফুলের অনুরোধে সত্যচরণ জীবনচরিত লিখে রেখে গিয়েছিলেন। সেটিকে অবলম্বন করেই বনফুল লিখেছিলেন ‘উদয় অস্ত’ উপন্যাসটি। আবার শীর্ষেন্দুবাবুর উপন্যাসে ‘বে-দাগ’ (কলঙ্কহীন) চরিত্র নেই বলেছিলেন যে মানুষটি, তিনি নিজের লেখায় কিন্তু ‘বে-দাগ’ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
সম্ভবত বনফুল তখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তাঁর বেশ ভাব জমেছিল। কথা প্রসঙ্গে বনফুল তাঁকে এক দিন বলেছিলেন, ‘ইংরেজের যতই দোষ থাকুক তাহারা দুষ্টের শাসন করে।’ সেই অফিসার বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ গরিব দুষ্টদের’। নিজের কথার প্রমাণ হিসেবে সেই অফিসার দেখিয়েছিলেন, একটি প্যাকিং বাক্স। তাতে অপহৃতা এক নারীকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল, এক দেশীয় মহারাজার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এই ঘটনা স্থান পেয়েছিল ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে। মেডিক্যাল কলেজে তাঁর ছাত্রজীবন পর্বে নাগরিক-অভিজ্ঞতার ভাণ্ডটি যেন এমনই নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হতে শুরু হয়েছিল।
আর পড়াশোনা কেমন চলছিল? এ বিষয়ে ‘পরিমল গোস্বামী’র বর্ণনার উপরে নির্ভর করতে হয়। বোর্ডিংয়ে তখন একই ঘরে থাকতেন ‘বনফুল’, তাঁর দূর সম্পর্কীয় ভাই ‘সিদ্ধেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়’ আর ‘পরিমল গোস্বামী’। মেসের পরিবেশটি খাসা ছিল। তিনটি তক্তপোশ ছিল। তার তলায় ছিল কয়েকটি হাঁড়ি। তাতে ফর্মালিনে চোবানো থাকত ‘মানুষের মগজ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতি’। সব মেডিক্যাল কলেজ থেকে আনা। এ সবের আয়োজন ছিল মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র সিদ্ধেশ্বরকে পাঠ দেওয়ার জন্য। হয়তো বা নিজের পড়াশোনাটাও ঝালিয়ে নেওয়া চলত এ ভাবে। ওই মেসে উঁকি দিলে দেখা যেত, এক দিকে শতরঞ্চিতে বসে মানুষের ফুসফুস কাটা চলছে। অন্য দিকে প্রেশার কুকারে রান্না হচ্ছে মাংস!
ডাক্তারি-পাঠ পর্বেই নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন বনফুল। তেমনই এক জনের কথা অবশ্য উল্লেখ্য।
দিনটা ছিল রবিবার। বনফুল গিয়েছিলেন এক জনের বাড়ি। সেই বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা প্রশ্ন উড়ে এসেছিল, ‘দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ কবে হয়েছিল?’ নিরুত্তর ছিলেন বনফুল। তা দেখে সেই গৃহকর্তা বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের ছাত্র বলে দেশের ইতিহাস জানবে না!’ শেষমেশ ওই বাড়ির গ্রন্থাগারে বসেই ঈশানচন্দ্র ঘোষের লেখা ইতিহাসের বই পড়া শেষ করে তবে মুক্তি মিলেছিল। যাঁর সঙ্গে বনফুলের এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ‘বাংলার বাঘ’ খ্যাত ‘শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’।
এই সময়পর্বেই তাঁর আলাপ হয়েছিল ‘শিশির ভাদুড়ী’র সঙ্গেও। তিনি বনফুলকে আরব্য উপন্যাস বা কোনও সামাজিক বিষয়ে নাটক লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বনফুলের ‘শ্রীমধুসূদন’ প্রকাশের পরে ‘শিশির ভাদুড়ী’ স্বয়ং ভোরের ট্রেনে ভাগলপুর এসে জানিয়েছিলেন, ‘আপনার শ্রীমধুসূদন অভিনয় করব।’ যদিও তা হয়ে ওঠেনি। ডাক্তারি পড়ার একেবারে শেষ বছরে বনফুলকে চলে যেতে হয়েছিল পটনায়। সেখানে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হওয়ায় এই চলে যাওয়া। কিন্তু ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডে প্রশিক্ষণ ঠিক মতো হয়নি বলে তিনি গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। সেখানে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছিল।
এখানেই তাঁর আলাপ হয়েছিল এক স্কটিশ নার্সের সঙ্গে। কবি ও স্বদেশি জামাকাপড় পরিহিত ‘স্টুডেন্ট মুখার্জি’–কে বেশ পছন্দই করেছিলেন সেই নার্স। আলাপ গড়াতেই আবদার এসেছিল, একটি ইংরেজি কবিতা লিখে দিতে হবে। বেঙ্গালুরু থেকে আসার আগে বনফুল লিখেও দিয়েছিলেন কবিতাটি। পরে যা ‘ডানা’ উপন্যাসে ব্যবহার করেছিলেন বনফুল। পটনার প্রিন্স অফ ওয়েলস মেডিক্যাল কলেজে বনফুল ফেরার পরে সেই নার্স একটি চিঠি দিয়েছিলেন বনফুলকে।
তার পরে আর আলাপ অবশ্য গড়ায় নি। ডাক্তারির ফাইনাল পরীক্ষার আগেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। ইতিমধ্যে তখন রমরমিয়ে ‘প্রবাসী, ‘ভারতী’, কল্লোল’ পত্রিকায় লেখাও ছাপা হচ্ছিল তাঁর। পাত্রী ছিলেন ‘শ্রীমতী লীলাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়’। নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে স্বয়ং ‘মা সারদার তত্ত্বাবধানে’ বড় হয়েছিলেন ‘লীলাবতী’। বিয়ের পরে পড়াশোনা শেষ করার জন্য লীলাবতীদেবী বেথুন হস্টেলে থাকতেন। আর নববধূকে উদ্দেশ্য করে নানা চিঠি, কবিতা লিখতেন বনফুল। তার সেই চিঠিগুলোর কয়েকটি নিয়ে ‘কষ্টিপাথর’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল।
ডাক্তারি পাশের পরে কর্মজীবনে ফের দেখা গিয়েছিল ‘স্বাধীনচেতা’ বনফুলকে।
পটনা মেডিক্যাল কলেজে হাউস সার্জেনের কাজ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার দিনেই বনফুল দেখেছিলেন, হাসপাতালের নিয়মের প্রথমটিতেই লেখা রয়েছে – ‘সালাম’ দিতে হবে সিনিয়রদের। এই নিয়ম দেখেই বনফুল ‘গুডবাই’ বলে সটান বেরিয়ে এসেছিলেন।
এরপরে ঠিক করেছিলেন ‘প্যাথলজিতে ট্রেনিং’ নিয়ে স্বাধীন ভাবে পশরা জমাবেন। ‘চারুব্রত রায়ের তত্ত্বাবধানে’ পাঠ নিয়ে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন ‘আজিমগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে’। সেখানে থাকাকালীনই বনফুলের প্রথম সন্তান ‘কেয়া’র জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বেশি দিন থাকা হয়নি আজিমগঞ্জের নিশ্চিন্ত চাকরিতেও। রাজনীতির নানা কূটকচালি থেকে দূরে সরে যেতে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর পরে ভাগলপুরে ল্যাবরেটরি খুলেছিলেন। সেখানেও দেখা গিয়েছিল ‘মেজাজি’ বনফুলকে। গল্পটা পরে বিভিন্ন পত্রিকায় শুনিয়েছিলেন বনফুলের ছোট ভাই, পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছিলেন, একবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্ত্রীর ইউরিন নিয়ে এসেছিলেন, বনফুলের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করাবেন বলে। এসেই হাকিমি মেজাজে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন। মুহূর্তে সেই বোতল-ভর্তি ইউরিন নর্দমায় ফেলে দিয়েছিলেন বনফুল। ল্যাবরেটরি থেকে বার করে দিয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটকে।
বাড়িতেও এমনই ‘রাগী’, ‘চটা মেজাজ’ ছিল বনফুলের। তবে প্রায়ই ‘জব্দ’ হতেন স্ত্রীর কাছে। প্রায়ই দেখা যেত, রেগে গেলে বনফুল হাতের কাছে থাকা জিনিসপত্র ভাঙচুর করছেন। এক বার তেমনই রাগের বশে ছ’খানা কাঁচের প্লেট ভাঙার পরে তবে তাঁর রাগ কমেছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে শীতল গলায় লীলাবতীর হুকুম এসেছিল, ‘কালকে যাবে, আবার নিয়ে আসবে।’
স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই এমন ঝগড়া হত। ঝগড়ার অন্যতম কারণ ছিল, বনফুলের বিপুল ‘খাদ্যপ্রেম’। তাঁর খাওয়া নিয়ে নানা গল্পও প্রচলিত।
গল্পটা সংবাদমাধ্যমে শুনিয়েছিলেন ‘সজনীকান্ত দাসের ছেলে’ ‘রঞ্জনকুমার দাস’। এক গুণমুগ্ধ ভক্তের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এসেছিল। ‘বলাইকাকা’র সঙ্গী হয়েছিলেন রঞ্জনবাবু। গন্তব্যের কাছাকাছি, এক জায়গায় একটি দোকানে বনফুল দেখেছিলেন, ফাউল কাটলেট ভাজা হচ্ছে। তা সেই ভক্তের বাড়িতে ঢুকেছিলেন দু’জনে। গল্প চলছিল তো চলছিলই। অবশেষে পরিচারক চায়ের পেয়ালা আর সঙ্গে করে দু’টি প্লেটে নোনতা বিস্কুট নিয়ে হাজির হয়েছিল। আর তা দেখেই আগুনে ঘি পড়েছিল যেন। বনফুল চিৎকার করে উঠে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ব্যাপার কী বলো তো! … অতিথি আপ্যায়ন দু’খানা বিস্কুট দিয়ে!’ সঙ্গে সংযোজন করেছিলেন, ওই ফাউল কাটলেট যেন খানকতক আনা হয়। আনা হয়েছিল কাটলেট। আর কাটলেট দেখেই তাঁর রাগ গলে জল হয়েছিল।
বনফুলের খাদ্যরসের প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়েছেন তাঁর ছোট ভাই পরিচালক ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’ ও ভ্রাতুষ্পুত্র ‘অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়’। ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’ জানিয়েছিলেন – রাতে মাংস, দিনে দু’রকম মাছ না হলে তাঁর দাদার চলত না। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির মেথর সীতাবীর মেয়ের বিয়েতে মেথরপল্লিতে গিয়ে তাঁর মোটা পুরি, ছোলার ডাল, শুয়োরের মাংস, টক দই আর বোঁদে খাওয়ারও অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছিলেন ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’। আর ‘অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়’ জানিয়েছিলেন, বনফুলের উপন্যাস নিয়ে তৈরি মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’-এর শুটিং চলাকালীন উৎপল দত্তের টিফিন বাক্সে করে বনফুলের প্রিয় কষা মাংস নিয়ে আসার কথা। এমনকি এটাও জানা যায়, বনফুলের কাছে ‘হাটে বাজারে’-র অশোককুমারও সাতসকালে নিজের রান্না করা মাংস নিয়ে হাজির হতেন।
এই দু’টি ছাড়া বনফুলের অন্য আর যে বইগুলি অবলম্বনে সিনেমা হয়েছিল, তার অন্যতম ‘অগ্নীশ্বর’। পরিচালক ছিলেন তাঁরই ছোট ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় এই সিনেমা সংক্রান্ত একটি ঘটনার কথা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন।
‘অগ্নীশ্বর’ সিনেমার একটি ‘শো’ হচ্ছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয়। পরিচালক, উত্তমকুমার, সকলেই ছিলেন। মহানায়ক একটু ভয়েই ছিলেন, কে জানে কাহিনীকার কী বলবেন এই ভেবে। ‘শো’ শেষ হয়েছিল। কিন্তু বনফুলের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। উত্তমকুমারও উসখুস করছিলেন। তা দেখে তাঁর ভাই তথা পরিচালক শেষে বলেছিলেন, ‘উত্তম কেমন করেছে, বলবে তো!’ এ বার আর প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নেন নি বনফুল। মুখে চওড়া হাসি এনে মহানায়কের কাঁধে হাত রেখে বনফুল বলেছিলেন, ‘অপূর্ব! অগ্নীশ্বরের ব্যক্তিত্বকে তুমি সুন্দর ফুটিয়েছ।’
খাওয়াদাওয়া এবং খাওয়ানো, দু’টিতেই বনফুলের জুড়ি মেলা ভার ছিল। তবে এমন খাদ্যপ্রেমে উৎসাহ বনফুল রবীন্দ্রনাথের থেকে পেয়েছিলেন কি না, তা অবশ্য জানা যায় না। তবে রবীন্দ্রনাথের জলখাবারের সাক্ষী ছিলেন তিনি।
সময়টা ছিল ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাস। বেশ ঠান্ডা পড়েছিল শান্তিনিকেতনে। ভোররাতে শান্তিনিকেতন এসেছিলেন বনফুল। তখনই ‘শ্যামলী’ বাড়ি থেকে হড়াস হড়াস করে জল ঢালার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। কী ব্যাপার? পরিচারক নীলমণির কাছে জানতে চেয়েছিলেন বনফুল। নীলমণির উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাবামশাই চান করছেন।’ স্নান থেকে বেরিয়ে জলখাবারের আয়োজন থাকত রবীন্দ্রনাথের জন্য। তালিকাটি ভালই ছিল। মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা ভেজানো। গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে ডিম সিদ্ধ। সঙ্গত দিত অস্ট্রেলিয়া থেকে আনানো মধু দিয়ে মাখানো পাঁউরুটি, ফল। সব শেষে এক খাবলা মুড়ি আর চিনি দেওয়া কফি! কে জানে বিপুল খাদ্যরসিক বনফুলও হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন কি না এই তালিকা দেখে।
তবে খাদ্যপ্রেমের কারণে বিড়ম্বনার মুখেও পড়তে হয়েছিল ‘হাই ব্লাড সুগারের রোগী’ বনফুলকে। একবার বনফুলের বড় ছেলে অসীম আর রঞ্জনকুমার দাস (সজনীকান্ত দাসের ছেলে) গিয়েছিলেন সাহিত্যিকের ভাগলপুরের বাড়িতে। বাড়ি পৌঁছতে সামান্য দেরি হয়েছিল দু’জনের। কিন্তু বাড়িতে পা দিতেই অবাক হয়েছিলেন দু’জন। কারণ, তাঁরা দরজা থেকেই শুনেছিলেন স্বামী-স্ত্রী’র তুমুল ঝগড়া। আসলে এর কারণ ছিল, ছেলেরা আসবে বলে লীলাবতী দু’টি আস্ত ইলিশের রোস্ট, মাংসের কোর্মা, ক্ষীর তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ছেলেদের পৌঁছতে দেরি হচ্ছে দেখে ততক্ষণে একটি গোটা ইলিশ, কোর্মার অর্ধেকটা ও ক্ষীর বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলেছিলেন বনফুল। স্ত্রী’র নির্দেশে ফের থলি হাতে বার হতে হয়েছিল বনফুলকে।
স্ত্রী ‘লী’-র সংসারে এ ভাবেই ‘সম্মানিত অতিথি’র দাম্পত্য-জীবন কাটিয়েছিলেন বনফুল। সেই সংসার-জীবন সাজানো ছিল একাধিক ভাড়াবাড়ি, ভাগলপুরের আমোদপুর মহল্লায় কেনা বাড়ি ‘গোলকুঠি’র চৌহদ্দিতে। এই সুখী দম্পতির চার সন্তান – ‘কেয়া’, ‘অসীম’, ‘চিরন্তন’ ও ‘করবী’।
শেষমেশ অবশ্য ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে বনফুলের সংসার উঠে এসেছিল কলকাতায়, লেকটাউনে। এই চলে আসার দিনটার কথা জানা যায় পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ‘সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষালের’ অভিজ্ঞতা থেকে। দিনটা ছিল ১৯৬৮ সালের ১৬ই জুন। ভাগলপুর স্টেশনে উপচে পড়েছিল ভিড়। স্টেশন মাস্টার নিজে প্রথম শ্রেণির প্রতীক্ষালয় থেকে চেয়ার আনিয়েছিলেন, বনফুল অপেক্ষা করবেন বলে। ভিড়ের মধ্য থেকে এক জন বলে উঠেছিলেন, ‘বাড়িটা বিক্রি না করলেই পারতেন। ভাগলপুরের সঙ্গে সম্পর্ক তা হলে বজায় থাকত।’ মুহূর্তে পাশে থাকা এক মারোয়াড়ি ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘এখন সে বাড়ি রইল না, ভাগলপুরে সব বাড়িই ওঁর বাড়ি হয়ে গেল। যখন খুশি আসবেন, যেখানে খুশি উঠবেন।’
পারিবারিক জীবনে ‘মিতব্যয়ী’ ছিলেন না বনফুল। তবে সময়-সুযোগ বুঝে ছেলেমেয়েদের গল্প শোনানোয় কোনও কসুর ছিল না বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর। ছোট ছেলে চিরন্তনের স্মৃতিতে রয়েছে বাবার একটি মজার স্বভাবের কথা। বনফুল বাড়িতে পর্দা টাঙানো একেবারেই পছন্দ করতেন না। তার কারণ হিসেবে বনফুলের যুক্তি ছিল, ‘আমরা তো জামাকাপড় পরেই বসে রয়েছি!’
কিন্তু আপাত-উদাসীন এই মানুষটিকেই আবার দেখা যায় ছোট মেয়ে করবীর জন্য পাত্র খুঁজতেও। করবীদেবীর বিয়ে হয় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাজলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
কিন্তু ডাক্তারি জীবন হোক বা পারিবারিক জীবন, সেগুলি সবই বনফুলের সাহিত্যিক সত্তার এক-একটি অঙ্গ বোধহয়। আর তাই মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজার বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেন ‘কন্যাসু’। একটা সময় বাড়ি কিনতে গিয়ে ঋণ শোধ করার জন্য ভোররাতে উঠে লেখালেখি করতে হয়েছিল বনফুলকে।
তবে কোনও দিনই ফরমায়েশি লেখায় কলম সরেনি বনফুলের। এক বার পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক খ্যাতনামা চিকিৎসক তথা ভারতের বিশিষ্ট এক রাজনীতিবিদ দেশের কোনও জরুরি সমস্যা বা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করা যাবে, এমন কোনও বিষয় নিয়ে নাটক লিখতে বলেছিলেন বনফুলকে। যদিও তা তিনি লিখতে পারেননি। অনুরোধটা করেছিলেন ‘বিধানচন্দ্র রায়’।
তবে রাজনীতির প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন এ কথা বলা চলে, বনফুল প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে কোনও দিন জড়াননি। যদিও রাজনীতি তাঁর সৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছিল। বিশ্বযুদ্ধ, সুভাষচন্দ্র বসুর কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার মতো নানা ঘটনা সামাজিক ক্ষেত্রকে এক সময় নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ের প্রভাব রয়েছে তাঁর ‘অঙ্গারপর্ণী’ কবিতা সংগ্রহে। আবার অগস্ট আন্দোলনের ছায়া দেখা যায় তাঁর কবিতা সঙ্কলন ‘আহবনীয়’-তে। পরে ‘অগ্নি’ উপন্যাসেও রাজনীতির প্রভাব দেখা যায়।
বনফুলের সাহিত্যে রাজনীতি দেখে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেছিলেন বনফুলের ‘পলিটিক্স্’-এর দিকে ঝোঁক আছে কি না। ‘নেই’ শুনে কবির স্বগতোক্তি ছিল, ‘সাহিত্যিক পলিটিকস করলে পলিটিকসও হয় না, সাহিত্যও মার খায়। আমি পলিটিকস করতে গিয়ে ঘা খেয়েছি।’ রবীন্দ্রনাথ এ ভাবেই বনফুলের কাছে নিজের নানা কথা জানিয়েছিলেন, নিজস্ব ভঙ্গিতে। এই রবীন্দ্রনাথই আবার চিঠিতে ‘নির্মোক’ উপন্যাসের প্লট দিয়েছিলেন বনফুলকে। যদিও এর মধ্যে আজিমগঞ্জের হাসপাতালে কিছু দিন থাকার অভিজ্ঞতারও মিশেল দিয়েছিলেন বনফুল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বনফুলের জাগতিক সম্পর্কের শেষ হয়েছিল, ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। রেডিয়োয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল ‘সমস্ত দেশের বুক ফাটা হাহাকার’, মহাকবির প্রয়াণ-সংবাদ। এই প্রয়াণ নাড়িয়ে দিয়েছিল বনফুলকেও। কবির উদ্দেশে কবিতায় প্রশ্ন রেখেছিলেন তাঁর স্নেহধন্য বনফুল, ‘আবন্ধনলোকে তুমি লভিবে নির্বাণ?’
কিন্তু এই জিজ্ঞাসা শুধু কি রবীন্দ্রনাথকেই ছিল? না কি বনফুলের নিজেকেও।
তাঁর জন্মই হয়েছিল বাংলার বাইরে। বিহারের পূর্ণিয়া জেলা, মণিহারি গ্রাম। সাহেবগঞ্জের স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, হাজারিবাগের কলেজ থেকে আই এসসি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়া আর প্যাথলজিতে শিক্ষানবিশির সময়টুকুই যা বাংলায় থাকা। ১৯২৭-এ বিয়ে, সংসার পাতা; আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে চাকরি। তার দু’বছর পর ভাগলপুরে ল্যাবরেটরি খুলে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করছেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তথা বনফুল।
বাংলার বাইরেই তাঁর ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যজীবনেরও শুরু; বনফুলের ছেলে অসীমকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘… প্রায় ৩৩ বছর বয়স থেকে নিয়মিত সাহিত্যচর্চা শুরু করলেও ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি অতি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। তাঁর চল্লিশতম জন্মদিনে তাঁকে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানানোর জন্য ভাগলপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এক সভা আহ্বান করা হয়। কলকাতা থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মানপত্র দেওয়া হয়।’ মানপত্র নিয়ে ভাগলপুর এসেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’-র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। রেশমি কাপড়ে ছাপিয়ে চমৎকার কায়দায় বাঁধিয়ে নেওয়া সেই মানপত্রে স্বাক্ষর ছিল ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।
অসীমকুমারের লেখা শুধু ছেলের চোখে দেখা বাবার অন্তরঙ্গ ও পারিবারিক জীবনচিত্রই নয়, লেখক বনফুলের অজস্র সাহিত্য-মুহূর্তেরও সাক্ষী। আর তার প্রায় সবটাই ঘটছে কলকাতা থেকে দূরে, ভাগলপুরে বনফুলের কেনা বিখ্যাত ‘গোলকুঠি’ বা অন্য ভাড়াবাড়িতে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বেরিয়েছে বনফুলের ‘কবয়ঃ’ নাটিকা, সন্ধের পর মুন্নিচকের ভাড়াবাড়ির উঠোনে চৌকিতে একটা বাল্ব লাগিয়ে তিনি সেই নাটক পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁর সন্তানদের – তাঁদের বয়স তখন নয়, ছয়, আর চার! আর এক ভাড়াবাড়িতে এক সন্ধেয় ফিটন গাড়ি চেপে এসেছেন বন্ধু প্রবোধেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সে দিন দুপুরেই লেখা একটা গল্প বন্ধুকে শোনালেন বনফুল।
বন্ধুই প্রথম শ্রোতা বিখ্যাত সেই গল্পের – ‘নিমগাছ’! সারা দিন ল্যাবরেটরিতে প্র্যাকটিস করেন, আর লেখেন রাত জেগে, বা ভোরে উঠে। পাখি দেখার নেশা ছিল। মাইলের পর মাইল হাঁটতেন, বাইনোকুলার হাতে ঘুরতেন ভাগলপুরের গঙ্গার চরে, হাতে সেলিম আলির বই। এক দিন গাছের ডালে পাতার সঙ্গে মিশে থাকা একটা বসন্তবৌরি পাখি দেখতে ঘণ্টাখানেক হেঁটেছিলেন। ‘বার্ডওয়াচিং’-এর এই নেশাই লিখিয়ে নিয়েছিল ‘ডানা’ নামের উপন্যাস। তখন ভাগলপুরের ঘর ভরে থাকত পাখি বিষয়ক বইয়ে। ‘স্থাবর’ লেখার সময় একই ভাবে লাইব্রেরি ভর্তি নৃতত্ত্বের বই। লেখার টেবিলের উপরে ছোট ট্রে-তে থাকত নানান সুগন্ধি আতরের শিশি। লিখতে লিখতে কখনও শিশির ছিপি খুলে ঘ্রাণ নিতেন। গোলকুঠির বাড়ি তাঁর খুব শখের, প্রাঙ্গণে বেল, কাঁঠাল, আলফানসো আর হিমসাগর আম, তাল, নিম, পেয়ারার সঙ্গে শিউলি-গন্ধরাজ-কুন্দ-রক্তকরবীর গলাগলি। পাশের খাপরার ছাদের ঘরে কাঠের সিলিং লাগিয়েছিলেন, সেখানে ছিল একটা রিভলভিং বুকশেল্ফও! তেইশ বছর এই ঘরে ছিলেন, দুই দশক ব্যাপী বনফুলের সব লেখার ঠিকানা কলকাতা থেকে অনেক দূরের সেই বাড়িই!
বনফুলের সংসারে তাঁর লীলাবতী দেবী ছিলেন ছায়ার মত। কঠিন রোগভোগের পর ১৯৭৬ সালে তিনি যখন চিরকালের জন্য চলে গেলেন, তারপরে বনফুল খুব ‘একা’ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখলে সকলেরই খুব কষ্ট হত সেই সময়টায়। শেষ বয়সে বহুকালের সঙ্গীকে হারিয়ে তিনি তখন মনে মনে একেবারে নিঃস্ব হয়েছিলেন! এই একাকী জীবন অবশ্য দীর্ঘকাল সইতে হয়নি তাঁকে। ১৯৭৯ সালের শ্রীপঞ্চমী। সকালের জলখাবার খেয়ে বিছানা ছেড়ে টেবিলে বসতে গিয়ে হঠাৎই চলচ্ছক্তিহীন হয়েছিলেন বনফুল। ন’দিন যমে-মানুষে টানাটানি চলেছিল। অবশেষে এসেছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ। সব থেমে গিয়েছিল। প্রাণের মানুষ লীলার কাছে লীন হবেন বলে অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বনফুল …
মৃত্যুর আগে লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস ‘হরিশচন্দ্র’-তে হয়তো তাই আপন ‘মর্জিমহল’-এর বাসিন্দা বনফুল বাঙালিকে বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি আর ফিরব না। তোমরা যন্ত্র সভ্যতার বিলাসে সুখে থাক।’
(তথ্যসূত্র:
১- বনফুল: জীবন মন ও সাহিত্য, ড. ঊর্মি নন্দী, করুণা প্রকাশনী (১৯৯৭)।
২- বর্ণময় বনফুল, শ্রাবণী পাল, অক্ষর প্রকাশনী (২০১৫)।
৩- কিংবদন্তি বনফুল, অসীম কুমার মুখোপাধ্যায়, একুশ শতক (২০১১)।
৪- বাংলা ছোটগল্পের তিন নক্ষত্র: বনফুল-প্রেমেন্দ্র মিত্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীতল চৌধুরী, প্রজ্ঞা বিকাশ (২০০৯)।
৫- ১৮ই মার্চ ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত